সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

প্রদীপ চক্রবর্তী:প্রবন্ধ:অলখ নূপুর, দোহারীর আপেলখণ্ড কিংবা প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ভাবনাগুলো

 


 অলখ নূপুর, দোহারীর আপেলখণ্ড কিংবা প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ভাবনাগুলো ...

 



                       

এক .

 

অপ্রাকৃত লিঙ্গ অতিক্রম করে যায় বৃষ্টির নৈঃশব্দ্য

........................................................................

 

বাড়ন্ত বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে যখন মাত্রাতিরিক্ত গরম ও আদ্রতা অস্থির করে দিচ্ছে , সেই সময় তিনটি বই নিয়ে বা বলা চলে তিনটে শিরোনাম নিয়ে একটি স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন ভেতরে ভেতরে কেমন বিষাদের বৃষ্টি নিয়ে এলো | সেই কল্পিত বর্ষায় ভিজে গেলাম | স্তব্ধ হলাম | নির্বাক হয়ে মনের ভেতর থেকে একটি গান বেজে বেজে উঠলো | গানের কথাগুলো এই রকম --

" দেখনি কি পাথরেও ফোটে ফুল

ভুল করেও মধুর হয় যে ভুল |

 

দেখেছ কি বরষারও ফাঁকে ,

জোছনার চোখ জলে ভরে থাকে ,

দেখেছো কি সেই দুটি চোখ কিছু জানাতে ব্যাকুল ,

ভুল করেও মধুর হয় সে ভুল |

 

লোকে যারে মরীচিকা বলে ,

ভেবেছ কি তারও বুকটা যে জ্বলে |

জানো না কি ফল্গুরও রেখা ,

কখনো তো চোখে যায় নাকো দেখা

বোঝো না কি ঝড়ে ভাঙা তরী শুধু পেতে চায় যে কূল ,

ভুল করেও মধুর হয় সে ভুল "

 

গানটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা | সুরকার ,  গোপেন মল্লিক | গায়ক মান্না দে | সবরমতি সিনেমায় উত্তম কুমারের লিপে এ গান অনেকের শোনা | কিন্তু একটা দীর্ঘ সংকলন শেষ করার পর যে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে এই গানের কথাগুলো মনে এলো , তার একমাত্র কারণ , কোথাও যেন এই গানের কথার ইশারায় এই কবির কবিতাগুলো আমাকে সেই সুদূরপরাহত এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করালো | কবি , প্রশান্ত গুহ মজুমদার | তার স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলনটির নাম " ক্যাকোফোনি |" এই বইয়ে মোট তিনটি বইয়ের লেখায় সমৃদ্ধ | প্রথম অংশটির নাম " পেয়ালা ", দ্বিতীয় অংশের নাম

 " অপার ", এবং তৃতীয় অংশের নাম

" বেলাছোটর ক্যাকোফোনি "|

আসলে " ক্যাকোফোনি " হলো শ্রুতিকটুতা, স্বরের অনৈক্য , বেসুরো অবস্থা বা কর্কশ শব্দ | গ্রীক শব্দ phone থেকে আসা শব্দগুলো ইংরেজিতে শব্দ করছে | কেন ? কারণ ফোনে মানে " শব্দ " বা " কণ্ঠস্বর ", ক্যাকোফোনি এসেছে গ্রীক উপসর্গ kak এর যোগদান থেকে | সিম্ফনি  , একটা শব্দ যা শব্দের মধ্যে সাদৃশ্য বা চুক্তি নির্দেশ করে , যা phone এবং গ্রীক উপসর্গ syn - এর চিহ্ন , যার অর্থ একসঙ্গে | এর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করছে , euphony , একটি আনন্দদায়ক বা মিষ্টির ধ্বনির জন্য একটি শব্দ , eu - এর সাথে phone যুক্ত করে , একটি উপসর্গ যার অর্থ ভালো |

এটা ঠিক গেরামভারী পন্ডিতি নয় , বুঝে নেওয়ার প্রাথমিক চেষ্টা | সারাজীবন সাধু গদ্যের অবয়বে , যে কবিতার বিস্তার বিন্যাস বা প্রকরণের ভেতর যে কবিতার বিস্তৃতি , প্রশান্ত গুহ মজুমদারের তা কী শ্রুতিকটুতা ? তিনি কী জেনেশুনেই এই বিপরীত পথে প্রথম থেকেই হাঁটছেন ? ফুল বৃক্ষ পাহাড় ভ্রমণ নদী ঝর্ণা নিসর্গ সৌন্দর্য প্রেম মানবিক হৃদি সর্বস্ব আবেগ মনস্তাত্বিক জটিলতা বা প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য কবিতা বয়নের পথ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে মরুভূমির অন্তহীন বালুরাশি আর তৃষিত আত্মার রক্তাক্ত শত বেদনার ঊষর প্রতিকূল পথেই কী তার কবিতার যাত্রাপথ ? কবির মোটো কী ? তার জীবনদর্শন ? তিনি কী বিষয়অভিমুখী না হয়ে বিষয়হীন শাস্ত্রহীন চলার বেদনাকেই পাথেয় করে নিয়েছেন ? আরও হাজারো এক প্রশ্ন নিয়ে , প্রশান্তকে পড়তে পড়তে আমি পৌঁছে যাই অমোঘ কিছু ব্যতিক্রমী ভাবনায় !

প্রায় বছর দশেক আগে , তার " কাহাদের কথা " বইটির ওপর আমি দীর্ঘ একটি গদ্য লিখেছিলাম , যেটি আমার প্রথম গদ্য গ্রন্থ , " স্বপ্নের জেহাদি ও অন্যান্য গদ্যে " রয়েছে | বছর দশেক পর তার এই স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলনটির কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এবং আমার পুরোনো গদ্যটিকে নিয়ে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম , প্রশান্ত আরও জটিল বা কঠিন বা অনড় বা নড়বড়ে বা পুনরাবৃত্তির ঘেরাটোপে আটকে গিয়ে নিজের স্বখাত - চক্রব্যূহ , নিজে তৈরী করেন নি | কিন্তু সে সম্ভাবনা তার ক্ষেত্রে ছিলই | কারণ অসম্ভব এক চলার পথকে বেছে নিয়েছেন কবি | সেটা কী ? সেটা বলার আগে আমি একবার প্যারিসে , পিকাসোর স্টুডিওতে ঘুরে আসবো |

পিকাসোর প্যারিসের স্টুডিওর তিনতলায় , দরজার ডানপাশে একটা কনভেক্স আয়না ছিল | এবং এই আয়নার একটা নিজস্ব খেলা ছিল | খেলাটা অনেকটা পরম্পরাগত কিংবা সমসাময়িক বিষয়ী উৎকেন্দ্রিক  পিচ্ছিলতার বাইরে দাঁড়িয়ে | ব্যক্তিগত কিংবা স্ব - বিষয়ক অভিজ্ঞতা কিংবা কথকতা ছাড়িয়ে আমরা পাই স্থিতিশীল ও গতিশীল এক অন্তর্জগতের " কনভেক্স আয়না |" তো যার মাধ্যমে পিকাসো নিজেকে এবং অন্যদের বক্রবিকৃতির ক্রিয়ার পর্যবেক্ষণ করতেন | প্রশান্তের কবিতা পড়তে পড়তে অবাক ও বিস্মিত হই যখন দেখি , বিষয়হীন বক্তব্যহীন ছন্দারোপহীন উপমা রূপক প্রতীকহীন এই তীব্র ব্যবহৃত বাংলার আবহমানের মাল মশলাকে নেগেট করতে করতে সুরের প্রতিসুর , স্বরের প্রতিস্বর এমন ভাবে ওয়ার্কলোড করে যে এক সীমাশেষহারা সময়হীন ইতিহাস ও বহমানতা ক্রমান্বয়ে ধাক্কা দেয় চেতনার সমূহ বিস্তারে | চেতনার ধারাবাহিক প্রসার বা চেতনাই ক্রমান্বয়ে আঘাত করে , বিষয়হীন চেতনার ধ্বনি ও ভাবনাচিত্রগুলো অভূতপূর্ব নানান সম্ভাবনার দরজাকে খুলে দেয় |



ধারাবাহিক ভাবনার অবিমিশ্র চিত্র | যেখানে দেশ ইতিহাস সমাজ পরিবার নিসর্গ প্রেম ও সময়ের আখ্যান ও বর্ণনামূলক কবিতাকারি যা আবহমান পরম্পরার আখ্যান হিসেবে কবিতাকে গতানুগতিক পথে ঠেলে নিয়ে গেছে , সেই সারাংশী  পরমকারণবাদী স্ট্যাগনেশন বা স্থিতাবস্তাকে ভেঙে এক অবর্ণনেয় বা ননন্যারেটিভ মুক্তির স্বাদ আমরা পাই তার লেখায় | এখানেই ক্যাকোফোনি | এখানেই পাথরে ফুল ফোটে | ফাল্গুর আকুতি আর জ্যোৎস্নার জলে ভরা চোখ আমরা দেখি বাদল হাওয়ায় |

এরফলে প্রশান্তর কনভেক্স আয়নার হৃদপিণ্ডের দিকে তাকালে যে কার্ডিওগ্রাফ পাওয়া যায় , তার অনেকটাই দুটো অলিন্দের বুৎপত্তিগত অনন্ত ও অন্তর্গূঢ় নাদ যা অন্তহীন নিরবচ্ছিন্ন উড়ান রঙের টুকরো আর স্বপ্নের অর্ধস্ফুট আরকে ঠাসা | নানা রঙের প্রেক্ষায় , বিস্ফোরণে , বিকল্প বোধের চর্চায় , প্রোটিন সাপ্লিমেন্টে , অতিরঞ্জিত ক্যালোরি ঝরানো | ব্যক্তিগত অনুভব ও স্বকপোলকল্পিত এক নিজস্ব অলীক জগতে ( এই অলীক মানে কিন্তু মিথ্যে নয় , অতিরিক্ত এমন সত্য যা আলোকিত অন্ধকারের মতো ভাস্বর ) অনুসঙ্গহীন - পুরনো সংস্কারমুক্ত |

শব্দ বা শব্দের স্ট্রাকচার , প্রাতিস্বিকতাই কেবল তার এই নিজস্ব মুদ্রাদোষের জন্য দায়ী নয় | আসলে সাধু গদ্যের এক বিশুদ্ধ অভিজাত বয়ানে যখন পুরোনো অবয়বের ভেতরে নতুন বোধের রক্ত চলাচল করে , renew হয় , বাচনভঙ্গিতে লাগে উল্টো পালের হাওয়া তখনই টেক্সচারে ভিন্ন বুননের কাজ চলে | কিন্তু এখানেই তো তা শেষ হয় না |

 

দুই .

 

সুঁচের অভ্যন্তরে একরূপ ব্যথা আছে ...

............................................................

 

 

চূড়ান্ত সঙ্গমকালীন তৃপ্তির প্রথম অভিজ্ঞতা , প্রথম টাইগার হিলের সূর্যোদয় বা কন্যাকুমারী থেকে প্রথম সূর্যাস্ত দেখা , প্রথম চুম্বন , জীবনের অকল্পনীয় সৌন্দর্যের প্রথম দর্শন আমাদের মনে তৈরী করে অলৌকিক বিস্ময় | আমাদের বাক বিভূতি হারিয়ে যায় | আনন্দের অশ্রু অনেকটা ভোরের আলোকিত অন্ধকারের মতো | তাই আজ বুঝি উৎকৃষ্ট কবিতার কোনও ব্যাখ্যা হয় না | প্রশান্ত গুহ মজুমদারের কবিতা ক্রমান্বয়ে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছয় | কবি যখন এটা টের পান ও জানে ব্যাপারটা কি , ব্যবহার করে কবিতায় , তখন সেই উৎসমুখে ধ্বনি অনুসারী বিচিত্র শব্দাবলীর জন্ম হয় যা নতুন কিন্তু সাযুজ্যগত নিকট শব্দের আত্মীয় | এভাবেই বর্ণ অবতরণ সাতের জায়গায় সত্তর বা সুরের অবতারণা সাতের জায়গায় চৌষট্টি | অনুভূত কবিতাকে বাংলা শব্দে অনুবাদের সময় কবির শব্দভাণ্ডার বেড়ে যায় এভাবেই | যে যত  সেন্সিটিভ , ছুৎমার্গহীন , তার রেঞ্জ বেড়ে যায় অনেক | সূর্য থেকে দিয়া , বর্ণ থেকে সীমাহীন বর্ণালী , সুর থেকে সুরাভাসের দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা ওপেনন্ডেড কবিতার জনক প্রশান্ত গুহ মজুমদার যেখানে তিনি কলমকে বেটন - ভাবে নাচান আর সুরের প্রতিসুর , স্বরের প্রতিস্বররা কম্পোজ করে চলে একের পর এক কবিতা যারা হয়ে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যেতে থাকে যেন কোন বোর্ড নেই , ক্লাসরুম নেই , মঞ্চ ছিল না কোথাও | এরফলে পাঠক আলাদা ভাবে এই বইয়ের কবিতাগুলোকে নিয়ে কথা না বলে , আমার সামগ্রিক অনুভূতির ওপর আলোকপাত করেছি আমি |

কবি প্রশান্ত গুহ মজুমদারের কবিতায় সমস্ত সময় ও কাল আপাত নিশ্চুপ কিন্তু তার চলৎশক্তি নিহিতে তীব্র | অনেকটা হাজার হাজার বছরের পরিত্যক্ত প্রাসাদে , এন্টিক জিনিস | নানারকম বেলোয়ারী , পার্সিয়ান মুখোশ ও স্টাফড মোষের মাথা দেয়াল আলিশায় , দেয়ালগিরির আলোয় স্তব্ধ হয়ে থাকে , কি নশ্বর ! কি জীবন্ত !

প্রশান্ত গুহ মজুমদার এই সমকালকে , চিরসময়কে টাইম মেশিনে চাপিয়ে অনন্তের যাত্রায় ছেড়ে দেন | এরফলে ওর বাক বিভূতি , ভাষার অনমনীয় স্বচ্ছতা , অবয়ব গঠন শৈলী সব নিয়ে যেন কবিতার এক অতিলৌকিক বা অলৌকিক যাদুঘরে পৌঁছে যাই | আসলে এক  পরম্পরাগত সাধুভাষার ট্রান্সক্রিপশন এবং গভীরে  রাইজোমেটিক  আঁতঘরে তাঁর কবিতা প্রোজভার্স  বাংলা কবিতার নতুন কাব্যিক জেনর  ও ফিজিক্যাল টোপোগ্রাফির সঙ্গে অন্তর্জগতের মৌলিক মিশ্রণ কী সাবলীল ভাবে আমাদের মধ্যে সংবেদিত হয় | এবং এর ফলে সিম্ফনি ও প্রতিভাসে কবিতাগুলো হয়ে ওঠে নাগরিক জীবনের উদ্দীপককারী গঠনসন্ধির পরিত্রাতা |

 

তিন .

 

কিছু নেশায় হারিয়ে যাওয়া বৃষ্টি , লেবেল ক্রসিং

.....................................................................

 

 

 

উদাহরণ হিসেবে , পেয়ালা , অপর এবং বেলাছোটর ক্যাকোফোনি থেকে কয়েকটি কবিতা তুলে ধরছি ---

 

পেয়ালা কাব্যগ্রন্থে ধারাবাহিক ভাবে ৬৮ টি কবিতা আছে , শিরোনামহীন | তার নিজের ভাষায় , এ এক অলীক চরাচর |

সাত নং কবিতাটি এখানে রাখি --

 

" একবিংশ ভাঙিল | অর্থাৎ দুইটি টেবিল মধ্যবর্তী সেতুটি বাহুল্য প্রত্যয়িত | সন্ধ্যাসকাল এত অবান্তর ! বস্তুগত শ্লোকে ডুব দিই | আবহে পরিত্রাণহীন কেবল বাক্যসকল অতিক্রমে | চমৎকার | লিরিকহীন এই শব্দে কিছু আশা নাই | অশ্রু তদবধি অসম , বিদ্রুপাত্মক এবং কদাচিৎ গ্রাহ্য ! এ এক অলীক চরাচর "

 

এবার ৬৭ নং কবিতাটি তুলে দিচ্ছি ---

 

" একটা ভাঙা সাইকেল | ইতিহাস ভাঙিতেছে | ঝড় তুলিতেছে একা কম্পিউটার | ঘটমান বর্তমান এবং  একদায় চমৎকার সিম্ফনি | নিরবচ্ছিন্ন ঘন্টার দোলনা | প্রশ্ন এবং উত্তেজনায় | ফুলে এবং বহুচর্চিত সিঁড়িতে | একটি ছায়া , হ্রস্ব , চলিয়া যাইবে , এমত বসে পা তুলিয়াছে | তাহারা কোনো আঙুল তোলে নাই | কেবল দিনাতিপাতের জল এবং ধোঁয়া ভাবিতেছে | যদি কোনোদিন | যদি | তৎপরে সন্তান হাসিবে ? "

 

এবার অপার কবিতার বই থেকে | শিরোনামহীন ৩৬টি কবিতা | এখানে চার নং কবিতাটি রাখছি --

 

" খুব বেশি কিছু নয় | চামচ সরিয়ে রাখো | বন্ধ মুক্ত করো | আলো অবান্তর | আলোচনায় আজ সুতরাং চলো পাখি দেখি | অতিপ্রাকৃত ! হোক , ভাবো , ছায়ার ভিতরে অলকেন্দু ছায়া | মুদ্রার সেই শ্যামলী আঙুল | উন্মোচনে অধীর , অশ্রুর সাদা সেই ব্যাকুল আদরে | রক্তের প্রগাঢ় অঞ্চলে | রাখো | আরশির গোপন আজ অন্তরা হোক | বাজিতে থাকুক শাস্ত্র - বিরুদ্ধে অনিবার |

 

রক্ত , শুকনো , দুই হাত জুড়ে মাখি "

 

এবার " বেলাছোটর ক্যাকোফোনি থেকে কয়েকটি কবিতা , কবিতাংশ | এখানে ৫৭ টি শিরোনামহীন কবিতা আছে |

 

কবিতা নং - দুই .

 

" প্রতিস্থাপনে জাতীয় বাজিয়া উঠিল | ধ্রুবতারার নীল তোমাতেও বাজিল | উদ্ধত দৌড়ে তুমি | বস্তুত সানাই কিছু অতিরিক্ত আনন্দ করে নাই | কে বল আবহে ছিল | আলো হইতে নামিল বর্ণ | বাতাস হইতে বাতাস | আঙুলে  মেজরাব | আমি কি পূর্বেই ঐ অশ্রু স্পর্শ করিয়াছি মীড় কিছু সঙ্গ দিল | সে এক ! পথের | তুমি ! অনন্ত ? আমিও দরজা সবে খুলিয়াছিল | বোতাম তখন স্পর্ধায় !"

 

ঊনত্রিশ .

 

" অধুনা মাংস এই রূপ | পাখির শিহর | তুষার পাচ্ছি | টের পাচ্ছি সংগীত নাই | এই পাওয়া করতলের  বাদামিতে কাঁপিতেছে ! "

 

তেতাল্লিশ .

 

" পাতা , ছেঁড়া , সংবাদ বিধ্বস্ত , বোতলের পাশে | সম্ভবত আমি তৃষ্ণা দেখিতেছি | এক অকথিত স্নান | কথা বলিতেছে আজ |"

 

পঞ্চাশ .

 

" কে যে সরিয়ে নিচ্ছে একমাত্র টেবিল | সাদা গোলাপের ঝার ! শব্দ ঘুরছে | যাচ্ছে কেউ নির্দিষ্ট বিহারে | পাখির বাতাসে | গন্তব্যের খোঁজে উঠে আসছে অন্ধ কাঁটা | কোলাহল কি একদিন বাজে | গোল হয়ে শব্দ সব | গোল হয়ে |ক্রমশ রাস্তা সব বৃহৎ , শূন্যের ছায়ায় | সিঁড়িগুলো কতদূরে ছিল ? নদীর সীমান্তে ! "

 

 

সাতান্ন .

 

" কত তো কতো ভাবে পথে রাখিয়াছে ছায়া ! আমি কেবল আপাত অনন্ত এক সরীসৃপ , কিছু বেদন এবং এই জন্মকে  রাখিব | অধিক কিছু নহে , চর্যাপদের শোকের সহিত মণিদিকে রাখিব | একা ছাদের কোণায় নরমের সহিত গঠিত আঁকিব | তেঁতুলপাতার ওপারে লাল এবং শ্রম একটা একটা রাখিয়া  যাইব | অধুনান্তিক বিকাল যোগ করিব না | কেবল সেই যে পথ , ভাঙাচোরা , তৎপর , অন্ধত্ব , সবটুকু রাখিতে রাখিতে সন্ধ্যা আসিবে | দেখিব | অতিরিক্ত হইবে এই  সামান্যে !"

 

চার .

 

চর্যাপদের শোকের সহিত মণিদিকে রাখিব ...

..................................................................

 

 

ওপরের কয়েকটি কবিতা বা কবিতাংশের ঝলক থেকে , প্রশান্ত গুহ মজুমদারের সামগ্রিক ভাবনা - দর্শনের দিক দিশা সম্পূর্ণ ভাবে উদ্ধার করা অসম্ভব | কেবল কিছু স্পষ্ট রেখাপাতকে চিহ্নিত করা যায় | এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের একটি অবিস্মরণীয় ভাবনাকে কোর্ট না করে পারছি না | তিনি বলছেন , " The good walker should be able to change pace , stop , start , turn , step up or down , twist or stoop , easily and quickly , without loosing balance or rhythm ..."

 প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ক্ষেত্রে এই মন্তব্যটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে | যেখানে সমস্ত বিষয় থেকে যাবতীয় সুতো তুলে নেবার মতো এক মানস - ভাবুকের কবিতালিপির ভাঙনের পরবর্তী গঠন যৌগের দিশা ও গঠন মিশ্রের বহুরৈখিকতা কিংবা বিমূর্তে রাখা কাল্পনিক অভিজ্ঞতাগুলোর নতুন ফিল্টার উঠে আসতে দেখি একের পর এক | ল্যান্ডস্ক্যাপে- র মধ্যে এমন এক বিমূর্ততা , যা স্নায়বিক ধ্বনি উৎসবের ক্রেস্টে উঠে যায় | বস্তুর বস্তুগুণ থেকে কল্পনার টানা রঙে | যেখানে একা রজ্জু অন্ধকারে অসময়ের সমাপ্তিরেখা | এক একটা অসমাপ্ত বাক্যবন্ধ | নতুন সম্ভাবনার অস্থিরতায় কেন্দ্রচ্যুত | ট্র্যাডিশন ভাঙে | আত্মনিরীক্ষণের সূচিমুখ খোলে একটু একটু | অবয়বহীন , সংবেদিত , দূরপনেয় , চেতনার সংরক্তিক বিন্যাসে রক্তস্বেদ , সংগীতের ঋজুতম দ্বান্দ্বিকতার সহাবস্থানে জারিত , দ্বিধাদ্বন্দ্বের , উত্থানপতনের , ব্যতিক্রমী সংশয়ে | না হয়ে ওঠা আমি দের শূন্যতা ব্যাখ্যাহীন , অসম্পূর্ণ অথচ নিবিড় | অনুভূতির খেলা বৃত্তকে ভাঙতে ভাঙতে অবিমিশ্র চেতনার নানান স্তরের প্রকাশ সম্ভাবনার অভিনবত্বকে অভ্যন্তরীণ প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেয় | বিষাদিত ব্যাপ্তি ও শূন্যতা একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে যায় নতুন কোনও সম্ভাবিত লক্ষ্যে | সূক্ষ্ম ও স্বগত , ব্যক্তিগত উচ্চারণ কখনো কখনো ক্রিয়াপদের চলনকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে , খন্ডপ্রাপ্তিজনিত ,স্পার্কগুলোকে , নীহারিকা মেঘের নিরুম্মেষে , নির্ভারে , আত্মজ্ঞতায় দিনান্তে এক অসীম ছায়ারৌদ্রের সঙ্গে একাকার করে দেন |  প্রয়োজনীয় শব্দের সংখ্যায় , প্রতিশব্দহীন আনন্দে , কিংবা , কম শব্দে অটুট অনুভূতির জগৎকে আরপার করে দিতে দিতে তিনি পৌঁছে দেন পাঠককে এমন এক অনুকরণহীন বিনির্মাণে যেখানে সময় মানুষ ও নানা সম্পর্কের আলোকিত অন্ধকার মেঘের ছায়ার চেয়েও নির্ভার অথচ নাগরিক ফিলোমেল , প্রেম , যৌনতা ,রাজনৈতিক ব্যঙ্গ - বিদ্রুপ , চাপা হাসি মাপা কান্না শিহরে এমনভাবে রক্তদ্রুতি বাড়িয়ে দেয় যেন মনে হয় , কবিতা ও পাঠক কখন যেন স্বখাত সলিলে দাহ্য হয় এবং অনিবার্য হয়ে ওঠে , জন ডোয়ানের পাণ্ডুলিপির মতো চেতনা - রাক্ষস !

পাঠক , আন্তন চেখভের " চেরি অর্চার্ড " গল্পটা মনে পড়ে যাচ্ছে | সেখানে একটি চরিত্র আর - একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিল , " কার জন্য তুমি চারাগাছটার যত্ন করছ ? এ তো আর তার কোন কাজে আসবে না |" লোকটি তার উত্তর দিয়েছিল , " আমি ঠিক জানি না , হয়তো দু 'শো বছর বা দু ' হাজার বছর বাদে এ দিয়েই সংসার সুখময় হয়ে উঠবে | আজ আমি সেই সুখী সংসারের জন্যই কাজ করছি | যতটুকু কাজে লাগতে পারি ততটুকুই করছি |"

চেখভের ভবিষৎ চিন্তনের গভীরতার মধ্যে দিয়েই আমরা প্রশান্ত গুহ মজুমদারের কবিতাকে দেখতে পাই | তিনি সারাজীবন এমন এক বৃক্ষ রোপন করতে চেয়েছেন , যাতে ভবিষ্যতের পাঠক নতুন ভাবনার কবিতায় একটি সুস্থিত ছায়া দেখতে পান | তার নীচে দুদণ্ড বসে শান্তি অনুভব করেন | প্রশান্তের কবিতার মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর জুতোর আওয়াজ , ঋষির গায়ত্রী ধ্বনি , নির্মাণ পাগলের ছেনি বাটালির  কোরাস শুনতে পান | যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দশ দিগন্তকে খুলে দেয় মৃত্যুলীন ভাষায় | যেখানে পাথরেও ফোটে ফুল | ঝিরঝির বাতাসে ইহুদি মেনুহিন |  চৌরাশিয়ার বাঁশিতে কোন ভিস্তিওয়ালা জ্যোৎস্না ছেটায় অপর  কবিতার অদৃশ্য

বনপথে | চ্যাপলিনের মতোই উপলব্ধি করি

 ' লাইম লাইটের ' চূড়ান্ত পর্যায়ে কমেডিয়ান ক্যানভারোর উপলব্ধি | জীবন গতিশীল এবং তাই - ই প্রগতি | একটা নতুন নির্মাণ শৈলীর প্রথাভাঙা চল যেন ডাস্টবিনের ওপর ঋজু সূর্যরশ্মির মতো , কিংবা কাঁটার মধ্যে সহজে বেড়ে ওঠা একটা গোলাপের মতো | এল গ্রেকোর সৌন্দর্য দর্শন যেমন ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মধ্যে | অখণ্ড কাল , সর্বব্যাপী জগৎ এবং সর্বত্র স্পন্দিত অগণ্য  জলবিম্বের  মতোই উত্থিত নিমীলিত জীবনের পাশে কবিতাকে বিজনের রক্তমাংস করে তুলেছেন কবি প্রশান্ত গুহ মজুমদার | তার কবিতায় পাই সেই অনাগত সময়ের প্রতিচ্ছবি | এখানেই তার কবিতা স্বতন্ত্র , মৌলিক এবং চূড়ান্ত ভাবে নিজস্ব শক্তিতে একটি নির্জন ইতিহাসের স্রষ্টা , যার কবিতা ছাড়া বাংলা কবিতার আবহমান ধারা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে |



 প্রদীপ চক্রবর্তী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ