সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অভিজিৎ চৌধুরী




গুগল , শীর্ষ এবং আমি


হু আর ইউ ?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি আমি । লম্বা , কালো , অকরুণ মুখের পুলিশ আধিকারিক । 
কিছুদিন আগেও সরকারি আধিকারিক ছিলাম । তখন একটা লাল রং এর আই কার্ড ছিল । তখনও পুলিশ উল্টে-পাল্টে অনেকক্ষণ দেখতো ।
কোন ডিপার্টমেন্ট !
আই কার্ডে যাঁর সই তিনি গ্রামের নন এমনকি মফস্‌সলেরও নন । অনেক সুদূরের । তবুও তখন কিছুক্ষণ নাড়া-ঘাঁটা করার পর ছেড়ে দিতো ।
এখনতো সেসব উত্তরও নেই । অবসর প্রাপ্ত । ছেলে একটা গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে । মোবাইলে গুগল অ্যাপ দেখিয়ে বলেছে ~ এই অ্যাপ তোমার ম্যাপ । পথ হারাবে না কখনও । ড্রাইভারও বয়স্ক মানুষ সন্তর্পণে চালাচ্ছিলেন । 
হঠাৎ এই অশান্তি । ভি. ভি. আই. পি. কেউ আসছেন । সেই ভি. ভি. আই. পি. র পথের কাঁটা এখন আমি । 
এরকম হুংকার শুনেছিলাম বেদানাপুরের এক পুলিশ অফিসারের মুখে । তখনও আমি চাকরি করি । স্কলারদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান । আমার দায়িত্ব ছিল দেখভালের । খুবই সুভদ্র ছিলেন তাঁরা । 
হু আর ইউ ? এই প্রশ্নের উত্তর হয় কি কোনো !
আমি কে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমিও তো সেই কবে থেকে খুঁজছি । আমি তো কোন গ্রহ , নক্ষত্র নয় । স্বীকৃত স্কলারও নই । রাজ্য , রাষ্ট্রের আমার মতোন অর্বাচীনকে স্বীকৃতি দিতে বয়ে গেছে ।
পুলিশ অফিসার ঠোঁট কামড়াচ্ছিল । কোনরকম আঁতলামি উত্তর দিলে পুলিশি ভাষা বেরিয়ে আসতো বা এমন চাটতো যে তা পেঁদিয়ে খাল খুলে দেওয়ার গোছের হতো ।
সূর্য সেন স্ট্রিটে আমার ছেলেবেলা কেটে ছিল । পোড়া পাঁউরুটির ছেলে মনোহারির চুড়ির দোকানের সুশীলকে পুলিশ এমন চেটেছিল যে এক রাতেই পায়ুর দ্বারে ক্ষত হয়ে গেছিল । পুলিশকে আমার অরণ্যের বাঘ , সিংহের চেয়েও বেশী ভয় করে । অবশ্য ওদেরও ট্রেলার আছে । যাদের নরম কি গরম ভাষণে পুলিশ ইঁদুর হয়ে যায় । তাঁদের তো আমার আরো আরো ভয় করতো । তাঁদের কথা মতোন না চললে একটাই ভাষণফেঁসে যাবেন
তখন তাঁদের যদি আমতা আমতা করে বলতাম আমি তো সৎ । ৩৬৫ দিনের ক্রীতদাস । 
তাঁরা উত্তর দিতেন না । চাবুক-টা চক্রাকারে শূন্যে ঘোরাতে থাকতেন । 
হু আর ইউ ?
এর আগে ছোট অফিসার বলেছিলেন আপনি কি আমাদের চাকরি খেতে চান ! 
আমার ব্যাগে তখন একটা ছোট্ট স্মারক আর দুটো টিফিনের প্যাকেট । গার্ডার আলগা করে বাক্স দেখে নিয়েছি ~ চারটে লুচি আর আলুর দম । ফাঁকা রাস্তায় খাবো বলে এখনও খুলিনি । 
উত্তর না পেয়ে , গাড়িতে পুলিশের লাঠি পড়ল । শালা ঢ্যামনা ।
ড্রাইভার আমার বয়সি । তার হাত কাঁপছে । 
সে বললো স্যার । আপনার মোবাইল কি বলছে ! 
নেট চলে গেছে ।
মধ্য কলকাতা জলমগ্ন । তার মধ্যে ভি. ভি. আই. পি দমদম বিমান বন্দরে যাবেন । খবরে পড়েছি তিনি চলেছেন মঙ্গলগ্রহে । নতুন কোন খনিজ , প্রানের সন্ধান সেখানে পাওয়া গেছে । সেই খনিজ দ্রব্য ভারতবর্ষে এলে বেকারি ঘুচে যাবে । শিল্প চাকরি সব হবে ভারতবর্ষে । কম তো হয়নি ! নিজের জীবনেই তো দেখলাম । বাড়ি , গাড়ি , সাইকেল গ্রাম-গঞ্জের পথে ঘাটে । স্কুলে গেলেই মেয়েরা রোজগেরে । এসব কিছু চাকরি করার সময় দেখেছি এবং শপথ মেনে করেছি ।
শহরে তখন আসতে পারতাম না । বছরেও একবার নয় । ক্যালেন্ডারের সন তারিখ চোখের সামনে ডাকিনী যোগিনী হয়ে নাচতো । খুব অপমানের ভয় ছিল আমার । অপমান আর অপমান । তাচ্ছিল্য আর তাচ্ছিল্য । তবে তখন পে কমিশন বসেছিল । লিভ স্যালারি বেড়ে গেলো , গ্র্যাচুইটি বাড়তো । অনেকে এসব ব্যাপারে দড় ছিল । আসলে তাঁদের ভয়ংকর রোমান্টিকতা ছিল পে-কমিশনে মাইনে বৃদ্ধি নিয়ে ।
আমার সময় ছিল না ভাবার । শুধু কাজ আর কাজ । উন্নয়ণের সভা এবং টার্গেট । কিছুই হচ্ছে না । ওপরের বসদের একটাই হুংকার সব রিল্যাক্স করছে । 
ভয় পেতে পেতে অবসর নিয়ে নিলাম । আমি যখন চাকরি করি ছেলেটা এম. বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল । দক্ষিণ ভারতের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । হিউমেন রিসোর্স । 
ওর নিজের রিসোর্স অধরা থেকে গেলো এখনও , আরকি করে কোন কোম্পানির হিউমেন রিসোর্স হবে ! অথচ শহরে সবুজ একেবারে নেই। মোড়ে মোড়ে আইনক্স , শপিং মল। টাকা উড়ছে ।
গোপনে ডাইরি লিখতাম । অবসরের পর হারুর দোকানেচাপান করে লেখার মাত্রা বাড়িয়ে দিলাম । বউ সদয় থাকলে একেকদিন এসে বলতো  
কি লেখো বলো তো তুমি !
আমি বলতাম ডাইরি ।
বউও বেশ সচেতন নাগরিক । আমার চেয়েও অনেক বেশী সচেতন নাগরিক ।
একদিন আমার লেখার বেগ দেখে সে বেশ ভয় পেয়ে গেলো ।
বললো তোমার পেট পরিস্কার হয়তো ! আমি বললাম হয়তো মনে হয় কারণ ওটা তো প্রতিদিনই হয় ।
বউ বললো স্বপ্ন দেখো !
আমি বললাম হ্যাঁ ।
এসব তো তোমার ছিল না !
আমি বললাম কি সব !
এই যে ঘাড় গুঁজে লেখা ।
আমি এখন নাক ডাকি !
বউ বললো অনেক কম ।
আমার কি পেচ্ছাপে গন্ধ হয় !
না । কি করে কমালে ! সত্যিই তো !
এসব আজগুবি লেখায় ।
দেখো তোমাকে না একদিন পুলিশে ধরে নিয়ে না যায় !
আমি ঘারড়ে গেছিলাম । রাষ্ট্র তো অভয়ারণ্য হওয়া উচিৎ । কিন্তু আমি পরিবারের কর্তা , ভয় পেলে চলবে কেন ! 
বললাম আমি যা লিখি তুমি বুঝবে না ।
বউ বললো মানে !
আমি বললাম সত্যি তুমি বুঝবে না ।
বউ তো রেগে কাঁই , সে বললো তোমার মতোন আহাম্মক ভীতু বুঝবে , আর আমি বুঝবো না !
আমি তখন বললাম বেদানাপুরের কথা । 
হাতে স্কলারদের পাস । মূল স্টেজে পৌঁছে দিতে হবে । আর সেই পুলিশ অফিসার চীৎকার করে বলেছিল হু আর ইউ ?
আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি । সেই থেকে একটু আধটু লিখছি আর খুঁজছি আমি কে ?
উত্তর পাচ্ছি না ।
বউ এবার নরম গলায় বললো তুমি তো এরকম ছিলে না ! মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো !
আমি বললাম , তুমি-ই তো বললে আমি ক্রমশ শারীরিক দিক থেকে সুস্থ হয়ে উঠছি । আর মন তো শরীরের দোসর ।
বউ খুব একটা নিশ্চিন্ত হলো না ।
এদিকে উত্তর না পেয়ে পুলিশ হিংস্র হয়ে উঠলো আরো ।
হিংস্র লাঠির আঘাত গাড়ির বনেটে আছড়াতে থাকলো । ওদিকে লাল বাতির হুঁসিয়ারিতে জনপথ আরো আরো সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছিল । 
জলমগ্ন কলকাতার রাজপথে তখন আমি নেমে পড়েছি । আমার বাম দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ । এক সময় নাম ছিলহিন্দু কলেজসেই কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের কক্ষে একদা প্রতিধ্বনিত হতো রবার্টসনের শেক্সপিয়র । আর আমরা খারাপ ছেলেরা বেকার হলের মাঠে বহু ফুটবল ম্যাচ খেলেছি । 
ফুটবল যে চামড়ার গোলাকৃতি অবয়বের এবং পায়ে তার স্পর্শ হলেই টুং টাং শব্দ হয় আমি রবার্টসনের বদলে সেই টুং টাং আর হই হল্লা শুনতে পেলুম । 
গুগলের ম্যাপের যাবতীয় আপলোড মোবাইলে করে দিয়েছিল আমার ছেলে । শীর্ষ আমায় হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিল । তারাশংকর ড্রাইভার পুরোনো মানুষ । আমি আশ্চর্যের বিহ্বল থেকে গুগলের পথ নির্দেশ তারাশংকরকে বলে যাচ্ছিলাম । রোমাঞ্চিতও হচ্ছিলাম । সঠিক পথে আসতে আসতে ছেলেকে বলেও ছিলাম ।তোর জয় হোক 
সে বলেছিল , গুগলের ভারতীয় শাখার সি. আই. ও সুন্দর পিচাই । তুমি বরং ওঁকে ধন্যবাদ জানাও । আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম । ভারতবর্ষ তবে তো এগোচ্ছে । চন্দ্রাভিযান হলো কয়েকদিন আগে । অবশ্য স্যাটেলাইটে নাকি শেষ অবতরণের বার্তা আসেনি । আবার আমাদের ভি. ভি. আই. পি. মঙ্গলগ্রহে চলেছেন ।  
আমার অবশ্য এসবে কোন অন্তরাস নেই । আমি নিজেকেই খুঁজছি শুধু ।
বউ বলে,  স্বার্থপর ।।
আমি ছেলেকে মুঠোফোনে বললাম ,
এর উদ্ভাবক কে ?
ছেলে বললো তুমি আবার আইনস্টাইনের সম-মর্যাদা দিয়ে ডাইরিতে লিখতে যেও না । এটা কোন আবিস্কার নয় । প্রযুক্তির সম্প্রসারণ মাত্র । 
শীর্ষকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম । এক সময় রচনা লিখতে হতো ~ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি । তখন প্রযুক্তিকে ব্যাপক গাল মন্দ করেছি ।
আবার বললাম যাই হোক কে ?
ল্যারি পেজ ও সারজি ব্রিন ।
কতো সালে ?
১৯৯৮ । শীর্ষ বললো ।
সে আবার বললো গুগল এসবও তোমায় বলে দেবো ।
নিরাপদে এসেছিলাম সুস্মিতা মেমোরিয়াল হলে । হলের ভিতরে আশি শতাংশ কবি , গল্পকার হচ্ছেন ৫ জন পক্ককেশ । আমার বয়সি । 
টেবিলে থরে থরে পুতুলের মতোন ছোট ছোট স্মারক সাজানো রয়েছে ।
ডাইরি লিখতে লিখতে সেটা একদিন উপন্যাস হয়ে গেছিল । তারপর শব্দ গুণে গুণে সামঞ্জস্য রেখে পরিচ্ছেদ ভাগ করে নিলাম ।
সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছে দেখলাম কতো প্রকাশক । শুধুফেলো কড়ি , মাখো তেলআর অনেক প্রকাশকের নানা ব্যবসা রয়েছে । কাঠ , ইন্টিরিয়র ডেকরেশন । 
একজন প্রকাশক আমাকে তাঁর প্রকাশনার কাগজের মান বোঝাতে থাকলো । শেষমেশ চটি একটা উপন্যাসের জন্য ৫২,০০০/- টাকা চাইল । তাঁর কথা শুনে আমি তো প্রায় ভিরমিই খেলাম । প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে এতো টাকা তুললে সংসারে আমার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি অনিবার্য ।
মহার্ঘ প্রকাশককে ছেড়ে শেষমেশ একজন মাঝারি পেলাম । ৩০,০০০ টাকায় রফা হলো । ২০০ কপি বই সে হাতে দিয়েছিল । ২০০ কপির ২ কপিজাগরণপত্রিকার প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলুম । ফলপ্রাপ্তি-স্মারক , টিফিন-বাক্স এবং নিখর্চার হাসি ।
সব ঠিকঠিক চলছিল কিন্তু ভি. ভি. আই. পি.র আগমন গুগলের সুলুক সন্ধানে বিপর্যয় আনলো । 
তারাশংকরের গাড়ি বাঁচানোর জন্য আমি জলমগ্ন পথে নেমে পড়েছি । হাঁটতে হাঁটতে ফেবারিট কেবিনে এলাম । রবিবাসরীয় ফেবারিট কেবিনে একটা টেবিলও খালি নেই । ধুম্র উদ্‌গীরণ হচ্ছে চারপাশে ।
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিউটের কাছে যাওয়ার আগেমন্টুর বিখ্যাত মিষ্টি পান খেলাম ।
আমার মধ্যে এসব হয় ! বউ বলে , এক ধরণের স্কিজো ফ্রেনিয়া । মনে হচ্ছেটিনের তলোয়ারহচ্ছে । উৎপল দত্তের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি ।
সেই বেদানাপুরের বড় পুলিশ অফিসার একটা উপকার করেছিলেন । ভি. আই. পি. কার্ডগুলি আমার কাছ থেকে নিয়ে বলেছিলেন ~ আপনি তো নন ভি. আই. পি । ভি. আই. পি দের কার্ডগুলি আমি পৌঁছে দেবো ।
গুগল সার্চ করলাম পাগলের মতোন । কিছুই দেখাচ্ছে না । নেট নেই । তখন বুঝলাম প্রযুক্তির আসল ঈশ্বরনেটকানেকসান । 
কিন্তু ফিরবো কি করে ! আমি তো বহুদিন পথে বের হয়নি । ঘাড় গুঁজে লিখে চলি পাতার পর পাতা । মধ্যরাতে সহানুভূতি দেখিয়ে বউচাকরে দেয় । শুধু বিপর্যয়ের সতর্ক- বার্তা দিয়ে বলে এমন কিছু লিখো না যাতে এই বয়সে পুলিশ তোমাকে তুলে নিয়ে যায় । 
২৬/৬ সূর্য সেন স্ট্রিট । আমার জন্মভূমির বাসাবাড়ি । দু-হাত জড়ো করে পেন্নাম করলাম । জীবন শুরু হয়েছিল এই অন্ধ গলি থেকেই । 
বিকেলের আলো শেষ হয়ে আসছে । গরম গরম তাজা তাজা বক্তৃতা হচ্ছে চারিদিকে । উন্নয়ণ হচ্ছে । উন্নয়ন চাই । নতুন একটা জিনিস পাবলিক খাচ্ছে ~ তার নামধর্মশনি ঠাকুরকে পেন্নাম করলাম সুযোগ বুঝে কারণ কোন ধম্মোর খপ্পরে পড়তে চাই- না ।
নিয়নের আলোগুলি জ্বলে উঠেছে । সেই আলোয় দেখতে পেলাম শীর্ষের মুখ । আমার খুব কাছেই চলে এসেছে সে । 
বললো পথ হারিয়ে ফেলেছিলে ! তোমার চেনা পাড়া তো ! 
আমি বললাম জন্মভূমি ।
তারপর বললাম নিজেকে চিনেছি এতোদিনে ! 
শীর্ষ হেসে বললো কী ?
নন ভি. আই. পি ।
শীর্ষের এক হাত ধরে আমি এগিয়ে চললাম তারাশংকরের গাড়ির দিকে । 

অভিজিৎ চৌধুরী