পরোয়ানা
কাউকেই পরোয়া করে বাঁচতে চাইনি ‘বিরাট’। অথচ তার মৃত্যুই নিয়ে এল এক চরম পরোয়ানা; দেহদান করে গেলেও কি এত জটিলতা হতো? যদি এমন একটা নির্দেশ সে দিয়ে যেত যে মৃত্যুর পরে তার মৃতদেহ কার হাতে তুলে দেওয়া হবে ! সেক্ষেত্রেও তাকে অবশ্য ভাবতে হতো যে, এই ইচ্ছাপত্রটিই বা কাকে দিয়ে যাবে ‘বিরাট’! তাছাড়াও এটাও তো ভাববার বিষয় যে, অন্যান্য স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির মতই নিজের মৃতদেহটাকেও এরকম কোনও ক্যাটেগরিতে আইনত ধরা হয় কি না! অন্যান্য ব্যাপারে যেমন উইল বা নমিনি করা যায়, নিজের মৃতদেহের সৎকার- বিষয়েও উইল করে যাওয়ার, এ রকম কোনও আইন আদৌ এদেশে আছে কি ? পুলিশের ‘প্রণাম’-দপ্তর কি এ ক্ষেত্রে এমন কোনও সাহায্যে আসে, যারা স্বজন-পরিজনকে অস্বীকার করে মৃত্যুর পরেও চিহ্নিত হতে চায় শুধুমাত্র নিজেরই পছন্দের পরিচয়ে!
‘পরিচয়’ ব্যাপারটাতেই যে একটা বড় জট পাকিয়ে ছিল, সেটাই আসলে খুলে গেল, ‘বিরাটে’র মৃত্যুতে। সেখানেও তো ভয়ঙ্কর অস্বচ্ছতা। ফলে ভীষণ ফাঁপরে পড়তে হল তার চেনা-পরিচিতদের। কারণ দেখা গেল যে তার দুটি নাম এবং দ্বৈত পরিচয়। যে নামে সরকারি নথি, সে নামে সে বিশেষ পরিচিত ছিল না। সরকারি নথিতে এই যে ‘ধীমান’ নামটি, সেটা জানত তার হাতে গোনা সহকর্মীরা। প্রায় একযুগ পরে, দশ- বারো বছর আগে অবসর নেওয়া ‘ধীমান’কে কি করেই বা শনাক্ত করা যাবে! এদিকে পুলিশের কাছে সেই একটা পরিচয়ই গ্রাহ্য, যেটা সরকারি নথিতে পাওয়া যাবে; আর সেই নথি অনুযায়ী তার মৃত দেহের দাবীদারও হবে শুধু রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত এবং নথিবদ্ধ আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু তারা কারা? কোথায় খোঁজ মিলবে তাদের? সাধারণ ভাবে যারা তাকে চিনত, তাদের কাছে তো সে একেবারে অন্য নামে পরিচিত; এদের মধ্যে পড়ে, তার বাড়ি কাজ করতে আসা মেয়েটি আর লেখালেখির সূত্রে চেনাজানা একমুঠো কবি এবং লেখক, যারা কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে এ- অতিরিক্ত আরও কোনও পরিচয়ও যে তার থাকতে পারে ! কারণ এমন নজির তো বিরলের চেয়েও বিরল। ফলে মৃত দেহের দাবীদার খুঁজতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হল আরও বড় এক প্রশ্নে যে কে এই ‘বিরাট’!
পাকাপোক্ত সরকারি চাকরি করলেও, একটি ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বা ‘কাগজ’ সে চালাতো । লক ডাউনের সময় অনিয়মিত হয়ে গেলেও, সারা জীবন ধরেই খুব নিষ্ঠাভরে সে চালিয়েছে এই ‘কাগজ’টি। তার বাড়ির ঠিকানা দেখে সবাই বুঝত যে সরকারি চাকুরে বলেই , সরকারি কোয়ার্টারেই সে থাকে। যদিও কাউকেই কোনদিন তার বাড়িতে আড্ডা দিতে বা লেখা জমা দেওয়ার জন্য যে ডেকেছে এমনও শোনা যায় না ; বিভিন্ন আড্ডার ঠেক এবং পরিচিত লেখকদের বাড়িতে সে নিজে গিয়েই লেখা সংগ্রহ করে আনত; মিতভাষ এবং অতি সুভদ্র একজন সম্পাদক হিসেবে সকলেই তাকে পছন্দও করত। কোনও সহযোগী বা অনুগত অনুজ-লেখকদের দেখা যায়নি তার আশেপাশে, যেমনটা অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। প্রকাশিত সংখ্যাটি ডাকে এলে, নাড়াচাড়া করেই বোঝা যেত যে প্রখ্যাত, অল্প পরিচিত এবং অপরিচিত কত লেখককেই না সে জানে এবং চেনে! পত্রিকার নামটিতেও যেন এক না- অহং ঘোষণা – ‘কপর্দক’ । আর তাকে সবাই চিনত- ‘বিরাট শিষ্ট’ এই নামে এবং পদবীতে। সকলেই হয়তো একবার হলেও ভ্রু কোঁচকাতো তার নামের সঙ্গে পদবির এমন অর্থবহ মিল দেখে। কিন্তু এ নিয়ে হৈ হৈ করে প্রশ্ন করেনি কেউ; মানে তার সাহিত্য-আড্ডার স্বজনেরা। যদিবা কেউ তার অন্য নামটা জেনে থাকে, সে নিয়েও সোচ্চার হয়নি তারা। ফলে ‘কপর্দক’ পত্রিকার সম্পাদক ‘বিরাট শিষ্টে’র মারা যাবার খবরটাই তো সকলে পেয়েছে, একে অন্যের মুখ থেকে। সেই মতো শুরু হয়ে গেছে চর্চাও--- কে কতখানি তাকে চিনত ,কার লেখা কতবার সে তার কাগজে ছেপেছে, এবং মানুষ হিসেবে কেমন ছিল এই ‘বিরাট শিষ্ট’। দেখা গেল সকলেই অতীত-চারণা করেই লিখছে। কারোরই প্রায় জানা নেই যে শেষ কয়েক বছর সে কোথায় থাকত, বা কেমন ভাবে কাদের ভরসায় বেঁচেছিল ‘বিরাট’! সে সব না জানলেও সকলেই ধরে নিল যে এর পরের পোস্টগুলো আসতে থাকবে বিরাটের স্মরণসভা সংক্রান্ত লেখা এবং ছবি দিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই এক সুবিধে; মস্ত একটা ঢেউও উঠেই আছড়ে পড়েই স্তিমিতও হয়ে যায়; কিংবা তা মুছে যায় অন্য এক নতুন ঢেউয়ের তোড়ে। তখনকার মতো বিস্মৃত হয়ে নিষ্কৃতি পেতে থাকে মানুষ; সকলেই জানে যে, সে স্মৃতি যদি ফিরেও আসে, তবে তা আসবে আবার এক বছর পরে। কিন্তু বিরাটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম হল না। ক্রমাগত জানা যেতে লাগল যে, বিরাটের সৎকার হয়নি; আইনী- জটিলতা দেখা দেওয়ায় সে পড়ে আছে মোমিনপুরের পুলিশ মর্গে , সৎকারের অপেক্ষায়।
ঝ্যামেলাটা জানাজানি হল, সোশ্যাল মিডিয়ার একটি পোস্ট থেকে; ‘কপর্দক’ পত্রিকার সম্পাদক ‘বিরাট শিষ্টের’ ফটো দিয়ে তার পরিচিত কেউ অনুরোধ জানাল , সত্বর এই ‘বিরাট শিষ্টের’ বাড়ির লোকজনের হদিশ জানাতে; মানে কারোর যদি জানা থাকে; কারণ, সকালবেলা কাজে এসে বিরাটকে মৃত দেখে, তার বাড়ির পরিচারিকাটি কাউকে না পেয়ে পুলিশে খবর দিয়েছে; পুলিশ এসে মৃতদেহ তাদের হেফাজতে নিয়ে চলেও গেছে; সেই সঙ্গে এ কথা জানিয়েও গেছে যে, প্রমাণিত নথি সহ রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত এমন কোনও আত্মীয় ছাড়া আর কাউকেই বিরাটের মৃতদেহ দেবে না পুলিশ ; বোঝা গেল যে মরদেহেরও উত্তরাধিকারী লাগে! বাড়ি-জমির মতোই প্রবেট নিয়ে দাবীদার হতে হয়। না হয়তো দিনের পর দিন তা পড়ে থাকে পুলিশ- মর্গে একটা ‘unclaimed body’ হয়ে। শেষে ওই পুলিশ-মর্গের শশ্মানেই প্লাস্টিকে মুড়ে, পুড়ে যেতে হয় গণ - সৎকারে।
পাড়ার কেবল অপারেটার ছেলেটির সাহায্য নিয়ে পরে ওই পরিচারিকাই ডেকেডুকে আনে সেই গুটি কয়েক মানুষকে, যারা তার খোঁজ খবর রাখত। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বন্ধুদল নিজেরাও তৎপর হয়ে উঠল থানা-পুলিশকে বোঝানোয়, যাতে বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে সসম্মানে দাহ করতে দেওয়া হয় ‘বিরাট’কে। কিন্তু পুলিশ তা মানবে কেন! সকলের উপরোধে, মানে প্রাক্তন এবং বর্তমান দুই ভিন্ন দলের পরাজিত এবং বিজিত দুই কাউন্সিলররাও এসে পড়ায় তড়পানি থামাল পুলিশ; অপেক্ষার সময়টাও তিনদিন থেকে বেড়ে হল সাতদিন। যমে-মানুষে টানাটানি – সে এক রকম; এখানে তো টানাপোড়েন শুরু হল মৃত্যু এবং সৎকারের প্রশ্নে। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধু তারপর? তারপর? আর তারপর!
এ প্রশ্নও তো উঠবেই ; তাই উঠলও। কারণ যে মানুষ সরকারি পেনশন পেত, তার সহায় তো নথিও। কিন্তু সে-সব নাড়াচাড়ায় মাথা ঘামাতে যাবে কে? কার সময় আছে, সত্তর বছরের এক অদ্ভুত এবং মৃত-মানুষকে জীবিতের সম্মান ফিরিয়ে দিতে কোমর বেঁধে লাগার ! খুঁজে পেতে বার করে আনতে, হয়তো বা বিবাহ বিচ্ছিন্ন স্ত্রী, না হয়তো পিছুটান মুছে যাওয়া সন্তান, নিদেন পক্ষে ভাই-বোনের পরিবার! এক ফোঁটা হলেও রক্তের সংযোগ চাই-ই চাই। তার ওপর ভোটের বাজার। চলতি কাজই বন্ধ হয়েছে যেখানে, সেখানে পুরনো নথি! কিন্তু সেখানেও নাড়াচাড়া পড়ল। আত্মীয় -শূন্য হলেও ‘বিরাট’ যে বান্ধব-বর্জিত নয় এটাই প্রমাণ হল। হাত গুটিয়ে বসে না থেকে এগিয়ে এল অবসর প্রাপ্ত তার অন্য সহকর্মীরাও । আজকের এই কোণঠাসা বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিল ‘বিরাট’। তবুও সেই তারাও এগিয়ে এল, দল বদলে আজ যারা কেউই আর বামপন্থী নয়। যে যেমন করে পারল, চেষ্টা চালিয়ে গেল, যাতে তার ক্ষেত্রেও প্রথামাফিক শবানুগমন হয়। সকলের একটাই দাবী যে মৃত্যুর প্রায় ছ'দিন পরে হলেও তবু তা হোক স্বজন পরিবৃত হয়েই এবং সসম্মানে ।
অবশেষে যা জানা গেল, তাতে তার পছন্দের সেই অণু গল্পটাও দীর্ঘ হতে হতে প্রায় একটা নভেলেটের আকার নিতে চলল। অনেকেই বলেও ফেলল, ভাগ্যিস তার দাহ হয়নি! কারণ জানা গেল যে সে ছিল খ্রিস্টান। জন্ম সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার নাম ধীমান স্যামুয়েল সরকার । স্ত্রী সুলক্ষণা সরকার যিনি মারা গেছেন আগেই। কারোর সঙ্গেই তার এবং তার সঙ্গে তথাকথিত আত্মীয়-স্বজনদের কণামাত্র যোগাযোগ না থাকলেও , বহু খোঁজের পর পাওয়া গেছে সেই নমিনিকেও ; সে নামও সুনীতা গোমস নামে, খ্রিষ্টান পদবীধারী একটি মেয়ের; সুনীতা আসলে তার বোনের মেয়ে। নমিনি না হলেও খোঁজ মিলেছে সুনীল গোমস নামে তার এক বোনের ছেলেরও । ছোটখাটো হলেও মোটামুটি একটা পরিবারের হদিশ পেয়ে পুলিশও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে । এবার তো নাটক তুঙ্গে। কারণ পরিবার থেকে জানানো হয়েছে যে তার মৃতদেহের সৎকার, দাহ করে হবে না; খ্রিস্টধর্মালম্বীদের প্রথা অনুসারে কবরই দেওয়া হবে ‘বিরাট শিষ্ট’ বা ধীমানকে। ফলে, পুলিশ এবার মৃতদেহ দিতে চাইলেও , পরিবার থেকে সময় চাওয়া হল আরও একদিন। এ জন্যই তার মর্গ -বাসের মেয়াদও প্রায় এক সপ্তাহ ছাড়াল। বিশেষ কোন ধর্মে সে নিজে কি বিশ্বাস করত ? কিন্তু সমাজ এবং আইন পরস্পরে হাত ধরলে যা হয়, সেটাই হল; বিশ্বাস- অবিশ্বাসকে হুট করে বেঁধে দিল সরকারি নথি, মানে আইন। কারণ ধীমান স্যামুয়েল সরকার তো এফিডেভিট করে তার পছন্দের নাম ‘বিরাট শিষ্ট’ করে নেয়নি! তবে পরিবারভুক্ত একজন ‘নমিনি’ এসে যাওয়ায় শুরু হওয়া গপ্পোটা একটু অন্যদিকে মোড় নিলেও, এবার আবার তা এগিয়ে চলল অন্তিম পরিণতির দিকে। গত সাতদিন পরে ‘আন-ক্লেইমড বডি’ হিসেবে পুলিশ -মর্গে পড়ে থাকা থেকে উদ্ধার পেল বটে ‘বিরাট’, কিন্তু নতুন করে সে আবার পরিবারভুক্তই হয়ে গেল ধীমান স্যামুয়েল সরকার নামেই। তবে এখানেই শেষ নয়; কারণ তার এই নতুন করে উদ্ধার হওয়া পরিচিতিতেও জড়িয়ে গেল আরও কিছু পরিচয়। কারণ সরকারি নথি অনুযায়ী ধীমান স্যামুয়েল সরকার নামে এই লোকটি একই সঙ্গে বিবাহিত এবং বিবাহ বিচ্ছিন্নও বটে ; বহু বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেলেও ধীমান স্যামুয়েলের মেয়ে আজও বর্তমান; কিন্তু তাকে সে তার নমিনি করে যায়নি। ধীমানের স্ত্রী কি তবে হিন্দু ছিল? কিন্তু তার মেয়ে? কফিন-বন্দী হয়ে এবার একদিকে যেমন সে চাপা পড়ে যাবে মাটির নীচে এক কবরে, অন্যদিকে তেমনই সময়ের খবর খুঁড়ে প্রকাশ্যে আসবে এমন সব নথি যা সে কোনও দিন কাউকে বলেনি। সকলের পরিচিত ‘কপর্দক’ পত্রিকার সম্পাদক জীবিত ‘বিরাট শিষ্ট’ সারা জীবন গোপনে যা বহন করে গেছে , তা আসলে তার নিজেরই মৃতদেহ, যার নাম শুধু ধীমান সরকারই নয়, আসলে সে ধীমান স্যামুয়েল সরকার; আর এই নামটাই তার মৃত্যুর পর ‘বিরাট শিষ্টে’র মৃতদেহে পাকাপাকি ভাবে এঁটে বসল আইনের পোশাকে। মৃত্যুও কী ভীষণ আইন - অনুসারী এবং আক্রমক!
আর তার বন্ধুরা? যুদ্ধ শেষে, কফিন বন্দী বিরাটের শবানুগমন করল তারা; আর ছড়িয়ে দিল, শুধু কিছু ফুল সেই ধীমান স্যামুয়েল সরকারের কবরে, যে ছিল আদ্যন্ত অভিমানী এবং সুভদ্র এক সৈনিক।
শেষ হাসিটা যে কে হাসল কে জানে! ধীমান স্যামুয়েল সরকার না ‘বিরাট শিষ্ট’? নাকি দুজনেই!
0 মন্তব্যসমূহ