ঘড়ি
খানিকটা বিফল মনোরথ হয়েই শো-রুম থেকে বেরিয়ে
আসছিল সমীরণ। শহরের সব কেতাদুরস্ত, ঝাঁ চকচকে দোকান, শপিং
মল..নামীদামী দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের ঘড়ির সম্ভার সাজিয়ে বসে আছে ...অথচ কোথাও
গিয়ে কাজ হলো না। একটা জিনিসকে বগলদাবা করে অফিস ফেরতা আর কতোই বা চড়কি পাক খাওয়া যায়।
পার্কিং লট এ গাড়িটা রাখা ছিল। বাড়ি ফিরবে বলে শো রুমের সামনে
রাস্তাটা ধরে কয়েকপা এগোতে গিয়ে হঠাৎই পাশের একটা দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে অন্যমনস্কভাবে চোখটা
চলে যেতে থমকে দাঁড়াল সমীরণ।
শোরুম ক্রস করে একটা হার্ডওয়্যার শপ্ আর একটা মুদিখানা। তার ঠিক গা
ঘেঁষে পুরনো আমলের একটা দোকান চোখে পড়ে। কতো পুরনো সেটা সাইনবোর্ডের ধূলো ময়লা পরা চেহারা দেখলে বেশ ভালোই আন্দাজ করা
যায়। বোর্ডের গায়ে লেখা আবছা হয়ে আসা অক্ষরগুলো কাছ থেকে না দেখলে হয়তো পড়াও যেতো
না..' মডার্ন ওয়াচ হাউস। এখানে নামীদামী সব ব্র্যান্ডের ঘড়ি
যত্ন সহকারে বিক্রয় ও মেরামত করা হয়। '
একবার ঘুরে দেখবে নাকি? কি মনে করে দোকানটার
দিকে এগিয়ে গেল সমীরণ।
ভেতরে না আছে খদ্দের, না দোকানদার। রং চটা,
ঝুল পরা,
স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। আদ্দিকালের কাঠের ফ্রেমওলা কাঁচের শোকেসে
সাজিয়ে রাখা বেশ কিছু পুরনো আর খানকতক নতুন ঘড়ি। একটা বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলছে
দেওয়ালের হুক থেকে। পাশে স্ট্যান্ডওলা ছোট্ট কাঠের শেল্ফে মালা পড়ানো গণেশের মূর্তি। দোকানের এই
দৈন্যদশাগ্রস্ত চেহারা দেখলে কাজ তো পরের কথা, ভক্তিটুকুও
বুঝি উবে যায় নিমেষে।
বিরক্তির সাথে ফিরে যাবে কি যাবে না ভাবছিল সমীরণ, হঠাৎ দোকানের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে চোখের দৃষ্টিটা যেন নিবদ্ধ হয়ে
গেল তার। ওপাশে
পেছনের শোকেসে পর পর সাজানো বেশ কিছু পুরনো ঘড়ির মাঝে কিছুটা কোণের দিকে যে দেওয়াল ঘড়িটা রাখা রয়েছে, হুবহু একই রকম দেখতে একটা ওয়াল ক্লক ব্যাগে করে
নিয়ে সে যে নিজেও ঘুরে বেড়াচ্ছে! অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সমীরণ। সেই নকশা করা কাঠের ফ্রেম...ঝকঝকে বার্ণিশ..রোমান হরফের এক,দুই সংখ্যা.. পেন্ডুলামের রূপোলী ছটা..এমনকি ঘন্টা, মিনিটের সোনালি রংয়ের কাঁটাদুটোর ডিজাইন পর্যন্ত.. কোথাও
যেন এতটুকু পার্থক্য নেই, হাতপাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা
সমীরণের চোখে!
'কিছু বলবেন দাদা? '
' কে?'
গলার আওয়াজে চমকে ফিরে তাকালো সমীরণ।
দোকানের একেবারে কোণে একটা ফালি মতো ঘর। বাল্ব জ্বলছে। আওয়াজটা এলো
সেদিক থেকেই।
খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা, গাল তোবড়ানো, দড়ি পাকানো চেহারার একটা আধবুড়ো লোক গুমটি ঘরের দরজা দিয়ে সুরুৎ করে
বেরিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
' হ্যাঁ একটু কথা ছিল। '
' ভেতরে আসুন।'
স্যাঁতস্যাঁতে ড্যাম্প ধরা গন্ধ এদিক সেদিক। গণেশের গলায় জড়ানো
রজনীগন্ধার নিজস্ব সুবাস কিছু থাকলেও তা প্রায় ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মাথার ওপর কোন্
যুগের একটা লোহার সিলিং পাখা ঘরঘর শব্দে শম্বুক গতিতে ঘুরে চলেছে, এই বুঝি ভেঙে পড়ে। পাখাটা থেকে কিছুটা তফাতে সরে দাঁড়ালো সমীরণ।
আরো একবার চোখ পড়ে গেল খুব কাছে,শোকেসের ঐ
নির্দিষ্ট কোণে। 'ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ করপোরেশন ' হারিয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত জার্মান কোম্পানির নামটুকু দূরত্বের কারণে বোঝা
না গেলেও ডায়ালের গায়ে লেখা ক্ষুদে ক্ষুদে হরফের ইটালিক্স স্টাইলের অনবদ্য সাজুয্য
সমীরণের মনে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখলো না, যে এই ঘড়িটাই
আসলে তার সেই...।
লোকটা একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বললো,' বসুন। বলুন এবার..।'
' একটা পুরনো দেওয়াল ঘড়ি,মানে গ্র্যান্ডফাদার
ক্লক.. অনেক দিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। নিয়ে এলাম, একটু
যদি..। '
' কই দেখি।'
ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করে প্যাকিং কাগজটা খোলা মাত্রই কুতকুতে
চোখদুটো আশ্চর্য রকম গোলগোল করে তাকিয়ে রইলো লোকটি।
' এ জিনিস পেলেন কোথায় বলুন তো? আমার কাছেও
আছে এক পিস..ঐযে, ঐ দেখুন। আজ অবধি একেবারে সচল।'
ঘড়িটাকে ঘিরে অনেকক্ষণ ধরে যে চাপা কৌতুহল আর জিগ্গাসাটা মনের মধ্যে
ঘোরাঘুরি করছিল সমীরণের,এবার এই সুযোগে সেটা আর না বলে থাকতে
পারলো না।
' ঘড়িটা কার? মানে আপনারই কি...?'
' না,না ও আমার নয়। বলতে পারেন একজন রেখে
গেছে। সে অনেক কাহিনী...।'
এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না লোকটি। জানার আগ্রহ হলেও একজন অচেনা,
অজানা লোকের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক না।তাই সমীরণও
প্রসঙ্গ পালটে বললো,
'এ ঘড়ি আমার ঠাকুর্দার আমলের।
বহুদিন দম দেওয়া হয় নি। একদিন দেখি সত্যি সত্যিই আর কাজ করছে না। এ দোকান সে দোকান
ঘুরেও কিছু লাভ হলো না। পাশের শোরুমে তো বলেই দিল, "পার্টস
পাওয়া যাবে না। অ্যান্টিক হিসেবে সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই..। "
ঘড়িটা ততক্ষনে হাতে নিয়ে নিবিষ্ট মনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন দেখছিল
লোকটা।
সমীরণ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে মুখের দিকে। হয়তো উত্তরের অপেক্ষায়।
শেষরক্ষা হবে কিনা কে জানে।
' কতদিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে? '
ভুরু কুঁচকে তাকায় লোকটি।
' তা বছর সাত আট..।'
' বলেন কি! নেগলিজেন্স..! এ জিনিসের কদর বা মূল্য যাই বলি না কেন,
বোঝেন কি?"'
কথাটা যেন খট করে এসে বিঁধলো সমীরণের মনে। যতই শুনতে খারাপ লাগুক,
'নেগলিজেন্স' শব্দটাকে এই মূহুর্তে সে কীকরেই
বা অস্বীকার করবে?
সুলতা নেই আট বছর হয়ে গেল। এবার ছুটিতে বাড়ি এসে অর্ঘর চোখে যদি না
পড়তো,তাহলে হয়তো আরো কতদিন যে অযত্ন আর অবহেলায় ঘরের বাঙ্কে
ঐভাবে পড়ে থাকতো ঘড়িটা...! তারওপর দূরে পোস্টিং হবার পর থেকে ইদানীং বাড়ি থেকে
বেরোনো আর সময়মতো ট্রেন ধরা.. দুটো ব্যাপার এতো তাড়াহুড়ো করে ম্যানেজ করতে হচ্ছে
যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ঘড়ি নামক বস্তুটার প্রয়োজনীয়তা গত কদিন ধরে
রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করছে সমীরণ। তার একটা বড় কারণ, ঘরের
ইলেকট্রনিকস ডিজিটাল ক্লকটার হঠাৎ করেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। কাঁহাতক আর মোবাইল
এ টাইম দেখতে দেখতে ছুটে যাওয়া যায়। ছেলের মন রক্ষা আর নিজের প্রয়োজন, দুটোই যেন আজ এখানে চলে আসার মূলে..।' ভাবলো সমীরণ।
'একটু বসুন। ভেতরকার কলকব্জা খুলে
দেখতে হবে। তবেই বলতে পারবো সারানো যাবে কি যাবেনা..।'
বলতে বলতে লোকটি ঘড়িটা নিয়ে গুমটি ঘরটাতে আগের মতো সুরুৎ করে ঢুকে
পড়লো।
ফিরে এলো মিনিট দশেক পর। মুখে হাসি।
' এ যাত্রা রক্ষা পেলেন বোধহয়। বিশেষ কিছু হয় নি। স্প্রিং হুইলটা
বসে গেছে। অয়েলিং করতে হবে। আসা করি তাতে রোগ সেরে যাবে। তবে হ্যাঁ, পুরনো আমলের জিনিস..হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি কি আর দেওয়া যায়..চলুক,কদিন দেখুন, তাহলে বোঝা যাবে। আর এ ভুল করবেন না। দম
দেবেন মনে করে। আর কিছুদিন দেরী করলে এ ঘড়ি হয়তো মিউজিয়ামেই পাঠাতে হতো..।'
' অনেক ধন্যবাদ। ' হেসে বললো সমীরণ। কেন জানি
না ভেতরটা বেশ হালকা লাগছে।
' পাশের ঐ শোরুমে কীযেন বলেছিল আপনাকে? পার্টস
পাওয়া যাবে না? তাহলেই বুঝুন!’
কথাটা বলার পর কিরকম যেন অনমনস্ক হয়ে যায় লোকটি। মুখের সেই হাসিটুকু ম্লান হয়ে আসে। দোকানের চার দেওয়ালের
দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বলে,
' কি আর বলবো দাদা, বাপের কিছু সম্পত্তি ছিল।
যখন ঐ পুঁজি নিয়ে,কাজ শিখে ব্যাবসায় নামি, এ তল্লাটে হাতে গোণা দুএকটা ঘড়ির দোকানের মধ্যে আমার একটা। অ্যাংলোসুইস
ঘড়ি এ অঞ্চলে আমিই প্রথম দোকানে রাখতে শুরু করি। বেশ ভালোই চলছিল ব্যাবসা। কালে
কালে একটু একটু করে সবকিছু কিরকম বদলে যেতে শুরু করলো। বাহারি সব দোকানপাট,
ঝাঁ চকচকে শপিং মল, বিরাট বিরাট ফ্ল্যাট
বাড়ি.. বড় বড় লোকের বড় বড় চাহিদা... কম্পিটিশনের চক্করে পড়ে আর পুঁজি লাগাতে
পারলাম না। একদিন দেখি আমার দোকানের নাকের ডগায় এই শোরুম খানা কবে যেন গজিয়ে
উঠেছে। আর আমি পড়ে রইলাম ঘুঁজির মধ্যে..। কপাল ছাড়া কি বলবো বলুন..। লোকে গিয়ে ভীড়
করবে বাহারি সব ফ্যাশানের দোকানে। অ্যাংলোসুইস ঘড়ির সে কাহিনী শুনলে ভাববে গল্প
আওরাচ্ছি...। ’
ছায়া যেমন আলোর পাশে ঘোরাঘুরি করে, কথা বলতে
বলতে সেরকমই একটা আলোর আভা এবার যেন ছলকে উঠলো তার চোখে মুখে।
' তবে সবাই নয়। বাঁধাধরা কিছু খদ্দের, এ
দোকানের পুরনো
কাস্টমার..তারা জানে এই কামাখ্যা সাঁতরার হাতযশ এখনো কথা বলে। যেটুকু করে কম্মে
খাচ্ছি, তা এই হাতের গুণেই আর এককালের জমানো সেই কিছু লাভের
কড়ি. ..। ঘড়িটা সারাই হলে পর একবার পাশের শোরুমে গিয়ে দেখিয়ে আনবেন। ওটাই ওদের
যোগ্য জবাব। যাক গে, তাহলে পরশুদিন আসুন। এরকমই বিকেলের দিকে।
মাল রেডি হয়ে যাবে। অনেক কথা বলে ফেললাম। '
সমীরণ শুনছিল বসে। দোকানদার নয়। একজন মানুষের কাহিনি। তার
উত্থান-পতন, অধোগতি, নিম্নগতি যাই বলা
যাক না কেন..। চোখের সামনে দেখছিল নিজের পালটে যাওয়া শহরটাকেও যেন।
পরশু বিকেল.. ছুটির দিন। ভালো। একফাঁকে এসে ঘড়িটা নিয়ে যাবে সে।
মনে মনে ঠিক করে নিল সমীরণ।
' কত দিতে হবে?' জিজ্ঞেস করলো সমীরণ।
' বেশি না একশো। ঐ মজুরি টুকুই। অন্য দোকান হলে যেমন তেমন একটা কিছু
করে দিয়ে দাঁও মেরে নিত।'
বেশ অবাকই হয়ে গেল সমীরণ। মাত্র একশো!এর তিনগুণ বেশি দাম চাইলেও
হয়তো সত্যিসত্যিই কিছু বলার ছিল না।
সে যাই হোক, কামাখ্যা সাঁতরার হাতযশ কথা বলবে কি বলবে না সেটা হয়তো সময়ই বলবে। তবু আর
যাই
হোক্ এতো ঘোরাঘুরি করে শেষমেশ কাজটা তো হলো..কথাটা অর্ঘকে একবার ফোন করে
না জানালেই নয়, মনে হলো সমীরণের।
রাত বেশ গভীর। সারা পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
স্ট্রীট লাইটটাও আজ আর জ্বলছে না। ফুরফুরে হাওয়া আসছিল সমীরণের দোতলার ঘরের খোলা
জানলা দিয়ে। তবু ঘুম আসছিল না যেন। সন্ধের পর বন্ধু বিনয় এসেছিল বাড়িতে। গল্পে
আড্ডায় হুইস্কির মাত্রাটা হয়তো খানিকটা বেশিই হয়ে গেছে। তারই হ্যাংওভার নয় তো? দূর,তা কি করে হয়। মদের
গ্লাসে অভ্যস্ত একাকিত্বের জীবন তার কাছে তো আর নতুন কিছু নয়। তাছাড়া বিনয় চলে গেছে,
সে বহুক্ষণ হয়ে গেল।
এক গ্লাস জল খেয়ে আবার বিছানায় এলো সমীরণ। পাশের মাথার বালিশটা
এইভাবেই পরিপাটি করে রেখে দেয় সে,রোজ। সুলতা নেই আট বছর হয়ে
গেছে। রাখা আছে শুধু একরাশ স্মৃতি। আর ওর এই খালি বালিশটা। নীচের একতলায় বাবা
মায়ের ঘরখানা সেও আজ শূণ্য। একমাত্র ছেলে অর্ঘ কানপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। এ
বাড়িতে সমীরণ এখন একা। ভীষণভাবে একা।
সামনে গুহবাবুদের বাড়ির দোতলার ঘরের আলো এইমাত্র নিভে গেল। দূর
আকাশে দুটো একটা তারা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার যেন গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে চারিধারে।
কাছেপিঠে কোথাও
একটা কুকুর কেঁউকেঁউ করে ডেকে উঠলো, নাকি কেঁদে উঠলো বোঝা
গেল না।
ঢং..ঢং..ঢং...ঢং..।
অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে যেন চমকে দিল হঠাৎ আওয়াজটা! আবার সব চুপচাপ।
শুধু দেওয়ালে টাঙানো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পেন্ডুলামের একটানা টিকটিক শব্দ ক্রমশই
যেন নিঝুমতাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর থেকে আরো গভীরে..।
কামাখ্যা সাঁতরার হাতে বার্ণিশ করার পর যেন আরো ঝকঝকে হয়ে উঠেছে
ঘড়িটা। জ্বলজ্বল করছে মেহগনি কাঠের ফ্রেম, সময়ের কাঁটার
সোনালী আভা, পেন্ডুলামের রূপোলী ঝলক...।
সমীরণের কেন জানি না মনে হলো, বহুবছর পর নিস্তব্ধ
রাত্রে ফিরে আসা এই অনভ্যস্ত 'টিকটিক 'শব্দের
অস্তিত্ব.. এটাই কি তাহলে দিচ্ছে না দুচোখের পাতা এক করতে? আস্তে
আস্তে হয়তো সময় আবার নিজের করে নেবে সবকিছু। যেমনভাবে ঘড়িটাকে নিজের করে নিয়েছিল
সুলতা।
ভাবতে গিয়ে অনেক বছর আগেকার একটা স্মৃতি যেন ঝলক দিয়ে উঠলো ডায়ালের
কাঁচে...। বাবা তখন সদ্য মারা গেছেন। এ ঘড়িটা তখনো পর্যন্ত বাবার ঘরেই রাখা থাকতো।
একদিন টুলে উঠে অভ্যাসমতো ঘড়িটা ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে হঠাৎই চমকে ওঠে সুলতা।
' এই দ্যাখো দ্যাখো..!'
সমীরণ কাছেই ছিল। ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে আসে।
'কী হয়েছে? '
সুলতার চোখ ডায়ালের কাঁচে নিবদ্ধ।
' বাবা!বাবার মুখটা ভেসে উঠলো ঘড়ির কাঁচে! আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
যেন কিছু বলতে চাইছেন..! '
কথা বলতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল সুলতা। নিঃশ্বাস ফেলছিল জোরে জোরে।
ওর হাতখানা জড়িয়ে ধরে সমীরণ।
' কী বলছো এসব?'
'অবিকল বাবার মুখ! '
দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল সুলতার।
সেদিন ওকে অভয় দিয়েছিল সমীরণ।
' ওরকম মনে হয়। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। '
সেই সুলতাও একদিন চলে গেল। বিদায় নিল এ বাড়ি ছেড়ে, এ সংসার ছেড়ে,
সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে। একা করে দিয়ে গেল সমীরণকে..।
বাড়ি এসে ছেলে সেদিন নীচের ঘরের স্টোররুমের বাঙ্কে কি একটা খুঁজতে গিয়ে
হঠাৎই আবিষ্কার করে জিনিসটা।
' বাবা, এটা দাদামশাইয়ের সেই ঘড়িটা না! এ বাবা
এতো পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! '
সমীরণ নিজেও ভুলে গিয়েছিল ঘড়িটার কথা।মা, বাবার
অবর্তমানে সুলতা রোজ মনে করে দম দিত ঘড়িটাতে। ঝাড়পোঁছ করতো। ও চলে যাবার পর আর
সেভাবে যত্ন নেওয়া হয়ে ওঠে নি জিনিসটার প্রতি। একদিন অজান্তে সেই যে চলৎশক্তিহীণ
হয়ে পড়ে, আর কিছু করা যায় নি কিংবা মেকানিক ডেকে সারাবার
চেষ্টাও করা হয় নি।
কাজের লোক রামুকে দিয়ে নিজেই একসময় স্টোর রুমের বাঙ্কে ঘড়িটা
তোলাবার ব্যবস্থা করেছিল সমীরণ।
' এতদিনে সত্যিসত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম রে! আসলে সবই তো জানিস,
তোর মা মারা যাবার পর এতটাই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে
হয়েছিল যে, এসবের প্রতি যত্ন বা খেয়াল রাখার মতো
মানসিকতাটুকুও তখন আর ছিল না।' ছেলেকে বলেছিল সমীরণ।
অর্ঘ একটু
চুপ করে থেকে বলেছিল, ' আমি তো বেশ কয়েকবার দম দিয়ে দেখলাম।
চললো না। একটা
কাজ করবে বাবা, ঘড়িটা ইমিডিয়েট ভালো কোনো দোকানে সারাই করতে
দিলে কেমন হয়? আজ বৃহস্পতিবার। বাজার বন্ধ। ছুটি থাকলে আমি
কাল নিজেই..। ''
' না,না তোকে যেতে হবে না। আমি দেখছি কী করা
যায়..।'
' হ্যাঁ,তাই কোরো। কতদিনের ঘড়ি! দাদামশাইয়ের
স্মৃতি জড়ানো.. মা, ঠাকুমার হাতের যত্ন..।'
জিনিসটা চোখে পড়তে আজ অবাক হয়ে গিয়েছিল বিনয়ও।
' আই সী, লং ইয়ার্স এগো এ ঘড়িটা যেন এ বাড়িতেই
দেখেছি! মেশোমশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে..।'
হুইস্কির গ্লাসটা টেবিলের একপাশে রেখে ভালো করে তাকিয়ে দেখছিল বিনয়
ঘড়িটার দিকে।
' ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ করপোরেশন..! রিসেন্টলি একটা বিদেশি জার্নালে
আর্টিকেল দেখেছিলাম, ফর্টির মিডলেই ওয়াল্ড ফেমাস এ কোম্পানি
উঠে যায়। সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ারে জার্মানী ডিফিটেড হলো। ফিনানশিয়ালি একটা বিরাট
সেটব্যাক! ওয়াচ কোম্পানির মনোপলি ব্যাবসা সেইসময়েই ফেল করলো। পরে আর প্রোডাকশান
হয়নি, যদ্দুর জানা যায়। ভেরি প্রেশাস থিংস! নতুন করে দেখছি
যেন..। এতদিন জিনিসটা কোথায় ছিল বলতো?'
'পুণর্জন্ম হয়েছে বলতে পারিস।' হেসে বলেছিল
সমীরণ।
গোল গোল চোখ করে কামাখ্যা সাঁতরা বলে উঠেছিল, ' এ জিনিস পেলেন কোথায় বলুন তো? আমার কাছেও এক পিস আছে..ঐ যে ওখানে..। 'ভদ্রলোকের এক পিস ওয়াল ক্লকের পেছনে কোন্ অজানা কাহিনী লুকিয়ে রয়েছে,
সমীরণ জানে না। হয়তো জানতে পারবেও না কোনোদিন..। কিন্তু যা সে জানে,
সে ইতিহাস যে বিরাট। বিস্তৃত। 'দাদামশাইয়ের কত
স্মৃতি.. মা,ঠাকুমার হাতের যত্ন...।’
একাকি, নিভৃতে, নির্ণিমেষ
চোখে সমীরণ তাকিয়ে থাকে ঘড়িটার দিকে। সময়ের কাঁটা ক্রমশই তাকে যেন হাত ধরে টেনে
নিয়ে চলে দূরে..বহু দূরে এক স্মৃতিমেদুর, বিরাট বিস্তৃত
ইতিহাসের জগতে...।
ঘটনাগুলো পরবর্তী কালে বাবার মুখে শুনেছিল
সমীরণ। এসব তার জন্মের বহু আগের কথা।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মানি একই সঙ্গে পূর্ব আর পশ্চিম
রণাঙ্গনে পাল্লা দিয়ে লড়াই করতে গিয়ে ক্রমশ পিছু হটছে মিত্রপক্ষের কাছে। ভারত সহ
পৃথিবীর একাধিক দেশ কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধে। কলকাতা সহ বিভিন্ন
অঞ্চলে একের পর এক গড়ে উঠতে শুরু করেছে সামরিক শিবির, সেনা
ছাউনি। খবরের কাগজের ছত্রে ছত্রে শুধু ধ্বংসলীলা, যত্রতত্র
পরে থাকা মানুষের বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া লাশ,হাহাকার আর
আর্তচিৎকারের করুন দৃশ্য। সংবাদ শিরোনামে বড় বড় আকারে লেখা..' ওয়ার নিডস ইউ। ওয়ার নিডস ডক্টর।'
সমীরণের ঠাকুরদা রামরতন মিত্র তখন ছিলেন কলকাতায় সরকারি হাসপাতালের
কর্মরত চিকিৎসক। একদিন বছর চব্বিশ পঁচিশের একটি ছেলেকে গুরুতর আহত অবস্থায় সেখানে
নিয়ে আসা হলো। জানা গেল, সেই ছেলেটি বিহারের জগদীশপুরের
জমিদার কুনওয়ার সিংয়ের উত্তর পুরুষ উধম সিংহের একমাত্র পুত্র রজবীর সিং। রাস্তা
দিয়ে যেতে গিয়ে ঘটনাচক্রে বোমার আঘাতে মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছে সে। তার আশংকাজনক
অবস্থার কথা চিন্তা করে পুর্ণিয়ার হাসপাতাল থেকে কলকাতায় রেফার করা হয়েছে। ছেলেটির
চিকিৎসার ভার পড়লো ঠাকুর্দার ওপর। অচৈতন্য রজবীরের বাঁচার আশা প্রায় ছিল না বললেই
চলে। তার অসহায় বাবা এসে হাতে পায়ে ধরলো ছেলের প্রাণভিক্ষার জন্য।
উধম সিংহের পূর্বপুরুষ কুনওয়ার সিং এককালে
সিপাহি মিউটিনিতে যোগদান করে আরা নামক স্থানে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করা
স্বত্তেও মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে শেষকালে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর থেকেই জগদীশপুরের
সে রাজপুত পরিবারের জমিদারি প্রভাব প্রতিপত্তি অবলুপ্তির পথে চলে যেতে থাকে। উধম
সিংহের শরীরে বনেদি রক্তটুকু থাকলেও জগদীশপুরে কুনওয়ার সিংহের সে প্রাসাদ তখন
ব্রিটিশ অধীকৃত সম্পত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। আর উধম সিং নিজে তাঁর পূর্বপুরুষের
জন্মভূমি সাহাবাদ (বর্তমানে ভোজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) গ্রামের এক নিতান্ত ছাপোষা, সাধারণ মানুষের মতো দিন যাপন করছেন।।
যাই হোক, টানা কুড়ি পঁচিশ দিনের অক্লান্ত
প্রচেষ্টায় শেষমেশ রজবীরকে বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হলেন ঠাকুরদা রামরতন।
মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেকে ফিরে পেয়ে, ঠাকুর্দার কৃতিত্বে মুগ্ধ
হয়ে উধম সিং নিজের পছন্দের কয়েকটি জিনিস তাঁর হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিয়ে
বলেছিলেন, 'এগুলো আমার পরিবারের এখনকার সম্পদ। যেটুকু বেঁচে
আছে, তার মধ্যে থেকে সেরাটা তোমাকে দিলাম। তুমি আমার ছেলের
প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছো। এর থেকে বড় উপহার আমার কাছে আর কি ই বা হতে পারে..।'
ঠাকুরদাকে দেওয়া সেই উপহারগুলির মধ্যে ছিল, মধ্যএশিয়ান
মার্বেলে তৈরি গ্রীক দেবতা জিউসের একটা সাড়ে তিন ইঞ্চির মূর্তি, একটা ইটালিয়ান সুরাপত্র, এলিজাবেথীয় যুগের অপুর্ব
সুন্দর কারুকার্য মন্ডিত শ্বেতপাথরের ফুলদানি, বিদেশ থাকা
আনা কিছু চোখ ধাঁধানো আর্টিফিসিয়াল ফুলের তোড়া আর তার সঙ্গে আজকের এই ওয়াল ক্লকটা...।
সেই ঘটনার পর উধম সিংহের সঙ্গে ঠাকুর্দার একটা
অন্যরকম সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উভয়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার পত্র বিনিময়ও হয়েছে।
তারপর হঠাৎই একদিন উধম সিং মারা যান। ফলত যোগাযোগের রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে যায়।
ঠাকুর্দাকে দেওয়া উধম সিংহের উপহারগুলোর মধ্যে কিছু কিছু জিনিস
দেখার সৌভাগ্য সমীরণের যে হয়নি তা নয়। তার তখন খুবই অল্প বয়স। বাবার ছিল ট্রান্সফারেবল জব। জীবনের শেষ
বয়সে এই ব্যারাকপুরে এসে বাড়ি করে সেটল হন তিনি। ঠাকুর্দারও ছিল বদলির চাকরি। বাপ, ঠাকুর্দার ঘন ঘন পোস্টিং, তার
জেরে বাড়িবদল..টানাপোড়েন.. এইসব কারণেই মূল্যবাণ জিনিসগুলো জীবনের বিভিন্ন সময়ে
এদিক ওদিক হয়ে হারিয়ে যায়। তা নিয়ে আক্ষেপের শেষ ছিল না বাবার। সেইসব
চিঠিপত্রগুলোও কখন,কিভাবে যে চোখের আড়াল হয়ে যায় তা জানারও
আজ আর কোনো উপায় নেই। শুধুমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে সেদিনের সেই দেওয়াল
ঘড়িখানা..কত দিন,কত কাল,কত জানা অজানা
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ঠাকুর্দাকে দেখার সৌভাগ্য সমীরণের হয়নি। শুনেছে বহুবছর আগে
বাড়িতে তাঁর একটা ছবি ছিল। সেকালের হাতে আঁকা তৈলচিত্র। এই পর্যন্ত। দেওয়াল ঘড়ির
কাঁচে বাবার মুখচ্ছবি সত্যিই ভেসে উঠেছিল কিনা, তাও সে
স্বচক্ষে দেখে নি। শুধু জানে, ঘড়িটা অনেকের মায়ার সঙ্গে
জড়িয়ে..এই অবধি। ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে সমীরণের।
বাইরে কলিং বেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। জানলার
স্লাইডিংয়ের ওপাড়ে প্রথম সূর্যের আলোর স্পষ্ট ছবি। কাজের লোক রামু এসেছে নিশ্চই।
বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আপনা থেকে চোখটা চলে গেল সমীরণের, সামনে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। আর চলে যেতেই দৃষ্টিটা
সেদিকে নিবদ্ধ হয়ে গেল ওর। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো যেন! চোখটা কচলে কাছে
এগিয়ে আরো ভালো করে দেখতে লাগলো ঘড়িটা। না,কোনো ভুল নেই! ঠিক
দশটার ঘরে এসে স্থির হয়ে রয়েছে বড় কাঁটাটা। নিস্পন্দ, নিথর
পেন্ডুলাম। এ কীকরে সম্ভব! গত রাতে বারোটার সময়েও তো বেজে উঠলো ঘড়িটা! পরিষ্কার কানে ভাসছে সেই শব্দ!
গুহবাবুদের দোতলার ঘরের আলো নিভে গেল। আজ বছরের পর বছর ধরে বারোটা বাজার সাথে
সাথেই বাতি নিভিয়ে দেয় ওরা। নিজের চোখকে কীকরে এতটা অবিশ্বাস করবে সে? ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না সমীরণ। ঘুম ভাঙা সকালটা অদৃশ্য কে যেন
অন্ধকারে ঢেকে দিল। নীচে
কলিং বেল বেজে চলেছে বারেবারে। দ্রূত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো সমীরণ।
আপাদমস্তক ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করেছে ওর...।
নীচে নেমে দরজা খোলা মাত্রই অবাক হয়ে যায় সমীরণ।
কামাখ্যা সাঁতরা এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চোখে মুখে প্রবল উদ্বেগ।
'একটা বড় ভুল হয়ে গেছে স্যার! তার জন্যই এই সাতসকালে ছুটে এলাম।
ভাগ্যিস দোকানের বিল এ আপনার ঠিকানাটা লেখা ছিল, নইলে কি যে
হতো...!'
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমীরণ।
ভদ্রলোক বলে চলেন,'দোকানের শোকেসে দুটো ঘড়ি
পাশাপাশি রাখা ছিল। কাল যেটা নিয়ে গেলেন ওটা আসলে আপনার নয়। আমার এক পুরনো
কাস্টমারের। যার কথা আপনাকে সেদিন বলতে
গিয়েও..।'
একটা ঘোর লাগা বিস্ময়বোধ যেন ঘিরে ধরলো সমীরণকে।
' তার মানে?'
' বলছি স্যার,সব বলবো। সে লোক আমার অনেক দিনের
খদ্দের। মাঝে মাঝেই দোকানে আসতো। গপ্পো করে চলে যেত। তার একটাই ছেলে। সে ছেলে এমনই
গুণধর যে মদ,জুয়ো,মেয়েছেলের নেশা
কোনোকিছুই তার জীবনে বাকী ছিল না। একদিন এমন অবস্থা হয় যে ধার দেনায় বিকিয়ে গিয়ে
হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সে তাদের পরিবারের বহুকালের পুরনো এই ঘড়িখানা বিক্রি করে
দেবার ফন্দি আঁটে। আর এই খবর জানতে পেরে তার বাবা একদিন চুপিচুপি দোকানে এসে ঘড়িটা
আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে,"এটা তোমার কাছে রেখে দাও। কার
ঘড়ি,কী বৃত্তান্ত.. কাউকে কিচ্ছু বোলো না। জানবো ঠিক
জায়গাতেই আছে। তবু আমি এ জিনিস কোনোমতেই হাতছাড়া হতে দেবো না। পরে সময়মতো চেয়ে
নেব।"
সেই থেকে ঘড়িটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। অন্যের জিনিস, এভাবে কদিনই বা আগলানো যায় বলুন..।
সে লোকের বাড়ির ঠিকানায় ধাওয়াও করেছিলাম। পাড়া প্রতিবেশীরা বললো,সে নাকি তার ঐ উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের কারণে, লোকলজ্জা
থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি বেচে বুচে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কেউ
কোনো খবর জানে না।
কাল সন্ধ্যার দিকে একটি ছেলে মদ্যপ অবস্থায় হঠাৎ আমার দোকানে এসে
হাজির। সঙ্গে ষণ্ডামার্কা আরো দুজন..। নিজের পরিচয় দিয়ে ছেলেটি বলে,ওর বাবা ঘড়িটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেসব কিছুই নাকি সে জেনে গেছে। জিনিসটা আজই তার
ফেরত চাই। এখনই। আমি দিতে না চাইলে সে হুমকি দেয়, "ঠিকানা
দিয়ে গেলাম। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যদি ঘড়ি ফেরত না আসে কি করতে হয় দেখিয়ে
দেবো..।"
এমন হুজ্জতির পর কে আর অন্যের দায়ীত্ব নিতে চায় বলুন তো? দোকানপাট বন্ধ করে রাত্তিরেই ধাওয়া করলাম সেই নতুন ঠিকানায়। দেখি বাড়ির
সামনে সে এক হুলুস্থুল কান্ড! শুনলাম আমার পুরনো কাস্টমার ভদ্রলোক আমি আসার জাস্ট
একটু আগে মারা গেছেন। ঠিক রাত দশটায়। '
চমকে ওঠে সমীরণ। শিরা উপশিরা দিয়ে যেন একটা রক্তের স্রোত দারুণ বেগে
বয়ে গেল!
ভদ্রলোক বলে চলেন, ' ভাগ্যিস সেই পরিস্থিতিতে
দিয়ে দেবো মনে করেও ঘড়িটা আর দিতে পারিনি। বাড়ি ফিরে কি মনে করে ঘড়িটা নিয়ে
নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হঠাৎই চোখে পড়লো ফ্রেমের পেছন দিকে খুদি খুদি অক্ষরে কি যেন
লেখা রয়েছে।
এমন এক বিশেষ ধরনের কালিতে লেখা, যার দাগ
হাজার চেষ্টা করলেও...
তার ঠিক নীচেই বাঁকা হরফে খোদাই করা রয়েছে কোম্পানির একেবারে জেনুইন
একটা ছাপ...’ মেড ইন জার্মানি’
সে অক্ষরও এতই খুদে যে, টর্চ না মারলে ঐ ছাপ
রাতের আলোয় বোঝাই যেত না। আর যেই না বুঝলাম, আমার টনক গেল
নড়ে! এমন লেখা কিংবা ছাপ, এসব তো আগের ঘড়িটাতে ছিল না! কিছুই
ছিল না!
তবে কি অদলবদল হয়ে গিয়েছে? নির্ঘাৎ তাই! শুধু
অদলবদলই হয় নি...কয়েক পুরুষ ধরে যারা পারিবারিক ঐতিহ্য মনে করে ঐ ঘড়ি আগলে আসছিল,
এই আমি, কামাখ্যা সাঁতরার মতো লোক, চোখে ঠুলি এঁটে সময়ের নাড়িনক্ষত্র দেখতে দেখতে যে কিনা বুড়ো হয়ে গেল
...কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেল না, ছাপ খোদাই বিহীন ঐ ঘড়ি আসলে
একটি নকল প্রোডাক্ট ছাড়া আর কিছু নয়! আপনার এই জাতঘড়িখানা না দেখলে মস্ত বড় ভুলটা কোনোকালে ভাঙতো কিনা
সন্দেহ! তবু একটা মিথ্যে
জিনিস এতকাল কি করে সময় মেপে চললো, কি করে...এ আমার জ্ঞান
বুদ্ধির বাইরে! বছর নয়, যুগ নয়, বংশপরম্পরায়...ভুতনাথ
কুন্ডু, মানে আমার সেই পরিচিত ভদ্রলোকের কথা অনুযায়ী।
জ্ঞান...বুদ্ধি... বিভ্রম...জ্ঞান...,বুদ্ধি...!‘
কামাখ্যা সাঁতরা নিজের মনে শব্দগুলো কয়েকবার বিড়বিড় করে ওঠে। সমীরণ
স্থির দৃষ্টিতে তাকায় লোকটার দিকে।
’ এই নিন স্যার, এই নিন আপনার সম্পত্তি...আশা
করি আর কোনো অসুবিধা হবে না, এর আয়ু এখনো অনেককাল, ও আমি বুঝে গিয়েছি...শুধু কতক্ষণে সঠিক লোকের হাতে তুলে দেবো এই চিন্তাতেই
ছিলাম...কাল সারারাত বলতে গেলে জেগে কাটিয়েছি...এবার আমি নিশ্চিন্ত!
জাতসাপ...জাতঘড়ি...।’
বলতে বলতে থেমে গেলেন ভদ্রলোক। এমন ভাবে ঘড়িটা সমীরণের হাতে তুলে
দিলেন, মনে হলো সত্যিই বুঝি তিনি কি একটা অজানা উদ্বেগ থেকে
মুক্তি পেয়েছেন।
বার্ণিশ করা গোলাকৃতি বাদামী বর্ণের ফ্রেমের পেছনে অজানা, অমোচনীয় কালো কালিতে খুদে হরফে লেখা...
’ উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্ট ফ্রম উধম সিং...দ্য সেকেন্ড জেনারেশন অব
কুনওয়ার সিং’...
সমীরণের নিজেরও কোনোদিন চোখে পড়ে নি লেখাগুলো।
এককালের ওয়াল্ড ফেমাস কোম্পানির প্রোডাক্ট অন্য কেউ অসাধু উপায়ে নকল
করে বাজারে ছাড়তেই পারে...আমাদের দেশে এমন ঘটনা বিচিত্র বলে ভাবা ভুল হবে। এ জিনিস
তখনো ছিল, এখনো হচ্ছে। বিচিত্রতা আর তাকে ঘিরে রহস্যময়তা যদি
পৃথিবীতে কিছু থেকে থাকে, তবে
সেটা এখন এই মুহূর্তে সমীরণের অস্তিত্বের পরতে একাধিক শিকড় মেলে
ক্রমশই যেন জাতসাপের মতো...!
’ স্যার...’
কামাখ্যা সাঁতরা লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। কি যেন বলতে
চায়।
’ হ্যাঁ বলুন ’
’কিছু ভাবছেন?’
’ ভাবছি...মানে...আচ্ছা, আপনার ঐ পুরোনো
কাস্টমার ভদ্রলোক, কটার
সময় মারা গেছে বললেন?’
’ ভুতনাথ
কুন্ডু? রাত দশটায়। কেন বলুন তো?’
গতরাত্রের অবিশ্বাস্য, অলৌকিক ঘটনাটা
ভদ্রলোককে খুলে বললো সমীরণ।
সবটা শুনে কামাখ্যা সাঁতরার মুখের চেহারাটা কিরকম যেন ফ্যাকাশে মেরে
গেল। চোখের মধ্যে ভয়ার্ত ছাপ। অন্যমনস্কমনে আস্তে আস্তে বললেন,
’ মায়া এমন-ই , বুঝলেন না...? মরা মানুষের দৃষ্টি , এ বড় ভয়ঙ্কর বাঁধন! কাল রাত
বারোটার কিছু আগে আপনার ঘড়িটাকে দেওয়ালের একজায়গায় টাঙিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায়
চোখটা সবে বন্ধ করেছি, হঠাৎ মনে হলো, কে
যেন হাতকয়েক দূরে বাইরে
জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে ডাকছে আমায়! একটা ছায়ামূর্তি। বাতি জ্বালিয়ে
টর্চের আলো ফেলে চতুর্দিক তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই! একবার, দুবার, তিনবার...যতবার চোখ রাখছি জানলার
দিকে...ততবারই বেশ বুঝতে পারছি আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ একটা সমানে লক্ষ্য করে চলেছে
আমাকে। একটা লম্বা ঝাপসা কালোমতো কি যেন! তাকে আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না,
কিন্তু নিস্তব্ধ নিশুতি রাতে জানলার আড়াল থেকে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস
নেওয়ার সেই
স্পষ্ট শব্দ এখনো শিরা-উপশিরায়...! জীবনের এতগুলো বছরে কখনো তো এরকম হয়নি! ভাবলাম
বাড়ির লোককে ডাকবো কিনা। রাতদুপুরে ওদের আর বিরক্ত না করে জানলাটা বন্ধ করে শুতে এলাম। ঘড়িটা চলছে..টিক টিক
টিক টিক...। বালিশে মাথাটা ফেলবো, আচমকা কিরকম যেন একটা মনে
হতে লাগলো আমার। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি! মনে হলো ঘরটার ভেতর আমিই শুধু একা নই।
আরো কেউ একজন আছে। এ জানলা থেকে ও জানলা, এ প্রান্ত থেকে ও
প্রান্ত, খাটের ধার বরাবর...আমারই চারপাশে ইতস্তত ঘুরঘুর
করছে কেউ...কোনো এক অশরীরী...! ধারণাটা ক্রমশ বদ্ধমূল হতে লাগলো...বলতে পারেন
ধূপের ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়লো...’
কামাখ্যা সাঁতরার কুতকুতে চোখ দুটো ছানার বড়ার মতো গোলাকৃতি আকার
ধারণ করে।
’ তারপর কী হলো?’
কথাটা সমীরণের মুখ থেকে ছিটকে এলো প্রায়।
’ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, বাকি সারাটা
রাত আর ঘুম হলো না। চোখ বুজলেই খালি মনে হতে লাগলো, অশরীরী
কে যেন ঠিক আমার বালিশের পেছনেই, শিওরে দাঁড়িয়ে আমারই দিকে
একদৃষ্টিতে....শব্দহীন চারিদিক, নিঝুম জানলার ওপার, ঘরে একা আমি, অথচ ঘাড়ের কাছে কি এক স্পষ্ট
নিঃশ্বাস...! ঐ একবার...একবারই সে অস্তিত্বের স্পর্শটুকু...! আমার জ্ঞান, বুদ্ধি সব লোপ পেতে বসেছে...এক প্রবল অস্বস্তি কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে
দিচ্ছে না...তারপর একটু একটু করে কখন কিভাবে যে ভোর হয়ে এলো...!’
মুহূর্ত কয়েক চুপ করে থেকে, ভয় পাওয়া চোখদুটোকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে,
হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামাখ্যা সাঁতরা বললেন, ’ আপনি
হয়তো ভাবছেন, এ নেহাৎই বিভ্রম। তা ভাবতে পারেন, ওতে আমার কোনো হাত নেই।
ভেবেছিলাম যার সম্পত্তি তার হাতে তুলে দিয়ে এবার আমার শান্তি...একটু
আগে আপনার মুখে ঐ কথাগুলো শোনার পর ভুতনাথ কুন্ডুর ঐ ঘড়ি আর আমি নিজের কাছে রাখি?
এখনই ফোন করবো ওর ছেলেকে। বাপের ঘড়ি, এসে নিয়ে
যাক, যা খুশি করুক...আচ্ছা স্যার, মানে
বলছিলাম, আপনার এই ঘড়ির আড়ালেও কি কোনো ইতিহাস...? মায়া, বুঝলেন না! মরা মানুষের দৃষ্টি, সে বড় ভয়ংকর! মিথ্যে জিনিস সত্যি হতে কতক্ষণ! ’
অফিসে যাবে বলে টাই বাঁধছিল সমীরণ। দেরি হয়ে গেল
না তো? দেওয়ালে টাঙানো ওয়াল ক্লকটার দিকে চোখ চলে যায়।
রামু এসে সেট করে দিয়ে গেছে। আগের সেই ঘড়িটা কামাখ্যা সাঁতরা ফেরত নিয়ে চলে গেছে।
বিশেষ কিছুই হয়নি। দম দিতেই আবার চলতে শুরু করেছে, রাত দশটায়
থেমে যাওয়া ঘড়ি... এক অমীমাংসিত রহস্যকে পেছনে ফেলে। এবার ঘড়িটা নিয়ে কি করবে
লোকটা, সেটা ওর মাথাব্যাথা।
কয়েক প্রজন্মের স্বাক্ষরিত ওয়াল ক্লকটার দিক
থেকে চোখ না সরিয়েই খানিকটা আনমনে চুল আঁচরাচ্ছিল সমীরণ।
পেন্ডুলাম দুলছে। একবার এ প্রান্ত। একবার ও প্রান্ত...
কোম্পানি উঠে যাওয়া 'ওয়েষ্ট অ্যান্ড ওয়াচ
করপোরেশন ’
ডায়ালের বেলজিয়াম গ্লাসের গায়ে জানলা দিয়ে এসে পড়া আলোর ছটা..। ঐ আলোতেই সুলতা একদিন খুঁজে পেয়েছিল..!
হঠাৎই ওর যেন ভীষণভাবে জানতে ইচ্ছে করলো, সুলতা
কি সত্যিই খুঁজে পেয়েছিল বাবাকে এই ঘড়ির কাঁচে? খুব দেখতে
ইচ্ছে করলো ছবিটা..অন্তত একবারটি হলেও নিঃশ্বাসটুকু...যে অনুভব আগে কখনো নিজের
মাঝে টের পায়নি সে।
সময়ের নাড়িনক্ষত্র হাতড়ে বেড়ানো ক্ষয়াটে, শিরা
বের করা দুটো হাত কখন এসে ছুঁয়ে যায়....
’ মিথ্যে জিনিস সত্যি হতে কতক্ষণ...! ’
ঢংঢং করে নটার বাজার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিয়ে গেল কে
যেন!
ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে অন্য কেউ।।
0 মন্তব্যসমূহ