অমিত সরকার : গল্প: একটি গল্প এবং

 


একটি গল্প এবং   

 

  ‘অভিনন্দন’, আবছা ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা তুলতেই প্রথমেই স্ক্রিনের ওপরে অনেকগুলো নোটিফিকেশন চোখে পড়ল মাটির। কোনরকমে কানে রিসিভারটা চেপে ধরতে ধরতে সে আড়চোখে স্ক্রিনেই একবার সময়টা দেখে নিল । মোটে সকাল সাড়ে আটটা। আজ শনিবার, স্কুল নেই। এত সকালে, কে তাকে ফোন করতে যাবে ? তার পরিচিতরা সবাইই তো তার  মত রাতচরা পার্টি, দুটো তিনটের আগে কেউ বিছানায় যায় না। একটা উচ্ছ্বসিত স্বর লাফিয়ে এল কাচের উলটোদিক থেকে।    ‘অভিনন্দন, উঠেছিস।’ ‘ও তুই। তা হঠাৎ অভিনন্দনটা কিসের, সেটাই তো এখনো অবধি বুঝলাম না ?’ ‘এই একটু আগেই   হাতে গল্পসম্মেলন পত্রিকাটা পেলাম । তোর সেই গল্পটা বেরিয়েছে। পড়েও ফেলেছি। হেব্বি হয়েছে।’ ‘ও তাইই, কোন  লেখাটা বলতো ?’ ‘ন্যাকামি করিস না তো । নিজেই তো পাঠিয়েছিলি, নাকি ? তোর সেই ‘একটি গল্প এবং’ যেটা  সেই  শমীকদার বাড়ির সাহিত্য আড্ডায় শুনিয়েছিলি । অনেকদিন আগে অবশ্য। তবে সেবার শুনে কিন্তু অতটা ইমপ্যাক্ট করেনি, প্রায় ভুলেই গেছিলাম । কিন্তু আজ সকালে পড়ে বেশ  অন্যরকম লাগল । একদম দমদার হয়েছে, তোর অ্যাভারেজ   লেখার চাইতে অনেক বেশি জোরালো।  যাই বলো বস, এখনো কিন্তু আমবাঙালি  সাহিত্যের কাগজ বলতে ‘গল্পসম্মেলন’কেই  বোঝে । ওখানে  একটা গল্প বেরোনো মানে একলাফে পঞ্চাশ হাজার পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া, আর কী চাই ?’ ‘ও, ওইটা,  বেরিয়েছে এই সংখ্যায় ? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরা সিলেক্ট করেছে বলে  মেলও করেছিল বোধহয়। ভুলেই গেছিলাম। আসলে এরা লেখা  সিলেকশনের পর ছাপতে এত দেরি করে। অবশ্য প্রতি মাসেই প্রচুর লেখা জমা পড়ে শুনেছি। যাকগে, পড়েছিস বলে ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ তোর জলদি প্রতিক্রিয়ার জন্যে। সন্ধ্যেবেলা পারলে যাদবপুর কফিহাউসে চলে আয়। এত ভালো একটা খবর দিলি, কফি খাইয়ে  দেব।’ ‘দেখি, ঠিক বলতে পারছি না। আজ ছেলে ঠ্যাঙানো আছে। টেক্সট করে দেব। এনিওয়ে এখন  রাখছি রে, আমাকে আবার অফিস যেতে হবে । তুই চটপট খবরটা দিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট মেরে দে, কটা লাইক, কী  কী  কমেন্ট, সব আমায় জানাস কিন্তু।’ সায়ন ফোনটা কেটে দেবার পরেও ভালো লাগার রেশটা থেকে গেল। প্রত্যেকটা  সকালই তো আর এত সুন্দরভাবে শুরু হয় না । আর সে বা তার মত লেখকেরা যারা ‘আমন্ত্রিত’  ক্যাটাগেরির নয়, তারা এইসব বড়ো  কাগজে তিন মাস অন্তর লেখা পাঠিয়েই যায়, পাঠিয়েই যায়। যতদিন না অন্তত একবার  শিকে ছেঁড়ে। ‘গল্পসম্মেলন’ অবশ্য  মেল করে জানায় লেখা নির্বাচিত হয়েছে কিনা, একটা মোটামুটি ভদ্রগোছের সাম্মানিকও দেয়। এবারও নিশ্চয় মেল করেছিল । সে আজকাল আর অত মেল টেল খুলে দেখে না। তার ধৈর্য বেশ একটু কম। শুধু  লেখাটুকুকেই সে এখন নিজের কাজ  বলে ভাবে । তার পরে টাইপ, মেল, পাঠানো ইত্যাদি ঝক্কি তার আর একদম  ভালো লাগে না। খুব একটা পারেও না ঠিক করে। প্রায়ই এর কাছে হোয়াটসঅ্যাপ করলে ওর কাছে  চলে যায় । কয়েকবার এর জন্যে, সে বেশ জটিলতাতেও পড়েছে। যতদিন অরণ্য তার জীবনে ছিল, ততদিন তাকে এসব  নিয়ে ভাবতে হয়নি একমুহূর্তও। অরণ্য টেকস্যাভি মানুষ । তারপর নিজে খুব একটা  না লিখলেও কিন্তু তার লেখার গুরুত্বটা বুঝত দারুণভাবে। বানান ও বাক্য সংশোধন থেকে শুরু করে, লেখা পাঠানো এবং হিসেব রাখা, সবদিকটা সে একাই সামলে দিত। আচ্ছা অরণ্য এখন কার লেখার হিসেব রাখে ? কাউকে কি  জুটিয়েছে আবার ? অবশ্য জোটাও শক্ত, যা খ্যাঁচামার্কা লোক ? কেউ জুটলে অবশ্য  এদিক ওদিক থেকে কথাটা ঠিক কানে আসতো মাটির। কথাটা মনে আসতেই মাটি নিজেকে জোর করে সরিয়ে আনল ভাবনাটা  থেকে । যে গেছে, সে গেছে। তার অত কিসের ভাবার দরকার ? আচ্ছা, ঠিক এরকম একটা কবিতা জয়ের আছে না ?     

নিজেকে ভালো রাখার কিছু নিজস্ব টেকনিক আছে মাটির। কোন অপছন্দের চিন্তা তার মাথায় চেপে বসলেই সে নিজেকে  দিব্যি সুইচ অফ করে দিতে পারে । সে আবার সায়নের কথাটায় ফিরে গেল । সায়ন ছেলেটা ভালো, তার লেখাটেখা চোখে পড়লে ঠিক ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানায়। কথাটা ঠিকই বলেছে, এখানে প্রকাশিত লেখাটা তাকে একটা বিশাল মাইলেজ দেবে। অনেকদিন এ লাইনে খেলছে তো, ভালো গল্পের জাত ঠিক চিনতে পারে । ভাবলো  মাটি । মুখে যতই  কমার্শিয়াল কাগজ,  প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এইসব ভাট বকুক, মনে মনে ঠিকই  জানে দশটা লিটিল ম্যগাজিনে গল্প বেরিয়ে যা হয় না, একটা লেখা গল্পসম্মেলনে বেরোলে তার থেকে ঢের বেশী পরিচিতি বাড়ে। আর যে কোন লেখকেরই মূল কাম্য তো বেশি করে পাঠকের কাছে পৌঁছানো। এই মুহূর্তেই পত্রিকাটা দেখতে ইচ্ছে করছে মাটির। ওরা অবশ্য কুরিয়ার করে লেখক কপি পাঠায়। তবে পেতে আরও দিন দুই তিন তো লাগবেই । যাকগে  বন্ধুবান্ধব কারোর কাছ থেকে চেয়ে দেখে নেবে একবার।  তবে টাকাটা পেতে পেতে এখনো দিন পনেরো । মাটি চেক করে দেখলো ওর ইনবক্স এখন অভিনন্দনের জোয়ারে  ভেসে যাচ্ছে । 

 

 ‘শোন, এই সংখ্যার গল্পসম্মেলনে মাটির একটা গল্প বেরিয়েছে, দেখেছিস ?’ ‘দেখব না কেন ? তোর কী ধারণা,  গল্পসম্মেলন আমাকে শুধু আমার দাড়িওয়ালা মুখটা দেখাবার জন্যে সিলেকশন বোর্ডে রেখেছে ?’ ‘না, না তা বলছি না। তোদের তো অনেক সিলেক্টার। তোর চোখ তো এড়িয়ে যেতেও পারে।’ ‘তুই তো পুরো প্রসেসটাই জানিস সুমন্ত । প্রাইমারি সিলেকশনের পরে সব  লেখাই আমাদের তিনজনের কাছে ফাইনাল সিলেকশনের জন্যে আসে। ন্যাচারালি, আমি জানব ।  যাই হোক শুধু এইজন্যেই কী ফোন করেছিস ?’ ‘না, না । তা নয়। তবে যাই বল। মাটি মেয়েটা কিন্তু সৎ এবং বহুত দম আছে । গল্পটা পড়ে বুঝলাম, তোদের দুজনের সম্পর্কটার  ব্যাপারে। তবে ও কিন্তু একদম সত্যিকথাটাই লিখেছে । যারা তোদের কেসটা জানে, ক্যারেকটার  দুটোর আড়ালে ঘটনাটা ঠিকই চিনে নিতে পারবে । আর এই এক্সপোজারটা তোর জন্যে দরকার  ছিলও। বেশ কিছু লোক তো এখনো তোকেই আসল দোষী ভাবে।’ ‘যার যা  ইচ্ছে ভাবুক। এখন রাখছি রে  সুমন্ত, আর একটা কল  এসেছে । পরে আবার কথা বলব। টেবিলে গাদা কাজ।’ অরণ্য গম্ভীর মুখে ফোনটা নামিয়ে রাখে । সে ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারেই খুল্লম  খুল্লা কথা বলা একদম  পছন্দ করে না । আর নিজের ব্যাপারে তো নয়ই । যদিও মাটির এই গল্পটা নিশ্চিত তার  জীবনেও একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে রইলো । যদিও ইদানীং সে নিজেকে আর লেখক বলে মনে করে না, কিন্তু  অনেকেই তার  তিনফর্মার  ছোটগল্পের চটি বইটার কথা এখনো মনে রেখে দিয়েছে । তবে সে বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত সিরিয়াস পাঠক । আর সেইজন্যেই গল্পসম্মেলন কতৃপক্ষ  তাকে এত টাকা মাইনে দিয়ে সম্পাদকীয়  বোর্ডে রেখেছেন। আর এই গল্পটা সিলেকশনের জন্যে প্রথমেই তার কাছে এসেছিল। সেই কারণে তার মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তো ছিলই । আর, আর, আর অন্য একটা ব্যাপার তো আছেই। আসলে প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব গল্প আছে। গল্পের ইন্টারপ্রিটেশন আছে। সে সবসময় তার নিজের গল্পটা অন্যের মুখ থেকে কিন্তু নিজের পছন্দের   ইন্টারপ্রিটেশনেই শুনতে পছন্দ করে। সেও  বোধহয় এর ব্যতিক্রম নয়।        

কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তখন মাটি ইতিউতি তাকাচ্ছিল চারপাশে। একবার ওর খেয়াল পড়ল,   গল্পসম্মেলনের একটা কপি পাতিরাম থেকে কিনে নেবে, কিন্তু সেই মুহূর্তে রক্তিম, প্রজেশদা ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল । ব্যাপারটা আবার মাথায় ফিরে এলো ট্রামে উঠে । ততক্ষণে পত্রিকা  কেনার  সম্ভাবনাটা একদম শূন্যে এসে ঠেকেছে। বাড়িতে ফিরে এসে একগাদা কাজের ভিড়ে মাটিরও আর ব্যাপারটা মনে পড়েনি । কথাটা আবার মনে এল রাতে যখন  জল ফোন করেছে । জল আর মাটির বয়েসের তফাৎ বছর দু’য়েকের হলেও ওরা  দুই বোনে একদম গলায় গলায়। মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়া হলেও, পরস্পরের প্রতিটা কথা শেয়ার না করলে রাতে এখনো ওদের ঘুম  হয় না । কোনও ভূমিকা না করেই আজ জল শুরু করলো, ‘গল্পসম্মেলনে আজ তোর যে  গল্পটা বেরিয়েছে, ওটা পড়লাম । তুই যে তোদের নিজেদের ব্যাপারটা নিয়ে গল্প লিখেছিস আমায়  বলিসনি তো ?’ মাটি হাসলো, জলের সবটাই ভালো । তবে  বাংলায় এমএ করলেও সাহিত্যের ব্যাপারে আসলে ওর খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই। কিন্তু পড়ে । মাটির  লেখা কোন গল্প বা উপন্যাস বড় কাগজে বেরোলে অবশ্যই পড়ে। ‘ওই লিখলাম । তুই পড়লি লেখাটা ? কেমন হয়েছে ?’ ‘হয়েছে ভালই, তবে ওই লিখলাম মানে ? তুই এত কিছু  লিখলি, তোদের  ব্যাপারটা লিখলি, আমার কথাও লিখলি, আর আমাকে একবার   জানালি না ? ভাগ্যিস ওর গল্প উপন্যাস পড়ার ইন্টারেস্ট নেই। নইলে কী হতে পারতো বলতো ?’ মাটির একটু খটকা  লাগল। ‘কেন  বলতো ? আর আমি তো এমন  কিছু লিখিনি যাতে তোর প্রেস্টিজ যেতে পারে।’ ‘কিসে কার প্রেস্টিজ যায়, সেটা যদি তুই বুঝতিস মাটি, তাহলে তো আজ অরণ্যদার সাঙ্গে তোর ডিভোর্সটাই হত না। আফটার অল, অরণ্যদাকে তুই  কিন্তু খারাপ লোক বলতে পারবি না।’ ‘জল, তোকে তো আগেও বলেছি, যে যার সাথে বেডরুম শেয়ার করে, সেই তাকে একমাত্র ঠিকঠাক চেনে । আর তুই হঠাৎ এতদিন পরে ফের অরণ্যর জন্যে ওকালতি করছিস কেন বলতো ?’ ‘এটা ওকালতি নয় মাটি । এটা তো ঘটনা,  তুই তখন বড় কাগজে লেখা বেরনোর জন্যে প্রজেশদার সঙ্গে সাঁতার কাটছিস । আর অরণ্যদার তখন চাকরি নেই। কী সামান্য একটা প্রুফ রিডিঙের কাজ করে, আর ওই কটা পয়সার জন্যে অনুবাদ । মানুষটা দিনের পর দিন গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যেয় বাড়িতে ফিরে একা একা চা নিয়ে বসে  থাকত । আর তুই তখন রোজই হয়  কফিহাউস,  নয় নন্দন, নয় কোথাও তোর কবিতাপাঠ । যাই  বলিস । অরণ্যদার সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল কিন্তু তোর সাহচর্য । যেটা তুই কিন্তু একদম দিতে পারিস নি । অত পণ্ডিত লোকটা শেষে  পয়সার জন্যে অন্যের হয়ে  নোটবই পর্যন্ত  লিখেছে । তুই একবারও তখন ফিরে তাকাসনি।’ ‘হ্যাঁ, জানি তো । আমার লেখালিখির কেরিয়ারটা তো  কেরিয়ার নয় । শুধু তোর অরণ্যদারটাই কেরিয়ার । আর তুই সেই অরণ্যদার জন্য দুঃখে বিগলিত হয়ে তার কোলেই  একদিন শুয়ে  পড়লি । অপূর্ব । তুইতো ওই লোকটার  ওকালতি করবিই । তুই যে কতটা নোংরা, আর তোর মনে যে এখনো ওর জন্যে দুর্বলতা আছে, সেটা  আমি বেশ ভালোই জানি ।’ ‘আছেই তো । সবাই তো আর তোর মতো স্বার্থপর নয়, যে  লেখা ছাপানোর জন্যে সম্পাদকদের গায়ে ঢলে ঢলে পড়বে, এর তার সঙ্গে সাহিত্য সভার নামে হলদিয়া, আসানসোল  চলে  যাবে।  জেনে  রাখ সবাই কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে লোকে কার সঙ্গে কী জন্যে  মেশে ? আসলে অরণ্যদাকে তোর আর  তখন ভালো লাগছিল না, বেকার একটা বোঝা মনে হচ্ছিল। আর তোকে আগেও বলেছি, সেদিন আমার প্রচণ্ড মাথা  ধরেছিল বলেই ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম,  অরণ্যদা আমার মাথাটা টিপে দিচ্ছিল শুধু। তুই ঘরে ঢুকেই যে এই সামান্য  ব্যাপারটা  নিয়ে এত সিন ক্রিয়েট করবি, জানলে আমি মাথা রাখতাম না।’ ‘ছাড়, ছাড়। কথা বাড়াস না। তুই অরণ্যকে সিগারেটের  জন্যে, মদের জন্যে নিয়মিত টাকা দিতিস না। সেটাও তো তোর নিজের রোজগারের টাকা নয়, বরের টাকা। প্রতি সন্ধ্যেবেলা তোর এত কিসের দরকার থাকত এ  বাড়িতে আসার ? আমাকে আর মুখ খোলাস না। অনেক কিছুর কঙ্কাল  বেরিয়ে  পড়বে।’ কথা না বাড়িয়ে  দুম করে ফোনটা  কেটে দেয় জল। মাটির মাথাটা ঝাঁঝাঁ করছে । অনেকদিন বাদে কেউ আবার ওকে এই  প্রসঙ্গটা তুলে সরাসরি দোষারোপ করল। শিক্ষিত, রুচিশীল পরিবারের সন্তান হওয়ার একটা বিরাট সুবিধে হচ্ছে, সম্পর্কের অনেক কিছু কার্পেটের তলায় বেমালুম লুকিয়ে রাখা যায়। প্রথমত ব্যক্তিগত  ব্যাপারে চট করে তাদের বাড়ির কেউ ইন্টারফেয়ার করে না, দ্বিতীয়ত তাদের ঝামেলাটা স্বাভাবিক কারণেই বাবা মা  দুজনেই অনেকদিন না দেখার ভান করে ছিল । মা অবশ্য তার আড়ালে জলকে কিছু বলেছিল কিনা সে ঠিক জানে না । তবে তাদের দুই বোনে কথা বন্ধ  ছিল প্রায় দুবছর । মায়ের মৃত্যুর পর ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়েছিল।  কিন্তু দেখা যাচ্ছে জলের মনে সেই দাগটা এখনো লেগে আছে। পুরোপুরি মোছে নি। এখন অবশ্য  মাটি নিজের কাছে স্বীকার করে সেইসময় তার অতটা ওড়া ঠিক হয়নি ।  

আসলে সে ঠিক বুঝতে পারে নি, বাংলাবাজারে মাঝে মাঝে এরকম এক একটা ঢেউ আসে, তারপর আবার দাগ না রেখেই মিলিয়ে যায়। সেই সময়টায় যে কোন লিটিল ম্যাগ খুললেই মাটি রায় । যে কোন পুরষ্কারের তালিকায় তার নাম তখন এক নম্বরে। যে কোন সাহিত্যসভায় তার অনিবার্য উপস্থিতি, আর তার সঙ্গে ছায়ার মত সর্বত্র প্রজেশ চৌধুরী। নিজের ঝকঝকে প্রেজেন্স আর মোটামুটি সুন্দর মুখটাকে মাটি তখন ভালোই ব্যবহার করেছে। ব্যবহার করেছে প্রজেশকেও।  আধবুড়ো লোকটা ওর মধ্যে যে কি পেয়েছিল ?  ওই একবার বোধহয় কোচবিহার লিটিল ম্যাগাজিন মেলা, আর একবার সম্ভবত মালদায়, এই তো মাত্র দুবার হয়েছিল । তা ছাড়া ওই গাড়িতে  যেতে যেতে ফাঁকায় কয়েকটা চুমু, একটু আধটু হাত  বোলানো। বদলে মাটির ড্রাইভারগিরি করতে করতেই লোকটার নিজের সাহিত্য কেরিয়ারটাই  ফ্ল্যাট হয়ে গেল। তবে   ওইগুলোতে তার কিছু আসে যায় না। এই তো সিঁদুরদি আছে বাবা । এখন যন্ত্রপাতি সর্বস্ব ঝুলে গেলে কি হবে, দিব্যি একেকটা বুড়ো ধরে ধরে এতদিন তো চালিয়ে দিচ্ছে । আর এই তিন বছরের মধ্যেই শালা দিতিপ্রিয়া সেন এসে তার মার্কেটটা দিব্যি ক্যাপচার করে নিল । লিখতে তো ঘন্টা পারে, শুধু মুখটুকুই সম্বল । ওই টেকো  অরূনেশ ব্যাক করে করেই   মালটাকে এতটা উঠিয়ে দিয়েছে । তবে এবার পড়বে নিশ্চিত। সামিটে অনন্তকাল কেউ থাকতে পারে না, নেমে আসতেই হয় । তবে অরণ্য কিন্তু মাটির এই খেলাটা ধরে  ফেলেছিল । মানুষটা শুধু তার চোখের দিকে তাকালেই ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু বরাবরের শীলিত মানুষ, তাই সরাসরি কিছু  বলতে পারে নি। মনে মনে নিজেই রক্তাক্ত,ক্ষতবিক্ষত   হত শুধু  । পরে মাটি সেটা বুঝতেও পারত। কিন্তু তখন তার আর কিছু করার ছিল না। উড়ানের জাঢ্য তাকে তখন ভাসিয়ে রেখেছে । চলন্ত প্লেন থেকে ইচ্ছে করলেই তো  নেমে আসা যায় না । আর অরণ্যর শুকনো পাণ্ডিত্যও তার আর ভালো লাগছিল  না । এমনিতেই নিজের সমালোচনা কারোরই ভালো লাগে না, তার তো নয়ই । তার ওপর সেই সময় অরণ্য কাঠবেকার। মাটির কাছে পুরুষের  সঙ্জ্ঞাটা একটু অন্যরকম। সে শিকার পছন্দ করে, পছন্দ করে মুগ্ধতা । আর যে কোনও শিকারীর কাছে ছুটন্ত তরুণ হরিণ, বেঁধে রাখা ছাগলের থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। যাকগে, যা হয়েছে, ভালোই  হয়েছে। একাই সে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ । মেয়েরা একা হয়ে গেলে, সাহায্য অনেকটা বন্যার মত জোর করে ভেসে আসে। তার এখন  স্কুলের চাকরিটা  আছে । আছে বাবা মায়ের দেওয়া ফ্ল্যাট । ওরকম  অনেক অরণ্যকেই আজ সে পুষতে পারে। মাঝে মাঝে অবশ্য তার  মনটা একটু খচখচ করে, ওই সময় অরণ্যকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে দেওয়াটা, হয়তো তার খুব একটা ঠিক হয় নি। শুনেছে   ওই  সময় অরণ্য নাকি বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে  থাকত, পেট চালাতো । জলও ব্যাপারটা একদম মেনে নিতে পারে নি । মাটির সন্দেহ হয়, জল পরেও ওকে নিয়মিত টাকা  দিয়ে সাহায্য করতো কিনা ? মরুকগে, ওর বরের বিজনেস, ওদের অনেক টাকা । যাকে খুশি দিকগে যাক। তার কি ছেঁড়া গেল ? তবে অরণ্য কিন্তু লড়াকু মানুষ । নিজের বিরাট পড়াশোনাটাতো আছে । ঘষতে ঘষতে এই কদিনের মধ্যেই  ঠিক বিগ হাউসে ঢুকে  গেছে । সেখানে  কী করে মাটি অবশ্য জানে না । তবে এদিক ওদিক থেকে শোনে, এখন নাকি এডিটোরিয়াল বোর্ডে উঠে গেছে । এই সময়, তার এই গল্পটা গল্পসম্মেলনের মত ইম্পরট্যান্ট কাগজে বেরনো খুব জরুরী  ছিল । সামনে একটা বড় পুরষ্কারের সিলেকশন আছে ।  বাংলাবাজারের লোকে ঠিকই বুঝবে,  এটা আসলে কার জীবনের গল্প ।  প্ল্যান  করেই এখানে  অরণ্যের ক্যারেক্টারটাকে একটা অত্যাচারী দানব বানিয়েছে সে । আর নিজেকে লেখালিখিতে নিবেদিতপ্রাণ একজন  গৃহবধূ । যার স্বামী বউয়ের লেখালিখি, কবিতাপাঠ এইসব অপছন্দ করে, হীনমন্যতায় ভোগে । অরণ্য  গল্পটা  পড়লে নিশ্চয় বলত, ‘সেকেন্ড সেক্সের  এই অত্যাচারিত ইমেজটার একটা সচেতন পলিটিক্স আছে’ । মাটিও জানে, কথাটা হাড়ে মজ্জায় ঠিক। তবে মাঝবয়সী  পাঠকেরা এখনো এটা বেশ ভালো খায় । আর  প্রজেশওতো এটাই খেয়েছে। শুধু খেয়েছে ? খেতে খেতে এখনো নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। লেখাটা পড়ে বেশ কিছু সমালোচকও নিশ্চয় তার প্রতি আবার সহানুভূতিশীল হবেই । মাটির ঠোঁটে গোধূলির মত  একটা আবছা হাসি ফুটে উঠল। বাঘিনী নিজেকে হরিণীর ক্যামোফ্লেজে এবার ভালোই সাজিয়েছে ।  

 

অরণ্য একা একটা ব্লেন্ডার্স নিয়ে অলি পাবে বসেছিল । সামনের গ্লাসে বরফের মত ভাবনারা গলে গলে যাচ্ছে । ও ব্যাগ খুলে নিউইয়র্ক টাইমসের চিঠির প্রিন্ট আউটটা সামনে নিয়ে আবার, আবার পড়ল, এবং রেখে দিল । ওরা ওকে তিন বছরের  জন্য একটা স্কলারশিপ দিতে চাইছে । সামনের মাসেই ওকে চলে যেতে হবে, এবং ও যাবেও । এটা যে কারুর জীবনেই একটা বিরাট সুযোগ । কিন্তু তবে আর এই প্রতিশোধ নিয়ে ওর কী লাভ হল ? এথিকস ভেঙে, সম্পাদক হিসেবে অরণ্য   নিজেকে কি নিজের কাছেই অনেকটা ছোট করে ফেলল না ? আসলে জীবনের চাকা কখনো স্ট্রেট লাইনে চলে না । নিয়তি নির্ধারিত বাঁকচুর, ভাঙাপথ, টায়ার পাংচার তার সঙ্গী।  চিঠিটা বারবার পড়তে পড়তে তিন বছর আগেকার দিনগুলোর কথা মনে আসছিল ওর । রোজকার প্রয়োজনীয় টাকা রোজগার করতে না পারার অপমান, মাটির সঙ্গে প্রজেশের তন্ময়  ঘনিষ্ঠতা,   অরণ্যর অস্তিত্বকেই পাত্তা না দেওয়া, তাকে ক্রমাগত গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল সেসময় । রাস্তার কুকুরের মত তার তখন শুধুমাত্র একটা থাকার জায়গা আর এক  প্লেট ভাতের জন্যে  মাটির ফ্ল্যাটে রোজ সন্ধ্যেয় ফিরে যাওয়ার লড়াই । এটাও ক্রমাগত মেনে নিচ্ছিল সে, বলা ভালো মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিল। সহানুভূতিহীন সেই দিনগুলোতে তাকে একমাত্র সান্নিধ্য দিত জল।   জলের ঠাণ্ডা হাতের আয়ুরেখায় অরণ্য খুঁজে পেত নিজস্ব অপমানিত পৌরুষের আশ্রয়, যেটা মাটি তাকে কোন দিন দিতে  পারে নি। তবুও এভাবেই সে চালিয়ে নিচ্ছিল নিজের লড়াই। এখানে ওখানে অ্যাপ্লিকেশন, নোটবই লেখা, এইসব টুকটাক  করে হয়তো একদিন দাঁড়িয়েও যেত অন্যভাবে।  কিন্তু সেদিন, জলের সামনে পুরোপুরি অকারণে তার নিজস্ব মেধার অপমান সে  আর সহ্য  করতে  পারে  নি। আজ সে বুঝতে পারে হয়তো সেদিন মাটির কাছে সে একদম অবান্তর ভাঙা খেলনা হয়ে  গিয়েছিল। আসলে মাটির নিজস্ব চারণভূমিতে মেধা, পাণ্ডিত্য এই শব্দগুলোর কোনও আলাদা গুরুত্ব ছিল না। পত্রিকার  পাতায় এইসব  শব্দ দিয়ে আজকাল আর লেখা ছাপানো যায় না, যায় না পুরষ্কারের তালিকাতে নাম ওঠানোও। মাটি বিশ্বাস  করতো,  তার  জন্যে লাগে সম্পাদকদের সঙ্গে অন্য সমীকরণ। প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেত সেটা তৈরি করার। অথচ অরণ্য আজও  বিশ্বাস করে শুধুমারত্র মেধা এবং পাণ্ডিত্যে, যেটা তার একান্ত নিজস্ব অর্জন । এটাকে  উত্তরাধিকার  সুত্রে তো আর ফ্ল্যাট   বা গাড়ির মত পাওয়া যায় না । তাই নিজের মেধার জন্যে তার স্বাভাবিক গর্ব আছে । প্রিন্ট  আউটটা  আবার স্পর্শ করে অরণ্য যেন খানিকটা আত্মরতির আদর উপভোগ করল । কিন্তু এই প্রতিশোধ নিয়ে শেষমেশ নিট ফলটা কী দাঁড়ালো ? দুটো ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ নিজস্ব উপবৃত্তাকার কক্ষপথে কখনো কাছাকাছি এসেছিল, কালের নিয়মে তারা আবার দূরে  সরে যাচ্ছে । হয়তো এ জীবনে তাদের কক্ষপথের আর কোন ছেদবিন্দু তৈরি হবে না। তবে ? কী লাভ হল এতে ? অশান্ত অরণ্য আর একটা লার্জ  পেগ অর্ডার করার জন্যে বেয়ারাকে হাত নেড়ে ডাকল ।  

গল্পসম্মেলনের কুরিয়ারটা আজকে এসেছে, টাকাটাও কাল অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে মনে হয় । মাটি ভাবল, আজ একটা    পারফেক্ট মি-টাইম । রাত্তিরে জমিয়ে নিজের লেখাটা পড়া যাবে। আজ নিজেকে একটু প্যাম্পার করা যাক। সুইগির নম্বর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠল ওর আঙুল। গল্পটা ওর জন্যে আজ বিছানায় অপেক্ষা করছে । সব লেখক বা কবি ছাপা ম্যাগাজিন  হাতে  পেলে প্রথমেই নিজের লেখাটায় একবার চোখ  বুলিয়ে  নেয় । প্রধানত বানান বা প্রিন্টিং ভুলের জন্যে, তারপর ছাপার অক্ষরে  নিজের সন্তানকে দেখার এক অদম্য মোহে। হাওয়ায় এখনো হালকা ঠাণ্ডার একটা অনুভূতি আছে । মাটি চাদরটা  গায়ের ওপর টেনে গল্পটা নিয়ে বসল । বাঃ, রোদ্দুর রায় ইলাস্ট্রেশনটা ভালো করেছে তো । গল্পটা পড়তে শুরু  করল মাটি । খানিকটা পড়তে পড়তেই চোখদুটো চমকে উঠল ওর। এটা কি পড়ছে সে ? গল্পটা সে কি এরকম লিখেছিল  নাকি ? অবশ্য প্রায় একবছর আগে লেখা । কিন্তু এইসব কথা ও কী সত্যিই লিখেছিল গল্পটার মধ্যে ? ভ্যাট, এতটা সত্যি ।  না, এটা তো ওর লেখা গল্পটা নয়। তাই বা কী করে হবে ? প্রথম পাতাটা   উল্টে দেখলো আবার, ওরই তো নাম লেখা আছে । আজ চেকটাও ওর নামেই এসেছে । লেখাটা পড়তে পড়তে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল মাটির । গল্পের চরিত্রগুলো ওর আসল জীবনের সঠিক প্রতিফলনটাই দেখাচ্ছে । মূল চরিত্রটা নিজের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা,  নিজের মনের অন্ধকার  কোনাগুলোকে পরতে পরতে মেলে ধরেছে। দেখিয়েছে বাঘিনী শিকারের জন্যে কতটা পরিশ্রমী, স্কিমবাজ হতে পারে । মাটি কাঁপছিল, রাগে, ভয়ে, উত্তেজনায় । এটা কীভাবে সম্ভব ? ওর গল্পের অন্তত তিরিশ ভাগ বাক্য বদলে গেছে আপনাআপনি ।   এমনকি ও যে নিজের সাফাই হিসেবে, অরণ্য আর জলের নামে একটা মিথ্যে কেচ্ছা রটিয়ে দিয়েছিল, সেই কথাটাও উঠে এসেছে গল্পে । কিন্তু এই মিথ্যের ব্যাপারটা তো সে, অরণ্য আর জল ছাড়া কেউ জানতে পারে না । জানা কোনভাবেই  সম্ভব  নয় । তবে ? মাটি উঠে ঘাড়ে মাথায় জল দিল, ফ্রিজ খুলে অনেকটা জল খেল । ভাবল, এবার কী করবে ? এই মুহূর্তে  লেখাটা  অন্তত পঞ্চাশ হাজার  পাঠকের হাতে পৌঁছে গেছে । তারপর প্রথম থেকে খুব খুঁটিয়ে আবার পড়ল গল্পটা । আবার, আবার । ক্রমশ মুগ্ধতার সঙ্গে তার চোখে পড়লো, লেখাটা প্রকৃতপক্ষে পুরোটা তার না হলেও একটা অসম্ভব ভালো দক্ষ গল্প হয়েছে। আসলে মানুষকে স্নানঘর ছাড়াও তো অন্য কোনও জায়গায় কখনো  কখনো নগ্ন হতে হয় । আয়নার সামনে অথবা নিজস্ব চিতায় । গল্পের চরিত্রগুলো ঠিক এই কাজটাই করেছে । মানুষ জন্মকাল থেকে যা কিছু ছুঁড়ে ফেলে, আসলে তার অনেক কিছুই তার গ্রহণ করবার কথা থাকে। সেইসব গ্রহণের মধ্যেই টিকে থাকে তার অভিজ্ঞতা, তার অর্জন।   আর এভাবেই যাপিত জীবন কখনো সখনো প্রকৃত শিল্প হয়ে ওঠে।  

ও অনেকদিন ব্যবহার না করা অরণ্যের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা খুঁজে বার করলো । মেসেঞ্জার দেখাচ্ছে অরণ্য এখনো অন-লাইনে । তারপর খুব ধীরে ধীরে সযত্নে শব্দ চয়ন করে করে লিখলো, ‘আমার গল্পের ভুলগুলো সংশোধন করে দেবার জন্যে ধন্যবাদ । ঠিক করে দিয়ে খুব ভালো করেছ । এবার লেখাটা আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে । আচ্ছা, আমরা কী আর একবার দেখা করতে পারি ? নন্দনের কফি স্টলটার সামনে, ঠিক সেই সব দিনের মত ? ভালো থেকো।’ টিক জানালো অরণ্য মেসেজটা পড়েছে । বাইরে তখন অন্ধকার  কেটে গিয়ে  একটু একটু আলো ফুটছে।

 



অমিত সরকার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ