হনুস্মৃতি ও হনুম্যানকাইন্ড
‘হনুম্যানকাইন্ড
মানে কি হনুমানকান্ড?’ ধৃষ্ট লেখকের প্রশ্নের উত্তরের তিনি
হাসলেন। তারপর মুখের চুরুটটা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরিয়ে বললেন ‘নো।
ইট’স্ জাস্ট আ সিঙ্গল স্টেপ অফ আ পোয়েট, আ জায়েন্ট লীপ
টু হনুম্যানকাইন্ড’
‘স্যর, কবিতাটা
শুরু হয়েছিল কিভাবে?’
‘শুরুটা
গাছেই হয়েছিল। পরমাসুন্দরী এক হনুমতীকে দেখে অত্যন্ত পছন্দ হওয়ায় নিদ্রা-আহার ভুলে
সবে একটা অশ্বত্থ গাছে সংসার বাঁধার আয়োজন করছি, এমন
সময় কি থেকে কি ঘটে গেল। আমার মুখ থেকে বিচিত্র এক শ্লোক বেরিয়ে এল- ঊর্ধ্বমূলম্
অধঃশাখম্ অশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্ …এই সংসাররূপ বৃক্ষ নাকি অশ্বত্থ, তার
নাকি ঊর্ধ্বে মূল, ডালপালা নীচের দিকে। নিজের কথা শুনে আমার
নিজের মাথাতেই হুড়মুড়িয়ে আকাশ যেন ভেঙে পড়ল। কোনটা ঊর্ধ্ব, কোনটা
অধঃ বুঝতে না পেরে প্রবল অধঃপাতে যেতে লাগলাম আমি। তখন হনুমতীই আমায় বাঁচাল।
প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ল্যাজ ধরে এক অতিমানস বিবর্তনের চাপ থেকে আমায় বাঁচাল। তখন
যদি আমার পা মাটিতে পড়ে যেত তাহলে বিবর্তনের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত…’
‘কিন্তু
স্যর, কবিতাটাই তো বললেন না…’
‘কবিতাটা
অত সহজে কয়েকটা লাইনে উচ্চারণ করে ফেলা যায় না। এটা তেইশ লক্ষ বছর ধরে লেখা হচ্ছে।
আমাদের টাইমস্কেল তোমরা ধারণাও করতে পারবে না। তোমাদের কবিদের ক’দিন লাগে একটা
কবিতা ধারণ করতে? ফুস করে শুরু হয়ে ফস করে শেষ। ওই তোমাদের
লর্ড আলফ্রেড টেনিসন চেপেচুপে রেখে আঠারো বছর ধরে একটা কবিতা লিখেছিলেন –‘ইন
মেমোরিয়াম’, তারপর আর কই তেমন! আর তেইশ লক্ষ বছর ধরে সেই
রামাপিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস জীবনের ভেতর দিয়ে আত্মার
অতলে আমার কবিতার ট্রান্সফর্মেশন, ট্রান্সেন্ডেনস, ট্রান্সলুমিনেসেন্স
হয়েই চলেছে। কবিতাটাই শরীর, আমি তার বসনের
মত। বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়…হায় কতবার আমার শরীরের বিনাশ হল, নতুন
জন্ম হল, মৃত্যু হল, পুনর্মৃত্যু
হল…কবিতাটা শাশ্বত হয়ে রয়ে গেল…ন হন্যতে হনুমানে শরীরে…’
‘স্যর, ওটা
হনুমানে নয়, ওটা হন্যমানে…’
‘থামো, ওটা
ট্রান্সক্রিয়েট হয়েছে, অপভ্রংশ হয়েছে তোমাদের রিমিক্স সংস্কৃতির
যুগে। এরকম আরো কিছু রিমিক্স ভার্চুয়াল-প্রস্তরযুগ পেরিয়ে ওটা ‘হানিমুনে’ হয়ে
যাওয়াও বিচিত্র নয়’
‘আপনি
গিয়েছিলেন স্যর, হানিমুনে’?
‘হ্যাঁ, সেটা
মানহানিমুন’
‘মানে
আর কি! আমাদের হানিমুনের সীন চুরি করে ক্রৌঞ্চমিথুনের লীপে বসিয়ে নিষাদ এনে
রিমিক্স করে প্রথম শ্লোকের দাবি করে বসলেন এক ডাকাত। একেবারে দিনে ডাকাতি! সে নাকি
রত্ন, রত্নাকর…’
‘মামলা
করলেন না?’
‘ভাবনা
চুরির কি প্রমাণ দেব, বলো তো? রামের
কাহিনি চাপিয়ে, আমাকে এক কোণে চিরজীবি, চিরকুমার
করে ফেলে দিয়ে পুরো চব্বিশ হাজার শ্লোকের বইটাই ঝেঁপে দিল। ছেপে দিল রামায়ণ নামে।
প্যারাফ্রেজিং, রিমিক্স, ট্রান্সক্রিয়েশন
করে ওর ভেতর থেকে হন্যমান আত্মাটাই পালটে দিল’
‘এখানে
হন্যমান মানে কবি কি বুঝাইতে চান?’
‘হন্যে
হওয়া হনুমান’ একটু গা চুলকে বললেন ‘ কি করি নি বলো দেখি ওতে! সূর্যের থেকে সমস্ত
বিদ্যা শিখে এসে মানুষকে দিয়েছি, নারদের থেকে
মার্গসঙ্গীত শিখে নতুন সঙ্গীতধারার সৃষ্টি করেছি, ভেষজবিদ্যার
পাহাড় তুলে এনেছি, অতিদর্পিত লঙ্কা জ্বালিয়ে দিয়েছি, লঙ্কাদহন
সারং রাগের সৃষ্টি করেছি। গোটা উত্তরাপথ আজ কিছু না পড়লেও রামায়ণের
সুন্দরকান্ডটুকু পড়ে…’
‘এতকিছুর
পরেও এই যে এইভাবে আপনার সৃষ্টি কেড়ে নেওয়া হল, এতে
বিরাট ধাক্কা কি লাগে নি আপনার বুকে?’
‘সৃষ্টি
যে করে, তার ধাক্কা লাগে না। তাকে আহত করা যায়
না। সব কিছু কেড়ে নিলেও সবই তার থাকে। পূর্ণ থেকে পূর্ণ গেলেও পূর্ণই থাকে।
তত্ত্বদর্শীর কাছে উৎপত্তি বা বিনাশ বলে কিছু হয় না। নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো
বিদ্যতে সতঃ উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ…’
‘স্যর, এ তো
গীতার কথা…’
‘এও
প্রথমে ‘হনুগীতা’ নামে রচিত হয়েছিল। পরে ‘হ’ উচ্চারণ হারিয়ে ‘অনুগীতা’ নামে
মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে সেটিকে রাখা হয়, তারপরে
মহাভারতের কাহিনীবিন্যাসের সময় ভীষ্মপর্বে ‘গীতা’ নামে রাখা হয়। সেখানেও অর্জুনের
রথের চূড়ায় বসে শ্রীকৃষ্ণের মুখে রিফ্লেক্ট করে আমিই সবটা বলেছি…’
‘এক্সেলেন্ট
স্যর। কিন্তু আজকালের সাহিত্য নিয়ে যদি কিছু করেন। মানে একটা উদ্দাম যৌবনের রগরগে
প্রেমকাহিনী যদি আপনাকে নামাতে বলা হয়…’
‘নামাতে
বলবে? কোথায় নামাব?’
‘কোমরের
নীচ…না…স্যরি স্যর…মানে গাছের নীচে…কদম্বতরুর নীচে…’
‘ক্ষীরকদম্ব
না রসকদম্ব?’
‘খাবার
নয়, স্যর। সত্যিকার কদম গাছের নীচে। লাইট, ক্যামেরা
রেডি। আপনি শুধু ডায়লগ ফেলে দিন। ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝাক্কাস মিউজিক রেডি আছে…’
‘মানে, সিনেমাটোগ্রাফি
লিখতে হবে আমায়?’
‘আজকাল
স্যর, ওটাই সাহিত্য। আর তেলমাখা বাঁশে বেয়ে
মঞ্চে ওঠা। রাজনৈতিক গণহত্যাকারী ধর্ষকামীদের হাত ধরে ওপরে উঠতে চাওয়া মানে নীচে
নামতে চাওয়ার চেষ্টা। লেখার আগেই হাজার-হাজার কপি প্রিবুকিং। বাঁধা কপি, বাঁধা
পুরস্কার। কপি-পেস্ট-টুথপেস্ট, টুকে পাশ করা ওই
সিনেমাটো-সাহিত্যিকদেরই আজ জয়জয়কার। এদের সৃষ্টির পেছনে আপনি কিভাবে থাকবেন? কিভাবে
কোন নৈতিকতায় ডিফেন্ড করবেন এদের?’
‘দিস
টাইম, ডিফেন্স ইস অফেন্স। সাহিত্য মানে নিজেকে
খোঁজা, নিজের ভেতরে-বাইরে ‘বৃহৎ আমি’কে খোঁজা।
আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিবাদ করা। ওই যে যখন ‘মনুস্মৃতি’ বাজারে
বেরিয়েছিল, আমরা তখন প্যারালেলী আমাদের হনুমান-সমাজে
‘হনুস্মৃতি’ লিখলাম। তাতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মনুর
বিধানে অন্যায় কোথায় কোথায়। এর সুদূরপ্রসারী ফল কি হল? মানুষেরা
এখনো কত বন্ধনে গন্ডিতে আটকে নীচে পড়ে রয়েছে। আর হনুমানেরা মুক্ত স্বাধীন হয়ে গাছে
গাছে উচ্চস্তরে বিরাজ করছে…’
‘স্যর, স্যর, এই হনুস্মৃতির
আলোয় ছোট্ট করে একটা উদ্দাম প্রেমকাহিনী হয়ে যাক। রূপনারায়ণের তীরে একটা ভাল
লোকেশন আছে…’
‘ঠিক
আছে। একটা ভাল বেল গাছ খুঁজে হনুমতীকে উঠতে বল। আমি একটা সিঙ্গাপুরী কলা খেয়ে
আসছি’
তারপর তিনি
অন্তর্হিত হলেন। বিহান-গোধূলি-দিন-রাত্রি-মাস-বর্ষ পার হয়ে গেল। তিনি ফিরলেন না।
কাছে-দূরে বসন্তের কিংশুক-মন্দারের রূপলাবণ্য ক্ষয় হয়ে গেল, শরতের
সপ্তপর্ণীর তরুক্ষীরগন্ধ ক্ষয় হয়ে গেল। তিনি ফিরলেন না।
তারপর একদিন যখন
তার অসমাপ্ত সাক্ষাৎকার ফেলে দেওয়ার উপক্রম করছেন লেখক, তখন
তিনি সহসা বাতাস চিরে আবির্ভূত হলেন। সঙ্গে হনুমতী। বিষন্নমুখে তিনি বললেন ‘তোদের
এই হাল আমলের সাহিত্য আমার চিরজীবন এবং চিরযৌবন ধারণের উপযুক্ত নয়’
‘কেন
স্যর? কি হল স্যর?’
‘বেলের
শরবতে স্বাদ নেই। কলায় কিচ্ছু নেই। তেলমাখা বাঁশে জোর নেই। কোথাকার গল্প কোথায়
গিয়ে দাঁড়াবে? কিভাবে দাঁড়াবে? সমুদ্রে
তরঙ্গ নেই। চকমকি পাথরে আগুন জ্বলে না। এসব কি আর সাবস্টিটিউট দিয়ে হয়? আমি
ভ্রমর হয়ে পদ্মের মধু খেতে গিয়ে যদি দেখি, মধুর
বদলে ইসবগুল জুটছে, তবে অবস্থাটা কি হবে একবার ভাব। কিম্বা
আমি গোলাপের গন্ধমাখা আপেলের জ্যুস খেতে গিয়ে যদি দেখি, গোলাপের
বদলে জোলাপ জুটছে, তাহলে কি হবে? ভাব।
ভাব, শুধু ভাবা প্র্যাকটিস করলে হবে না। ভাবের ঘরের এই চূড়ান্ত
অভাবকে কিভাবে মেটানো যায়, সেটা ভাব’।
‘স্যর, কোনোভাবে
ঠিকা-ঠ্যাকা দিয়ে কি এই মুমুর্ষু সাহিত্যটা একবার দাঁড় করানো যায় না? অন্তত
একবার?’
হনুমতীর দিকে
একবার তাকালেন তিনি ‘কি গো, একবার ম্যাজিক
রিয়েলিজম ট্রাই করবে নাকি?’
‘হুম।
তা আমায় কি করতে হবে?’ হনুমতী ভ্রুভঙ্গিতে সামান্য বিরক্তি।
‘কিচ্ছু
নয়। শুধু হ্যাজাতে হবে। শুধুই হ্যাজাতে হবে। কাল্পনিক কর্মের ধাঁধায় ঘুরেফিরে
পাঠককে চোখবাঁধা কলুর বলদের মত ঘুরিয়ে বিভ্রান্ত ও আধমরা করে দমাস করে বাস্তবের
মাটিতে এনে ফেলতে হবে। পতনের আঘাতজনিত ব্যথা যতক্ষণে সে অনুভব করবে, ততক্ষণে
আমরা তরতরিয়ে প্রেম করতে করতে গাছের মগডালে উঠে যাব’।
‘আর
এই লেখকের কি হবে’?
‘কি
আবার হবে? এসব ক্ষেত্রে যা হয় তাই হবে। ভাল করে
সীটবেল্ট বেঁধে প্রুফ দেখতে বসবে’।
‘তারপর’?
‘তারপর
আবার কি? গাছের নীচে ডারউইন সাহেব আর মেন্ডেল
সাহেব আসবেন। আমাদের বিবর্তন দেখে ডারউইনের মাথার আবর্তন হবে। আর মেন্ডেল বংশের
গতি মাপবেন। ততক্ষণে আমরা হুড়হুড় করে হনুম্যানকাইন্ড মানে ম্যানকাইন্ডের বন্যা
বইয়ে দেব’
‘বন্যা
মানে’?
‘এই বিপুল সৃষ্টিস্রোতই
বন্যা। বহুধা বিভক্ত হয়ে যাবে এই স্রোত-
ঔং
হ্রীং ওল্ডুভাইগর্জে অস্ট্রালাঃ চ টাইরলে টাইরলাঃ
ডেনী
ডেনিসোভ্যাম নিয়ান্ডারথাল জার্মানকন্দরে
যবদ্বীপে
ইরেক্টাসাঃ টুর্কানাহ্রদে হ্যাবিলিসাঃ
ডিমানিসে
জর্জিকাসাঃ চ বাল্টিকে গ্রেসিওপিথেকাসাঃ
আফারে আর্ডিপিথেকাসাঃ
চ সাহেলে সাহেলান্থ্রোপাসাঃ…’
‘এ তো বিপুল তরঙ্গ!!
রুধিবে কে’?
‘রুধিবে কেন? ইহা চলিবে। চলিতেই
থাকিবে। চলিতেই থাকিবে’।
0 মন্তব্যসমূহ