মার্ক্সবাদ ও বিশ্বায়নের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই গড়ে উঠেছে নব্বই দশকের বাংলা কবিতা: অংশুমান কর
আয়নামহলে দেখা এই দর্শনের
পৃথিবীতে কড়া আর প্রতিকবিতা সমানভাবে সক্রিয় থেকে জগতের কোলাহলকে আশ্রম দেয়।
তারও তো বিবিধ রীতি আছে। প্রকরণের বিপুল বিন্যাস। বাংলা কবিতাও সেই বিপুল
বিন্যাসেরই ধ্রুবপদ। চর্যাকার থেকে জয় গোস্বামী যে বিচিত্র মহাজনপদ গড়েছেন,
নব্বই দশকে সেই অভিজ্ঞানে লিখতে এসে অংশুমান কর ইতিমধ্যেই স্বয়ং একটি সময়পর্ব।
বিশেষ করে অভিভূত,বিমূঢ় করে দেওয়া এই লকডাউন পর্বে অংশুমান এত বিচিত্র ফর্মে
সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন যা পাঠকের বিস্ময়ের কারক।
এই পরিসরে আমাদের ওয়েবজিনের পক্ষ থেকে তরুণ কবি শ্রীসব্যসাচী মজুমদার মুখোমুখি হয়েছিলেন অংশুমান বাবুর। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে এলো তত্ববিশ্ব ও তত্ত্ব নির্বিকার বিশ্বের কথা। ব্যক্তি যেখানে কবিতা হয়ে যায়...
সব্যসাচী মজুমদার: আপনি লিখতে এলেন বাংলা কবিতার নব্বই
দশকে। একটা বড়ো রাজনৈতিক স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সেই নব্বইয়ে। ঘটে গেছে ঐতিহ্যের
প্রান্তিকীকরণ। নতুন শব্দ ঢুকে পড়ছে জীবনে। একটা দোলাচল তৈরি হয়েছে। আবার সঙ্গে
সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে স্হিরতার সন্ধান চলছে। একটা দ্বিমুখী সময় এবং নতুন একটা
পৃথিবীর ভেতর ঢুকে পড়ার অভিজ্ঞতা। এই সময়টাকে আপনি বা আপনারা কীভাবে দেখেছেন? বা
তিরিশ বছর পর দাঁড়িয়ে কীভাবে দেখছেন?
অংশুমান কর: আমার লেখালিখির শুরুটা নিয়ে একটা কথা বলি। আমি প্রথমে সবাই যেরকম লেখে তেমনই অর্থাৎ স্কুলে পড়ার সময় কিছু কবিতা লিখেছিলাম। স্কুলের ম্যাগাজিনে একটি লেখা প্রকাশও পায়। তারপর আমি সেভাবে কবিতা লিখতাম না। বরং গল্প লিখতাম। আমার পাড়া থেকেই প্রকাশ পেত প্রবীর দত্তের সম্পাদনায় "নকশীকাঁথা" নামে একটি চমৎকার পত্রিকা। আমি তার সঙ্গে যুক্ত হই। এরপর আমি ইলেভেনে ভর্তি হই বাঁকুড়া খ্রিশ্চান কলেজে। এই কথাটা একাধিকবার লিখেছি, বলেওছি। তবু আর একবার বলি। তখন আমার সঙ্গে আলাপ হয় অনিন্দ্য রায়ের। নব্বইয়ের অন্যতম প্রধান কবি অনিন্দ্য রায় আমাকে কবিতা লেখায় নিয়ে আসে। ওঁর মাধ্যমেই বাংলা কবিতার স্বর্ণখনিটির খোঁজ আমি পাই। এর আগে আমার কবিতা পাঠ আবৃত্তির জন্য যে কবিতাগুলো প্রায় সবাই পড়ে থাকে, সেগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি তখন খুব সিরিয়াসলি আবৃত্তিচর্চা করতাম। জেলাস্তরে, রাজ্যস্তরে নানা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম। বাঁকুড়া শহরে এখনও তুমি যদি যাও, দেখবে একটা অংশের মানুষ আমাকে মনে রেখেছেন আবৃত্তিচর্চার জন্য। এইরকম একটা জায়গা থেকে আমি একটা অন্য ধরনের যে বাংলা কবিতা লেখা হয়, সেই জগতে প্রবেশ করি। এই প্রক্রিয়ায় অনুঘটকের কাজ করেছিল অনিন্দ্যদা। এখনও ও তীব্রভাবে বাংলা কবিতা লেখে। পেশায় প্রথিতযশা ডাক্তার। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে আরও দু'জন আমাকে প্রভাবিত করেন। এই দু'জনই ছিলেন খ্রিশ্চান কলেজের অধ্যাপক। একজন রূপাই সামন্ত। বাংলা ভাষার অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক। আসল নাম রবীন্দ্রনাথ সামন্ত। কিন্তু রূপাই সামন্ত নামেই তিনি লিখতেন। তিনি আমাকে খুবই উৎসাহ দিতেন। আর একজন ইকনমিক্সের অধ্যাপক তারাপদ ধর, বাংলা কবিতার সুপরিচিত নাম, ঈশ্বর ত্রিপাঠী। এই দু'জনের সঙ্গেই আমার দ্রুত ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। অসম্ভব স্নেহ পেয়েছি এঁদের কাছ থেকে। এঁরা আমাকে কবিতা লেখায় খুবই সাহায্য করেছিলেন। একটু পরে আমার সঙ্গে আলাপ হয় আমার গ্রাম বেলিয়াতোড় থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে অবস্থিত যে-গ্রাম সেই কাদাখুলির বাসিন্দা প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন কলকাতানিবাসী। তখন "কবিতা পাক্ষিক" বেরোতে শুরু করেছে। সেটা বিরানব্বই বা তিরানব্বই সাল হবে। ততদিনে আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি। গল্প, কবিতা দুইই লিখছি তখন। "নকশীকাঁথা"য় লিখছি, খ্রিশ্চান কলেজের ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপা হচ্ছে। বাঁকুড়া শহরেরই "মুক্তবিহঙ্গ" নামে একটা কাগজে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা শুরু করি। যদিও সে লেখা আর শেষ করিনি। এই সময় আমি গল্প/কবিতা লেখার নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। কলেজের একটা স্বরচিত কবিতা লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়েছিলাম। আসানসোলের বাংলা আকাদেমি আয়োজিত একটি গল্প প্রতিযোগিতায়ও প্রথম হয়েছিলাম।
সব্যসাচী: মানে আরও একঅভিমুখী হতে চেয়েছেন...
অংশুমান: হ্যাঁ, আমার আসল কাজ কোনটা বেছে নিতে
চেয়েছি। আমি নাটকও করেছি একসময়। খুব খারাপ অভিনয় করতাম না। যতবার
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি, প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার
পেয়েছি। তারপর নাটক করাও বন্ধ করে দিয়েছি। একসময় এটা একজন মানুষ বুঝতে পারে যে
তার আসল কাজ কী...আমিও ধীরে ধীরে এমন একটা জীবনে
প্রবেশ করেছি , বুঝতে পেরেছি যে আমার প্রথম...নাহ, বলা ভালো একমাত্র কাজ লেখা।
মূলত কবিতা লেখাই। আমার নিশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার মতো লেখা আমার জীবনের অঙ্গ।
সাহিত্যের মধ্যে আমি বসবাস করি। চব্বিশ ঘন্টাই। সত্যিকারের কবিতার জগতে, যেমন
বললাম, আমার প্রবেশ উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদারের কবিতার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে,
আমাকে, কাইন্ড অফ, ব্যপটাইজ করেছিল অনিন্দ্যদা। একসময়, ইনফ্যাক্ট, আমি পড়াশোনাও
ছেড়ে দিয়েছিলাম। লেখাপড়ার জগতকে একেবারে টা টা করে দিয়েছিলাম। তখন চুটিয়ে ছাত্র
রাজনীতি করছি আর লিখছি। তবে এই পর্বটি পেরিয়ে আমি শেষমেশ পড়াশোনার জগতেই আবার
ফিরে আসি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। বলতে পারো বেশ কৃতি ছাত্রই ছিলাম। মাধ্যমিক
এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রচুর নম্বর পেয়েছিলাম। তবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আমি
সিদ্ধান্ত নিই যে, বিজ্ঞান নিয়ে আর পড়ব না। এই সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে খুবই খুব সাহায্য
করেছিলেন রূপাই সামন্ত ও ঈশ্বর ত্রিপাঠী। এছাড়া সেই সময়ের খ্রিশ্চান কলেজের বাংলার
দুজন মাস্টারমশাই প্রভাত বাবু ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে
সাহায্য করেন যে, আমার সাহিত্য নিয়েই পড়া উচিৎ। আমি চেয়েছিলাম আমি বাংলা নিয়ে
পড়ি। বাংলা নিয়ে
পড়ার ব্যাপারে বাবার একটু আপত্তি ছিল। বাবা চাইছিল সাহিত্য নিয়ে পড়লে যেন ইংরেজি
নিয়ে পড়ি। আমি শেষমেশ বাবার যুক্তি মেনে নিই। ততদিনে আমি বাংলা সাহিত্যের মধ্যে
প্রবেশ করেছি। ফলে এটা জানতাম যে, বাংলা সাহিত্য আমি এমনিই পড়তে পারব। কিন্তু
ইংরেজি নিয়ে পড়লে বিভিন্ন ভাষার কবিতা পড়তে পারব, অন্যদেশের সাহিত্য পড়তে পারব।
তাই ঠিক করলাম ইংরেজি নিয়েই পড়ব। তবে আমার জেঠু আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি।
উনি চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হই। ইনফ্যাক্ট, আমি যখন ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভরতি হই তখন
আমার জেঠু আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমাদের সম্পর্ক আবার খানিকটা
স্বাভাবিক হয় অনার্সে আমি ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পরে। তুমি
প্রথম যে প্রশ্নটা করেছিলে, তার উত্তরে ভূমিকা হিসেবেই অনেকগুলো কথা আমাকে বলতে
হল। এবার প্রশ্নটায়
আসি। নব্বইয়ের কবিতা ও সেই সময়; কীভাবে আমরা সেই সময়টাকে দেখেছিলাম? দেখো, তুমি
যে সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ, সেই সময়কে, জীবনে তার অভিঘাতকে, খুব বিশ্লেষণাত্মক
দৃষ্টিতে সেই সময়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে দেখা বা বোঝা সম্ভব নয়। আমার এখন মনে হয় যে,
আমরা আসলে রেসপন্ড
করেছিলাম। যে সমস্ত পরিবর্তনগুলো ঘটছিল সেই ঘটমানতার প্রেক্ষিতে রেসপন্ড করছিলাম।
এখন নির্মোহ দৃষ্টিতে সেই সময়টাকে দেখতে পারি। বুঝতেও পারি খানিকটা যে, আমরা আসলে
কী করছিলাম। নব্বইয়ের শুরুতে কেবল সোভিয়েতেরই পতন ঘটল না, আমাদের দেশে উদার
অর্থনীতিই চালু হল না, একটু পরে, এই সময়েই আমরা দেখলাম টেলিভিশনের উত্থান। একাধিক
চ্যানেল গুটিগুটি পায়ে নব্বইয়ের শেষের দিকে এল।
সব্যসাচী: নচিকেতা লিখলেন...
অংশুমান: হ্যাঁ অনেকেই লিখলেন। আমরা সবাই রেসপন্ড
করেছিলাম। এই সময়ে আমার ব্যক্তিজীবনেও একটি ঘটনা ঘটে, সেটা হল এই যে, আমি সুমন
চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনি। ওই যে বললাম, উৎপলকুমার বসুর মাধ্যমে আমার কবিতার জগতে
প্রবেশ, এটা খুবই সত্যি। প্রথম দিকে উৎপলকুমার বসুকে অক্ষম অনুবাদ করেছি।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখতে গিয়ে না-জেনে ভুলভাল করে ফেলেছি। সে সমস্ত কবিতা সংকলিত
নয়। হারিয়েও গিয়েছে। ভুলভাল ছিল সে সমস্ত লেখা। টেকনিক্যালি ভুল। কিন্তু
পরবর্তীতে আমার লেখার আত্মার কথা যদি বলো, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান যদি আমার
সামনে সে সময়ে এসে না-পড়ত, তাহলে হয়তো কবিতার কাছে এতটা আত্মসমর্পণ করতাম না।
আমাকে উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদারের ঋণ যেমন স্বীকার করতে হবে, তেমনই সুমন
চট্টোপাধ্যায়ের ঋণও স্বীকার করতে হবে। এর আগে গান বলতে, সত্যি কথা, রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল ছাড়া তেমন শুনিনি। আর শুনতাম সলিল চৌধুরী। তাঁর গণসংগীত ও অন্যান্য গানগুলি
অন্তরে প্রবেশ করেছিল। তবুও একথা স্বীকার করতেই হয়, সুরের ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরী
অনবদ্য হলেও গানের কথার ক্ষেত্রে যাকে বলে আধুনিকতা...
সব্য: সমকালীনতা?
অংশুমান: না, এক্ষেত্রে আমি আধুনিকতা আর সমকালীনতাকে
আলাদা রাখব। সাহিত্যে যাকে বলে আধুনিকতা সেটা সলিল চৌধুরীর গানের কথায় তেমনভাবে
ছিল না। অনেকক্ষেত্রে অন্তমিল বজায় রাখতে গিয়ে সাধু-চলিত একই সঙ্গে ব্যবহার
করেছেন উনি। এই সমস্ত ত্রুটি কিন্তু সুমনের লিরিকে একেবারেই নেই। বাংলা গানের
লিরিকের কথা ধরলে, রবীন্দ্রনাথের পরেই সুমন চট্টোপাধ্যায় বা কবীর সুমনকে রাখতে
হবে। ইনফ্যাক্ট, সুমন একটা ফেনোমেনন। নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, অনিন্দ্যদা, চন্দ্রিল,
শ্রীজাত, অনুপম, রূপম ইসলাম এঁরা কেউই বোধহয় গান লিখতে পারতেন না, যদি না সুমন
চট্টোপাধ্যায় আসতেন। আমাদের সময়ের চিহ্ন ধরা আছে সুমনের গানে। আমাদের সময়ে লেখা
কবিতাতেও এই চিহ্নগুলি স্পষ্ট। পরবর্তীকালে আমি বিভিন্ন প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করে
দেখিয়েছি যে, ওই সময়ের কী ছাপ পড়েছে আমাদের লেখায়। তাই পুনরাবৃত্তি করছি না। এই
প্রবন্ধগুলির একটি বাংলায়
প্রকাশ পেয়েছিল "কৃত্তিবাস" পত্রিকায়, আর একটি ইংরেজিতে
"ইন্ডিয়ান লিটারেচার"-এ। যাঁরা আগ্রহী পড়ে নিতে পারেন। এক কথায় বলতে
গেলে বলব, আমরা বিশ্বায়নের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে করতেই লিখেছি।
সব্যসাচী: আপোস?
অংশুমান: না,আপোস কথাটিকে এখানে ব্যবহার করব না।
বিশ্বায়নকে আমরা অস্বীকার করিনি। তার সঙ্গে বরং একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছি।
ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়নের মূল চরিত্র
লক্ষ্মণগুলি কী তা নিয়ে অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের একটা চমৎকার বিশ্লেষণ আছে। আমরা এই
লক্ষ্মণগুলির সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছি। যার চিহ্ন আমাদের কবিতায়, আমার
কবিতায় আছে। কিছু জিনিসের বিরুদ্ধে কখনও প্রতিবাদ করেছি, কখনও কিছু জিনিসকে গ্রহণ
করতে বাধ্য হয়েছি, গ্রহণ করেও অতৃপ্ত থেকেছি। সেই অতৃপ্তি আর প্রতিবাদ খুব
জটিলভাবে আমাদের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, আমি দুটো উদাহরণ দেব। এক,
যে-পণ্যায়িত পৃথিবীতে আমরা প্রবেশ করলাম, সেই পৃথিবীর নানা চিহ্নগুলো আমাদের
কবিতার মধ্যে ঢুকে গেল। যশোধরা রায়চৌধুরীর একটা বইয়ের নামই হল, "পণ্যসংহিতা"।
দুই, টেলিভিশন। টেলিভিশন নিয়ে আমাদের সময়ের একাধিক কবি কবিতা লিখেছেন।
মন্দাক্রান্তা সেন, যশোধরা রায়চৌধুরী, শ্রীজাত লিখেছেন। আমিও লিখেছি। আমাদের
জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল টেলিভিশনের প্রভাব।আরেকটা বড়ো বিষয় হল,
মার্কসবাদের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া। তার পক্ষে/বিপক্ষে যাওয়া শুরু হল। সাতের
দশকের পরে এটা কিন্তু আমাদের সময়ে আবার শুরু হয়। শুরু হয় অন্য প্রেক্ষিতে। ফুকুয়ামা এই সময়েই
মার্কসবাদের মৃত্যু ঘোষণা করেন। বলেন যে, ইতিহাস শেষ। এখানে একটা কথা বলি। অনেকেই
অভিযোগ করেন যে, নব্বইয়ের কবিরা গ্ল্যামার সর্বস্ব কবিতা লিখে গেছেন, তাঁরা
তত্ত্বে দীক্ষিত ছিলেন না। রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ছিলেন না। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ
মিথ্যে।
সব্যসাচী: এ বিষয়ে পরেই আসছি
অংশুমান: বেশ। কিন্তু এইটুকু আবারও বলি যে, এটা সঠিক
সমালোচনা নয়। আমি একটা কবিতাতেই লিখেছিলাম যে, যে-কবিতা আমি লিখতে পারিনি, সেই
কবিতা লিখে গেছে আমার বন্ধুরা। আমি কিন্তু আমার বন্ধুদের লেখালিখি নিয়ে গর্বিত।
সহজ, মনোরঞ্জনের কবিতা এই সময়ে লেখা হয়েছে। অনেকেই লিখেছেন।
কিন্তু, এটাই একমাত্র ধারা ছিল না। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ দশকগুলির
মধ্যে নব্বই দশক
একটি। কবিতার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অভিমুখের কারণে আমি এই কথা বলছি।
এরপরে ঘটল সাইবার বিস্ফোরণ। যার প্রভাব পড়ল আমাদের ওপর। আমাদের পরে তোমরা যারা
লিখতে এসেছ, তাদের ওপর আরও বেশি করে ছায়া পড়ল এই বিস্ফোরণের। একটা কথা এখানে বলা
জরুরি। আমার মনে হয় যে, এই যে বোঝাপড়া আমরা করেছি বিশ্বায়নের সঙ্গে, মার্কসবাদের
সঙ্গে, উদার অর্থনীতির সঙ্গে তা কিন্তু খুব সচেতনভাবে করিনি। আমাদের যাপন ও বিশ্বাস
থেকেই এটা হয়েছে। যাঁরা কবি তাঁরা তো মানুষও। সচল ও দ্বন্দ্বময় মানুষ। ফলে
তাঁদের ওপরে তো সময়ের প্রভাব পড়বেই। সেটা অন্তর্মুখী-বহির্মুখী উভয়তই হতে
পারে।
সব্যসাচী: দাদা, এইবার অন্য প্রশ্নে আসি। আপনি একটা
ভীষণ বড়ো দিক তুলে ধরলেন যে, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান আপনাদের সমসময়ের অনেকের
ওপরই প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সেই সময়ে জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার বাংলা
কবিতাকে শাসন করছেন। তাহলে জয়-সুবোধের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি আপনার কাছে? আর
দ্বিতীয়ত, আপনাদের সমকালীন কবিতা ও আপনার কবিতা কতটা তত্ত্বকে আত্মস্হ করেছে?
কতটাই বা তত্ত্বনিরপেক্ষভাবে মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছে?
অংশুমান: দেখো তুমি একটা দীর্ঘ ও জটিল প্রশ্ন করলে।
আমি যখন কবিতা লেখা শুরু করি আমাকে গ্রস্ত করেছিলেন উৎপলকুমার বসু। ইনফ্যাক্ট, কবি
হিসেবে এর আগেই আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন জয় গোস্বামী এবং সুবোধ সরকার। কবিতা লিখতে
শুরু করার আগের পর্ব থেকেই আমি এঁদের কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আবৃত্তির সূত্রেই।
সেটা তোমাকে আগেই বললাম। তবে আমি পড়েছিলাম, কোট আনকোট, এঁদের জনপ্রিয় কবিতাগুলিই। ততদিনে তাঁরা দুজনেই এরকম
অনেক কবিতা লিখে ফেলেছেন। পরে আরও লিখবেন।
এই সময়, সম্ভবত, উনিশশো ঊননব্বই সালে জয় গোস্বামীর
"ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা" আনন্দ পুরস্কার পায়। সেই বইটা তখন কিনি। মূলত,
প্রেমের কবিতা ছিল এই বইতে। ওই বইয়েই পড়ি,"হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে..."।
বইটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল।এরপর যখন আমি ওঁর অন্য কবিতার কাছে গেলাম, মানে যখন সচেতন
ভাবেই আঁতিপাঁতি করে বাংলা কবিতা পড়ে চলেছি (সেই পাঠ আমার আজও জারি আছে; দাবি
করছি না যে, সবই পড়েছি বা পড়তে পারি, তবে চেষ্টা জারি রেখেছি) সেইসময়
"ক্রিসমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ", "উন্মাদের পাঠক্রম",
"ভুতুম ভগবান", "আলেয়া হ্রদ" মুগ্ধ করেছিল আমাকে। পরে
"ওঃ স্বপ্ন", "পাগলী তোমার সঙ্গে", "সূর্য পোড়া
ছাই" (এই বইটার কথা বিশেষ কেউ বলে না) এই বইগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। উৎপলকুমার
বসুর ঘোর কাটিয়ে আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, প্রেমের কবিতা, তখন জয় গোস্বামীর
প্রভাব আমার ওপর ছিল। তুমি যদি আমার "খেলনা পিস্তল" বইটা পড়ো, দেখবে
বেশ কিছু সফট কবিতা আছে। সেগুলোতে যদি বলো জয় গোস্বামীর প্রভাব আছে, অস্বীকার
করতে পারব না। কেননা তখন আমি জয় গোস্বামীতে আক্রান্ত ছিলাম। সেই বয়সটাতে এরকম
প্রভাব তৈরি হয়।
সব্যসাচী:এটাকেই কি আপনি সময়ের আত্তীকরণ বলছেন?
অংশুমান: না। "খেলনা পিস্তল" অনেক সফট
কবিতায় ভরতি হলেও পরে কিন্তু আমি সরে আসছি এই ধরনের লেখা থেকে। আমার কবিতা পালটে
যেতে থাকে। কেননা তখন আমি সুবোধ সরকার পড়ি। সুবোধ সরকারের কবিতা আমাকে প্রচণ্ড
চার্জ করে। জয় গোস্বামী যেমন আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন, সুবোধ সরকার চার্জ করেছিলেন।
আমার ওপরে এই দু'জনের প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই বলতে পারি।ইনফ্যাক্ট, সুবোধ সরকারকে
পড়ার পরেই আমি অ্যান্টি পোয়েট্রি কী, লোরকা, নেরুদা, পাররাই বা কারা, এসব নিয়ে
ঘাঁটাঘাটি করতে শুরু করি। ততদিনে আমি ইংরেজি অনার্স পড়া শেষ করেছি। নানা দেশের
কবিতা পড়ছি। সেই সময় সুবোধদার "রাজনীতি করবেন না" খুবই হন্ট করেছিল।
তখনও আমি "ঋক্ষ মেষ কথা" পড়িনি। পরে পড়ি। তারপর ধরো নাইন্টিজ শেষ
হচ্ছে, দু'হাজার একে বের হচ্ছে "ভালো জায়গাটা কোথায়"। এটা একটা
অসামান্য বাংলা কবিতার বই বলে আমি বিশ্বাস করি। একটা ক্লাসিক। এই বইটাও আমাকে
খুবই প্রভাবিত করে। তবে জয় এবং সুবোধ এই দু'জনের প্রভাব থেকেই আমি ধীরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি বলে আমার
মনে হয়। দেখো, এক দশকেই তো একজন কবির নিজের লেখার চিহ্ন তৈরি হয় না। তুমি নিজের
ক্ষেত্রেও দেখেছ এটা নিশ্চয়ই, নিজের ধরন বুঝতে অন্তত দশ-বারো বছর লেগে যায়।
তারপরেও সেই ধরন পালটে পালটে যায়। কখনও সেটা সচেতনভাবেই, কখনও নিজের অজান্তেই
পালটায়। আমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। এইভাবে ভাবলে, আমি আমার প্রথম যে-বইটিকে
স্বীকার করি, মোটামুটি যে-বই থেকে আমার নিজের একটা স্বর খু্ঁজে পাচ্ছি বলে মনে
করি, সেটা হল "আপেল শহরের সম্রাট"।
সব্যসাচী: হ্যাঁ, খুবই বিখ্যাত হয় বইটি।
অংশুমান: বিখ্যাত কি না বলতে পারব না। তবে বইটি
বেরোয় দু'হাজার এক সালে। এর খরচ আমি নিজেই দিয়েছিলাম। কোনও রকম বিজ্ঞাপন ছাড়া
কেবল লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল থেকেই দু'বছরের মধ্যে ৫০০ কপি বই বিক্রি হয়ে যায়৷ এবং
বইটি ছেপে আমার ৪০০০ টাকা লাভ হয়।
সব্যসাচী: আমি এবং আমার মতো অনেক তরুণেরই কিন্তু আপনাকে প্রথম
পড়া এই বই থেকেই। তখন আমরা ইলেভেন।
অংশুমান: হ্যাঁ, অনেক তরুণ কবিই সেকথা পরে আমাকে বলেছেন। বলা যায়, এই বইটি থেকেই কবিরা আমাকে কবি হিসেবে, কাইন্ড অফ, অ্যাকনলেজ করতে শুরু করেন। এইরকম ভাবতে থাকেন, মনে হয়, যে, এর কবিতা পড়া যায়। এই জায়গাটায় আসার জন্য একটা সময় লাগে তো। বলতে পারি, পরবর্তী কালে আমি যে-ধরনের কবিতা লিখব তার প্রাথমিক গঠনের ক্ষেত্রে প্রথমে মুগ্ধ করেন জয় গোস্বামী। তারপরে সুবোধ সরকার। ইনফ্যাক্ট, আমি বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম জয় গোস্বামীর লেখা দীর্ঘ কবিতার প্যাটার্নকে অন্ধ অনুকরণ করে। এরপর আস্তে আস্তে যা হয়, এসব জায়গা থেকে সরে গিয়ে আমি নিজের মতো করে, নিজের স্বরে লিখতে শুরু করি।
সব্যসাচী: আপনার কবিতায় একটু রাগী প্রতিবাদ আছে বলা
যায়...
অংশুমান: হ্যাঁ, আবার এক একসময় আমি খুব বিষণ্ণ
মানুষে পরিণত হই। "আপেল শহরের সম্রাট" থেকে এই বিষণ্ণতা আমার কবিতায়
জায়গা পেতে থাকে। "আপেল শহরের সম্রাট" মূলত লেখা হয়েছিল আমার বাবা মারা
যাওয়ার পরে। দু'হাজার সালে আমার বাবা মারা যান। এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতা লেখা
হয়েছিল এরপর। তবে আমার কবিতা প্রসঙ্গে আমি সাধারণ ভাবে বলব যে, আমি এমন একটা
স্তরে বাস করি, যেখানে এমনও হয়েছে, একই দিনে দু'তিন রকমের কবিতা লিখে ফেলেছি।
একটা হয়তো ভীষণভাবে রাজনৈতিক, অন্যটা একজন বিষণ্ণ মানুষের লেখা। অনেকেই প্রশ্ন
করেন এটা কি আদৌ সম্ভব? এটা কি আদৌ করা উচিৎ? আমি বলব যে, দেখো সকালবেলায় সত্যিই
আমি হয়তো বিষণ্ণ ছিলাম। ফলে এমন একটা লেখা লিখলাম যেটা একজন বিষণ্ণ মানুষের লেখা।
এবার ধরো দুপুরে এমন একটা ঘটনা ঘটল যার তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত আছে। ফলে
হয়তো বিকেলে এমন একটা কড়া লেখা লিখে ফেললাম যেটা মেজাজে, আঙ্গিকে, বিন্যাসে,
সজ্জায় সকালে আমি যে-লেখাটি লিখেছিলাম তার একদম বিপ্রতীপে অবস্হান করছে। অনেকেই
বলেন, এটা হয় না। এটা তঞ্চকতা। আমি দায়িত্ব
নিয়ে বলতে পারি যে, এই দুটো আমিই আমি। সৎভাবে এই দুটো লেখাই আমি লিখেছি। কবিতার
সঙ্গে আমি তঞ্চকতা করি না। একজন মানুষ একইসঙ্গে বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করেন। তাঁর
বিবিধ অবস্হান থাকতেই পারে। প্রতিবাদের কবিতায় ইঙ্গিতময় ভাষায় অনেকেই তাঁদের
প্রতিক্রিয়া জানান। কেউ কেউ আবার স্পষ্ট করে বলেন। তবে আমার মনে হয়েছে, যখন আমি
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে কবিতা লিখব, আমাকে স্পষ্ট করেই বলতে হবে। ইঙ্গিতময়
ভাষায় যে বলা যায় না তা নয়, আমার বন্ধুরা, অনুজ-অগ্রজরা, এরকম ইঙ্গিতের ভাষায়
অনেকেই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, কবিতা লিখেছেন। সেটা তাঁদের
পদ্ধতি। আমিও দুএকটা এরকম কবিতা লিখেছি। কিন্তু আমি যেহেতু আদ্যন্ত একজন রাজনৈতিক
মানুষ, আমার কবিতা লেখা আর রাজনৈতিক জীবন যেহেতু সমান্তরালে চলেছে, তাই আমার মনে
হয়েছে যে, এই ক্ষেত্রে আমাকে খুব স্পষ্ট করে বলতে হবে। কবিতায় যাকে বলে কূটত্ব,
অর্থাৎ ইশারা-প্রবণতা, ইঙ্গিতময়তা সেইটি তাকে যাকে তুমি যাকে রাগী কবিতা বা
প্রতিক্রিয়া জানানোর কবিতা বলছ, সেইসব কবিতায় আমি সচেতনভাবে পরিহার করেছি।
সব্যসাচী: মানে আপনি তত্ত্বনিরপেক্ষভাবে সহজ হতে
চেয়েছেন?
অংশুমান: একজাক্টলি। একটা ঘটনার কথা বলি। একসময় একজন
তরুণ কবি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, "কবিতা পাক্ষিক"-এর পোস্টমর্ডান কবিতা
সংকলনে তো আপনার বেশ কিছু কবিতা আছে, তাহলে আপনি কি পোস্টমডার্ন কবি? একসময় আমি
"কবিতা পাক্ষিক"-এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় অনার্স
পড়ছি। ছোটো ছিলাম। ফলে পোস্টমডার্নিজম সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বইগুলো ঠিকঠাক পড়তে
পেরেছিলাম, এমনটি কিন্তু নয়। তখন আমাদের সিলেবাসও অনেক পিছিয়ে ছিল। আমাকে পরে
আস্তে আস্তে এইসব তত্ত্ব পড়তে হয়েছে। সেই সময় সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত
হচ্ছি। কবিতা পাক্ষিকের সূত্রেই। প্রাথমিকভাবে ওঁদের কথা আমার ভালোই লাগত। এবং সেই
সময় তত্ত্বনিরপেক্ষভাবেই কিছু কবিতা লিখেছিলাম যেগুলো পড়ে ওঁদের মনে হয়েছিল যে,
সেগুলো পোস্টমর্ডান কবিতা। তাই ওঁদের সংকলনে, বাংলা এবং ইংরেজিতে...ইংরেজিটা
সম্ভবত সমীর রায়চৌধুরী করেছিলেন, হাওয়া উনপঞ্চাশ থেকে বেরিয়েছিল, আমার কবিতা আর
কবিতার অনুবাদ রেখেছিলেন। আমি আপত্তিও করিনি। কেননা অনেক সময় আমাদের অগ্রজদের
আদেশ মেনে নিতে হয়। কিন্তু আমাকে যদি কেউ পোস্টমর্ডানিস্ট কবি বলে চিহ্নিত করতে
চান, আমি বলবো নাহ, আমি পোস্টমডার্নিস্ট কবি নই। আমি তত্ত্ব মেনে কবিতা লিখিনি। আমার এটাও মনে হয় যে,
এদেশে পোস্টমর্ডান কবিতাচর্চা হিসেবে যা কাজ হয়েছে তাতে অনেক খাদ আছে। একটা
চালাকি আছে। আমি এটা অনেক প্রবন্ধেও লিখেছি। এতে আমার ওপরে অনেকে রেগেও গেছেন।
কিন্তু আমি আমার বলা-কথা থেকে সরে আসব না। এখানে অবশ্য একটা কথা বলতে হয়। অমিতাভ
গুপ্ত উত্তরআধুনিকতা বলে যে তত্ত্বচর্চাটি করেছেন সেটি সম্পূর্ণ অন্যব্যাপার। তার
মধ্যে বেশ কিছু জরুরি কথা ছিল। যেমন অমিতাভদা আমাদের আধুনিকতাকে ইউরোপীয় আধুনিকতার
এক্সটেনশন হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু এটিও খণ্ডিত দেখা। আজ আমার এটা বারবার মনে হয়।
খেয়াল করলে দেখবে যে, বিষ্ণু দে কেবলই ইউরোপীয় মিথ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেননি।
সমগুরুত্ব দিয়ে ভারতীয় পুরাণও ব্যবহার করেছেন। আসলে, আমার মনে হয় যে, বাংলা
কবিতাকে কখনওই কোনও তত্ত্বের খাঁচায় পুরে দেওয়া যাবে না। আমি বলব, বাংলা কবিতায়
কয়েকটি বিচ্ছিন্ন কালখণ্ড ছাড়া আন্দোলনও সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। বা আন্দোলন
হলেও সেটা দীর্ঘস্হায়িত্ব পায়নি।
সব্যসাচী: মানে, আপনি জীবন লিখতে চেয়েছিলেন! মানে
যেভাবে সে যাচ্ছে, তাকেই সরাসরি লিখতে, ধারনা আরোপ করে নয়...
অংশুমান: একদমই। একদমই। আসলে দেখো বাবার মৃত্যুটা
আমার কাছে এমন একটা ধাক্কা ছিল যে একটা পজ তৈরি হয়। এই পজের পর থেকে যদি তুমি
আমার লেখা লক্ষ করো, দেখবে, আমার লেখা ক্রমশ সহজ হওয়ার দিকে চলে গেছে। আজ আমি অনরেকর্ড এই কথাটাও
বলতে চাই যে, আমার কবিতা
লেখার ওপরে ধীরে
সবচাইতে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন তারাপদ রায়। ওঁর সহজ কথা বলার ভঙ্গিমা আমাকে
ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
সব্যসাচী: কবি তারাপদ রায় বাংলা কবিতার অন্যতম
প্রধান কবিকে প্রভাবিত করছেন, কিন্তু কী আশ্চর্য দুঃখের বিষয়, আমরা তাঁকে হাসির
গল্পকার...বলা ভালো চুটকির গল্পকার হিসেবে নির্দিষ্টিকৃত করে দিলাম।
অংশুমান: এটা খুবই দুঃখের বিষয়। তবে এখন তারাপদ রায়
পুনরাবিষ্কৃত হচ্ছেন। যেমন ভাস্কর চক্রবর্তী। মৃত্যুর পর ভাস্করদা নতুন করে
আবিস্কৃত হলেন। এখন তাঁকে আমরা উপাসনা করি। এই ভাস্করদাও একসময় আমার ওপর প্রবল
প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। প্রবল প্রভাব বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। আমার তো
ভাস্করদাকে নিয়ে কবিতাও আছে।
সব্যসাচী: এইবার যদি কবি অংশুমান করের কাছ থেকে সরে
তাত্ত্বিক, অধ্যাপক, পণ্ডিত, গদ্যকার অংশুমান করের কাছে একটা প্রশ্ন করি...
অংশুমান: না না, আমি তাত্ত্বিক নই সেই অর্থে। পণ্ডিতও
নই।
সব্যসাচী: প্রশ্নটা হল, দাদা আপনি গদ্যের বিভিন্ন
স্তর ছুঁয়েছেন। ছোটোগল্প, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত গদ্য...
আবার কবিতাতেও তো একই অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন ও বিচিত্র ফরম্যাটে লিখছেন। একই সঙ্গে
এতগুলো স্তরে কীভাবে স্বচ্ছন্দ হতে পারেন?
অংশুমান: আসলে মেধাবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তি একই সঙ্গে
একজন মানুষের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হতে থাকে। এটাকে আলাদা করা যায় না। আলাদা করলে ভুল
হবে। দেখো, একজন মানুষ সবসময় দুটো বিষয়ের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকেন। তবে আমার
লেখালিখির ব্যাপারে বলতে পারি গদ্য লেখার সময় আমি অনেক বেশি সচেতন থাকি। কবিতা
লেখার সময় যে সচেতন থাকি না তা বলব না, বলব অনেক বেশি আক্রান্ত হই। কোনও একটা
ভাবনা, কোনও একটা ইমেজের দ্বারা। তখন আমি সেই আক্রমণকে প্রতিহত না-করে সেই
আক্রমণের সামনে নিজেকে সমর্পণ করি।
আর গদ্য লেখার সময়ে ওই ভাবনার, ওই ইমেজারির, ওই বিষয়ের আক্রমণকে
প্রতিহত করার চেষ্টা করি। আমার চিন্তন ও ভাবনার জগৎকে কিছুটা অধিক সক্রিয় করে।
তারও আবার তারতম্য আছে। যখন আমি উপন্যাস লিখি এই প্রক্রিয়াটিকে অনেকটা কবিতার
কাছাকাছি এনে ফেলি। কারণ উপন্যাস আর কবিতার দেওয়ালটা তো হাজারো ছিদ্রময়। কিছুদিন
আগেই একটা জায়গায় এটা আমি বলেছিলাম। এটা জয় গোস্বামীও বলেছেন। কিছুদিন আগে
প্রশান্ত মাজির সম্পাদনায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা চমৎকার কবিতার সংকলনেও
পড়েছিলাম এই রকম একটি লেখা। যেটি কবিতা না গদ্য বোঝা যাচ্ছে না। আমি প্রশান্ত দাকে জিজ্ঞেস
করি, এই লেখাটাকে কীভাবে দেখব? কবিতা না গদ্য, এটা? প্রশান্তদাও বললেন, ঠিক বুঝতে
পারছি না। আসলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়রিতে এমন অনেক লেখা আছে, গদ্য,
যেগুলিকে পংক্তি বিন্যাস করে দিলে মনে হবে অবিকল কবিতা।
সব্যসাচী: এটা কিন্তু পূর্বজ বিভূতিভূষণের...
অংশুমান: অনেকের ক্ষেত্রেই বলা যায়। অনেকেই এমন
লিখেছেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমি একটা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলাম মাত্র। আসলে
এই কবিতা আর গদ্যের ভেদরেখাটি খুব জটিল। কখনও কবিতার মধ্যে গদ্য মিশে থাকে। কখনও
গদ্যের মধ্যে কবিতা। এই দুই মাধ্যমের মধ্যে পাঁচিল যদি থাকে তো সেটা লক্ষ ছিদ্রময়
পাঁচিল। আমি কিন্তু প্রবন্ধকে এর মধ্যে সেভাবে ধরছি না। প্রবন্ধ অনেক সংহত কঠিন
বিন্যাস দাবি করে। প্রবন্ধ সাধারণত কবিতার থেকে একটু দূরের জিনিস। আমি যেটা করি
গদ্য যখন লিখি, উপন্যাস বলো, মুক্ত গদ্য বলো, সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ বলো,
কিংবা রাজনৈতিক প্রবন্ধ কিংবা খবরের কাগজের ফিচার বলো, আমার ভাষাটাকে বদলে বদলে
দিই। আবার এক উপন্যাস থেকে আর এক উপন্যাসেও তারতম্য করেছি। মানে আমি যখন "আমি বিনয়
মজুমদার" লিখছি, যে ভাষায় লিখছি সে ভাষায় "চে ও কলাবতী" লিখিনি।
আবার "বিখ্যাত হইবার সহজ উপায়" লিখেছি আরেক ভাষায়। গত বছর ধরো দুটো
উপন্যাস লিখলাম পুজো সংখ্যায়, এই সময় আর আরম্ভে। এই দুটো উপন্যাসের ভাষার সঙ্গে
কিছুতেই আমি বিনয় মজুমদারের ভাষা মিলবে না। এটা আমাকে সচেতন ভাবে করতে হয়েছে।
তাবলে "আমি বিনয় মজুমদার" লেখার সময় কি হৃদয়বৃত্তিকে কাজে লাগাইনি?
আমার হৃদয় কি নিশ্চেষ্ট ছিল? নিশ্চয়ই না। কিন্তু বলতে পারো তার ওপরে ডমিনেট
করেছে আমার চিন্তাশক্তি, আমার সচেতনতা, আমার নির্মাণশৈলী। কখনও কখনও কবিতা লেখার সময়েও এমন
হয়, শেষ লাইনটা আমি আগে পেলাম। তারপর গোটা কবিতাটা আমি নির্মাণ করলাম। এটা
কিন্তু অনেকবার হয়েছে আমার সঙ্গে।এই নির্মাণটাকে অস্বীকার করলে কিন্তু মিথ্যে বলা
হবে।
সব্যসাচী: হ্যাঁ, এটা নির্মাণ আর সৃষ্টির একটা
বিখ্যাত তর্ক।
অংশুমান: হ্যাঁ, এই নির্মাণ আলিমেটলি সৃষ্টিই হয়ে
ওঠে। আবার এমনও হয়েছে যে, একটি কবিতা আমি লিখতে শুরু করেছি কিন্তু শেষ লাইনটা আমি
জানি না। লেখাটা আমাকে নিয়ে গিয়ে ওই শেষ লাইনে ফেলেছে। কিন্তু এমন কোনও গল্প বা
উপন্যাস আমি লিখিইনি, যার শেষটা আমি জানি না। মানে, আমি তখনই একটা গল্প বা
উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিই, এটা নাটকের ক্ষেত্রেও হয়, নাটকও লিখেছি কিছু, যখন
গোটা বিষয়টাকে একটা ছকের মতো দেখতে পাই। এরপরে এই, তারপরে ওই। এভাবে লেখাটাকে
এগোবো। এটা দেখতে না-পেলে আমি উপন্যাস, গল্প বা নাটক লিখতে শুরু করি না। মাঝখানে
হয়তো লেখাটা অনেক বাড়তে থাকে। এদিকে চলে যায়, ওদিকে চলে যায়। কিন্তু উপন্যাস,
ছোটোগল্প বা নাটকের ক্ষেত্রে আমাকে শেষটা দেখতেই হয়। দেখতে পেতে হয়। দেখার জন্য
অপেক্ষা করতে হয়। না হলে লিখতে শুরু করি না। এইটা কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে আমি বলতে
পারব না। এইটুকু তফাতের কথা আমি তোমাকে বলতে পারি।
সব্যসাচী: এখানে যদি আরেকটা সূত্রে আসি, আপনি কিশোর
উপন্যাস লিখেছেন...
অংশুমান: হ্যাঁ। কেবল কিশোর উপন্যাস নয় একদম ছোটোদের
জন্যও লেখালিখিও করেছি, একেবারেই ছোটোদের জন্য। আনন্দমেলায়,আনন্দমেলার বাইরেও।
তোমাকে বলছি ছোটোদের জন্য লেখা ভীষণ কঠিন। আমি যতরকমের লেখা লিখেছি, তার মধ্যে
রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে প্রতিটা শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমাকে অত্যন্ত সচেতন
থাকতে হয়। আমার ব্যবহৃত কোনও শব্দের যাতে ভুল ব্যাখ্যা না হয়, বা কোনও শব্দ যেন অস্হির
পরিস্থিতি তৈরি না করে দেশে বা রাজ্যে, এই বিষয়ে আমাকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। আমাকে
কিন্তু ঠিক এতখানিই সতর্ক থাকতে হয় যখন ছোটোদের গল্প বা ছোটোদের উপন্যাস লিখি।
সারাক্ষণ ভাবতে হয় যাতে এমন কোনও শব্দ লিখে না ফেলি যা ছোটোদের মনে একটা দাগ তৈরি
করবে, যে দাগটাকে আমি আর মুছে ফেলতে পারব না।
সব্যসাচী: আপনি কি মনে করেন আদৌ শিশু বা কিশোরদের
জন্য আলাদাভাবে কোনও লেখা হতে পারে?
অংশুমান: অবশ্যই পারে। না হলে তো এতবছর ধরে এই ধারাটা
গোটা বিশ্বসাহিত্যেই বজায় থাকত না। ছোটোদের লালন করার দায় তো বড়োদের ওপরেই বর্তায়।
ছোটোরা তো আর নিজেদের জন্য লিখতে পারে না। কেউ লিখেছে কিছু কিছু। কিন্তু ছোটোদের
একটা মনোজগত তৈরি করা, সুকুমার মনোবৃত্তি তৈরি করার একটা দায় বড়োদের থাকে। যদি
আমরা লিখিত ইতিহাসের আগে যাই, সেখানেও কিন্তু ছোটোদের একটা জগত ছিল। কোনটা ভুল
কোনটা ঠিক এগুলো কিন্তু চিহ্নিত করে দেওয়া আছে, মুখে মুখে ঘুরতে থাকা ছড়ায়,
লোককথায়।
সব্যসাচী: তবে সম্প্রতি অনেকেই চাইছেন না শিশু কিশোর
সাহিত্য বলে আলাদা করে কিছু চিহ্নিত করতে। কিন্তু আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা
তুললেন, যে কিছু মূল্যবোধ ওষুধের মতো দেওয়া উচিত শিশু কিশোরদের। এখন আমার প্রশ্ন
হল এই মূল্যবোধ নির্মাণের ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কোথায়?
অংশুমান: দেখো, বিশ্ব শিশু সাহিত্যের দিকে আমি যাচ্ছি
না। আমাদের বাংলার শিশু সাহিত্যে যে কাজগুলো হয়েছে তার মধ্যে বলতে পারি যে, এই
ভালো মন্দের দ্বন্দ্বটার মাধ্যমে মূল্যবোধ তৈরি করে দেওয়ার কাজটা আমাদের অগ্রজরা
করেছেন। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে শিশুসাহিত্যর মাধ্যমে ছোটোদের অনেক তথ্য
দেওয়া। বিশ্ব সংসার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এছাড়াও একটা বিষয় হল, ছোটোদের
কল্পনার প্রসার ঘটানো। এটা শিশু সাহিত্যিকরা করেছেন। তোমাকে কিছু ক্লাসিক উদাহরণ
দিচ্ছি। যদি তুমি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পড়ো, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
পড়ো, লীলা মজুমদার পড়ো, দেখবে এই সব গুণগুলোই এঁদের লেখায় রয়েছে। উপেন্দ্রকিশোরের
মধ্যে যেমন নীতিশিক্ষার ব্যাপার আছে, বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর লেখা আছে। আবার একই
সঙ্গে কল্পনার জায়গাটাকেও উসকে দিচ্ছেন। গুপী গায়েন বাঘা বাইন লিখছেন। এই যে
ট্রাডিশন, এই ট্রাডিশনের ক্ষেত্রে রায়চৌধুরী পরিবারের একটা বিরাট অবদান আছে।
উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ--কী কাজ করে গেছেন এঁরা সবাই,
জাস্ট ভাবা যায় না! আমার আশ্চর্য লেগেছে সত্যজিতের ক্ষেত্রে এইটা দেখে যে, অপরাধ
জগতের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ফেলুদার মাধ্যমে অথচ সেই অপরাধ জগতে,
খেয়াল করলে দেখা যাবে, নারী ঘটিত কোনও অপরাধ একেবারেই নেই। এইটা কিন্তু তুমি
ব্যোমকেশ পড়তে গিয়ে পাচ্ছো না। সেখানে নারী হাজির। এই যে অপরাধের মধ্যে দিয়ে
সাদা কালো দেখানো, কিন্তু তাকে অমলিন রাখা... বড়োদের জগতের যে ক্লেদ আর গ্লানি
তার স্পর্শ যেন ছোটোরা না পায় এটা
নিশ্চিত করা, এইটে সত্যজিৎ-এর খুব বড়ো একটা অর্জন। এইটা করা কিন্তু একটা বেশ কঠিন
কাজ।চাট্টিখানি কথা নয়। ফেলুদা পড়লে বোঝা যায় যে, সত্যজিৎ ছোটোদের নীতি শিক্ষা
দিচ্ছেন আবার অসংখ্য নতুন তথ্য দিচ্ছেন। ফেলুদার জনপ্রিয়তার এটাও একটা কারণ।
তথ্য। আবার একই সঙ্গে এন্টারটেইন করছেন, সাদা কালোর দ্বন্দ্ব দেখিয়ে নীতি শিক্ষা দিচ্ছেন, আবার
থ্রিলার পড়ার যে রোমাঞ্চ সেটা তৈরি করছেন। কল্পনার জায়গাটাও প্রসারিত করছেন।
কল্পনাকে প্রসারিত করার সবচাইতে বড়ো উদাহরণ বলা যায় বিভূতিভূষণের "চাঁদের
পাহাড়"কে। আবার এইখানে তোমাকে সুকুমারকেও মানতে হবে। কল্পনা যে কতদূর যেতে
পারে, কীভাবে ননসেন্সের মাধ্যমে সেন্সের কথা বলা যেতে পারে তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ
সুকুমার।
সব্যসাচী: কিন্তু রূপকথা কী এর চাইতে আলাদা জায়গায়
অবস্থান করছে?
অংশুমান: ওই যে বললাম, রূপকথায় ওই সাদা কালোর
দ্বন্দ্ব তৈরি করা... তুমি যদি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার পড়ো, উপেন্দ্রকিশোরের
কিছু রূপকথার রি-রাইটিং পড়ো, কিংবা এর সবচাইতে বড়ো উত্তরাধিকার শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যায় পড়ো বা লীলা মজুমদারের ভূতের গল্প--দেখবে কী অসামান্য কল্পনার
প্রসার। "হলদে পাখির পালক" বাংলা ভাষায় আর কী লেখা হবে! কিংবা
"টংলিং"? এইগুলোই কিন্তু আধুনিক রূপকথা। এই যে ধারা পরবর্তী কালে তাকে
বহন করলেন শীর্ষেন্দু। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
সেখানেও দেখবে এমন কোনও অপরাধ চিত্রিত হচ্ছে না...
সব্যসাচী: অমলিন অপরাধ যাকে বলে...
অংশুমান: একদমই। এমন কোনও অপরাধ চিত্রিত হচ্ছে না যাতে
বড়োদের জগতের ক্লেদ লেগে থাকে। ছোটোদের জগতে কী অপরাধ নেই? ছোটোরাও অপরাধ করে
চলেছে। কিন্তু সেই জায়গাটাকে অমলিন রাখা... এই দিক থেকে কিন্তু শিশু কিশোর
সাহিত্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করা, আলাদাভাবে ধরিয়ে দেওয়া যায়। যেমন ধরো সায়েন্স
ফিকশনের ক্ষেত্রে, বাংলা সায়েন্স ফিকশন এখন যথেষ্ট স্ট্রং হয়েছে। অনেকেই এসেছেন।
অদ্রীশ বর্ধন লিখেছেন। সেখানেও একইভাবে শিশু কিশোর সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফলে, আমি
বলব, বিচিত্র দিকে বাংলা শিশু কিশোর সাহিত্য প্রবাহিত হয়েছে। এবং আমি যখন
ছোটোবেলায় পড়ি শৈলেন ঘোষের লেখা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু ছোটোদের লেখা,
অসম্ভব ভালো লাগতো। আবার মতি নন্দী খেলাকেই নিয়ে এলেন শিশু কিশোর সাহিত্যে।
সব্যসাচী: হ্যাঁ চুনী গোস্বামী, পি কে আনন্দমেলায়
লিখতেন খেলতে খেলতে, উইং থেকে গোল...
অংশুমান: না না, ওগুলো তো একরকম কিন্তু আমি বলছি
ফিকশনের মধ্যে মতি নন্দী নিয়ে এলেন খেলাকে।
সব্যসাচী: হ্যাঁ কলাবতীকে নিয়ে এলেন
অংশুমান: হ্যাঁ, ঠিক। ভাবা যায় একটা মেয়ে
ক্রিকেটারকে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছেন ওই সময়ে! কতটা এগিয়ে ছিলেন সময়ের থেকে! মতি
নন্দীর মতো ছোটোগল্পকার, ঔপন্যাসিক খুব কম এসেছেন বাংলা সাহিত্যে। কবিতার ক্ষেত্রে
যেমন তারাপদ রায় তেমনই বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একজন আন্ডাররেটেড লেখক হচ্ছেন
মতি নন্দী। যাঁরা তাঁকে আদর করার ঠিক করেন অবশ্য। আমি তো মতি নন্দী পড়ে চমকে চমকে উঠি। এবং বাংলা
শিশু কিশোর সাহিত্যে উনি কিন্তু একটা ছাপ রেখে গেছেন। ওঁর সবচাইতে বিখ্যাত উপন্যাস
যেটা "কোনি", সেটা এখন লড়াইয়ের গল্প হিসেবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত
হয়েছে। কিন্তু যদি তুমি ওঁর ক্রিকেটের গল্পগুলো পড়ো, মানে কলাবতীর লেখাগুলো,
সেগুলো এক একটা বিস্ময়। আমি এই লেখাগুলোকে অনেক বেশি নম্বর দেব।
"কোনি"র চেয়ে ফার বেটার। " কোনি" সিনেমা হয়েছে বলে একটু বেশি
প্রচার পেয়ে গেছে।
সব্যসাচী: এখান থেকে আবার কবিতার কাছে ফিরি। আপনি
আপনার কবিতায় কী লিখতে চান? কী দেখতে চান?
অংশুমান: দেখো, কী লিখতে চাই আমি সবক্ষেত্রে জানি না।
তবে একধরনের কবিতা আমি লিখি, সেখানে কী লিখবো আমি জানি। নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়
আমি এইসব কবিতা লিখি। এর বাইরে আবার এমন কিছু কিছু কবিতা লিখি যেখানে আমি যে
ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তার ছাপ থাকে। আমার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে
বলতে পারি যে, আমার লেখার ক্ষেত্রে দেখাটা খুব জরুরি। কিছু কিছু জিনিস অবজার্ভ
করতে করতে আমার মাথায় কবিতার পংক্তি চলে আসে। এই অবজার্ভেশনটা আমার ক্ষেত্রে ভীষণ
জরুরি। আবার কোনও লেখা পড়তে পড়তেও লেখা চলে আসে। যেমন কারোর একটা পংক্তি আমাকে
এমন ইন্সপায়ার করল যে, সেটা পড়ে আমার মাথায় একটা পংক্তির জন্ম হল। আসলে আমার
নিজের মনে হয়েছে যাপন এবং পাঠ, অর্থাৎ তুমি
যে জীবনটার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ এবং যা পড়ছ, তাই একজন কবির জীবন তৈরি করে। আমার
ক্ষেত্রে বলতে পারি, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-নাটকের ক্ষেত্রে কী বলব আমি জানি।
স্পষ্ট করে জানি। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আমি জানি তখন যখন আমি রাজনৈতিক
-অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে লিখছি। তখন কী লিখতে হবে আমি জানি। আরেক ধরনের কবিতার
ক্ষেত্রে আমি এটা জানি না। সেটা আমার কোনও অবস্থান থেকে বা মনের কোনও অবস্থা
থেকে তৈরি হয় বা দেখা দৃশ্য থেকে অটোমেটিক্যালি চলে আসে। বিখ্যাত কোনও উপন্যাস
বা কবিতা পড়তে পড়তে যখন কোনও একটি পংক্তির কাছে থমকে দাঁড়াতে হয়, এবং এই
দাঁড়ানো থেকে একটা লেখা আসে, সেখানে আমি সত্যিই জানি না কী আমি বলতে চাইছি। তবে
আমি খেয়াল করে দেখেছি ইদানিং কালে এই ধরনের কবিতাতে আমি কিছু স্পষ্ট কথা বলে
ফেলছি। কী বলছি তা হয়তো জানি না, কিন্তু বলে ফেলতে হচ্ছে। বলে ফেলছি। দেখা থেকেই
হয়তো সেটা জন্ম নিচ্ছে বা পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে সেটা জন্মাচ্ছে।
সব্যসাচী: মানে আপনি নিঃসহায়ের মতো কবিতার কাছে
যাচ্ছেন...
অংশুমান: হ্যাঁ, আমি বললাম তো সেটা কোনও দৃশ্য দেখেই
হোক বা কোনও পংক্তির সঙ্গে সংঘর্ষেই হোক, আমি আক্রান্ত হলে সেই আক্রমণের সামনে নিজেকে সমর্পণ
করি।
সব্যসাচী: অসাধারণ বললেন, আক্রমণের সামনে নিজেকে
সমর্পণ করি। এই সাক্ষাৎকারের শেষের দিকে এসে পড়েছি। এবার একটা প্রশ্ন করি। গদ্যের
ক্ষেত্রে আপনি এত স্তর ছুঁয়েছেন, এতটা বিস্তার আপনার সমকালে বা উত্তরে কী আর লক্ষ
করেছেন? বিশেষ করে প্রবন্ধ লেখা কম হয়েছে বলে কি আপনার মনে হয়?
অংশুমান: না, এটা সঠিক অবজার্ভেশন না। দেখো, তোমাকে
বলতে পারি, একজনের কথা। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময় এ বিষয়টি নিয়ে কথাও হয়।
মাঝেমাঝেই। তিনি হিন্দোল ভট্টাচার্য। তিনি কিন্তু উপন্যাস, প্রবন্ধ...যদিও তিনি
এখন আর প্রবন্ধ কথাটি ব্যবহার করতে রাজি নন...প্রচুর গল্প, উপন্যাস লিখেছেন। হয়তো
ব্যক্তিগত গদ্যের সংখ্যা আমার চেয়ে কম। কিন্তু অনেক গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও
লিখেছে। আবার শ্রীজাত বা বিনায়ক হয়তো
প্রবন্ধ কম লিখেছে কিন্তু নিয়মিত উপন্যাস লিখে চলেছে। বিনায়কের কিছু উপন্যাস তো
গুরুত্বপূর্ণ।
সব্যসাচী: আপনার কি মনে হয় না, বিনায়ক
বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন
বেশি, ঔপন্যাসিক সত্তাকে সরিয়ে!
অংশুমান: দেখো, এটা অনেক সময় হয়। লেখা সংখ্যায়
বেড়ে গেলে অনেক সময় এটা হয়। কিন্তু ওর দু'তিনটে উপন্যাস তো আমার মনে হয় খুবই
যত্ন করে লেখা। শ্রম ছিল। শ্রমের ছাপ ছিল। এগুলো বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে লেখা।
তুমি বলতে পারো যে, এখানে তো বিষয়টারই মুখ্য। হয়তো ঠিক। কিন্তু যে ইস্যুটাকে ও ধরতে
চেয়েছে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা আমার মনে হয়েছে। আমি ওর কিছু উপন্যাসের
মুগ্ধ পাঠক। আর আমি তো শ্রীজাতের উপন্যাসের খুবই ভক্ত। আমি ওপেনলি বলতে পারি,
বাংলা ভাষায় শ্রীজাতের আগে কেউ "বৃক্ষ অনুবাদক"-এর মতো উপন্যাস লিখতে
পারেনি। লেখার কথা ভাবতেও পারেনি। "তারা ভরা আকাশের নীচে" শ্রীজাতের আগে
কেউ লেখেনি, কেউ লেখেনি।
মানে... এগুলো পরে বোঝা যাবে। এখন হয়তো বোঝা যাচ্ছে না। আসলে জনপ্রিয়তা অনেক
সময় সমকালে লেখকের শত্রু হয়ে যায়। যেটা শ্রীজাতের ক্ষেত্রে হয়েছে। ওর
জনপ্রিয়তা ওর সমকালে অনেক ক্ষেত্রে ওর শত্রু হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সময়ের পর
যখন দূর থেকে সবকিছু বিচার হবে, আমি ওর দীর্ঘদিনের বন্ধু বলে এটা বলছি না, আমি
একটা ডিসট্যান্স রেখেই ওকে পড়ার চেষ্টা
করি, তো সেইখান থেকে আমি এই দুটো উপন্যাসের কথা বলব, "বৃক্ষ অনুবাদক" আর
"তারা ভরা আকাশের নীচে"। আমার মনে হয়েছে, এই দু'টি উপন্যাস বাংলা
সাহিত্যে খুবই উল্লেখযোগ্য দুটি সংযোজন। আবার শ্রীজাত হয়তো বা সেই অর্থে খুব বেশি
প্রবন্ধ লেখেনি। কিন্তু যশোধরা রায়চৌধুরী খুবই সিরিয়াসলি প্রবন্ধের কাজটা
করেছেন। প্রবন্ধের বই আছে একাধিক। যশোধরাদি প্রবন্ধ লিখেছে, উপন্যাস লিখেছে,
ছোটোদের জন্য লিখেছে। নানা ফির্মে, নানা জনরাতে সমান ভাবে যশোধরাদি সক্রিয়। এটা
আমার কাছে একটা বিস্ময়! একই সঙ্গে যশোধরাদি এত উন্নত মানের লেখা লিখছে কী করে!
সেটা হিন্দোল সম্পর্কেও আমার মনে হয়। সত্যি সত্যিই মনে হয়। ও যে কম্প্রোমাইজ করে
তা তো নয়। আমি এই মুহূর্তে হিন্দোলের একটি বই পড়ছি, সেটা "বিশু পাগলের
অচলায়তন"। এবং বইটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ বই হয়েছে। বা ওর যে বইটা
অলোকরঞ্জনের ওপর সম্প্রতি প্রকাশ পেল, খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই, সেটি। বা ওর
"নাশকতার বারান্দা" বলে একটা উপন্যাস, ও দিয়েছিল আমাকে, সেটিও
অন্যরকমের একটা কাজ। হিন্দোলের ছোটোগল্প নিয়েও অনেক কাজ আছে। সম্প্রতি ওর একটা
গল্প সংকলন প্রকাশ পাচ্ছে। একইভাবে আমি চমকে উঠি অর্ণবের লেখাপত্র পড়ে। অর্ণব
সাহা। একই সঙ্গে কতগুলো বিভিন্ন জনরাতে ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে। আমাদের পর
তোমাদের সময়ে যারা ধারাবাহিকভাবে এই কাজটা করে যাচ্ছে, তাদের অনেকের নামই নেওয়া
যায়, কিন্তু একজনের নাম আমি করব, সে হচ্ছে পার্থজিৎ চন্দ। সে কিন্তু নিয়মিত এই
বিচিত্র ফর্ম এবং জনরা নিয়ে চর্চার মধ্যে রয়েছে।
সব্যসাচী: শেষ প্রশ্নে আসব। এই যে তরুণ কবিদের নগর
অভিমুখে, বলা ভালো, পুঁজি অভিমুখে যাত্রা, কারণ মফসসলেও একটা করে কেন্দ্র বা নগর
থাকে, সে যাত্রা আপনারও। আপনি একজন মফসসলের মানুষ, আপনার জার্নিও হাজার হাজার
তরুণ কবির সঙ্গে মিশে যায়, এইবার এই যাত্রায় যে বিষ আর শিক্ষা দুটোই মিলেমিশে
আছে, এ ব্যাপারে তরুণ প্রজন্মের জন্য কী বলবেন। বা কী শুধরে দিতে চাইবেন?
অংশুমান: দেখো, আমার যাপনটা মোটামুটি বললাম। তবে তরুণ
কবিদের কোনও পরামর্শ দেওয়ার জায়গায় আমি আছি বলে মনে করি না, পরামর্শ দেওয়া
উচিতও নয়। তবে একটা কথা বলতে পারি, তাঁরা কেবল পুঁজি থেকে বিষটাই আহরণ করছেন তা
নয়। দেখো পুঁজিটাকে তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। এবং নগর অভিমুখিতা একটা
স্বাভাবিক ব্যাপার। যদি তুমি বড়ো আকারে দেখো, সভ্যতার জার্নিটাই কমবেশি এরকম।
আবার এর মধ্যেই ছোটো ছোটো পকেট যে রেজিস্ট্যান্স ছিল না, তা তো নয়; সাতের দশকে যে
বিখ্যাত স্লোগান ছিল, যেটা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সফলও হয়, যে গ্রাম দিয়ে শহর
ঘেরো, সেইটা কিন্তু এখনও চলমান আছে। দেখো আমি মফসসলের ছেলে বলেই হয়তো একটু বেশি
করে এই লড়াইটা অনুভব করেছি...গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার লড়াই। আবার আমি কলকাতাতেও সমান
স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে থেকেছি। একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই। একটা সময় আমি
কলকাতাকে আক্রমণ করে কবিতা লিখেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম যে, কলকাতা একটা মানসিকতা।
একটা প্রবণতা। একটা মেটাফোর। কলকাতার মধ্যেও অনেকগুলো কলকাতা আছে।
সব্যসাচী:এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা...
অংশুমান:
হ্যাঁ, আমি এটাকে আরেকটু এক্সটেন্ড করে বলতে চাইছি, কলকাতার মধ্যেই কেবল কলকাতা
নেই, আমার গ্রাম বেলিয়াতোড়ের মধ্যেও একটা কলকাতা রয়েছে। আসলে এটা কেন্দ্র আর
প্রান্তের মধ্যের একটা সম্পর্ক। আবার এ কথাও সত্য, কলকাতার মধ্যেও একটা মফসসলও
রয়েছে। কলকাতার মধ্যে থেকেও কলকাতায় পৌঁছতেই তোমার অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে।
কলকাতার মধ্যে থেকেও তুমি একজন মফসসলের মানুষ হয়ে থেকে যেতে পারো। আবার মফসসলের
মধ্যে থেকে তুমি কলকাতার মধ্যে রয়েছ এটাও আজকের দিনে হতে পারে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ,
মেসেঞ্জারের যুগে তো এটা আরও বেশি করে সম্ভব। এবার আমার বক্তব্য হল যে, এটা থেকে
পালাতে পারবে না তুমি। এটার মধ্যেই থাকতে হবে। কেবল তোমার পায়ের তলার মাটিটাকে
একটু বুঝে নিতে হবে। সেইটা যদি সরে যায়, সেইটাকে যদি ভুলতে শুরু করো, তাহলে খুব
বিপদ। তবে আমি তরুণদের ক্ষেত্রে খুবই আশাবাদী এবং বেশিরভাগ তরুণই নাগরিক বিষ আহরণ
করছেন না। ধরো আমি একজন তরুণের কথা বলতে পারি যে কবিতা লেখে। নাম নিচ্ছি না। তার
একটা বইমেলার গল্প বলে শেষ করব। তুমি যে বললে নগরকেন্দ্রিকতা বা পুঁজির
ডমিন্যান্স তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে এই তরুণরা নিজেদের মতো করে একটা লড়াই
দিচ্ছে, সেটা হয়তো একটা অসম লড়াই কিন্তু সেটার একটা বিরাট গুরুত্ব আছে। শেষ যে বইমেলা
হয়েছিল দু হাজার কুড়ি সালে, সে বছর আমার অনেকগুলো বই বেরিয়েছিল। পুরুলিয়ার
একটি ছেলে, আমি তার নাম করছি না সঙ্গত কারণেই। সে কৃত্তিবাসের স্টলে গিয়েছিল।
সেখানে আমার অনেকগুলো বই রাখা ছিল, অন্য অনেক কবি লেখকদেরও বই রাখা ছিল, তা সে
বলে, স্যার, আমি অন্য স্টল থেকে আপনার অন্যান্য বই কিনেছি, আপনার এই দুটো বই আমি
কিনতে চাই কিন্তু আমার কাছে আর টাকা নেই। ওর কথা শুনে আমি পড়ি সংকটে। দেখো আমি তো
নিজের বই আর নিজে প্রকাশ করি না, ফলে নিজেরই বই আমাকে কাউকে দিতে হলে, প্রায়ই
কিনে দিতে হয়। সেই ছেলেটিকে আমি বললাম যে, ঠিক আছে, তুমি নাও, আমি কিনে দিচ্ছি। সে তাতেও সম্পূর্ণ রাজি না। তার কাছে যতটুকু
টাকা আছে, সেই টাকাটুকু দিয়েই সে কিনতে চায়। বলল, আমার কাছে এইটুকু টাকা আছে,
আমাকে দিয়ে দিন। তখন আমি আমাদের স্টল যাঁরা সামলাতেন তাঁদের বলি, দিয়ে দিন ওকে
বই দুটো। বাকি টাকাটুকু আমি পে করে দেব। এটা ওই ছেলেটিকে জানতে দিইনি। এখন বলছি।
এটা বলার মতো ঘটনাও নয়। আসলে আমি যাদের কাছ থেকে নিজেরই বই স্টলে রাখার জন্য নিয়েছিলাম, তাদেরকে তো
বইয়ের টাকা দিতেই হত। তাই আমি দিয়ে দিয়েছিলাম ডিফারেন্সটুকু। ছেলেটি বইদুটো
কিনলে দেখি পিঠের বিশাল বড়ো ব্যাগ বইয়ে ঠাসা। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি, এই যে
যেটুকু টাকা ছিল সেটা দিয়ে বই কিনে নিলে, এবার তুমি ফিরতে পারবে তো? তোমার কাছে
ফেরার মতো টাকা আছে? বলল, রাতে আমি যদি চক্রধরপুরের টিকিট পাই তো পুরুলিয়া যাব।
না হলে রাতটা হাওড়া স্টেশনে শুয়ে থেকে কাল সকাল বেলা ট্রেন ধরে ফিরে যাব। টাকা
আছে ট্রেনে ফেরার। হোটেলে থাকার টাকা নেই। আমি পরের দিন ছেলেটিকে ফোন করেছিলাম। সে
আমাকে জানিয়েছিল রাত্তির বেলাটা সে হাওড়া স্টেশনে কাটিয়ে সকালে ফিরে যায়। এবং
সেটা শীতকাল। জানুয়ারির শেষ, ফেব্রুয়ারি শুরু। ভাবা যায়! এই কমিটমেন্ট! একে
তুমি কী বলবে? এই ছেলেটির যে নগরকেন্দ্রিকতা...তাকে কীভাবে নেবে? যে বইগুলো সে
কিনেছিল সেই বইগুলো তো সে গ্রামে বসে পাবে না। সেখানে ফ্লিপকার্ট গিয়ে পৌঁছবে না,
বইঘর গিয়েও পৌঁছবে না। ওকে কলকাতায় আসতেই হবে, কলেজস্ট্রিটে আসতেই হবে। এবং সে
এতখানি পরিশ্রম করে নগর থেকে রসদ সংগ্রহ করছে, নিজেকে লালন করার জন্য। যাতে করে
তার মানসিকতাটা গ্রাম্য না-হয়ে যায়। আমরা যাকে বলি গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট, তার
বাইরে গিয়ে যাতে সে দাঁড়ায়, তার জন্য সে সচেষ্ট। আবার তার পা কিন্তু মাটিতে প্রোথিত আছে। অর্থাৎ সে যেন গ্রামে
থাকে অথচ তার মানসিকতা যাতে গ্রাম্য না হয়ে পড়ে তার জন্য সে সচেষ্ট আছে। এজন্য সে
নগরে এসেছে। গ্রামের তো সব কিছু ভালো না। সেই খারাপগুলোকে একত্রে বলছি গ্রাম্যতা,
সেইটা থেকে সে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই জন্য যদি ভাবো যে সে পুঁজির
দাসত্ব করছে তাহলে কিন্তু ঠিক ভাবা হবে না। এই উদাহরণটা একটা খুব বড়ো উদাহরণ।
এরকম একাধিক উদাহরণ আছে। বাংলা কবিতার বই বিক্রিতে,
আমি উপন্যাস বিক্রির দিকে যাচ্ছি না, কাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি? কারা কেনে? আমি
দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই তরুণরা কেনে আর তাদের জন্যই বাংলা কবিতা নিরাপদ রয়েছে। এই
যে পুঁজির দাপটের কথা তুমি বলছ, তার উলটোপিঠে দাঁড়িয়ে এরা হিম্মত নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। এবং এই লড়াইকে আমি লাল
সেলাম জানাই।
সব্যসাচী: এরপর আর কোনও কথা চলতে পারে না। এবং সইকথার পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ
থেকে আপনাকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। ভালো থাকবেন সবসময়।
অংশুমান:
তোমরাও ভালো থেকো।
5 মন্তব্যসমূহ
সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়ে মুগ্ধ হলাম। অনেক কিছু শিখলাম
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হলাম। ঋদ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো। পড়লাম। কিছু বিষয় জানলাম।
উত্তরমুছুনভীষণ ভালো একটা সাক্ষাৎকার পড়ে ফেললাম।
উত্তরমুছুনসুন্দর, সাবলীল। অনেক কিছু জানলাম। অভিনন্দন জানাই কবিকে।🙏
উত্তরমুছুন