রবীন্দ্র পাত্রপাত্রী ও যন্ত্রযুগের প্রথমবেলা
উনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বিশেষ করে বাংলায় বিজ্ঞানের
কর্মকান্ড যেন কিছুটা শীতঘুমে ছিল। অর্থাৎ ভিতরে ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। বিংশ
শতাব্দীর শুরু থেকেই সে সজাগ হয়ে কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ভাগীরথীর দুই তীরে
বিজ্ঞানের বরপ্রাপ্ত কলকারখানারা সজোরে-সবলে অঙ্গবিকাশ ঘটাতে শুরু করে। বিজ্ঞানের
মন্ত্র সেই সময় শ্রম করবার শক্তিকে সহজেই নিজের বশে আনতে পারে। শুধু কলকারখানা নয়,সাধারণ
মানুষের জীবনেও বিজ্ঞানের দূতেরা না না ভূমিকায় প্রবেশ করতে আরম্ভ করে।ফলে রেডিও,সিনেমা,টেলিফোন এরোপ্লেন এবং যন্ত্রচালিত শকটের
দৃশ্যে ও ভাষ্যে কলকতাবাসীরা ক্রমশ তাদের চমকে ওঠার মাত্রাকে কমিয়ে এনে এগুলিকে
স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করতে শিখে যায়।রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন বিজ্ঞানের এই গতিশীল
প্রকৃতির প্রতি নিবিড় ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছেন। তাঁর গল্প উপন্যাসেও বিজ্ঞানপুষ্ট
সময়ের নানা খুঁটিনাটি বিষয় বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় ধরা দেয় কারণ প্রযুক্তি সরাসরি
প্রভাব ফেলে সেই সমাজে যেখানে তাঁর সৃষ্ট পাত্রপাত্রীরা সুখদুঃখ হাসিকান্নার ঝোঁকে
নিত্য দোলায়িত।
আমি এই প্রবন্ধে
আলোচনা করতে চাই রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কয়েকটি উপন্যাসে (কালানুক্রমিক বিচারে
নয়) বিজ্ঞানজাত আধুনিক কালের ছবি কীভাবে আঁকা হয়েছে তাই নিয়ে। বলাই যায়,সেই
যুগে রবীন্দ্রনাথের মতো আর কোনো লেখকের লেখায় সমসাময়িক কাল অত সূক্ষ্ম ও গভীর
ব্যঞ্জনায় ধরা দেয়নি। সেই সময়ে তথাকথিত আধুনিক বলে যারা পরিচিত ছিলেন যেমন বুদ্ধদেব
বসু,অন্নদাশঙ্কর রায় বা অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত,তাদের লেখাতে রেডিও,টেলিফোন বা মটর গাড়ির কথা এসেছে
ঠিকই কিন্তু সেসব কথায় যেন চোখের দেখাটাই বড় হয়েছে,দেখার
ফলাফলটা আলোচ্য হয়নি। অর্থাৎ চোখে দেখা জিনিসগুলি তাদের মনে গভীর কোনো লক্ষণে
চিহ্নিত হয়নি। সেই হিসাবে
রবীন্দ্রনাথ মস্ত বড় ব্যতিক্রম।বিজ্ঞানের বিচিত্র আবিষ্কারের ধাক্কা গুলো তাঁর
দার্শনিক মনকে বিচলিত করেছে এবং সেই বিচলনকে তিনি সুচারুভাবে সঞ্চারিত করেছেন
উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর মধ্যে। তাই 'চার অধ্যায়' উপন্যাসে অখিল নামের কিশোরটিকে আমরা কাগজ নিয়ে এরোপ্লেনের নমুনা বানাতে
দেখি। চার অধ্যায়' এর কথা বললাম বটে কিন্তু প্রথম এই প্রবণতা
প্রকটভাবে ধরা পড়ে 'দুই বোন' উপন্যাসে। বিজ্ঞানের
প্রসাদধন্য যে আধুনিক কালকে সেই গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে,তার
সুখদুঃখের মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা নিতে দেখা যায় প্রযুক্তির উপাচারকে। এছাড়া
চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ বোঝাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছেন অনেক
জায়গায়। 'দুইবোন' থেকেই নমুনা দিচ্ছি।
দুইবোন'এ
দেখি ইঞ্জিনিয়ার শশাঙ্ক একটি কাপড় কাচা কল(অর্থাৎ ওয়াশিং মেশিন) তৈরি করেছে। ওর
স্ত্রী যন্ত্রটির তারিফ করলেও ওতে বস্ত্র প্রক্ষালনে অনুৎসাহী। এখানে রবীন্দ্রনাথ
বুঝিয়ে দিলেন শর্মিলার মনটিতে আধুনিক সময়ের চঞ্চল হাওয়া তেমন লাগেনি।ও অভ্যস্ত
চালের বাইরে যেতে নারাজ। উল্টোদিকে শশাঙ্কের শ্যালিকা ঊর্মিমালা স্বভাবে বিপরীত। সে 'একালের' মেয়ে। তাই ও 'রেডিওতে
কান পাতে'। বিজ্ঞান যে একটা
গতি দিয়েছে তার বেগে ঊর্মিমালা সদা চঞ্চল। রবীন্দ্রনাথ ঊর্মিমালার স্বভাব বোঝাতে
রেডিওর প্রসঙ্গ আনলেন এটা বোঝাতে যে সে প্রযুক্তির দানকে উপেক্ষা করে না। আবার 'কানপাতা'
শব্দবন্ধের প্রয়োগে তার অস্থিরমতি প্রকৃতিরও একটা আভাস দিলেন। কান
পাতা আর শোনা এক জিনিস না। তাৎক্ষণিক কৌতূহলেই মানুষ কান পাতে আর শুনবার জন্য মনের একাগ্রতা প্রয়োজন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে
ঊর্মিমালা এখনও পরিণত হবার অপেক্ষায়।
ঊর্মিমালা
কনভেন্টে পড়েছে,'ইংরেজিতে ওর বিদ্যে পাকা'। ইংরেজি শিক্ষাই হয়তো ওর আদবকায়দার মধ্যে একরকম মসৃণতা দিয়েছে(তবে সব
সময় এমন ঘটেনি যেমন 'শেষের কবিতা'র কেটি
চরিত্র)। সেকেলে ধ্যানধারণা ধুয়েমুছে ঊর্মিমালা পুরো দস্তুর আধুনিকা। নইলে
জামাইবাবুর কাছে আব্দার করতে পারত না,"মোটরে করে উধাও
হয়ে যাব।"এখনকার ভাষায় যাকে বলে লং ড্রাইভ। এমনকি মোটর যাত্রার শেষে ফিরে এসেও
''ঘন্টায় পয়তাল্লিশ মাইলের বেগ রক্ত থেকে এখনও কিছুতে থামতে
চায় না''। ঘন্টায়
পয়তাল্লিশ মাইলে ছোটা এই মটর গাড়িটি বিজ্ঞানের অনিবার্য বাহন রূপে কাহিনীতে
উপস্থিত হল। এ এমনই এক বাহন যা শশাঙ্ক ও ঊর্মিমালার কাছে চরম উদ্দীপনার অথচ
শর্মিলার জীবনে সেটাই যেন মূর্তিমান উৎপাত।
কখনো শ্যালিকার
মনোযোগ আকর্ষণ করতে ''পেনসিলে দাগ দেওয়া খবরের কাগজ মেলে দেখায়
বিজ্ঞাপনে চার্লি চ্যাপলিনের নাম''। গল্পে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নায়কের নাম টেনে এনে একমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ চিনিয়ে দিলেন সেই
সময়কার যুবক যুবতীদের মনে আকর্ষণের কেন্দ্রটিকে।
শশাঙ্ক নিজে
বিজ্ঞানের সাধক হয়েও প্রযুক্তিজাত যন্ত্রের প্রতি হয়তো ততটা কৌতূহলী না,অথচ
শ্যালিকার উৎসাহে তাকেও যোগ দিতে হয়।সেই জন্য সে ও একসময় রেডিওতে কান পাতে।এমনকি
মনোরঞ্জনের খাতিরে তাকে ''এরোপ্লেন ওড়া দেখবার জন্য একদিন ভোরবেলা দমদম পর্যন্ত যেতে হল''।বিজ্ঞানের কৃপায় কলকব্জার এত উন্নতিসাধনে মানুষের
চোখে ধাঁধা লেগে যায় এবং প্রকৃতির রূপ সেই চোখে কি ঝাপসা হয়ে আসে?নইলে
ভোরবেলা নদীর বদলে এয়ারপোর্ট সন্দর্শনে কেন তারা যাবে!যন্ত্র দানবের খলপ্রভাবের
আভাস অগোচরে যেন দেওয়া হয়ে যায় এর মধ্যে দিয়ে।
'শেষের কবিতা 'য় অমিত ও লাবণ্যর সাক্ষাৎ লগ্নটি নিশ্চয়ই মনে আছে? শিলং
পাহাড়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছিল অমিত।একটি মোড়ে উল্টোদিক থেকে আরেকটি গাড়ি আচমকা এসে
পড়ায়,ব্রেক কষতে কষতে অমিতর গাড়িটি কোনোরকমে গিয়ে পড়ল তার
উপর।"পরস্পর আঘাত লাগল,কিন্তু অপঘাত ঘটল না। অন্য গাড়িটি
খানিকটা এগিয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল।"সে ই অকুস্থলে অমিত-লাবণ্যর প্রথম
দর্শন ঘটে। যন্ত্রচালিত নিয়তির উপর ভর করে রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে দুটি অবিস্মরণীয়
চরিত্রের গতিপথ নির্ধারণ করে দিলেন।'গোরা'র শুরুতে পেয়েছিলাম ঘোড়ায় টানা ঠিকা গাড়ির দুর্ঘটনা। চরিত্রের বিচারে সে
অনেক নিরীহ,কারণ ঘোড়া যন্ত্র না। কিন্তু মটরচালিত যান
অন্ধশক্তিনির্ভর। যন্ত্রের প্যাঁচে পড়ে মানবীয় সম্পর্কের গ্রাফে কীরকম অদলবদল ঘটে
তারই পরীক্ষায় যেন নেমেছিলেন স্রষ্টা। বর্তমান কালে মানবীয় সম্পর্কগুলি কি অতিরিক্ত
প্রযুক্তিশাসনের কবলে এসে পড়ছে না?
'যোগাযোগ'এর নায়িকা কুমুদিনীর শ্বশুরবাড়ির ছাদটা তার একটা আশ্রয়স্থল। যখনই কোনো দুঃখ
ওকে আঘাত করে তখনই ও ছুটে আসে ছাদের নিরালায়। সেই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা
উল্লেখ্য। ছাদের একটি বিশেষ স্থান থেকে আকাশে উঁচু হয়ে থাকা একটি কারখানার চিমনি
দেখা যায়। সেই চিমনি সারাদিন ধোঁয়া উদ্গীরণ করে। কুমুর কাছে "সমস্ত আকাশের
মধ্যে ঐ কেবল একটি যেন সজীব পদার্থ,কোন একটা আবেগে ফুলে ফুলে
পাক দিয়ে উঠছে"। অবাক হতে হয় রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনায়। ধোঁয়া তো এখানে কেবল
ধোঁয়া নয়। ভোগবাদের প্রসারের অনিবার্য ফল হিসাবে অসংখ্য কলকারখানার উৎপত্তি। এইভাবে
দেখলে কারখানা নির্গত ধোঁয়া বিজ্ঞান-মন্ত্রপূত যুগের ভোগবাদের নঞর্থক ভাবকেই তো
ফুটিয়ে তোলে। কুমুর মনের বেদনার সাথে আকাশময় ছড়িয়ে পড়া করাখানার কালো ধোঁয়া যেন
কোথাও মিশে একাকার হয়ে যায়। আগুনে পোড়া কাঁচা মালের ধোঁয়াকে সেই মুহুর্তে মনে হয়
দুঃখের তাপে দগ্ধ কুমুর অন্তঃকরণ থেকে উদ্গত দীর্ঘশ্বাস।
বিজ্ঞানের
অগ্রগতিতে সংস্কৃতিরও অনেক পালাবদল ঘটে। 'মালঞ্চ' উপন্যাসেও তার আভাস পাই। দেখা যায় নীরজা ও আদিত্যর সাধের বাগানে নতুন
চারারোপনের উৎসবে গ্রামোফোনে বাজে 'দিশি-বিদিশি সংগীত'। একটি যন্ত্রের দৌলতে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে
পারছে বিদেশী সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্রনাথ তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন
যেন। প্রযুক্তির হাত ধরে সহজে আমদানি হওয়া বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব মনুষ্য চরিত্রেও
পড়ে।সব সময় সে প্রভাব সদর্থক নয়।তারই প্রমাণ পাই 'শেষের কবিতা'র কেটি-র চরিত্র বিন্যাসে।নইলে কেটির পক্ষে ইংরেজি বলা, ছেলেদের সঙ্গে অবাধে মেশা বা সিগারেট খাওয়া কোনোটাই অত সহজ হত না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর
শেষ পর্বের উপন্যাসগুলির মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শাসনে
আমাদের জীবনে যে পরিবর্তন ঘটছে,স্বভাব চরিত্রে যে নতুন রঙ লাগছে তাকে
সাহিত্যের অঙ্গনে স্বীকৃতি জানানো। এইখানেই সার্থক স্রষ্টার কালোপযোগিতা।
0 মন্তব্যসমূহ