গুগল , শীর্ষ এবং আমি
হু আর ইউ ?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি
আমি । লম্বা , কালো ,
অকরুণ মুখের পুলিশ আধিকারিক ।
কিছুদিন আগেও সরকারি
আধিকারিক ছিলাম । তখন একটা লাল রং এর আই কার্ড ছিল । তখনও পুলিশ উল্টে-পাল্টে
অনেকক্ষণ দেখতো ।
কোন ডিপার্টমেন্ট !
আই কার্ডে যাঁর সই তিনি
গ্রামের নন এমনকি মফস্সলেরও নন । অনেক সুদূরের । তবুও তখন কিছুক্ষণ নাড়া-ঘাঁটা
করার পর ছেড়ে দিতো ।
এখনতো সেসব উত্তরও নেই ।
অবসর প্রাপ্ত । ছেলে একটা গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে । মোবাইলে গুগল অ্যাপ দেখিয়ে বলেছে ~ এই অ্যাপ তোমার ম্যাপ । পথ হারাবে না কখনও ।
ড্রাইভারও বয়স্ক মানুষ সন্তর্পণে চালাচ্ছিলেন ।
হঠাৎ এই অশান্তি । ভি.
ভি. আই. পি. কেউ আসছেন । সেই ভি. ভি. আই. পি. র পথের কাঁটা এখন আমি ।
এরকম হুংকার শুনেছিলাম
বেদানাপুরের এক পুলিশ অফিসারের মুখে । তখনও আমি চাকরি করি । স্কলারদের সম্বর্ধনা
অনুষ্ঠান । আমার দায়িত্ব ছিল দেখভালের । খুবই সুভদ্র ছিলেন তাঁরা ।
হু আর ইউ ? এই প্রশ্নের উত্তর হয় কি কোনো !
আমি কে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমিও তো সেই কবে থেকে খুঁজছি ।
আমি তো কোন গ্রহ , নক্ষত্র নয় । স্বীকৃত স্কলারও নই । রাজ্য ,
রাষ্ট্রের আমার মতোন অর্বাচীনকে স্বীকৃতি দিতে বয়ে গেছে ।
পুলিশ অফিসার ঠোঁট
কামড়াচ্ছিল । কোনরকম আঁতলামি উত্তর দিলে পুলিশি ভাষা বেরিয়ে আসতো বা এমন চাটতো যে
তা পেঁদিয়ে খাল খুলে দেওয়ার গোছের হতো ।
সূর্য সেন স্ট্রিটে আমার
ছেলেবেলা কেটে ছিল । পোড়া পাঁউরুটির ছেলে মনোহারির চুড়ির দোকানের সুশীলকে পুলিশ এমন
চেটেছিল যে এক রাতেই পায়ুর দ্বারে ক্ষত হয়ে গেছিল । পুলিশকে আমার অরণ্যের বাঘ , সিংহের চেয়েও বেশী ভয় করে । অবশ্য ওদেরও ট্রেলার আছে
। যাদের নরম কি গরম ভাষণে পুলিশ ইঁদুর হয়ে যায় । তাঁদের তো আমার আরো আরো ভয় করতো ।
তাঁদের কথা মতোন না চললে একটাই ভাষণ ‘ফেঁসে যাবেন’ ।
তখন তাঁদের যদি আমতা আমতা
করে বলতাম – আমি তো
সৎ । ৩৬৫ দিনের ক্রীতদাস ।
তাঁরা উত্তর দিতেন না ।
চাবুক-টা চক্রাকারে শূন্যে ঘোরাতে থাকতেন ।
হু আর ইউ ?
এর আগে ছোট অফিসার
বলেছিলেন – আপনি কি আমাদের চাকরি খেতে চান !
আমার ব্যাগে তখন একটা
ছোট্ট স্মারক আর দুটো টিফিনের প্যাকেট । গার্ডার আলগা করে বাক্স দেখে নিয়েছি ~ চারটে লুচি আর আলুর দম । ফাঁকা রাস্তায় খাবো বলে
এখনও খুলিনি ।
উত্তর না পেয়ে , গাড়িতে পুলিশের লাঠি পড়ল । শালা ঢ্যামনা ।
ড্রাইভার আমার বয়সি । তার
হাত কাঁপছে ।
সে বললো – স্যার । আপনার মোবাইল কি বলছে !
নেট চলে গেছে ।
মধ্য কলকাতা জলমগ্ন । তার
মধ্যে ভি. ভি. আই. পি দমদম বিমান বন্দরে যাবেন । খবরে পড়েছি তিনি চলেছেন
মঙ্গলগ্রহে । নতুন কোন খনিজ , প্রানের সন্ধান সেখানে পাওয়া গেছে । সেই খনিজ দ্রব্য ভারতবর্ষে এলে বেকারি
ঘুচে যাবে । শিল্প চাকরি সব হবে ভারতবর্ষে । কম তো হয়নি ! নিজের জীবনেই তো দেখলাম
। বাড়ি , গাড়ি , সাইকেল গ্রাম-গঞ্জের
পথে ঘাটে । স্কুলে গেলেই মেয়েরা রোজগেরে । এসব কিছু চাকরি করার সময় দেখেছি এবং শপথ
মেনে করেছি ।
শহরে তখন আসতে পারতাম না
। বছরেও একবার নয় । ক্যালেন্ডারের সন তারিখ চোখের সামনে ডাকিনী যোগিনী হয়ে নাচতো ।
খুব অপমানের ভয় ছিল আমার । অপমান আর অপমান । তাচ্ছিল্য আর তাচ্ছিল্য । তবে তখন পে
কমিশন বসেছিল । লিভ স্যালারি বেড়ে গেলো , গ্র্যাচুইটি বাড়তো । অনেকে এসব ব্যাপারে দড় ছিল । আসলে তাঁদের ভয়ংকর
রোমান্টিকতা ছিল পে-কমিশনে মাইনে বৃদ্ধি নিয়ে ।
আমার সময় ছিল না ভাবার ।
শুধু কাজ আর কাজ । উন্নয়ণের সভা এবং টার্গেট । কিছুই হচ্ছে না । ওপরের বসদের একটাই
হুংকার – সব রিল্যাক্স করছে ।
ভয় পেতে পেতে অবসর নিয়ে
নিলাম । আমি যখন চাকরি করি ছেলেটা এম. বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল । দক্ষিণ
ভারতের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । হিউমেন রিসোর্স ।
ওর নিজের রিসোর্স অধরা
থেকে গেলো এখনও , আর
‘ও’ কি করে কোন কোম্পানির হিউমেন রিসোর্স হবে
! অথচ শহরে সবুজ একেবারে নেই। মোড়ে মোড়ে আইনক্স , শপিং মল।
টাকা উড়ছে ।
গোপনে ডাইরি লিখতাম ।
অবসরের পর হারুর দোকানে ‘চা’
পান করে লেখার মাত্রা বাড়িয়ে দিলাম । বউ সদয় থাকলে একেকদিন এসে বলতো
–
কি লেখো বলো তো তুমি !
আমি বলতাম – ডাইরি ।
বউও বেশ সচেতন নাগরিক ।
আমার চেয়েও অনেক বেশী সচেতন নাগরিক ।
একদিন আমার লেখার বেগ
দেখে সে বেশ ভয় পেয়ে গেলো ।
বললো – তোমার পেট পরিস্কার হয়তো ! আমি বললাম – হয়তো মনে হয় কারণ ওটা তো প্রতিদিনই হয় ।
বউ বললো – স্বপ্ন দেখো !
আমি বললাম – হ্যাঁ ।
এসব তো তোমার ছিল না !
আমি বললাম – কি সব !
এই যে ঘাড় গুঁজে লেখা ।
আমি এখন নাক ডাকি !
বউ বললো – অনেক কম ।
আমার কি পেচ্ছাপে গন্ধ হয়
!
না । কি করে কমালে !
সত্যিই তো !
এসব আজগুবি লেখায় ।
দেখো তোমাকে না একদিন
পুলিশে ধরে নিয়ে না যায় !
আমি ঘারড়ে গেছিলাম ।
রাষ্ট্র তো অভয়ারণ্য হওয়া উচিৎ । কিন্তু আমি পরিবারের কর্তা , ভয় পেলে চলবে কেন !
বললাম – আমি যা লিখি তুমি বুঝবে না ।
বউ বললো – মানে !
আমি বললাম – সত্যি তুমি বুঝবে না ।
বউ তো রেগে কাঁই , সে বললো – তোমার মতোন আহাম্মক
ভীতু বুঝবে , আর আমি বুঝবো না !
আমি তখন বললাম
বেদানাপুরের কথা ।
হাতে স্কলারদের পাস । মূল
স্টেজে পৌঁছে দিতে হবে । আর সেই পুলিশ অফিসার চীৎকার করে বলেছিল – হু আর ইউ ?
আমি কোন উত্তর দিতে
পারিনি । সেই থেকে একটু আধটু লিখছি আর খুঁজছি – আমি কে ?
উত্তর পাচ্ছি না ।
বউ এবার নরম গলায় বললো – তুমি তো এরকম ছিলে না ! মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো
!
আমি বললাম , তুমি-ই তো বললে আমি ক্রমশ শারীরিক দিক থেকে সুস্থ
হয়ে উঠছি । আর মন তো শরীরের দোসর ।
বউ খুব একটা নিশ্চিন্ত
হলো না ।
এদিকে উত্তর না পেয়ে
পুলিশ হিংস্র হয়ে উঠলো আরো ।
হিংস্র লাঠির আঘাত গাড়ির
বনেটে আছড়াতে থাকলো । ওদিকে লাল বাতির হুঁসিয়ারিতে জনপথ আরো আরো সন্ত্রস্ত হয়ে
উঠছিল ।
২
জলমগ্ন কলকাতার রাজপথে
তখন আমি নেমে পড়েছি । আমার বাম দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ । এক সময় নাম ছিল ‘হিন্দু কলেজ’ । সেই
কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের কক্ষে একদা প্রতিধ্বনিত হতো রবার্টসনের শেক্সপিয়র । আর
আমরা খারাপ ছেলেরা বেকার হলের মাঠে বহু ফুটবল ম্যাচ খেলেছি ।
ফুটবল যে চামড়ার গোলাকৃতি
অবয়বের এবং পায়ে তার স্পর্শ হলেই টুং টাং শব্দ হয় আমি রবার্টসনের বদলে সেই টুং টাং
আর হই হল্লা শুনতে পেলুম ।
গুগলের ম্যাপের যাবতীয়
আপলোড মোবাইলে করে দিয়েছিল আমার ছেলে । শীর্ষ আমায় হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিল ।
তারাশংকর ড্রাইভার পুরোনো মানুষ । আমি আশ্চর্যের বিহ্বল থেকে গুগলের পথ নির্দেশ
তারাশংকরকে বলে যাচ্ছিলাম । রোমাঞ্চিতও হচ্ছিলাম । সঠিক পথে আসতে আসতে ছেলেকে বলেও
ছিলাম । ‘তোর জয় হোক’ ।
সে বলেছিল , গুগলের ভারতীয় শাখার সি. আই. ও সুন্দর পিচাই । তুমি
বরং ওঁকে ধন্যবাদ জানাও । আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম । ভারতবর্ষ তবে তো এগোচ্ছে ।
চন্দ্রাভিযান হলো কয়েকদিন আগে । অবশ্য স্যাটেলাইটে নাকি শেষ অবতরণের বার্তা আসেনি
। আবার আমাদের ভি. ভি. আই. পি. মঙ্গলগ্রহে চলেছেন ।
আমার অবশ্য এসবে কোন
অন্তরাস নেই । আমি নিজেকেই খুঁজছি শুধু ।
বউ বলে, স্বার্থপর
।।
আমি ছেলেকে মুঠোফোনে
বললাম ,
এর উদ্ভাবক কে ?
ছেলে বললো – তুমি আবার আইনস্টাইনের সম-মর্যাদা দিয়ে ডাইরিতে
লিখতে যেও না । এটা কোন আবিস্কার নয় । প্রযুক্তির সম্প্রসারণ মাত্র ।
শীর্ষকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা
জানালাম । এক সময় রচনা লিখতে হতো ~ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি । তখন প্রযুক্তিকে ব্যাপক গাল মন্দ করেছি ।
আবার বললাম – যাই হোক – কে ?
ল্যারি পেজ ও সারজি ব্রিন
।
কতো সালে ?
১৯৯৮ । শীর্ষ বললো ।
সে আবার বললো – গুগল এসবও তোমায় বলে দেবো ।
নিরাপদে এসেছিলাম
সুস্মিতা মেমোরিয়াল হলে । হলের ভিতরে আশি শতাংশ কবি , গল্পকার হচ্ছেন ৫ জন পক্ককেশ । আমার বয়সি ।
টেবিলে থরে থরে পুতুলের
মতোন ছোট ছোট স্মারক সাজানো রয়েছে ।
ডাইরি লিখতে লিখতে সেটা
একদিন উপন্যাস হয়ে গেছিল । তারপর শব্দ গুণে গুণে সামঞ্জস্য রেখে পরিচ্ছেদ ভাগ করে
নিলাম ।
সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কলেজ
স্ট্রিটে পৌঁছে দেখলাম কতো প্রকাশক । শুধু ‘ফেলো কড়ি , মাখো তেল’ । আর
অনেক প্রকাশকের নানা ব্যবসা রয়েছে । কাঠ , ইন্টিরিয়র ডেকরেশন ।
একজন প্রকাশক আমাকে তাঁর
প্রকাশনার কাগজের মান বোঝাতে থাকলো । শেষমেশ চটি একটা উপন্যাসের জন্য ৫২,০০০/- টাকা চাইল । তাঁর কথা শুনে আমি তো প্রায় ভিরমিই
খেলাম । প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে এতো টাকা তুললে সংসারে আমার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি
অনিবার্য ।
মহার্ঘ প্রকাশককে ছেড়ে
শেষমেশ একজন মাঝারি পেলাম । ৩০,০০০ টাকায় রফা হলো । ২০০ কপি বই সে হাতে দিয়েছিল । ২০০ কপির ২ কপি
‘জাগরণ’ পত্রিকার প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলুম ।
ফলপ্রাপ্তি-স্মারক , টিফিন-বাক্স এবং নিখর্চার হাসি ।
সব ঠিকঠিক চলছিল কিন্তু
ভি. ভি. আই. পি.র আগমন গুগলের সুলুক সন্ধানে বিপর্যয় আনলো ।
তারাশংকরের গাড়ি বাঁচানোর
জন্য আমি জলমগ্ন পথে নেমে পড়েছি । হাঁটতে হাঁটতে ফেবারিট কেবিনে এলাম । রবিবাসরীয়
ফেবারিট কেবিনে একটা টেবিলও খালি নেই । ধুম্র উদ্গীরণ হচ্ছে চারপাশে ।
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিউটের
কাছে যাওয়ার আগে ‘মন্টু’র বিখ্যাত মিষ্টি পান খেলাম ।
আমার মধ্যে এসব হয় ! বউ
বলে , এক ধরণের স্কিজো – ফ্রেনিয়া । মনে হচ্ছে ‘টিনের তলোয়ার’ হচ্ছে । উৎপল দত্তের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি ।
সেই বেদানাপুরের বড় পুলিশ
অফিসার একটা উপকার করেছিলেন । ভি. আই. পি. কার্ডগুলি আমার কাছ থেকে নিয়ে বলেছিলেন ~ আপনি তো নন ভি. আই. পি । ভি. আই. পি দের কার্ডগুলি
আমি পৌঁছে দেবো ।
গুগল সার্চ করলাম পাগলের
মতোন । কিছুই দেখাচ্ছে না । নেট নেই । তখন বুঝলাম প্রযুক্তির আসল ঈশ্বর ‘নেট’ কানেকসান ।
কিন্তু ফিরবো কি করে !
আমি তো বহুদিন পথে বের হয়নি । ঘাড় গুঁজে লিখে চলি পাতার পর পাতা । মধ্যরাতে
সহানুভূতি দেখিয়ে বউ ‘চা’
করে দেয় । শুধু বিপর্যয়ের সতর্ক- বার্তা দিয়ে বলে – এমন কিছু লিখো না যাতে এই বয়সে পুলিশ তোমাকে তুলে নিয়ে যায় ।
২৬/৬ সূর্য সেন স্ট্রিট ।
আমার জন্মভূমির বাসাবাড়ি । দু-হাত জড়ো করে পেন্নাম করলাম । জীবন শুরু হয়েছিল এই
অন্ধ গলি থেকেই ।
বিকেলের আলো শেষ হয়ে আসছে
। গরম গরম তাজা তাজা বক্তৃতা হচ্ছে চারিদিকে । উন্নয়ণ হচ্ছে । উন্নয়ন চাই । নতুন
একটা জিনিস পাবলিক খাচ্ছে ~ তার নাম
‘ধর্ম’ । শনি
ঠাকুরকে পেন্নাম করলাম সুযোগ বুঝে কারণ কোন ধম্মোর খপ্পরে পড়তে চাই- না ।
নিয়নের আলোগুলি জ্বলে
উঠেছে । সেই আলোয় দেখতে পেলাম শীর্ষের মুখ । আমার খুব কাছেই চলে এসেছে সে ।
বললো – পথ হারিয়ে ফেলেছিলে ! তোমার চেনা পাড়া তো !
আমি বললাম – জন্মভূমি ।
তারপর বললাম – নিজেকে চিনেছি এতোদিনে !
শীর্ষ হেসে বললো – কী ?
নন – ভি. আই. পি ।
শীর্ষের এক হাত ধরে আমি
এগিয়ে চললাম তারাশংকরের গাড়ির দিকে ।
অভিজিৎ চৌধুরী