নির্বাসনের গদ্য
আমি যে কি ভীষণ ভালোবাসতে পারি তা ভেবে একেকদিন ভেতরে ভেতরে খুব ভয় হয়। পাতার ওপর বৃষ্টির জলের মতো আমার প্রাণ হুহু করে কাঁপে।নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার কাউকে সমস্ত দিয়ে ভালোবাসার দিনগুলো নিজেকে ভীষণ নরম লাগে। একতাল নরম মাটি, কেউ সামান্য হেঁটে গেলেও পায়ের দাগ পড়ে যায়।
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন
করি এমনকী ভাল? কাউকে নিজের সমস্ত দিয়ে ভালবাসা। প্রতিবার কেন জানি না উত্তর আসে,
আঘাত শুধু আঘাত, আরেকবার নিজেকে ধীরে ধীরে মরে যেতে দেখা।
কিছুদিন আগেই এক বন্ধুর
সঙ্গে রেলস্টেশনে দেখা।একদিন আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। নিজেদের সুখ দু:খের কথা
কিছু কিছু জানতাম। ট্রেনে ফিরলাম পাশাপাশি বসে। নানা গল্পের মাঝে আমার পাশে রাখা
তার হাতটি দেখে মনে হল একদিন কত সহজে ধরেছি এই হাত অথচ এতটা খেয়াল করিনি। একটা
দীর্ঘ হাত,আঙুলগুলো নীলমণিলতার মতো সুন্দর। মাঝে মাঝে আমাদের কাঁধদুটো স্পর্শ করে
যাওয়া শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্বস্তি তৈরি করছিল অথচ একদিন এই শরীরদুটি একে
অপরের সঙ্গে কতটা পরিচিত ছিল। কোনও অস্বস্তি হত না।
আমাদের বাড়ির মধ্যে
তফাৎ দুটি স্টেশনের। কিছু বছর আগে হলে, নেমে ওকে বাড়ি অব্ধি দিয়ে আসতাম। অথচ, এবার
ও নেমে গেল ট্রেন থেকে, আমি শুধু বিদায় জানিয়ে নিজের আসনে বসে রইলাম। ও নেমে গিয়ে
একবারও জানলা দিয়ে না তাকিয়ে সোজা চলে গেল গন্তব্যের দিকে।
বুকের ভেতরে একটি মানুষ
কেমন হাহাকার করে উঠল। মনে হল, একবার তাকানোও কি আমার প্রাপ্য নয়? কেন ছেড়ে গেল
আমাদের সম্পর্ক? কেন ছেড়ে যায়? কিছুতেই উত্তর পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয় এত চাওয়া
আমাদের প্রতিদিন জীবনের কাছে যে কিছুতেই আর সামান্যতে সন্তুষ্ট হই না।
এখনও কেউ খুব কাছে সরে
আসতে চাইলে নিজের সমস্ত দিয়ে আটকাই। বলি, তফাৎ যাও। ভালবাসায় আমি তেমন বিশ্বাস করি
না। আসলে নিজের ভেতরে সমস্ত কিছু দিয়ে ভালবাসতে পারা মানুষটিকে আমি ভয় পাই। জানি,
কেউ একজন এলে তাকে ঘিরেই আমার সমস্ত জীবনে আবর্তিত হবে। ছোট ছোট ভাল মন্দ লাগা,
অভ্যেস, তার সুখ, দু:খের দ্বারা প্রবল প্রভাবিত হব। এমনকী একটা দিনও তাকে না দেখে
থাকা যাবে না।
যায় না, এমন বহুবার
দেখেছি। তবে পৃথিবী তো এমন নয়। সেখানে কাজ আছে, ব্যস্ততা আছে, সেখানে প্রতিযোগিতা
আছে, আছে নানারকমের নানারকম।আরও যা বেশি আছে তা হল নতুন নতুন জীবনের প্রলোভন।
রাগ হয় নিজের ওপরে কেন
যে সহজে প্রলোভিত হই না। একনিষ্ঠ থাকি। বহুদিন আগে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে
প্রতিভা মানে কী?
বলেছিলাম একনিষ্ঠতা।
কী আশ্চর্য বিশ্বাস করি
আমি কথাটায়। চারিদিকে এর বিপরীত এক প্রবাহ দেখি। একজন মানুষও পাই না যে এই কথাটা
সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে। তাই নিজের ভেতরের ভালবাসাকে গোপন রাখি।প্রকাশ্যে বলি,
ভালবাসায় আমি কতটা অক্ষম।
তবুও তো মাঝে মাঝে মনে
হয়, কেউ কি সত্যিই থাকে না? কেন এই পৃথিবীতে সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে চাওয়া
মানুষেরাই সবথেকে আহত হয়। জানি না, শুধু চারিদিকে দেখি এক উন্মাদ কর্মযজ্ঞের
দামামা বাজে।সেখানে সবাই খুব শক্ত, সবাই নির্মম, সবাই প্রতারক।
সবাই শুধু আমি, আমি আর
আমি।
কাউকে সমস্ত দিয়ে
ভালবাসতে গেলে এই আমিত্বের বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয়। তবুও ভয় লাগে।প্রাণের
ভেতরটা পাতার ওপরে দুফোঁটা জলের মতো কাঁপে।
জীবনে যে কতবার অনুভব
করেছি, আমার ভালবাসা সীমা অতিক্রম করেছে অথচ সে সীমার ভেতরেই আছে। কতবার দেখেছি
আমিই একমাত্র ভালবাসা নই তার জীবনে। কতবার জেনেছি সমস্তকিছুর জন্যই ভালবাসা
বিসর্জন দেওয়া যায়।
কেন এমন ভাবতে পারি না।
ভয় হয়, খুব ভয় হয়। হুহু করে কাঁপি।নিজেকে একা একটা ঘরের ভেতরে বন্দী করে রাখি।
দরজায় ঝোলাই অনেক তালা। তবুও যে কী করে একটা ছিদ্র থেকে যায় প্রতিবার।
তবু যে কেন প্রতিবার এই
অসহ্য দংশন।
সেই ট্রেনের জানলা দিয়ে
এখনও তাকিয়ে থাকি। যে নেমে যায়, সে গন্তব্যের দিকে চলে যায় একবারও না তাকিয়ে।
কেউ নেমে যেতে বলে না
আমাকে। আমার ট্রেন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে এই জীবনের
আশ্চর্য অতিক্রম দেখি, দেখে যাই।
শান্তিনিকেতন ১৪২৮
0 মন্তব্যসমূহ