ব্রহ্মপুত্রের তীরে
একাদশীর সকাল বড় বিষণ্ণ। যদিও উঠোনে সোনা রঙের রোদ পড়েছে, কিন্তু পড়ে থাকা বাঁশ,
হলুদ শালু বলে দিচ্ছে কে যেন চলে গেছে।এই যে বহু দিন ধরে বহু যত্নে একটি প্রতিমা
নির্মাণ করা হল, কত তার সাজ, কত তার আয়োজন, তাকে এমন অকাতরে বিসর্জন দেওয়া, সে কি এতই সহজ? এই নির্মাণ আর বিসর্জনের রীতিটি যাঁরা
বানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন বিল্বপত্রে সিঁদুরে লেখা একশ আট দুর্গা নামের মতো সূক্ষ্ণ
সঙ্কেতে জীবনের আসল সত্যটির ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়, মিছে
ভ্রম ভূমণ্ডলে’ ভূমণ্ডল! কি আশ্চর্য, এর মধ্যেই তো মণ্ডালাকার ইশারা। পশ্চিমের মতো
সরলরেখায় চলে না এই পূর্বের সময়। তা চলে চক্রাকারে, গোল হয়ে। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে
সুখানি চ, দুখানি চ। সুখের পর দুঃখ, দুঃখের পর আবার সুখ। আর তাই আমরা বিসর্জিত
প্রতিমাকে বলতে পারি ‘পুনরাগমনায় চ’ আবার এসো। আসছে বছর আবার হবে, আবার মাকে আসতে
হবে। অর্থাৎ এ এমন এক চক্র, যা কেবল ঘুরেই চলে, যার আদি নেই, তাই অন্তও নেই। এমনটা
হয় বলেই, ভাঙ্গা মণ্ডপ থেকে এক টুকরো শোলার কারুকাজ কুড়িয়ে মন খারাপ ভুলে হাসতে
পারে শিশুরা, কারণ সময় এখানে গোল হয়ে ঘুরছে। যা শেষ হয়ে গেল, তা আসলে শেষ হয়নি,
আসছে বছর আবার হবে।
আমরাও বিষাদ ভুলে বিজয়া সারতে বেরিয়ে পড়ি এক আত্মীয়ার বাড়ি।নাটকঘর লেন থেকে বেরিয়ে
বাঁদিকে রাস্তার ওপরেই বাড়ি। একটি একান্নবর্তী পরিবারে প্রত্যেকের ভাগে একটি করে
ঘর। সেই ঘরেই খাট, আয়না, টেবিল, কাচের শোকেসে তোলা বাসন, মেলায় কেনা পুতুল। আর
দেওয়ালে অকালপ্রয়াত গৃহস্বামীর ছবি। দুটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিদি অকূলপাথারে যে
পড়েননি, তা এই একান্নবর্তী পরিবারের জন্যেই। আবার এই সব পরিবারেই সবার জন্যে
বরাদ্দ ব্যবস্থার তলায় তলায় গোপন থাকে এক একজনের দীর্ঘশ্বাস। তাই তো সম্পন্ন
পরিবারের অকাল বিধবা বধূটি খুশি হয়ে উঠলেন আমার নিয়ে যাওয়া শাড়ির থেকেও বেশি মশলা
পাঁপড় আর সোয়াবিনের প্যাকেট দেখে। এইসব নাকি এখানে পাওয়া যায় না। তিনি না বললেও
আমি জানি, এই বিরাট পরিবারের সবাইকে খাইয়ে তিনি যখন খেতে বসেন, তখন ভাত আর ডাল
ছাড়া তাঁর জন্যে কিছু পড়ে থাকে না। তাই এই পাঁপড় পেয়ে তিনি খুশি। তিনি যে এটা চট
করে ভেজে নিয়ে ডাল দিয়ে কটা ভাত খেয়ে নিতে পারবেন।
আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দিদি বারবার উঠে যাচ্ছিলেন, মুড়ি আর চিঁড়ের মোয়া
বানানো হচ্ছে, সামনে লক্ষ্মী পুজো আসছে। সেই দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে বাবার বাড়ির লোক
কুটুমের আপ্যায়ন, হলই বা তারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে, ভালো দেখায় না। আমাদের জন্যে
মেলামাইনের প্লেটে মিষ্টি এল। এদেশে মেলামাইন খুব চলে। একটা বাজারই আছে যেখানে শুধু মেলামাইনের
বাসন বিক্রি হয়। শুনে শুনে ভেবেছি মেলামাইন বুঝি কোম্পানির নাম। কিন্তু তা না।
মেলামাইন আসলে নাইট্রোজেন বেসড একটা যৌগ, যা দিয়ে অনেক কিছু তৈরি হয়, যার মধ্যে
প্রধানত বাসনপত্র। আবার এর উল্টো উদাহরণ হচ্ছে জেরক্স, যা আসলে একটা কোম্পানির নাম, কিন্তু লোকের মুখের কথায় তা হয়ে
গেছে ফটো কপি করার সমার্থক। খেতে খেতে মুড়ির মোয়া পাক করার গন্ধ উন্মন করে দিচ্ছিল। খাওয়া শেষ
করে আমরা চললাম
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে।
‘বহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমা ইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জাঙপো নামে তিব্বতে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করে যখন এর নাম হয়ে যায় শিয়াং। তারপর আসামের উপর দিয়ে দিহাং নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে। ’
শরতে এখনো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কাশের দোলা। এইখানে বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের
দিকে তাকিয়ে থাকত টুনু। সে দেখত মুহূর্তে মুহূর্তে জলের রঙ বদলাচ্ছে। এই টুনুর
শান্ত স্বভাবের জন্যে বাড়িতে সবাই ডাকত ঠান্ডা মিয়াঁ বলে। বড় হয়ে সে হল বিশ্ব
বিখ্যাত শিল্পী, জয়নাল আবেদিন।
বাঁধানো পাড়ের পাশ দিয়ে সুন্দর রাস্তা। কাছেই কৃষি বিদ্যালয়, তাই বেশ কিছু ছাত্র
ছাত্রীকে চোখে পড়ছে। তার মধ্যে দুজনে কূজনের অভাব নেই। আশ্চর্য কি, এমন মনোরম
প্রেমের পরিবেশ যখন।
জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সত্যিই রঙের তফাত চোখে পড়ে। দূরে দূরে নৌকো, ওপারে
কাশ বন।
ময়মনসিংহ শহরের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে প্রায় ১২০০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখানে আছে আরও দুটি জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে হুমায়ুন আহমেদকে মনে পড়ছিল।তাঁর শিক্ষক
জীবন শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেমিস্ট্রি বিভাগে লেকচারার হিসেবে। তিনমাস এখানে
নিস্তরঙ্গ জীবন কাটিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এখানে তাঁরা কয়েকজন অধ্যাপক
মিলে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। একজন কাজের মেয়ে এসে ঘর ঝাড়ু, রান্নাবান্না করে দিয়ে
যেত। বিনোদন বলতে ছিল কাজের মেয়ের সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করা আর তাস খেলা। সেই পরিবেশে
হুমায়ুন আহমেদ হাঁপিয়ে উঠলেন বলা বাহুল্য। বিশেষ করে প্রতি রাতে এক অধ্যাপক এসে
বলতেন ‘আমার পাছায় লাথি কষান দয়া করে। আমি খুব পাপী’ তাঁর পাপের ফিরিস্তি শুনে বমি
আসত হুমায়ুনের। সেই গ্লানিময় পরিবেশ থেকে পালানোর জন্যে মাঝে মাঝে তিনি তাঁর
মেজখালার বাড়ি যেতেন। সেখানে তাঁর প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলত মফস্বলের আধুনিকারা,
যাদের আধুনিকতা মানে দুলে দুলে হাসা আর কথায় কথায় সরি বলা। যেমন ‘আপনি নাকি
রাইটার? আপনার কোন বই পড়িনি, সরি’
হুমায়ুন নিজেই বলেছেন ময়মনসিংহে তাঁর কোন অর্জন নেই, শুধু একটিমাত্র গল্প লেখা
ছাড়া। তার নাম সৌরভ।
সেইসব ভাবতে ভাবতে সূর্য মাথার ওপর চড়ে এল। বেশ গরম লাগছে, খিদেও পেয়ে গেছে, এবার
বাসায় ফিরতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ