নাসের হোসেন—আপাদমস্তকএক
স্বপ্নে-পাওয়া মানুষ
“দীর্ঘতম জীবনের দীর্ঘ
উপাখ্যান শোনানো হবে আজ”—এমন পঙ্ক্তিযে-কবির কলম লিখতে পেরেছিল তার নাম নাসের
হোসেন;এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।তবে, মাপ করবেন
প্রিয় পাঠক, এই উদ্ধৃতি দিয়ে আজ জীবন নয়, এক মৃত্যুর উপাখ্যানের মুখবদ্ধ লিখতে
হচ্ছে। সেই উপাখ্যান আবার সেই প্রিয়তম কবিকে নিয়েই।
বড়ো
তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেল, বন্ধু ও কবি নাসের হোসেন। কবিতা পাক্ষিক প্রকাশিত
‘আমাদের নাসের হোসেন’ সংকলনটির জন্য নাসের কবিতার উপর একটা আলোচনা লিখেছিলাম
২০১৮-র মার্চে; তাকে নিয়ে যে এত তাড়াতাড়ি আবার কলম ধরতে হতে পারে, তাও এমন একটা
সময়ে যখন সে আমাদের সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে, সে কথা কখনো দুঃস্বপ্নেওভাবিনি। বেঁচে
থাকা মানুষের এই এক যন্ত্রণা, প্রিয়জন-বিয়োগের শোককে বুকে আঁকড়ে ধরে তারস্মরণে কোনো
গদ্য লেখা। তবু, ব্যাপারটা স্বার্থপরেরমতো
শোনালেও, একথা তো অস্বীকার করা যায় না, শোক যত গভীরই হোক এক সময় সেই শোক থেকে
বেরিয়ে আবার ফিরে আসতে হয় সহজ ও স্বাভাবিক জীবনে। সেটাই তো বেঁচে থাকার শর্ত। আমরা, যারা নাসেরের কবিতার অনুরাগী এবং তার
ব্যক্তি-জীবনের ঘনিষ্ট-বৃত্তের লোকজন, তাদের কাছে এখন এটাই একটা বড়োচ্যালেঞ্জ। যে
জীবন-দর্শনের মধ্যে আমরা আজন্ম লালিত-পালিত, এটা তো তারও একটা শিক্ষা। তবে নাসেরের
এই চলে যাওয়াটা বড়ো আকস্মিক, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, যা আমাদের হতচেতন ও বিমূঢ়
করে দিয়েছে।
আচ্ছা,
এই গদ্যে কি আমি সত্যিই মৃত্যুর উপাখ্যান লিখতে বসেছি, না জীবনের। তার অজস্র
কবিতায় নাসের তো ঘুরিয়েফিরিয়ে সেই জীবনের কথাই লিখেছে।সে জীবনবাস্তবের নয়,
জাদু-বাস্তবের। নাসেরই তো লিখেছিল-“হয়তো সবটাই জাদু,
বস্তুত জাদুর জীবন কথাটাইঅধিক সত্য, অসত্য
কিছু নেই”। নাসের বলেছিল - “এসো আজ খুলে দিই জীবন, এসোঝরে যাক রক্তচন্দন/আশ্বিন
প্রদোষে”…।
আশ্বিন
নয়, হেমন্তের দ্বি-প্রহরে ঝরে গেল নাসের নামক প্রিয় সেই রক্তচন্দনেরমহীরুহটি।
যাঁরা
নাসের হোসের কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক, তাঁরা জানেন নাসের হোসেন মানেই আপাদমস্তক এক
স্বপ্নের নাম, এক স্বপ্ন-দেখা-মানুষের নাম। যে-কবির চোখে এক ‘ঐন্দ্রজালিক চশমা’; সেই
আশ্চর্য চশমার ভিতর দিয়ে সে দেখতে পায়-“স্বপ্নের ঝরনা উঠছে নামছে, অজানা পাখিদের কূজন…”, এবং লিখতে পারে, “ঘুমিয়ে থাকতে/ থাকতে স্বপ্ন
দেখি অজস্র অসংখ্য গোলাপ শুধু নেমে আসে আকাশ থেকে”।
শুধু
গোলাপ নয়, নাসেরের স্বপ্নে জেগে থাকে রূপসী আপেল, নৌকা-জ্যোৎস্না-নারী, আরো কত কী।
হত্যা মৃত্যু ধ্বংস কোনো কিছুই নাসেরকে বিচলিত করতে পারেনি, তাই সে অনায়াসে
উচ্চারণ করতে পারে-“ধ্বংসের ভিতর থেকে উঠে আসে উল্লাস”। বলতে পারে- “এই বিস্ফোরণ
আর নগ্নতার দিনে/ আমার ভিতর/ গান গেয়ে ওঠে নিশি পাওয়া মানুষ”।
আসলে
কোনো নেতিবাদের ভিতর নাসের নিজের লেখাকে সমর্পন করতে চায়নি। তার কাছে সব কিছুই
প্রসন্ন।সবকিছু সবুজ। সবকিছুই শুভ, সুন্দর ও কল্যাণময়। তার কলমে উঠে আসে শুধু অনন্ত
জীবনের কথা, বেঁচে থাকার কথা- –“জীবনের প্রসন্ন ভিটেতে/ বেঁচে আছি, আছি।”সেই দিক
দিয়ে দেখতে গেলে নাসের অনেকটাই রবীন্দ্র-পথের পথিক।
সদা-হাস্যময়,
শান্ত, স্নিগ্ধ, সৌম্য ও সমাহিত নাসের এমনই এক আশ্চর্য মানুষ যে, যে-কোনো সময়ে
যে-কোনো জায়গায় বসে লিখে যেতে পারত পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি, মানে যাকে বলে
অটোমেটিকরাইটিং। সেই লেখার ভিতর থাকত একটা নতুন করে জেগে ওঠা; জীবন ও জপগৎকে দেখা
ও চেনার নতুন নতুন বিস্ময় ও আনন্দ।
আর
নাসেরের কাঁধের সেই বিখ্যাত ঝোলাটি, আমরা তো সবাই সেই ঝোলাকে চিনি। বিস্তর ‘স্বপ্ন
ও অনুরাগ’-এ বোজাই ঝোলা কাঁধে সেই মানুষটি, যার “প্রতিটি পা ফেলায় ভরে আছে নাচ”, যার “প্রতিটাপদক্ষেপ থেকে উঠে আসে আলো,
অর্বুদ”, যে চলে যেতে চায় ভালোবাসা থেকে
আরো ভালোবাসার দিকে, সে-মানুষ তো কখনোই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না।
হ্যাঁ,
তার কবিতার জীবনমুখী ভাবনার মধ্যেই নাসের বেঁচে আছে, নাসের বেঁচে থাকবে; আরতার কলম
জানিয়ে দেবে-ঃআজ আমি উঠে যাচ্ছি আকাশপ্রদেশ, তারও উপরে
কোনো/রহস্যলোকে,…”।
নাসেরের
কবিতার এই অনুপ্রেরণা থেকে শক্তি সঞ্চয় করেআজ আমরাও বেরিয়ে আসতে
চাইছি প্রিয়জন হারানোর দুঃখ ও বেদনা থেকে। আজ আমরাও অনুভব করতে পারছি - “জীবন/হয়তো এর
থেকে বেশি কিছু নয়, জীবন হয়তো এর থেকে/কম কিছুও নয়,…”।
0 মন্তব্যসমূহ