সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

দেবাশিস ঘোষ:প্রবন্ধ:মেটাফিজিক্যাল বাংলা কবিতার খোঁজে


 
মেটাফিজিক্যাল বাংলা কবিতার খোঁজে  


       মেটাফিজিক্যাল পোয়েট্রি বলতে বোঝায় সপ্তদশ শতকের কিছু ইংরেজী কবির কবিতাকে। আব্রাহাম কাউলি , জন ডান , জন ক্লিভল্যাণ্ড, জর্জ হার্বার্ট, হেনরী ভন , অ্যাণ্ড্রু মার্ভেল , রিচার্ড ক্র্যাশ (Crashaw) প্রমুখ কবিরা এই ধারার কবি। হেলেন গার্ডনারের মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস (১৯৫৭) বইয়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, স্যার ওয়াল্টার রলে, এডমাণ্ড ওয়ালার , রচেস্টারকেও এই কাব্য ধারায়  রাখা হয়েছে । সুতরাং মেটাফিজিক্যাল কবিতার বৃত্ত ছড়িয়েছে বহুদূর। এবং তার বৈশিষ্ট্যকে অ্যাসিড টেষ্ট দিয়ে প্রমাণ করাও খানিক দুরূহ। মেটাফিজিক্যাল বাংলা কবিতার কথা শোনা যায় নি কখনও। তবুও সাহিত্য জগতে কোনও ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। তার প্রমাণ যুগে যুগে পাওয়া গেছে। এদেশের দুই মহাকাব্যের সঙ্গে ওদেশের ইলিয়াড, ওডিসির অনেক অনেক মিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা যেমন দোষ গুন নিয়েই মানুষ তারাও তাই। এলিয়েন নয়। সুতরাং বাংলায় মেটাফিজিক্যাল কবিতা নামে কোনও পার্বিক বিভাজন না থাকলেও বাংলা কবিতায় তার উপাদান নেই তা কিছুতেই বলা যায় না। 

  আলোচনার পরিসরে প্রবেশের শুরুতেই মেটাফিজিক্যাল কবিতা ঠিক কাকে বলা হয় তা জেনে নেওয়া ভালো। মেটাফিজিক্যাল পোয়েট্রি এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার ও ব্যাখ্যা করেন ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত সমালোচক স্যামুয়েল জনসন। তিনি আব্রাহাম কাওলির জীবনীতে প্রথম মেটাফিজিক্যাল পোয়েট্রি কথাজোড় ব্যবহার করেন। সপ্তদশ শতকের কিছু কবির কবিতায় একটা বিশেষ ধারার লক্ষণ ধরা পড়ে। সেই নির্দিষ্ট লক্ষণচিহ্নিত কবিতাগুলোকে স্যামুয়েল জনসন মেটাফিজিক্যাল পোয়েট্রির বর্গভুক্ত করেছেন। এই কবিতার লক্ষণ inventive use of conceits, emphasis on spoken rather than lyrical quality. তবে জনসনের সংজ্ঞায় পূর্ববর্তী কবিতার ধারাকে বিরুদ্ধ দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়েছে বলে অভিযোগ। গ্রিয়ারসন মেটাফিজিক্যাল কবিতার লক্ষণগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে এই কবিতা আগেকার কৃত্রিম রীতি থেকে মুক্ত। আগেকার প্রথাগত চিত্রকল্প, ও অর্জিত উপমাকে পুনরায় ব্যবহার করে না। গ্রিয়ারসন আরও বলেছেন এই কবিতায় ব্যারোক (Baroque) ইউরোপীয় মাত্রার উপস্থিতি রয়েছে। যা হল কল্পনার অভিনবত্ব এবং অতিশয়োক্তি ( hyperbole)। মার্ভেলের To His Coy Mistress কবিতায় অতিশয়োক্তির চমৎকার উদাহরণ আছে। জর্জ হার্বার্ট ও অন্যান্য কবিদের সম্পর্কে ড্রাইডেনের অবিস্মরণীয় মন্তব্য, '(they) torture one poor word ten thousand ways'. মেটাফিজিক্যাল কবিতায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন এবং তার অনুসন্ধান দেখা গেছে। উপমা!য় প্যারাডক্স বা ভীষণ রকমের বিসদৃশ দুটি বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মোট কথা পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতাকে চমকে দিয়েছে এই কবিতা। এছাড়া মেটাফিজিক্যাল কবিতায় বিষয়বস্তুকে শব্দের বহুমুখী অর্থ ব্যবহারে ও সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মেটাফিজিক্যাল কবিদের মধ্যে একটা পাণ্ডিত্যসুলভ ঝোঁক দেখা গেছে। 

  জন ডানের কবিতায় প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গে একজোড়া কম্পাস কাঁটার অভিনব তুলনায় ভাস্বর হয়ে আছে। কিংবা The Flea কবিতায় মাছিকে যৌনতার  অনুষঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে এভাবে যে মাছি যখন প্রেমিক প্রেমিকার শরীরের রক্ত শুষেছে তখন তাদের দুজনার রক্ত তার শরীরে মিশেছে । সুতরাং তারা পরস্পর যৌনতায় রত  হতে পারে  কারণ  সেই  কাজেও দুজনার রক্ত মিশ্রিত হয় ।

ভারতীয় কবিদের মধ্যে যাদের ডানের সন্তান সন্ততি বলা হয় আরা হলেন অনামিকা, সুজাতা ভাট এরা। অনামিকার গৃহলক্ষী সিরিজের কবিতায় পাই 'আমি ক্যাসারোলের শেষ রুটি/এখনও ক্যাসারোলের ভিতরে', কিংবা 'আমি এ বাড়ির চিলেকোঠা/বাড়িটি আমায় বইছে/মাথার উপর আকাশের মতো।' নারী জীবনের অবহেলাকে ক্যাসারোলে আটক শেষ রুটির সঙ্গে তুলনা বা চিলেকোঠা ঘরের সঙ্গে তুলনায় অভিনবত্ব রয়েছে। এটাই মেটাফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য। 

  বাংলায় শব্দের বহুমুখী ব্যবহার করেছেন শিব্রাম চক্রবর্তী, দাদাঠাকুর এবং আরো অনেকেই। কবিতায় তো অনেক কবিরাই করেছেন। মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যে লঙ্কেশ  রাবণ যখন সমুদ্রের উপর রামচন্দ্র নির্মিত সেতু দেখে সমুদ্রকে বলেন, 'কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছো গলে!' তখন তা আগের সবকিছু রচনারীতিকে ঝেড়ে ফেলে অভিনবত্বের অসামান্য নিদর্শন হয়ে ওঠে। এইসব কিছু ঘটনাবলীর সঙ্গে মিলে যায় ইংরেজি কবিতার মেটাফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধার করা যাক, 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনী উঠল রাঙা হয়ে' । এই কবিতায় কিন্তু মেটাফিজিক্যাল মিস্টিসিজম সুস্পষ্ট। তবে রবীন্দ্রনাথে মেটাফিজিক্যাল শক ততটা নেই। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর লোহার ব্যথা  কবিতায় মেটাফিজিক্যাল উপাদান মেলে। লোহার ব্যথা একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের উপমা যা পাঠককে চমকে দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবিদের রচনারীতিতে এই কবিতার উপাদান মেলে। 

    জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেসব অভিনব উপমা ব্যবহৃত হয়েছে তা কিন্তু মেটাফিজিক্যাল কবিতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। সেদিক থেকে জীবনানন্দে মেটাফিজিক্যাল উপাদানের প্রাধান্য  বেশিই হবে। 'পাখীর নীড়ের মতো চোখ', 'মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য', 'একটি মোটরকার গাঁড়লের মতো গেল কেশে' এইসব বৈশিষ্ট্য মেটাফিজিক্যাল কবিদের সঙ্গে মেলে

 ''স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে/ আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র --/তার নাম ভারতবর্ষ' (আমার নাম ভারতবর্ষ': অমিতাভ দাশগুপ্ত) এই অংশে যে ছবি ফুটে উঠেছে তা অভিনব। স্টেনগানের (তখনও একে৪৭ এদেশে আসে নি) বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা বুকে ভারতের মানচিত্র ফুটে ওঠার মতো একটা ভয়াবহ চিত্রকল্প ব্যবহার করলেন কবি।

 শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় মেটাফিজিক্যাল মিস্টিসিজম এবং মেটাফিজিক্যাল কনসিট (conceit) দুটোই মেলে। 'অনন্ত কুয়ার নিচে পড়ে আছে চাঁদ',  'হেমন্তের অরণ্যে আমি পোষ্টম্যান', 'এখন খাদের কাছে একাকী দাঁড়ালে চিতাকাঠ ডাকে আয় আয়', 'কুয়াশার মধ্যে আছে সাদা ছুঁচ, পিতলের মতো, /কখন সে পূবদিকে উঠে এসে দাঁড়াবে উঠোন' 'এখন শীতের বুড়ো মুখ', 'বয়ঃসন্ধি কাপড় ছিঁড়ত ভোরবেলাতেই' (বয়ঃসন্ধিকালে ভোরবেলায় পুং জননাঙ্গের উত্তেজিত হওয়া ও কাপড়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করার এক অতিশয়োক্তি। এইসব শব্দবন্ধ ও পংক্তিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে তীব্রভাবে একজন মেটাফিজিক্যাল কবি বলে মনে হয়।  বাংলা কবিদের বহু কবিতায় এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেটাফিজিক্যাল উপাদান। উৎপলকুমার বসুর কবিতায় মেলে  'উটেরা নক্ষত্র চেনে/চাঁদের আলোয় শুকোয় নাইলন সার্ট' (গ্রামসেবক)।  ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় মেলে কচি ছাগলছানার মতো রোদের লাফানো, এবং সর্বোপরি 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'-তে জল দেখলে লাফাতে ইচ্ছে করার ইচ্ছের কথা।  রণজিৎ দাশের 'নিজের খুব কাছে যেতে পারিনি এখনও, পুলিশ রয়েছে' (সুড়ঙ্গ) এইরকম নানা অনুষঙ্গে মেটাফিজিক্যাল চলন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 

  তবে মেটাফিজিক্যাল কবিতার সুনির্দিষ্ট লক্ষণাবলী ধরে ধরে সমকালীন বাংলার একটি পুরো কবিতাকে হয়তো মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মেটাফিজিক্যাল পর্বে যে সময় ছিল সেই সময় আজ আর নেই। হাংরি জেনারেশনের কবিতায় যৌনতাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার সঙ্গে মেটাফিজিক্যাল কবিতার কিছুটা মিল পাওয়া যায় বিষয়ে এবং অভিনবত্বে। মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার', বিনয় মজুমদারের ভুট্টা সিরিজের উপমা ব্যবহারে অভিনবত্ব রয়েছে। তাদের টোন ও টেনরে মেটাফিজিক্যাল কবিতার ছায়া মেলে। তবে সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। 

তথ্য সহায়তা: Wikipedia, 

milansagar.com

Daughters of Donne 1: A Metaphysical Reading Of Indian Women Poets by Dr Shweta Sharma



দেবাশিস ঘোষ



 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ