সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তনুশ্রী পাল: গ্রন্থজগত: নৃত্য: প্রতিমা দেবী

 

'নৃত্য'
প্রতিমা দেবী
 আলোচক: তনুশ্রী পাল




মহাবিশ্ব আবর্তিত  হয় নিজস্ব নিয়মে,ছন্দে। তাতেই পূর্বাপর যথানিয়মে জগৎ সংসার চলমান  থাকে, এই সহজ কথাটি সক্কলেরই জানা। কিন্তু সেই নিয়মিত ছন্দ ভঙ্গ হলে সানন্দ আগামীর স্বপ্ন কোন অদৃশ্যলোকে বিলীন হয়! বিষণ্ন হই।
আজ নৃত্য নিয়ে লিখতে চেয়ে উপরোক্ত কথাগুলো মনে হল! 
নৃত্যকলা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রজ্ঞাবতী প্রতিমা দেবীর রচনার কিছু অংশ উল্লেখ করি-
"বিশ্বজগতের মর্মে যে অনাদি চাঞ্চল্য,অস্তিত্বের যে অসীম আবেগ, তাই মিলল এসে পাখির দেহের ছন্দে,মিলল তার প্রাণের আবেগ-বনরঙ্গভূমিতে তার থেকে দেখা দিল নাচ। আদিম কালে মানুষের অপরিণত মনের প্রকাশ-চেষ্টা ভাষার আঙ্গিক তখনো গড়ে তুলতে পারে নি, বিশ্বপ্রকৃতির থেকে আদিম চাঞ্চল্যের প্রেরণা পেয়েছে আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। পাখির ভাষার সঙ্গে মিল করে মানুষের এই প্রথম ভাষা। ছন্দের স্বাভাবিক আনন্দ মানুষ পেয়েছে বিশ্বজগতের দোলা খেয়ে, তার সঙ্গে মিশেছে সুখ-দুঃখ-বিরাগ-অনুরাগে হৃদয়ের দোলা,এই আন্দোলনে সাহিত্যের পূর্বেই নৃত্য হয়ে উঠেছে তার ভাষার বাহন।...আর্ট মাত্রেই একটি গভীর রহস্যের আন্দোলন আছে। কেননা আমরা স্পষ্ট করে  জানি না সে কী বলছে। যে ভাবার্থ ভাষার আনুষঙ্গিক, শিল্পে তার স্থান থাকার প্রয়োজন নেই। শিল্পের সার্থকতা অব্যবহিতভাবে তার নিজের মধ্যেই। যার কল্পনার মধ্যে সে সাড়া পেল সেই জানলে তার মূল্য। যার কল্পনাকে সে স্পর্শ করল না, তার কাছে সে চিরকালই সংসারের অসংগত পদার্থের মধ্যে নির্বাসিত।নৃত্যকলাতেও সবসময় তথ্যের বা যুক্তির মূল্য না থাকতেও পারে। অর্থাৎ, তার সঙ্গে তথ্যের যোগ থাকলেও যেটা গৌণ। তার ভঙ্গি একটি বিশ্বছন্দকে দেহের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত করে, যার অনির্বচনীয় বেদনা মানুষের মনকে চিরকাল নাড়া দিয়ে আসছে।যেমন ফুল ফোটা বা চারাগাছের পরিণতির মূল প্রকৃতি তার নিজের নিগূঢ় গতিবেগের অনুসরণ করে, নৃত্যকলাও সেই রকম অপরিমেয় গতির ছন্দকে রূপ দিচ্ছে ইঙ্গিতমূলক মুদ্রাতে, তাই তার ভাষা সাহিত্য বা চিত্রের ভাষা নয়।...সাহিত্য যেমন ভাষার যোগে আত্মপ্রকাশ করে, ছবি যেমন রং ও রেখার ভিতর নিজেকে ধরা দেয়, নৃত্যকলাও সেই রকম সুর ও তালের যোগে স্বরূপ নেয়।...নৃত্য দেহের ভঙ্গিতে ছন্দোবদ্ধ করে পূরবীর বিদায়-ব্যথা, সাহানার করুণ আনন্দ, আর ভৈরবীর অনির্দিষ্ট সুদূরের আহ্বান। যে যত বড়ো রূপকার সে তত গভীরভাবেই সেই অসীম ছন্দকে দেহের রেখার মধ্যে ধরতে পারে। এ যেন নি:শব্দ রেখার কবিতা,রেখাই তার ভাষা,দেহের একটুখানি মোচড় যে মীড় লাগায় দর্শকের মনে, সেই মীড়ের মধ্যে নৃত্যরসিকের সৌন্দর্যবোধ দানা বেঁধে ওঠে, আন্দোলিত করে রসপিপাসুর চিত্ত কখনো বিষাদে কখনো বা আনন্দ-অনুরাগ"
প্রতিমা দেবী ছিলেন শিল্পী পরিবারের কন্যা। আর পুত্রবধূকে সর্বতোভাবে শিক্ষিত করার বাসনা রবীন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল। শিল্পপ্রতিভার স্ফুরণ আমরা তাঁর মধ্যে দেখেছি নানাভাবে। তাঁর শিল্প শিক্ষার গুরু ছিলেন  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু। ১৯২৪ সালে প্যারিসে আদ্রে কার্পেলসের তত্ত্বাবধানে  প্রতিমা শেখেন পটারি বা মৃৎশিল্পের কাজ। আর ইটালিয় পদ্ধতিতে ফ্রেস্কো রচনার কাজ। পরবর্তীকালে সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে। যাইহোক সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত যাচ্ছি না। শিল্পকলার মতো নৃত্য, নাট্যাভিনয়, মঞ্চসজ্জা, নাটকের পাত্রপাত্রীদের রূপসজ্জার ক্ষেত্রেও প্রতিমা দেবীর স্বকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে। বারবার বিদেশ ভ্রমণের ফলে বিভিন্ন ধরনের নৃত্য পদ্ধতি সম্বন্ধে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয়  করেছিলেন। ১৯১২ সালে লন্ডনে রাশিয়ান নৃত্যনাট্যে পাভলোভার নাচ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ডেভনশায়ারে লেওনার্ড এলমহারস্টের ডার্টিংটন স্কুলে জার্মানির সুবিখ্যাত নর্তক লাবাসের শিষ্য মিস্টার ইয়সের নৃত্যশালায় উপস্থিত থেকে প্রতিমা দেবী ইউরোপীয় নৃত্যকলা সযত্নে অনুধাবন করেন। তাঁর সেই অনুশীলনের ফলে শান্তিনিকেতনে অভিনীত রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যগুলি বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। নৃত্যনাট্য পরিচালনা ও প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ প্রতিমাদেবীর কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিষ্যা প্রতিমা যেমন সনিষ্ঠতায় শিল্প, সংগীত, নৃত্যনাট্যের অনুশীলন করেছেন, সাহিত্যচর্চা তেমনভাবে করলে বাংলাসাহিত্যের উপকারই হত। মাত্র চারখানি বই আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। বইগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় কেন তিনি আরও বেশি লিখলেন না! তাঁর সহজ সাবলীল অপরূপ ভাষা পাঠক মনকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে।
প্রতিমা দেবীর 'নৃত্য' গ্রন্থটি বিশ্বভারতী প্রকাশনা থেকে ২৫শে বৈশাখ,১৩৫৬(১৯৪৯) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবিটি রবীন্দ্রনাথের আঁকা এ ছাড়াও কবিকৃত আরও পাঁচটি ছবি এই ছোট্ট বইটিতে সংযোজিত হয়েছে। আর লেখিকা বইটি উৎসর্গ করেছেন আপন মাতুল শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা এবং চণ্ডালিকা দুটি নৃত্যনাট্য বিষয়ক গভীর আলোচনা ও নৃত্যরস নামক আরও একটি মৌলিক রচনা নিয়েই 'নৃত্য'গ্রন্থটির নির্মাণ। মহামূল্যবান এই ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থটিতে নৃত্য বিষয়ক আলোচনা তো আছেই সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনৃত্য নির্মাণের পর্ব থেকে পর্বান্তরের ইতিহাসও বিধৃত হয়েছে; প্রকাশ পেয়েছে নৃত্য বিষয়ে লেখিকার নিজস্ব দর্শন, গভীর ভালবাসা ও মৌলিক চিন্তাভাবনার কথাও।



                                                              তনুশ্রী পাল

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ