(১)
“বাড়ির পশ্চিম দিকের জানালাটায় বসে ছিলাম । বড়ো বড়ো খোপওলা ডিজাইনার গ্রিল
দেওয়া জানালা, ভিতরের দিকে বসার ব্যবস্থা । আমার বয়স তখন কত হবে ! সাত কি আট ! গ্রিলের
ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে হাওয়াই চটি সমেত পা-দুটো বের করে দিকে নাচাচ্ছিলাম — ওটা ছিল
একটা খেলা — কিছুতেই যেন পা থেকে চটিদুটো খুলে না যায় । কিন্তু হঠাৎ একপাটি চটি পড়ে
গেল জানালার বাইরে । তড়িঘড়ি হাত থেকে খেলনা পিস্তলটা রেখে, গ্রিলে মুখ চেপে, নীচের
দিকে ঝুঁকতেই দেখি একটা বিশ্রী দেখতে লম্বাটে লোক আমার চটি-টা হাতে নিয়ে ঘাপটি মেরে
ঠিক জানালাটার নীচে বসে আছে । ভয় পেয়ে মা-কে চেঁচিয়ে ডাকলাম । মা সাড়া দিচ্ছে না দেখে
লোকটাকে কিছু বলতে যেতেই দেখি সে বড়ো বড়ো দাঁত বের করে খ্যাকখ্যাক করে হাসছে । আমি
রেগে চিৎকার করে উঠতেই লোকটা উঠে দাঁড়ায় — বাপরে ! কী লম্বা ! অন্তত আট ফুট তো হবেই
! প্রথমে জানালার ভিতর থেকে তার বুক অব্দি দেখা যাচ্ছিল । তারপর সে একটু পিছিয়ে গিয়ে
আমাদের গন্ধরাজ গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আর আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল । আমি জানালার
থাক-টা থেকে নামতে যেতেই লোকটা ডানহাত থেকে বাঁ হাতে আমার চটি-টা নিয়ে, ডানহাতটা আমার
দিকে বাড়িয়ে দিল । চমকে দেখি, হাতটা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে । লাফিয়ে নেমে ছুট্টে বারান্দায়
গিয়ে কাউকে দেখতে পাই না । ছুটে বারান্দাটা পেরোতে গিয়ে দেখি চেনা বারান্দাটা কখন একটা
দুপাশে লাল ইঁটের পাঁচিল তোলা সরু গলি-তে বদলে গিয়েছে । দুপাশে শুধু ইঁটের দেওয়াল
— কোনো বাড়ি নেই — কোনো দরজা নেই — পালাবার পথ নেই । ছুটতে গিয়ে পা থেকে আরেক পাটি
চটি খুলে যায় — খেয়ালই করি নি এতক্ষণ একপায়ে জুতো পড়ে দৌড়েছি ! লোকটা এবার হাত বাড়িয়ে
এই চটিখানাও তুলে নেয় । লোকটা ভয়ংকর ভাবে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে । এদিকে গলি শেষ
হয়ে আসছে । দুদিকে দেয়াল, সামনে দেয়াল । ঘুরে দাঁড়াতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় । দাঁড়িয়ে
পড়তে হয় । লোকটা তার স্প্রিং-এর খেলনার মতো লম্বা হয়ে ঝুলে পড়া হাতদুটো গুটিয়ে নিয়ে
ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে । দু-হাত গলার দিকে বাড়িয়ে দেয় । ভয়ে আমার দম বন্ধ
হয়ে আসছিল । এমন সময় --- ঘুম-টা ভেঙে যায় ।” — এই পর্যন্ত একটানা বলে দীর্ঘ একটা শ্বাস
ফেলে অর্ক থামল ।
রাকা বাঁ চোখের ওপর উড়ে আসা চুলগুলো আঙুলে পাকিয়ে কানের ওপর তুলে দিয়ে,
ভ্রূ কুঁচকে বলে, “হাইলি সাসপিসিয়াস অ্যান্ড ভেরি প্রিসাইস্ !”
অর্ক শুধু হাসে — তবে তার হাসিটা কেমন যেন দুর্বল ঠেকে ।
রাকা চোখে একটা ইশারা করে । অর্ক বিব্রত বোধ করে । রাকার সাথে ওর পরিচয়
ইউনিভার্সিটিতে । সেসময় ও রাকাকে বিশেষ পাত্তা দেয় নি । কিন্তু কথা প্রায়ই হতো । ছেলেদের
দলে রাকা ছিল বেশি স্বচ্ছন্দ । ও সুন্দরী তো বটেই, দারুণ বুদ্ধিমতীও । আগে দুজনেই দুজনকে
তুইতোকারি করতো । তারপর মাস্টার্স শেষ করে অর্ক আর বন্ধুদের সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখতে
পারে নি । বছর দুই আগে রাকার বিয়ের খবর এক কমন ফ্রেন্ড ইন্দ্রনীলের মুখে শুনেছিল অর্ক
। একটু অবাকই সে হয়েছিল, নিমন্ত্রণ না পেয়ে । আবীরদা, অর্থাৎ রাকার বর, ইউনিভার্সিটিতে
অর্কদের থেকে তিনবছরের সিনিয়র । মেধাবী ছাত্র ছিল । এখন সে মনোবিদ আবীর সান্যাল । চার
বছর পর, হঠাৎ করেই দার্জিলিঙে এসে রাকার সাথে দেখা হয়ে গেল অর্কর । পরেশের বাড়িতে কবিতার
আড্ডায় আবীরদার সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল অর্ক আর রাকার — মনে পড়ে অর্কর । আবীরদার সাথে
ওর শেষ দেখা হয়েছিল বোধহয় মাস তিনেক আগেই — বরধান মার্কেটে । এখন এই আবার --- । লাভায়
এসে মনাস্ট্রী দেখতে যাবে বলে বের হতেই পিছন থেকে ডাক, “এই অর্কদা !” সত্যি বলতে রাকার
ব্যবহার যথেষ্ট স্বাভাবিক । কিন্তু রাকা ওকে ‘তুই’ না বলে ‘তুমি’ সম্বোধন করতেই, অর্ক
বুঝে যায়, রাকা চাইছে না, তার বর ওদের পরিচিতির আন্তরিকতা বিষয়ে সম্যক জানুক । বাধ্য
হয়ে অর্ক-কেও ‘তুমি’ ‘তুমি’ করতে হচ্ছে ।
কুয়াশা কেটে রোদ উঠছিল । আবীর অর্ক-কে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে
হেসে বলল, “Dream comes from the stomach বুঝলে ! এটা একটা জনপ্রিয় মত । তবে মনে হচ্ছে,
তুমি সেসময় খুব আজগুবি ভূতের গল্প পড়তে । আর এই গল্পটা তুমি আমাদেরই প্রথম শোনালে,
এমনটা নয় — এত সাজিয়ে বললে মানে আগেও বারকয়েক শুনিয়েছো ।”
“তা বটে !” — অর্ক-কে মানতেই হয় ।
রাকা কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করে, “স্বপ্নে কি ওটা ভূতই ছিল ?”
“স্বপ্ন যখন — তখন বলা মুশকিল !” — অর্ক বুঝে পায় না কী বলবে ।
“বিচ্ছিরি স্বপ্ন, তবে ওই বয়সে অমন স্বপ্ন দেখাটাই স্বাভাবিক ।”
আবীর দা মোমো আনতে উঠে গেলে অর্ক ভালো করে রাকার দিকে তাকায় । ফুরফুরে রোদ
এসে পড়েছিল রাকার কপালে । অর্কর চোখে অনিচ্ছাকৃত বিস্ময় ভর করে । অর্ক অনুভব করে, রাকাকে
আশ্চর্য সুন্দর লাগছে । এই সিঁদুর ব্যাপারটাই ভারি অদ্ভূত । বাঙালি মেয়েদের গ্ল্যামার
বাড়াতে এর জুড়ি নেই । রাকা ওর ফরসা হাত দুটো নেড়ে নেড়ে কথা বলে । সোয়েটারের নেভি ব্লু
রঙ্ থেকে দুটো সোনা রঙের হাত বেরিয়ে এসে বাতাসে যেন ম্যাজিক তৈরি করছে । অর্ক ভাবতে
চেষ্টা করে, বিয়ের পর রাকা কি আরো সুন্দরী হয়েছে ? এখন জিন্স পরে আছে — দারুণ মানিয়েছে
। এইসময় আবীরদা মোমো-র প্লেট নিয়ে এগিয়ে এলে, অর্কর ঘোর কাটে । তার ভাগের মোমো দুটোকে
সেই মুহূর্তে রাকার চেয়েও আকর্ষণীয় মনে হয় ।
মোমো-তে কামড় বসিয়ে আরামে দু-চোখ বুজে আবীরদা বলল, “অর্ক, আদিম যুগে মানুষ
যা ভাবত আর যেভাবে ভাবত, তার ধরণ নানাভাবে বদলেছে, বদলাচ্ছে । মানুষের মস্তিষ্ক, পৃথিবী
সম্পর্কে ধারণা, আত্মা, আগ্রহ — সব বদলাচ্ছে । মানুষ এখন যেসব সমস্যার মোকাবিলা করে,
তা আরো জটিল ।
ফিচেল হেসে রাকা বলে ওঠে, “ইয়েস… আই নিউ ইট, হ্যাভ সাম গ্যানস্ !”
“ঠিক কী বলতে চাইছ আবীরদা ?” — অর্ক প্রশ্ন করে ।
“বলতে চাইছি, স্বপ্ন ওই প্রভাবগুলির সাথে বর্তমান ।” — একটু থেমে মোমোর
স্যুপটুকু আয়েস করে গলাধঃকরণ করে আবীরদা ফের বলতে থাকে, “প্রকৃতিতে কিছু উদ্দীপক আছে
। এগুলো অনায়াসে আমাদের উদ্দীপিত করতে পারে । এমনকি একটা শব্দও এটা পারে । একটা জোরালো
আলো, একটা দুর্গন্ধ তোমায় যন্ত্রণা দিতে পারে । তীব্র বিরক্তি জাগাতে পারে । আর যদি
তুমি সেসময় ঘুমন্ত অবস্থায় থাকো, তবে
ঐ বিরক্তকর অনুভূতির প্রভাব হবে অস্বাভাবিক । আর ঘুমের মধ্যে সেটাই স্বাভাবিক । আমরা
যখন ঘুমোই, তখন আমাদের শরীরের যেসব অঙ্গ নগ্ন থাকে, তা ঠান্ডা বা গরম — যেকোনো দ্রব্যের
সংস্পর্শে এলে সেই মুহুর্তেই আমাদের ঘুমের উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে । ভোরবেলায় মোরগের
কর্কশ চিৎকার স্বপ্নে মৃত্যু বা ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদের রূপ নিতে পারে । বুকের ওপর
ভারী কিছুর অনুভূতি, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে তোমাকে দমবন্ধ-করা পরিস্থিতির সম্মুখীন
করতে পারে ।”
রাকা এবার উসখুস করে ওঠে । তারপর ঠোঁট ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ তার গম্ভীর বরের
দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে । তারপর আপন মনে বলে ওঠে, -
“বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু ।”
আবীর যেন কোনো গোপন ইঙ্গিতের মর্মার্থ অনুধাবন করেই গাম্ভীর্য ত্যাগ করে
এবার হেসে ফেলে । অর্কর হঠাৎ মনে হয়, এই রাকা-কে সে চেনে না । এই রাকা বড্ড টানছে তাকে
।
চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে আবীর এবার রাকার দিকে তাকিয়ে মজার সুরে ছড়া কাটে —
“হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী,
তিনজনেতে জটলা করে, ফোকলা হাসির পাল্লা দি !“
রাকা কৃত্রিম বিস্ময়ের ভান করে, “তুমি ফোকলা বুঝি !”
(২)
লাভায় এসে অর্ক খেয়াল করে, কাঞ্চনজঙ্ঘাটা বেমালুম উধাত্ত হয়ে গেছে । চারপাশে
সবুজ পাহাড়ে মেঘ-রোদের আলোছায়া । আর একটু উঠলেই মনাস্ট্রী । কবিতার পংক্তি সত্যি করে
দিয়ে মেঘগুলো যেন ঠিক গাভীর মতোই চড়ছে । চড়াই বেয়ে উঠতে হবে — উঠতে উঠতেই ঠান্ডা হাওয়ায়
শীত-ভাবটা বেড়ে যায় । মেঘগুলো ভারী হয়ে গায়ের কাছে নেমে এসে প্রায় ছুঁয়ে দিতে চাইছে
। জায়গাটা এমন যে অর্কর মনে হয় সে চীনের প্রাচীর ধরে হাঁটছে । দুপাশে পাথরের প্রাচীর
প্রায় অর্কর বুক অবধি উঁচু । মনাস্ট্রীর প্রবেশ-তোরণে লেখা — ‘Kagyu Thekchen Ling
Monastery’ । দূরে দূরে সবুজ পাহাড়ের মাথায় দুধসাদা মেঘ ছুঁয়ে আছে । যেন মায়ের মতই
মমতায়, স্পর্শ করে আছে তাদের সবুজ-বৎসদের । ছোটো ছোটো বিভিন্ন রঙিন ধর্মীয় পতাকা মনাস্ট্রীর
প্রবেশ-প্রাচীরের গায়ে পতপত করে উড়ছে । এই হলুদ, সাদা, কমলা, গোলাপি, সোনালি রঙের পুঁচকে
পতাকাগুলো নিঃসন্দেহে যে কোনো মনাস্ট্রীর শোভা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় ।
প্রাচীরের শেষপ্রান্তে নীচের দিকে ঝুঁকে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে ছিল রাকা
। মুখোমুখি দুই উপাসনা গৃহের দিকে আবীরদা-কে এগিয়ে যেতে দেখে অর্ক এগিয়ে যায় রাকার
দিকে । তিনটে বছর সাত-আটের বাচ্চা লামা প্রজাপতির মতো অর্কর পাশ দিয়ে উড়ে বেরিয়ে যায়
। একটির মুখে আবার স্পাইডারম্যানের মুখোশ । রাকা ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগে খাদের দিকে চেয়ে
ছিল । অর্কর দিকে ফিরে এবার সহসা প্রশ্ন করে, “স্বপ্ন কি কেবল ভয়েরই হয় ? স্বপ্ন তো
আমিও দেখেছিলাম রে…” তারপর মাথাটা তুলে সোজা অর্কর দিকে তাকিয়ে, ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে
হাতের মুঠোটা মেলে ধরল । অর্ক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল, রাকার হাতে একটা দোমড়ানো
মোচড়ানো চটকানো সদ্য-মৃত মথ্ । বিস্ময়ের ঘোরে অর্ক পুরনো স্বভাবে ফিরে যায়, তুইতোকারি
করে ফেলে, “মারলি কেন ওটাকে শুধুমুদু ?” বলতে গিয়েই খেয়াল করে, ঠান্ডায় রাকার ঠোঁট
ফেটে গিয়েছে । রক্তমুখো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে অদ্ভূতভাবে হাসল রাকা । তারপর বলল, “আর একটা
ছিল । এটার গায়ের ওপর বসেছিল । ওটাকেও এইভাবে চটকে ওই নীচে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছি
। তাই ঝুঁকে দেখছিলাম, কোথায় পড়ল !”
“কিন্তু কেন ! ওরা তোর কী ক্ষতি করেছিল ?”
“কিচ্ছু না । But they were happy and I'm not... So..”
অর্ক এতটা অবাক কখনো হয় নি । কী বলছে রাকাটা যা-তা !
রাকা এগিয়ে যায়, যেদিকে আবীর গেছে ঠিক তার উলটো দিকের আধো অন্ধকার ঘরে ।
আবছা আলোয় রহস্যময় লাগে বুদ্ধমূর্তিটিকে । অর্ক অসহায়ের মতো পিছু নেয় রাকা-র — যেন
একটা অদৃশ্য সুতো ওকে টানছিল । কিন্তু সে রাকাকে খুঁজে পায় না । আশেপাশে আরো মূর্তি
সাজানো, তাদের সামনে মোমবাতি জ্বলছে । এতবড়ো ঘরটায় ঐ টিমটিমে আলো আরো গা-ছমছমে পরিবেশ
সৃষ্টি করেছে । হঠাৎ কানের কাছে একটা ঠান্ডা হাতের রোমাঞ্চকর স্পর্শে অর্ক শিহরিত হয়
।
“এই রাকা প্লীজ, এই অন্ধকারে এলোমেলো যাস না ।”
“মানে তুই চাস্, আমি তোর্ হাত ধরে থাকি !”
“কী বাজে বকছিস ? আবীরদা কোথায় ?”
“তোর আবীরদা-কে এইমাত্র একটা ‘Kirin’ খেয়ে ফেলেছে । মনে আছে তো, কেমন দেখতে
! সেই যে তুই বলতিস — অর্ধেকটা ঈগল আর অর্ধেকটা সিংহ ।”
“তোর এখনও সেইসব
কথা মনে আছে ! আরে ওটা তো একটা Mythical Creature ! যদিও তুই যেটাকে ‘Kirin’ বললি,
মনে হয় ওটা ‘Griffin’, অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে ।”
“দেখেছিস এখানে দেয়ালে কতো ড্রাগন আঁকা ! দেখতে দেখতে তোর কাছে শোনা গল্পগুলো
মনে পড়ল । বলতো ‘Chimera’ কেমন দেখতে ?”
“চিমেরার তো দুটো মুখ — একটা সিংহ-ছাগলের ককটেল আর একটা সাপ বোধহয় ! ভীষণ
রক্তচক্ষু, চারটে পায়ের দুটো পা সিংহের আর বাকি দুটো ছাগলের পায়ের মতো । আর লেজ-টাই
হল সর্পমুখ ।” — বলতে বলতেই রাকার গ্লাভস্-পরা একটা হাত ধরে বারান্দার আলোতে টেনে আনে
অর্ক ।
“Exactly my boy !” — রাকার গলায় যেন বোতলবন্দী মদের ঢাকা খোলার উচ্ছ্বাস
।
“আমার আগে সব মুখস্থ ছিল — Basilisk, Unicorn, Simurgh - সব । আর আবীরদা
মোটেই ড্রাগনের পেটে যায় নি, ঐ তো আসছে —” বলে অর্ক আঙুল তুলে রাকাকে দেখিয়ে দেয় ।
দেয়ালজোড়া সিম্বল আর তিব্বতী লিপির বিচিত্র বর্ণময় কারুকাজ । তার গা ঘেঁষে
হাসিমুখে এগিয়ে আসে আবীর । কিন্তু অর্কর নজর এড়ায় না, রাকার মুখ গম্ভীর । আবীর দু-জনের
উদ্দেশ্যেই বলে, “এবার তাহলে ফেরা যাক্ না-কি !” দোতলা-তিনতলা প্রাসাদোপম বৌদ্ধ শিক্ষায়তনগুলো
পিছনে ফেলে নীচে ঢালু বেয়ে নামতে নামতে অর্ক খেয়াল করে, আবীরদার পুল ওভারটার পকেট থেকে
উঁকি মারছে একটা কাগজ-মোড়া বোতল ।
(৩)
রাত ন’টা বাজে । দার্জিলিঙ্ ম্যালে লোকজন ক্রমেই কমে আসছে । উপত্যকা জুড়ে
ছড়িয়ে আছে বিন্দু বিন্দু আলোর জাল । যেন অজস্র জোনাকি জ্বলছে, কিন্তু নিভছে না । সাহানা
বাজপেয়ীর ভঙ্গিতে রাকা একটা গানের কলি গুনগুনিয়ে গাইছিল, “আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে”। অর্ক আর
আবীরের কথা হচ্ছিল, স্বপ্ন
নিয়ে । আবীরের প্রিয় বিষয়, স্বপ্ন ।
“এমনিতে ‘Organically determined sensations’ হল সাধারণত দুরকম — প্রথমটা
‘General Sensation’ আর আরেকটা হল ‘Specific Sensations’ । এই দ্বিতীয়টার মধ্যে পড়ে
Mascular, Gastric, Pneumatic,
Sexual, Peripheral Sensations । এমনকী touch, pressure, vibration, itch, pain,
temperature, hair movement এইসব প্রভাব ফেলতে সক্ষম । স্বপ্ন আমাদের নিয়ে খেলা করে
। তার একটা কাজ হতে পারে — ‘Dream Fantasy’ ! তোমার শার্টটা যদি খুব টাইট্ হয়, তবে
স্বপ্নে তুমি গলায় দড়ি - দেখতে পারো । তাছাড়া আকাঙ্ক্ষা মেটে এই স্বপ্নে । আর বুদ্ধিজীবীরা
দেখেন গুরুতর স্বপ্ন । নিজেরা তার অর্থও খোঁজেন ।”
অর্ক নার্ভাস একটা হাসি হেসে বললো, “খুব অকিঞ্চিৎকর ইতালিয়ান ছবিতে, এমনকি
অনেক রোম্যান্টিক সফটকোরেও, যেরকম প্রায়ই চমকে দেওয়া দুর্দান্ত মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট
থাকে, স্বপ্ন দেখছি প্রায় সেইরকম । আচ্ছা তুমি নিজে স্বপ্ন দেখো না আবীরদা ?”
হাসতে হাসতেই আবীর উত্তর দেয়, “আমি দেখি কম, কিন্তু পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর
মতো স্বপ্ন ছাড়াই বেশি । আমার একটা প্রিয় স্বপ্ন আছে, একটা ফিনিক্স পাখি উড়তে চাইছে
। কিন্তু আগুনের হাত তার লেজ আর পা চেপে ধরছে । আর পাখিটা আপ্রাণ ডানা ঝাপটাচ্ছে ।”
বড়ো বড়ো চোখ করে রাকা মাঝখান থেকে বলে ওঠে, “ব্রাভো ডাক্তারবাবু ! তোমারই
যদি স্বপ্নের এই বহর হয়, তবে তোমার পেশেন্টরা স্বপ্নে কী দেখে, জানতে ইচ্ছে করছে
!”
একটু আহত মুখে আবীর বলে, “এই ধরো এক মহিলা তাঁর বিচ্ছেদের পর দুবছর ডিপ্রেশনে
ভুগে প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর প্রাক্তন স্বামী সপরিবারে তাঁর বেড রুমে ঢুকতে চেষ্টা
করছেন । সেখানে কিছু Symbol আছে — Black chair, Box, Calendar, Flashback, Doom ইত্যাদি
। আবার একজন নার্সের খালি মনে হত, কেউ তাঁকে খুন করতে চায় । হসপিটালের অন্যান্য সহকর্মীদের
আচরণে সে তার আতঙ্কের প্রতিফলন কল্পনা করত । এক্ষেত্রে Symbol হচ্ছে, Alarm, baby,
bite, crippled, crying, disabled এইগুলো ।”
“অর্থহীন কাজ করার চেয়ে বড়ো শাস্তি আর হয় না । জানো অর্কদা, আবীরের প্রিয়
গল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, আর আমার ‘সমুদ্রের
স্বাদ’ !” — দুম করে কথাগুলো বলে রাকা একটু থামে । কপালের ওপর থেকে চুলগুলো আঙুলে পাকিয়ে
নিয়ে সে অর্কর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলে, “তুমি সালভাদোর দালির আঁকা ‘Sleep’ ছবিটা
দেখেছ নিশ্চয়ই । ফেঁসে গিয়ে হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া একটা বেলুনের মতো নাক-মুখ সর্বস্ব-শরীর,
কানে ছেঁড়া পর্দা লাগানো । সন্ন্যাসীর হাতের আংটা লাঠির মতো কয়েকটা লাঠি সরু হয়ে যাওয়া
শরীরটা মাটিতে ঝুলিয়ে রেখেছে । বা বলা যায় টাঙানো আছে । ঠোঁট, চোখ বোজা — আংটা লাঠির
মতো পিন দিয়ে বেঁধা । চোখ পর্যন্ত খোলার উপায় নেই । পিছনে দূরে একটা আলোকিত প্রাসাদ
। ... আমার স্বপ্নগুলোও ঐরকম হয়ে গিয়েছে ।”
অর্ক আর থাকতে না পেরে বলে ফেলে, “কেন ! তোর ওই ঐ ছবিটার কথা মনে পড়ে না
? যেটায় একটা মানুষের মাথায় চুলের বদলে মেঘ । তার দুটো আলাদা প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে
। একটা প্রতিবিম্বে মানব-মস্তিষ্ক, পিছন থেকে গাছের মতো । ঘাড়টা কান্ড আর মাথাটা পাতায়
ঢাকা । সেটাও তো বিচিত্র ! ওটাও কি দালির ?”
কথাটা বলেই অর্ক খেয়াল করে সহসা উত্তেজনার আতিশয্যে সে রাকা-র প্রতি ‘তুই’
সম্বোধন করে ফেলেছে । আর আবীর ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে আছে তার দিকে । অর্ক অনুভব করে তার
স্বপ্নের মতোই আবার তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে ।”
রাকা নিজের হাতে একটা ফুল-সমেত ছোট্ট কাঁটা যুক্ত গোলাপ ডাল চটকে মাটিতে
ফেলে, নিজের হাতের তেলোয় বিঁধে থাকা একটা কাঁটা বাঁ-হাত দিয়ে তুলে ফেলে রক্তের দিকে
চেয়ে আপন মনে বললো — “এসব নিয়ে একটা গল্প লেখাই যায় ! তাই না রে অর্ক ? গল্পের নাম
হওয়া উচিত মর্বিড ।”