বাড়ির কাছেই আরশিনগর
‘আমার আদি ও অকৃত্রিম শ্ত্রু এই
সময়। চরিত্রবান থাকতে দেয় না, চরিত্রহীন হতে দেয় না, ছুঁতে পারি না, অথচ প্রতি মুহূর্তে নানা ছদ্মবেশে
দেখি’
দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘নাটকের বই করতে হিম্মত লাগে
নাট্যকারের আর পাবলিশার্সেরও’। গোড়াতেই বলেছেন বিভাস চক্রবর্তী। তারপর বলেছেন শহরটা কিন্তু বেশ।
কেমন সে শহর? মানে আয়না শহর?
আমরা সবাই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখি।
যা আসলে কয়েক সেকেন্ড পুরনো। মুখের
অতীত। আয়নায় আমরা কখনই বর্তমান মুখটা দেখতে পাই না। যে ছবিটা আমরা দেখি, তা কয়েক সেকেন্ড পুরনো। আমরা তবে
কবে বর্তমান মুখ দেখব? কবে দেখব মুখের ভবিষ্যত? আমরা দেখার আগেই সে আয়নায় অন্যদের মুখের ছায়া পড়ে। কখনো পুরনো প্রেমিক,
কখনো দুঃস্থ আত্মীয়, কখনো ভুলতে চাওয়া
ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায় ছায়া ফেলে আমাদের আয়নায়। আবার কখনো ভাল করে ধরার আগেই
হাত ফসকে পড়ে টুকরো
টুকরো হয়ে যায় আয়না। আর প্রতিটি টুকরতে প্রতিফলিত হয় আমাদের হাজার হাজার মুখ।
আমাদের বহুবাসনা।
হাজার খাভিশে আয়সী কে হর খবাহিশ পে দম
নিকলে
বহোত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফির ভি কম
নিকলে।
(সহস্র আকাঙ্ক্ষা এমন, যে প্রতি বাসনায় কণ্ঠাগত পরান
প্রকাশ হলও বহু ইচ্ছে আমার, তবুও হল না বাসনার অবসান)
এই যে বহু বাসনা - এই হচ্ছে আধুনিক
মানুষের লক্ষণ। রাবণের দশমুণ্ডে যে জগত গ্রাস করতে চায়। ‘এ দিল মাঙ্গে মোর’।
এই বহু বাসনায় বিকীর্ণ এই সময়ের এই শহরের কথাই
বারবার আসে এই নাটকের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। এমনকি টাইম ইনভারশনের মতো জটিল বিষয়
উঁকি মেরে যায়। মনস্তত্ত্বের মোড়কে মনের অতি গভীর নির্জন পথ, যেমন আয়নায় পড়া প্রতিবিম্বের
পেছনে থাকে, সেই পথে এক অন্তহীন জার্নির কথা থাকে। যে পথ
আমাদের প্রশ্ন করে, হে দর্শক, আপনার কি কখনই প্রতিবিম্ব নয় , প্রকৃত মুখটা দেখতে ইচ্ছে হয়নি?
ছুটন্ত এক শহর। সেখানে এক মুহূর্ত কারও
দাঁড়াবার সময় নেই। কুন্দেরা বলেছিলেন গতির সঙ্গে বিস্মরণের নিবিড় সম্বন্ধের কথা।
এই শহর এত ব্যস্ত যে কারও নিজের মুখের দিকে তাকানোর সময় নেই। তাই অন্যদিকে বেড়ে
ওঠে ক্লান্তি, বেড়ে ওঠে
স্ট্রেস, বেড়ে ওঠে অবসাদ। সুরাহা হয়তো আছে
মনোবিদের চেম্বারে। সে এক অদ্ভুত চেম্বার। অ্যাসিস্টেন্ট ভজহরি সারাক্ষণ মোবাইলের
টাওয়ার খুঁজে যায়, আর নালা পরিস্কারের মিস্ত্রির খোঁজ করে।
প্রতিটা রোগী গিয়ে তাদের এত ক্লেদ সেখানে ফেলে , তাই কি ঘন
ঘন আটকে যায় নালা? সেখানে বসে
থাকেন এক নাট্যকার যিনি রোগীদের সঙ্গে কথা বলে নোটস তৈরি করেন। তিনি এখানে এসেছেন
তাঁর লেখার উপাদান খুঁজতে।
‘নাটকে তো চরিত্র লাগে নাকি! নাটুকে
চরিত্র। তা ঘরে বসে থাকলে কি চরিত্র মিলবে? একটু এদিক সেদিক…
একটু সমাজ, রাজনীতি একটু ঘোরা একটু আড্ডা…। একটু
জুতসই চরিত্র খোঁজ… । তা
এইভাবে আমি চরিত্র খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এই ক্লিনিকে…’
সব কিছুতেই তিনি ম্যাজিক দেখতে পান। ফুলের ফুটে
ওঠা, গর্ভে শিশুর
বেড়ে ওঠা, এমনকি খিদে পাওয়া, খিদে মিটে
যাওয়া- যেসব জিনিস আমরা খেয়ালই করি না, তার পেছনে ম্যজিক দেখতে পান লেখক
অত্নু। ক্লিনিকের বাইরের ঘরেও একটা ম্যাজিসিয়ানের ছবি ঝুলছে। অর্থাৎ নাট্যকার
প্রপসের মাধ্যমেও একটা ইঙ্গিত, একটা পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা
করেছেন প্রথম থেকেই।
কেউ চরিত্র খুঁজছেন, কেউ চরিত্র হয়েই এখানে ঢুকে পড়েছেন। আর
পুরো সেটিংটাই নাট্যকার রেখেছেন হেটেরোটোপিয়ারর ধরনে। লাইব্রেরি, মিউজিয়াম বা কবরখানার মতো মানসিক চিকিৎসালয় একটি স্থায়ী হেটেরোটোপিয়া।
There are also, probably in
every culture, in every civilization, real places — places that do exist and
that are formed in the very founding of society — which are something like
counter-sites, a kind of effectively enacted utopia in which the real sites,
all the other real sites that can be found within the culture, are
simultaneously represented, contested, and inverted. Places of this kind are
outside of all places, even though it may be possible to indicate their
location in reality. Because these places are absolutely different from all the
sites that they reflect and speak about, I shall call them, by way of contrast to utopias,
heterotopias. I believe that between utopias and these quite other sites, these
heterotopias, there might be a sort of mixed, joint experience, which would be
the mirror. The mirror is, after all, a utopia, since it is a placeless place.
In the mirror, I see myself there where I am not, in an unreal, virtual space
that opens up behind the surface; I am over there, there where I am not, a sort
of shadow that gives my own visibility to myself, that enables me to see myself
there where I am absent: such is the utopia of the mirror. But it is also a
heterotopia in so far as the mirror does exist in reality, where it exerts a
sort of counteraction on the position that I occupy. From the standpoint of the
mirror I discover my absence from the place where I am since I see myself over
there. Starting from this gaze that is, as it were, directed toward me, from
the ground of this virtual space that is on the other side of the glass, I come
back toward myself; I begin again to direct my eyes toward myself and to
reconstitute myself there where I am. The mirror functions as a heterotopia in
this respect: it makes this place that I occupy at the moment when I look at
myself in the glass at once absolutely real, connected with all the space that
surrounds it, and absolutely unreal, since in order to be perceived it has to
pass through this virtual point which is over there.
(মিশেল ফুকো)
এই যে আয়না শহর নাট্যকার তৈরি করেছেন তা
একসঙ্গে ইউটোপিয়া আবার হেটেরোটপিয়া। এখানে বিভিন্ন রোগী তার নিজের সমস্যা নিয়ে আসে। অরণ্য দেখে সে যখনি এটিএমে
টাকা তোলে, একটা লোক তাকে
লক্ষ্য করে কাচের ওপার থেকে। বুদ্ধদেবের সমস্যা সবাই তার জীবন
ছারখার করে দিলেও সে কাউকে মনের সুখে খিস্তি দিতে পারল না।
এইসব চরিত্র ঢুকে পড়ে আয়না শহরে, র্যাদার তাদের ঠেলে দেওয়া হয়। এটাই থেরাপি।
সেখানেই তারা নিজেদের সামনে দাঁড়ায়। নিজেদের খোঁজে, খুঁজে
পায় কিনা সে পরের প্রশ্ন।
সৌমজিৎ একাধারে কবি, কথাকার এবং নাট্যকার। তার ছোটদের নাটক
পড়ার সুযোগ হয়েছে। খুব ছোট ছোট নাটকে সে নাট্যমুহূর্ত গড়ে তুলতে যে কতটা সক্ষম তার
প্রমাণ রয়েছে স্বল্পায়তন সেই বইটিতে। ‘রাস্তা হারিয়ে’
নামের একটি নাটকে এই শহরের একটি কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অন্য
গ্রহ থেকে আসা বহুভাষী শ্রীপুর। সেই শ্রীপু খায় আর কিছু না, রঙ
আর কোলাহল। দেওয়ালে দেওয়ালে এত রাজনৈতিক দলের দেওয়াল লিখন, তা
খেয়েই তার পেট ভরে যায়। আর কলকাতার রাস্তার কান ফাটানো হর্নের আওয়াজ তো আছেই। শেষে
চলে আসে হুজাগিজ নামে একটা ঘোড়া। ছোটদের নাটক হলেও রাজনৈতিক উপাদান আর ফ্যান্টাসির চমৎকার ব্যবহার
।
আয়না শহর সম্ভবত আরও আগে লেখা। এর
স্তরবিন্যাস জটিল। নাট্যময়তা আছে, যা না থাকলে টেক্সটি মাঠে মারা যেত। তাই অভিনীত হতে পারে কোন দলের আগ্রহে। তবে তৃতীয় পেশেন্ট, যিনি মহিলা, কেবল ‘শুয়োরের মতো মুখ করে’ সেলফি তোলা ছাড়া আর কিছু জানা
গেল না তাঁর সম্বন্ধে। তাঁকে নিয়ে একটি অংক থাকলে নাটকটি সম্পূর্ণতা পেত।
শেষে বলি, বাংলায় মৌলিক নাটক নেই বলে হাহাকার শুনি। এমন একটি
বহুস্তরীয় ও উপভোগ্য নাটক লিখেছেন এক তরুণ কবি, তার প্রকাশক সেই নাটকের
সত্যনাশ করে ছেড়েছেন। প্রতিটি শব্দে ভুল। পড়তে প্রভূত কল্পনাশক্তির দরকার হচ্ছিল। নাট্যকার যদি তাঁর নাট্য জীবনের
যবনিকা পতন না চান, তবে শীগগিরই সুসম্পাদিত পুনর্মুদ্রণের
কথা ভাবুন।
আয়না শহর
- সৌম্যজিৎ আচার্য
- তরঙ্গ পাবলিশা র্স
- প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৯
- মূল্য ১১০ টাকা
1 মন্তব্যসমূহ
দুর্দান্ত। দুজনের জন্যই অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা রইল।
উত্তরমুছুন