সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সজ্জ্বল দত্ত:গ্রন্থজগত:এ উৎসর্গ ... সর্বস্ব ... সব

 


"এ উৎসর্গ ... সর্বস্ব ... সব" 


  

 

জ্বলন্ত চিতার পাশে একা একা বসে ও কে! ও কি উন্মাদ? ... তান্ত্রিক? ... একটু আগে যখন সুবাসিত চন্দনকাঠে সাজানো হচ্ছিল  চিতা, তখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মৃত শরীরের দিকে, এক-আধবার শরীর ঝুঁকিয়ে যেন বুক ভরে টেনে নিল সাজানো কাঠের গন্ধ! ... এই মুহূর্তে ওর শূন্যদৃষ্টির সামনে শুধু দাউদাউ জ্বলতে থাকা আগুন। নিঃশব্দে ভস্ম হচ্ছে কোনো নশ্বর শরীর। ... কার শরীর? ... সামান্য শরীর আগুনে ভস্মীভূত করার জন্য ব্রহ্মাণ্ডের কোন্ দৈব-জঙ্গল থেকে নিয়ে আসতে হল এমন সুগন্ধি চন্দনকাঠ! ... কে ওই পোড়া দেহে? কে উন্মাদ? 

 

             " অগ্নিহোত্রী হিতায় চ মানবেকম্ 

              সো অহম্ সো অহম্ সো অহম্ "। 

 

     আমি। আমি। সর্বকালে সর্বযুগে। আমি অকৃত্রিম, অচঞ্চল, সনাতন। আমি মন্ত্র দেওয়া ঋত্বিক, আমি নিত্য হোমের সাগ্নিক। আগুনে দগ্ধ হলেও উড়ে যাই না, জলে মগ্ন হলেও ধুয়ে যাই না। সৃষ্টির আদি থেকে ওই বিরল চন্দনগন্ধ মাখা আমার ভস্মাস্থি সযত্নে রক্ষিত এক সোনার কলসে। যা শ্রেষ্ঠ যা পরম-প্রধান আমার অস্থিভস্মের প্রতিটি কণিকা জুড়ে সেই প্রেম , সেই কীটদষ্ট ভালোবাসা-টান। ... ওই আশ্চর্য  উন্মাদ  কী করে দখল নিল সোনার কলসটির?  মাঝেমধ্যে স্পর্শ করে, পরিপূর্ণ বাতাস টেনে গ্রহণ করতে থাকে গন্ধ আর আপনমনে লিখতে থাকে : 

 

 "অন্ধ জাগে অন্ধকারে দীর্ঘ নিদ্রা শেষ। 

  প্রিয়ভাষ্য গরিমাশূন্য , ছিদ্রহীন প্রাকার 

  দ্যাখে কাঁদছে আলো , তরল জ্যোতির ফোঁটা 

  গড়িয়ে পড়ছে ,  নক্ষত্র হোমাগ্নির প্রিয় ... 

 

  এ হীন চত্বরে ফোটে লাল ফুল , দীর্ঘ বেণী পিঠে

  উজ্জ্বল শরীর ত্বক কিশোরীর -- ও অন্ধ এসো ,

  ফুল বাসো ভালো , সুবাসও ... , এসো 

  ঢালো রস - আদিরস , সোমরস শিরা ছিঁড়ে দেহে "

 

              ছোট্ট এই কীট তবে কোথা থেকে এল ? কোন্ গতিপথে এসে দেহপোড়া অস্থিভস্মের মধ্যে ঢুকে গুটিগুটি ঘুরে চলেছে এদিক-ওদিক? ... স্থিরদৃষ্টি মেলে সেইদিকে তাকিয়ে উন্মাদ। ... কী দেখছে ? কিছু কি খুঁজছে ? ...   না রে বাবা , না , কিছু বিশ্বাস করে বসে আছে যে ! কে তাকে টলায় ? সে যে গুঁড়ো গুঁড়ো ছাইয়ের উৎসে সূর্যের আগুন দেখছে ! দেখছে স্পর্শ , চুম্বন, তীব্র হলাহল, কোন্ সুদূর মঙ্গল বৃহস্পতি কিংবা শনির বলয় থেকে কীট হয়ে নেমে আসা পৃথিবীর তলদেশে প্রত্যন্ত পাতালমুখে পলকে পৌঁছে যাওয়া দুঃখ যন্ত্রণা মনখারাপী ব্যথার অনিবার্য নিয়তি ! ... ভস্ম নিজে জানে তার ব্যপ্তি কতদূর ? উন্মাদও জানে নাকি এ অনুভূতির কোথায় সীমা ? তবে ভস্ম ও অনুভূতির কোন্ বন্ধন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ? কেন হঠাৎই হাতে উঠে আসে অনিবার্য এ' লিখন : 

 

      " শ্লেষে বিদ্ধ কোরো না আশ্লেষ আমি 

        জন্মলগ্নে অশ্লেষা নক্ষত্রে ছিলাম , দূর ! 

        এসব ভাবনা কেন , ভাবো কিছু ফুল , যথা 

        ঊর্বশীর শাড়ীর বুটি -- আজ ফুসফুসে 

        শ্লেষ্মা জড়ানো এই দিনে - এই রাতে 

        কষ্ট দূর করো হৃদয়ের , আধখানা পোড়া বিড়ি

        যথেষ্ট -- তৃতীয় বিশ্বে ধরাও আগুন , দ্যাখো 

        নিভে যাওয়া ব্ল্যাকহোল জ্বলে উঠবে 

        দ্বিগুণ খুশিতে -- ক্ষার ঝরে যাবে 

       পূর্ব পূর্ব শতাব্দীতে -- অব্দপূর্ব শব্দপূর্ব 

       নিস্তব্ধ শতকে তুমি টান দাও , 

       ব্যোম ব্যোম মহাব্যোম , টান দাও ! " 

 

   এই টান বরাবর হাঁটতে শুরু করলে একজন্মে ফুরোবে পথ? যদি বলি , এই টান অন্তরীক্ষমুখী তবে তার মধ্যে পৃথিবী কতটুকু ? কতটুকু আমি আর কত লক্ষ কোটি শাড়িতে বসানো বুটি ,ওড়নায় কুচি কুচি চুমকি? ... তার মধ্যে অস্তিত্ব খোঁজা! মস্তিষ্ক! হৃৎস্পন্দন! ... হোক না আগুনকীট সেও , তুচ্ছ কীট বই তো নয় ! 

 

      " বিন্দু আমি সহস্রময় হর্ষপ্রাণে 

        একটিমাত্র অগ্নিশিখার পরিত্রাণে "। 

 

... ভেতরে তারের ঝঙ্কারে একবার বাউলসাধনা , আর একবার মধ্যবিত্ত সংসার ! একই প্রিয় নারী আশ্চর্য বিক্রিয়ায় কখনো মাতৃরূপে কখনো বঁধু! 

 

  " মা চলেছেন মৃত্যু প্রেমিকের হাত ধরে নিশাকালে

    যথা অরণ্যচারী ব্যাধিনী ফেরে নগরভ্রমণ শেষে ;

    আমি আর্যপুত্র হয়ে দেখি তার চলে যাওয়া , বঁধু 

    কী প্রকারে সহ্য করি এ বিরহজ্বালা , বলো .... " 

 

   বলি তবে । ... কোনো দিব্যোন্মাদ যখন কবিত্বপ্রাপ্ত হয় , যখন তার বিশ্বাসের সমস্ত মিথ আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে সূক্ষ্ম শিল্পশৈলীর ভেতর দিয়ে , ছন্দে ছন্দভাঙায় উপমা অনুপ্রাসে তৃপ্তি অতৃপ্তিতে কলমের ডগা বেয়ে নামতে থাকে এই মহাবিশ্বের প্রেক্ষিতে , মানবাত্মার ক্রম বিবর্তনের যে কোনো একটি কার্য্যকারণ পূর্ণ অঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে, ... তখন তার সম্পূর্ণ সৃষ্টিকথনই যেন প্রতি সূর্যোদয় প্রতি সূর্যাস্ত জড়িয়ে ডুব দেয় একা কোনো মনোহর সরোবরে । তাপতৃষ্ণাহর সরোবর । ... তারও আগে যে কিভাবে ছুটেছে আর ছটফট করেছে সে অগ্নিচিতায় ! ... " সব রক্ত জ্ঞান বুদ্ধি মজ্জারস পিত্ত কফ জমা হল / মস্তিষ্কের কোটি কোটি কুঠুরীর আনাচে কানাচে - / ওঁ পঞ্চভূত , ভবিষ্যে হ্রীংকূট , আহা মহাব্যোম ... / 'খ'-পরা পরার্দ্ধকাল -- এই বর্তমান ভূয়ো -- ভুয়োদর্শী / নই তাই চর্চা করি নিবিড় নিবিড়তর বিশুদ্ধ অগ্নিকে । " .... 

 

   এইবারে শুধু শান্তি! স্বচ্ছ শীতল সে সরোবরে ভাসতে থাকে সৃজনশীল পৃথিবী । ভাসতে ভাসতে ইড়া পিঙ্গলা থেকে পদ্মের পাপড়ি খুলে রঙে রঙে ফুটতে থাকে প্রেম ! ... তোমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কিচ্ছু নয় তুমি। কত সহজ তোমাকে বোঝা!  " নহ মাতা , নহ কন্যা, নহ বধূ সুন্দরী রূপসী "! আকাশের মতো সহজ, প্রাণের মতো সহজ , তৃণের মতো সহজ , নিঃশ্বাসের মতো সহজ .... 

 

                

    আজ থেকে বছর কুড়ি আগে কবি মীরা মুখোপাধ্যায় 'অগ্নিকীট' সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন -- " ঠিক যেন মধুমতী সাধনায় উত্তীর্ণ সাধক মধুযামিনী যাপন করছেন দেবীর সান্নিধ্যে "। 

    প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বে প্রকাশিত মাত্র একুশ পাতার এই ক্ষুদ্র কাব্যপুস্তিকা পরিক্রমণে এটুকু পাঠকহৃদয়ে ভেসে উঠতে খুব বেশি ক্লেশের প্রয়োজন হয় না যে সৃষ্টিমুহূর্তে, সিদ্ধিলগ্নে এবং প্রলয়-প্রাক্কালে সন্যাসীপ্রতিম প্রেমিককবির কাছে এই সান্নিধ্যযাপন এই টান এই ধিকি ধিকি আকর্ষণী অগ্নিলাভা উজ্জ্বল সূর্যালোকের মতোই নিত্য নিয়মিত, যা নিছক অনুভূতি-মুহূর্ত নয়, যা চরাচর শূন্য করে, এক ও অদ্বিতীয় করে ক্ষুদ্র প্রাণশক্তিকে। কবি হয়ত সময়ভেলায় ভাসতে ভাসতে ক্ষয়ে যান, ক্ষীণ হয়ে আসে তার দৃষ্টি, কিন্তু এ' আলোর প্রতিটি ফোটনকণা প্রসারিত হতে থাকে নিঃসীমে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথে .... 

 

১ ) "একী সূর্য - কোটি সূর্য - সমুদ্র কই, 

                                       শুখা ভুখা সমুদ্র ! 

বুভুক্ষু বাতাস গরম অম্লগ্যাস - গান নেই - ওঁকার .."

 

২ ) " দ্যাখো কালাকাল পার হব সরল হাসিতে 

                                        ঋক মর্মে আছে , 

হৃৎপদ্ম ভেদ করে তখন টংকার লেগেছে সহস্রারে 

একটি একটি করে খুলে যাচ্ছে 

                                     ব্রহ্মকমলের পাপড়িগুলি

 

৩ ) "তুমি বিষয় ছেঁছে মন দাও টলটলে বিষে, 

দ্যাখো পুষ্প ছেড়ে অভ্রকীট তোমায় জানাবে তার                       

  অভীপ্সা ওই ফোয়ারার নীচে ..." 

 .... "তুমিও অমোঘ নিদ্রা মেনে মন দাও অভ্রকীটে, 

যার দংশন দংশিলে হৃদয়, জেনো 

                     সপ্তসূর্য জ্বলে ওঠে এক সত্ত্বা জুড়ে " 

 

৪ ) "... ফলে সব ভাসমান 

ভেসে ভেসে দু' শরীর ব্রহ্মাণ্ডের ঘাটে এসে 

                      স্থির হয়ে আছে ,        

জলকীট খেয়ে নিচ্ছে সব" - 

 

   স্তব্ধ হই , রিক্ত হই , নিঃস্ব হই , চেতনা নিষ্ক্রিয় হয়। মানবজীবন ও তার হৃদয়প্লাবিত করা অনুভূতির চাহিদা যা নিরন্তর ঊর্ধ্বমুখে আগুন ছড়ায়, যার কাছে আকাশের পরিসীমাও অতি দীন, অতি সামান্য, তার ক্ষুদ্রতা তুলনীয় ক্ষুদ্রতম এক কীটের সঙ্গে ! 

   প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল কবি মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতার অংশ --

 

 

  " আমি পোকা হয়ে বুকে হেঁটে তোমার নিকটে যাব

     প্রাগৈতিহাসিক নই, দৈত্য নই, কবি নই -- কীট "।

 

                                                    ( মণীন্দ্র গুপ্ত ) 

 

যে ধারায় এই অগ্নিময় কীটের ভেতরে প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল, তার কিছু অংশ তপ্ত লোহিত কণিকা হয়ে কখন ঢুকে পড়েছে রক্তে! সব উৎসর্গ, সর্বস্ব নিয়ে সাধক-রক্তপ্রবাহে অস্তিত্ব সে এভাবে জানান্ দেয় : "সকলেই জানুক আমি পরীপ্রেমে মাতোয়ারা/ তাই বাক্যে ফোয়ারা ছোটে - কর্মে চাঞ্চল্য"। ... এই সেই গূঢ় ভালোবাসা , যার আগুনের আঁচ পেতে 'জীবন্ত খুলিতে আমি ধারণ করেছি কৈলাস' , 'যার একদিকে হিমবাহ অন্যদিকে একাক্ষরী ওঁ , প্রেতেরা নৃত্য করে রাতঘুমে রেটিনার কোলে'। চাঁদ নেই , উত্তাপে ঋতুচক্র গিয়েছে থেমে। আমি কখন নিয়েছি শপথ পুতাগ্নি স্পর্শ করে , ... বহু বহু অগ্নিজন্মের শপথ, কয়েক হাজার শিশুনক্ষত্রে আকাশ আলোকিত করবার শপথ। হাঁটছি ... হাঁটছি ... হাঁটছি ... 

 

       " ঘুরে বেড়াই মহাবিশ্বের শিরায় শিরায় 

         প্রজ্জ্বলন্ত হচ্ছি আমি অগ্নিপীড়ায় " 

 

      

ভাঁটা পড়ে এসেছে সমুদ্রে। এবার ফেরা যাক। এই অমৃত-কবিতাকথা পড়তে পড়তে ঢেউয়ে ঢেউয়ে কতদূর চলে এসেছি শব্দ ঠেলে ঠেলে, খেয়ালই নেই। অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকা এই আগুনপোকাকে এবার অস্থিভস্মের ভেতর থেকে মুক্তি দেওয়া যাক। মুক্তি অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে, মুক্তি আকাশজোড়া নির্মলতার মধ্যে। ... কে তাকে ছোঁয়, কে আটকায় ! 

 

 " চক্র শেষ করো, আমি পরী নিয়ে রঙ্গে মজি 

যাতে সমাজপতি নাসিকাকুঞ্জন করে বলে রাম রাম

আমরাও রামগঙ্গা না বলে আশ্রমের ফুলবাগানে 

                                        এক হয়ে মিশে থাকব, 

আর সন্যেসীঠাকুর খুঁজে খুঁজে হয়রান হবে। 

জপআহ্নিক ত্যাগ করে দূষিত বায়ুর খোঁজে 

                                        নদীতীরে ছুটবে, 

আমরাও ক্রমশঃ আকাশের ফুল হয়ে যেতে থাকব,

ক্রমশঃ বিকিরণ ছড়াব, 

ক্রমশঃ ... 

 

   তবে বলি, কোন্ পাপী-পাঠতৃষ্ণা আমার যে ধরা দেয় না এ' ফুল? কোথায় বিকীর্ণ রঙ? কই সে কীটজড়ানো আগুন? পাঠে যতই নির্বন্ধন, নির্মুক্ত হওয়ার চেষ্টায় থাকি, সবই যে ধূ ধূ কালো, গাঢ় অন্ধকার। 

 

   " কালীর কথা বলুন "। জিজ্ঞেস করল কেশব। " কালী কালো কেন"? 

    শ্রীরামকৃষ্ণ : "দূরে আছে বলে কালো দেখায়। জানতে পারলে আর কালো নয়, তখন আলো"। 

 

   জান্ ওকে। ওরে পাগলা, জানার চেষ্টা কর। তুই পূর্ণ যুবাসাগর জান্ তোর যথার্থ চান্দ্রমাসে, জান্ তোর প্রতি দগ্ধকোষে, অযুত-নিযুত কাল ধরে, সমস্ত ক্ষয়ের আঙ্গিকে, সমস্ত অর্ধ-পূর্ণ চন্দ্র-সূর্য গ্রহণে, জানতে বুঝতে থাক এই স্বেচ্ছাপ্রবাহ অনুলোমে, প্রতি অঙ্গমনে। 

 

   ততক্ষণে আগুনপতঙ্গ-কবি, পুনর্ভবা সঙ্গীতা হে ভৈরবী, ভেসে যেতে থাকুক নিখাদ কোমল গান্ধারে

 

"মেধা সার, প্রজ্ঞা-রস, থকথকে প্রতিভার বিষ -- 

 তাতে জ্বালা দূর হবে, আহা! সুরে সুরে কিছুকাল 

 ভেসে যাওয়া যাবে, যেমন এ অধমপুত্র 

 ভেসেই চলেছে বিশ্বে দ্রবীভূত নিঃসঙ্গ স্রোতে!"  

 

   আর মহা কালধারায় ভাসতে থাকা রক্তমাংসের এই চিরন্তন প্রবাহে কোন্ ক্রিয়ালব্ধ সাধনফল-প্রাপ্তিযোগে উড়ে চলেছে পৃথিবী, সংসার, দেওয়াল, দালান, রাস্তা, গাড়ি, পুষ্করিণী ? সব নিয়ে সূক্ষ্মতম অনুভূতির আকাশ-ব্যপ্তিতে কিভাবে মিশে যাচ্ছে ক্ষুদ্র মানবঅস্তিত্ব? ... দূরে বিন্দুর মতো কিছু স্থির । ... স্থির ? কই , না তো ! রীতিমতো নড়েচড়ে। ... কী ওটা ? বস্তু ? দ্যুতি? অগ্নিময় ওই কি সিদ্ধ-প্রেমিকহৃদয়ের শেষ খণ্ড ? ... নাকি স্থিরই , ভুল দেখছি। ... শিলা বা দারুবিন্দু? ভূমি বা কাঠখড়, লোহা-তামা ? ... তবে এসো, খুঁজি জীবনভোর, কিংবা জীবন ছাড়িয়ে, জন্ম-মৃত্যু-ক্ষুধা-তৃষ্ণা-যৌনবোধশূন্য হয়ে, প্রাচীন সৃষ্টি থেকে আগামীর প্রলয়মুহূর্ত অবধি, ... আকারে নিরাকারে, অত্যুজ্জ্বলে অনুজ্জ্বলে, স্বাভাবিকে উন্মত্ততায় ...! 

 

       " জামদাগ্নি কামদগ্নি জঠরাগ্নি ,মূলে 

         প্রণয়াগ্নি অগ্রবর্তী জন্ম মৃত্যু কুলে "। 

 

   বহুজন্ম পেরিয়ে এলে মহাশূন্যে কবিজন্ম ! সঙ্গে পরিক্রমায় বরাবর পাশে পাশে অগ্নিপতঙ্গ-প্রণয়ে নিষ্কাম নির্ভার সে নিত্য সাধনসঙ্গিনী ... 

 

   " ... হে দৃশ্য ! দ্যাখো জন্ম কতদূর সরে চলে গ্যাছে, / কালরেখা, লালপর্দা ছুঁয়ে জন্ম মহাশূন্যে ভাসমান আজ। / মহাযোনী অন্ধকারে রজ:স্বলাহীন হয়ে ঊর্ধ্বমুখীন / প্রতীক্ষায় আছে এক জ্যোতিপুঞ্জ চেয়ে । " 

 

পথ অন্তহীন... ! অন্তহীন প্রেম... ! "অগ্নিশ্চ বাড়বানলে প্রজ্জ্বলিতা"। 

 

                                   

অগ্নিকীট : তপন ভট্টাচার্য : পুনরুত্থান :প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮ : পৃষ্ঠাসংখ্যা ২১ : কবিতাসংখ্যা ২৬


 







সজ্জ্বল দত্ত

(আলোচক)

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো আলোচনা। অগ্নিকীট কবি তপন ভট্টাচার্যর জাত চিনিয়ে দেয়। আলোচক কবি সজ্জ্বল দত্তর সমৃদ্ধ কলম সমৃদ্ধতর হোক।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক ভালো লাগা, সঙ্গে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ।

      মুছুন
  2. বাংলা কবিতার শত শত বছরের পরিক্রমায় শব্দের অতীত এক বোধের জন্ম হয়েছে। সেই বোধ অধিবাস্তব অতিচেতনকে আশ্রয় করেই। কবিতা বিষয়ে আমার পাঠ ও শিক্ষা অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু যখনই খন্ড কাল খন্ড সত্বাকে ছাপিয়ে ঋষিতুল্য উচ্চারণে কেউ সেই তুরীয় নির্গুণ মহাকালকে স্পর্শ করেন তখন তার আর তাঁর একার উপলব্ধি থাকে না। বিশ্বময় হয়ে যায়। সেই আত্মিক উত্তরাধিকার কবিতায় সাক্ষর রেখেছেন। জহর সেন মজুমদার ও শতবর্ষ অতিক্রান্ত রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কবিতার ধারা মনে পড়ায়। ব আংটি পড়ার আগ্রহ হচ্ছে।

    🙏 অনিন্দিতা মণ্ডল

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অত্যন্ত ভালো লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে । মনোযোগ দিয়ে পড়লেন , ভীষণই ভালো লাগা । পরে আরও আলোচনা হবে আপনার সঙ্গে এই অতুলনীয় কাব্যপুস্তিকাটি নিয়ে ।

      মুছুন
  3. অতিগভীর আলোচনা । বইটি পড়তে চাই ।

    উত্তরমুছুন
  4. অনেক ধন্যবাদ । আমার কাছে একটি আছে । যোগাযোগ করে জেরক্স করে নিতে পারেন একুশটি পাতা ।

    উত্তরমুছুন