মার্চমাসের চৈত্রসেল
চৈত্র
মাস,
মার্চের ট্যাক্সের হিসাব মেলাতে অনেকেরই অ্যাকাউন্টে টান পড়ে। সে
রাতে হঠাৎ করেই তিন-চার জন সহকর্মী তুহিন
বাবুর কাছে থেকে ফোন পেলেন। তুহিন বাবু একটা স্কুলে পড়ান। দুটো ধর্মীয়
অনুষ্ঠানের কারণে টানা তিন দিন স্কুল ছুটি ছিল। যাদের ফোনে বলতে পারলেন না তাদের মেসেজ করলেন।
কী বিষয় ? না, “ যদি সম্ভব হয়, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে দুই
হাজার টাকা পাঠাও।”
দুই হাজার টাকার পরিমানটা আজকের সময়ের জন্য
তেমন কিছুই নয়। বড় কোন বিপদে পড়লে এই টাকায় আর কতোটা হবে ! তবু দু হাজার টাকা।
আর সত্যি বলতে কী, সবাই যে এক কথায় রাজি হলেন তা নয়,
বরং অনেকে ভাবলেন, ফ্রড কল নয়তো… যাই হোক দেবেশবাবু টাকাটা পাঠিয়ে
দিলেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন দপ্তরে তার সহকর্মী সুচরিতা
দেবীকে। সুচরিতা দেবী কথাটি বিশ্বাস করে বললেন, তার নিজের
বান্ধবী শ্রাবন্তীকে। এবং অন্যান্যরা পরস্পরকে ফোন করে জেনে নিলেন যে, এরকম কোন ফ্রড কল
তোমার কাছে এসেছে কিনা ? পরদিন সকালে যখন কর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছলেন সাত আট
জন সহকর্মী তাকে ঘিরে ধরলেন।
প্রথম প্রশ্ন, আচ্ছা তুমি কি
টাকা চেয়েছিলে ? দ্বিতীয়
প্রশ্ন, এমন কি হলো যে মাত্র দুই হাজার টাকার জন্য এত লোককে
ফোন করলে, মেসেজ করলে ? তুহিন বাবু বুঝলেন, ঘটনাটা
সবাই শুনতে আগ্রহী এবং তিনিও মনে মনে বেশ কৌতুক অনুভব করলেন। যারা শুনতে চান, একসঙ্গে সবাই গোল হয়ে বসুন।
একবারই মাত্র বলবো। ঘরের গল্প তো, বেশি বলা যাবে না। প্রিভেসি রাখতে হবে।
–গতকাল সকাল থেকেই বাড়িতে
জোর লড়াই চলছে চৈত্র সেলের কেনাকাটা করতে যাবেন। স্ত্রী প্রথমে শুরু করলেন দুই
সন্তানকে নিয়ে। মেয়েদের এখন আর আমি নিজের হাতে কিছুই কিনে দিই না। সবই সে
কিনে দেয় । আগে গাল ফুলিয়ে কথা
বলত। এখন জিভে ধার হয়েছে। তাই শুনলাম –”টাকা চাইলেই শুনি
টাকা নেই। কোথায় টাকা যায়, আমি বুঝি না !”
মনে মনে ভয় পেয়ে গেলাম। নতুন কি কেউ আমাকে
ফাঁসিয়ে দিল ? আমি তখন দুই
হাজার টাকা ট্রান্সফার করে বললাম, যাও দুই মেয়েকে নিয়ে
বাজার করে এসো। একথা শোনার পরে শুরু হলো
দ্বিতীয় ভাগের তাণ্ডব। ওই টাকায় কি হবে ? ঐটুকুন টাকা তো দুই মেয়ের দুটো জামা কিনতেই শেষ হয়ে
যাবে। আমি তো আর মানুষ না… আমার তো আর কিছু লাগে না… আমার শখ আহ্লাদ নেই। সোনা
দানা না কিছু পাইনা। আর চাইও না ।
দাম্পত্য আলাপ একসময় চরমে পৌঁছেছে তখন স্ত্রী বললেন,
ঐ টাকা দিয়ে আপনারই মেয়েদের জন্য কিছু কিনে দেবো। আর এখানে
থাকার ইচ্ছা আমার নেই। যে ইচ্ছে মনে পুষে
রেখেছেন, আমি গেলেই ডাইনিকে এনে সুখের সংসার বসাবেন, সেই শখ পূরণ করে দেবো। যেখানে আমার সম্মান নেই, দাম
নেই, সেখানে থেকে কী হবে ?
আমিও একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, –যাওয়ার ইচ্ছা যাও/ চাইলে নতুন গাছে বানতে পারো নাও।আরো বললাম, দুই হাজার টাকার জন্য চৈত্র মাসের এই এমন টানাটানির মধ্যে যে এমন করে,
আমারও তার সঙ্গে থাকার ইচ্ছা নাই। ব্যাস , বাতাস পেয়ে সে
ঝগড়ার আগুন দাম্পত্যের সব সুতো পুড়িয়ে দিল।
( তুহিন বাবু দাম্পত্য সম্পর্ক
নিয়ে মাঝে মাঝে জঘন্য মজা করেন, এবং ভারতীয় সাত জন্মের
দাম্পত্যের নিষ্ঠুর সমালোচনা করেন। )
তুহিনবাবুর
গল্প বলার ঢঙে যখন গল্প যখন ক্লাইম্যাক্সে প্রায়, সবাই প্রায়
একসঙ্গে একটা গভীর প্রশ্ন করলেন
– তার, আপনার
স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে গেল ?
শ্রোতাদের দুটো শ্রেণি : যারা মনে করেন, তাদের দম বা পতি যোগ্য হয়নি তারা সাগ্রহী, এবং যারা
নিজেকেই শ্রেষ্ঠ যোগ্য দম বা পতি মনে করেন, তারা অতি আগ্রহী।
তুহিনবাবু একটু সময় নিলেন। একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছাদের দিকে একটা পেটমোটা টিকটিকির
উপর দৃষ্টি গেঁথে রেখে, সুনীল গাঙ্গুলির কবিতার মতো আবৃত্তি
করলেন –
”কেউ কথা রাখে না”
0 মন্তব্যসমূহ