সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শান্তা মুখোপাধ্যায়

        



লি’তালিয়া



 আমার ছোট ছেলে ( খুব ছোট নেই এখন আরমাঝে মাঝেই অনুযোগ করে যে ওর নাকি একদম ফোটো নেই ওর দাদার তাও আছে এমনিতে আমি স্বভাবচিত্রী নই তাই সত্যি এই স্মার্টফোন যুগেও আমি ফোটো তোলার ব্যাপারে সেই ক্যাবলাই রয়ে গেলাম সে যাই হোকওকে কনভিন্স করার জন্য album টা খুলতেই মনে হল, " জীবন গিয়াছে পেরিয়ে আমাদের কুড়িনানাবাইশটি বছরের পার..... দেখা হল ফোটোতোমাতে আমার......"


  সেই ১৯৯৬ সালে ত্রিয়েস্তে গেছিলাম গবেষণা সংক্রান্ত কাজে বিস্তর mail-আ-mail-ই র পর বোঝা গেল আমি "Spring College on Disorder and Chaos" এ participate করার জন্য selected হয়েছি সময়কাল১৯৯৬এপ্রিলের শেষ সপ্তাহস্থানত্রিয়েস্তেইতালী ব্যাপারটা গালভারি করে কলেজ বলা হলেও আসলে পাঁচ সপ্তাহের একটা কোর্সের মত আয়োজক, International Centre for Theoretical Physics. আমার গবেষণার বিষয় ছিল chaos. (এটা ভাঙচুর related chaos নয় তাতে Ph. D করলে আজ কোন উচ্চাসনে বসতাম ভাবুন!) এই chaos হচ্ছে চলমান সমীকরণে প্রাথমিক অবস্থা দিয়ে পরবর্তী অবস্থা নির্ণয় সংক্রান্ত অসুবিধা মানে আপনি সোমবার সকাল ৯-৩৫ মিনিটে হাওড়া স্টেশন থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে ভাবলেন পরদিন সকাল ৯-৪৫ এ দিল্লী পৌঁছাবেন কিন্তু এমনও হতে পারে যে আপনি কোচিতে পৌঁছে গেলেন অবশ্যই এত সরল নয় বিষয়টাউদাহরণ মাত্র দিলাম নির্বাচিত হবার আনন্দের সাথে সাথে আশঙ্কাও উপস্থিত Local hospitality ICTP দেবে যাতায়াতনিজের পয়সায় বিদেশ যাওয়া স্বপ্নেরও অতীত CSIR fellow হিসাবে ভারত সরকারের শরণাপন্ন হলাম সরকার বাহাদুর যাতায়াত ভাড়া অনুমোদন করলেন আজ ভাবি সরকার বাহাদুর বিশেষজ্ঞ তৈরীর কাজে ব্যয়কুন্ঠিত ছিলেন নাঅথচ আমি সেই বিশেষ অজ্ঞই রয়ে গেলাম যাতায়াত ভাড়ায় সরকারী অনুমোদন একটিই শর্তে, Air India য় যাতায়াত করতে হবে কলকাতা থেকে দিল্লী দিল্লীতে রাত্রিবাস হোটেল Air India provide করবে পরদিন সকাল আটটায় উড়ান -রোমকে লিয়ে সন্ধে সন্ধে দিল্লী পৌঁছে এয়ার পোর্টের বাসে হোটেল পৌঁছেই সোজা ঘরে একা একা লাউঞ্জে ঘুরলে যদি সবাই বুঝে ফেলে আমি একা! সে হতে দেওয়া যায় না রাত্রের খাবারও ঘর থেকে ফোনে বুক করলাম ভয়ে ভয়ে শুধু ভাত চিকেন আর স্যালাড নইলে Air India যে কুপন দিয়েছে তাতে যদি না কুলায়! কিন্তু ওরা ক'পয়সা ভরে  রেখেছিল কে জানে! হোটেল ছাড়ার সময় সেই একশ টাকা দিতে হল!
ভোর ভোর ইন্দিরা গান্ধী International Airport. এত লোক বিদেশ যাবে? Air port চত্বরে ভিড় দেখে আমি তো হতবাক কি কি করতে হয় জানি না Air India র logo আঁটা counter এর সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম সামনের লোক যা যা করছে তাই তাই করতে হবে বুঝে নিলাম লম্বা একটা টিকিটের মত দিল ওটা নাকি বোর্ডিং পাস ওটা দেখিয়েই প্লেনে উঠতে হয় বোর্ডিং পাস নিয়ে দেহ তল্লাসীর পর departure lounge এ পৌঁছালাম প্রথম বিদেশ উত্তেজনায় টান টান space-time চাদরে বাস করছি প্লেনে জানলার ধার পেলাম প্লেম চলতে শুরু করল গর্জন করে শক্তি সঞ্চয় করছে মাটির টান কাটিয়ে আকাশচারী হবার জন্য দেখতে দেখতেই টুক করে আকাশে উঠে পড়ল ছোট হতে থাকল দিল্লী শহরের আকাশচুম্বী বহুতলেরা ফিতের মত যমুনা মিলিয়ে যেতেই কেমন একটা ফিনফিনে মনখারাপ চেপে ধরল আবার ফিরব তো? 


 খাবার দাবার আসতে থাকল টিভিতে সিনেমা চলতে থাকল বাইরে মেঘ ছাড়া আর কিছু দেখবার নেই আমি সিনেমা দেখতে লাগলাম আটঘন্টা টানা ওড়ার পর প্লেন আবার মাটীর টানে ফিরতে লাগল ঘোষণা হতে লাগল, "সিনিওরাসিনিওরে...বুঝতে পারলাম প্লেন স্পর্শ করেছে ইতালীর মাটি
 রোমে আবার আটঘন্টা waiting. তারপর আবার domestic flight ধরে যেতে হবে ত্রিয়েস্তে আটঘন্টা কি করবপ্রথমে lounge এ বসলাম বার বার ঘোষণায় লি'তালীয়াগ্রাৎসিয়েআর র'মা র'মা বুঝতে পারছি গ্রাৎসিয়ে মানে ধন্যবাদ এটুকু শিখে গেছিলাম লি'তালীয়া মানে ইতালী বুঝলাম পরে জেনেছিলামলা ইতালীয়া মিলে লি'তালীয়া হয় লা মানে দ্য ইতালী স্ত্রী লিঙ্গ ল্যাটিন originated ইতালীয় ভাষা ভীষন ভাবেই gender sensitive. আরো বুঝলাম রোমকে ওরা র'মা বলে উত্তমকুমার শুনলে কত খুশি হতেন ভাবুন! যেদিকে তাকাচ্ছিবেবাক বাক্যিহারা হয়ে যাচ্ছি সুবেশ পুরুষসুন্দরী সুবেশা মহিলাসুদৃশ্য দোকানপাট! কিন্তু একি! একটা গাড়ি চলছে কেন lounge ও হরি! ওটা পরিষ্কার করার গাড়ি! যে চালাচ্ছে তাকে দেবদূতের মত দেখতে! রোমের সাফাইকর্মীকেও দেবদূতের মত মনে হচ্ছেকেলেঙ্কারি! মহিলারা বেশিরভাগই লেডিস স্যুট পরা মানে ফর্ম্যাল স্কার্টজ্যাকেট (আমরা যাকে তখন কোট বলতাম) লাল তো গোটাটাই লালমাস্টার্ড ইয়েলো তো গোটাটাই তাইমায় স্টকিন্সজুতো অবধি রঙ বৈচিত্রপোষাক বৈচিত্র বেশ কম মনে হল 
 lounge এর duty free shop এ ঢুকে তো চক্ষু চড়কগাছ! গ্লাস ব্লো করে বানানো শিল্পকর্মকাচের বাসনমার্বেলের মেমেন্টো দেখে দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছি লাল টুকটুকে transparent কাচের ডিনার সেট প্রান্তভাগ সোনা দিয়ে মোড়ানো দামবলতে নেই! ভাবতেও নেই! শুধু দেখতে হয়! দেখতে দেখতেই আটঘন্টা পার আবার উড়লাম

 রোম থেকে domestic flight এ পৌঁছালাম ত্রিয়েস্তে যাঁর নিতে আসার কথা ছিল তিনি লাস্ট মোমেন্টে ই মেল এ জানিয়েছেন আসতে পারবেন না তখন টেলিফোনই সব মধ্যবিত্ত বাড়ি থাকত না মোবাইল তো ভবিষ্যতের গর্ভে এয়ারপোর্টের বাস যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেল সেখানে একদিকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে অন্যদিকে অনন্ত নীল বারিধি আড্রিয়াটিক সী ড্রাইভার হাত পা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যেতে তাহলেই গ্যালিলিও গেস্ট হাউস ঘড়িতে বাজছে সাড়ে সাতটা কেউ কোত্থাও নেই পাহাড়ের ঐ পথে যাবনা কভি নেহি তাহলে কি করাওরা চিঠির সঙ্গে ম্যাপ পাঠিয়ে ছিল সেটাই ভরসা ম্যাপ দেখে International Centre for Theoretical Physics অভিযানে রওনা হলাম " চলি চলি চলি পথের যে নাই শ্যাষ!" হাতের সুটকেস আর পিঠের ব্যাগ ক্রমশঃ ভারী হয়ে উঠছে হ্যাঁম্যাপে আঁকা টানেলদুটো টানেল পেরিয়ে এঁকে বেঁকে অবশেষে পেয়েছি! " অতি দূর সমুদ্রের পথ পার হয়ে হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশাযখন সে দেখে সবুজ ঘাসের দ্বীপ দারুচিনি দ্বীপের ভিতর... তেমনি দেখেছি তারেসন্ধ্যা নামিবার আগে ICTP! কিন্তু পেলে কি হবেকে শনিবারের সন্ধেবেলা আমায় স্বাগত জানাতে বসে আছেঅতঃ কিমটেনিদা শিখিয়েছিল বিপদে নার্ভ না হারাতেএটা বিপদ কিনা বুঝতে পারছি নাকিন্তু সন্ধে এবার হবেই বুঝে নার্ভ হারিয়ে যাচ্ছে যদিও পরে বুঝেছিলাম ওখানে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নটার আগে সন্ধে হয় না বিদেশে একটা সুবিধেসব লেখা টেখা থাকে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখলাম একদিকে গ্যালিলিও লিখে তীর চিহ্ন দেওয়া অতএব কদম কদম বাঢায়ে যা কিন্তু আবার পাহাড়ি পথ যদিও ম্যাপ অনুমোদিত কিন্তু হাঁটতে আর পারছি না দেখি একটা গাড়ি আসছে এক মহিলা ড্রাইভারমহিলা আরোহী আমি মরীয়া হয়ে দু হাত দিয়ে হাঁকাহাঁকি করে থামতে বললাম গন্তব্য বললাম বুঝল লিফট চাই তাও বুঝল কিন্তু হাত পা নেড়ে কি বোঝাতে চাইল বুঝলাম না শেষে বলল, " পেতেপেতেপেতে" বুঝলাম উঠে পড়তে বলছে এখন আর দেরী নয় ওঠ ওরে তুই গাড়ির ভেতর ওঠরে ও বাবাউঠেই এসে পড়লমানে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার থেকে দু পা সেটাই তাহলে মহিলারা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেনরিসেপশন থেকে চাবি নিতেই শুনলাম রবিবার ডিনার পর্যন্ত সব রেস্তোরাঁ,  ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ থাকে বোঝপ্লেন থেকে অল্প শুকনো খাবার বাঁচিয়ে রেখেছিলাম মহাজনদের পরামর্শমত ভাগ্যিসকালকাল কেয়া হো কিসনা জানা!

এমন সব রোমহর্ষক স্মৃতি আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল!  workshop এ যা লাঞ্চ দিত তাতে আমাকে রাত্রে খেতে হত না ডি এ র টাকাটা ( খুদ কুঁড়ো মাত্রবাঁচিয়ে আমরা কয়েকজন বাঙালী মিলে রোমভ্যাটিকানপিসাফ্লোরেন্স আর দ্য গ্রেট ভেনিস যেতে পেরেছিলাম এখন ভাবলে মনে হয় সত্যিসত্যি আমি সান মার্কো পিয়াজ্জা (ভেনিসতে গান শুনেছিকলোসিয়াম দেখেছিপিসার গম্বুজ হাত দিয়ে ছুঁয়েছিশাড়ি দেখে ইতালীয়ান মহিলারা এসে আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছেন পোষাকটা কি? " শাড়িশুনে আশস্ত হয়ে বলেছেনও শাড়িযেন এ তো জানাই ছিলরোমের রাস্তায় বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষরা উদবিগ্ন হয়েছেন আমাদের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না ভেবে....আর আমরা ফ্লোরেন্সে একটা শুধু আইসক্রীম খেয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেরিয়েছি এ মিউজিয়াম থেকে সে মিউজিয়াম...., পাহাড়ের উপর ডেভিড। 
স্মৃতি সততই সুখের এই স্মৃতি নাড়া দিয়ে যেতেই আমি আবেগতাড়িত হয়ে হ্লাদিত চিত্তে বসে গেছি স্মৃতির ঝুলি থেকে যাবতীয় মার্জারাদি বার করায় যাঁরা ঘটনা প্রবাহের দৈর্ঘ্যে পাঠ উন্মুখতা হারিয়ে ফেলবেনতাঁদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি রইল সঙ্গের ছবিগুলি সেই বাইশ বছর আগের তোলাসময়ের ঘষা কাচের দূরবীনে ঝাপসা  

 শনিবার আমি পৌঁছালামআর রবিবার সন্ধেয় Saha Institute of Nuclear Physics, BARC, IISc, Bangalore থেকে অনেকে এসে পড়লেন সোমবার থেকে কলেজ শুরু যাঁরা এলেন তাঁদের মধ্যে সিংহভাগ বাঙালী আমার রুমমেট একজন ক্রোয়েশিয়ান ম্যাডাম কলেজে পড়ান Vjera Lopak. বলতে হয় ভিয়েরা। সেই প্রথম আমার ক্রোয়েশিয়া জানা তাঁকে ফলো করে আমি অনেককিছু শিখে ফেললাম বেসিনটা আটকানোর প্যাড দিয়ে আটকে নিলেই বালতি হয়ে যায়ছোটখাটো কাচাকুচি সেরে নেওয়া চলে লেডিস স্যুট পরলে স্টকিন্স না পরাটা অসভ্যতা(আমি অবশ্য লেডিস স্যুট পরিনি কখনওহাঁটু ছাড়ানো হাতাওলা ড্রেস না হলে ফর্ম্যাল হয় না পরে চার্চে দেখেছিলাম ছবি দিয়ে বোঝানো আছে হাঁটু ছাড়ানো হাতাওলা ড্রেস পরলেই শুধু চার্চে প্রবেশাধিকারনইলে নয়  লাঞ্চ ব্রেকে কুপন জমা দিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হয় সে ইলাহী ব্যবস্থা ভাতনানারকম মাংসের পদবিভিন্নরকম ব্রেডস্যালাডডেসার্টফল শেষে ছোট এক বোতল রেড বা হোয়াইট ওয়াইন অথবা জল আমি জল নিচ্ছি দেখে বিনয়দারা হায় হায় করে উঠল ওয়াইনের বোতল নিয়ে ওদের দিতে হল আমার কলের জলই ভরসা (mineral water কিনে খাবার মত পয়সা বা মানসিকতা কোনটাই  ছিল নাশক্ত ভাত ইতালীয়রা নাকি শক্তের ভক্ত ভাত নিলে সস বলে কি একটা দিয়ে দিচ্ছেগন্ধটা নেওয়া যাচ্ছে না পাশে সাদা মাখনের মত কি রাখা চাইতেই এত্তটা দিয়ে দিল খেয়ে দেখিও হরি! ও তো আমাদের আলুসেদ্ধঅনেকটা মাখন দিয়ে মাখা তারপর থেকে ওই আলুসেদ্ধ আর ভাত আমার প্রিয় খাবার ছিল। 
 ভাত খেয়ে একটু ঘুম ইতালীয় শাস্ত্র সম্মত তাই সব দোকানপাট দুপুরে দু ঘন্টা সিয়েস্তার জন্য বন্ধ থাকে ঘুমের ব্যাপারে যারা এত সচেতন তারা স্বপ্নও দেখবে আর তাদের মেয়ের নাম সোনিয়া হবে এ আর আশ্চর্য কি! সোনিয়া মানে dream!

 রাত্রে খাবারের পাট আমার ছিল না একটা কফি খেয়ে নিলেই চলত কিন্তু অন্যান্যদের একটু খেতে হত ক্যান্টিনে খেলে DA র টাকাটা শেষ হয়ে যাবে ঐ পয়সা জমিয়ে ঘোরা যাবে না তাই সুপার মার্কেট যেতাম আমরা তখন সুপার মার্কেটই বলত মল নয় সেই প্রথম সুপার মার্কেট দেখা আমার এক ছাদের তলায় সবরকম জিনিস আমার তো একটা কোট কেনার খুব ইচ্ছে সব্বাই বারণ করল কিন্তু কেনার বাই চাপলে আমাকে রোখে কার সাধ্যি! সেলসগার্ল আবার কোট বোঝে না বলে, "জ্যাকেতঅ?" আমি ভাবি "জাকেতঅআবার আমার স্বপ্নের জিনিসটা হবে তোশেষে সে আমার মাপে একটা এনে আমায় পরিয়ে দেওয়ায় চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল পকেটও একটু হালকা হল কিন্তু ধপধপে সাদা সেই কোট আমার ফ্যাশান স্টেটমেন্টে তারপর কতদিন ধরে যে চাপা অহংকার ভরে দিয়েছে সে কথা বলবার নয় যারা তাকে অ্যাপ্রনের সাথে গুলিয়েছেন তাদের intellectual ability কে জিরোর কাছাকাছি রেটিং করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হই নি সে যাই হোকঐ সুপার মার্কেট থেকেই পাঁউরুটিডিমমাখনফল খুব সস্তায় কিনে নিয়ে আসা হত গেস্ট হাউসে রান্না allowed নয় তবে চা কফি খাবার জন্য চব্বিশ ঘন্টা গরম জল পাওয়া যেত আমার কাছে স্টীলের টিফিন বক্স ছিল ঐ টিফিন বক্সে গরম জল পুরে তার মধ্যে ডিমটা রেখে দুবার জল পাল্টে সেদ্ধ করা হত আশচর্যের ব্যাপার এই যে তাতে কুসুম শক্ত হয়ে যেতসাদা অংশটা তলতল করত সেটা পাঁউরুটিতে ভরে দিব্বি স্যান্ডউইচ হত! ক্যান্টিনে খাবার খরচ বেঁচে যেত

 গেস্টহাউসের লিভিং রুমে একটা টিভি ছিল চেয়ার টেয়ার ছিল একদিন টিভি দেখার টানে সেখানে গিয়ে কি কান্ড! আমার ডবল লম্বা একটি ছেলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "From Nigeria." আমি হ্যান্ডশেক করে বললাম, "From India." তারপরই আমাকে জিজ্ঞেস করল,  "আর ইউ মুজলমান?" বুঝলাম আমার সালোয়ার কামিজ ওর ধারণার উৎস বললাম, "নোএরপর কোনও ভণিতা না করে বলল, "ম্যারি মী?" মা গো! হার্ট অ্যাটাক হবে নাকি! এটা আমার জীবনের দ্বিতীয় প্রপোজ প্রথমটাতেই ক্লীন বোল্ড হয়ে গেছি! (সেটাও যা ছিরির ছিল!) এবার কি হবে! মুকুজ্জে মশাই নেই বলে যা খুশি বলবে! থাকলে এক্ষুণি যা একটা ঘুঁষি হাঁকড়াত না..."ম্যারি মীবেরিয়ে যেত! ঘুঁষি মারার কথা মাথায় আসতেই বিপদটাও মাথায় এল! মুকুজ্জে মশাইর প্রোফাইল তো মোটামুটি z-axis বরাবর প্রলম্বিত X, Y তে কিচ্ছু নেই! এই দশাশই নাইজেরীয় ঘুঁষির উত্তর দিলে কি হত ভেবে মাথায় বিপদ্ঘন্টি বাজতে শুরু করল সামলে নিয়ে কোনওমতে বলি, "I am engaged!"  বলতে বলতেই উল্টো দিকে হাঁটা শুনছি পিছন দিক থেকে বলছে, "where is your ring?" দুত্তোর নিকুচি করেছে রিং! এবার থেকে শচীনদাবিনয়দাঅ্যালেক্সসুদীপ্তাদের ছাড়া এক পাও হাঁটব না!

  বিকেল পাঁচটার পর গবেষণা থেকে ছুটি আমরা হাঁটতে যাই সমুদ্রের ধারে ঘন নীল Adriatic সাগর ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিকেলের রোদকে ওঠ বোস করায় সূর্য ডোবার পালা আসতে আরো চারঘন্টা দেরী রাত্রি ন'টা নাগাদ সূর্য "বোনাসেরা" (শুভরাত্রিবলে ওপাড়ায় আলো বিলাতে চলে যাবে

আমরা আলোচনায় বসি মাস্টার প্ল্যান কোথায় কোথায় যাওয়া চলে আমাদের জমানো পয়সায় প্রথমেই গন্তব্য তালিকায় উঠে আসে ভেনিস ইতালীয় ভাষায় ভেনেৎসিয়া তারপর রোম ফ্লোরেন্স আর পিসা একলপ্তে দেখে নেওয়া হবে রোম বা ফ্লোরেন্সে রাত্রিবাস করলে খরচ অনেক বেশী ভরসা রেল কোম্পানি একমাসের সীজন টিকিট করে নিলে প্রচুর ছাড়ও পাওয়া যায় এমন ট্রেন নেওয়া হোক যেন সারারাত ট্রেনে চলে পরদিন সকালে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় সারাদিন দেখেশুনে রাত্রে আবার ট্রেন পরের গন্তব্যের জন্য আইডিয়াডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিসইয়াকইয়াক!
ত্রিয়েস্তে থেকে ভোর ভোর বেরোলে একদিনে গিয়ে একদিনেই দেখে আসা যাবে ভেনিস এক রবিবারের ভোরে আমরা " বন জিওরনো" ( good morning) বলে রওনা হয়ে পড়লাম ট্রেন চলেছে অপূর্ব দৃশ্যপট পিছনে ফেলে ফেলে রোদছায়া মাখানো পাহাড় ছোট্ট ছোট্ট জনপদ পাহাড়ে বিছানো আঙুর ক্ষেত
   ট্রেনটি চলে ট্রেনটি চলে/পাহাড় ঘেঁষেলাইন তলে,/আঙুর ক্ষেতের সবুজ মায়া/মেঘ রৌদ্রের আলোছায়া,/সব পেরিয়ে সাগর ডাকে,/নটি চলে ব্রীজের বাঁকে।/নীল সাগরে হাতটি ধুয়ে/ট্রেনটি দাঁড়ায় স্টেশন ছুঁয়ে। 
 ভেনিসের নিকটতম স্টেশন মূল ভূখন্ড থেকে সাগরের উপর ব্রীজ বানানো প্রায় যেন সাগর তলেই সেই ব্রীজ পেরিয়ে স্টেশন স্টেশন থেকে ভেনিস যেতে হলে সেই আদি অকৃত্রিম গন্ডোলা সরু লম্বা নৌকা বেশিরভাগই ইঞ্জিন লাগানো ভট ভট করতে করতে গিয়ে নামালো নামালো ভেনিসের ঘাটে নেমে পড়লাম ভেনিসের রাস্তা মানে খাল পাশে বাঁধানো ফুটপাথ সে বরাবর হাঁটা যায় মাঝে মাঝেই ছোট্ট সাঁকো এ ফুট থেকে ও ফুটে যাওয়া চলে বিশাল বিশাল ইতিহাস দ্রষ্টা অট্টালিকা দীর্ঘ জলবাসে তাদের জল থেকে মুখ বাড়ানো একতলার দরজা জানলায় সবুজ শ্যাওলার প্রলেপ মনে হচ্ছিল যেন এক্ষুনি কোন বাড়ির জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে পোর্সিয়া উঁকি মেরে বলবে, " এলেনভালো করে দেখুনশাইলক কি জলের নিচের অন্ধকারে আত্মগোপন করে আছেসুযোগ মত ছুরি নিয়ে উঠে আসতে পারেকল্পনা আর বিস্ময়ের টানা পোড়েনে মনে মনে বোনা হতে থাকে ভেনিসকথা
         ভেনিস প্রায় ৪০০ খ্রীস্টাব্দে তৈরী হয় মূল ভূখন্ড থেকে বারবারিয়ানদের তাড়া খেয়ে ভেনিসিয় জলাভূমিতে আশ্রয় নেয় রোমানরা কাঠের বড় বড় গুঁড়ি জলাভূমিতে গেঁথে তার উপর কাঠের পাটাতন বিছিয়ে তৈরী হয় ইমারত কোনও কোনওটা হাজার বছর পার করেও টিঁকে আছে গুঁড়ি গুলো পুরো জলের তলায় বলেই নাকি পচে যায় নি দুটো কাঠের গুঁড়ি র মাঝখানে সামান্য হলেও ফাঁক আছে তা দিয়ে জল বয়ে যেতে পারে আর তাই জলের প্রাবল্যেও ভেঙেপড়েনি ইমারত আশ্চর্যকিন্তু জলাভূমিতে এত কাঠের ভারতার উপর অট্টালিকা নির্মাণ করায় আস্তে আস্তে বসে গেছে মাটী সমুদ্র একটু একটু করে দখলদারি হানা চালাতে থাকে ক্রমে ক্রমে জল আর জীবন এক হয়ে যায় ভেনিসে
         ভেনিসে সিবচেয়ে বিখ্যাত সান মার্কো পিয়াজ্জা পিয়াজ্জা মানে প্লাজা আমরা সান মার্কো ব্যাসিলিকা দেখলাম ভিতরে অপূর্ব কারুকাজ গম্বুজাকৃতি সিলিং কাচে মোড়ানো আর কাচগুলো রঙীন ছবিতে ভরা সকালের আলো পড়ে অপার্থিব হয়ে উঠছিল ছবিগুলি ইটালো বাইজেন্টাইন শিল্প রীতি কিছু ছবি অস্পষ্ট হয়ে আসায় পুনর্নির্মাণের জন্য ছবিগুলি তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল ওঠানো দুরূহ হয়েছিল তখনই জানা গেছিল ন্যানো গোল্ড সল ব্যবহার করা হয়েছিল রঙ হিসাবে তার ধর্ম না জেনেই

         রবিবার দুপুরের পর সান মার্কো পিয়াজ্জায় গান গাইতে আসেন অনেকে গিটার ড্রাম নিয়ে বসে গেছেন হয়ত এক গায়ক অন্য বাদককে চেনেন না কিন্তু সুরছন্দোবদ্ধতায় তাল কাটে না অবশ্য ভিভালদির জন্ম যে শহরে সেখানে সুর তাল ছন্দোবদ্ধতার মেলবন্ধন শিল্পে মূর্ত হয়ে উঠবে এ আর আশ্চর্য কিতাদের সামনে পাত্র রাখা চাইলে সেখানে পয়সা দিতে পারে কেউ তাদের কনসার্টে র টানেই কিনা কে জানে উড়ে আসে রাশি রাশি পায়রা উপস্থিত সাধারণ মানুষ জন তাদের খাবার দেন জল যুদ্ধে সমুদ্রের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে বেঁচে আছেন ডেনিস বাসী তাঁদের যাপন চিত্র প্রানবন্ততায় এমন ঝলমলে তো হবেই!
   ভেনিস থেকে মেমেন্টো কিনতে গিয়ে আমরা ভেনিসের মুখোশ উৎসববের মুখোশের মত ব্রোচ কিনলাম ভেনিসের পাশেই ম্যুরানো দ্বীপ সেখানে গ্লাস ব্লো করে অপূর্ব শিল্পকর্ম তৈরী হয় কাচের ভেতর রঙীন উপাদান ভরে দেওয়া হয় গরম গলন্ত কাচকে ব্লো করে নানারকম আকৃতি দেওয়া হয় হতে হতে তারা ঠান্ডাও হয় ঠান্ডা হবার সময় কাচের ভেতরের রঙ গুলো ডিফিউশনে বিভিন্ন দূর পর্যন্ত যায় এবং যেতে যেতে কাচ ঠান্ডা হতে থাকলে তাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ হয়ে যায় তার দরুণ তৈরী হয় অপূর্ব সব নক্সা কাচের ভেতর রঙীন আলপনা আমরা এদেশে তার খুব স্থূল উদাহরণ হিসেবে কাচের পেপার ওয়েট গুলো দেখে থাকি আমরা ম্যুরানো দ্বীপেও গেলাম আমি কালো কাচের ছোট্ট হার্ট শেপের লকেট কিনলাম যার মধ্যে তিনটে ছোট ছোট কমলা হলুদ ফুল গ্লাস ব্লোয়িং এর জন্য ফুটে আছে মনে হচ্ছে যেন কেউ বাইরে থেকে ডবল জিরো তুলিতে এঁকেছে এত নিঁখুত
         মে'র প্রথম সপ্তাহ পড়ে গেছে দিন যথেষ্ঠ বড় হলেও অফুরান তো নয়দিনের আলো ক্রমক্ষীমান হয়ে যেতে যেতে তাগাদা দিল ফেরার আবার গন্ডোলাতে স্টেশনট্রেন পাহাড়ের গা বরাবর এক বিরাট ইগল পাখী যেন ছায়ার ডানা বিছিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট জনপদগুলোয় জ্বলে উঠছে সাঁঝবাতি আমরা ফিরে চলেছি হয়ত আর কোনওদিনও আসা হবে নাতাই স্মৃতি পটে শুষে নিতে চাইছি সবটুকু আলো.....       
  ত্রিয়েস্তে শহর খুব ছোট্ট হলেও গোছানো। শহরেই একটি ক্যাসেল আছে। ইতালীয় ভাষায় "কাসা"। ছোট্ট সেই ক্যাসেলে ঢুকলে মনে হবে ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত রাক্ষসীর মায়ায় লোকজন সব উধাও হয়ে গেছেশুধু পড়ে আছে তার যাপন চিহ্ন। হয়ত কোন গোপন কুঠুরীতে রাজকন্যা ঘুমাচ্ছে সোনার কাঠি ছোঁয়ার অপেক্ষায়।
         "কাসাররাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকলেও বাস্তবের রাজকন্যারা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিবিড় দৃশ্যের অবতারণা করেন। অনভ্যস্ত চোখে অসুবিধা হলেও তাদের ব্যবহারে অশ্লীলতা নয়ভালোবাসা ফুটে ওঠে। রবিবার সকালে সমুদ্রের ধারে রোদ পোহানোর মেলা বসে। ইতালীয় মা অনায়াসে উর্দ্ধাঙ্গে পোশাকের বাঁধন না রেখে প্রাতরাশ পরিবেশন করেন পরিবারকে। ইতালিয়ানরা নাকি খুব পারিবারিক। 
 ইতালীয়ান ভাষার কিছু শব্দ আমার চেনা চৌহদ্দিতে পড়ে আর আমি অবাক হয়ে যাই। "অক্কিমানে অক্ষিচোখ। দুয়ে-দ্বিত্রে-ত্রিপাদরে- পিতৃ। মাদ্রে -মাতৃ এইরকম। ল্যাটিন যে কোনকালে আমাদেরও অতি প্রাচীন মাতামহী ভাষা ছিলসংস্কৃত হয়ে আমাদের কাছে বয়ে এসেছে তার প্রমাণ কিসংস্কৃতের মতই ইতালীয়ানে শব্দরূপধাতুরূপ আছে। সংস্কৃতে যেমন পুংলিঙ্গ শব্দ নর শব্দের মতস্ত্রীলিঙ্গ শব্দ লতা শব্দের মত হয়তেমনই। দেশে ফিরে বেশ কিছু বছর পরে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে ইতালীয়ান ক্লাসে যখন ভর্তি হয়েছিলামতখন ধাতুরূপ শব্দরূপ  মুখস্থ করতে হয়েছিল। আমার কম্বল বুদ্ধির কল্যানে যথারীতি তা আবার ভুলে গেছি। ভাষাচর্চায় ক্ষান্ত দিয়ে বরং ত্রিয়েস্তে ফিরি। ত্রিয়েস্তের কাছেই এক মস্ত গুহা আছে। "গ্রত্তা জিগান্তে"। মানে জাইগ্যান্টিক গুহা। সত্যিই বিশাল। স্ট্যালাগটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের বিচিত্র ভাস্কর্য।  
         এবার আমরা প্রস্তুতি নিই আমাদের মাস্টার প্ল্যানকে বাস্তবায়িত করার। অর্থাৎ রোমফ্লোরেন্স আর পিসা ঘোরা। প্রথমে সারারাত ট্রেনে চেপে ভোরবেলা পিসা। পিসার হেলানো মিনার আমার অভিজ্ঞতার ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেল। মিনারে ওঠার অনুমতি নেই। বাইরে থেকে দেখতে আর কতক্ষণই বা লাগে! সাত আশ্চর্যের একটি আশ্চর্য  নিজের চোখে দেখছি এটাই আমার কাছে অষ্টম আশ্চর্য হয়ে দাঁড়ায়। সকাল ন'টার মধ্যেই আমরা আবার রওনা হলাম রোমের উদ্দেশ্যে। র'মা। 

         রোমের রাস্তা মার্বেলে বাঁধানো। সত্যি। পুরোনো রাস্তায় মার্বেলের ব্লক দেখা যায়। একটু অন্তর অন্তরই স্থাপত্যমূর্তি। আমরা প্রথমে আধুনিক পার্লামেন্ট ভবন দেখে কলোসিয়ামে এলাম। কত কত পুরোনো! প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের। কি বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার। প্রায় আশি হাজার লোক বসতে পারত। জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছেকিন্তু ভেঙে পরা স্থাপত্যকেও কত যত্নে রাখা যায় তা তো আমাদের কল্পনায় নেই। কিছু জায়গায় বসার আসনতার নিচে বন্দী আর জন্তু জানোয়ারদের ঘর এখনও দেখা যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোন হতভাগ্য বন্দীর আর্তনাদ সিংহগর্জন আর দর্শকদের উন্মত্ত চিৎকার! তখনই মনে হয় নৃশংসতায় মানুষের জন্মগত অধিকার। যুগে যুগে শুধু ক্ষেত্র বদলে যায়!
 এত মিউজিয়াম যে সব দেখা সাধ্যের অতীত। ভ্যাটিক্যান তো যেতেই হবে। তখন সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল। বাইরে থেকে ভ্যাটিক্যান দেখে বোঝার উপায় নেই কত সমৃদ্ধ ভিতরটা! পরিচয় পত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঐতিহ্য দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল। ভ্যাটিক্যান নিজেই একটা স্টেট। পোপ পরিচালিত। পোপ রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বময় কর্তা। ভ্যাটিক্যানের মধ্যে সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকাসিস্টিন চ্যাপেল আর ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ভ্যাটিক্যান সিটির খরচ চলে পোস্টেজ স্ট্যাম্পমেমেন্টো বিক্রি আর ট্যুরিস্টদের এন্ট্রি ফির টাকাতে।  

         সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা রেনেসাঁ যুগের শিল্প সমৃদ্ধিকে বুকে আগলে রেখেছে। মাইকেল এঞ্জেলোবের্নিনিব্রামেন্তেএদের অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন। সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং এর ফ্রেস্কো দেখলে রোমে রোমে শিহরণ জাগে। বত্তচেল্লিমাইকেল এঞ্জেলো আরও অন্যান্য শিল্পীদের বানানো। ভ্যাটিক্যানকে শিল্প সুষমায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন রাফায়েলও। ওখানেই দেখলাম মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ভাস্কর্য "পীয়েতা"- যীশুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে মেরী মা। মূর্তির পরিধেয়র ভাঁজ এত নিখুঁত যে মনে হচ্ছে কাগজের তৈরী। দেওয়ালের কারুকার্যও তাই। গোস্তাকি মাফ কিয়া যায়তাজমহল দেখেও বলছিএই মার্বেলের শিল্প পার্থিব নয়। যেন কোনও অনন্ত সুরলোক থেকে স্থপতি এসে নির্মাণ করেছেন ইন্দ্রেরও ঈর্ষার যোগ্য এই সৃষ্টি। দেওয়াল জোড়া মোজাইকাগুলো ছোট্ট ছোট্ট পাথরের ব্লকে তৈরী। কিন্তু তাতেও মুখের রেখার অভিব্যাক্তি অবধি নিখুঁত বোঝা যায়। দেখে আশ মেটে না। পা চলে না যেন। মনে মনে আভূমি প্রণত হই শিল্পীদের উদ্দেশ্যে।
         ভ্যাটিক্যান থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারের ফুড কর্নার থেকে সামান্য খাওয়া দাওয়া। পিৎজা। খেতে খেতে বাইসাইকেল থীফের বাচ্চাটার খাওয়া মনে পড়ছিল। চীজটাকে টেনে লম্বা করার খেলা। চীজ যত টেনে লম্বা করা যাবেতত ভালো চীজ। আবার পথে হাঁটা। রোমের দর্শনীয় স্থানের বাইরে বেলুনে প্ল্যাস্টিসিন জাতীয় জিনিস ভরে নানা রকম শেপ দিয়ে অত্যন্ত শস্তায় বিক্রি করছেন যাঁরাতাঁরা আমাদেরই মত দেখতে। আমরা বাংলায় কথা বলছি দেখে এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন। বাংলাদেশী। দারিদ্র জয় করতে জাহাজের খোলে চেপে চলে এসেছেন এদেশে। বৈধ কাগজপত্রের অভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেমুদ্রায় সন্তুষ্ট করে বিদেশে বেঁচে থাকেন ও বাড়িতে টাকা পাঠান। স্বপ্ন দেখেন বেশ কিছুটা পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরে একটা ব্যবসা করার। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আফনাদের কাগসপত্র ঠিকঠাক আসে তো?" তাঁদের আস্বস্ত করি। বেঁচে থাকাটা যে এক আশ্চর্য লড়াই তা আরেকবার অনুভব করি। একদিনে রোম কতটাই বা আর দেখা যায়! শুনলাম ট্রেভি ফাউন্টেনে পিছনদিক করে দাঁড়িয়ে পয়সা ছুঁড়লে নাকি আবার ফিরে আসা যায় র'মায়। পয়সা ছুঁড়ি আমরা। ঝর্ণা আর তার পাশের অপূর্ব মর্মরমূর্তি ফিসফিস করে বলে, "আবার হবে তো দেখা...আজও আশায় আশায় আছি!

 ফ্লোরেন্সইতালীয় ভাষায় ফিরনজে শহরে এসে মনে হল যেন ষোড়শ শতাব্দীতে পৌঁছে গেছি। পাথরে বাঁধানো রাস্তা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই "ম্যুজেওমানে মিউজিয়াম। রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ঘোড়ার গাড়ী। আর্নো নদীর তীরে ক্যানভাসে শিল্পসাধনায় মগ্ন ফ্লোরেন্সবাসী। নদীর উপর পুরোনো কাঠের ব্রীজ, "ponte vecchio". আমরা হাঁটি। ফ্লোরেন্স ইতালীর সাংস্কৃতিক রাজধানী। ফ্লোরেন্সের ডায়ালেক্টই ইতালীর শীলিত কথ্যভাষা। আমাদের কলকাত্তাইয়া ভাষার মত আর কি! এত মিউজিয়ামএত দর্শনীয় স্থান যে বাঁশবনে ডোমকানার মত অবস্থা।  Duomo দেখলাম। সবচেয়ে বড় brick structure এ তৈরী ডোম। ব্রুনেলেসচি আর জত্ত(Giotto) বানিয়েছিলেন। ভিতরে অসাধারণ দেওয়াল চিত্র। 
         আমরা Uffizi museum এ গেলাম। এখানে  বত্তিচেল্লির "The birth of venus" আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির "Annunciation"  রাখা আছে। মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ভাস্কর্য "David" ও এখানে রাখা। মুগ্ধতা...শুধুই মুগ্ধতা... ইতালীয় রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর ফ্লোরেন্স। প্রতিটা গ্যালারী যেন সেই সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। আমরা precious stone এর মিউজিয়ামেও গেলাম। এত রঙের পাথর হয় জানাই ছিল না। শিল্পীরা মোজাইকায় ব্যবহার করেছেন। 
         শেষ বিকেলে বাইরে এসে টের পাই খিদেটা। পয়সা কমে আসছে। রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত হয় "জেলাতোমানে আইসক্রীম খাবার। আইসক্রীম খেয়ে হেঁটে হেঁটে উঠি পাহাড়ের উপর। ডেভিডের পূর্ণাবয়ব প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা আছে। যেন দেবদূত।শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় স্বর্গীয় মহিমায় বিরাজমান। প্রকৃত শিল্পকে অশ্লীলতা স্পর্শ করতে পারে না এমনই ধারণা নিয়ে ফিরতে লাগলাম।

         ত্রিয়েস্তে বাসও ফুরিয়ে এল। পাঁচ সপ্তাহের কোর্স শেষের পথে। আসার সময় দিদি বলেছিল, "ইতালীয়ান অলিভ অয়েল দুর্দান্ত! ওরা মাখে বলেই অত সুন্দর!তখন ভেবেছিলাম কে জানে! খায় না মাখে! এখানে এসে দেখলামখায় তো বটেইমাখে কি না জানি না। তাই অলিভ অয়েল লিটারে বিক্রি হয়। এক লিটার নিলাম দিদির জন্য। ছোট্ট ছোট্ট মোসাইকার বাক্স নিলাম গিফটের জন্য। ওদের দোকানে দোকানে সুতীর খুব কদর। "কোতোনেবলতে অজ্ঞান। এক জায়গায় একটা স্যুটের গায়ে "khadi cotton" লেখা দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে ভেবেছিলাম দেশে ফিরে ফিয়ে ড্রেস মেটিরিয়াল export শুরু করব। আর শাড়ি। এমনি নয়স্টীচ করে। ওরা এত ভালোবাসছে! ভাগ্যিস করিনি! নইলে আম্বানী আজ করে খেতে পারতবলুন?


  ত্রিয়েস্তের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেতাম লেখা, "স্ত্রাদা সেনজা উশিতামানে, "way without exit"। মনে মনে ভাবি আমার ইতালী বাসও এমন হলে কেমন হয়? "স্ত্রাদা সেনজা উশিতা?" নানাতাতো হয় না। দেশে অসুস্থ বাবামাদিদিরাজামাইবাবুরাগুন্ডুস বোনপোগুলো... মুকুজ্জেমশাই...তাকে বিয়ে করতে হবে... ফিরতে হবেই। L'italia মনের ক্যানভাসে তার রঙ রূপ নিয়ে বড় সুন্দর ছবি এঁকেছে। যত্নে লালন করন তাকে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। 
         ফেরার পথে আবার দিল্লী হয়ে কলকাতা। দিল্লীতে বারো ঘন্টা ওয়েটিং।ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞেস করে, "anything to declare?" কি বলবযে মণিমুক্তো স্মৃতির প্রতিটি বিন্দুতে ভরে নিয়ে আসছি তা জানাতে হবেহেসে বলি, "nothing but memories." 


শান্তা মুখোপাধ্যায়