সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সৌরভ বর্ধন:মুক্তগদ্য:রাঢ় বাংলায় একটি সাংগীতিক ভ্রমণ

 



 রাঢ় বাংলায় একটি সাংগীতিক ভ্রমণ 



বঙ্গদেশের পশ্চিমে এক গভীর জঙ্গল। সেখানেই একটি বৃদ্ধ গাছ তার কাঁটা ও ফুলফল নিয়ে বাস করে। সেই জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। নদীর নাম মেখলা। ওই নদীর পাড়েই একদিন দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল একটি ছোট্টো ডাহুক পাখি। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও মেয়েকে দেখতে না পেয়ে তার মা কাঁদতে শুরু করলো। তখনই একটা কুবোপাখিকে দেখে ডাহুক-মা জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি আমার বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেছো, কুবোদা?' ---- হঠাৎ পাখির মুখে মানুষের মতো কথা শুনে কুবোপাখি তো চমকে গেলো। সে বলল, 'তুমি কে? তুমি ওই বৃদ্ধ গাছের কাঁটা নও তো? ওই কাঁটা ফুটলে শুনেছি মানুষও মারা যায়!' ----- তখন ডাহুক-মা বলল, 'আরে না না। আমি কোনো কাঁটা নই, আমি পাখি। আমার বাড়ি এই জঙ্গলের শেষপ্রান্তে একটি ডোবার ধারে। আমার মেয়েকে আজ দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।' এই কথা শুনে কুবোপাখি বলল, 'ডাহুক পাখিরা তো শুনেছি জলাশয়ের ধারে ধারেই থাকে; এই কাছেই আছে মেখলা নদী, তুমি ওই নদীতে গিয়ে একবার দেখতে পারো, তোমার মেয়েকে ঠিক পেয়ে যাবে।' ---- এই কথা শুনে কুবোকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডাহুক-মা ছুটে গেলো নদীর দিকে। সূর্য তখন অস্ত যাবে যাবে করছে, আর তখনই মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে ডাহুক মেয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমঘোরেই সে বলে উঠলো, 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত!' 

 


গত ২৭শে মার্চ ২০২৪ অর্থাৎ আমাদের পুরুলিয়া ভ্রমণের ঠিক আগের দিন ভোরবেলা একটা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়
, ওপরের অনুচ্ছেদটি সেই স্বপ্নেরই অনুলিখন। হঠাৎ করে গাছ পাখি নদী নিয়ে এমন বাচ্চাদের রূপকথার মতো স্বপ্ন কেন দেখলাম, জানি না। তবে এখনো কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা হলে নানান স্বপ্নে আমার মন ও মস্তিষ্ক ভরে যায়। আরও কয়েকদিন আগে এই পুরুলিয়া বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনাতেই বেশ অনেকদিন পর 'ঈশ্বরের আলো' নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম, তার শেষ তিনটে লাইন এরকম ----- 'কিন্তু হঠাৎ নিজের জন্য কষ্ট হবে খুব, হৃদয়ের রক্তময় পাখা / ভাসিয়ে দিয়ে আমি -------- সারা আকাশ ফুঁড়ে কাঁদবো / তখনই ঈশ্বরের আলো আর পলাশের জঙ্গলে বৃষ্টি নামবে'। যদিও পূরণ হয়নি, তবুও খুব ইচ্ছা ছিল, আমরা যখন পলাশের বনে যাব তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামবে, সকলে মিলে ভিজে যাব পলাশে আর বরষে। অথচ আমরা যাওয়ার কয়েকদিন আগেই পুরুলিয়ায় বৃষ্টি হয়েছিল, সেই খবর আমার কবিবন্ধু, ছৌশিল্পী রামকৃষ্ণ মাহাতোর কাছে শুনে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটেছিলাম, আর স্বপ্ন দেখেছিলাম পলাশের জঙ্গলে বৃষ্টি হচ্ছে আমাদের ঘিরে ঘিরে... 

 

২৯শে মার্চ খুব সকালবেলা, সারারাতের জার্নি কাটিয়ে তখন সবে বাঁকুড়া এসে পৌঁছেছি, একটা চায়ের দোকানে সকলে মিলে চা খাওয়া হলো, পুরুলিয়া পৌঁছতে এখনো ৮০ কিলোমিটার, অর্থাৎ যেতে যেতে চড়া রোদ উঠে যাবে, তাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়তে হলো। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই আবার এক জায়গায় গাড়ি থামাতেও হলো, কেননা বাঁদিকেই কিছু পলাশ গাছ, সেই প্রথম আমরা পলাশ দেখলাম, সকালবেলার নরম ঘাসে লাল পলাশ বিছিয়ে রয়েছে, আমরা আড়ষ্ট পায়ে হেঁটে সেই আলোকে আলিঙ্গন করলাম। তারপর পুনরায় যাত্রা শুরু, এবার শেষমেষ পুরুলিয়া গিয়েই থামা হলো, তবে অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার সময় রাস্তা চিনতে না পেরে এক জায়গায় আবারও দাঁড়াতে হলো গাড়িকে; সেখানে রাস্তার ধারে দেখা গেলো একটিইমাত্র পলাশ গাছ, পাতা নেই, শুধু লাল ফুলে ভরা, আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম দূরে, যেন প্রান্তর উঠে গেছে নেমে কোনো ঝরনার ধারে, পাহাড় দেখা যাচ্ছে; আমার তো নামার উপায় ছিল না, কিন্তু স্যার যখন গাড়ি থেকে নেমে ওই গাছ থেকে একটি পলাশ তুলে এনে আমার হাতে দিলেন, তখন শিহরনে আমার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, মনে হলো এইতো সম্পর্ক, এইতো বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে, এইতো মানব মানবের সঙ্গে আত্মিক সম্বন্ধে আমরা জুড়ে আছি। সেই যে গানটা আছে না, 'ওগো প্রিয় মোর, খোলো বাহুডোর, পৃথিবী তোমারে চায়...' ----- পৃথিবীর এই যে ডাক, তাতে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা করে সাড়া দেয়, আমাদের সাড়া দেওয়াটা এই ভ্রমণের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়, যাতে কোনো স্বার্থপরতা নেই, আছে ভালোবাসার এক ভিন্ন রূপ, ভিন্নতর প্রকাশ। খলিল জিব্রানের প্রফেট যেমন বলেন 'Love has no other desire but to fulfill itself.'। যাইহোক, একটু খোঁজখবর করার পর আমাদের রিসর্টের নিশানা পেয়ে গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো, আমাদের গন্তব্য ছিল 'হিল কুইন ইকো রিসর্ট', মুরগুমা অঞ্চলের মামুডি গ্রামে, শাল পলাশ কুসুম পিয়াল গাছে ঘেরা নির্জন পাহাড়ের কোলে, যেখানে সকাল হলেই গ্রাম থেকে ছাগল ও গরুর পাল নিয়ে রাখালেরা চরাতে যায়, গ্রাম্য মহিলারা মহুল ফুল কুড়োতে আসে, অনেকে শালপাতা। পরেরদিন, অর্থাৎ ৩০শে মার্চ সকালবেলা, এসব চাক্ষুষ করার জন্য আমি একা একাই একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম; হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছলাম বিরসা মুন্ডা মোড়ে, তার ডান দিকে সাত কিলোমিটার গেলে খামার, বাঁদিকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই অযোধ্যা, আর আমি এলাম মুরগুমার দিক থেকে। সেই মোড়েই একটা প্রকাণ্ড বটগাছ, বটগাছের ঝুরি দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়বে, মনে হবে যেন আমাদের নদিয়া জেলার কোনো গ্রামের বটগাছতলা, অথচ চারিদিকে শাল গাছ, মহুয়া গাছ, কয়েকটি বড় বড় আমগাছ‌ও ------ সেসব গাছের তলা দিয়ে গুটিকয় বাছুর চরে বেড়াচ্ছে, ওদেরই দুজন শুঁকতে শুঁকতে আমার কাছে এলো, ওদেরই আমার ডাকতে ইচ্ছে করে 'রামধেনু' বলে (যদিও 'রাম' শব্দটা এখন এতো রাজনৈতিক যে, ওদের আমি 'রংধেনু' বলে ডাকতেই স্বস্তি বোধ করলাম।), সকালের উজ্জ্বল রঙে তারা এক-একটি রঙিন স্বপ্ন। আর কে না জানে স্বপ্নের পথ অনিঃশেষ হয়, তাই এগিয়ে চললাম। একটা গাছের নীচে খচমচ করে শব্দ হচ্ছে, পাতা সরানোর শব্দ‌ই হবে, একটু ঢাল বেয়ে নিচে নেমে দেখলাম হ্যাঁ শব্দটা ক্রমাগত, একেবারে মহুয়া গাছের গায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম, অদূর ঝোপের নীচে একজন আদিবাসী নারী ঝুড়িতে কিছু কুড়োচ্ছেন, 'সেই কত দূরের শঙ্খ ও শোভা নদীর তীর, গভীর নাকটিটাঁড়ের বনমধ্যস্থ কৃষ্ণ প্রস্তরের রস‌ই গণ্ডশৈল ও আদিম মানবের চিহ্নযুক্ত গুহা, ভালকীর জঙ্গলে বন্য বরমকোচা গ্রামের সেই মুণ্ডা যুবতীটি, যে আমায় বলেছিল ----- 'তুই কি করছিস এ বনে আমাদের? ভালো ভালো জায়গা দেখে বেড়াচ্ছিস বুঝি? অবিশ্যি এত ভালো বাংলায় বলেনি।' তবুও বিভূতিভূষণের 'হে অরণ্য কথা কও' বইয়ের এই অংশটি আমার বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে খানিকটা মিলে যাওয়ায় মনে পড়ে গেলো, চমক লেগে গেলো, তাই ওনাকেই জিজ্ঞেস করলাম, 'এগুলো কী কুড়াচ্ছেন, ফুল?

 

 'হ্যাঁ ওই মহুল ফুল। সকালবেলা গাছ থেকে পড়ে।' 

 

---  'এই ফুল দিয়ে কী করেন আপনারা?' 

 

 'ওই দারু বানাই। আর‌ও কাজে লাগে আমাদের, বীজের তেল বানাই' 

 

------- এই মহুয়াই হলো সেই ফুলগাছ যে ফুলের নির্যাসে মাদকতা আছে, আছে সাঁওতাল জীবনের সংগ্রাম, দুঃখময় যাপনকথা। কাজী নজরুলের সেই যে গান 'মহুল গাছে ফুল ফুটেছে, নেশার ঝোঁকে ঝিমায় পবন / গুন গুনিয়ে ভ্রমর এলো, ভুল করে তোর ভোলালো মন' ----- মনে পড়ায় এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মহুল ফুলের অথবা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের প্রাচীন সম্পর্কের রসায়ন কথা। আবার ভেষজ গুণেও মহুয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নানান রোগের চিকিৎসায় সাঁওতাল সমাজে বহুকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই গাছের বাকল, ফুল ও ফল (ফলটির স্থানীয় নাম 'কড়চা')। জঙ্গলমহলের নিজস্ব ধর্মক্ষেত্র 'জাহের থান' গড়ে ওঠে শাল ও মহুল গাছকে কেন্দ্র করেই। যাকগে, এবার আবার ভ্রমণের কথায় আসি ----- সেদিন সকালটা একাকী আমার 'শব্দ' নিয়ে কেটেছিল, বিভিন্ন রকমের শব্দ, যাদের উৎপত্তি মাটির অনেক কাছ থেকে। আর এতো শান্ত চারদিক, মনে হবে শব্দই সেখানে একমাত্র বাসিন্দা, শব্দের আবহাওয়া এমন যে তা মানুষকে চলমান করে রাখে মূর্ছনায়, রহস্যে, প্রাকৃতিক কথোপকথনে। আমি শব্দ শুনছি শালপাতার, আমি শব্দ শুনছি ছাগলের গলায় বাঁধা কাঠের ঘন্টির, আমি শব্দ শুনছি পুরোনো শাল গাছের কোটরে লাল পিঁপড়ের বাসা বানাবার তোরজোড়, আমি শব্দ শুনছি আদিবাসী পুরুষের কাঁধে করে শুকনো কাঠ, শালপাতার বোঝা নিয়ে চলা এবং তার চলার যে ছন্দ তাতেই বেজে উঠছে অহল্যাভূমির সুর 'মাঝি বাবা বন বদল ক‌ওয়া' ------ আর টুপটাপ টুপটাপ করে মহুয়া ফুল খসে খসে পড়ছে মাটিতে, সেই মাটি যা আগুনে পোড়া, কালো হয়ে আছে সারা দেহ, 'অভুক্ত দেহে তুমি কি রং দেবে আমায়!' ----- এতো সকাল এখন যে সূর্যের আলো এসে পড়ছে গাছের ফাঁক দিয়ে, কিন্তু গাছে গাছে তেমন পাখি নেই, অনেক পুটুস (লান্টানা) ফুলের ঝোপ, অনেক অচেনা গন্ধ আছে সেখানে, কিন্তু পাখির ডাক একটু কম। আমাদের রিসর্টের ঘরের জানলা খুললেই যে নিবিড় বন দ্যাখা যাচ্ছিল, সেই বনে আমাদের আর যাওয়া হয়নি, আমরা ২৯শে মার্চ বিকেলবেলা গেছিলাম খামারের দিকে কাশিডি গ্রামে (এই ডিহি বা ডি কথার অর্থই হলো গ্রাম), সেখানে পলাশের জঙ্গল, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ি থামলো আর দুদিকে অসংখ্য পলাশ গাছ লাল সূর্যের আভা হয়ে ফুটে উঠেছে। তখন গোধূলি, সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। আমরা দলবেঁধে পলাশের অরণ্যে ছুটে ছুটে চলেছি, চারদিকে ছোটো-বড়ো পাহাড়, সাঁওতালি ভাষায় 'বুরু' (গোর্গাবুরু, গজাবুরু, চেমটাবুরু ইত্যাদি। আ‌র অনুচ্চ বিচ্ছিন্ন পাহাড় বা টিলাকে বলে 'ডুংরি'। ----- 'ই ডুংরি উ ডুংরি পিয়াল পাকেছে' ওদেরই লোকগান।), ভূগোলের ভাষায় মোনাডনক্, আর মাঝে এই পলাশের উপত্যকা। কোন সে প্রাচীন যুগের শিলাস্তর ক্ষ‌ইতে ক্ষ‌ইতে দধীচির অস্থি-অবশেষের মতো পড়ে আছে পলাশের রাজ্য পুরুলিয়া। তার যেকোনো উচ্চতায় উঠে দেখলেই বোঝা যায় একে কেন রাঢ়ভূমি বলা হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর, নুড়ি, কাঁকর, মোটা বালিকেই সাঁওতালরা বলে রাঢ় বা লাড়; কখনো কখনো ভুড়ভুড় করে এই বালিপাথর ভেদ করেই দ্যাখা দিচ্ছে প্রস্রবণ বা দাঁড়ি (যেমন - সীতাকুণ্ড); আবার অন্তঃসলিলা হয়ে কোথায় কোন নদীতে মিশে যাচ্ছে। জেগে উঠছে আদিমতা, যন্ত্রসভ্যতার মেশিনাঘাতে আবার হারিয়ে যাচ্ছে সে। কাশিডি থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলা আমরাও হারিয়ে গেছিলাম, মুরগুমার অন্ধকার রাস্তায় অযোধ্যা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম পথ।



একের পর এক ডিহিতে, মোড়ে মোড়ে, অনেক বসতিতে পথের হদিশ জেনে, রাতের পাহাড় দেখতে দেখতে, দুর্নিবার স্বাভিমানে ঘেরা মানভূম আমাদের পথ ছেড়ে দিয়েছিল, দেখিয়ে দিয়েছিল আলো; উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের মিশেল তখন আমাদের ধমনীতে ছুটে চলেছে, গাড়ির চেয়েও দ্রুত, তখনই তার দূরপাল্লার হেডলাইটে দেখা মিলল সেই 'বিরসা মুন্ডা মোড়', সেই বটগাছ, সেখান থেকে সাত কিমি দূরে খামার আর এক কিমির মধ্যেই অযোধ্যা।

সেদিন রাতে ফিরেই স্যার ঠিক করে দিলেন, আগামীকাল সকালে একটি ছোটো প্রভাতী অনুষ্ঠান হবে এবং সেখানে সকলেই প্রকৃতি নিয়ে কিছু কথা বলবে; আমাকে স্যার দিয়েছিলেন 'প্রকৃতি ও কবিতা প্রসঙ্গ' এই বিষয়ে কিছু বলতে। কিন্তু সকালবেলা আমার একক ভ্রমণ শেষ করে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো; ফিরে সকলেই দেখলাম স্নান সেরে প্রায় প্রস্তুত, আমিও দ্রুত স্নান করে এসে যোগদান করলাম অনুষ্ঠানে। প্রকৃতির মাঝে বসেই আমরা প্রকৃতি নিয়ে আমাদের কথা বলছি, সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি ও উত্তেজনা সকলের মধ্যে। আমি কথা বলা শুরু করলাম আমাদের পুরুলিয়া আসার পথের জার্নি দিয়ে ------ রাতের বেলা যখন আমাদের বড়ো গাড়িটির আগে আগে স্যারের ছোটো গাড়িটি দ্রুত ছুটছিল এবং সেই ছোটা এতটাই নিরবচ্ছিন্ন ছিল যে আমাদের গাড়ি কিছুতেই পেরিয়ে যেতে পারছিল না; ফলে গাড়ির সামনের কাচ দিয়ে আমরা যেন একটি সিনেমার চলমান দৃশ্য দেখছিলাম বলে মনে হচ্ছিল। আমি তখন ঝিলিকের সাথে গল্প করতে করতে বলছিলাম, দ্যাখো স্যারদের গাড়িটা যেন কোনো সিনেমার অভিমানী নায়িকা, প্রেমিকের কাছে দুঃখ পেয়ে অভিমানে দ্রুত বাড়ি ফিরছে অথবা যাচ্ছে কোনো নির্জন স্থানে একাকীত্ব কাটাতে। তখন ঝিলিক আমায় জিজ্ঞেস করে, তাহলে আমাদের গাড়িটি কি সেই প্রেমিক? আমি বলি, না, আমাদের গাড়িটি হলো ওই সিনেমার ক্যামেরা ----- একের পর এক দৃশ্যকে আমরা ধরতে ধরতে চলেছি, অন্ধকার ও গাড়ির হলুদ-লাল আলো এড়িয়ে আমরা চিত্রের পর চিত্র সংগ্রহ করতে করতে এগিয়ে চলেছি, জানি এই সংগ্রহ কখনো ফুরোবার নয়, তবুও জীবন তো নানারকম দৃশ্যের ও স্মৃতির সংগ্রহই বটে। রবি ঠাকুর তো বলেই গেছেন, 'আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। / এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥' এই জানতে জানতেই আমাদের জীবন একটা সময়ে অগস্ত্য যাত্রায় চলে যায়, প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির উপাদান আবার বিলীন হয়ে যায়। সেখান থেকেই আবার নতুন প্রাণ জন্ম নেয়, আবার নতুন জানা, নতুন বিস্ময়, নতুন দিগন্ত খুলে যায় প্রকৃতির মাঝে, প্রকৃতি এমনই অপার, এমনই চিরন্তন। আমরা কথা বলে চলি, উল্লেখ করি আমার প্রিয় কবি বিনয় মজুমদারের কথা, উদ্ধৃতি করি তাঁর কবিতার লাইন, প্রকৃতি ও সত্যের সঙ্গে তাঁর কবিতা কীভাবে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে তাও বলার চেষ্টা করি। ---- 'সকল ফুলের কাছে এত মোহময় মনে যাবার পরেও / মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।' যদিও ভেবেছিলাম আজ সকালে আমার সেই একক ভ্রমণের অনুভূতির কথা সকলকে বলবো; কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি, কারণ স্বভাববশতই বক্তব্য রাখার সময় আমি বেমালুম সেকথা ভুলে গেছিলাম। তবে আমার ছোটবেলার কথা অর্থাৎ কবিতা লেখার শুরুর সময়ের কথা, কীভাবে একদিন গঙ্গার ঘাট থেকে আমি নিখোঁজ হয়ে গেছিলাম বাংলা কবিতায় -- সেই কথা; প্রকৃতি দেখে বিস্ময়ের কথা, প্রকৃতির মাঝে ছুটে যাওয়ার কথা। সেই সঙ্গে ২০১৪-১৫ সালে আমাদের উত্তর ভারত ভ্রমণের কথা, সেখানে ঋষিকেশ পর্বতে বৃষ্টিস্নাত হয়ে আমি যে শব্দ যে অনুরণন অনুভব করেছিলাম, সেই অনুভূতির কথা ---- যে অনুভূতি কখনো ফুরোবার নয়, ভিজে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমি এক-পা এক-পা করে হাঁটছি আর বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে, দলছুট নিঃসঙ্গ পাখির মতো গাছের ডালে বসে আমার ভিজে ডানা আমি ঝেড়ে ঝেড়ে নিচ্ছি, তাকাচ্ছি গাছে, তাকাচ্ছি আকাশে, তাকাচ্ছি দূরে পর্বতের ঢাল কোথায় গিয়ে নেবেছে কোন দিকে; আমার সামনে দিয়ে একজন সন্ন্যাসী সহসা হেঁটে গেলেন বনের গভীরে, বৃষ্টির মতোই তিনি নিঃশব্দ, রোমাঞ্চের মতোই আমি অবগুন্ঠিত তখন, অনুভবে পাগল হয়ে আছি, আমি হাঁটছি আর শব্দ হচ্ছে নিস্তব্ধতার আকারে -----

 

'বাকি আমি রাখব না কিছুই।

তোমার চলার পথে পথে

ছেয়ে দেব ভুঁই।

ওগো মোহন, তোমার উত্তরীয়

গন্ধে আমার ভরে নিয়ো,

উজাড় করে দেব পায়ে

বকুল বেলা জুঁই।

দখিনসাগর পার হয়ে-যে

এলে পথিক তুমি।

আমার সকল দেব অতিথিরে

আমি বনভূমি।

আমার কুলায়ভরা রয়েছে গান,

সব তোমারেই করেছি দান,

দেবার কাঙাল করে আমায়

চরণ যখন ছুঁই।'                             -------- (বনভূমি : বসন্ত ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

... শরীরে শিহরন জাগছে ক্রমাগত, অথচ এই দৃশ্য শেষ হয়ে যাবে। যদিও শেষ হওয়ার নয় স্মৃতি, অনুভূতি; যেমন শেষ হয় না কিশোর বেলার মুহূর্তগুলো ----- সেসময় আমার মননে, মস্তিষ্কে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান খেলা করতো, বাড়ির উঠোনে ছড়িয়ে থাকা আম জাম কাঁঠাল তাল ও লেবু গাছেদের মাঝে আমার দিনভর একক ভ্রমণ, গাছে গাছে পাখি দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ----- বাড়ি পরিবর্তন করায় আমার প্রিয় পাখিদের আমি আর পাই না, আগে আমার জানলায় সারাদিন পাখির কিচিরমিচির ছিল, কত কত পাখি আসতো। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠেঘাটে ঘুরতে যাওয়া ছিল। শিহরিত হওয়ার মতো আনন্দ ছিল, প্রতিটি পাতার কম্পনে আমার অনুভূতি জাগতো। একেকদিন রাতের বেলা পুরোনো বাড়িতে আমার ঘর জোনাকিতে ভরে যেত, নীল মশারির মধ্যে আমি একলা শুয়ে আছি আর আমার অন্ধকার ঘরে অসংখ্য জোনাকির মিটিমিটি আলো; আমি হা হয়ে থাকতাম, ঝাঁকে ঝাঁকে খদ্যোত আমার ঘরে যেন বেঠোফেন বা ইয়ানির সংগীতের মূর্ছনা রূপান্তরিত আলোয় ফুটিয়ে তুলতো। আহা! সেসব রাত। তারপর সকালবেলা আমি আর বাবা মিলে কাঠবেড়ালি আর পাখিদের কখনও রুটি কখনও বিস্কুট বা ভুজিয়া খাওয়াতাম। পড়িয়ে বাড়ি ফিরলেই আমার বেড়ালটা পা ঘেঁষে ঘেঁষে ঘুরতো, আমি যেদিকে, ও সেদিকে। তার‌ও আগে আমার একটা পোষা মুরগি ছিল, সে আমার ঘরে ছাড়া রাতে কোথাও থাকতো না, ডিম পাড়লে একমাত্র আমাকেই সে ডিম নিতে দিতো, অন্য কেউ নিলে ঠুকরে লাল করে দিতো হাত, কখনও রাস্তায় দেখা হলে উড়ে এসে আমার সাইকেলে বসতো। আমাদের বাড়ির পেছনে গোরস্থান আর একদিকে ইটভাটা। তারপর আরও বাগান, পুকুর। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, তাই খুব গরম পড়লে আমরা রাতের বেলা উঠোনে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতাম। আমাদের বাড়িটাও ছিল গাছগাছালিতে ভরা। ফলে রাতের বেলা বাইরে শোবার উত্তেজনাও কম ছিল না সেসময়। কখনও অন্ধকার রাত্রি, কখনওবা পূর্ণিমার আকাশ, নীল মশারির ভেতরে শুয়ে চাঁদ দেখছি, তারা দেখছি, কখনও ভাটার পাঁচিলের গায়ে জিবলি গাছে দুটো পেঁচা এসে বসেছে, দেখতে পাচ্ছি তাদের জ্বলজ্বলে চোখ। এক মশারি থেকে আর এক মশারিতে ভাই-বোনেদের কথা চালাচালি হতো। কখনও গভীর রাতে হঠাৎ দেখলাম গোরস্থান হ্যাজাকের আলোয় ভরে গেছে, মুসলমান পাড়া থেকে মরা এসেছে, কবর দেবে, আমরা উঠোনে শুয়ে শুয়ে দেখতাম সেসব দৃশ্য, দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে যেতাম। আমাদের সকলেরই ছোটবেলাটা এরকম প্রায় প্রাকৃতিক হয়, কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে যান্ত্রিকতা আমাদের গ্রাস করে নেয়, আমরা খাঁচার পাখির মতো খাবি খাই আর স্মৃতি রোমন্থন করি।

 

--------- এরকমই আরো ছাইপাঁশ বলতে বলতে (অথবা সেসব কাহিনী এখন লিখতে লিখতে) আমার গলা শুকিয়ে আসে, আমি জল খাই। আজ সারাদিন এই প্রাচীন মালভূমির আনাচে-কানাচে আমাদের ঘোরা। কিন্তু আজ প্রভাতী অনুষ্ঠানে সকলের সাত্ত্বিক কণ্ঠস্বরে প্রকৃতির কথা শুনে আমরা অনেকেই মৌন ও সমৃদ্ধ হলাম। এরপর স্বাভাবিকভাবেই ব্রেকফাস্ট হলো মৃদুমন্দ তানে। এবার বেরোবার পালা, এবার সমস্ত জানা ও শোনাকে ছাপিয়ে বাস্তব দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়া, চাক্ষুষ করা রাঢ় বাংলার আঞ্চলিক রূপ। তাই সাজো সাজো রবে আমরা বেরোলাম। সকালবেলার মৃদু রোদের পর্দা ফুঁড়ে গাড়ি ছুটতে শুরু করলো, যেন সুবীর সেনের গলায় 'পাগল হাওয়া, কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে, ফুলের‌ বনে, হাজার রঙের মেলায়...' ----- সলিল চৌধুরী কোন দৃশ্য দেখে বা কী ভেবে এসব লাইন লিখেছিলেন আমি জানি না, কিন্তু ২০১৬ সালে যখন আমরা প্রথমবার পুরুলিয়া এসেছিলাম, তখন দৃশ্য দেখেছিলাম আলাদা, কবিতাও লিখেছিলাম আলাদা, তাতে ছিল প্রাচীন গুল্মলতার প্রাণ, কান পাতলেই শোনা যেত দূরাগত শান্ত সামগান ------- 'বঞ্চিতের বিজয়কেতন উড়িয়ে এ যেন অচেনা ধরিত্রী / আজ‌ও উদভ্রান্ত, নিভৃত কুহক হেনে চলেছে দিনগুজরানে'। এই শেষ শব্দটির অভিঘাতে মনে পড়ে গেলো, সেবার পুরুলিয়া এসে দ্যাখা সাঁওতালডিহি গ্রামটির কথা, অথবা এবারের পিটিডিরি গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, বার্ডম্যান অফ ইন্ডিয়া সেলিম আলির আত্মজীবনীর নাম 'চড়াই-উতরাই'

 

সেদিন বেরিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল পিটিডিরি গ্রাম। আমাদের গাইড ছিলেন একজন স্থানীয় লোক, গোপাল সিং মুড়া; যদিও তিনি আমাদের নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন প্রাক্তন মাওবাদী কমান্ডার হিসেবে, এমনই মজাদার আর সরল মানুষ। তার‌ই তত্ত্বাবধানে যখন আমরা পিটিডিরি গ্রামে গিয়ে পৌঁছালাম তখন চড়া রোদ আমাদের মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে; ওই গ্রামবাসীদের কাছে তিনি পূর্ব পরিচিত হওয়ায় ওনার ডাকে প্রচুর গ্রামবাসী, বিশেষত মহিলা ও শিশু, এসে জড়ো হলেন আমাদের কাছে, পিটিডিরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটা কুসুম গাছের নীচে, বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য কিছু জামা-কাপড় আমরা নিয়ে গেছিলাম, সেগুলো ওদের পছন্দ মতো ওরা বেছে নিলো। গ্রামের কিছু জোয়ান পুরুষ‌ও তাদের ঘর তৈরীর জন্য ভিতের মাটি কাটার কাজ ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছিল এই উপহার গ্রহণে, আমি অবাক হয়েছিলাম, প্রয়োজন এতটাই! আমি তো স্বপ্ন দেখি একদিন এই প্রয়োজনটা আর থাকবে না, তখন উপহার দেওয়া-নেওয়া হবে শুধু প্রকৃতির সন্তানদের ভালোবাসা ও আলিঙ্গন, দেওয়া-নেওয়া হবে ভাষা ও সংস্কৃতির। এবং তাতে যেটুকু খুশি আমরা ওদের চোখেমুখে দেখতে পেলাম, বুঝতে বাকি র‌ইলো না যে এই এক-আধটা পোশাক ওদের দরকার, সরকারি এতো প্রকল্প এতো উন্নয়ন এতো গ্যারান্টি এবং গরীব মানুষদের উপকার করার জন্য নেতাদের এতো ব্যাকুলতা থাকা সত্ত্বেও গরীব মানুষেরা প্রকৃত অর্থে এখনো যে কতটা পিছিয়ে, দৈনন্দিন রুজি রোজগারে তাদের এখনো কী অমানুষিক সংগ্রাম করতে হয় তা 'রুটি কাপড়া মাকান' বা 'খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা' এই মৌলিক অধিকারগুলোকে সুকৌশলে দূরে রেখে শুধু ধর্ম, জাতপাত এবং চমকদারি বিভেদকামী রাজনীতির ধ্বজাধারীরা বোঝার চেষ্টা করে না। আমাদের গাইড গোপাল সিং মুড়া বলছিলেন, জঙ্গলমহলে যা একটু রাস্তাঘাট হাসপাতাল ইত্যাদি হয়েছে তা সবই নাকি মাওবাদীদের আন্দোলনের অবদান, জানি না এই দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত বা সত্য কিনা, কিন্তু সেখানকার মানুষের যে অদূরগামীতা, রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকার যে সংগ্রাম, তার প্রতিদান তারা যেমন প্রকৃতি থাকে পায়, ফি-বছর নির্বাচনে ভোট দিয়ে সেই প্রতিদান তারা পায় কিনা সন্দেহ আছে, বরং পায় না বলাই ভালো। তবে তথাকথিত সভ্য জগতের জটিলতা থেকে দূরে নিজেদের মৌলিক সংস্কৃতিকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার যে সরলতা, যে পূর্ণ সুখ তা উন্নত সভ্যতার নেই, তার শুধু একে অন্যকে মেরে এগিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য। প্রকৃতি ও মানুষের এমন একত্র সমাবেশ পুরুলিয়ার কুড়মি, মাহাতো, খেড়িয়া, বিরহড়, সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মতো মানুষ ছাড়া খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর তাই পিটিডিরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে যে বাচ্চাটির সঙ্গে আমাদের আগেই পরিচয় হয়ছিল, সে-ই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো পিটিডিরি ফলস্-এর কাছে; যাওয়ার পথে ছেলেটিই আমাদের চিনিয়ে দিলো কুসুম গাছ, রক্তের মতো লাল হয়ে থাকা পাতা বসন্তের আদরে সারা গাছ জুড়ে ছেয়ে আছে। এই চড়াই উতরাই দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় একটি মেহমান জলের ধারা, তাতে পা ডুবিয়ে, কখনো পাথর কখনো মাটির আঙুল শুঁকতে শুঁকতে আমরা পৌঁছলাম, তীব্র রোদ আর চাঁদিফাটা উত্তাপ থেকে একটু যেন স্বস্তি পেলাম ওই ঝর্ণার ধারে। স্যার-বৌদি ছুটি আর কথা-কে নিয়ে বসলো একটা গাছের নীচে, পাথরের উপর। আমাদের মধ্যেই অতি-উৎসাহী কিছু দামাল ছেলে, যারা কাশিডি গ্রামে পলাশের জঙ্গল ছেড়ে 'খোদার আসন আরশ ছেদিয়া' উঠে গেছিল পাহাড়ে পাহাড়ে, ছুঁতে চেয়েছিল আকাশ, মুঠো মুঠো বাতাস আর সূর্যাস্তের ওই লাল রং-কে, এরা তারাই, ছুটতে ছুটতে উঠে গেলো ওই ঝর্ণার মাথায়, আমরাও পিছু নিলাম শীতল জলে, পাথরের কৈশিক ফাঁক দিয়ে চুঁয়ে-চুঁয়ে জল, জলের মধ্যে ছন্দ, আর ছন্দের মধ্যে কবিতার আড়াল নিয়ে। এই ঝর্ণার ওপারে কী আছে, এর উৎস কোথায়, উঁচুতে যে ঘন বন দেখা যাচ্ছে চলো সেখানে যাই, বনের মধ্য দিয়ে একটু নিশ্চুপ হাঁটতে পারলে ভালো হতো, একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো গাছেদের সঙ্গে, কিন্তু পর্যটক বোধহয় অতটা আপনার হতে পারে না প্রকৃতির, যতটা আপন সেখানকার মানুষ, আমাদের দূর থেকে শুধু দৃশ্য নিয়ে খুশি থাকতে হয়, আমাদের ফিরে আসতে হয়; মনের মধ্যে রহস্য রয়ে যায় এই পাহাড়ের ওপারে কী আছে, এই আকাশের ওপারে কী আছে, 'নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো' ইত্যাদি।


এভাবেই খানিকটা সময় ঝর্ণার জল থেকে ছিটকে আসা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জলের কণার আবহে ছড়িয়ে পড়া প্রশান্তি
, কিছু হাসি কিছু উল্লাস আর সকলের মনে সেই জলে অবগাহনের সুপ্ত ইচ্ছা জাগিয়ে রেখে আমরা আবার ফিরে আসি গাড়িতে। গাড়ি এবার যাবে সোজা পেট্রোল পাম্প, সেখান থেকে মার্বেল লেক, আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, তুর্গা ফলস্ ইত্যাদি জায়গা।
 

 

কিন্তু পাঠক, এখন আমরা আর সেদিকে যাবো না, আমরা বরং চলে যাই ৩১শে মার্চ সকালে ----- আজকের প্রভাতী অনুষ্ঠান, আজ আমাদের রং খেলবার দিন, বসন্তে প্রকৃতির যে রং, সেই রঙের বিনিময় করবো আমরা একে অপরের সঙ্গে। যদিও সকাল আর প্রভাত রইলো না, অনুষ্ঠান শুরু করতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো আমাদের, তবুও প্রাতঃরাশের পর ছুটি ও উৎপলদার গাওয়া 'প্রভাত সঙ্গীত'-এর মাধ্যমে শুরু হলো আমাদের বসন্ত উদযাপন। মুহূর্তে বদলে গেলো পরিবেশ; চারিপাশে ফুটে থাকা রঙিন ফুলেদের যেন আকাঙ্ক্ষিত কালের অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে। মানুষের মধ্যেকার জটিল উচ্ছ্বাস নির্মল বাতাসের মতো যেন উদগ্রীব হয়ে রয়েছে প্রকাশিত হওয়ার জন্য, যেন ফর্মা বাঁধাইয়ের কাজ শেষ, এখনই পাঠকের হাতে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে সে ফুলের গন্ধ, অথবা এখনই কোনো ডিঙি নৌকার পাটনি আমাদের নিয়ে চলে যাবে কোনো অচেনা পুষ্পরাজ্যের মোহনায়, তাদের গন্ধ এতটা মোহময় যে আমাদের শরীর হয়তো এখনই রাঙা হয়ে উঠবে, আমরা পৃথিবীকে বলবো সুন্দর আর সুন্দর হয়ে উঠবে সে, আমরা বাতাসকে বলবো সৌরভ আর সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক হয়ে উঠবে সে, সমস্ত ক্ষত উবে যাবে, উড়ে যাবে আকাশের রং। আর 'বসন্ত' নামে গদ্যনাট্যের বেণুবন গেয়ে উঠবে -----

 

'যখন আমার বুকের মাঝে

তোমার পথের বাঁশি বাজে,

বন্ধভাঙার ছন্দে আমার

মৌন কাঁদন হয় অবসান।

দখিনহাওয়া, জাগো জাগো,

জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।'

 

আমাদেরও অবস্থা হলো তাই, রঙের নেশায় আমাদের সুপ্ত প্রাণ জেগে উঠলো, রঙের খেলায় মেতে উঠলো বসন্তবৌরি। একে একে সকলের থেকে প্রকৃতি নিয়ে, আমাদের ভ্রমণ নিয়ে, নিজস্ব আবেগ নিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতির কথা শোনা হলো; স্যারের মুখ থেকে শুনলাম রং নিয়ে নতুন কিছু কথা। অথচ ভেতরে ভেতরে 'আমরা বাস্তুছাড়ার দল, / ভবের পদ্মপত্রে জল। / আমরা করছি টলমল।' ------ শুরুটা করলো ছুটিই, কারণ ওই আমাদের পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল ফুল, সবচেয়ে উন্মুখ ঝরনাটি। অনুষ্ঠান চলাকালীন‌ই ও আমাদের সকলকে নিঃশব্দ খিলখিলে নানান রঙের আবির মাখিয়ে দিলো। আর আমি তুললাম ছবি ----- এবারের ট্যুরে আমার যেন সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল এই অনুষ্ঠানের মুহূর্তগুলোতে সকল সদস্যের পোর্টেট জাতীয় ছবি তোলায়, সবচেয়ে ভালো হয়েছে রাতের অনুষ্ঠানে তোলা ছবিগুলো, আর আজকের এই রং খেলার সময়ে তোলা ছবিগুলো। ছুটিকে দিয়েই শুরু করলাম এবং তা উর্মিমুখর; ছুটির সঙ্গে আমি একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব অনুভব করি, ও আমাকে 'সৌরভ কাকা' বলে যেমন ডাকে, তেমন ওর মায়ের, মানে আমাদের বৌদির দেখাদেখি ও আমাকে 'কবিদা' বলেও ডাকে। এবং আমাদের সকলের সঙ্গে ও খুব স্বতঃস্ফূর্ত, মনের গোপন কথাটিও বলতে পারে, আমাদের সঙ্গে ছুটতে পারে, দৌড়াতে পারে, অমলিন আনন্দ করতে পারে। এই ছোটো থেকেই ওর মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে পরিবার মানে একটা বৃহৎ সম্পর্কের কথা, যেখানে শুধু ওর বাবা-মা-বোন নয়, বাকি আমরা যারা আছি তারাও ওর এই বৃহৎ পরিবারের সদস্য; সেই জন্যই তো আমরা আমাদের এই পরিবারের নাম দিয়েছি 'God's Great Big Family.'। আমরা নতুন পুরোনো সকলে মিলে এই ভাঙনের যুগেও গড়ে তোলার চেষ্টা করি ভালবাসার রঙিন পৃথিবী ------ আমাদের প্রতিটি ছুঁড়ে দেওয়া রঙের কণায়, প্রতিটি হাসিতে, প্রতিটি নৃত্যে-ছন্দে সেই ভালোবাসার শব্দই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, ফুটে ওঠে ফুল হয়ে। জগতের আনন্দযজ্ঞে আমাদের যে নিমন্ত্রণ, আমরা তার চাটনীটুকুও চেটেপুটে গ্রহণ করি। আর দেখতে দেখতে অনুষ্ঠান‌ও শেষ হয়ে যায় এভাবে। শুরু হয় শেকল ভাঙার গান, সেই যে দামাল ছেলের দল, যাদের মধ্যে কেউ বিপ্লব, কেউ সুজন বা কেউ শাকিল, শ্রাবণী, সৌমজিৎ, আবার কেউ সায়ন, কেউ চয়ন বা কেউ নিশান, সৌভিক ----- যারা জ্ঞানে, বোধে, আবেগে, অনুভূতিতে নিজেদের বিছিয়ে দিতে পারে যেকোনো মুহূর্তে, ওরাই আবার চরম আনন্দে বিগলিত হয়ে যেতে পারে ----- আমার সেই ভাই-বন্ধুদের শৃঙ্খলাহীন নাচের মুহূর্তগুলো ধরা রইল আমার ফোনের ক্যামেরায়, সেসব দৃশ্যের শাব্দিক রূপান্তর আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সে যে কী উত্তুঙ্গ আনন্দ তা বলে বোঝানোর নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, রিসর্টের সাউন্ড সিস্টেমটি বেজে উঠতেই মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়েছিলো সমবেত বনচাঁড়ালের নৃত্য, যেন কেউ অলক্ষ্য তুড়িতে আমাদের মধ্যে বিশেষ স্পন্দন জাগিয়ে দিয়েছিল; যেমন অনির্বাচনীয় ছিল সংগীত, তেমনই তার নাচের সমারোহ। তবে ওই নাচানাচির মধ্যে সবচেয়ে ইউনিক যে ছিল সে আমাদের শানমুখিয়া, ছেলেটি কর্ণাটক থেকে এসেছে শুধু রাঢ় বাংলায় আমাদের এই সাংগীতিক ভ্রমণে সামিল হতে, ও আমাদের বিট্টু-মহেন্দ্র-অভিজিৎ -এর ইউনিভার্সিটির বন্ধু। বন্ধুত্বের টান ওদের মধ্যে এতটাই প্রগাঢ় যে দূরত্ব, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রেখে শুধু হৃদয়ের টানে পাড়ি দিয়েছে এতটা পথ। যেমন আমাদের রক্তিম, প্রতিটা মুহূর্তে অন্যকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে আছে, অন্যের প্রয়োজন ও যে কী করে এতো অনুভব করে আমি বুঝি না; বালুরঘাট থেকে বারবার হৃদয়ের কোন গভীর টানে ও ছুটে ছুটে আসে এই পরিবারের যেকোনো উৎসবে যোগ দিতে, তা সত্যিই প্রত্যক্ষ অনুভব না করলে বোঝা সম্ভব নয়। বুঝতে গেলে যে বৃহদাকার আনন্দযজ্ঞের মাঝে গিয়ে আমাদের দাঁড়ানো দরকার, তা অনেকেই পারে না, কেউ সুযোগের অভাবে বা কেউ সদিচ্ছার। অথচ "প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে / প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে ভূলোকে / তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া॥" 

 

        এবং এই দোলাতেই আমাদের‌ সুপ্ত ইচ্ছাটিও বাস্তবায়িত হলো। স্যারের অনুমতিক্রমে আমাদের রঙিন দেহমনগুলির সমনকে প্রবল উন্মাদনায় নিয়ে যাওয়া হলো পিটিডিরি ফলস্-এ। ঘর থেকে বাহির হলেই যেমন চারিদিকে জীবনের উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যায়, সেই উচ্ছ্বাস এখানে নেই, এখানে জীবন যেন নিঃশব্দ আচার্য। অথচ ওই ঝর্ণার কাছে যেন বাদ্যযন্ত্র আছে, সারাদিনমান সে বাজিয়ে চলেছে নিজেকে। তার কুলু কুলু ধ্বনির মধ্য থেকেই হয়তো শোনা যায় সেই উত্তর "মহাদেবের জটা হইতে"! ---- নইলে এই অনন্ত স্রোত কোথা থেকে আসতে পারে, যার শেষ নেই যেন। যদিও পৃথিবীর কোন মাটির কুঁজোয় সে জল ছিল আমরা জানি না, কিন্তু তার শীতল স্পর্শে আমাদের দেহনদী, এমনকি হৃদয় অব্দি ভরে গেলো পরমানন্দে। কিন্তু এ আনন্দের সংরক্ষণ করবে কে, আমাদের কারোর কাছেই তো সেইসময়ে কোনো ফোন বা ক্যামেরা ছিল না, ফলে ওই মুহূর্তগুলোর ছবি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি; তাহলে সে কি কেবল কালের আলোকে পরিব্যাপ্ত হতে হতে মিলিয়ে যাবে অনন্তে, নাকি আমাদের স্মৃতিই আমাদের আবর্ত আনন্দগুলির স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষক হবে! --




যদিও তার উত্তর দেবে সময়, কিন্তু ওই সময়ের‌ সকল শব্দখণ্ড, সমস্ত আলোকিত দৃশ্য, সকলের হাসি, সম্মিলিত উচ্ছ্বাস আমাদের মনের মণিকোঠায় অমলিন করে রেখে দেবে এই স্মৃতিকথা, এ আমার একান্ত বিশ্বাস। পুরুলিয়ার কথা মনে করলেই আমার তো প্রথম মনে পড়ছে ওই স্নানের দৃশ্য‌ই, আর সর্বাঙ্গগুলালসম্ভূতা মহেন্দ্র-র কথা, ওর শ্বেতদন্ত বিকশিত হাসি, শানমুখিয়ার ইউনিক নাচের স্টেপগুলো আর বাকি সকলের রঙের গানে গানে প্রখর নাচের উন্মত্ততা, যাকে 'বনচাঁড়ালের নৃত্য' বললে ভুল হবে না ------- সে নাচ যেন উৎপলকুমার বসুর 'সলমা-জরির কাজ'-য়ের উৎসর্গপত্র ----- 'আমাকে নাচতে দাও, ওগো ওই পাথরটুকুর 'পরে ঘূর্ণিপাকের মতো জায়গা ছেড়ো, নিচে খাদের নদীর দিকে তাকিয়ে যেমন মাথা ঘোরে, সেই ঘোর...  ... শুধু ঘুরি, চক্রাকারে, নিজের মধ্যে নাচি, বাহুতে দ্বিপদে নাচি, নাচি পেশী ও চিবুকে, নাচি উপবীত থেকে ঝুলে, আঁচলে, কাছায়, বোতাম-ঘরের ফাঁকে, নাচি সৌরশক্তি উৎপাদনে, নাচি গোপাল গোপাল বলে, নাচি ধর্মান্তরিত খৃষ্ট-পদে, শুধু পাথরটুকুর 'পরে স্থান রেখো, এই নাচ ফুরোবার নয়...  ... নাচো আমার দু-হাত ধরে, কোমর জাপ্টে ধরে, এসো নাচবুদ্ধি দিয়ে সব কিছু জেনে ফেলি।' ------- যেকোনো কিছু লেখার এই এক মস্ত সুবিধা যে, বিভিন্ন শব্দ লেখার সময় লেখকের স্মৃতি তাকে পূর্বে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা বা মুহুর্ত বা পার্থিব কোনো বস্তুর স্মরণ করায়, আমার ক্ষেত্রে বেশিরভাগই হয় কোনো না কোনো বইয়ের স্মৃতি বা অন্য কোনো শ্রদ্ধেয় লেখকের লেখার কথা, একটু আগেই ব্যবহৃত 'স্নান' শব্দটির অভিঘাতে এখন যেমন মনে পড়ছে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখেকবিতাটির কথা। এই কবিতায় গ্রিক মিথোলজির তাইরেসিয়াসকে কবি হাজির করেছিলেন রূপকধর্মিতায়। দেবী এথেনাকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে ফেলায় এই ভবিষ্যকথকের চোখদুটি অন্ধ হয়ে যায়! 

 

'ফলত যেমন অন্ধ তেমনি অন্ধ রইল, সন্ন্যাস 

চায়নি, সন্ন্যাসী তবু রয়ে গেল তাইরেসিয়াস।'

 

অথচ এই কবিতার সঙ্গে বর্তমান লেখাটির কোনো সম্বন্ধ নেই। কিন্তু তবুও, কথার বুকে কথার বাড়ি লেগে লেগে ব্যথা বেড়ে যায়। যেমন দীর্ঘকাল ধরে অসংখ্য জলধারার মৃদু মৃদু ক্ষয়ের দ্বারা পুরুলিয়ার ঈষৎ ঢেউ এখন সমপ্রায়; এ ব্যথা কোথায় লুকোবে সে! ---- গাছে গাছে, ফুলে ফুলে, নাকি নুঁড়ি-পাথরে! পাথর তো অশ্ম হয়, পাথরের পাললিক স্তরেই তো জীবাশ্ম থাকে, তার থেকেই ইতিহাস, সভ্যতা ও মানুষের বিবর্তন ---- ধাপে ধাপে ধরা আছে সবই। আমাদের বিক্ষিপ্ত চেতনায় সেসবের ধাক্কা নিতান্তই অবহেলাবশত ফুরিয়ে যায়, রঙিন ক্যানভাস ভরে ওঠে নিত্যনতুন স্মৃতিতে। এই স্মৃতির সত্তা কী, তার ভবিষ্যত‌ই বা কী, তা আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবুও সাংস্কৃতিক মানুষ তার মননে সংস্কৃতিরই ধারক ও বাহক, সে নিজের জয়কেই এগিয়ে রাখে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যন্ত্রের সহজলভ্য ব্যবহার মানুষ যত বেশি করতে শিখছে, ততই তার বিজ্ঞানচেতনা কমে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক চেতনা ততোই ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে আলো জ্বলে উঠছে বনের ভিতরে, অথচ তা আলো ও অন্ধকারের একটা সমসত্ব মিশ্রণ হওয়ার কথা ছিল, অথচ তা আলোক-সমৃদ্ধ রহস্যের আধার হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাকে স্থিতিশীল উন্নয়নের নামে দিনের আলোর মতো মানুষের বিচরণের সুবিধা দিতে বনভূমি বদলে যাচ্ছে প্রকল্পভূমিতে। এর জন্য দায়ী যে উন্নত মানুষ, আমি তাকে করুণা করি ----- এর জন্য দায়ী যে উদ্ভাবনী মস্তিষ্ক, আমি তাকে সন্দেহ করি ------ এর জন্য দায়ী যে সাম্রাজ্যবাদ, আমি তাকে ঘৃণা করি ------ এর জন্য দায়ী যে রাজনীতি, আমি সেই রাজাকে 'আমরা সবাই রাজা' বলে খিল্লি করতে চাই। অথচ এই প্রাচীন গ্রানাইট এতো উত্তপ্ত যে খালি পায়ের সংগ্রাম প্রায় অসম্ভব এখন। এই মালভূমির শরীর নিঃসৃত জল যতটা ঠাণ্ডা, এর শিলাস্তর ততটাই উষ্ণ। 

 

অবগাহনের ওই মুহূর্তগুলি থেকে ফিরে এসে আবার এক প্রস্থ স্নান সেরে খাওয়াদাওয়া; এবং যেটুকু বিকেল পাওয়া গেল সেটুকুই বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যায় শুরু হলো এবারের ট্যুরের শেষ অনুষ্ঠানপর্ব। স্বাভাবিকভাবেই তা আবেগতাড়িত হয়ে পড়লো বৌদির জীবন সংগ্রামের কথায়, সৌম্যজিতের বিশুদ্ধ অনুভূতিপূর্ণ শব্দে ----- অথচ এই সৌম্যই একটু আগে সায়ন আর চয়নকে সঙ্গী করে অসাধারণ হাস্যরসের একটি নাটিকা আমাদের সামনে উপস্থাপন করলো এবং আমরা ওই ১৫ মিনিট শুধুই হাসলাম আর ভাসলাম। রাতের অন্ধকারে কালো সানগ্লাস প'রে আমাদের নিশান এমন একেকটি উদ্ভাবনী স্টেপ দিলো তার নাচে যে তা আমাদের হৃদয়যন্ত্রকে বাধ্য করলো হা-হা হি-হি করতে, আমরা নিরুপায় যন্ত্রের মতো কম্পনে হেসে গেলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছুটির সেই অনিন্দ্যসুন্দর নাচের কথা তো বলা হলো না, বলা হলো না ঝিলিকের নাচের কথাও ------ ওরা দুজনেই নৃত্যপটিয়সী, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় এই আলো ও অন্ধকারের ছন্দে, এই লোক ও নৃলোকের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলো তাদের নর্তন প্রক্রিয়া। দেওয়া-নেওয়া হলো পুরস্কারের‌ও। আমার ভাইবন্ধুদের কাছ থেকে আমিও উপহার পেলাম, ছবি তোলার জন্য, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'মণিমহেশ' নামে কাশ্মীর ভ্রমণের একটি বই। বেশ অন্য রকমের আনন্দ হলো এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে, যদিও আমি দেখেছিলাম আমাদের চয়ন এবং বিপ্লব অসাধারণ সব ছবি তুলেছে, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো আমার করা ক্লিক থেকে অনেক অনেক ভালো, তবুও ওদের দেওয়া ভালোবাসার উপহার পেয়ে আমি যারপরনাই পুলকিত হ‌ইলাম। এই পুরস্কার দেওয়ার আবহেই ঝিলিক ঘটিয়ে বসলো একটা কাণ্ড ----- যারা যারা গত দুদিন ধরে রাতের অনুষ্ঠানে হাস্যনাট্য উপহার দিয়েছে আমাদেরকে, তাদের পারফরমেন্সে ও হাস্যমুগ্ধ হয়ে দুটি Happy Happy বিস্কুটের প্যাকেট উপহার দিলো, যা দামে খুবই সামান্য কিন্তু আন্তরিকতায় কাঁচা সবুজ। ফলে সকলেই খুশি হলো; যদিও আমাদের কাজই তাই, খুশির আবেশ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এসব যখন দেখছি ঠিক তখনই আমি ভাবছি, সে কাণ্ডারী কোথায়, অনুষ্ঠানের এসব মুহূর্তেও তিনি কখনো কাছে কখনো দূরে, আমি মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করছি, যিনি আমাদেরকে বলেন তার বাগানের ফুল আর তিনি এই বাগানের মালি, তিনি কতটা খুশি এই আবেগঘন পারিবারিক মুহূর্তে ----- তার হাঁটার ধরন, তার মাথার সরণ, এমনকি  মুগ্ধতা স্পষ্ট তার ঠোঁটে। যে আদর্শ যে স্বপ্ন যে আনন্দের পৃথিবীর কথা তিনি আমাদের ক্রমাগত বলে চলেন, তার একটু একটু পরিস্ফুটন নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দেখতে পারলে যে তৃপ্তি আসে, তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট করে তুলছে শরীরী বিহঙ্গ। পুরুলিয়ার অন্ধকার তাকে যেন আরো খানিকটা মায়াময় করে তুলেছে। সেদিন সকালেই উৎপলদা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে রক্তিম তার লেখায় 'সাত্ত্বিক পরিবেশ' কথাটা লিখতে চাইছে, এই দুটো শব্দ কি পাশাপাশি বসতে পারে? আমি বলেছিলাম যেকোনো শব্দ যেকোনো শব্দের পাশেই বসতে পারে এবং সেটা পারলেই শব্দের নতুন নতুন অর্থ প্রকাশিত হয়। এখন আমি ভেবে দেখলাম যে, সত্যিই রক্তিম অজান্তে ঠিকই ভেবেছিল, এই পরিবেশকে 'সাত্ত্বিক' ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই সরলতা সকালের মতোই স্নিগ্ধ, বিদায়ের মতোই রিক্ত। বারী সিদ্দিকী সাহেবের 'ও রজনী, হ‌ইসনা অবসান / আজ নিশিতে আসতে পারে আমার / বন্ধু কালাচাঁন।' গানটির মতোই স্বপ্নালু ---- ভোর ভোর। অথচ আগামীকালই আমাদের ফিরে যাওয়া, খুব সকাল সকাল গোছগাছ করে বেরোতে হবে; সারাদিনের জার্নি সেরে রাতের বেলা যে যার বাড়িতে। সারাদিন হয়তো তীব্র রোদ, তীব্র গরম আমাদের সহ্য করতে হবে, কিন্তু পুরুলিয়া থেকে মনের মধ্যে যে শীতলতা নিয়ে যাচ্ছি, তা বেশ কিছুদিনের রসদ হয়ে রইবে। গতকাল অনেক রাত অব্দি আমরা রিসর্টের ঘাসের উঠোনে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি, বাঁশের চেয়ারগুলোতে বসে বসে থেকেছি, যেন রাত শেষ হবার নয়, অনন্ত পথ ওই রাতের সঙ্গে আমাদের পাড়ি। ফলে সকালে উঠে সম্পূর্ণ তৈরি হতে প্রায় ন'টা বেজে গেলো আমাদের। প্রস্থানের সময় সদাহাস্য গোপাল সিং মুড়া, সারা গায়ে মহুয়ার গন্ধ, মাথায় বাঁধা গামছা, আমাদের গাইড এসে উপস্থিত। তার সরল কথাবার্তায় তিনি আবার আমাদের আসার আমন্ত্রণ জানালেন, ফোন নাম্বার দিলেন, বললেন আবার আসতে হবে, এই রাঢ় বাংলায় তিনি যে শিশুদের দেখাশোনা করেন, গ্রামের যেসব স্কুলে বাচ্চারা পড়াশোনা করে, সেসব জায়গায় যেতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষার, যে শিক্ষা আমরা আমাদের শিক্ষকের থেকে পেয়েছি, সেই চিরন্তন শিক্ষার পাঠ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের ------কেননা স্বপ্ন এভাবেই প্রবাহিত হয়, নদীর জলের মতো তা হয়তো নিরবচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু কে না জানে স্বপ্নের পথ অনিঃশেষ হয়, তাই এগিয়ে চললাম, চরৈবেতি...

 

'যেন এই হয় এই ঘন্টার ধ্বনি যায় আমাদের পৃথিবীর পরে, 

যেন শোনে যারা আছে অন্ধকার নাগরিক লোহার পাহাড় তার পারে, 

যেন শ্রুতি শুদ্ধ হয় আর ইন্দ্রিয় সব যেন সংমিশ্রিত হয় পরস্পরে;

সকল ইন্দ্রিয় যেন শেষে প্রজ্ঞাপারমিতা বুঝে নিতে পারে।'                 --------- (একটি জেন প্রার্থনা)

 

 

  

 


 সৌরভ  বর্ধন

 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. সৌরভ! কি।যে বলি ভাই! এতো ভালো একটি লেখা।পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে যেন সব ভেসে উঠছিল।আমিও তোদের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. সৌরভ অপূর্ব লাগলো লেখাটা পড়ে। মনে হল যেন ভ্রমণের চিহ্ন আমার বুকেও গেঁথে বসলো। অনেক সুন্দর সুন্দর উদ্ধৃতি দিয়েছ। অনেক প্রসঙ্গ এনেছ। লেখার সাবলীল ছন্দময়তা রেশ রেখে গেল। 🌹🌹🌹🌹
    শতাব্দী চক্রবর্তী

    উত্তরমুছুন
  3. মন্তব্য লিখতে গিয়ে, উধাও হয়ে গেল।
    পুনশ্চ লিখছি, এক কথায় অসাধারণ বললে কিছুই বলা হয়। নিসর্গ প্রকৃতি পাঠে, নিবিড় আপ্লুত হয়ে আপনার এই ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে যে কবিমনের একাগ্র নিবিষ্ট উপলব্ধির কথা প্রকাশ পেয়েছে তা, বিভূতিভূষণ সহ সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য বাংলাসাহিত্যের নির্যাস ধরা পড়েছে; আপনি শুধুমাত্র এই কারণেই একজন প্রিয় গদ্যকার, যা আপনাকে কথাসাহিত্যের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। আমার খুব ভাল লাগলো; আপনাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন এবং ভালবাসা জানাই।



    উত্তরমুছুন
  4. তোমার সাত্ত্বিক নিসর্গ প্রকৃতি আশ্চর্য ছবির মত ধরা দিল। খুব উপভোগ করলাম। ঋদ্ধ, সাবলীল লিখনভঙ্গিমা, চমৎকৃত করল, সৌরভ।

    উত্তরমুছুন
  5. ভাই সৌরভ, তোমার অনন্য শব্দশাখা ধ'রে ধ'রে আমি পৌঁছলাম পুরুলিয়ার পিটিডিরি গ্রামে। সমনামের ঝরনাটির কোলে যে খেলাদুপুর কেটেছিল হেলাফেলায়, তার গান শুনতে পেলাম আবার। এই অবাক লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠল ছিয়ানব্বই স্বর। ধূসর থেকে ধূসরতর, অন্ত-অনন্তে অন্তর্লীন হয়েছিল যে সব বসন্তবাক, কথা বলে উঠল তা, কোলাহলসম্ভব হলো তোমার সত্যে, তোমার সখ্যে। 'জীবন এতো ছোট কেনে', ভাবি তাই। ভাবি, কেন ফিরে যাওয়া হয়না, ছেড়ে যা এসেছি, তার কাছে। নিজেকেই বলি, কেউ তো যায় তবু - অন্য কোনো নামে। পুরুল্যা-সৌরভ মাখে অকাতরে...

    প্রীতি নিও। শুভেচ্ছা নিও। নিও
    আর যা কিছু, তার সবটুকু -- গদ্যপদ্যে এমন রং যেন বারেবার মর্মে এসে লাগে। 🌿

    উত্তরমুছুন