সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অমিত সরকার:একজন দেবু ও একটি ঘর: গল্প

 

 

একজন দেবু ও একটি ঘর

 

মানুষ আসলে গাধাগিরি করতেই বেশি ভালবাসে। গাধা ছাড়া আর কিই বা তাকে বলা যায় ? থাকার জন্য তার প্রথমেই একটা ঘর লাগে, তারপর কিছু লোকজন লাগে, যাদেরকে সে পরিবার বলে ডাকবে। আর এসব বানাতে  তার নিজের গাধার খাটুনিও লাগে। মুখে যতই বলুক সে একলা থাকতে চায়, স্বাধীন থাকতে চায়,  আসলে কিন্তু সে সবচেয়ে পছন্দ করে এই ফালতু খাটুনিটাই। যেটা একদমই বেকার আর পুরোটাই অন্যদের জন্য। সাধে বলেশালা গাধার খাটুনিবেশিরভাগ জন্তু জানোয়ারদের কিন্তু এসব বালাই নেই। বাঘ সিংহ কী ঘর বানায় ? নাকি বউয়ের জন্য সারাজীবন ধরে জামাকাপড় কেনে, বেড়াতে নিয়ে যায় ? পুরোটাই যে যার সে তার। নিজের জন্য বাঁচতে প্রকৃতপক্ষে মানুষেরই বা কতটুকু লাগে ?  খুঁটে খাবার জন্য এতবড় দুনিয়াটার এখানে সেখানে এখনো অনেক ফসল  ছড়ানো রয়েছে। আর নিজের মাথার তলায় হাত রেখে একবার ঘুমিয়ে পড়লে  তুমি ফাইভ স্টার  হোটেলের ঘরে না গাছতলায়, কোথায় ঘুমোচ্ছ ফারাকটাই বুঝতে পারবে না। তাহলে খাটুনিটা কি পুরোটা গাধাগিরি নয় ?  

 

ব্যাপারটা দেবু অনেক ভেবেচিন্তে বার করেছে। মানে একরকম আবিষ্কারই করেছে বলা যেতে পারে। সে নিউটনের নামটুকু শুনেছে, আইনস্টাইন বা স্ট্রিং থিয়োরি, ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হলে সে নিশ্চয়ই করে এটাকে সেইরকমই একটা কিছু বলে লোকজনকে জানাতো। প্রথম যখন এইখানে, এই দামোদরের ক্যানালপাড়ে সে  একলা এই ঘরটা  তুলেছিল,  ভেবেছিল দুনিয়ার সংশ্রব ছেড়ে এবার  থেকে সে একা এই তল্লাটে দিব্যি থাকবে। ঘুরবে, ফিরবে, মাঝে  মাঝে দুয়েক খ্যাপলা  মাছ ধরবে এবং, চিন্তা করবে। চিন্তা করতে সে বড্ড ভালবাসে।  সকালে একবার মাছগুলো নিয়ে  চলতি নৌকায় ব্যারেজে পৌঁছে গেলেই দুঘন্টার মধ্যে  তার সারা দিনের খোরাকিটা উঠে যাবে। পথচলতি মানুষজনেরা কেন জানি এইসব মাছের জন্য একদম হুমড়ি খেয়ে পড়ে, বিশেষ করে ব্যারেজ সাইডে চা খেতে থামা গাড়িওয়ালা লোকগুলো। একটু পয়সা হলেই এত টাটকা খাবার বাই মানুষের কেন যে ওঠে, সে জানে না। জিভে অনেকদিন ধরেই সে কোনও কিছুরই  স্বাদ পায় না। টাটকা বাসির তফাৎ তো বোঝেই না একদম। তাতে কী অসুবিধে  হচ্ছে তার?  আর বলতে নেই শরীরটাও তো তাকে এখনো সাথ দিচ্ছে। নইলে কি আর পারতো? এই তো সেদিন একটা পুরনো ঝোলার ভেতর থেকে কবেকার একটা আধখাওয়া পাঁউরুটি খুঁজে পেল। কোথা থেকে পেয়েছিল, কবে রেখেছিল নিজেই ভুলে গেছে। সে সেই শক্ত হয়ে যাওয়া  পাঁউরুটিটাকে খানিক জল দিয়ে ভিজিয়ে রাতে মেরে দিল। পরের দিন সকালে তার দিব্যি সরল হাগাও হল।   শরীরের কোনও কিছুই গোলমাল হয়নি। তাহলে মানেটা কী এরকম দাঁড়াচ্ছে না যে, খাওয়া নিয়ে, শোয়া নিয়ে,   মেয়েছেলে, বাড়িঘর নিয়ে, মানুষের এত যে ন্যাকরচ্যাকর সবটাই আসলে একদম বেকার খেলাধুলো?    

জেলে বসে বসে সে এই কথাটাই অনেকরকম করে  ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাববার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু সেখানে ঠিক সুবিধে হয়নি। আসলে জেলটাও ধরতে গেলে একটা বাড়ি। সেখানেও একটা বিরাট পরিবার আছে।  একদম নিজস্ব খানিক নিয়মকানুন আছে। সেখানে থাকাটাকে কোনওভাবেই একলা থাকা বলা যায় না। আর  চুপচাপ থাকলেও সে সেখানে একা থাকার সুযোগ বিন্দুমাত্র পায়নি। ঘুম থেকে ওঠার পরেই তাকে একের পর এক কাজে জুতে দেওয়া হতো। সকালের গিনতি, লাইন লাগিয়ে খাওয়া, তারপর থালা ধুয়ে রাখা, এর ফাঁকফোকরে একবার বাথরুমের লাইনে দাঁড়িয়ে অন্যদের দুটো অশ্লীল বটকেরা শুনে মুচকি হাসা, এমনটা সাতসতেরো কাজেই সকাল দশটা বেজে যেত। তারপরে তার ডিউটিটা ছিল বাসন মাজার। এই কাজটাকে অবশ্য মোটের ওপর খুব কঠিন বলা যায় না। কেনই বা বলবে?  প্রথমত জেলে এই রকম মাত্র একটা দুটো কাজেই মেট বা সুপারভাইজাররা নিয়মিত ঘাড়ের ওপর তাকিয়ে থাকে না। একটু কায়দাকানুন জানলে বেশি পরিশ্রম না করেই  দিব্যি ছুটকারা পাওয়া যায়। আবার কিচেন ডিউটির মধ্যে বলে মাঝে মধ্যেই মাছের বড় পিসটা, বা খানিকটা   বেশী ভাত, পলিটিকাল সেলের আলাদা রান্না খিচুড়ি, সবকিছুই টুকটাক পাতে চলে  আসে। অনেক সময়েই  যে  সব  কয়েদিরা বাড়ির  খাবার পায়, তারা টিফিন ক্যারিয়ারটায় কিছুটা খাবার রেখে দেয়, হাঁক পেড়ে বলে, ‘দেবু,  আজ তোর  বউদি তোর জন্যে একটু বেশি করে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে।তারপর গলাটা একটু নামিয়ে, ‘খেয়ে একটু টিফিন বাটিটা ধুয়ে দিস তো।  এসব পিতলা পিরীতের প্যাঁচপয়জার সে বোঝে সবটাই, কিন্তু প্রতিবাদ করে না। যেখান থেকেই হোক, ঘরের স্বাদওয়ালা খানিকটা খাবার তো তার থালাতেই জুটছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়।  জেলে কিচেন ডিঊটিতেই একমাত্র সন্ধের পরেও কাজ করতে হয়। রাতের  খাবার বানানো হয়ে গেলে সমস্ত বাসনপত্র মেজে ধুয়ে মেটকে বুঝিয়ে দিতে হয়। নইলে  পরের দিন সকালেই আবার যজ্ঞির হাঁড়ি চড়বে কী করে ? তাই ভাবনার সময়টা সে জেলে একদম পেত না। 

 

ছোট থেকেই সে বরাবর স্বপ্ন দেখতো স্বাধীনভাবে একলা একলা থাকবে। সন্ন্যাসীদের মত যখন যেখানে ইচ্ছে  ঘুরে বেড়াবে। যেখানে সন্ধে হবে, সেখানেই ডেরাডাণ্ডা গাড়বে। বলাকওয়ার কেউ থাকবে না। পরিবারের মূল   সমস্যাটা এটাই, একলা থাকা যায় না। তাই তার মনে হয় ঘরসংসার ব্যাপারটার মধ্যেই কেমন একটা বন্দীত্ব  আছে, যেটা তার ঠিক পছন্দসই নয়। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, আর কে কে যেন একলা থাকতো না ? তাদের  মতনই একলা থাকার ইচ্ছেটা তার ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু দুনিয়াদারির চক্করে সে সুবিধেটা তার এখনো  অবধি ঠিকঠাক  জোটে নি। এই ক্যানালের পাড়ে বসত করার আগে,  মানে জেল  থেকে ছাড়া পাবার পর সে তাদের  পৈতৃক বাড়ির সামনে একবার ঘুরতে গিয়েছিল। মা মরার পর সে বাড়ি এখন প্রমোটারের কব্জায়। শুনেছে ভেঙে ফ্ল্যাট  হবে। তার মায়ের বাড়ি নিয়ে খুব আদিখ্যেতা ছিল। সে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করছিল, বাড়িটাও খর চোখে তাকে দেখছে। মনে হলো বলছে, ‘হারামির বাচ্চারা, আমাকে মেরে দিলি। তোরই  বাপঠাকুরদার স্মৃতি আমি কত যত্ন করে বুকে আগলে রেখেছিলাম। তোর বাপ ছোটবেলায় আমার কাঁচা দেয়ালের ওপর পেরেক দিয়ে নাম খোদাই করে রেখেছিল । কই, রাগ হলেও আমি তো তা নষ্ট করিনি। তোরই মা বউ হয়ে এসে প্রথম হপ্তাতেই মাংসের ঝোল নামাতে গিয়ে, ডেকচি উলটে সমস্ত ঝোল ছিটিয়ে রান্নাঘরের দেয়ালময় দাগ করে ফেলল। দ্যাখ রে শুয়োরের বাচ্চা, সেই দাগগুলো পর্যন্ত আমি আজও বুকে করে রেখে দিয়েছি। আর তোরাশালা অকৃতজ্ঞের গুষ্টি…’ সে তখন কেমন একটা রিক্ততা অনুভব করছিল। খানিকটা বাড়িটার প্রতি ক্রোধও। সে শুনেছিল বাড়িটা ভাঙার সময় তার কাকা নাকি অজ্ঞান হয়ে  গিয়েছিল। কে বাড়িটাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে এত সব স্মৃতি বুকে করে রাখতে।                  

           

আজ কবছর হয়ে গেল, সে ক্যানালপাড়ের এই ধু ধু ফাঁকা জমিতে ঘরটা তুলেছে। তুলেছে মানে তুলতে চায়নি কিন্তু  বাধ্য হয়েছে। কারণ প্রথমত তস্য গরীবের ঘরেও একটা গাঁয়ে দেবার কাঁথা, ভাত ফোটানোর একটা  হাঁড়ি বা পাতিল, এক দুটো সানকি, গেলাস এইসব থাকে। সবকিছু নিয়ে তো আর সবসময় বোঁচকা বেঁধে ঘোরা যায় না।  কোথাও একটা জমা করে রাখতেই হয়। তারপর ঝড়জল, শীত, গ্রীষ্ম তো আছেই। আবার এই দুর্গাপুর   ব্যারেজের এধারে বাঁকুড়া ওধারে  বর্ধমান। চারপাশে অনেক কারখানা, মেলা চক্কর। তাই পুলিশের নজরটাও এদিকে অনেক বেশি। এই ক্যানাল সাইডের  রাস্তা ধরে রোজ সন্ধে হলেই টহল ভ্যান ঘোরে। রাস্তায় কাউকে একা শুয়ে থাকতে  দেখলে, অনেক সময়েই তারা বিনা কারণে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে দেয়। অথবা দিলো কোনও পেটি কেস  লাগিয়ে চালান করে। কিন্তু একটা ঝুপড়ি ঘরে কেউ থাকলে তারা আর ডিস্টার্ব করে না। ঝুপড়ি হলেও একটা ঠিকানা  বলেই  হয়তো। এইসব কারণেই সে এই ঘরটা তুলতে বাধ্য হয়েছিল।  ঘর মানে  প্রথমদিকে ওই  বাঁশ, কঞ্চি,  রাংচিতা আর  শুকনো ডালের  ঠেকনা  দেওয়া একটা কাঠামো মাত্র । মাথার ওপর শুকনো  খেজুরপাতা দিয়ে ছাউনি। দরজা টরজার বালাই নেই। ওই রোদ্দুর বৃষ্টিটা থেকে কোনওরকমে বাঁচার একটা চেষ্টা মাত্র। ঘরটার সঙ্গে তার নিয়মিত ঝগড়া হতো। ঘরটা তাকে এটা আনতে বলতো, সেটা আনতে বলতো। এই বাঁশটায় ঠেকা দিতে বলতো, ওই টিনটা এনে দরজার মত করে চাপা দিতে বলতো। দেবুর  অত সব পোষায় না। সে তেড়ে ঘরটাকে খিস্তি করতো, কিন্তু নাছোড়বান্দা ঘরটা ঠিক 

ধীরে ধীরে দেখা  যেতে লাগলো ঘরটা নিজে নিজেই  শক্তপোক্ত করে কেমন  নিজেকে গড়ে  নিচ্ছে। কথাটা ভাবতে ভাবতে দেবুর মনে  হল  আরে, ঘর আর গাছের তো  খুব মিল। গাছও যখন চারা থাকে কেমন  নড়বড়ে, দ্যাখ না দ্যাখ গরু ছাগলে মুড়িয়ে খায়। তারপর একবার শিকড়েরা মাটি ধরে নিলেই ধাঁ ধাঁ করে বাড়তে থাকে, একদম নিজে নিজেই। তখন তার তলাতেই পাখপাখালি, কুকুর ছাগল, পথচলতি মানুষজন, সাধু সন্ন্যাসী, এমনকি ছোটখাটো  দেবতারা পর্যন্ত আশ্রয় খোঁজে। 

সে যখন প্রথমবার ঘরটা তুলতে শুরু করে,  ভাগ্যিস তখন চৈত্র মাস, সেবারে জলটা একদম হয়নি। পাতার ছাউনির মূল অসুবিধাটা হচ্ছে শালা একটু ঝড় হলে, এমনকি জোরে বাতাস দিলেই ছাউনি বেবাক ফাঁকা। আবার নতুন করে সবটা ছাইতে হবে। তারপর দেখা গেল একটা  নীল প্লাস্টিক  কোথা থেকে যেন জোগাড় হয়ে গেল। বীরভানপুর থেকে কী? সঠিক এখন তার মনে  পড়ছে না, আজকাল সে আর কিছুই মনে রাখতে পারেনা। তবে  মনে হচ্ছে ওখান থেকেই। বীরভানপুরেই এ তল্লাটের বড় শ্মশান। সেসময় যেহেতু তার থাকার খাবার তেমন ঠিকঠিকানা  নেই, প্রায়ই সে  নদী পেরিয়ে এই শ্মশানটায় গিয়ে বসে থাকতো। মড়া পোড়াতে এসে কারা একটা বড় বিছানা ওই প্লাস্টিকটা শুদ্ধু ফেলে গিয়েছিল। সে সেখান থেকেই ওই প্লাস্টিকটা আর যে কাঁথাটা এখন ঠাণ্ডাকালে গায়ে দিয়ে শোয়, এদুটোকে কুড়িয়ে আনে। লোকে যাই ভাবুক, শ্মশান আদতে কিন্তু খুব হ্যাপেনিং জায়গা। এখানে রোজ নতুন নতুন মানুষজন আসে। দেবু দেখেছে, শুধু হাজরি দিলেই এখানে চা বিস্কুটটা যতবার খুশি ফ্রিতে মিলে যায়।  একটু তক্কে তক্কে থাকতে হবে অবশ্য। খেয়াল রাখতে হবে, কখন বড়  পার্টি  আসছে। তাদের বেশ কিছু লোক কখন চা খেতে  যাচ্ছে। সময়টা ঠিকঠাক আন্দাজ করে  তাদের সঙ্গ ধরেই দোকানে  গিয়ে  হাত বাড়িয়ে দিলে সে দেখেছে কেউই প্রায় ফিরিয়ে দেয় না।   

এখান থেকে সে ঘরটার অনেক কিছুই জোগাড় করেছে। এমনকি একটা প্রায় আস্ত স্টিলের চেয়ার পর্যন্ত।  হাতের কাজটাজ সে টুকটাক জানে। ছোটবেলায় কোথা  থেকে  একটা ভাঙা স্ক্রু-ড্রাইভার জোগাড় করে সে যখন  চারধারে খুঁচিয়ে বেড়াত, তার মূর্খ মা ভেবেছিল সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু যার বাপ  নেই,  তাকে কে পড়ার পয়সা যোগাবে?  মাধ্যমিকের পর তাই আর তার লেখাপড়াটা হল না। ধীরে ধীরে যা শিখেছিল,  সবটা ভুলে  গেল। শুধু ভাবনার ব্যাপারটা আর মাথা থেকে বেরোল না। সারাক্ষণ উল্টোপাল্টা চিন্তার জট তার মাথার  মধ্যে পাক খায়। এই যেমন, তার মা তাকে একথালা ডাল ভাত দাওয়ায় বেড়ে দিয়েছে, সে  খাবার বদলে থালাটার দিকে তাকিয়ে বসেই আছে তো আছে। থালাটা দেখতে দেখতে হয়তো তখন তার  মনে  হচ্ছে এই যে ভাতের চালটা, এর একটা দানাও তো সে নিজে ফলায়নি। যে ফলিয়েছিল, সেও কী  এভাবেই আজ ভাত খাচ্ছে? মা যে বলে প্রত্যেকের অন্ন মাপা থাকে, কে মাপে ? কীভাবে মাপে? কোথায় মাপে? তার অন্ন  আজ কি সত্যি এখানেই মাপা আছে? ঘোর ভাঙে যখন মা চ্যালাকাঠ উঠিয়ে তাকে উদ্দাম গালাগালি শুরু করে, আর সে দেখে পাশের বাড়ির বেড়ালটা মাছের টুকরোটা থালা থেকে উঠিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে।  সঙ্গীসাথিরাও তাকে  সবসময়ক্যালানেবলে ডাকলেও এটাও সবাই  জানতো, কোনও বিষয়েই তার তেমন লোভ নেই। হলে ভালো, না   হলে যে চলবে না এমন নয়। তাই মালকড়ি বিষয়ে কোনও রকম হেরিফেরি তার কাছে হত না। বিষয়টা   সবচেয়ে  ভালো জানতো সহদেব ড্রাইভার। সে নিজেকে বলতো দেবুর গাড়ি লাইনের বাপ। সহদেবের অনেক  রকম ব্যাপার ছিল। এখানের এক কাঁটাকল মালিকের ছোটো হাতি চালিয়ে সে এ তল্লাট, সে তল্লাট করে  বেড়াতো।  সঙ্গে বেশ কিছু উপরি উপার্জনও তার কীভাবে যেন পকেটে ঢুকে যেত। মাঝে  মাঝেই সে একটা পুঁটলি বা দুটো ছোট পেটি তাদের ঘরে রেখে যেত। আবার দুতিন দিন পরে এসে নিয়ে যেত। জানতো তাদের ঘরে কোনও মালের একচুল এধার সেধার হবে না।  

মা-ই নিশ্চয় সহদেবের বেআইনি মাল লুকিয়ে রাখার জন্য তাদের ঘরটাকে ভাড়া দিতো। অবশ্য না দিলে মায়েরই  বা সংসার চলবে কী করে ? আর ঘরের সঙ্গে সংসার ব্যাপারটা তো জড়িয়ে জাপটে থাকেই।  ইদানীং তার মনে   হয়, মায়ের সঙ্গে সহদেবের একটা গোপন সম্পর্কও হয়তো  ছিল।  সহদেব  যতবার তাদের ঘরে আসতো, প্রতিবারেই মায়ের হাতে একটা  দুটো গান্ধী তুলে  দিতে সে দেখেছে। তবে এটা নিয়ে সে তেমনটা ভাবে না।  মাও তো একজন একলা মেয়েমানুষ, ঘর করতে গেলে একটা ব্যাটাছেলে যেমন লাগে, তেমনি গান্ধীও লাগে।  এটাও অবশ্য খুব ভাবনার কথা, কেন লাগবে? তবে এ ব্যাপারটা নিয়ে সে এখনো তেমন করে ভাবেনি। বাপটা ছোটবেলায় মরে যাবার সময় মায়ের জন্য এই ঘরটা ছাড়া তো আর কিছুই তেমন রেখে যায়নি। মা এই ঘরটাতেই জীবনের শেষ দিন অবধি কাটিয়ে গেছে।  ওদিকে সহদেবেরও এখানে নিজের ঘর বলতে কিছু ছিল না। সে খেতো  শুতো বড় মালিকের গ্যারেজে, তার নিজের বাড়ি সেই বর্ধমানের কোন একটা গ্রামে। তাই মায়ের সঙ্গে সহদেবের সম্পর্কটাও বিরাট কিছু আশ্চর্যের নয়।   

মায়ের অনুরোধেই মনে হয়, সহদেব একদিন তাকে নিজের টেনিয়া বানিয়ে নিল। আর দিন নেই রাত নেই সহদেবের সঙ্গে এ তল্লাট, সে তল্লাট ঘুরতে ঘুরতে দিব্যি স্টিয়ারিং-এ তার  হাতটা সেট হয়ে গেল। মনে হয় তার মা-ই বোধহয় সহদেবকে, তাকে গাড়ি চালানো শেখাতে অনুরোধ করেছিল। যাই  হোক, সহদেবের  টেনিয়া হয়ে ঘোরার জন্য কিন্তু মালিক তাকে কোনও পয়সাকড়ি  দিতো  না। শুধু খোরাকি বাবদ  দিনপ্রতি  পঞ্চাশ  টাকা। ড্রাইভিংটা শেখার পর অবশ্য মালিক নিজের খরচায় তাকে একটা  লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস দিয়েছিল। নইলে আজ আর তার জেল থেকে বেরোনো হতো না। লাইসেন্সটা হবার পর অবশ্য তার একটা ঝামেলা  বেড়ে গেল। রাত আটটা বাজলে সহদেব আর স্টিয়ারিং-এ হাত  দিত না। গোটা দুইক্যাপ্টেনে    বোতল নিয়ে পাশের সিটে বসে থাকতো। গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে মালের  লোডিং আনলোডিং সবটাই দেবুর একার ঘাড়ে এসে পড়লো। এমনকি কখনো কখনো এমনও হয়েছে রাত বিরেতে সহদেব তার  বাড়িতে ডাকতে এসেছে, তারপর তাকে মাল আর ডেলিভারির ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে তার বাড়িতেই থেকে গেছে। সে রাত দুটো তিনটে চারটের সময় মাল খালাস করে বাড়ি ফিরে দেখেছে, সহদেব তার বিছানাতেই লুঙ্গি পরে ঘুমোচ্ছে। সে এসবে কিছু মনে করতো না। কীইবা মনে করবে? শুধু গাড়ি  লাইনের বাপ নয়, সহদেব কুন্ডুই তো তার আসল মালিক। তারও নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর জন্যেও তো একটা ঘর  লাগবে।     

সব ঠিকই চলছিল, শুধু সেদিন রাতে এই এগারোটা নাগাদ, বাইরে থেকে ডাক শুনে সে দরজা খুলে দেখলো,  বড় মালিক দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে আর দুটো দামী জামাপ্যান্ট পরা লোক। তাকে ডেকে তুলে বড় মালিক নিজের গাড়িতে চাপিয়ে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে গেল। এই গাড়িখানায় সে আগে কখনো চাপেনি। আরিব্বাস, কী গাড়ি রে ভাই ! ওটা যদি তাকে একবার চালাতে দিত বড় মালিক ? যাবার সময় তাকে বড় মালিক আর ওই দুজন  লোক বারবার বারণ করে দিয়েছিল, কোনও রকম মুখ না  খুলতে। থানায় গিয়ে ওদের আলোচনা থেকে সে আবছা আবছা বুঝতে পারলো, সহদেব নাকি পথচলতি একটা বুড়োকে চাপিয়ে দিয়েছে। মালিক ওকে আড়ালে  জানালো, সহদেব মাল টেনেটরহয়ে ছিল। এখন যদি তাকে পুলিশ ধরে কেসটা পুরো কিচাইন হয়ে যাবে।  মালিকের বিরাট টাকা ফাইন হয়ে যাবে।  তার চেয়ে দেবু যদি বলে যে সে গাড়ি চালাচ্ছিল, আর বুড়োটা  উল্টোদিক থেকে রাস্তা পেরোতে গিয়ে তার  গাড়ির সামনে হঠাৎ চলে এসেছিল, তাহলে কেসটা মালিকের উকিলবাবু তুড়ি মেরে  সালটে নেবে। তাকে শুধু সারেন্ডার করতে হবে আর মাত্র কটা দিন একটু কষ্ট করে হাজতে থাকতে হবে। কেসটা কোর্টে উঠলে একমাসের মধ্যে ওর তো জামিন হয়ে যাবেই, ঘরে ফিরলে সঙ্গে সঙ্গে মালিক ওকে আরও বিশ হাজার  টাকাও দেবে। আর সহদেবের কাজটা তো ওর জন্য রাখাই রইলো।  সহদেবকে বড় মালিক আর রাখবে না। তা ও মেনে নিয়েছিল। ব্যাপারটা খুব একটা খারাপও লাগেনি তার। কটা দিন তো জেলে আরাম করা যাবে। ডেলি আশি কেজির ভারী ভারী চল্লিশটা পেটি কাঁধে করে গাড়িতে লোডিং আনলোডিং করা থেকে তো ছুটি ? তারপরে খাবারটাও ফ্রি। একটা মাসের তো ব্যাপার। কিন্তু মুশকিলটা হলো গিয়ে, একটা টেঁটিয়া জজসাহেবের  হাতে মামলাটা পড়ে। সেদিন জজসাহেবের হয়তো সকালে পায়খানা পরিষ্কার হয়নি,  অথবা বউয়ের হাতে বেদম ঝাড় খেয়েছে। উকিলবাবুও কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেছে  হয়তো, তার দুবছরের সাজা হয়ে  গেল। 

তবে জেলে গিয়ে দেবু দেখলো, ব্যাপারটাকে লোকে যতটা বলে, ঠিক ততটা খারাপ নয়। খাবারদাবারটা এখানে ভালোই জোটে। হাড়ভাঙা খাটুনিটাও অতটা নেই। একটা নিয়মের জীবন। এমনকি জেলে গিয়ে ওর কিছুটা ওজনও বেড়ে গেল। জেলটাকে ও মেনেই নিয়েছিল, আর না নিয়েই বা করবেটা কী? কিন্তু তারপর দুবছর বাদে যখন জেল  থেকে বেরলো, দেখলো মাটা কোভিডে মরে গেছে। সহদেব বর্ধমানে তার গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। সে  বাড়ির ঠিকানা কেউ জানে না। আর বড় মালিকের স্ট্রোক না কী বলে, সেই রোগ হয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেখাই তো করা গেল না। ফলত তার পাওনা বিশ হাজার টাকাটা সোজা ভোগে।    

এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সেই থেকে সে এই ক্যানালের পাড়ে ডেরা বেঁধেছে । তবে ইদানীং একটা বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।  সমস্যাটার নাম সালেহা। সেদিন রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যেতে দেবু ভাবল এবার একটা বিড়ি খাওয়া যাক।  বিড়িটা ধরাতে গিয়ে দেশলাইয়ের আগুনে হঠাৎ তার চোখে পড়লো, ঝুপড়ির মধ্যে তার পাশেই বিরাট একটা  পুঁটলি পড়ে আছে। কী ব্যাপার? একটু  আগে শোয়ার সময় তো এই পুঁটলিটা এখানে ছিল না। তার ঝুপড়ির অবশ্য দরজা নেই। একটা টিন দিয়ে  ঝুপড়ির মুখটাকে সে রাতে ঢেকে রাখে। তার ওপর দেবুর কুম্ভকর্ণের ঘুম।  মাঝে মাঝে লালি বলে একটা কুকুর অবশ্য টিনের ঝাঁপটাকে টেনে ফেলে তার পায়ের কাছটিতে শুয়ে   থাকে। কিন্তু এ তো লালি নয়, লালি তো আর ভেতরে  ঢুকে টিনটাকে আবার সুন্দর  করে  লাগিয়ে রাখবে না। সে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে পুঁটলিটাতে একটা লাথি  কষাতেই পুঁটলি উঁ উঁ করে উঠল। সে অবাক হয়ে  দেখলো একটা মেয়েছেলে নিজেকে আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে পুঁটলি পাকিয়ে দরজার কাছটিতে শুয়ে আছে। কাপড়টা সরাতেই দেখা গেল মেয়েটা মুখচেনা, নাম সালেহা। সালেহা তারই মত এখানকার টাল খাওয়া পার্টিদের একজন।  কেউ বলে পাগলি, কেউ ভিখিরি। আগে কোথায় থাকত কে জানে ? মাঝে মাঝে শাকপাতা বেচে, মাঝে মাঝে  রানিং গাড়িতে দৌড়ে দৌড়ে ভিক্ষে করে। তবে অনেকদিন সে তাকে দেখেনি। আর  তার দেখার  দরকারটাই বা কী  ? কথাটা হচ্ছে, এই মেয়েছেলেটা এখন এখানে  কোথা থেকে এলো ? আর কেনই বা এলো ?  

সে রাত্তিরে দেবুর  ঘুমের  তো পিছনটা মারা গেলই, তারপরে বৃত্তান্তটা  যা জানা গেল, সালেহা মাঝে মাঝেই নাকি এখানে এসে শুয়ে থাকে। ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙার আগেই  আবার চুপচাপ উঠে যায়। লালি কুকুরটাকেও  শালি  হাত করে ফেলেছে। দিব্যি লালি তার হাত মুখ চাটছে, এ তো ভারী সমস্যার ব্যাপার হল। এই ঝুপড়িটুকুও কি ভাগ করে নিতে হবে নাকি ? প্রথম আগলটা খুলে যেতেই তারপর থেকে সমস্যাটা বাড়তে শুরু করেছে।  ওই সালেহা রোজ রাত্তিরে এখানে এসে ঢুকছে, সে অবশ্য তার সঙ্গে বেশি কথা বলে না। কিন্তু মেয়েটা নিজে  নিজেই তার অনেক কাজকাম করে দিচ্ছে। হাঁড়িপাতিলগুলোকে খানিক গুছিয়ে গাছিয়ে রাখছে। মেঝেটা ঝাঁটপাট  দিয়ে  পরিষ্কার করছে, এমনকি একদিন তার কালচে মোশে ধরে যাওয়া সাতবাসি জামাটাকে পর্যন্ত কেচে সাফ করে রেখেছে। এবং দেবু খেয়াল করে দেখেছে মেয়েটা চুরণি নয়। তার জিনিসপত্র সব ঠিকঠাকই আছে।   

গতকাল আবার বিকেলে দেখলো একটা বাটিতে শাক দিয়ে খানিকটা কাঁকড়ার ঝাল কে যেন সাজিয়ে রেখে  গেছে। সঙ্গে  তিনটে  রুটি। বলতে নেই অনেকদিন পরে খেয়েদেয়ে দেবুর দিব্যি ভালো লাগলো। জেল থেকে  ছাড়া পাবার পর থেকে সে  জিভে অনেকদিনই কোনও স্বাদ পায় না। বহুদিন পরে আজ আবার জিভে খানিকটা  তার এল। বেশ অস্বস্তিকর ব্যাপার।  তবু বাড়া খাবার কি আর ফেলে দেওয়া যায় ? বিশেষ করে শাক দিয়ে  রান্না গরগরে মাঠ-কাঁকড়ার  ঝাল। তবে এসব দিয়ে দেবুকে কাত করা যাবে না। সে ক্যালানে হলেও অনেক ঘাটের  জল খাওয়া  মাল। আজই সে পুঁটলিকে লাথ মেরে নিজের ঘর থেকে তাড়াবে। তার একাই ভালো।    

 

একা একা চা খেতে খেতে দেবুর স্বগতোক্তি শুনে ঘরটা মনে মনে রাগছিল।হারামজাদা গান্ডু, ক্যানালের ধারে গাছের তলায় কোনওরকমে ঠেকনা দিয়ে একটা ঝুপড়ি বানিয়েছিস। জমিটাও কী তোর বাপের ? সরকারি খাস জমি। বাঁশের বেড়া থেকে শুরু করে, জিনিসপত্র সবকিছুই এধার সেধার থেকে জড়ো করে আমাকে বানিয়েছিস। আজ  তোর এতটা চুলকুনি উঠেছে, যে অসহায় মেয়েছেলেটাকে লাথিয়ে বার করে দিবি।বলতে নেই এই মেয়েছেলেটার  ওপরে তারও একটু দুর্বলতা আছে। মেয়েছেলে সে কম দেখেনি। দেবুর মত ঊনপাঁজুরে বরাখুরে মালও বহু  দেখেছে। তবে এ মেয়েটা অন্যরকম। কাছের গ্রামেই একদিন এদের বাড়ি ছিল। বাপমা মরে যাবার পর মামা  এসে বাড়িটা দখল করলো। মামা মামি মেয়েটাকে দুটো খেতে পরতে দিলেও, সারাদিন ঝিয়ের মত খাটাতো।   তারপর  একদিন  কোথা থেকে একটা বুড়ো  চাষির সঙ্গে কোনওরকমে ধরেপাকড়ে  বিয়ে দিয়ে  দিল। সেই লোকটার ঘরে আরও দুটো বউ। তারপরেও সালেহার মামির সঙ্গে তার সম্পর্ক। সেই রাগে  দজ্জাল বউদুটো একদিন  মেয়েটাকে মেরেধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল। কোনরকমে বেঁচে উঠে মেয়েটা সেই যে সোনামুখীর সরকারি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে, আর ফিরে যায়নি। ঘরও জানে, ফিরলে মেয়েটাকে এবার ওরা আর বাঁচতে দেবে  না। আধপোড়া শরীরটাকে ভালো করে ঢেকেঢুকে তাই সালেহা এখন মাঝে মাঝে ধানমাঠের কাঁকড়া ধরে, নয় ব্যারেজের ধারে শাক পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে। আর তাও না জুটলে মাগন ভরসা। কিন্তু মূল  সমস্যাটা হচ্ছে, আধপোড়া হলেও মেয়েছেলে, তাই সালেহারও একটা ঘর লাগে। ঘরটাই তাই ওকে বুদ্ধি  দিয়েছে, রাতে দেবু ঘুমিয়ে গেলে ঝাঁপের টিনটা সরিয়ে ওই ঝুপড়িতে ঢুকে ঘুমোতে। একবার ঘুমোলে দেবু একদম কুম্ভকর্ণ। ঘর আর সালেহার জন্য এর বেশি কী করতে পারবে ? তাই দেবু সালেহাকে তাড়িয়ে দেবার কথা  বলতে সে একটু রেগেই গেছে। আর তাই বিকেলের রোঁদে বেরোনর সময় ঝাঁপের আড়ায় দিল দেবুর মাথাটা আচ্ছা করে ঠুকে।  

 

সন্ধে থেকেই আজ দেবু ক্যানালের ধারে বসে আছে। ছাতিমফুলের গন্ধে এই সময়টা সবারই কেমন যেন একটা   ঘোর লেগে যায়। একটা অলৌকিক বাতাস শয়তানির চোখে দূর থেকে তাকে দেখছে। পাশে ঘুমন্ত জল।  সে আজ সকালে সালেহাকে আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েছে। এও বলেছে সালেহা যদি এরপরে কোনও দিন রাতে তার ঝুপড়িতে ঢোকে, থানার বাবুদের বলে সে সালেহাকে চুরির কেসে ফাঁসিয়ে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেবে। সালেহা তো আর জানে না, হাজত কী জিনিস। একবার ঢুকলেই টের পাবে। বলতে নেই, মেয়েটা কিন্তু বিরাট ভয় পেয়ে  গেছে।  চোখ দিয়ে টসটসিয়ে জল পড়ছিল। একটাও কথা বলেনি। চুপচাপ নিজের পুঁটলিটা উঠিয়ে কোথায় চলে গেছে? কোথায় আর যাবে, ধারেকাছেই কোনও দোকান টোকানের দাওয়াতে, নয় শ্মশানের চালার নীচে শুয়ে  আছে হয়তো। 

তারও যে খানিকটা খারাপ লাগছে না তা নয়। হাজার হোক একটা গোটা মানুষ তো তার সঙ্গে ছিল কদিন।  ইদানীং মেয়েটার পুঁটলিটা তার ঘরেই রাখা থাকত। সন্ধেবেলা ফিরে এসে মেয়েটা রাতের জন্য যা  হোক একটা   কিছু  জোগাড় টোগাড় করে আনছিলও। হ্যাঁ, দুজনের জন্যেই। সেই বরং একদিনওদুজনের মধ্যে কথা মাত্র  একটা দুটো হলেও, রান্না খেতে দেবুর তো আটকাচ্ছিল না ? এই তো গতকালই সালেহার বানানো সজনেডাঁটার ঝাল  দিয়ে দিব্যি দুজনে তারই কিনে আনা রুটি খেল। হঠাৎই দেবুর মনে হল মুসলমানের মেয়ে বলেই হয়তো সালেহার রান্নার হাতটা কিন্তু দিব্যি, জেলের খাবারের মত ট্যালটেলে নয়।           

আজ বিকেল  থেকেই  দেবুর  মাথাটা বড্ড ব্যথা  করছে। ঘর থেকে অন্যমনস্ক ভাবে বেরোতে গিয়ে কপালটা ঝাঁপের আড়ায় কীভাবে যে ঠোক্কর খেল ! ফুলে আলু হয়ে গেছে। দেবু অন্যমনস্ক ভাবে কপালে একবার হাতটা  বুলিয়ে নিয়ে ভাবলো কিছুটা ঘাস থেঁতো করে লাগিয়ে দেবে। অন্ধকার মাটি থেকে একমুঠো ঘাস ছিঁড়তে যেতেই আরো প্রবল একটা সবুজ ঠাণ্ডা হিলহিলে অন্ধকার যেন উঠে এল তার হাতে, আর ইঞ্জেকশনের মত তীক্ষ্ণ দুটো দাঁত তার কব্জিতে সজোরে বিঁধে গেল। মাথার গভীরে সেই প্রবল ভারী অন্ধকারকে বহন করতে অসমর্থ দেবু  আস্তে আস্তে ওইখানেই শুয়ে পড়ল। ছটফটে কালো সাপটা এই বেআক্কেলে লোকটার দিকে মুখ  ফিরিয়ে একবার ঘোর বিরক্তি প্রকাশ করে দ্রুতগতিতে ক্যানালের পাড় দিয়ে নেমে গেল নিজের গর্তের দিকে। 

 

ওঠ, শালা। দিব্যি খেল দেখালি চারদিন।থানার বড়বাবুর জিপ তাকে আজ পানাগড়ের আর্মি হাসপাতাল থেকে  নিতে এসেছে। 'ভাগ্যে, তোর বেহুলা। ওই পোড়া মেয়েছেলেটা, সালেহা না কী যেন নাম, তোকে অজ্ঞান  অবস্থায় দেখতে পেয়েই বড়বাবুর  জিপ থামিয়ে একদম পায়ে পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস তখনো খুব দেরি হয়ে  যায়নি। নইলে আজ তোকে তো লখিন্দরের মত ভেলায় করে দামোদরে ভাসিয়ে দিতে হত রে।পেছন থেকে মেজবাবু  আর একজন সিভিক পুলিস বড়বাবুর কথা শুনে হাসছিল, ‘ঠিক বলেছেন স্যার। বেহুলাই বটে। ফিরিয়ে তো  আনলো সাপে কাটা রুগিটাকে।’ ‘আসলে টাইমিংটাই এসব ক্ষেত্রে আসল, বুঝলে সামন্ত। তারপরে ভাগ্যিস ওর  বউটা ওঝা-টোঝার  চক্করে সময় নষ্ট করেনি। নইলে ছোঁড়াটাকে বাঁচানো যেত না। এই দেবু, তুই তো গাড়ি চালাতে  জানিস। তাহলে কাজটাজ কিছু একটা করিস না কেন ? তোর বউটা সারাদিন কী পরিশ্রম করে মাঠে ঘাটে শাক  তোলে। তুইও তো কিছু একটা করে ভালোভাবে একটা ঘর টর বানিয়ে দুজনে থাকতে পারিস। যে   জঙ্গুলে জায়গায় থাকিস, অ্যানাকোন্ডা কামড়ালেও লোকে আশ্চর্য হবে না।ক্লান্ত হেসে দেবু বড়বাবুর ভুলটা  ভাঙানোর কোনও চেষ্টাই করলো না।     

 

দেবুকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে সালেহা বলল, ‘আমি কাল ভোরবেলাতেই চলে যাবো। আসলে তুমি ছিলে  না, তোমার জিনিসপত্তরগুলো যাতে না চুরি হয়ে যায়, তাই একটাদিন আমি তোমার ঘরেই শুয়েছি। তারপর  লালিটাও খেতে না পেয়ে ছটফট করছিল।  দেবুর এখন খুব একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ভাবতেও না।  তবু সালেহার কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘তোকে কোথাও যেতে হবে না। এবার থেকে তুই  এখানেই  থাকবি। আমি সেরে উঠি। তারপর দেখা যাক ঘরটাকে দুজনে আর একটু শক্তপোক্ত করে বানানো যায়  কিনা ?’                      

 

অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো চোখের ওপর পড়তে দেবুর ঘুমটা ভেঙে গেল।  শরীরের দুর্বলতা এখন কিছুটা কেটেছে। সালেহা এই সকালেই হাঁড়িতে কী যেন চড়িয়েছে। ফোড়নের  সুগন্ধে ভরে রয়েছে ঘর। তার দিকে তাকিয়ে সালেহা বলল, ‘মাঠ থেকে কুলেখাড়া শাক এনেছি। মাছও চেয়ে এনেছি অনেকটা। আজ চুনো মাছ দিয়ে তোমাকে শাকের তরকারি করে দেব। দেখবে এক হপ্তায় শরিলে বল ফিরে পাবে।      

দেবু খেয়াল করে দেখল ঘরটা হাসছে, ফ্যাক ফ্যাক করে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। জানলা গলিয়ে ঢুকে আসা  রোদের অংশটুকুও হাসছে। আশ্চর্য, তার শরীরটা কিন্তু আজ তেমন জ্বালা করে উঠল না। বরং সেও ঘরটার দিকে তাকিয়ে একটু  হেসে আবার পাশ ফিরে শুলো।  

 

    

 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ