সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সোমা দত্ত:মুক্ত গদ্য:ক্যানভাস

 


ক্যানভাস

 

 

শরীর বিহঙ্গ। নবরস। অন্তরঙ্গ আলোছায়া। শরীরে বর্ষার ঘোর নিয়ে মেঘলা নদীটির পার ধরে ওই হেঁটে চলে অলীক কমললতা। পথে ছায়া পরে। ধূলি-ধূসরিত ক্যানভাসে গেঁথে যায় রঙের চেতনা। কাহিনির বিন্যাসে চরিত্র জন্ম নেয় শিল্পের বিমূর্ত অভ্যাসে। তার দুপায়ে ধাতু নির্মিত অলঙ্কার। গলায় হাঁসুলি, চুলে রুদ্রপলাশ। তার বন্ধনহীন বক্ষ উদার রৌদ্র মাখে তাঁতের শাড়ির মায়ায়। তার শাড়ির পার ধরে হরিণ ছুটে যায়। তার কাঁখে ও মাথায় কলসি। সে জল বয়ে নিয়ে যায় তার শরীরে। সে নিচু হয় তার শরীরের উপত্যকায় স্পষ্ট হয় গ্রামীণ অসন্তোষ। তার পুরু নিটোল মাংসপেশী শ্রমের অনুবাদ করে। মাটির গভীর থেকে তুলে আনা সেই জলে নির্দিষ্ট হয় তার স্নান। সে জলেই নির্দিষ্ট হয় পাক, সে জলেই নিবারিত হয় তেষ্টা এবং সে জলেই পরিপুষ্ট হয় প্রার্থনা ও পূজা। উঁচু নিচু খন্দের পথ। জল ছলকায়। কমললতার শরীরে ঢেউ ওঠে। জল পড়ে কাপড় ছাপিয়ে জেগে ওঠে বর্তুলাকার স্তন। তাঁতের শাড়ির ফুল আর পাতা লেগে যায় গায়ে। সুতোর অলঙ্কারে লেগে থাকে উন্মুক্ত কলঙ্কের কথা। সেবার জল হয়েছিল এমন যে গ্রাম ভেসে যায় স্রোতের অনুকূলে। এক বুক জল নিয়ে কমললতা তার গেরস্ত বাঁচিয়ে রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। ডুবো জলে দাঁড়িয়ে ছবি এঁকেছিল শহুরে মানুষ। ছবি আঁকার পর দেখা যায় ক্যানভাস জুড়ে শুধু একজোড়া স্তন। ওই স্তনজোড়ার নাম রাখা হয়েছিল কমললতা। কমললতা জানেনা ওই একজোড়া স্তন তার নাকি সে নিজে ওই এক জোড়া স্তনের। সে লজ্জা পেয়েছিল। ছবির অঙ্গ নিরাভরণ হয়ে ওঠায় তার শারীরিক শিহরন হয়েছিলনিজের প্রতি নিজের সংকোচআত্মসমাগম। সে তার মুখ ছুঁয়ে, হাত ছুঁয়ে পেট ছুঁয়ে পরিচয় খোঁজে বিমূর্ত ছবির কাছে। সে শিল্প জানে না। সে শুধু জানে তার একজোড়া স্তন বয়ে বেড়ায় তার সন্তানের খোরাক। সে জানে তার গায়ের রং কষ্টিপাথরের মতো কালো কিন্তু তার দুধের রং সাদা। সন্তানকে খাওয়ানোর সময় ওই সাদা স্বচ্ছ তরলের স্রোত যখন উপচে পড়ে কমললতার আনন্দ হয়। তার মনে হয় তার সন্তানদের শরীরের ভিতরকার সবকিছু স্বচ্ছ সাদা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তার সন্তানরা ধুয়ে যাচ্ছে পুণ্যস্নানে। জলের স্বচ্ছতায় সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তার ঘরের কুয়োর জলে বিষতার বাবা মা ভাইয়ের শরীর দগ্ধে উঠেছিল বিষ-জলে। কমললতা এখন জল আনতে যায় দূরের গ্রামে। লাল মাটির ভাঙাচোরা রাস্তা ডিঙিয়ে হাজার বছর ধরে জলের খোঁজে হেঁটে যায় সে। কুয়োয় বালতি ফেলে কপিকল ঘুরিয়ে জল তুলে আনে মাটির গভীর থেকে। দুটি কলসি কানায় কানায় ভরে তুলে নেয় মাথায় ও কাঁখে। সে ঘরমুখো হয়। আমি কমললতার শরীর ছুঁয়ে ফিরি সেই ছবিটির কাছে যে তাকে ছুঁয়েছিল। সেই ছবি এখন চিলেকোঠার ঘরে পুরনো ছবির ভিড়ে মিশে আছে ধুলো আর অন্ধকারের মেলবন্ধনে। হতে পারে কোনোদিন কেউ তাকে খুঁজে পাবে, হতে পারে কোথাও কোনোদিন কেউ আর খুঁজতে চাইবে না কিছুতেই কোনো কমললতার স্তন। ডাইনোসরের মতো সে হারিয়ে যাবে সভ্যতার প্রকোপে। শুধু যত কল্পিত রং, শুধু যত রাত জাগা কামুক ক্যানভাস নেশার ঝিল্লিতে তৈরি করবে কৃত্রিম শরীরের ঘ্রাণ। অথচ বৃষ্টি এবং ঝড়ের বিক্ষিপ্ত রাতগুলোতে সে জ্বলে উঠবে চোখের ভিতরে। আমিও ধারণ করব কমললতাকে। তুমিও খুঁজে পাবে হৃদয়ের ভিড়ে এক অপার বন্ধ্যাত্ব। মোমবাতির ছায়া কেঁপে উঠবে দেওয়ালের গায়ে। শীতের কম্বলের ভিতরে আমরা কমললতাকে খুঁজব। শরীরে শরীরে মূর্ত হয়ে উঠবে অশরীরী সাঁওতাল রমণী। কতদিন ধুলোর পথ পেরিয়ে সে চলে গেছে অচেনা নক্ষত্রপুঞ্জে শুধু জলের খোঁজে। শুধু জলের খোঁজে শুষ্কতা কৃত্রিম প্রসাধন মাখে। আমি দেখি সোনার প্যাকেটে মোড়া মূল্যবান রমণীর ত্বক। আমি দেখি উস্কো খুস্কো ময়লার কালো রং জুড়ে দুধ সাদা ফেনিল প্রপাত। আমি দেখি প্রগাঢ় অনুভব ঘেঁষে একদিন যৌনতা মায়ের শরীর হয়ে ওঠে। শিল্পের পাশ দিয়ে গলে যায় মাটির প্রতিমা। আমি দেখি মৌন শহরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যায় মাটি, বয়ে যায় কমললোচনা। শরীর মৃদঙ্গ, নৃত্য-গীত কলা। ক্যানভাস থেকে মুছে যাওয়া অনঙ্গ চেতনা।




 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ