সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সজ্জ্বল দত্ত: প্রবন্ধ: প্রভাব কিংবা পরম্পরা : জীবনানন্দ ... বিনয় , দেবদাস ... জয়

 


প্রভাব কিংবা পরম্পরা: জীবনানন্দ... বিনয়,  দেবদাস... জয়   


                       

      আমার শরীর , আমার আত্মা , আমার সমস্ত সত্তার পেছন থেকে প্রবল আগুন যদি চরাচর গ্রাস করার লক্ষ্যে ছুটে আসতে থাকে , আমি শিল্পী আমি কবি আমি শব্দব্যঞ্জনায় নিজেকে ভাসিয়ে রাখি - আমার দশা কী হবে তবে ? ... খেয়ে নেবে ? গ্রাস করবে ? উৎকট মাংসপোড়া গন্ধ বেরোবে ? ... এমন অলৌকিক কি হতে পারে না ? আগুন পৌঁছে গেল , স্পর্শ করল , কই আমি তো পুড়ে যাচ্ছি না ! স্পর্শ পেয়েই সরে যাচ্ছি আর আকাশ-বাতাস ঝলসে ফেলা আগুন আমাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে । ... এমন অলৌকিক কি হতে পারে না ? পুড়তে পুড়তে প্রবল গোঙানি আমার , অর্ধদগ্ধ হঠাৎই ছিটকে সরে এলাম , আগুনের ছোঁয়া পেয়ে। এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে , সে'সব সারিয়ে তোলা পর্বের শুভসূচনা এইবার ! ... আমি কবি , সেই আগুন সেই উত্তাপ , আলো , বরাবর পেছন থেকে আসতে থাকে , একটু একটু করে এগোতে থাকে । ... পালাতে চাই । না পারলে হু হু বাতাসে পুড়তে পুড়তে অতৃপ্ত আত্মা আমার গুমরে গুমরে কাঁদে । আঙুল তুলে পোড়া চামড়া দেখিয়ে কীসব য্যানো বলতে থাকে ওরা ! .... আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকে আসি । বুঝে ফেলি , আগুন লেগেছিল।

 

          

 

      একজন মানুষ তার একান্ত নিজস্ব সত্তার স্বতন্ত্রতা মহাশূন্যে ছড়িয়ে দিতে যখন শব্দে , চিত্রকল্প-অঙ্কন মাধ্যমে নান্দনিকভাবের আশ্রয় নেন , তখন আদৌ কতটা সচেতন থাকেন যে ঠিক ওই ভঙ্গীতে বা তার খুব কাছাকাছি কোনো ভঙ্গীতে বা অনেকাংশে পৃথক ভঙ্গীতে হলেও একই হৃদয়সত্তার সূক্ষ্ম নান্দনিক ব্যঞ্জনা তার পূর্বেই কেউ একজন বা বহুজন অনন্ত চরাচরে নিক্ষিপ্ত করে ফেলেছেন কিনা ? 

         প্রভাব কিংবা পরম্পরার মধ্যে ঢুকে থাকার অভিযোগ কবিতায় বহু পুরোনো । বিশ্বকবিতায় , বাংলাকবিতায় , বিশ্বকবিতার বাংলাকবিতায় ... । আলোচ্য দুই প্রধান ধারায় প্রবেশ করার আগে আলোচনার বিস্তৃতি সামান্য কমানোর লক্ষ্যেই বিশ্ব ছেড়ে শুধুমাত্র বাংলাকবিতার কোনো একটি দিকে সামান্য হলেও চোখ ফ্যালা যাক । 

   আজ থেকে বহুবছর আগে কোনো এক শ্রদ্ধেয় সিনিয়ার কবির বাড়ি বসে কবিতায় প্রভাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল । আলোচনা মানে , শ্রদ্ধেয় কবিই বক্তা আর আমি শ্রোতা । কথা হচ্ছিল বিষ্ণু দে'র কবিতায় রবীন্দ্রপ্রভাব নিয়ে । 

শ্রদ্ধেয় কবি : " ... কী বলছো কী তুমি ! বিষ্ণু দে রবীন্দ্রপ্রভাবিত একবার ছেড়ে একশোবার । ... ( হাতে তুলে নিলেন বিষ্ণু দে'র শ্রেষ্ঠ কবিতা পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ... ) শোনো তাহলে । বিষ্ণু দে'র এই কবিতাটির নাম " উর্বশী " । চারটে লাইন শোনো । 

  " আমি নহি পুরূরবা । হে উর্বশী , 

             ক্ষণিকের মরঅলকায়  

   ইন্দ্রিয়ের হর্ষে , জানো , গড়ে তুলি আমার ভুবন ?

   এসো তুমি সে-ভুবনে , কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে !"

অনুভব করতে পারছ রবীন্দ্রপ্রভাব ? ... গোটাটা পড়লে আরও ভালো বুঝতে পারবে । ... কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়েও বিষ্ণু দে কোথায় বিষ্ণু দে , জানো ? বিষ্ণু দে প্রকৃত উপলব্ধি করেছিলেন সত্তার শিকড়ে যেতে হবে । এই উপলব্ধিটুকু বিরাট ব্যাপার , এবং এই কারণে সর্ব খুঁটিনাটি আলোচনার ঊর্ধ্বে তার কবিতা কিন্তু নির্ভেজাল সৎ কবিতা । লেখার স্টাইলে হয়ত রবীন্দ্রনাথ , কিন্তু কবিতা প্রবলভাবে শিকড়ে যাবার পথনির্দেশ করে " । 

এইখানে আমি শ্রদ্ধেয় কবিকে সামান্য বাধা না দিয়ে পারলাম না । 

" ...দা , প্রভাব মানে সবক্ষেত্রেই কি তাহলে এরকম ? ধরনে অনুপ্রাণিত , অথচ আপন সত্তার মূল পর্যন্ত চলে যাওয়ার এক প্রবল প্রচেষ্টা " ? 

     শেষ করার আগেই শ্রদ্ধেয় কবি বলতে শুরু করলেন , " কখনোই না । প্রভাব দু'রকম । প্রথমতঃ একজন প্রকৃত কবিকে হৃদয়ে আত্মস্থ করে অতঃপর নিজেকে সেইভাবে পরিমার্জিত করে নিয়ে নিজের কবিতাটি লেখা । দ্বিতীয়তঃ - সরাসরি অনুকরণ । বিষ্ণু দে'র ব্যাপারটা প্রথমোক্ত শ্রেণীর । আর দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণীর কবি তুমি চারপাশে তাকালেই প্রচুর দেখতে পাবে । ... এর বাইরে অন্য আর একরকম ভাবে দু'জন বা দুইয়ের অধিক কবির কবিতাকে বড় কোনো এক ব্র্যাকেটের মধ্যে এনে ফ্যালা যায় । কিছুটা মিল কিছুটা পৃথক আঙ্গিক প্রকরণ , কিন্তু একই কোনো কমন ক্যানভাসের মধ্যে দুই বা ততোধিক কবির কাব্যভাব যখন আগে পিছে আশ্রয় গ্রহণ করে । .... কিংবা উল্টোটা । ভাবগত ভাবে কিছুটা বা চূড়ান্ত পৃথক জায়গায় থাকলেও , একই সাধারণ কোনো আঙ্গিকে , প্রকরণে , শব্দপ্রয়োগ ধরনে যখন তারা আগেপিছে .... । কবিতা লেখার ঘরানায় অমিল থাকলেও অন্য কোথাও অন্য কোনো একটি দিকের সাপেক্ষে তুমি বলতেই পারো যে তারা একই পরম্পরায় " । 

      ( বলাবাহুল্য এই কথোপকথন কাল্পনিক । কিন্তু মূল ভাবনার ক্ষেত্রটি বোধহয় তার জন্য আলাদা কিছু না । ) 

          এইবার তবে মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক । 

 


 

           বিনয় মজুমদার । " ফিরে এসো চাকা " সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ । যদি এই দিয়েই শুরু করি , তো এক অদ্ভুত সেনসিটিভ কবিমন ফুটে ওঠে মানসপটে , যা একাধারে প্রবল রোম্যান্টিক, কিন্তু সেই রোম্যান্টিকতার কেন্দ্রস্থলে জাঁকিয়ে বসে আছে মাটি আর মানুষের গল্প , আর সেইসঙ্গে তাদের কেন্দ্র করে প্রকৃতির কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফল ; আমাদের পৃথিবী আমাদের সভ্যতা । ... এটা ঠিক , এই অনন্ত সময় ও তাকে ঘিরে থাকা মানব-অনুভূতি বোঝাতে জীবনানন্দ আর বিনয়ের কবিতার উচ্চারণ ও চলনে নিশ্চিত মিল আছে । বিনয় এইভাবে বলবেন - " তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে / চিরকাল থেকে যাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা " । ( ফিরে এসো চাকা ) ... কিংবা - " যদিও এখানে মন সকল সময় / এ' বিষয়ে সচেতন থাকে না , তবুও এই কান্না চিরদিন / এইভাবে বয়ে যায়, তরুমর্মরের মধ্যে অথবা আড়ালে " । ( ফিরে এসো চাকা ) । .... এর পেছনে পেছনে জীবনানন্দর তিনকালব্যপী মহাসময় ও অনুভূতির উচ্চারণ অনুভব করলেই বোঝা যায় এই আলোচকের হঠাৎ করে কেন এই গদ্যলিখনের প্রচেষ্টা - " তবুও সিন্ধুর জল - সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে ; / একবার বর্তমান হয়ে - তারপর , আমাদের ফেলে যাও পিছনে - অতীতে , - / স্মৃতির হাড়ের মাঠে, / অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে - " ।

" ফিরে এসো চাকা " থেকে যদি " অঘ্রাণের অনুভূতিমালা"য় যাই , এবং তারপর আরো এগোই , একটি বিষয় ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে থাকবে - পরম্পরা হিসেবে জীবনানন্দর পর বিনয় , এটাই বোধহয় অত্যন্ত স্বাভাবিক সাধারণ বোধ । বিনয়ের ভাবনা সময়কে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে পৃথিবীর জল মাটি হাওয়া আর মানুষের মধ্যেই । শুরু করছেন পৃথিবীতে শেষও করেছেন পৃথিবীতে । জীবনানন্দও শুরু করেছেন পৃথিবীতে , অতঃপর মহাসময় জুড়ে বিস্তৃত হয়েছেন বহুদূর নক্ষত্রের পথে , ফিরে এসে শেষও করেছেন এই মানুষের রাজত্বে পৃথিবীর মাটিতে , আর এই সমগ্র পথের মধ্যে খুঁজে খুঁজে বেড়িয়েছেন প্রেম , মায়া , হিংসা , যৌনমোহজালে আবদ্ধ নিজের অস্তিত্বকে । 

বিনয়ের কবিতাকে তবে কী বলা যেতে পারে ? জীবনানন্দর কবিতার আধুনিক রূপ ? বিনয় একেবারে স্পষ্টতঃ স্বীকারই করে নিয়েছেন জীবনানন্দর কবিতাধারা কী অমোঘ হয়ে উঠেছিল তার কাব্যচর্চায় । পরম্পরায় থাকা নয় , বিনয় অত্যন্ত সৎ সচেতনে প্রভাব শব্দটিই এক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন , ... এবং এ ও ঠিক , বিস্তৃতপাঠে দীক্ষিত পাঠকের বুঝে নিতে দেরীও হয় না যে সমগ্র চরাচরের সর্বপ্রকার " কালো "কে সঙ্গে নিয়েও জীবনানন্দর কবিতার প্রবল আশাবাদ বিনয়ের কবিতাতেও প্রায় কাছাকাছি চলনেই পুনর্ব্যক্ত হয় । তার কবিতার নন্দনতত্ত্ব বিনয় যেন আবিষ্কারই করেন পুরোপুরি জীবনানন্দকে জড়িয়ে । উভয়ের পংক্তি অনুসরণ করলে একটুও ধরে নিতে অসুবিধে হওয়ার কারণ নেই যে বিনয়ের গায়ত্রী-বিরহের ব্যক্তিগত বেদনা তার অনন্তযাপনের মধ্যেই জীবনানন্দর কবিতার বিষাদময়তার সঙ্গে কিভাবে যেন তুমুল সামঞ্জস্যপূর্ণ । .... সবচেয়ে বড় কথা মিলহীন অক্ষরবৃত্তের চলন , কবিতার সূচনার আট মাত্রা ( একেবারে জীবনানন্দীয় ধারায় এই আট কখনো ৩+৩+২ , কখনো ৪+৪ ) , শব্দপ্রয়োগ - এই সমস্তকিছু প্রভাবের ধারণাকে আরো নিখুঁত করে । ' ফিরে এসো চাকা 'র শব্দপ্রয়োগে শুধু শঙ্খ , চিল আর প্যাঁচা'র ব্যবহার লক্ষ্য করলেই এই ধারণা থেকে বেরোনোর আর উপায় নেই । ... " শঙ্খমালা , তুমি কি হয়েছো ? / আজ তাই মনে হয় , / তবু তুমি পৃথিবীতে আছো " । ... কিংবা " করুণ চিলের মতো সারাদিন , সারাদিন ঘুরি / ব্যথিত সময় যায় শরীরের আর্তনাদে " । ... কিংবা " দেবদারু , আমি স্পষ্ট পেচকের মতো গহ্বরের স্বস্তি অভিলাষী , / তবু ফিরে আসি পূর্ববর্তী ফুলে ক্কচিৎ কখনো " 

শুধু শব্দপ্রয়োগই বা কেন , এক্কেবারে নির্ভুল এই যে -- সর্বদিকে সম্পূর্ণ ধরনেই এইসব লাইনে জীবনানন্দ । সেই রিয়েলিজম্ থেকে ধীরে ধীরে স্যু'রিয়েলিজমে যাওয়ার চেষ্টা । কিন্তু ... ( এতক্ষণ ধরে বলতে থাকা বক্তব্যের মধ্যে এই " কিন্তু " অংশটুকু অত্যন্ত গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য ) পড়তে পড়তে অবাক হয়ে দেখি বিভিন্ন জায়গায় কেমন করে হঠাৎই এক এক ঝটকায় যেন জীবনানন্দ পালিয়ে গিয়ে পরিস্কার ফুটে উঠতে থাকেন বিনয় । ... " কোথায় , কোথায় তুমি , কোথায় তোমার ডানা , শ্বেত পক্ষীমাতা / এই যে এখানে জন্ম , একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা ? " ... জীবনানন্দর কবিতার উচ্চারণ কি এত স্পষ্ট ? জীবনানন্দর কবিতার আকাশ দেখতে হয় অনেক কুয়াশা অনেক মেঘের স্তর সরিয়ে । বিনয়ের কবিতার আকাশেও অনেক অনেক জীবনানন্দীয় মেঘ হয়ত স্তুপাকার জমা হয়ে থাকে , অথচ তারই ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝেই যেন একেবারে ঝকঝকে স্পষ্ট বিনয়-আকাশ । এ' আকাশ অন্তরের শুদ্ধতম উচ্চারণ । পাঠক সমস্ত প্রভাব কিংবা পরম্পরাযাপনের ধারণা সরিয়ে পরিস্কার এখানে এসে অনুভব করবেন প্রকৃত মৌলিক কবিতার রসসৌন্দর্য্য । কবিতার ফাণ্ডামেন্টাল অনেস্টি ও স্পনটেনিটি । সেই আগে আলোচিত ' সত্তার প্রবলভাবে শিকড়ে যাওয়ার চেষ্টা ' যেতে পেরেছিলেন বলেই না অন্য সব ধারণা সরিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি অন্যতম একটি নাম -- বিনয় মজুমদার ! 

      বিশিষ্ট কবি ও আলোচক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী " মধুবন " পত্রিকায় ( সংকলন - ২০ , জানুয়ারী '৯৯ ) " ফিরে এসো চাকা " নিয়ে এক বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে একজায়গায় লিখছেন - " জীবনানন্দর দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা জীবনানন্দোত্তর কালপর্বে মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয় ; বিনয়ের মহৎ কীর্তি এটাই যে জীবনানন্দর কাব্যজগতের কয়েকটি আঁশ চুঁয়ে চুঁয়ে তার কবিতাভাবনায় ঢুকে গেলেও তা তিনি নিজের মতো করে আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক কাব্যবলয়ের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন । জীবনানন্দ যেমন নির্জনতার সঙ্গে জীবনের কর্কশ ঘর্ঘর রুক্ষতার ও মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্নতার সুমেল বন্ধন রাখতে পেরেছিলেন -- বিনয় তাকে অনুসরণ করেও হাঁটলেন একটু ভিন্ন পথে । তিনি কবিতায় আনলেন মাত্রাবহুল অ্যাক মানসজগৎ , যা দিয়েছে মহাজাগতিক ঘটনা পরম্পরা ও মানুষের ব্যক্তিক অনুভূতিমালার যুগপৎ বয়নে ঠাসবুনোট অ্যাক আলোছায়ার পরিপ্রেক্ষিতের জন্ম । " 

জীবনানন্দ ... বিনয় থেকে এ' আলোচনা তুলে অন্য দুই কবির আলোচনা শুরু করার আগে , শেষতম কথা -- " ফিরে এসো চাকা " , " অঘ্রাণের অনুভূতিমালা "ই তো শুধুমাত্র বিনয় মজুমদারের কবিতা নয় । মধ্য থেকে উত্তরপর্বে বিনয়ের কবিতায় কোথায় জীবনানন্দ ? কাব্যব্যঞ্জনায় বিনয়ের বাস্তুবিদ্যা , তার দুরূহ গাণিতিক সঙ্কেতের প্রয়োগ , মধ্যপর্বে হাংরি-বিনয়ের কবিতালিখনে " চাঁদ আর ভুট্টা "র কবিতার যে সিরিজ , সে সিরিজের কবিতা পছন্দ হোক আর নাইই হোক , তার নির্মাণ প্রকরণে তার শব্দ প্রতিস্থাপনে যখন যোনি হয়ে ওঠে মায়াসভ্যতা , বীর্য হয়ে ওঠে চন্দনের ফোঁটা - তখন জীবনানন্দের " জ " ও খুঁজে পাওয়া যায় কি ? উত্তরপর্বে এসে বিনয় যখন অন্ত্যমিল জড়ানো ছন্দে প্রবেশ করছেন , যখন তীব্র সচেতনতায় প্রবেশ করছেন , তার কবিতার জীবনানন্দীয় " চিল " তখন এই ধারায় - 

" বহু বৎসর চিল দেখিনি এ খালবিল 

        ঘুরে ঘুরে কোথাও দেখিনি ।

  আশাকরি তাহলেও ফের চিল দেখলেও 

        আমার ধারণা আমি চিনি । 

   অথচ চিল কে টেনে আমার সামনে এনে 

         পরখ করে নি কোনো বোকা ।

   ভেবে খুব ভালো লাগে দশ বৎসর আগে 

         মাছরাঙা দেখেছি রে খোকা " । 

 

      কী বলা যেতে পারে এবার ? ... হায় চিল ! জীবনানন্দীয় চিল ! --- ? ... উত্তরপর্বে বিনয়-কবিতা পাঠশেষে এই প্রভাব কিংবা পরম্পরার আলোচনায় জীবনানন্দর কবিতার অংশকে সামান্য মোচড় দিয়ে এটুকুই এ' আলোচকের শেষকথা হোক তবে । 

 

      শুরু করা যাক দেবদাস ... জয় । 

 

           

 

       দেবদাস-কবিতার গভীর পাঠক মাত্রই জানেন দেবদাস শুরু করেছেন পৃথিবীর তাবৎ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের মধ্যে থেকে , তারপর বিস্তৃত হয়েছেন পৃথিবী ছাড়িয়ে গোটা সৌরসংসারে , সৌরসংসার ছাড়িয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছেন অনন্ত মহাশূন্যে , আর তারমধ্যেই খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন নিজেকে তথা প্রাণের অস্তিত্বকে । দেবদাসের " মৃৎশকট " , দেবদাসের " উৎসবীজ " স্থির আবেগের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত অস্তিত্বের এমন কোনো কম্পন যা সমুদ্রের বুকে একের পর এক ঢেউয়ের মতো পাঠকহৃদয়ে আছড়ে পড়ে তাকে তার মহাশক্তিমান অস্তিত্বে জড়িয়ে জীবনের অভিকর্ষমুখ চেনায় , চেনায় তার বিচরণক্ষেত্র জল-স্থল-বায়ুলোক ও তারও বহু বহু লক্ষ মাইল ঊর্ধ্বে বিস্তৃত সেই মহা-মহাবিশ্বকে । পরবর্তীতে দেবদাস-কবিতার স্থির আবেগ আর ছাইচাপা আগুন প্রবল উষ্ণতায় একেবারে দাউদাউ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অনেকটা একই পটভূমিকায় একই অনুষঙ্গে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে নিজের মতো করে প্রথমপর্যায়ের জয় গোস্বামীর কবিতায় আসছে কি ? ... ভাবা যাক । 

সৃষ্টির আদিপর্বে দু'কোটি বছর আগের কোনো প্রাগৈতিহাসিক ' আমি 'র থেকে শুরু করে ( যার বুক নেই মুখ নেই পেট নেই ) বিস্তৃত চরাচরে যাবতীয় শুভ অশুভ সংকেতের মধ্যে দিয়ে বর্তমান ছুঁয়ে জয় গোস্বামীর " প্রত্নজীব " ভবিষ্যতের সেই ঘুমন্ত ভ্রূণ পর্যন্ত বিস্তৃত , তিন লক্ষ বছর পরে যার বেরিয়ে আসবার কথা । ... উদ্ধৃতাংশ রাখি অদৃশ্য তিনটি পর্যায় জুড়ে প্রবাহিত " প্রত্নজীব " থেকে , খণ্ড মহাকালের তিনটি পর্যায় থেকেই । 

১ . সৃষ্টির আদিপর্ব : -- " উজ্জ্বল বলে কিছু নেই । / কূপের উপরে বিষণ্ণ একটি গোলক , কালো মতো , ভাসছে / এবং উদ্ভিদের শহর জাগছে কিছুদূরে ... / ..... / কালো মহাকাশ । প্রচণ্ড ফ্যাকাশে , ঠাণ্ডা । / খুব শীতে পিঠ দিয়ে শুধু গ্রহগুলি পড়ে আছে । / তবে কি প্রত্নেই ....

২ .. বর্তমান ছুঁয়ে বহু বহুদূর ভবিষ্যৎ , হয়ত বা প্রলয়ের প্রাকমুহূর্ত : -- " এই কালো গ্যাস আর ধোঁয়াশার ভিতরে এখন আর কী-ই বা পাবি ? / কেন ? পৃথিবী তো টলটল এখন তরলে , / চল্ , খানিকটা বাদ-টাদ দিয়ে পাব বহু ধাতু , ভাঙা টিন ; / হয়ত বা ফেলে যাওয়া নূপুর-ই পাবো কারো । / আর কিছু পুরোনো রিঅ্যাক্টর , বোমারু , / এমন কি ভাঙা বীণা পেয়ে যেতে পারি " 

৩ . প্রলয় পরবর্তী ফের কোনো এক শুভমুহূর্তে নবসৃষ্টিজনিত আশার বার্তা : -- " যে পাত্রে রয়েছে মদ , ঘনীভূত নাতি-শীত-উষ্ণ জলবায়ু আমাদের , / বাষ্প ও আরক । / আরকের মধ্যে রয়ে গেছে ডুবে যাওয়া ফুল / ফুলে শরীর গুটিয়ে নিয়ে শুয়ে আছে পতঙ্গ , মানুষ , পাখি আর উদ্ভিদের মিশ্রিত শিশুটি । / তিন লক্ষ বছর পর তার বেরিয়ে আসবার কথা ... " 

 তুলনায় দেবদাসের ' মৃৎশকট ' এর প্রচণ্ড কম্পন ঠিক কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় লক্ষ কোটি বছর ধরে সময়ের ইতিহাসকে ? 

" যে বায়ু আমার মাথায় কামড়ে বসেছে / আমার ঘিলু ছড়িয়ে দিয়েছে বীজে ব্রহ্মাণ্ডে / সে উদাস খেলা দেখতে চায় , খেলা দেখে উদাস হাই তুলে চলে যায় / স্রোতের কলমি যেমন ভেসে থাকে , সেইভাবে ভেসে আছি " । ... ঠিক এইখান থেকে শুরু করে " মৃৎশকট " শেষ হচ্ছে এইভাবে : " স্পর্শকাতর পৃথিবীর চামড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দুটি বিশাল পা / ঝুলে আছে দুটি বিশাল হাত , শব্দের মধ্যে নক্ষত্রসমূহ ছটফট করে / সাড়ে চারশো কোটি বছরের জীবাশ্ম এই পৃথিবী / জীবাশ্ম এই পৃথিবী , ওঁ জীবাশ্ম এই পৃথিবী " 

 পাশাপাশি রেখে অত্যন্ত নিবিড়পাঠে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে , দিকচিহ্নহীন রূপান্তরিত মহাকালের যে অনন্ত বিস্তৃতির মধ্যে প্রাণ আসে , লুপ্ত হয় , হারিয়ে যায় সমস্ত স্মৃতি এবং অন্তহীন কোনো এক গতির বলয়ে যেখানে প্রাণের পুনরাবির্ভাব ঘটে , সেই কয়েক কোটি বৎসরের বিস্তৃত ক্যানভাসের নীচে কাব্যশৈলীর সমস্তরকম নিজস্বতা জড়িয়ে একইসঙ্গে আশ্রয় পায় " মৃৎশকট " ও " প্রত্নজীব " । ... সেই কাল্পনিক শ্রদ্ধেয় কবির কথায় - একই পরম্পরায় । 

প্রত্নজীবের পর জয় গোস্বামীর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ " আলেয়া হ্রদ " । আলেয়া হ্রদ এক অদ্ভুত রহস্য , মায়া অভিজ্ঞতায় জড়ান কবিমনের আশ্চর্য কল্পনাবিলাস , যা সপ্তমস্তরের অবচেতনের ফ্রেমে ফেলে প্রবহমান সময়ের নিরিখে অস্তিত্বের একপ্রকার পুনরাবিষ্কার বলা যায় । ... লম্বা শীতঘুম আর দীর্ঘসময় জুড়ে ফণার হিংস্র ছোবল - অস্তিত্বের এই দুই সর্পঅবস্থার সঙ্গে রতির প্রজ্জ্বলন্ত শিখা কিভাবে কোটি কোটি বছরের প্রাণের ধারাকে বহন করে চলে , তা কাব্যব্যঞ্জনায় অনুভব করতে হলে পাঠককে " আলেয়া হ্রদ " অতি গভীরভাবে পড়তেই হবে । 

" আমাকে নিয়ো না আর স্রোতঃপথে , / বাতাস আমার দেহ বয়ে নিয়ে গেল আলেয়াজ্যোতির সরোবরে / আমাকে নিয়ো না আর তমোগৃহে , ওই নীল গুহাতে নামার / সমস্ত মুহূর্তগুলি মনে আছে , মনে আছে জলে ভরা খনির গহ্বরে পাঠালে আমাকে " 

..... " ... ওরা গিয়ে অশ্রুগুলি খুঁজে দেয় তাকে বালুকারাশির থেকে ; / সামনে খুলে ধরে এক রঙিন গহ্বর / আমি যত ডুবে যাই তত বেশি যত্নে দাহ করে সে আমাকে " 

... " ... দোলায় আগুন আর কামপুঞ্জ জ্বলে ধিকিধিকি / জড়পথ কেঁপে কেঁপে চূর্ণ হয়ে যায়-- / থামে না বাতাস আর অগ্নিও থামে কি ? / জলের তলায় আর বালির উপরে সেই দীপ্র রসায়ন / ধীরে ধীরে শিখা দেয় রতির ভিতরে ... "  

এর পাশাপাশি এবার , দেবদাস আচার্য'র " ঠুঁটো জগন্নাথ " আর " জাতকের কথা "র কিছু অংশ সামনে আসুক । 

" পাহাড়ের গুহায় খড় ও বিচুলির মধ্যে শায়িত এক যুবতীকে পরিচর্যা করছেন কায়ক্লিষ্ট এক পুরুষ " / ........ / কায়ক্লিষ্ট পুরুষটি হাঁটু মুড়ে বসে থাকেন তার শ্রোণীর কাছে / গণ্ডুষে ধরে থাকেন পৃথিবীর নিঃশ্বাস / ছিটকে যায় একটি নক্ষত্র ঐ প্রাচ্যে , ঐ ভূগোলে " 

" ... যতবার জাগি , কষ্ট হয় / আমার শরীরময় ফাঙ্গাস গজিয়েছে বুঝতে পারি / বাহু নাকের কাছে তুলে গন্ধ শুঁকি / ঐ ক্ষুদে বৃক্ষগুলির কি ফুল আছে , পাতা আছে , কত সূক্ষ্ম ছিল তাদের বীজ ? / সারা শরীর ছত্রাকে ঢাকা এক সবুজ মানুষকে রৌদ্রে , শীতে , আকাশের নীচে হেঁটে যেতে দিই ... " 

        বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠক মাত্রেই জানেন যে জয় গোস্বামী ছোট্ট এক স্ফুলিঙ্গ নয় , রীতিমতো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে এগিয়ে যাওয়া বিশাল বিশাল এক অগ্নিবলয় । কিন্তু দেবদাসের প্রথম পর্বের কবিতা ও জয়ের প্রথম পর্বের কবিতা সত্যিকারের গভীরতা নিয়ে পাঠ করলে এই সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিনও নয় , যে দেবদাস আচার্যর কবিতার জগতকেই একেবারে অন্যভাবে টগবগে নিজস্ব আঙ্গিকে প্রথমদিকে লেখা কবিতায় যিনি আলোকিত করে গ্যাছেন , তিনি জয় গোস্বামী । 

       জয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ " ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ "র প্রথম লাইন : " সম্পূর্ণ ক্ষুধার নীচে বালি আর সোরা আর গন্ধকের গৃহ " । অর্থাৎ বিস্ফোরক অবস্থায় ক্ষুধা । প্রাথমিক প্রবৃত্তি । চিরকালীন প্রাথমিক । মানুষই আধুনিক শুধু । .... দেবদাস আচার্য'র " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র লাইন -- " আধপেট শূন্য পেট / হাভাত /আমার বুক হা-হা করে খুন হয় ঘুমে জাগরণে"। ... প্রাথমিক প্রবৃত্তি ক্ষুধাকে জড়িয়ে নিয়েই অতঃপর জয়ের প্রত্নজীব আলেয়া হ্রদ এ সভ্যতার সৃষ্টি , ... আদিমের ক্রম বিবর্তন , ... আধুনিক , ... আরও লক্ষ কোটি বছর ... বিবর্তিত আধুনিকও ... , আর সেইসঙ্গে দেবদাসের মৃৎশকট আর উৎসবীজেরও এক নতুন কবির হাতে ক্রমবিবর্তন অন্য ভাবে অন্য ঢঙে অন্য আঙ্গিকে । 

         তফাৎ -- দেবদাসের কবিতার ভাষা ভঙ্গী প্রকরণ অনেকখানি এই বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের ভাষা , মানুষের শব্দপ্রয়োগ । দেবদাসের কবিতার চলন কখনো চোরাছন্দে কখনো চূড়ান্ত ছন্দহীনতায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কথাবলার কবিতা-চলন । ... অন্যদিকে জয় গোস্বামীর কবিতার চলন এক অদ্ভুত তানপ্রধান চলন যা অনায়াসে যে কোনো স্তরের পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে । জয় গোস্বামী'র কবিতার বাস্তবে সবসময়ই মিশে থাকে জাদুরূপকথা । আর সেই রূপকথার মতো উঠে আসা জাদুবাস্তবের দুরূহ আঙ্গিকে লিখিত জয় গোস্বামীর প্রত্নজীব আলেয়াহ্রদের বহু জায়গায় পাঠক যেন কল্পজগতে সেই কাফকার গ্রেগর সামসার মতো নিজের অবস্থানকে এক নতুন রূপ দিয়ে নতুনভাবে আবিষ্কার করে উঠতে পারে । ফলতঃ জয়ের কবিতার লিখনধারায় দেবদাস খুঁজে পাওয়া যায় না । কিন্তু উভয়েরই প্রথম পর্বের কবিতায় পৃথিবীর বিবর্তন , প্রাণের বিবর্তন , সূর্যকে ঘিরে গোটা সৌরসংসারের বিবর্তন যেভাবে ইতিহাস হয়ে থাকে মানুষের বিবর্তনে , তাতে প্রথম পর্বের দেবদাস আচার্য এবং জয় গোস্বামী যে কেউ নিবিড়ভাবে পাঠ করলেই বুঝতে পারবে দুজনে দুজনের স্বকীয়তা সম্পূর্ণ বজায় রাখতে পারার পরেও কেন এই পরম্পরা সার্থক ।

         আলেয়া হ্রদের পর " উন্মাদের পাঠক্রম "এ এসে জয় গোস্বামীর কবিতায় সময় ও তাকে ঘিরে মানবপ্রাণের অস্থিরতা তীব্র আবেগে তীব্র উত্তাপে যেভাবে ধরা পড়েছে , তাতে এই প্রথম যেন কবি এতক্ষণ ধরে বলা দেবদাস-পরম্পরা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বড়রকমের একটি পা ফেলছেন । সৎকারগাথার মায়ের অস্থি আর শিক্ষার খুলে দেওয়া ভয়ঙ্কর উন্মাদ-পাঠক্রমের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক যেন প্রত্যক্ষ করছেন একমেবাদ্বিতীয়ম কোনো কবির প্রতিভা । ... এরপর " ভুতুম ভগবান " । জন্ম থেকে শুরু করে কোনো এক ক্ষুদ্র প্রাণের জীবনভ্রমণ এবং জীবন-পরবর্তী কোনো এক ইতিহাস যা আদতে জীবনপ্রবাহ পথেরই কোটি কোটি বছরের ইতিহাস , সেই ইতিহাস লিখে যেতে চাওয়ার আকুতি .. । ... অতঃপর " এক " , ...পৃথিবীর বিবর্তন, প্রাণের বিবর্তন , সূর্যকে ঘিরে গোটা সৌরসংসারের বিবর্তন যখন আবর্তিত হতে থাকে মানুষের বিবর্তন ঘিরে । ... " দুজন দুজন করে ওঠাও আশ্রম ওই ভেসে চলা চূড়ায় চূড়ায় ... " -- ' উন্মাদের পাঠক্রম ' , ' ভুতুম ভগবান ' এবং ' এক ' -- এই পর্যায়ের কবিতায় এসে জয় যেন নিজের মতো করে ছিটকে সরে দেবদাস-পরম্পরার বাইরে । 

        কিন্তু " পরম্পরা " আর " পরম্পরার বাইরে " এই দুই শব্দবন্ধ আলোচনা থেকে সরিয়ে দেবদাস আচার্য ও জয় গোস্বামীর কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট পরিস্কার " পার্থক্য " শব্দটি কি ব্যবহার করা যায় না ? দু'য়ের কবিতার একেবারে একশো শতাংশ পৃথকীকরণের ছবি কি কোথাও কোনো ভাবে কোনো পর্যায়ে ফুটে ওঠে না ? কখনো কি জয় নিজের কবিতালিখনে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা হয়ে যেতে পারেন নি ? অবশ্যই হয়েছেন । স্পষ্টভাবেই হয়েছেন । ... কোথায় ? ... ওই সেই একই জবাব , বিনয়ের মতো উত্তরকালে এসে । ... কিভাবে ? ... ' প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা রেফারেন্স । 

       অশ্রুকুমার শিকদার তার " আধুনিক কবিতার দিগবলয় " গ্রন্থে ইয়েটস্ ও জীবনানন্দ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দুজনের কাব্যভাবনায় অজস্র মিল দেখিয়েও বলছেন - " শেষ পর্যায়ে এসে দুইজন অন্যপথ , ভিন্নমতি " । জীবনানন্দর কবিতার শেষ পর্যায় সম্পর্কে বলছেন - " স্বাদগন্ধরূপময় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চরাচরের অব্যবহিত প্রকাশের চেষ্টায় যে কাব্য নিরলস ছিল , তার কিছু কিছু চিহ্ন বেলাবসানের দিনেও রয়ে গেল বটে , কিন্তু তা নিরলঙ্কার হয়ে এল । যে উত্তেজিত ইমেজের প্লাবন একদিন দুকুল ভাসিয়ে নিয়ে যেত , তাও স্তিমিত হল । এখন দার্শনিক চিন্তা ও সত্যোপলব্ধিকে তিনি কাব্যের কেন্দ্রে নিয়ে এলেন " । .... আর ইয়েটসের শেষ পর্যায়ের কবিতা নিয়ে লিখছেন -- " উত্তরপর্যায়ে ইয়েটসের কবিতাও নিরলঙ্কার হয়ে গেল । কিন্তু তার কবিতার এই নিরলঙ্কার আস্থাবাচনকে উচ্চারণ করার জন্য নয় । এই নিরলঙ্কারের উদ্দেশ্য নিজেকে ভারমুক্ত করে দ্বন্দ্বের চেহারাকে আরো ভাবাবেগবর্জিত স্পষ্টতায় দেখান " । 

        পুরোপুরি ভাবাবেগবর্জিত না হলেও দেবদাস আচার্য ও জয় গোস্বামী'র উত্তরকালের কবিতাতেও দ্বন্দ্বকে লঘুমাধ্যমে স্পষ্টতায় দেখানোতেই ঠিক এইরকম বড়সড় পার্থক্য । পরের দিকের কবিতায় জয় গোস্বামী আস্থাভাজন কোনো ব্যক্তিগত বা বিশ্বগত দর্শনের আশ্রয়ই না নেওয়ায় তার কবিতার ধূ ধূ মরুভূমিতে তিনি প্রকৃত-সঙ্গীহীন এক পরিব্রাজক । উত্তরপর্বে তার কবিতার বিষয় হয়ে তাই উঠে এসেছে " টিউটোরিয়াল " , এসেছে অজস্র স্পষ্ট যৌনতার ইমেজ । ... " কী বুঝেছে সে-মেয়েটি ? / সে বুঝেছে রাজুমামা মায়ের প্রেমিক / কী শুনেছে সে-মেয়েটি ? / সে শুনেছে মায়ের শীৎকার । / কী পেয়েছে সে-মেয়েটি ? - সে পেয়েছে জন্মদিন ? / চুড়িদার , আলুকাবলি -- কু ইঙ্গিত মামাতো দাদার " । এইসব ইমেজ একধরনের বিকারগ্রস্ত নি:সীম শূন্যতাকেই কবিতার আকার দিয়েছে । ... অন্যদিকে দেবদাস আচার্য'র উত্তরকালের কবিতা শুরু হচ্ছে " সুভাষিতম " থেকে । জীবন তথা ইতিহাসের অনন্ত পদযাত্রা সম্পর্কে একেকটি প্রশ্ন , আবার পরক্ষণেই তার সমাধান তার উত্তর । এভাবেই দেবদাস আচার্য তারপর " তর্পণ " এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে তার ধারা বজায় রেখেছেন ( বরং বাড়িয়েছেন বলা ভালো ) । আর জয় গোস্বামী ভারমুক্ত হতে হতে " প্রত্নজীব " আর " আলেয়া হ্রদ " থেকে সরে তার কাব্যভাবনা হিসেবে " ঝাউপাতা " , " বুকুনের জন্মদিনে " আর " দোল : শান্তিনিকেতন " এর মতো ভাবানুষঙ্গকে বেছে নিয়েছেন একের পর এক কাব্যগ্রন্থে। 

          তবু সর্ব আলোচনা শেষে নিশ্চিতভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে , যে জয় গোস্বামীর প্রথম পর্বে প্রত্নজীব ও আলেয়া হ্রদের কবিতা দেবদাস আচার্যর কবিতার মহাবিস্তৃত ভাবনারই সার্থক উত্তরসূরী , এবং একইসঙ্গে পরবর্তীতে এই টর্নেডো-কবির কবিতাপথের অভিমুখ ধীরে ধীরে দেবদাস-কবিতার থেকে অন্যদিকে যেতে যেতে উত্তরপর্বে এসে একেবারেই পৃথক । 

 

 

       একটা হাড় খসে পড়ল ! ঝলসানো , কালো ঘেঁষা ছাই-ছাই রঙ ! যতটুকু দগ্ধ অংশ , তার চামড়া কখন খুলে ধোঁয়া হয়ে ফুটছে মাটিতে । যারা নেবে বলে কোমরে গামছা বেঁধে , যারা এই অগ্নিঝড়ের মুখে কতটা পুড়েছে কবি দূর থেকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে , তাদের সকলকে দু' হাত জোড় করে প্রণাম । যদি সে কবি হয় ... , তারা প্রত্যেকে কবি হয় যদি ... , ' গদ্যপাঠে হতাশ হও গো তোমরা , শতদগ্ধ হলেও জানবে বেঁচে থাকা তাদের অভ্যেস ! 

 

                    

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ