ভালো অভিনেতা আর জনপ্রিয় অভিনেতা কি এক? যিনি যত বেশি জনপ্রিয় তিনি কি তত বড়ো ভালো অভিনেতা? কিংবা যিনি যত বড়ো ভালো অভিনেতা তিনি কি তত বেশি জনপ্রিয়? সাধারণ ভাবে সাধারণ দর্শকের কাছে জনপ্রিয় অভিনয় মানেই ভালো অভিনেতা। ফিল্ম ইণ্ড্রাস্ট্রিতে একটা অশ্চর্য্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়। একজন অভিনেতা একবার জনপ্রিয় হয়ে গেলে। দর্শক আর তাঁকে অভিনয় করতে দেখতে চায় না। দর্শক চায় তিনি তাদের মনোরঞ্জন করে চলুন। এখন একজন জনপ্রিয় অভিনেতা কিভাবে দর্শকের মনোরঞ্জন করে থাকেন। একজন অভিনেতার পরপর কয়েকটি ছবি জনপ্রিয় হয়ে গেলেই। সেই সেই ছবিতে অভিনেতার হাঁটা চলা কথা বলা। কণ্ঠস্বর, স্বরক্ষেপণ। চোখের চাহনি। মুখের হাসি। পোশাক পরিচ্ছদ। কেশবিন্যাস। নৃত্যভঙ্গি, ক্লাইম্যাক্সের সিনে তাঁর সামগ্রিক উপস্থিতি। এই সমস্ত কিছুই, একটার পর একটা ছবিতে পুনরাবৃত্তি করে করেই একজন জনপ্রিয় অভিনেতা তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রাখেন। আর সেই ধরে রাখাই স্টারডম। সেই স্টারডমের ভিতরে যতদিন একজন অভিনেতা রয়ে যাবেন। ততদিনই তিনি দর্শকের মনোরঞ্জন করে যেতে সফল হবেন। সাধারণ দর্শক সিনেমা হলের পর্দায় এই সকল স্টারদেরকে দেখতেই পয়সা দিয়ে টিকিট কাটে। তারা, সিনেমার গল্প যাই হোক। যেমনই হোক। তাদের প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীকে নানান পোশাকে একই স্টাইলে পর্দায় নড়াচড়া করতে দেখতে চায়। ফলে একবার একজন অভিনেতা যদি কোনভাবে জনপ্রিয় হয়ে যান। তাঁর পক্ষে সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখার একটিই উপায়। অভিনয় বিসর্জন দিয়ে সব ছবিতেই একই রকম শৈলীতে পর্দায় উপস্থিত হওয়া। সিনেমার প্রযোজক মাত্রেই এই সত্যটুকু অত্যন্ত ভালে করেই জানে বলে তারা নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই ক্রমাগত একের পর এক স্টার তৈরী করে যায়। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই ভালো অভিনয়ের পিছনে অর্থলগ্নী মুনাফাজনক নয়। বরং জনপ্রিয় স্টার তৈরীর পিছনে অর্থলগ্নী অনেক বেশি মুনাফার।
ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির প্রায় একেবারে সূচনালগ্ন
থেকেই এই অবস্থা চলে আসছে। আমাদের বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় যে জুটি। প্রায়
কিংবদন্তীর মতো জনপ্রিয়তা। সেই উত্তম-সুচিত্রা জুটির দুই অভিনেতা অভিনেত্রীও আজীবন
তাঁদের সেই জনপ্রিয়তার ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পাননি। ছবির পর ছবিতে সেই একই উত্তমকুমারকে
আমরা দেখি। একের পর এক গল্পের চরিত্রগুলি সেই একই স্টাইলে চুলছাঁটে। একই স্টাইলে
তকায়। ঠিক একই রকম রোমান্টিক মুডে নায়িকা চরিত্রের সাথে ইনটারেক্ট করে চলে। উল্টো
দিকে অভিনেগ্রী রূপে নন। সুচিত্রা সেনও ঠিক সুচিত্রা সেন স্টাইলেই ছবির পর ছবিতে
একের পর এক চরিত্রে দর্শকের সামনে হাজির হন। সেই এক সাজে। এক ছন্দে। এক লয়ে। চেনা
হাসি। চেনা রূপ। নায়িকতাচিত। নায়কচিত। দর্শক সেই নায়ক নায়িকারূপী উত্তম
সুচিত্রাকেই দেখতে যায়। পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমার প্রযোজকদের হাউসফুল শো উপহার
দিয়ে বাড়ি ফিসে আসে। উত্তমকুমার সুচিত্রা সেনকে দেখে আসার আনন্দে।
ফলে দর্শক যখন বাড়ি ফিরে এসে সিনেমা দেখে আসার
আনন্দটুকু উপভোগ করে। সেই আনন্দে সিনেমার কোন ভুমিকা নেই। সিনেমার চরিত্রগুলির কোন
ভুমিকা নেই। এমনকি চিত্রপরিচালকেরও কোন ভুমিকা থাকে না। একমাত্র ভুমিকা থাকে
জনপ্রিয় অভিনেতা জনপ্রিয় অভিনেত্রীর। সিনেমায় যে গল্পটি দর্শকদের দেখানো হলো। সেই
গল্পের কোন চরিত্র। তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে দর্শকের মনে গভীর ছাপ রাখলো না।
গভীর ছাপ রাখলো বরং দর্শকের চেনা প্রিয় অভিনেতা প্রিয় অভিনেত্রীর পর্দায় সার্বিক
উপস্থিতি। এবং সেই ছাপ রাখার উপরেই দর্শক মনে করতে থাকলো। তাদের প্রিয় অভিনেতা
অভিনেত্রী অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার নিদর্শন রেখেছেন। যত বেশি জনপ্রিয়তা। তত বেশি
অভিনয় দক্ষতা। এই যে ফিল্মের দর্শকের মানসিকতা এটাই ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির প্রাণ
ভোমরা। ছবির পর ছবিতে দর্শক প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীর দিকে তাকিয়ে মশগুল থাকে। তাঁরা
যে চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেন। দর্শকের মনে সেই চরিত্রগুলি কোনরকম ছাপ রাখে না। ছাপ
রাখে প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীর জনপ্রিয় ম্যানারিজমগুলি। চেনা স্টাইলগুলি। বার বার
দেখা মুখশ্রীটুকু, দেহসৌষ্ঠবটুকু।
বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির এই চেনা ছকের ভিতরেই
বাংলার অভিনেতা অভিনেত্রীরা যে যাঁর দক্ষতায় জনপ্রিয় হয়েছেন। বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন।
ক্ষেত্রবিশেষে কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছেন। একের পর এক জন। প্রমথেশ বড়ুয়া থেকে শুরু করে
প্রসেনজিৎ। কানন দেবী থেকে শুরু করে ঋতুপর্ণা। এমনকি বাংলা ছবির তথাকথিত
স্বর্ণযুগের বিখ্যাত সব অভিনেতা থেকে অভিনেত্রীরা। যিনি যত বেশি বিখ্যাত হয়েছেন।
তিনি তত কম বিভিন্ন চরিত্রকে প্রাণ দিতে পেরেছেন। ছবির পর ছবিতে নিজেকে নিজের মতো
করেই উপস্থাপিত করে গিয়েছেন। দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য। কে নয়? রবীন মজুমদার, নবদ্বীপ হালদার,
বিকাশ রায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্র, তুলসী লাহিড়ী,
তুলসী চক্রবর্তী, অসিতবরণ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, বসন্ত চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ। এরপরে চিন্ময়
চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর
দে, রঞ্জিত মল্লিক। অভিনেত্রীদের ভিতরে ভারতী দেবী, মলিনা দেবী, সুমিত্রা দেবী, ছায়া
দেবী, মঞ্জু দে, সুপ্রিয়া চৌধুরী,
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী চট্টোপাধ্যায়,
অনুভা, অঞ্জনা ভৌমিক, সন্ধ্যারাণী,
সন্ধ্যা রায়, অপর্ণা সেন, সুমিত্রা। এঁদের প্রায় প্রত্যেকের অভিনয় প্রতিভা কিন্তু সত্যিই অত্যন্ত
উচ্চস্তরের ছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রযোজকদের মুনাফার জন্য যে দর্শক মনোরঞ্জনের
জোগান দেওয়া অবশ্যক। এঁরা সেই মনোরঞ্জনের জোগান দিতে গিয়ে। পর্দায় নিজেদের অভিনয়
দক্ষতাকে ততটা নয়। যতটা না তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজেদের, ‘পর্দার উপস্থিতিকেই’। যাকে চলতি ভাষায় স্ক্রিন
প্রেজেন্স বলা হয়ে থাকে। এঁদের নিজেদের জনপ্রিয়তাই এঁদের অভিনয়কেও ম্লান করে
আচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছে। পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন। আমি বিশেষ একজনের নাম স্মরণ
করি নি এখানে। এখনো। উত্তম সুচিত্রার কথা দিয়েই আলোচনা শুরু হয়েছে। ফলে তাঁরা দুজন
তো আছেনই। কিন্তু যাঁর নাম এখনো স্মরণ করা হয়নি। তিনি ‘ছবি
বিশ্বাস’। এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমীতায় তাঁর
কাছাকাছি অবশ্য রয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী, অসিতবরণ। এবং কিছুটা
পরিমাণে ছায়া দেবী, অনুভা, পাহাড়ী সান্যালও।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে সকলের থেকে আলাদা একটা
অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভার জোরে। যদিও, ইণ্ডাস্ট্রির প্রয়োজনে একের পর এক বহু ছবিতে
পরিচালকরা তাঁকে ছবি বিশ্বাস হিসাবেই পর্দায় উপস্থিত করিয়ে গিয়েছেন। নায়ক নায়িকার
পিতা, জ্যাঠা, মেশো ইত্যাদি ভুমিকায়।
কিন্তু যে ছবিগুলিতে তিনি বিশেষ বিশেষ চরিত্রকে রূপায়িত করে গিয়েছেন। যে ছবিগুলি
তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলিকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত। বিশেষ করে সেই সেই সিনেমায়। আমরা
সেই বিশেষ বিশেষ চরিত্রগুলিকেই স্বয়ং ছবি বিশ্বাসের থেকেও বেশি স্মরণে রাখি। আর
এইখানেই একজন অভিনেতার শ্রেষ্ঠ কাজ। তাঁর অভিনীতি চরিত্রটিই দর্শকের চেতনে অবচেতনে
ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিন্তু অভিনেতা নিজে সেই চরিত্রেরই আড়ালে পড়ে রইবেন। তবেই
সার্থক তার অভিনয়। খুব কম অভিনেতা অভিনেত্রীই এই বিশেষ দক্ষতার প্রমাণ রাখার সুযোগ
পান। কিংবা সুযোগ পেলেও রাখতে সক্ষম হন। কারণ আমরা আগেই দেখেছি। প্রযোজকের অর্থ
সেই রকম চরিত্র সৃষ্টিতে লগ্নী হয় কম। যেখানে চরিত্রের আড়ালে পড়ে যাবেন একজন
জনপ্রিয় অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী। ছবির পর ছবিতে সেই ঘটনা ঘটতে থাকলে স্টারডম
ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। প্রযোজকরা সেই ঝুঁকি নিতে চান না কখনোই। স্টারডম নির্মাণেই
ফিল্মইণ্ডাস্ট্রির জীয়নকাঠি।
বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে ছবি বিশ্বাস এক
অবিস্মরণীয় প্রতিভা। এক অবিস্মরণীয় কীর্তির অধিকারী। এমন এক একটি চরিত্রকে তিনি
নিজের অভিনয় দক্ষতায় সৃষ্টি করে দিয়ে গিয়েছেন। যে চরিত্রগুলি বাংলা সিনেমার
ইতিহাসে এক একটি মাইলস্টোন। একটি চরিত্রের ছবি বিশ্বাসের থেকে অন্য চরিত্রের ছবি
বিশ্বাস এতটাই ভিন্ন, এতটাই
আলাদা যে সেই ভিন্ন ভিন্ন ছবি বিশ্বাসকে জনপ্রিয় ফিল্মস্টার ছবি বিশ্বাসের সাথেও
মেলানো যায় না। মেলানো যায় না সেই ভিন্ন ভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রগুলিকেও পরস্পরের
সাথে। এখানেই ছবি বিশ্বাসের অনন্যতা। এবং কি অনায়াস দক্ষতায় তিনি সেই অসাধ্য
কাজটিকেই সহজসাধ্য করে তোলেন। গল্পের চরিত্রকে সমানে রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে যান
বাস্তবের অভিনেতা। গল্পের চরিত্রের কাছে নিজেই নিজেকে ম্লান করে রাখেন। অভিনেতাকে
ছাপিয়ে ওঠে গল্পের চরিত্র। স্টারডমের সমস্ত ছক ভেঙে ফেলে একজন অভিনেতা অভিনয়
শিল্পকেই প্রধান করে তোলেন। তিনি ছবি বিশ্বাস। এবং এ কথাটিও আমাদের স্বীকার করতে
হবে। ছবি বিশ্বাস যে কাজটি করে দেখিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেই একই কাজ কিন্তু উত্তম
সুচিত্রা সৌমিত্র করে যেতে পারেননি। তাঁরা তিনজনেই বহু রকমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন
একথা সত্য। কিন্তু দর্শক হল থেকে বেড়িয়ে এসেছে তাঁদের তিনজনকে নিয়েই। তাঁদের
অভিনীত চরিত্রগুলিকে নিয়ে নয়। একজন অভিনেতা অভিনেত্রী’র
জীবনে এটাই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। দর্শক তাঁকে নয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রকে বুকে নিয়েই
হল ছাড়বেন। যদি সেটা সম্ভব হয়। তবেই সার্থক হয় অভিনয়। ভারতীয় সিনেমায়। যে কাজটি
তাঁর সমগ্র অভিনয় জীবন ধরে ছবির পর ছবিতে সাফল্যের সাথে সার্থক করে গিয়েছেন আর এক
অবিস্মরণীয় অভিনেতা। ‘ওম পুরী’।
স্টারডমের সমস্ত ছক তছনছ করে দিয়ে ওম পুরীর অভিনীত চরিত্রগুলি অভিনেতা ওম পুরীকেও
ছাড়িয়ে গিয়েছে। একথা সত্য। ওম পুরী ছবি বিশ্বাসের অনেক পরে সিনেমায় এসেছিলেন।
ততদিনে সিনেমাও অনেক সাবালক হয়ে উঠেছিল। ওম পুরী অনেক বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করার
সুযোগ এবং সুবিধে পেয়েছিলেন। দুই জনে দুই ভিন্ন সময় এবং দুই ভিন্ন অঞ্চলের শিল্পী।
কিন্তু দুইজনের কাজের ভিতরেই অভিনয় দিয়ে অভিনেতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার দক্ষতার প্রমাণ
রয়ে গিয়েছে। এই দক্ষতাই একজন ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীর তুরুপের তাস। একজন ভালো
অভিনেতা অভিনেত্রীর সামগ্রিক পরিচয়। স্টারডমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে।
©শ্রীশুভ্র ২৪শে মে ২০২৪
0 মন্তব্যসমূহ