সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তন্ময় ধর :প্রবন্ধ:নারীশরীরং

 


                                           নারীশরীরং 

  

 

যে কোন যুদ্ধ, আন্দোলন, অবক্ষয়ের প্রথম আঘাত লাগে নারী শরীরের ওপর। আর দীর্ঘস্থায়ী অসুখের ক্ষত আর যন্ত্রণাও লেগে থাকে সেই নারী শরীরের ওপরেই। আমাদের মহাকাব্যে সীতাশরীরের উপর যুদ্ধ হয়, যুদ্ধশেষে অগ্নিপরীক্ষার দহনে, পরিত্যাগে, ধরিত্রীগ্রাসে তাঁর শরীর হারিয়ে যায়। রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পর যুদ্ধ হয়, এবং যুদ্ধশেষে মহাপ্রস্থানের পথে তাঁর শরীরের পতন হয়। কোথাও নারীর শরীরের প্রয়োজনীয়তার বাইরে উত্তরণ ঘটানো যায় না। ট্রয়যুদ্ধ শেষে হেলেনের শরীরও সৎপুত্রদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে দূর দ্বীপরাষ্ট্রের শাসকের হাতে বিনষ্ট হয়।  

প্রাচীন যুগ থাক, মধ্যযুগ থাক, শুধু গত তিন দশকের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাকানো যাক। ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডার গণহত্যার সময় মাত্র ১০০ দিনে প্রায় ৫,০০,০০০ নারীধর্ষণ হয়। ১৯৯২ থেকে শুরু হওয়া সিয়েরা লিওনের ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে প্রায় ২,৫৭,০০০ নারী ধর্ষণ হয়। বলকান অঞ্চলে সার্বিয়া-বসনিয়ার গৃহযুদ্ধে অন্তত ৫০০০০ নারীধর্ষণ হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অন্তত ৬০০০ থেকে ২৮০০০ বলাৎকার ঘটে। উত্তর ইরাকে আইসিস জঙ্গিগোষ্ঠী অন্তত ১০,০০০ থেকে ৬০,০০০ নারীধর্ষণ নিয়মিত এবং পুনরাবৃত্তভাবে ঘটিয়েছে। এগুলো আমাদের কাছে নিছকই সংখ্যামাত্র। সংবাদপত্রের উপেক্ষিত কোণের এইসব খবর আমরা অস্পষ্ট চোখে উপেক্ষা করেছি। সংখ্যাগুলির আগেপ্রায়’, ‘অন্তত’, ‘আনুমানিকইত্যাদি শব্দ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত সংখ্যার তারতম্য বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পৃথিবীর কেউই তেমন গুরুত্ব দেয় নি ওইসব নির্যাতনে। ঘরের মানুষ থেকে দূরের জনদরদী সংস্থা সবাই নির্লিপ্ত, স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এখন। ওই মুক্তিযুদ্ধে অন্তত ৪০০০০০ নারীধর্ষণ ঘটেছিল। পৈশাচিক, নারকীয়, নৃশংসতম ওইসব ঘটনার যে সামান্যতম প্রমাণ এখনো কিছু বইপত্রে, গবেষণাপত্রে, সংগ্রহালয়ে রয়ে গিয়েছে, উদাসীন বাঙালি হয়ত তাও খুব শীঘ্র পুড়িয়ে ফেলবে। এই উদাসীনতা অজ্ঞানকৃত নয়, ছদ্ম পরিকল্পিত। 

কেন নারীদেহের প্রতি এমন উদাসীনতা, হিংসা এবং ভোগদৃষ্টির এমন ত্রিচারিতা? এর ইতিহাস একটু গভীর। সংহত কৃষিকর্মের ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, যখন আধিপত্যলাভের জন্য যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হয়, যুদ্ধের গৌরবগাথা লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে, তখন থেকেই আস্তে আস্তে মাতৃদেহের প্রতি অবমাননা শুরু হয়। বিদূষী মার্লিন স্টোন তাঁর ‘When god was a woman’ বইতে যুক্তি দেখিয়েছেন- “As the new civilization spread and became a new aristocracy, the conquerors imposed their own system of government and their own theocracy of monotheism. During this time, there was a transition from a tribal clan-based society to a sovereign state form government where de jure and de facto rights of individuals were replaced by sovereignty to the state and territorial integrity, which led to the emergence of the empire. Matriarchy went into decline as goddess temples were destroyed পন্ডিত লিওনার্ড শ্লেইন তাঁরThe Alphabet versus the Goddess’ বইতে যুক্তি দেখিয়েছেন মানব-মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাপেক্ষে-literacy reinforced the brain's linear, abstract, predominantly masculine left hemisphere at the expense of the holistic, iconic feminine right one. This shift upset the balance between men and women initiating the disappearance of goddesses, the abhorrence of images, and, in literacy's early stages, the decline of women's political status. Patriarchy and misogyny followed 

তথাকথিতঘরের খাওয়ারকাজের গুরুত্ব কমিয়েবাইরের খাওয়ারকাজের গুরুত্ব যখন বাড়ল, তখন থেকেই নারীদেহের বিপদের সূচনা। বিদূষী মার্লিন স্টোন আরো বলেছেন “We cannot avoid observing the continual emphasis upon female sexuality as acceptable only when women were safely designated as the property of one specific male and that any deviation from that rule was denounced as harlotry or adultery and subject to punishment by death, making the sexual customs of the older religion rather difficult to follow”. 

নারীশরীর উপভোগ্য হবে, কিন্তু তাকে নিয়ে নিষ্ঠ আলোচনার পরিসর সবসময়ই সংক্ষিপ্ত হবে। কাজেইমমাশ্রমা সমীপতঃ বিনিধ্বংসবলে যেঅহল্যানামের নারীটিকে মহাকাব্যে অভিশপ্ত করা হল, তার কাহিনিটি অনুধাবন করেই এসংক্রান্ত সার্বিক ধারণার আভাস পাওয়া যাক। রামায়ণ মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তমশতকের আশেপাশে রচিত। তার বালকান্ডে অহল্যা'কে অযোনিসম্ভূত বলা হল। অহল্যা চরিত্রটি সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিকর্তার ব্রহ্মার শুদ্ধতম সৃজনকলার নিদর্শন। পন্ডিতেরা বলেন, অহল্যা পরবর্তীকালের গ্রেকো-রোমান কন্টেক্সটের ভিনাস বা ঊর্বশীর মতো জল থেকে উঠে আসা একটি কল্পনা,  আবার কেউ বলেন সপ্তর্ষির যজ্ঞধূম থেকে তাঁর জন্ম। ঋগ্বেদের উদার প্রকৃতি-উপাসনা কালে কিন্তু অহল্যার আবির্ভাব হয় নি। বরং পরবর্তী ব্রাহ্মণ-রচনাকালে, তন্ত্র এবং অন্যান্য জনজাতির দর্শনের সঙ্গে সংঘাতকালে কোনও কবি অহল্যা নামের এক শাশ্বত নারীসত্ত্বাকে কল্পনা করেছিলেন, যে একটি স্বকীয় মানুষ। কোনও প্রজননযন্ত্র নয়। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের সাম্রাজ্য বিস্তারের কালে এই দেশে এরকম স্বাধিকারচেতনা নারীর জন্য সমাজে স্বীকৃত ছিল কিম্বা নির্মাণ করা গিয়েছিল। পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ্য যুগে, যখন উত্তররামচরিত লেখা হয়েছে, তখন অহল্যা নামক চরিত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রসিদ্ধ গৌতমমুনির ইন্দ্রিয়জয় ও তপোশুদ্ধির পরীক্ষা করার জন্য। বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত অসংখ্য উপকথায় যে সূত্রটি উঠে আসছে তা হলো, যেহেতু অহল্যা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নারীসত্ত্বা কল্পনার শেষ কথা, তাই গত আড়াই হাজার বছর ধরে ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের ক্রমবিবর্তিত নারীত্ব মূল্যায়ণের খেলায় চরিত্রটি একটি সূচক হিসেবে কাজ করছে। একটি উপকথা বলে দেবরাজ ইন্দ্র গৌতমমুনির ছদ্মবেশে এসে অহল্যার মিলন প্রার্থনা করেন। অহল্যা পুরুষতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা অনুযায়ী সঙ্গতভাবেই মিলনে সম্মত হয়। কিন্তু ব্যাপারটি গৌতমমুনির গোচরে এলে অহল্যার কপালে জুটল অভিশাপমমাশ্রমা সমীপতঃ বিনিধ্বংসএই গল্পের প্রতিপাদ্য, অহল্যা যদিও 'সতী' ( উল্লেখ্য, অহল্যা-চরিত্র শাশ্বত পঞ্চসতীর একজন বলে পূজিত হয়), কিন্তু ইন্দ্র, প্রসিদ্ধ লম্পট, তাকে নষ্ট করে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বেশ কয়েকটি রচনায় পাওয়া যায়, অহল্যা সজ্ঞানে, সচেতনভাবে ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলো। সূত্র বলছে, বৃদ্ধ গৌতমমুনির কাছে ব্রহ্মা অহল্যা'কে রক্ষণাবেক্ষন করার জন্য রেখেছিলেন মাত্র। গৌতমমুনি অহল্যার বিবাহসূত্রে স্বামী নন, তিনি রক্ষাকর্তা, তিনি অধিকারবলে প্রভু। অতএব  অহল্যা পরগমন করলে তাঁকে অভিশাপের ভাগী হতেই হবে। এটা পুরাণযুগের পুরুষতন্ত্র। বৈদিকযুগের অন্তলগ্নে ব্যাপারটা এতো একমাত্রিক নয়। সেখানে অহল্যা কারুর 'স্ত্রীধন' নয়, একজন স্বাধীন পৃথক মানুষ। প্রজননরহিত হয়েও সে গর্বিত নারী হবার অধিকার রাখে। পুরাণযুগের সামাজিক মূল্যবোধে নারীর এই সত্ত্বাটিকে হরণ করা হয়। সেখানে নারী সতত পার্শ্বচরিত্র। যদিও এসময় গড়ে ওঠা অতি বিস্তৃত তন্ত্র ও অন্যান্য অধ্যাত্মসাধনায় নারীদেবতাদেরই মুখ্য ভূমিকায় দেখা যায়। তন্ত্রশাস্ত্রের এই নারী, ঋগবেদ ব্রাহ্মণের স্বাধীনানারী'র সমান্তরাল। অর্থাৎ এই স্বকীয় নারীত্বের ধারণাটি রক্তমাংসের সামাজিক নারীর থেকে হরণ করে পুঁথির পাতায় জ্ঞানমার্গের নারীদের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেলো-সদৈকরূপং চিন্মাত্রং নির্লিপ্তং সর্ববস্তুষু/ ন করোতি ন চাঽশ্নাতি ন গচ্ছতি ন তিষ্ঠতিঅর্থাৎ নারীকে নিয়ে শুধুই পুতুল-খেলা করা চলে। 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ