সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সাক্ষাৎকার / সুমন গুণ


সাক্ষাৎকার






এবং সইকথার পক্ষ থেকে কবি ও প্রাবন্ধিক শ্রী সুমন গুণের মুখোমুখি তরুণ কবি সব্যসাচী মজুমদার 

-----------------------------

সব্যসাচী মজুমদার: একদিকে সত্তরের সোচ্চার বৈচিত্র্য,অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিবেশের বিবর্তন আশির দশকে যখন ক্রিয়াশীল,আপনি কবিতা লিখতে এলেন। এবং শব্দের 'গোপন দেবনাগরীঅনুসন্ধান করলেন।

সময় কীভাবে আপনাকে নির্মাণ করেছে? এই 'গোপন দেবনাগরী' বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?

 

সুমন গুণ: আমি যখন লিখতে এলাম তখন বাংলা কবিতার একটা ঐশ্বর্যময় পর্ব চলছে। সত্তরের কবি হিসেবে এখন যাঁরা মান্য, তাঁদের আলোকময় বইগুলোতখন বেরোচ্ছে, অনেক  বই  বেরিয়ে গেছে। আশির উল্লেখযোগ্য কবিদের তখন প্রতাপ শুরু হচ্ছে। আমি আশি এবং নব্বইয়ের মধ্যবর্তী পর্বের মধ্যে পড়লাম এবং  লিখতে শুরু করলাম।

এই সময়ের যে-ঐশ্বর্যের কথা বলেছি, তার মধ্যে  আন্দোলন ছিল, অস্বীকার ছিল, প্রত্যাহার ছিল, সংবরণ ছিল, গ্রহণ ছিল, নির্মাণ ছিল, শুশ্রূষা, ছিল লালন ছিল। এগুলো আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আমি সেই সময়টা নৈহাটিতে থাকতাম।  রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী থাকতেন নৈহাটিতে। মণিভূষণ ভট্টাচার্য থাকতেন। আলোক সোম, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, ভাস্কর মিত্রসহ সেই সময়ের তরুণ কবিদের দাপটে নৈহাটি গমগম করত। আলোক সোমের 'এই দেশ দারুহরিদ্রার' বইটি ছিল সেই সময়ের ধ্রুপদি ফসল। কত দাপুটে কাগজ বের হতো তখন! সারা বাংলা থেকে। ছোট ছোট কাগজ, কিন্তু সেইসব কাগজের সৃজনশীল  ছোবল সহ্য করতে করতে বাংলা সাহিত্য পরিণত হয়েছে। বন্ধু তন্ময় মৈত্র ছিল আমার প্রতিবেশী। শুধু কবিতার নয়, নাটক গল্প প্রবন্ধের উল্লেখযোগ্য অনেক মানুষের চর্চার কেন্দ্র ছিল তখন নৈহাটি। আমি তাঁদের সান্নিধ্য অর্জন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সখ্য  আমার লেখাকে পুষ্টি দিয়েছে।  যে- 'গোপন দেবনাগরী'র কথা বলি আমি, তার উৎস কিন্তু মূলত রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর সান্নিধ্য, তাঁর সঙ্গ, তাঁর দর্শন, তাঁর পরামর্শ। আমি সেই সময় অন্তত শব্দের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতায় প্রতি মনোযোগ দিতাম। শব্দের মধ্যে নানা ঘরানার পরিবেশ থাকে, ভাষার মধ্যে সেই পরিবেশ রচনা করার স্বয়ংক্রিয়  ঝোঁক থাকে। অনেক কথা না বলে সংহতভাবে গন্তব্য নির্দেশ করার মধ্যে উত্তেজক  সৃজনশীলতা আছে। আমি সেই উত্তেজনা শুরু থেকেই গ্রহণ করেছিলাম, লালন করেছিলাম।


সব্যসাচী মজুমদার: নুনদুপুরের কলি থেকে সোমবার, আত্মীয়স্বজন প্রকাশিত হয় নব্ব‌ই দশকের মধ্যে, আবার ভেতরের অসম্পূর্ণ ঘর পর্যন্ত কাব্য প্রকাশিত দু হাজার পরবর্তী সময়ে।

এই‌ দুই দশক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল বৈচিত্র্য তৈরি করে। আপনার কবিতায় এই দুই দশক কেমনভাবে ধরতে চেয়েছেন? মানে,এই দুটো সময়ের,আদৌ কী দুটো সময়, চিহ্ন আপনি কীভাবে ধরতে চেয়েছেন?


সুমন গুণ:  অমিতাভ গুপ্ত আমার প্রথম কবিতার বইটি প্রকাশ করেছিলেন। বইটির নাম ছিল 'কলি, নুনদুপুর'। বইয়ের কবিতাগুলো ছিল যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত, পরিমিত, নির্দিষ্ট, কিন্তু কুণ্ঠিত নয়। এত কম শব্দে যে কথা বলা যায় সেটা দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন, অস্থির হয়েছিলেন, এমনকি ---অধ্যাপকেরা যেমন হয় আর কি ---কোনও কোনও অধ্যাপক বিরক্ত হয়েছিলেন। আমাকে একজন বলেছিলেন মনে আছে, এমন কবিতা লিখছ আমি বুঝতে পারছি না। ফলে  নিজের ওপর অনাস্থা  তৈরি হচ্ছে। এমন কবিতা লিখবে না! তবে সেই সময়ের নিরঙ্কুশ সংহতির বলয় থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। অনেকদিন আগেই বেরিয়েছি। কারণ, ক্রমশ আমার মনে হতে লাগলো যে, একটু ছড়িয়ে কথা বললে বোধহয় ভালো হয়। এতটা মন্ত্রগুপ্তি হয়তো কবিতাকে আমার অজান্তেই খাটো করছে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছতে অনাবশ্যকভাবে বাধা দিচ্ছে। তাছাড়া একটু বেশি কথা বললে মনেরও আনন্দ হয়। সেসব অতিরিক্ত কথা যে নির্দিষ্ট বক্তব্য প্রকাশ্যে খুব জরুরি তা হয়তো নয়, কিন্তু বিস্তৃতির নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। আমি এই সৌন্দর্যের অনুগত হয়ে পড়লাম। ফলে, মোটামুটিভাবে, ধরো এই শতাব্দীর শুরু থেকেই প্রায় আমার কবিতা একটু বিছিয়ে কথা বলতে শুরু করল। ১৯৯৯ সালের 'সোমবার আত্মীয়স্বজন' বইয়ে এই দুটো ধরণের মধ্যবর্তী একটা ঘরানা ছিল। তারপর থেকে আমার সব বইয়ের কবিতাই মুখরতার আরাধনা করেছে। যদিও এটাও ঠিক যে সবসময়ই সংহতির প্রতি আমার নাছোড় ঝোঁক থেকে গেছে। একটু বেশি কথা বলতে গেলেই ভেতর থেকে টান টের পাই। ফলে একটু গুটিয়ে নিতে হয়। আত্মপ্রচার হবে তবু বলি, জয় গোস্বামী আমাকে উপহার দেওয়া তাঁর একটি  বইয়ে লিখে দিয়েছিলেন : 'যার কবিতার সংহত বাচন আমাকে মুগ্ধ করে...'  জয়দার এই উক্তি আসলে আমার কবিতার প্রাথমিক সংহতিকে স্বীকৃতি দিল।
এই গোটা পর্বে বাংলা কবিতা নানাভাবে পালটেছে। নিজেকে কখনও  অরক্ষণীয় নানা গন্তব্যে নিয়ে গেছে, কখনো গুটিয়ে থেকেছে। ভাষায় অকল্পনীয় কিছু সীমালংঘন ঘটেছে। নানা গণমাধ্যমের প্রচার আর প্রসার যেভাবে বেড়েছে, তা আমাদের শুরুর পর্বে অভাবনীয় ছিল।  সবমিলিয়ে এখন বাংলা কবিতার ভাষা ও বিষয়ে উদার নৈরাজ্য চলছে।  এটা স্বাভাবিক। নতুন কবিতার  ভাষা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছে। নয়ের দশকের পরে বাংলা কবিতা নিজের মত করে পথ করে নিতে চেয়েছে। সেই পথের আওতাতেই বাংলা কবিতা এখনও আছে। ফেসবুক-ইউটিউব-ইন্সটাগ্রামে কবিতা দিয়ে বই বিক্রি বাড়িয়ে নেওয়া লেখকের সংখ্যা  সারা বিশ্বেই হুহু করে বাড়ছে। এমনই একজন রুবেন হোমস, যাঁর পাঠক দশ লক্ষের ওপর, আমাজনের সবচেয়ে বেশি বই বিক্রির পেপারব্যাক তালিকায় তিনি ছিলেন পনেরো নম্বরে। আছেন ইয়ুং পাবলো, যাঁর একক কবিতাসন্ধ্যার টিকিট অনুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ হয়ে যায়।

ইউটিউবে ডেন স্মিথের কবিতা পড়ে ফেলেছেন তিন লক্ষের বেশি মানুষ।
এমনকি ধ্রুপদি 'পোয়েট্রি' পত্রিকার সম্পাদকও বলছেন, ওইসব মাধ্যম অনেক নতুন পাঠককে কবিতার দিকে টেনে এনেছে। কবিরা 'পাঠক' পেয়েছেন। আর আমেরিকার রাজকবি নিয়োগ করে যে-সংস্থা, লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, তার কবিতা বিভাগের কর্তারাও মেনে নিয়েছেন, কবিতা শুধু চারজন নির্জন কবি অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের কোণায় বসে চর্চা করবেন, তাঁরাই শুধু বুঝবেন, বাকিরা টের পাবেন না, এই মিথ ভেঙে গেছে। সবচেয়ে দামি কথা বলেছেন ওয়াশিংটনের এক কবিতা উৎসবের কর্ণধার : কবিতা এখন আর তিনজন কবির রাজত্ব নয়। কবিতা সাম্রাজ্যের দরজা এখন খোলা, দারোয়ানদের চাকরি খতম। পাঠক নিজেই খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের কবিতা।
অবশ্য এর ফলে কবিতার শুদ্ধতা টোল খাচ্ছে ভেবে বিরক্তও অনেকে। আমি নিজে এইসব মাধ্যমে, ঈষৎ অস্বস্তি সহ, কবিতা দিতে চাই, দিচ্ছিও। অস্বস্তি, কারণ শুদ্ধতার নিরাকার ধারনা এখনও গায় লেগে আছে। আর দুলক্ষ না হোক, দুজন পাঠককেও যদি সরাসরি অর্জন করা যায়, এই লোভে মাঝে মাঝেই এখানে কবিতা টাঙিয়ে দিই।

 আর একটা ব্যাপার ঘটেছে, এই সময়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। সেখানে কবিরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক বলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তাঁদের আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে বিশ্বনাগরিকতার ধারণা তাঁদের মধ্যে আমাদের চেয়ে অনেক স্বাভাবিকভাবে  কাজ করে। বাংলাদেশের কবিতার আন্তর্জাতিক বহুস্বর পাওয়ার একটা বড়ো কারণ এটাই। আমাদের এখানে কেউ একবার দুবার বাইরে গেলেই সেটা খবর হতে থাকে। আর তাঁরা তো এটা নিত্য করেন। ফলে আমার পদ্মাপারের বন্ধুরা আমার পাশের সতীর্থের চেয়ে এই রূপসী পৃথিবীকে কয়েক গুণ বেশি চাক্ষুষ করেছেন, আমি জানি।

 তবে আমিও কয়েকবার সেই সুযোগ পেয়েছি। বোদলেয়ারের শহরের এক  সুরম্য সুরালয়ে তাঁর জন্মদিনে সারারাত ধরে তাঁরই কবিতাপাঠ শোনার শিহরণময় অভিজ্ঞতার আছে আমার।  সেই শহরের আরও দুটি রসজ্ঞ আস্তানায় ঢুঁ মেরেছিলুম। দুটিই সেই সময়ের দিকপাল মানুষজনের সরব মোলাকাতের ঠেক হিসেবে পৃথিবীবিখ্যাত।  Les Deux Magots-এ আসতেন হেমিংওয়ে, সার্ত্র ও তাঁর বান্ধবী সহ অনেকে। এতটাই খ্যাতি এই কাফেটির, যে এর নামে একটি সাহিত্য পুরস্কার আছে, ১৯৩৩ থেকে প্রতি বছর একটি করে ফরাসী উপন্যাসকে দেওয়া হয়! আর La Closerie des Lilas নামের পাবটিকে তো চিরকালীন করে গেছেন হেমিংওয়ে, তাঁর 'আ মুভেবল ফিস্ট' নামে প্যারিসকালীন স্মৃতিকথায়। প্যারিসের এক গহন আর কোলাহলহীন সরণির এই আয়োজনটি দেখেই টের পাওয়া যায়, কেন তখনকার প্রখর লেখকদের  এখানে না এসে উপায় ছিল না!

   

সব্যসাচী মজুমদার: ফর্ম বারবার আপনার কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আপনি ফর্ম এবং কবিতার সম্পর্ক কীভাবে দেখেন?

 সুমন গুণ: একটা কথা তো বলাই হয় যে, সাহিত্যের ইতিহাস আসলে তার আঙ্গিকের ইতিহাস। কথাটিতে যুক্তি একদম নেই তা নয়। বিশ্বসাহিত্যের পরম্পরা লক্ষ করলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বিষয়ের ভর না থাকলে শুধু আঙ্গিকের টানে লেখা  কোথাও পৌঁছয় না। অন্তত আমার কাছে একটি নির্দিষ্ট কবিতার আঙ্গিক তার বিষয়ের টানেই আসে। আমি মূলত লিখেছিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। কখনও কখনও গদ্যছন্দে। কখনওই কিন্তু আমি বিশেষ কোনও ছন্দে লিখব বলে কবিতা লিখিনি। সেই মেঘনাদবধ কাব্য থেকেই বাংলা কবিতা বুঝে নিয়েছে যে, ভাষায় যতরকম মোচড় সম্ভব, অক্ষরবৃত্তের নানা ধরনে তা ধরা যায়। তাই আমাদের কথার সব ইশারা আর ইতিকথা মনের মতো করে বলার জন্য এই ছন্দের কাছেই সফলভাবে হাত পাতা উচিত। কবিতার যদিও উচিত-অনুচিত বলে কিছু হয় না, কিন্তু নিজস্ব একটা ব্যাকরণ তো থাকেই লেখার, রচনার মুহূর্তে, তা সেই মুহূর্তের মাপ  কয়েক মিনিট বা কয়েক বছর --- যা- হোক। আর শুধু মেঘনাদবধ বলছি কেনআমাদের সাহিত্যের হাজার বছরের যা নমুনা, তার একটা বড়ো অংশ  তো আশ্রয় করে আছে মুখ্যত অক্ষরবৃত্তেরই নানা ঘরানাকে। কয়েকটির সুর তুলে নিয়ে  পড়লেই তা ধরা পড়ে।


সব্যসাচী মজুমদার: সুমন গুণ কেবল কবি বললে ভ্রান্তি হয়। বাঙালির পাঠরুচি নির্মাণ করেন তিনি তাঁর সন্দর্ভে। লক্ষ করলে দেখা যায়,আপনি উপন্যাস বা ছোটোগল্পের বদলে প্রবন্ধের ওপর নির্ভর করলেন অধিক।কেন?

পাঠ ও পাঠকের সম্পর্ককে , দাদা,আপনি কীভাবে দেখেন?

এ প্রসঙ্গে গদ্যের ভাষা এবং কবিতার ভাষা সম্পর্কে আপনার দর্শন জানতে চাই।

  

সুমন গুণ:  এটা আমি আগেও লিখেছি যে গদ্য লেখার জন্য, গদ্যের দুর্লভ অন্তঃসঞ্চার নানাভাবে স্পর্শ করার জন্য আমার বিশেষ তাগিদ কাজ করে। আয়ুর বেশিটাই কাটিয়ে দিলাম হরেক মাত্রার গদ্য লিখে। বিশ্বসাহিত্যের বহু আরাধ্য কুশীলব, নোভালিস বা কোলরিজ, রবীন্দ্রনাথ বা সৈয়দ শামসুল হক গদ্যের এই সৃজনশীল আহ্বান টের পেয়েছেন। ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে চেনা একটি কবিতাকে নতুন করে বুঝতে চেয়ে গোটা একটা বই লেখা হয়েছে। রবার্ট ফ্রস্টের 'দ্য রোড নট টেকেন' কবিতাটি নিয়ে পেঙ্গুইনের ঐ নামেরই বইয়ে লেখক ডেভিড ওর দাবি করেছেন এতদিন ধরে আমরা কবিতাটি ভুল ভাবে পড়ছি। শুধু সাহিত্য নয়, আমি অন্যান্য বিষয়েও নানা সময়ে লিখেছি। বিশেষ করে ফিল্ম নিয়ে। ‘দৃশ্যের শিল্প’ নামে একটি বইও আছে আমার, সেইসব লেখা নিয়ে। ‘The third man’-এর পারমার্থিক শেষ দৃশ্যটির কথা মনে আছে? আমার দেখা কোনও ফিল্মের গভীরতম অন্তিম দৃশ্য। হঠাৎ কোনও খারাপ খবরের ধাক্কায় যখন বিপন্ন, তখন এই দৃশ্যটির বাঙ্ময় স্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি, কিংবা ফিরে যাই ‘Notorious’ আর ‘Spellbound’-এর শেষের ঠিক আগের হিরন্ময় দৃশ্যগুলোর দিকে। শিল্প আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার জীবনের দিকে ফিরিয়ে দেয়, লিখেছিলেন এক বিদেশি কবিতা-সংকলনের প্রাজ্ঞ সম্পাদক। কথাটার মানে টের পেতে পেতে সেলুলয়েডের এইসব আলোছায়াময় আহ্বানের কাছে মাথা নত করি। বুনুয়েল-এর The Exterminating Angel ছবিটি, আরও অনেক ছবির মতো, আমায় একটি কবিতা লিখতে প্ররোচনা দেয়। বিত্তবান একদঙ্গল মানুষ আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে, নৈশ সমারোহে। হুল্লোরময় কিছুক্ষণ পর তাঁরা টের পেলেন কেউই আর ফিরতে পারছেন না। ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছেন কেউ, কেউ এগিয়ে যাচ্ছেনও দরজার দিকে, কিন্তু রহস্যময় কোনও কারণে আবার দলে এসে ভিড়ছেন, বেরোতে পারছেন না। গোটা ছবিটি জুড়ে তারপর অসহনীয় এক পরিবেশে আমাদের ভেতরের সব বদ, অশিষ্ট, আত্মরতিময় প্রবণতা ডালপালা মেলে দিল।


এই প্রসঙ্গে আমার এক সুভদ্র কবিবন্ধুর বার্তা এখানে উদ্ধার করি : 'আপনার গদ্যভাষা এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোর একটি। আপনার গদ্যে শৈলী নিজেই একটি বিষয় হয়ে ওঠে, তারপর সেই গদ্যের বক্তব্যের দিকে নজর পড়ে। নতুন শব্দে, শব্দের নতুনতর ঘরানায়, সৃজনশীল মোচড়ে কি কাজ যে করে চলেছেন আপনি... ' ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব পড়ে উদ্বেল না হবার জন্য যে-পরিমাণ নিরাসক্তি জরুরি, আমার তা এখনও অর্জিত হয়নি, সবিনয়ে স্বীকার করছি। 

গল্প উপন্যাস লেখার আগ্রহ যে আমার একেবারে নেই তা নয়। কিছু লিখেওছি। এখনও লিখতে চাই, কিন্তু প্রবন্ধের টানে সে-সব আর হয়ে ওঠেনা তেমন।

 
তোমার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে বিশ্বসাহিত্যতত্ত্বের আন্দোলনের আভাস  আছে। এটা নিয়ে বহুদিন ধরে বহু আলোচনা হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে। পাঠক কীভাবে অংশ নিচ্ছেন লেখায়, তিনি  কখন নিজেই লেখক হয়ে উঠছেন, লেখক নিজেই পাঠককে কখন লেখক হয়ে উঠতে আহ্বান করছেন, সেসব নিয়ে চর্চা চলছে। এটুকু বলাই যায় যে, পাঠক আর এখন নিষ্ক্রিয় নয়। একটি নির্দিষ্ট পাঠ সম্পূর্ণ হয়ে উঠছে, সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে পাঠকের অংশগ্রহণেই।

  

সব্যসাচী মজুমদার: সম্প্রতি আপনার একটি সন্দর্ভগ্রন্হ প্রকাশিত। মূলত বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবির গদ্য সংকলিত হয়েছে সেই গ্রন্হে।তালিকাটি লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলা কবিতার বিশিষ্ট ও গদ্যে পরিচিত বেশ কিছু নাম অনুপস্থিত। বিতর্কিত এই তালিকার সম্পর্কে যদি আলোকপাত করেন।

   সুমন গুণ: বইটিতে নির্বাচিত কয়েকজন কবির গদ্য সংকলিত হয়েছে। আরও অনেকের লেখা গ্রহণ করা অবশ্যই যেত, কিন্তু আসলে বইয়ের কলেবর সীমিত রাখার লক্ষ্যেই অনেকের লেখা আমরা দিতে পারিনি। তবে এটুকু বলাই যায় যে, দুই বাংলার নির্বাচিত কয়েকজন কবি, যাঁদের গদ্য আলাদাভাবেই উল্লেখযোগ্য,  তাঁদের অনেকেরই লেখা এখানে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। শিল্পীবন্ধু পার্থ রায়ের প্ররোচনায় হয়ে-ওঠা এই সংকলন আমার গদ্যরচনার প্রতি মৌলিক  তাগিদেরই সম্প্রসারণ। মোটামুটি সত্তর পর্যন্ত দুই বাংলার কবিদের লেখা গদ্যের এই সংগ্রহে আমাদের ভাষার আরাধ্য কয়েকজন লেখকের ভাষার বৈচিত্র্যময় শৌর্য টের পাবেন পাঠক।

 

 


 শ্রী সুমন গুণ

 
লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী





লেখকের প্রকাশিত কিছু বইয়ের ছবি

 

 

...।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ