সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সৌমী আচার্য্য:ভ্রমণ:জলপ্রপাতের কেওনঝড়

জলপ্রপাতের কেওনঝড়


 

ওড়িশার কেওনঝড় এককথায় জলপ্রপাতের ঘরবাড়ি। পথ চলতি ছোটো ছোটো ঝোরাও কিছু কম নয়। যদিও "গরমের ছুটিতে ওড়িশা উত্তপ্ত কটাহ যেন", এমন বাক্য শুনেও যাবই আমি যাবই বলে ভাগ্যিস চারচাকায় পাড়ি দিলাম, তাই তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হল। ওড়িশার অন্দরে প্রবেশ করা মাত্র ঝাঁ চকচকে রাস্তার সাদর অভ্যর্থনা মন ভরিয়ে তুলল। দূর দিগন্তরেখায় একে একে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পূর্বঘাট পর্বতমালার শিখররাজি।

এই পথের সৌন্দর্য মনমুগ্ধকর। যেন মহান শিল্পীর ক্যানভাস। একশো আশি ডিগ্রি বিস্তৃত পর্বতমালা তার মধ্যে যেন প্রবেশ করতে চাইছে কালো সর্পিল পথ। দুপাশে কখনও শালবন, কখনও বড়ো বড়ো অল্প পাতার ইউক্যালিপটাস বা সোনাঝুড়ি। ভোর চারটেতে কল্যাণী থেকে পাড়ি জমিয়েছি। সাথে ছিল ঘরে তৈরী কেক। কিন্তু তা দিয়ে আর কতক্ষণ? তাই পূর্ব পরিচিত বাংরিপোসির খয়েরী রিসর্টের রেস্টুরেন্টে গাড়ি দাঁড়াল। ইয়া বড়ো সাইজের ধোসা আর সুস্বাদু বড়া দিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট খাওয়া হল। তারপর আবার যাত্রা শুরু। এবার খানিকক্ষণ পাহাড়ি পথ বেয়ে চলা। যত এগোচ্ছি পথ আরও চওড়া আরও সুন্দর হয়ে উঠছে। এপথে গাড়িচালককে সতর্ক থাকতে হবে অনেক বেশি, কারন ইউ টার্ন যুক্ত ঝকঝকে রাস্তায় বিপদের প্রবল সম্ভবনা। বৈতরণী নদী পেরিয়ে কেওনঝড় শহরকে বাঁ হাতে রেখে আমরা হাইরোড ধরে একটু এগিয়ে ডানদিকে টার্ণ নিলাম, খানিক এগিয়ে বাঁহাতে পান্থনিবাস।

 

কেওনঝড় পান্থনিবাসে প্রবেশ করলাম ঠিক দুপুর বারোটা দশে। আগে থেকে বুক থাকায় ঘর রেডি করাই ছিল। ওটিডিসির এই পান্থনিবাস বেশ পুরোনো। তেমন মেনটেনেন্স নেই কিন্তু প্রতিটি স্টাফ্ আন্তরিক এবং ভদ্র। রাস্তাতেই তাদের ফোন এসেছিল, কখন পৌঁছব, কী খাব ইত্যাদি জানার জন্য। বলা ছিল কী খাব, তাই স্নান সেরে খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম সানাঘাগড়া জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে।


ওটিডিসি থেকে মাত্র 2 কিমি পাহাড়ি জঙ্গুলে পথে হেঁটে যাওয়া যায় কিন্তু আমরা অনেক জায়গায় যাব বলেই গাড়ি পথ বাছলাম, দূরত্ব ছয় সাত কিমি। এখানে বলে নেওয়া ভালো কেওনঝড় বর্তমানে কেন্দুঝার নামে ভূষিত হলেও কেওনঝর নামটিই প্রচলিত। এই জেলা তিনটি মহকুমা নিয়ে গঠিত। আর সানাঘাগড়া কথাটির অর্থ হল, ছোট জলপ্রপাত। সানমাছকান্দানা নদী 100 ফুট উচ্চতার এই জলপ্রপাতটি তৈরী করেছে অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে। এই জলপ্রপাতে যাবার জন্য টিকিট সংগ্রহ করে প্রবেশ করতেই একটি ছোট্ট ঝিল চোখে পড়ে, যার মাঝে মহাদেবের সুন্দর একটি মূর্তি রয়েছে। রয়েছে বোটিং এর ব্যবস্থা, ছোটোদের পার্ক। তবে আমার অসম্ভব সুন্দর লেগেছে পাহাড়ের ঢালে উঁচু উঁচু গাছের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে ঝরনায় পৌঁছানোর পথটি এর সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবেনা। বহু স্হানীয় মানুষ এই ঝরনায় ঘুরতে এসেছেন। তাদের হাসি মুখ, পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁদের কলতান সব মিলিয়ে মোহময় পরিবেশ। বেশ কিছু সময় এখানে বসে কাটিয়ে দিয়েছি।

 

এই ঝরনা থেকে বেরিয়ে আমরা সানমাছকান্দানা নদীর আরেকটি জলপ্রপাত বড়াঘাগড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। লালমাটির পাহাড়ি পথ ও জঙ্গলের মাঝে খাড়াই চওড়া পাথরের গায়ে জলপ্রপাতটি রুগ্ন হলেও সুন্দর।

লালচে ঘোলা জলে স্হানীয় ছেলেরা স্নান করছে, টুরিস্ট দেখে তাদের উৎসাহ দ্বিগুণ। তাই নানা রকমভাবে ঝাঁপ দিয়ে চলেছে জলছ। এই ঝরনার চারিদিকে আমগাছে ভর্তি। ছোটো ছোটো লিচুর মতো। আমার কর্তামশাই অতি উৎসাহী হয়ে একটি সংগ্রহ করে কেটে মুখে দিতেই "উরিবাপ' বলে চোখ উল্টালেন। বুঝলাম ওনারা গাছেই সুন্দর। এখান থেকে একটু উপরের দিকে এগোলেই বড়াঘাগড়া ড্যাম। চতুর্দিকে পাহাড়ের মাঝে বিপুল জলরাশি এক অপরূপ শোভা সৃষ্টি করেছে। যদিও গ্রীষ্মের দহনে জল শুকিয়ে এসেছে তবু কল্পনা করলাম এর ভরা বর্ষায় রূপ বড় সুন্দর হবে। যদিও তারই ভিতর ছোটো ছোটো নৌকায় মাছ ধরছে বাচ্চারা। এখানে বহু মানুষ পিকনিক করতে আসেন। ড্যামটিতে ওঠার সিঁড়ি নীচ থেকে দেখতে প্রাচীন কোনো স্হাপত্য বলে ভ্রম হয়।

 

কেওনঝড় থেকে ১৩২ কিমি দূরে সুন্দরগড় জেলার বনাইগড়ের নন্দাপানিতে অবস্থিত খণ্ডধর জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে আমরা পরদিন ভোরে বেরিয়ে গেলাম। এই জলপ্রপাতটি ওড়িশার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জলপ্রপাত যেটির উচ্চতা প্রায় ৮০১ ফুট। বনের পথ দিয়ে ৬৮৮টি সিঁড়ি ভেঙে এই ঝরনার কাছে পৌঁছে মন ভালো হয়ে যায়। দুধসাদা ঝরনা সরাসরি পাহাড়ের বুক চিরে ঝরে পড়ছে। সত্যিই একে দেখতে তলোয়ারের মতো তাই এর নাম খণ্ড বা তলোয়ার। এই পাহাড়ের পাথর অসম্ভব সুন্দর ও কৌতুহল উদ্রেককারী। লাল বেলেপাথর ও কালো লৌহযুক্ত শিলায় গঠিত পাহাড় মনে হয় যেন কেউ তুলিতে এঁকেছে। এখান থেকে একটি ছোট্ট পাথর খণ্ড আমরা নিয়ে এসেছি আমার বাড়ি এলে যে কেউ একে দেখতে পারে। তাহলেই বুঝতে পারবে পাহাড়টি কী ভীষণ সুন্দর।


খণ্ডধরের বাইরে দারুণ সুন্দর একটি ক্যাফে রয়েছে সেখানেই আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। এরপর যাব সমনামী আরেকটি জলপ্রপাতে কিন্তু সেটি রয়েছে কেওনঝড়ে। তাই আবার যাত্রাশুরু। দূরত্ব দীর্ঘ। যদিও পথের দুধারে প্রথিত নিমগাছের সারি মন ভরিয়ে তোলে। জগন্নাথ নির্মিত হন নিমকাঠে তাই বোধহয় এদের নিমগাছের প্রতি অপাড় ভালোবাসা। জঙ্গল পেরিয়ে ছোটো ছোটো গ্রাম এড়িয়ে নিঝুম নাতিদীর্ঘ পথ বেয়ে পৌঁছে যাই কেওনঝড়ের খণ্ডধরে। কেওনঝড় শহর থেকে 50 কিমি দূরে অবস্হিত এই জলপ্রপাতটি নিঃসন্দেহে ওড়িশার সবচেয়ে রোমান্টিক জলপ্রপাত।  জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছানোর রাস্তাটি কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বাঁধাই করে দেওয়া। পুরো পথটাই ঘোড়ানিম, শাল , চাকুণ্ডা, পিয়ালসাল গাছে পরিপূর্ণ। খাড়া পাহাড় তিনদিকে, মাঝখানে ঝরে পড়ছে জল। সূর্যের আলো থাকতে থাকতে এখানে এলে রামধনু অনিবার্য ভাবে চোখে পড়বে জলপ্রপাতের নীচের অংশে। আমরা পৌঁছেছিলাম পড়ন্ত বিকেলে। ফলে রামধনু দেখিনি। এখানে অল্প কিছু সময় কাঠিয়ে রওনা দিতে হল কেওনঝড়ের পান্থনিবাসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এরপর ঘন অন্ধকারের ভিতর দিয়ে জঙ্গলের রাস্তা পেরোনো সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এপথ আদতে হাতি করিডর। মাইলের পর মাইল ছুটে চলেছে আমাদের ছোট্ট লাল টিয়াগো। জনশূন্য রাস্তা। গাছেদের গায়ে মার্কিং টেপ লাল চোখের মতো জ্বলছে। ভয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইছে আমার। কেওনঝড় শহরের আলো পাহাড়ের বাঁকে দেখতে পাবার পর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। স্বস্তির শ্বাস। 

 

কেওনঝড়ে অসংখ্য ঝরনা বা জলপ্রপাত রয়েছে। আমাদের সময় সংক্ষেপ হওয়ায় সব দেখা হয়না। আবার যাব কথা দিয়ে এসেছি ওড়িশার অন্দরে।

 

 



সৌমী আচার্য্য

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ