সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শতাব্দী চক্রবর্তী:গ্রন্থজগত: কাশবনের ভাস্কর্য: শুভংকর গুহ

 


কাশবনের ভেতর দিয়ে


 সম্প্রতি পড়লাম কথা সাহিত্যিক শুভংকর গুহকাশবনের ভাস্কর্য  নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখক একটি ছবি এঁকে দিতে সার্থক হয়েছেন পাঠক হৃদয়ে। এটি একটি আত্মগদ্য যা উঠে এসেছে স্মৃতি থেকে। লেখক এখানে শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত তুলে ধরেছেন অনবদ্য লেখনী শৈলীতে। এটিকে কিন্তু উপন্যাস বললেও ত্রুটি হবে না। কারণ এখানে লেখকের সঙ্গে বড় হওয়া পরিবেশটি একটা চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক শুরুতেই বলেছেন গদ্যটি মাকে ঘিরে লেখা। মা অবশ্যই একটি স্তম্ভ কিন্তু আশপাশের যে বর্ণনা বা যে ঘটনাগুলো আলোর রোশনাই জ্বেলে দিয়েছে তাকে অস্বীকার করি কেমন করে। পরতে পরতে মুগ্ধতা। আর যে সমস্ত মণিমুক্তা ছড়িয়ে রয়েছে পাতায় পাতায় তার পাঠক যতটা কুড়িয়ে নিতে পারবেন ততটাই পাঠকের সঞ্চয়।    

   লেখকরা পাঁচ ভাই আর মা সেনাবাহিনীতে কর্মরত পিতার সাথে সাথে ঘুরেছেন ভারতবর্ষের নানা শহরে। যেখানে বড় হতে হতে দু হাতে এঁকে নিয়েছেন অযুত স্পর্শ সুখ। মনে জমা করেছেন আবেগ মথিত অমৃত ভাণ্ডার যা থেকে আমাদের পাঠক হৃদয়েও ছড়িয়ে দিয়েছেন পানাগড়, উত্তরপ্রদেশ, আগ্রা , মথুরা, এলাহাবাদ, লখনউ, কলকাতা সম্বলিত নানা কথা উপকথার মাধুর্য।

     প্রথম অধ্যায়ে লেখক সপরিবারে আছেন পানাগড়ে। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পাসে কোয়ার্টার ও বিভিন্ন মানুষের মধ্যে আত্মীয়তা বদলির চিঠি এলে কেমন মন খারাপে রূপান্তরিত হয়। এখানেই দূরে একটি কাশবনের জ্বলে যাওয়ার দৃশ্য এবং গন্ধকে সাথে নিয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। সেনাবাহিনীর বন্দুক চালনা প্র্যাকটিসের জন্য পুড়িয়ে ফেলা কাশবন দগ্ধ করেছে লেখকের শিশু হৃদয়। পরিত্যক্ত ওয়াগনের মতো একাকী করে তুলেছে তাঁকে। ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রার অ্যাকোর্ডিয়ানের সুর আর পন্ডিতানীজির আদর সাথে সাথে ঘুরেছে বাবার বদলির জায়গায় জায়গায়। এই অপূর্ব বর্ণনা প্রথম অধ্যায় থেকেই পাঠককে তাড়িয়ে বেড়াবে পরের অধ্যায়গুলো পড়ার জন্য, জানার জন্য। এখানেই লেখকের সার্থকতা। কোথাও ঝুলে যায়নি। একটি শব্দকেও স্কিপ করতে ইচ্ছে করবে না। কমান্ডার সাহেবের অর্ডারে বাদামী কুকুর লাকির পেটের ভেতর কার্তুজের ক্ষত লেখকের বর্ণনায় পাঠক হৃদয়েও মোচড় দিয়ে উঠবে।

      এরপর যখন মথুরাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানেও আমরা জুড়ে গেলাম কড়া ভরা দুধ, ক্ষীর মালাইয়ের সাথে । এখনে দেওয়ালে বাজারে অলিতে গলিতে কৃষ্ণ কানাইয়া ও তার কাহিনী পড়ে পড়ে মানুষ যেভাবে পরিবৃত আছেন সেই কাহিনীও তুলে‌ ধরেছেন সুন্দর ছন্দে। এইখানে এসে বড় জমিদার বাড়ি যা সেনাবাহিনীর অধিকৃত গাঙ্গুলী বাড়ির মালকিন জেঠিমার সাথে পরিচয় করান লেখক। যে চরিত্রটি অভিজাত একাকীনী নারীর। লেখকের সাথে তাঁর অসমবয়সী বন্ধুতা এবং তাঁর অপরূপ বর্ণনা মনে ধরে থাকে বহুক্ষণ। মথুরা কোয়ার্টারের প্রবীণ কাঠের মিস্ত্রী রাধেশ্যাম সিং - এর নেতাজি ভক্তিও দাগ কাটে। বালক কৃষ্ণের মাটির অবয়ব, বিশ্রামঘাট(কংসবধের পর কৃষ্ণ যেখানে বিশ্রাম নেন) , সন্ন্যাসী ও কৃষ্ণভক্তি সমণ্বিত বিভিন্ন পৌরাণিক ইতিহাস জানতে পারি এই পর্বে।

    এরপরে লেখকরা চলে যান যমুনার  আরেক দিক আগ্রা শহরের তাজমহলের নিকটে। বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে তাজমহলকে প্রথম দেখার যে বিবরণ দিয়েছেন মানসভ্রমণে আমরাও যেন কোনো দুধসাদা আশ্চর্য সৃষ্টির সম্মুখে বসে তার শুভ্র দেহের ওপর জ্যোৎস্না ফুটে ওঠা দেখছি। বড়রা সকলেই নিশ্চুপ। ছোটরা অস্থির হয়ে কথা বলতে‌ গেলে লেখকের বাবা বলে ওঠেন অবাক এই সৌন্দর্যের সামনে মানুষের কথা মানায় না  পূর্ণিমার রাতে নাকি বেগম মুমতাজ সম্রাটের সাথে একা ঘুরে বেড়াতে চান এমনটা জানালেন এক সহকর্মী। এই অধ্যায়ে একটু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি—“ দুর্গের উচ্চতা থেকে দেখলাম, যমুনা নদী এক টুকরো সুতোর মতো পড়ে আছে। নদীর জলে পোকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো নৌকা। যমুনা নদী তাজমহলকে পাশে রেখে চলে গেছে কোথায়? যে যমুনা মথুরায় কৃষ্ণ প্রেমে আচ্ছন্ন সেই যমুনাই আগ্রায় মুঘল ইতিহাসের সাক্ষী। কি অসামান্য বৈচিত্র্য!। এই পর্বে গোয়ালিনী নানির চরিত্রটিও মধুর স্মৃতি।  

   আগ্রায় তাজমহলের এলাকা ছেড়ে যখন সদর বাজারের দিকে কোয়ার্টারে গেলেন তখন লেখক দেখা করালেন এক পর্তুগিজ সাহেব ক্রিস্টোফার দুগার্তো ও পোষ্য স্পেনিয়াল কুকুর হাতে ধরা তার মোমের পুতুলের মতো স্ত্রীর সাথে। যে মানুষটা একটা লোকালয়ে আস্তানা নেওয়া চিতাশাবককে লালন পালন করতেন, কাঁচের শিশিতে ঘাস ভরে তার ভেতর মখমলি মেরুন পোকা ধরা শিখিয়েছিলেন এবং যা পরে ঘাসে ছেড়ে দিতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন, যিনি দেশ বিদেশের স্ট্যাম্প জমাতেন, সুগন্ধি সেন্টের শিশি সাজিয়ে রাখতেন, মাঝেমধ্যেই যিনি গীটারের ঝংকার তুলতেন, সেই মানুষটির হঠাৎ মৃত্যু লেখককে প্রথম মৃতদেহ চিনিয়েছিল। কফিন বন্দি মৃতদেহ থেকে লেখক জানলেন সব মানুষের জন্য এমন সুন্দর কফিন হয় না কেবল‌ খ্রীস্টানদের জন্য। এই দুগার্তোকে পাঠকের মনে থাকবে। 

    এই বই যতই এগিয়েছে ততই নতুন নতুন অধ্যায় আমাদের কাছে উঠে এসেছে। সাবলীল গদ্যে ঘটনাবলীর বর্ণনার ধারায় বয়ে গেছি আমরাও। নানা রকম সেনাবাহিনীর ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সাথে সাথে মা হয়ে উঠেছেন পরিশ্রান্ত। স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে যে আমাদের সংসার ও পরিবেশ বদলে যায় মেয়েরাই তো ভালো করে বুঝতে পারে। একটি কন্যা সন্তান নেই বলে মায়ের যে অসহায়ত্ব তাও ভরিয়ে তুলেছেন গদ্যে সংসারে সব থেকে একা কে হয় জানিস? মায়ের জাত।   এই গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অনেক শহর, গ্রাম তাই লেখক বলেছেন ভারতবর্ষের গ্রাম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পের ভাণ্ডার।এখানে মিশে গেছে সাক্সেনা জী, মিশে গেছে সুক্ষু নাইয়ের বেটা চন্দা তার মণিপুরী খাটো ঘোড়া ও হজমি গুলির সাথে। 

      তারপর শীতের এক রাতে লখনউ রেলস্টেশনে নামলেন বাবার বদলির পোস্টিংয়ে। যেখানে আবার নতুন বন্ধু, নতুন বিদ্যালয়, নতুন অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা। কোয়ার্টারের পেছনে পুড়ে যাওয়া বানজারাদের তাঁবু থেকে মুন্না নামের এক কিশোরকে খুঁজে যাচ্ছিলেন পুড়ে যাওয়া হাঁড়ি কড়াই তুলো বা পোশাকের ভেতর থেকে। কেউ তো হয় না তবুও যেন কেউ হয় তাঁর। লখনউ শহরের মিঠাইয়ের দোকান, মাঠ ঘাট ছাড়িয়ে আবার ফিরে আসতে হল কলকাতায়। জীবন প্রবাহ থেমে থাকে না। কলকাতার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থান অস্থিরতা ধরা পড়েছে লেখকের বর্ণনায়।   

      সবকিছুর শেষে বাবা যখন স্থিতু হলেন মায়ের বহু বছরের বাসনা নিজের একটি বাসস্থান, তার পূর্ণ হলো ঠিকই কিন্তু মা তাতে বেশি বছর স্থায়ী হতে পারলেন না। এত বছরের সংসার ছেড়ে এক মাথা সিঁদুরে আর আলতায় কর্কটরোগে ক্ষয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে অবসর নিলেন।  

       এ বই থেকে  কয়েক লাইনে শুধু অনুভূতিটুকু বললাম। এ বই অনেক বড় তাঁর বর্ণনার বহরে। মায়ের প্রভাব যে লেখককে লেখক করে তুলেছেন তার বেশ বুঝতে পারি এই লেখা পড়ে। মায়ের পড়ার নেশা তাঁকেও পড়ার নেশা ধরিয়েছে। 

   একটি স্মৃতি গদ্যে লেখক যে নিপুণভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন পাঠকদের এ বই না পড়লে তার উপলব্ধি করা যাবে না। পড়ার পর বহুদিন রেশ রয়ে গেছে। ঘি আহুতি দিয়েছেন লেখক স্মৃতির আগুনে তাই তো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পেরেছে অগ্নিশিখা। আমরা পুড়েছি , সহেছি, আত্মাহুতি দিয়েছি দুই মলাটের অন্তর্নিহিত রস ধারায়। কাশবনের ভাস্কর্যসার্থক নাম হয়ে উঠলো পাঠকের স্মৃতিতেও।

   লেখককে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার পাঠ আলোচনা সমাপ্ত করলাম। বই প্রেমীরা নির্মল আনন্দ পেতে অবশ্যই এই বই পড়বেন। বইকাশবনের ভাস্কর্য  লেখক শুভংকর গুহ প্রকাশক তবুও প্রয়াস মূল্য৫০০/_   



শতাব্দী চক্রবর্তী


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ