পুরাণ হল হিন্দুদের প্রাচীন ধৰ্মীয় সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। বিভিন্ন ধরণের পুরাণ রয়েছে। এককথায় বলা যেতে পারে মহাবিশ্ব ও জীবজগত সম্পর্কীয় সমস্ত বিষয়ই পুরাণের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি তত্ত্ব, দেবদেবীদের কথা,ঈশ্বরের অবতার তত্ত্ব, রাজা, ঋষি প্রভৃতির বংশ পরম্পরার কাহিনি, ধর্মতত্ত্ব, পূজো- আচ্চা, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ,বৃত্তি ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই বিভিন্ন পুরাণ আলোকপাত করে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের দ্বারা পুরাণগুলি লেখা
হয়েছে। প্রত্যেকটি পুরাণ পরবর্তী সময়ে কারুর না কারুর দ্বারা পরিমার্জিত ও
পরিবর্ধিত হয়ে এখন আমরা যেরকম দেখছি সেই অবস্থায় এসেছে। আবার, পুরাণভেদে
রচয়িতাও ভিন্ন। সুতরাং পুরাণ কে লিখেছেন নির্দিষ্ট ভাবে কোনো একজনের নাম বলা যাবে
না। তবে পুরাণকারদের মধ্যে ব্যাসদেবকেই প্রধান ধরা হয়। মহাভারত রচনা শেষ হলে তিনি
পুরাণ রচনার কাজে হাত দেন। তিনি নিজে এবং তাঁর শিষ্যদের দিয়ে কিছু পুরাণ রচনা
করিয়েছেন।
পুরাণের সময়কাল নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। প্রত্যেকেই
নির্দিষ্ট যুক্তি দিয়ে সময় কাল দেখিয়েছেন। আবার বিভিন্ন পুরাণের রচনার সময়কাল ও
আলাদা। তাই নির্দিষ্ট করে পুরাণগুলি রচনার সময়কাল বলা সম্ভব নয়। তবে বলা যেতে পারে, মহাভারত
লেখা শেষ হওয়ার পরেই পুরাণ লেখা শুরু। বিভিন্ন লেখা থেকে যে সময়কাল পাওয়া যায় তা
মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ শতক থেকে শুরু করে দশম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত।
তবে বেশিরভাগ পাশ্চাত্য ও কিছু কিছু ভারতীয় পুরাণবিদদের মতে পুরাণ রচনার সময়
মোটামুটি খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে দশম শতকের মধ্যে। তবে অনেকে বলেন কৌটিল্যের(জন্ম
খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫ অব্দে) রচনায় পুরাণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই হিসেবে উপরের দাবী
খাটে না। আবার বায়ু পুরাণে পুরাণগুলিকে বেদেরও পূর্ববর্তী বলে দাবি করা হয়েছে। সব
দেখে পুরাণ রচনার সময়কাল বেশ গোলমেলে ব্যাপার মনে হয়েছে।
মহাপুরাণ ১৮টি, যথা -১) ব্রহ্ম, ২)পদ্ম, ৩)
বিষ্ণু, ৪) শিব, ৫) ভাগবত, ৬) নারদীয়, ৭) মার্কন্ডেয়,৮) অগ্নি, ৯) ভবিষ্য, ১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, ১১) লিঙ্গ, ১২) বরাহ, ১৩) স্কন্দ, ১৪) বামন,১৫) কূর্ম, ১৬) মৎস্য, ১৭) গরুড় এবং ১৮) ব্রহ্মান্ড। মহাভারতের স্বর্গারোহন পর্বে এবং হরিবংশে এই
অষ্টাদশ পুরাণের উল্লেখ আছে।
এই আঠারোটি পুরাণের মধ্যে শিবপুরাণ নিয়ে কিছুটা
আলোকপাত করা যাক।
শিবপুরাণ আঠারোটি মহাপুরাণের অন্যতম এবং সংস্কৃত
ভাষায় লিখিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এই পুরাণটি মূলত হিন্দু দেবতা শিব ও দেবী
পার্বতীকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও এতে অন্যান্য দেবদেবীর উল্লেখ রয়েছে।
শিবপুরাণে ১২টি সংহিতায় এক লক্ষ শ্লোক থাকার কথা
জানা যায়, তবে রোমহর্ষণকে পুরাণের জ্ঞান দেওয়ার আগে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব এটিকে
সংক্ষিপ্ত করেন। প্রচলিত লিপিগুলির একাধিক ও বিভিন্ন সংস্করণ দেখা যায়।
উল্লেখযোগ্য সংস্করণগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত সাতটি অধ্যায়, অন্য
জায়গায় ছয়টি অধ্যায়, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত পূর্বখণ্ড ও
উত্তরখণ্ড নামক অধ্যায়বিহীন দুটি অংশ দেখা যায়। অধ্যায়যুক্ত দুটি সংস্করণের
মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ও কিছু বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ
পুরাণের ন্যায় শিবপুরাণও দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদিত ও পুনঃপুন লিখিত হয়েছে। ক্লাউস
ক্লস্টেরমাইয়ের এর মতে সবচেয়ে পুরনো লিপিগুলো দশম-একাদশ শতকে রচিত। বর্তমানে
প্রচলিত শিবপুরাণের কিছু অধ্যায় চতুর্দশ শতকের পরবর্তীকালের রচনা বলে মনে করা
হয়। শিবপুরাণের বিষয়াবলির মধ্যে শিবসংক্রান্ত ঘটনাবলি, সৃষ্টিতত্ত্ব, পৌরাণিক
উপাখ্যান, দেবদেবীর সম্পর্ক, নীতিকথা, যোগ, তীর্থস্থান, ভক্তি, নদী, ভূগোল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে শিবের উপাসনা এবং
ঐতিহাসিক তথ্যাবলির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস শিবপুরাণ। শিবপুরাণের প্রাচীনতম অংশগুলোয়
অদ্বৈত বেদান্ত মতের দার্শনিক চিন্তার ছাপ পাওয়া যায় যা অনেকাংশে ভক্তির সঙ্গে
সম্পর্কযুক্ত।
শিবপুরাণ আঠারোটি মহাপুরাণের অন্যতম এবং সংস্কৃত
ভাষায় লিখিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এই পুরাণটি মূলত হিন্দু দেবতা শিব ও দেবী
পার্বতীকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও এতে অন্যান্য দেবদেবীর উল্লেখ রয়েছে। শিবপুরাণের
বিষয়বস্তুর মধ্যে শিবসংক্রান্ত ঘটনাবলি, সৃষ্টিতত্ত্ব, পৌরাণিক
উপাখ্যান, দেবদেবীর সম্পর্ক, নীতিকথা, যোগ, তীর্থস্থান, ভক্তি, নদী, ভূগোল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে শিবের উপাসনা এবং
ঐতিহাসিক তথ্যাবলির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস শিবপুরাণ। এই গ্রন্থের একটি অংশে, শিব মন, বাক্য
এবং কর্মের মাধ্যমে মানুষের দ্বারা করা পাপ সম্পর্কে বলেছেন। যার মধ্যে ৫ ধরণের
পাপ বর্ণিত হয়েছে যা অজান্তেই আমরা করে থাকি। এই পাপগুলি এড়াতে এই শাস্ত্রে
দেওয়া রয়েছে প্রতিকারও।
জেনে নেওয়া যাক এই পাপগুলি কী কী?
(১ )
মানসিক -- মনের মধ্যে ভুল চিন্তা ভাবনা করা মানসিক পাপের অধীনে আসে। আমরা অনেক সময়
এই ধরনের ভুল করে থাকি। আর আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্রিয়া নামটি হ'ল যোগ।
অতএব, প্রতিদিন আমাদের অবশ্যই ধ্যানের মধ্যে দিয়ে এই মানসিক যোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
(২)
বাচিক -- অনেক সময় কথা বলার সময় কোনও বলা কথা শ্রোতার উপর কী প্রভাব ফেলবে তা
আমরা খেয়াল করি না। কাউকে আঘাত করে এমন কিছু কথা বলাও তাকে বাচিক পাপ হিসেবে
বিবেচিত হয় শিব পুরাণে। সুতরাং কারও সঙ্গে কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে যে, আমাদের
কথাগুলি কোনও মানুষকে যেন কোনওভাবে তাঁর ভাবাবেগে আঘাত না করে।
(৩ ) শারীরিক
-- প্রকৃতি ঈশ্বরের স্বরূপ। আমরা প্রতিনিয়ত এই প্রকৃতিকেই নানা ভাবে ধ্বংসের মুখে
নিয়ে যাচ্ছি। গাছ কেটে ফেলছি, প্রাণী হত্যা করছি। অজান্তে এমন অনেক কাজ করছি যা
প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। তাই এই ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের
স্বার্থেই প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।
(৪ )
নিন্দা -- অন্যের নিন্দা করার অভ্যাস প্রায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে। আমরা
এমনকি নিন্দা করার সময় তপস্বী, গুরুজন, প্রবীণ ব্যক্তি সকলের বিরুদ্ধে
গিয়ে খারাপ কথা বলে ফেলি। শিবপুরাণ মতে, প্রবীণদের সর্বদা সম্মান করা
উচিত। যদি তাঁদের কাজে কোনও প্রকার ভুল হয়ে থাকে তবে তাঁদের কখনোই খারাপ কথা না
বলে, ভাল করে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।
(৫ )
ভুল সান্নিধ্য -- চুরি, হত্যা এবং ব্যভিচার পাপ, এই সমস্ত কাজের সঙ্গে যারা
যুক্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাও পাপের মধ্যেই পড়ে। এই পাপ এড়াতে মুনি ঋষিরা সৎ
সংগঠনের ব্যবস্থা করেছেন। যখনই কোনও সুযোগ আসবে বা সময় মতো একজন সৎ ব্যক্তির
সঙ্গে গিয়ে আলোচনা করা অবশ্যই উচিত। তিনিই সঠিক পথের দিশা দেখাবেন।
0 মন্তব্যসমূহ