সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ফাল্গুনী দে

 





        রবীন্দ্রনাথের পত্র-সাহিত্যে বাংলার নদী ও গ্রামকথা


 

 

সঞ্জয়ের উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথ

শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে কুরুক্ষেত্র ধর্মযুদ্ধের ধারাবিবরণী শোনাতে উপস্থিত ছিলেন ভাষ্যকার সঞ্জয়। গুরু ব্যাসদেবের আশীর্বাদে দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত শিষ্য সঞ্জয় রাজসভায় বসে বহুদূরে যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত ঘটনা আধুনিককালের চলমান ছবির মত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। মহাভারতে বর্ণিত ধৃতরাষ্ট্র ও সঞ্জয়ের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ভগবতগীতার মহৎ তত্ত্ব দর্শনের মূল উপাদান। এখানে আমরা জানতে পারি যে, এই মহৎ তত্ত্ব দর্শন প্রকাশিত হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে, যা সুপ্রাচীন বৈদিক সভ্যতার সময় থেকেই পবিত্র তীর্থস্থানরূপে খ্যাত। ভগবান যখন মানুষের উদ্ধারের জন্য এই পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন, তখন এই পবিত্র তীর্থস্থানে তিনি নিজে পরম তত্ত্ব সমন্বিত এই গীতা দান করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে অধুনা বাংলাদেশের শিলাইদহ সাজাদপুর এবং পতিসর অঞ্চলের জমিদার শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মার বুকে নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালায় ভেসে ভেসে উপলব্ধি করছেন মহাপৃথিবীর অন্তরঙ্গ প্রকৃতিপাঠ। আত্ম-বীক্ষণের আতস কাঁচে অনুসন্ধান করছেন জীবনের পরম তত্ত্ব কথা। 1891 সালে কালীগ্রাম থেকে চলমান ছবির মতো কবি লিখছেন --  

"...এই-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালবাসি -- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু'হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোন স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মত এমন আদরের ধন কোথা থেকে দিত! আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে, এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখ-দুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই-সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে। আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে -- যেন এর মনে মনে আছে, 'আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে। জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে!' এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি -- এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সর্বদা চিন্তাকাতর ব'লেই।"

পূর্বে উল্লেখিত শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়ে ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয়ের ধারাবিবরণী শোনানো, এবং অন্যদিকে, ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় পাতায় প্রবাসিনী ভাইজি ইন্দিরাদেবীকে লেখা চিঠির মধ্যে বাংলাদেশের নদী-মাঠ-ক্ষেত এবং গ্রামকথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, প্রেক্ষাপটের বিচারে প্রায় সমতুল্য একথা বললে অত্যুক্তি হয়না। সঞ্জয়ের উত্তরসূরী রূপে দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের মহান জীবন দর্শন এবং প্রকৃতি প্রেম যেভাবে ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিগুলিতে প্রতিভাত হয়েছে, বাংলা পত্র-সাহিত্যের ইতিহাসে সেটি নবতম সংযোজন।

ছিন্নপত্রাবলী এবং রবীন্দ্রনাথ

শিল্প বিপ্লবের শতবর্ষ পেরিয়ে তথা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে যখন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে মানুষের সমাজ এবং অর্থনৈতিক জীবন নড়েচড়ে বসলো, ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশেও আছড়ে পড়ল সাগর পারের সেই অপ্রতিরোধ্য ঢেউ। এরপর রামমোহন থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়কালে শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে মুক্তচিন্তার নবজাগরণ ঘটলো ভারতবর্ষ তথা বাংলার পথে প্রান্তে। উনিশ শতকের বঙ্গভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতি, রসচেতনা, প্রকৃতি-ভাবনা, মানবপ্রীতি এবং আধ্যাত্মিক আকুলতার এক অত্যুজ্জ্বল মহাপ্রকাশের নামই রবীন্দ্রনাথ; যাঁর সাহিত্যকর্ম এবং সমাজ চিন্তা সারা পৃথিবীর মানুষকে একই সঙ্গে আবিষ্ট এবং উদ্বুদ্ধ করে তুললো। রবীন্দ্রনাথ তাই আজও আমাদের কাছে এক অনতিক্রম্য বিস্ময়। রবীন্দ্র-অন্বেষা তাই আজও আমাদের কাছে অনিঃশেষ। তবে একথা সত্য, বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে রবীন্দ্র পরিচয় অভিব্যক্ত হয় তা যতখানি শিল্পের স্বার্থে আদর্শায়িত, জীবনের মহান অনুভবের সত্য হিসাবেও ততখানি প্রকাশিত। 

তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার (বর্তমানে কুষ্টিয়া) বিরাহিমপুর পরগনায়, পাবনা জেলার ইসবসাহী পরগনায় এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনায় ছিল ঠাকুর পরিবারের প্রশস্ত জমিদারি। এই তিনটি জমিদারীর প্রধান তিনটি কাছারি অবস্থিত ছিল ছিল যথাক্রমে শিলাইদহ সাজাদপুর এবং পতিসরে। 1890 সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার নির্দেশে পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছিলেন এবং প্রায় এগারো বছর একটানা তিনি এই জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে 1901 সালে জমিদারি তদারকি করবার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও, অনেকদিন পর্যন্ত শিলাইদহ এবং কালীগ্রামের সঙ্গে তার যোগাযোগ এবং প্রজাদের মঙ্গলের জন্য চিন্তাভাবনা অটুট ছিল। কর্মব্যস্ত এই জমিদারি দেখাশোনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত ছিলেন ব্যক্তিগত পড়াশোনা এবং লেখালিখির কাজে। 

প্রায় বিশ শতকের শেষ লগ্ন পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের এবং ভাব বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র। যদিও বর্তমান সময়ের নব্য উদারনীতিবাদ এবং বিশ্বায়নের যুগে সেটি একটি নির্বাপিত শিল্প মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশি বছরের জীবনে অজস্র লেখালেখি, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, ভ্রমণ এবং বিচিত্র কর্মসাধনার পাশাপাশি বহু কাছের এবং দূরের মানুষজনকে লিখেছেন অসংখ্য চিঠিপত্র। চিঠি লেখা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন – “কথায় যে-জিনিসটা এড়িয়ে যায়, এবং প্রবন্ধে যে-জিনিসটা কৃত্রিম হয়ে ওঠে, চিঠিতে সেইটে অতি সহজেই আপনাকে ধরা দেয়।“ কবি যখন প্রিয়জনকে পত্র লেখেন তা শুধু ছাপাবার জন্য নয়, প্রয়োজনের কৃত্রিমতা অতিক্রম করে তার আনন্দঘন মুহূর্ত ধরা থাকে সেই পত্রের ছত্রে ছত্রে। ইংরেজিতে যেমন শেলী, কিটস, ব্রাউনিং, ওয়ার্ডসওয়ার্থরা তাদের পত্রসাহিত্যকে স্মরণীয় করে রেখেছেন, বাংলাতেও রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 

1887 সেপ্টেম্বর থেকে 1895 ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দীর্ঘ আট বছরে শিলাইদহ সাজাদপুর পতিসর অঞ্চলে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ তার বিচিত্র অনুভব এবং অভিজ্ঞতার কথা প্রায় নিয়মিত ভাবে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে। ছিন্নপত্রাবলী প্রধানত সেই চিঠিগুলির এক আশ্চর্য সংকলন। পদ্মাতীরে বাংলাদেশের সেই নিবিড় প্রকৃতি এবং মানুষগুলির সঙ্গে কবির অন্তরঙ্গ যোগসাধনার বিচিত্র জটিল কখনো বা পরস্পরবিরোধী সত্তার এক ঐক্যতান শোনা যায় এই ছিন্নপত্রাবলী বইটিতে। ছিন্নপত্রাবলী যেন রবীন্দ্রনাথকে চতুর্দিক থেকে প্রদক্ষিণ করে দেখার জন্য এক অনুপম ভাস্কর্য।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পত্রধারা বা পত্রসাহিত্যকে তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করে নিয়েছেন। ছিন্নপত্র প্রথম পর্যায়। ইউরোপ প্রবাসীর পত্রও এই পর্যায়ভুক্ত। ভানুসিংহের পদাবলী দ্বিতীয় পর্যায়। এই পত্রগুচ্ছ কবি শান্তিনিকেতন থেকে জনৈকা বালিকার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। পথে ও পথের প্রান্তে তৃতীয় পর্যায়। 1926 খ্রিস্টাব্দে তিনি ইউরোপ ভ্রমণের বৃত্তান্ত রানী মহলানবিশকে পত্রাকারে লিখেছিলেন। পথে ও পথের প্রান্তে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে এই পত্রগুলি। জাপান যাত্রী, পারস্যে,জাভা-যাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি -- এইসব ভ্রমনমূলক পত্রগুচ্ছ কবির পত্রসাহিত্যের তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্গত। এমন অগণিত চিঠিপত্রের মধ্যে ছিন্নপত্রাবলীতে যে-রূপে গ্রাম বাংলার নদী জনজীবন এবং মানুষের কথা ফুটে উঠেছে এমনটি আর কোথাও নয়।

 

নদী-চেতনা এবং রবীন্দ্রনাথ

বাংলা নদীমাতৃক দেশ। এযাবৎ পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের কথায় -- "বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলার ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদ-নদীগুলিই বাংলার প্রাণ। ইহারাই বাংলাকে গড়িয়াছে। বাংলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে এবং এখনও করিতেছে। এই নদ-নদীগুলিই বাংলার আশীর্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায় মানুষের অবহেলায় কখনো কখনো অভিশাপও।" 

বর্তমানে যেখানে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থান করছে বহু কোটি বছর আগে সেখানে ছিল টেথিস সাগর। এর উত্তরে ছিল আঙ্গারা ল্যান্ড এবং দক্ষিণে ছিল গন্ডয়ানা ল্যান্ড। দীর্ঘদিন ধরে দুই পাশের এই উচ্চভূমি থেকে নদী-নালা বিধৌত পলি এসে টেথিসকে ভরাট করে তোলে। পরবর্তীকালে ইউরেশীয় পাত এবং ভারত উপদ্বীপীয় পাতের পার্শ্বচাপে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছে। উত্তরের এই সুউচ্চ হিমালয় পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়ে অসংখ্য নদনদী ভারত এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ( গঙ্গা নদী বাংলাদেশে 'পদ্মা' নামে এবং ব্রহ্মপুত্র নদী 'যমুনা' নামে প্রবাহিত) মোহনায় মিশেছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদী বাহিত লক্ষ লক্ষ বছরের পলি সঞ্চিত হতে হতে বেঙ্গল জিওসিনক্লাইন (মহিখাত) ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। 

ভূগোলের এই ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যক্তি অনুভবের কষ্টিপাথরে পরিশ্রুত করে প্রকাশ করলেন দার্শনিকতার এক অনন্য মহিমায়। ছিন্নপত্রাবলীর 34 সংখ্যক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন -- "নানা দেশ দিয়ে নদী চলেছে, মানুষের স্রোতও তেমনি কলরব-সহকারে গাছপালা গ্রাম নগরের মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে চিরকাল ধরে চলেছে-- এ আর ফুরোয় না। 'মেন মে কাম অ্যান্ড মেন মে গো বাট আই গো অন ফর এভার' -- কথাটা ঠিক সংগত নয়। মানুষও নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে -- তার এক প্রান্ত জন্মশিখরে আর-এক প্রান্ত মরণসাগরে, দুই দিকে দুই অন্ধকার রহস্য, মাঝখানে বিচিত্র লীলা এবং কর্ম এবং কলধ্বনি -- কোন কালে এর আর শেষ নেই।" 

নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবিকা, পল্লী গ্রামের নানান উৎসব পার্বণ, জলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ ও পশু পালন। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার এমন নিদর্শন সমগ্র পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর নেই। বার্নিয়ারের (1666) মতে -- "প্রকৃতির দাক্ষিণ্য ও সম্পদের প্রাচুর্যের বিচারে অনেকেই মিশরকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করেন কিন্তু দু'দফায় দেখার পর আমার মনে হয়েছে নদীকেন্দ্রিক বাংলাই পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।"

ছিন্নপত্রাবলীর মুখ্য চরিত্র পদ্মা। যৌবনে পদ্মাপারের সেই সব দিনগুলি রবীন্দ্রনাথের জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল। অধুনা বাংলাদেশের পদ্মাপারের সেইসব দিনগুলির যাপনকথা ধরা পড়েছে কবির বিভিন্ন রচনায়। 1895 সালে 6 এপ্রিল পদ্মা পাড়ে বসেই লিখলেন 'পদ্মা' কবিতাটি --

"হে পদ্মা আমার,

তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।

একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,

গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,

সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান

তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।

অবসান সন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন

নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন,

সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে

চেয়েছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।

সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,

                    তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।"    (চৈতালি)

 

জমিদারির প্রায় সমস্ত কাছারিগুলি পদ্মার পাড়ে অবস্থিত হওয়ার কারণে পদ্মা-পথে যাতায়াতকালে পদ্মার সৌন্দর্য, নির্জন নদীর চর, নদীর কলতান, নদী তীরবর্তী প্রকৃতি ও মানুষের যুগলবন্দী রবীন্দ্রনাথকে মোহাচ্ছন্ন করেছিল। জমিদারি কাজকর্মের ফাঁকে দুপুরবেলা এবং সন্ধ্যার অবসর টুকুতে নদীবক্ষে বোটের উপর বসে রবীন্দ্রনাথ পদ্মার বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর অমৃত সমান দৃশ্যগুলি দুচোখ ভরে পান করেছেন। ছিন্নপত্রাবলীর 140 নম্বর চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন -- "আমাদের দুটো জীবন আছে একটা মনুষ্যলোকে আর একটা ভাবলোকে। সেই ভাবলোকের জীবন বৃত্তান্ত অনেকগুলি পৃষ্ঠা আমি এই পদ্মার উপরকার আকাশে লিখে গেছি।"

যদিও ছিন্নপত্রাবলী ছাড়াও পদ্মাপারের প্রকৃতি এবং জগৎসংসারের সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ যেমন সোনার তরী চিত্রাতেও একই ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় লিখলেন -- "মায়াময় স্বপ্নময় সুকোমল এই দুটি গ্রন্থের প্রায় সব কবিতাই আমাদের অভিভূত করিয়া দেয়। আর, সেই চিত্ররূপ একান্তই পদ্মাবিধৌত সুবিস্তীর্ণ বাংলার স্নিগ্ধ শ্যামল সরস রূপ।.......বস্তুত যদি বলি 'সোনার তরী' পদ্মারই কাব্য, তাহা হইলে কিছু অন্যায় বলা যায় না।" 

পদ্মাই রবীন্দ্রনাথকে তার প্রকৃতি দর্শনের শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। ব্যক্তি এবং বস্তু মিলে এই বিশ্ব চরাচরের যে গতি প্রবাহ, ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় পাতায় সেই নিগূঢ় অনন্ততত্ত্বটি বারবার ব্যক্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ নদীকে চিনেছে তার বহিরঙ্গে অর্থাৎ ধ্বংসের বিভীষিকায়, পলল-ব্যঞ্জিত সৃষ্টির সমভূমি বিনির্মাণে, নদীর জলে চাষাবাদের উৎকর্ষতায়, নদীবক্ষে উৎসব পার্বণের উচ্ছ্বাসে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিনেছেন নদীর অন্তরঙ্গের অনন্ত বিভাবে। ছিন্নপত্রাবলীর 23 সংখ্যক চিঠিতে লিখেছেন --

তীরে যেখানে নৌকা বাঁধা আছে সেইখানের থেকে এক রকম ঘাসের গন্ধ এবং থেকে থেকে পৃথিবীর একটা গরম ভাপ গায়ের উপরে এসে লাগতে থাকে -- মনে হয় এই জীবন্ত উত্তপ্ত ধরণী আমার খুব নিকটে থেকে নিশ্বাস ফেলছে, বোধ করি আমারও নিশ্বাস তার গায়ে গিয়ে লাগছে। ছোটো ছোটো ধানের গাছগুলো বাতাসে ক্রমাগত কাঁপছে — পাতিহাঁস জলের মধ্যে নেবে ক্রমাগত মাথা ডুবোচ্ছে এবং চঞ্চু দিয়ে পিঠের পালক সাফ করছে।... অনতিদূরে একটা খেয়াঘাট আছে। বটগাছের তলায় নানাবিধ লোক জড়ো হয়ে নৌকার জন্যে অপেক্ষা করছে, নৌকা আসবামাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছে। অনেকক্ষণ ধরে নৌকা পারাপার দেখতে বেশ লাগে। ওপারে হাট, তাই খেয়া নৌকোয় ভিড়। কেউ বা ঘাসের বোঝা, কেউ বা একটা চুপড়ি, কেউ বা একটা বস্তা কাঁধে করে হাটে যাচ্ছে এবং হাট থেকে ফিরে আসছে। ছোট নদীটি এবং দুই পারের দুই ছোট গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় এই একটুখানি কাজ কর্ম, মনুষ্য জীবনের এই একটুখানি স্রোত ধীরে ধীরে চলছে।” 

চলমান জীবনের সহস্রধারাটি পদ্মার বুকে নৌকায় ভেসে ভেসে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ। সমস্ত নাগরিক ঐশ্বর্য থেকে দূরে শান্ত নিরিবিলি গ্রাম জীবনে পদ্মার অকুণ্ঠ আতিথ্যে যেভাবে খেয়ানৌকায় মানুষের দৈনন্দিন নদী পারাপার, জীবিকার সন্ধানে ধীর স্থির জীবনে যেখানে ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই, রবীন্দ্রনাথের কলমে সেইসব নদীকেন্দ্রিক ইতিহাস যেন ছায়াছবির নিবিড় কোলাজ। 

আবার, কবি জীবনের অমূল্য দর্শনের লালনভূমি এই পদ্মার তীরে বসে পদ্মাকে তাঁর মানুষের মতোই মনে হয়েছে 93 সংখ্যক পত্রে -- "বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমার তেমনি পদ্মা -- আমার যথার্থ বাহন -- আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকার একটি স্বতন্ত্র মানুষের মতো। ওর পিঠে কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে।"

তবে যে শুধুই পদ্মার সৌন্দর্য বিলাসিতা করেছেন বা পদ্মার জলে জ্যোৎস্নার চরাচর ভেসে যাওয়া লিপিবদ্ধ করেছেন নরম স্নিগ্ধ কলমে তা কিন্তু মোটেই নয়। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিটি ঋতুর বৈচিত্রের মহিমায় লুকিয়ে থাকা পদ্মার নিজস্ব স্বরূপকে। দেখেছেন পদ্মার এক হাতে যেমন জননীর লালন পালনের অমৃতসুধা, অন্যহাতে তেমনই ধ্বংসের করাল বিভীষিকা। 68 সংখ্যাক পত্রে লিখছেন -- "নদীর যে রোখ ! যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো ঘাড়-বাঁকানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো। গতি গর্বে ঢেউ তুলে ফুলে ফুলে চলেছে। তাকে মনে করলে আমার কালীর মূর্তি মনে হয় -- নৃত্য করছে ভাঙছে এবং চুল এলিয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝিরা বলছিল নতুন বর্ষায় পদ্মার খুব 'ধার' হয়েছে। ধার কথাটা কিন্তু ঠিক। তীব্র স্রোত যেন চকচকে খড়্গের মতো, পাতলা ইস্পাতের মতো একেবারে কেটে চলে যায়। প্রাচীন ব্রিটেনবাসীদের যুদ্ধরথের চাকায় যেমন কুঠার বাঁধা থাকত, পদ্মার দ্রুতগামী বিজয়রথের দুই চাকায় তেমনই তীব্র খরধার স্রোত শাণিত কুঠারের মতো বাঁধা -- অবহেলায় একেবারে ছারখার করে দিয়ে চলেছে।"

তীব্রতম বর্ষার সময়ে মৌসুমী বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখার প্রভাব সমুদ্রের উপকূল ছাড়িয়ে যেভাবে বিস্তীর্ণ পদ্মার বুকে খোলা হাওয়ার তীব্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই পরিস্থিতিতে পদ্মার চেহারা কোনভাবেই মহাসাগরের ঢেউয়ের থেকে কম নয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান যাত্রাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ জাহাজের পথে এমন উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পূর্বেই পরিচিত ছিলেন কিন্তু পদ্মার বুকে ভৌগলিক পরিবেশ নিয়ে এমন সার্বিক সাহিত্য মূল্যায়ন ইতিপূর্বে লেখা হয়নি। 

ছিন্নপত্রাবলীর মূল প্রেরণা পদ্মা নদী হলেও, রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য অনেক চিঠিপত্র এবং লেখালেখিতে বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক নদী যেমন আত্রেই, বড়াল, গড়াই, নাগর, ইছামতি, করতোয়া, হুড়াসাগর, ফুলঝোর ইত্যাদির কথা উল্লেখ আছে। পদ্মার বীভৎসতার কাছে গ্রামীণ মানুষ এবং তাদের সাধের বসতি গুলি একেবারেই তুচ্ছ, কিন্তু ইছামতি অনেকাংশে মানুষ ঘেষা নদী। তার শান্ত জল প্রবাহের সঙ্গে মানুষের কর্ম প্রবাহের স্রোত মিশে আছে। ইছামতি ছেলেদের মাছ ধরবার আর মেয়েদের স্নান করবার নদী। স্নানের ঘাটে গ্রামীণ মেয়েদের গল্পগাছার হাস্যময় কলধ্বনি যেন ইছামতির স্রোতের সঙ্গে এক সুরে মিলে যায়।" 

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শনকালে তার জলপথের অপর একটি নদী 'ইছামতি' নিয়েও 'ইছামতি নদী' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতা 'চৈতালি' কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল –

যখন যেমন মনে করি তাই হতে পারি যদি,

আমি তবে এক্ষুনি হই ইচ্ছামতী নদী।

রইবে আমার দখিন ধারে সূর্য-ওঠার পার,

বাঁয়ের ধারে সন্ধ্যাবেলায় নামবে অন্ধকার,

আমি কইব মনের কথা দুইপারেরই সাথে,

আধেক কথা দিনের বেলায়, আধেক কথা রাতে।

 

যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই আপন গাঁয়ের ঘাটে,

ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই দূরের মাঠে মাঠে

গাঁয়ের মানুষ চিনি -- যারা নাইতে আসে জলে,

গোরু-মহিষ নিয়ে যারা সাঁৎরে ও পার চলে।

দূরের মানুষ যারা তাদের নতুনতরো বেশ --

নাম জানি নে, গ্রাম জানি নে অদ্ভুতের এক-শেষ।।

এক চিঠিতে লিখলেন – “এই আঁকাবাঁকা ইছামতি নদীর ভিতর দিয়ে চলেছি। এই ছোট খামখেয়ালি বর্ষাকালে নদীটি -- এই যে দুইধারে সবুজ ঢালু-ঘাট, দীর্ঘ ঘন কাশবন, পাটের ক্ষেত, আখের ক্ষেত আর সারি সারি গ্রাম -- এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন, আমি বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছি এবং বারবারই ভালো লাগছে। পদ্মা এতই বড় নদী যে কোন ঠিকানা মুখস্ত করে নেওয়া যায় না, আর এই কেবল ক'টি বর্ষা-মাসের দ্বারা অক্ষর-গোনা ছোটো বাঁকা ইছামতি নদীটি যেন বিশেষ করে আমার আপনার হয়ে যাচ্ছে।"

নদী আসলে একটি চেতনার জলছবি। এর উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা ভূগোলের পাতায় বর্ণনার বাইরে বেরিয়ে এসে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত বাস্তবিকতার জল-মাটি-হাওয়ায় লুকিয়ে থাকে। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকে আবিষ্কার করতে হয়।   

গ্রাম ও প্রকৃতি-প্রেমী রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ এক অনুপম কবি। পথপার্শে যা-কিছু অনিত্য অসুন্দর অবহেলিত তার মধ্যে সুন্দরের অনুসন্ধান করাই কবির হৃদয়ের অনন্ত রহস্যলোক। তিনি মনে করেন সৌন্দর্য উপভোগ শুধুমাত্র বাইরের আয়োজনের উপরে নির্ভর করে না; ভাব নিবিষ্ট হৃদয়ের গহিন অতল কখনও কখনও গলির মধ্যেও মুহূর্তে বিশ্বসংসারের স্বরূপ দেখিয়ে দিতে পারে। ছিন্নপত্রাবলীর প্রতিটি চিঠিতে প্রায় প্রত্যক্ষভাবে এই কথাই বলা আছে যে -- "এই সময়ে নদীপথে নৌকা করিয়া ঘুরিয়া বেড়াই বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতি ও গ্রাম্য জীবনের প্রত্যক্ষ পরিচয় না লাভ করিলে কবির স্বাভাবিক বিশ্বানুভূতি কখনোই বাস্তব রূপ পাইত না।"

পদ্মাপারের প্রকৃতির এই অঙ্গনেই রবীন্দ্রনাথের অন্তর্লীন হৃদয়ের আত্মা যেন জেগে ওঠে। গদ্যের ছন্দে প্রকৃতির স্বরূপ বিনির্মাণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন এক আশ্চর্য চিত্রশিল্পী – “সূর্য আস্তে আস্তে ভোরের বেলা পূর্ব দিক থেকে কী এক প্রকাণ্ড গ্রন্থের পাতা খুলে দিচ্ছে এবং সন্ধ্যার পশ্চিম থেকে ধীরে ধীরে আকাশের উপরে যে-এক প্রকাণ্ড পাতা উলটে দিচ্ছে সেই বা কী আশ্চর্য লিখন -- আর এই ক্ষীণপরিসর নদী আর এই দিগন্তবিস্তৃত চর আর ওই ছবির মতন পর পার ধরণীর এই উপেক্ষিত একটি প্রান্তভাগ এইবা কী বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা !”

আবার – “সূর্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারিদিকে কী যে সুন্দর হয়ে উঠল সে আর কী বলব ! বহুদূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল -- নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে এল মনে হল ঐখেনে যেন সন্ধ্যার বাড়ি।"

সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের ভাব রবীন্দ্রনাথের মননে বিচিত্র অনুভূতি সঞ্চার করেছে। অন্য ভুবনের পথে চলে যাওয়া সূর্যের সেই অস্তগামী লাল আলো রবীন্দ্রনাথকে চিরন্তন এক সুন্দর ব্যথার লালন পালন শিখিয়েছে। বাংলার গ্রামীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদীর জলে সূর্যের সোনালী ঝিকিমিকি, গাছগাছালি ঘেরা শান্ত নদী চর ইত্যাদি অমলিন মুহূর্তগুলি প্রবাসে অথবা নাগরিক জীবনে ব্যস্ত সময়ে কবিকে আক্ষেপে ভরিয়ে তুলেছে -- "পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।"

বাংলাদেশের গ্রামীণজীবন বাস্তবিকই নদীবেষ্টিত, আদিগন্ত বিস্তৃত অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত, যার মধ্যে ক্ষীণস্রোতের মতো অসহায় বয়ে চলে মানবতাবাদী হতদরিদ্র একটি সরল গ্রাম্য জীবন। তাই গ্রাম এবং নদীকে আলাদা করে গ্রামীণ প্রকৃতি উপলব্ধি করা বাস্তবিকই অসম্ভব। 

রবীন্দ্রনাথের জন্ম শহর কলকাতায় জোড়াসাঁকোর উঁচু দেওয়ালের পরিখাবেষ্টিত ঠাকুরবাড়ির কড়া পাহারার অন্দরমহলে। প্রথাগত স্কুল শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, তুলনায় সেখানে ছিল নিয়মের শিকল, বাধার সিংহদুয়ার। সেইসব বন্ধনকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথের শিশুমন পাড়ি দিত দূরে আরও দূরে বিশ্বের দরবারে। তাই প্রথমবার যখন বাবার সঙ্গে রেলগাড়ি চড়ে বোলপুরের পথে রওনা হলেন রবীন্দ্রনাথের শরীর থেকে সমস্ত বাঁধন যেন একে একে খসে পড়লো। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বোলপুরের গ্রামীণ জীবনের সেইসব দিনযাপনের কথা রবীন্দ্রনাথের নানান লেখায় বারেবারে ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ পৃথিবীর এই প্রকৃতিকে তার অনন্ত কবিসত্তা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন জননীর নিস্তরঙ্গ স্নেহ আদরের মতো। ছিন্নপত্রাবলীর 74 নম্বর চিঠিতে লিখলেন -- "তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে সূর্যালোক পান করেছিলুম, নবশিশুর মতো একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বর তলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম।......তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে।"

কবিতা গল্প গান ইত্যাদি রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন বিশ্বের সমস্ত শক্তিকে এবং সৌন্দর্যকে আত্মকরণ করছিলেন দৈবের প্রত্যক্ষ আদেশে। এ যেন তার মহাবিশ্বের মহান কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্ব প্রস্তুতি। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামেই নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী বৃহৎ জীবন অধ্যায়ের পটভূমিকা। কৈশোর বয়সে বিলেত এবং অন্যান্য প্রবাসের পথে পাড়ি দিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছেন। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের এমন সৌন্দর্যমন্ডিত গ্রাম্য প্রকৃতি উপলব্ধি করেননি। গ্রামজীবনের বাৎসল্য এবং প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণে জমিদারি কাজকর্মে নেহাতই অপটু হয়েও বাবার এক নির্দেশে পাড়ি দিলেন শিলাইদহের পথে। সোনার তরীর ভূমিকায় লিখলেন -- "বাংলাদেশের নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি .....কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খর রৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারা বর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পাণ্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে নানাবর্ণের ছায়ার তুলি। এইখানে নির্জন সজনের নিত্যসংগম চলছিল আমার জীবনে।"

পুনরায় লিখলেন -- "এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়তো, সূর্য কিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হয়ে থাকত.... তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শষ্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপছে।"

রবীন্দ্রনাথ আশৈশব প্রকৃতিপ্রেমী। শিশুকাল থেকেই বাবার সঙ্গে বোলপুরের পথে ডালহৌসির পথে হিমালয়ের পথে ভ্রমণ কালে অথবা পানিহাটিতে ছাতুবাবুর বাগান বাড়িতে গঙ্গার পাড়ে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কৈশোর জীবনে শিলাইদহের ভ্রমণপথে তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করেছেন সৌন্দর্য পান করেছেন আকন্ঠ পিপাসায়। এইসব দিনযাপনের মগ্নতা এবং প্রকৃতি প্রেমের বীজ তার শিরায় শিরায় মিশ্রিত হয়েছিল শিশুকাল থেকেই এবং একথা অনস্বীকার্য যে এই বীজের পূর্ণ মহীরুহের বিবর্তন ঘটেছিল নদী বিধৌত পল্লীবাংলার পথে-ঘাটে পরিভ্রমণ কালেই। 

বাংলাদেশে জমিদারি কাজে ব্যস্ত থাকাকালীন সময়ের মধ্যেও 1890 সালে মাত্র ছয় মাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে গেছিলেন কিন্তু সেখানে তার মন টিকলো না বেশিদিন। ছিন্নপত্রাবলীতে লন্ডন থেকে লেখা অস্থিরচিত্ত রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি আমরা পাই। 7 সংখ্যক সেই চিঠিতে গ্রামীণ-স্বদেশ থেকে দূরে প্রবাসের যন্ত্রণা ধরা পড়ে লেখার ছত্রে ছত্রে -- "এ দেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি সত্যি আমার মা বলে মনে হয়। এদেশের মতো তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসে। আমার আজন্মকালের যা-কিছু ভালোবাসা, যা-কিছু সুখ, সমস্তই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনোই ভোলাতে পারবে না -- আমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি। সমস্ত সভ্যসমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতো আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাই নে।"

এই আকুতির অন্যতম কারণ স্বদেশচিন্তা এবং গ্রামীণ উন্নয়ন কল্পে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করবার একটি সুপ্ত বাসনা। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তিনি যেমন আকণ্ঠ পান করেছেন তেমনি জমিদারের পোশাক পরে দেখেছেন হতদরিদ্র গ্রামবাসী প্রজাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন। এই প্রজা-দরদী রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনেছি ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় ১১১ সংখ্যক চিঠিতে -- "আমার কালীগ্রামের সরল চাষি প্রজাদের দুঃখ দৈন্য নিবেদন! আহা এমন প্রজা আমি দেখিনি -- এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে।...... এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক। এই সমস্ত নিঃসহায় নিরূপায় নিতান্ত নির্ভরপর সরল চাষাভুষোদের আপনার লোক মনে করতে বড় একটা সুখ আছে।..... এরা যখন কোন একটা অবিচারের কথা বলে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।" 

একটি আমলাতান্ত্রিক অর্থাৎ নায়েব গোমস্তা খাজাঞ্জি নির্ভর একটি জমিদারি প্রথায় 'প্রজাদের দুর্দশার গ্রামীণ চিত্র' খুব অস্বাভাবিক ছিল না তৎকালীন সময়ে। সেখানে প্রজারা সরাসরি জমিদার মহাশয়কে নালিশ করবেন দুঃখ অবিচারের কথা জানাবেন, এ ছিল নেহাতই অসম্ভব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী জমিদার। এই ব্যতিক্রমী শাসন ব্যবস্থার আড়ালে একটি প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব রকমের গুনাগুন তৈরি হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দু'বছরের মধ্যে অর্থাৎ 1863 সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূমের বোলপুরে কুড়ি একর জমি লিজ নিয়েছিলেন। 1901 সালে সেখানে ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে শান্তিনিকেতনের পথ চলা শুরু, সেই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করতে 1921 সালে সেখানে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি Leonard Elmhirst এর একান্ত সহযোগিতায় সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনকে পূনর্গঠনের জন্য শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। 1930 সালে তিনি যখন প্রথমবার রাশিয়া গেলেন, সেখানেও কিন্তু দেশ গ্রামের হিত চিন্তায় তিনি চিন্তিত থাকতেন। চিঠিতে লিখলেন -- 

"রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোন দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তাহলে ভারি উপকার হত। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি কী হয়েছে আর কী হতে পারতো।" 

যদিও রাশিয়া ভ্রমণের অনেক আগেই 'দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ' তার উত্তরসূরী, পুত্র শ্রীমান রথীন্দ্রনাথকে 1907 সালে শ্রীনিকেতনের দায়িত্ব নিতে, কৃষিকাজ এবং গ্রামোন্নয়নের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ইউরোপে না পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমেরিকায় পাঠাবার। ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথ বাবার ইচ্ছে পূরণে শিলাইদহে এবং শ্রীনিকেতনে গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পে যোগদান করেন। মানুষের কল্যাণই এখানে শেষকথা। মনুষ্য জাতির উন্নতিই এখানে শেষ গন্তব্য। 

মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ কখনও ঈশ্বরকে মন্দিরের গর্ভগৃহে খোঁজেননি। কর্মের মধ্য দিয়েই জীবনের মুক্তি এবং আনন্দ খুঁজেছেন। যে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি তার গ্রাম চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় পাতায় তা থেকে তৎকালীন বাংলার গ্রাম চিত্রটি স্পষ্ট ধরা পড়ে 16 সংখ্যক চিঠিতে -- "কেউ যে এক দণ্ড কুঁড়ে হয়ে বসে আছে তা দেখলুম না -- একটা-না-একটা কাজে আছেই আছে। .... পুরুষটা রান্না চড়িয়ে দিয়ে বসে বসে বাঁশ চিরে চিরে ধামা চাঙারি কুলো প্রভৃতি তৈরি করছে-- মেয়েটা কোলের উপর একটি ছোট্ট আয়না নিয়ে অত্যন্ত সাবধানে যত্নে সিঁথেটি কেটে চুল আচড়াচ্ছে।" 

আবার বর্ষায় কর্মরত অবিচল চাষাদের গ্রামজীবন এঁকেছেন 102 সংখ্যক চিঠিতে  -- "কাল সমস্ত রাত বাতাস পথের কুকুরের মতো হু-হু করে কেঁদেছিল -- আর, বৃষ্টিও অবিরাম চলেছে। মাঠের উপর ছোটো ছোটো নির্ঝরের মতো নানা দিক থেকে কল্ কল্ করে নদী এসে পড়েছে। চাষারা ওপারের চর থেকে ধান কেটে আনবার জন্য কেউবা টোগা মাথায় কেউবা একখানা কচুপাতা মাথার উপর ধরে ভিজতে ভিজতে খেয়া নৌকায় পার হচ্ছে -- বড়ো বড়ো বোঝাই নৌকার মাথায় উপর মাঝি হাল ধরে বসে বসে ভিজছে, আর মাল্লারা গুণ কাঁধে করে ডাঙার উপর ভিজতে ভিজতে চলেছে। এমন দুর্যোগ তবু পৃথিবীর কাজকর্ম বন্ধ করবার জো নেই।"

গ্রাম জীবন কর্মব্যস্ত কিন্তু তার প্রবাহটি ধীর লয়ের একটি ক্ষীণ নদীর মতো। গ্রাম জীবন দুঃখ-দারিদ্র-সর্বস্ব কিন্তু চলনটি আকাঙ্ক্ষায় নির্লোভ এবং চাহিদাহীন উপাচারের ঐশ্বর্যে ভরপুর। ইউরোপ-আমেরিকার গ্রামের থেকে অথবা শহর কলকাতা নাগরিক যাপনের থেকে যা অবিশ্বাস্য রকমের আলাদা। তাই প্রকৃত গ্রাম জীবন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পদ্মার বোটে ভাসমান অবস্থায়। সেই সময় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, কামার, কুমোর, চাষা, গোয়ালা, ধোপা, নাপিত, গাড়োয়ান, মাঝি মাল্লার, জেলে, কৃষক, তাঁতি, মজুর,পাচক, ডাক্তার বৈদ্য, বেদে, গায়ক, কেরানি, খানসামা, ভবঘুরে জিপসি ইত্যাদি নানান জাতি বর্ণ এবং জীবিকা ভিত্তিক মানুষের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ঘটে। গ্রামীন বাংলাদেশের পদ্মা-ইছামতির জলপথে রবীন্দ্রনাথ যে চরিত্র গুলির সঙ্গে পরিচয় লাভ করলেন সেগুলি তার সৃষ্টির মহাবিশ্বে মনুষ্য চরিত্র হিসেবে বিশ্বজনীন আবেদন বহন করে চলে। পল্লী প্রকৃতিতে মানুষের সঙ্গে সেই মহৎ সংসর্গের কথা তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাসের চরিত্র হয়ে তাঁকে আজীবন শাসন করেছে। এই প্রসঙ্গে লিখলেন -- 

"বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে পাবনার কোলের ইছামতীতে। ইছামতি থেকে বড়লে, হুড়া সাগরে, চলন বিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে। দুই ধারে কত টিনের-ছাদওয়ালা গঞ্জ, কত মহাজনী নৌকার ভিড়ের কিনারায় হাট, কত ভাঙনধরা তট, কত বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ছেলেদের দলপতি ব্রাহ্মণ বালক, গোচারণের মাঠ ছেলের জটলা, বনঝাউ-আচ্ছন্ন পদ্মা তীরের উঁচু পাড়ের কোটরে গাঙ-শালিকের উপনিবেশ। আমার গল্পগুচ্ছের ফসল ফলেছে আমার গ্রাম-গ্রামান্তরে পথে-ফেরা এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভূমিকায়।"

আবার 105 সংখ্যক পত্রে গ্রামীণ প্রাকৃতিক সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন ছবির মতো স্পষ্ট -- "ছোট খাটো গ্রাম, ভাঙ্গা চোরা ঘাট, টিনের দাঁত-ওয়ালা বাজার, বাঁখারি বেড়া-দেওয়া গোলাঘর, বাঁশঝাড়, আম কাঁঠাল কুল খেজুর শিমূল কলা আকন্দ ভেরেন্ডা ওল কচু লতাগুল্ম তৃণের সমষ্টিবদ্ধ ঝোপঝাড় জঙ্গল, ঘাটে-বাঁধা-মাস্তুল-তোলা বৃহদাকার নৌকার দল, নিমগ্ন প্রায় ধান এবং অর্ধমগ্ন পাটের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত এঁকেবেঁকে কাল সন্ধ্যার সময় সাজাদপুরে পৌঁচেছি।" 

অন্যদিকে গ্রাম জীবনের মূল সত্যটি চিনতে পেরেছেন 145 সংখ্যক চিঠিতে --  "পাড়াগাঁয়ের কর্ম স্রোত খুব বেশি তীব্রও নয়, অথচ নিতান্ত নিশ্চেষ্ট নির্জীবও নয়। কাজ এবং বিশ্রাম দুই যেন পাশাপাশি মিলিত হয়ে হাত ধরা ধরি করে চলেছে। খেয়া নৌকা পারাপার করছে, পান্থরা ছাতা হাতে করে খালের ধারে রাস্তা দিয়ে চলেছে। মেয়েরা ধুচুনি ডুবিয়ে চাল ধুচ্ছে, চাষারা আটিঁ বাঁধা পাট মাথায় করে হাটে আসছে। ..... সমস্তটাই যেন একটা শান্তিময় স্বপ্নময় করুণা-মাখা একটা বড়ো সোনাটার অন্তর্গত। কিন্তু খুব একটা বিস্তৃত বৃহৎ অথচ সংযত মাত্রায় বাঁধা।"

পূর্ণেন্দু পত্রী ছিন্নপত্রাবলীর পাঠ প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথকে 'অলসতম কবি' বলে সমালোচনা করলেও ছিন্নপত্রাবলীর সাহিত্য মূল্যায়ন এবং ভৌগলিক অনুষঙ্গ কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না। রবীন্দ্রনাথ জন্মগত ভাবে শহুরে হলেও বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত খামার খাল বিল গ্রাম মফঃস্বল চিনেছিলেন হাতের তালুর মতো স্পষ্ট। বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে নদীর পাড়ে অথবা দূরে যে গ্রাম মফঃস্বল ছড়িয়ে রয়েছে তাদের অর্থনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবন, নিবিষ্ট প্রাকৃতিক জীবন, দুঃখ দুর্দশার জীবন, জাতি বর্ণ বৈষম্যের জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন রবীন্দ্রনাথের নানান লেখায় বারবার সমৃদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র একজন পত্রলেখক-কবি পরিচয়ে বাঁধলে এবং তাঁর সাহিত্যকর্মকে শুধুমাত্র ভাষা-সাহিত্যের পাঠ্য বলে বিবেচনা করলে অন্যায় হবে। দেশ বিদেশের যেকোনো সভ্যতা-অনুগামী, সমাজ-চিন্তক, শিক্ষানুরাগী ছিন্নপত্রাবলী পাঠে সমৃদ্ধ হবেন এ কথা প্রশ্নাতীতভাবে সত্য। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, প্রকৃতি-প্রেম, সমাজ আদর্শ এবং গ্রামোন্নয়নের তত্বগুলিকে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কোন সুশীল পাঠক অনুধাবন এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলে আজ থেকে এক হাজার বছর পরেও মনোযোগ ভরে রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে। 

 

 

 

 

গ্রন্থ ঋণ

 

1.     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর           ছিন্নপত্রাবলী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভা,  কলকাতা, 2004

2.     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর          সঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, 2008

3.     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর          রাশিয়ার চিঠি, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, 2013

4.     দীপেশ মন্ডল             ছিন্নপত্রাবলীতে সমাজ চিত্র : একটি প্রসঙ্গ ও বিশ্লেষণ,             

                                      দে পাবলিকেশন্স, কলকাতা, 2020 

5.     গোপাল চন্দ্র রায়         রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, 1980 

6.     নীহাররঞ্জন রায়           রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট

   লিমিটেড, কলকাতা, 1963 

7.     সত্রাজিৎ গোস্বামী        ছিন্নপত্রাবলী ও রবীন্দ্রনাথ, জয়দুর্গা লাইব্রেরী, কলকাতা, 2011 

8.     নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী        সাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, 1991

9.     তপন কুমার মুখোপাধ্যায়     রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্য ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী,

  প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, 2021

 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ