সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অভিষেক ঘোষ



অপুষ্পক


()

ওড়িশার একাকুলা সৈকতে সমুদ্রে ডুবে মারা গেলেন এক প্রৌঢ় বয়স আনুমানিক ৭০ প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ভদ্রলোক বাঙালি নাম-ধাম-বংশ পরিচয় জানা যায় নি  
জীবনে কাকতালীয় ঘটনা তো কতই ঘটে ! প্রতীক যখন সংবাদ পত্রের একফালি রিপোর্ট-টার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো, ঠিক তখনই ডেস্কে ওর মোবাইল-টা বেজে উঠলো — “হ্যালো প্রতীক ! শোনো ওড়িশায় সী-বীচে একটা ঘটনা ঘটেছে একজন মারা গ্যাছেন লোকটা বাঙালি তুমি একবার আমার চেম্বারে এসো তো এক ভদ্রলোক এসেছেন, উনি বিষয়টার ডিটেইলস্ দেবেন
আসছি, সুব্রতদা জাস্ট এক মিনিট ” — বলে কল-টা কেটেই প্রতীক উঠে পড়লো

()

রাতের আকাশে তখন তারা-রা ফিসফিসিয়ে কথা বলছে, মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত করবে না বলে ! প্রজাপতি হতে চেয়েও কত শুঁয়োপোকা পদপিষ্ট হয়েছে নেহাত্ই মানুষের অনুমতি ব্যতিরেকে পথসভা করেছে বলে ! রক্তজবা গাছটা ঝিমোচ্ছে অশক্ত শরীরে বুড়ো কুকুরটাওওর কোনো নাম নেইওর ভাঙা পা আর অভুক্ত পেট বলে দেয়, নেই কোনো প্রয়োজনও উপরন্তু কালী পুজোর শব্দবাজি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ওকে যথেষ্ট উত্যক্ত করেছে অবশেষে এই কিছুক্ষণ আগে আদমের সন্তানেরা শান্ত হয়েছে আর তারপরই জীর্ণ খড়ম পায়ে, কালো আর সবুজে খোপ-কাটা লুঙ্গি-টা পরে, বাহাত্তুরে বুড়ো-টা বেরিয়েছে চুম্বক নিয়ে এই চুম্বক-খানা নাকি বুড়োর পৈতৃক সম্পত্তিসত্যি-মিথ্যে ভগবানই জানেন ! গ্রামের গয়লাপাড়া ফেলে, মজুমদার-দের পরিত্যক্ত ভিটেয় যে কুয়ো-টা আছে, তার মধ্যে চুম্বকখানা একটা লম্বা দড়িতে বেঁধে, নীচে অন্ধকারে ফেলে দিয়ে বসে থাকে বুড়োটা লোকটা নিরিবিলি গ্রাম-জীবনে সকলেরই বিস্ময় উদ্রেক করতো যেখানে সকলের সমস্ত কাজের ব্যাখ্যা মেলে, সেখানে লোকটা যেন মূর্তিমান অলক্ষণ বাম হাতটা ঈষৎ ব্যাঁকা, পুলিশে মেরে ওরকম হাল করেছে বলেই জনমত ওই কুয়ো আর ওর অতীতদুইই ভারী রহস্যময় কবে, কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে বুড়ো এখানে এসেছিল, আর কেনই বা রয়ে গেল, নিয়ে নানা মুনির নানা মত তবে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মত-টি ছিল, রাজু সাহার সোনার দোকানে একদিন খুচরো পয়সা চুরির অপরাধে লোকটা হাটুরে মার খাচ্ছিলো মরেই যেত, কারণ খ্যাপা জনতা খ্যাপা লোকটার সাথে তাদের আচরণের সাদৃশ্য প্রমাণ করতে তাকে ল্যাম্প-পোস্টে বেঁধে ফেলেছিল পিটিয়ে পোস্টার বানিয়েই দিত, যদি না পুলিশ চলে আসত পুলিশ এল এবং জনতাও পাতলা হল কেউ- সাক্ষ্য দিতে রাজি হল নাকেউই কিছু দেখে নিঅথচ হাঙ্গামায় সকলেই ছিল যাই হোক, এরপর লোকটা সসম্মানে থানায় গেল সাহা মশায় তো লোকটার নামে একেবারে লিখিত নালিশ দাখিল করে এলেন, কটা খুচরো পয়সার জন্য তখনও কুয়োর কাছটা পরিত্যক্ত হলেও মোটামুটি পরিষ্কার ছিল মজুমদারদের হাঁড়িকুড়ি- ছিল, অবস্থাও নেহাৎ মন্দ ছিল না তাই জায়গা-জমি পরিষ্কার রাখতো গোল বাঁধলো চুরির ঘটনার পর পুলিশের মারে হাত বেঁকিয়ে বসলো লোকটা আর কবুল করলো হাটুরেদের ভয়ে পালাতে গিয়ে টাকা-পয়সাগুলো কোথাও ঝোপে পড়ে গিয়েছিল তারপর অনেক খুঁজেও আর সেসব পাওয়া যায় নি যদিও প্রমাণের অভাবে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়, মাতব্বরদের অনুরোধে কিপটে সাহা- চেপে যায় অতঃপর কিছু দিন কাটে এবং সন্দেহজনক লোকটাকে পুনঃপুনঃ কুয়োর ধারে দেখা যায় মজুমদাররা তখনও কিছু বলে নি, কিন্তু একদিন লোকটা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ভাঙা বালতিতে জল টেনে, কুয়োর জলে স্নান করছিল এবং সেসময় মজুমদারদের বর্তমান প্রজন্ম সেখানে গিয়ে তা দেখে ফেলে   শৈশব হামেশাই ভ্রান্ত আবেগে ভুল কাজ করে ফেলে দৃশ্যখানার ভয়াবহতা অনুভব না করে, তারা বরং ঘটনার মধ্যে একটা লঘু মজাই খুঁজে পায়যেন কোনো গোপন রহস্য আসলে কতটা অবান্তর, তা জেনে ফেলেছে লোকটিও তখন তার চর্মরোগগ্রস্ত রক্তিম শরীর পুরুষাঙ্গ নিয়ে যারপরনাই বিব্রত হয়ে পড়েছিল বলাই বাহুল্য এরপরই বাচ্ছা গ্যাং একটা ছড়া বানায় যা শিশুদের বহু ধারণার মতোই যুক্তিহীন — “ল্যাংটো বাবাজি, একটা মুরগি পুষেছি / লাল মুরগির নাম রেখেছি, ল্যাংটো বাবাজি সেই ছড়াখানা দ্রুত মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে এরপরই লজ্জা বা যে-কোনো কারণেই হোক, মজুমদাররা তাদের অব্যবহার্য কুয়ো-টিকে বর্জন করে ফলে গ্রামে শ্যাওলার মত ভেসে আসা লোকটার একটা অলিখিত সম্পত্তি গজায়কুয়োটা জ্যোৎস্না রাতে নিরালা কুয়োর ধারে লোকটাকে গান গাইতেও শুনেছে কেউ কেউ

...একটা অদ্ভুত প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার আগে দ্বিধাগ্রস্ত সন্দীপ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলো ! নিজের সদর্থক নঞর্থক ভাবনাগুলো নাড়াচাড়া করে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে তাকে হাতে সময় বেশি নেই

()

আদিম এই উদ্ভিদবর্গের অন্যতম লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কুন্ডলিত মুকুল পত্রবিন্যাস শালা কি ডিজাইন মাইরি ! পৃথিবীতে ফার্ন প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১১০০০, অধিকাংশই আর্দ্র উষ্ণমন্ডলে হয়ে থাকে এগুলি সোর্ড ফার্ন, লেডি ফার্ন, ট্রি ফার্ন ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কোন কোন ফার্নের কুন্ডলিত পাতা সবজি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়যেমন ঢেঁকিশাক ভারতে ফার্নের প্রায় ৯০০ প্রজাতি আছে, বাংলাদেশে ২৫০, বেশির ভাগই দেখা যায় উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় লতানো পরাশ্রয়ী জাতের ফার্নও আছে বর্ষাকালে Azolla, Salvinia, Ceratopteris গোত্রের প্রচুর জলজ প্রজাতির ফার্ন দেখা যায় ম্যানগ্রোভ উপকূলের অন্যান্য এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) জন্মায় বৈশিষ্ট্য : সাধারণত ছায়ায় জন্মায়, কুয়াশা বা বৃষ্টিতে সিক্ত থাকতে পারে, এমন জায়গা পেলে তো পোয়াবারো এই উদ্ভিদ (!) অপুষ্পক ঠিক আমারই মত কিছুই হল না !” ডায়েরি-টা পড়তে পড়তে প্রতীক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে যে লোকটাকে গ্রামবাসীরা অ্যাদ্দিন খ্যাপাটে, উন্মাদ, পাগলাচোঁদা ছাড়া কিছুই ভাবে নি, সেই লোকটার কাছে শেষে কি-না রীতিমত স্টাডি নোটস্ পাওয়া গেল !

পাশে বসে সন্দীপ অন্যান্যরা, তারাও যেন তারাদের মতো নিরূচ্চারে কিছু বলতে চাইছিল  

প্রতীক জানতে পারলো, বুড়োটা শেষ পর্যন্ত কুয়োর ধারেই একটা পাতার কুটির বানিয়ে থেকে গিয়েছিল কুয়োর চতুর্দিকে ফার্ণজাতীয় উদ্ভিদের সমাচারচালচুলোহীন বুড়োর বসতবাড়ির ফার্নিচার ! পাড়ার লোকের বক্তব্যচুরির পয়সাকড়ি কুয়োতেই ফেলেছিল, পরে সুযোগমতো তুলে নেবে বলে জন্যই ওই চুম্বক ঝুলিয়ে বসে থাকতো, খুচরো তুলতো ঘাগু মাল‘, ‘ঢ্যামনা বুড়ো’, ‘তে-খচ্চরবিশেষণগুলোও সেই সঙ্গে কানে এসেছে দিনের বেলায় পয়সা তুলতে গেলে পাড়ার বাচ্ছারা ছিনে জোঁকের মতো পিছনে লেগে থাকতো বলে এরপর রাতের দিকেই আসতো লোকটা ডায়েরি-তে লিখেছে — “অজাতশত্রু বর্মন এই উদগান্ডুদের পল্লিতে এসে হয়ে গেলঢ্যামনা বুড়ো’ — তা ভালোভেবে দেখলে বাংলা ভাষাটা ভারী মজার বুড়োটাবললেটানির্দেশক কিন্তু যেই বলবোবুড়োটে’ — অমনি একেবারে অন্য কেস্বয়স বা, অবস্থা বোঝাচ্ছে আচ্চা ঝকমারি ব্যাপার যা হোক্

পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ে লেখা রয়েছে — “আগেকার দিনে কবিরা বলতে পারতেন এমন কথা — “আমি মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি নে মা / শুধু যা জেনেছি সেটুক হল এই — /
তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি / তবে আসবিনে তুই, এমন সাধ্য নেই / মা তোর এমন সাধ্য নেই আর এখন ? চারিদিকে সবাই সব জানে সব শাআলা খচ্চর আমায় ঢ্যামনা বলে ! ওদের চোদ্দ গুষ্টি ঢ্যামনা মন্ত্র তন্ত্র একটু জানলে ওদের সবকটাকে কাঁচা খেয়ে ফেলতাম

 ....গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকেও এই ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয় এক দুপুরে কুয়োর ব্যাঙ্ক থেকে পয়সা তুলে দোকানে দাঁড়িয়ে বুড়ো একটা পাঁউরুটি কিনে খাচ্ছিলো, এমন সময় হাজির হয় বাচ্ছা গ্যাং বুড়ো ওমনি হাঁটা দেয় আস্তানার পথে জানে বাচ্ছারা কুয়োতলায় যেতে ভয় পায় কিন্তু বাচ্ছারা রাস্তায় ওর পিছু নেয় ছড়া বলে খ্যাপাতে থাকে — “ঢ্যামনা বুড়ো ঢ্যামনা বুড়ো / একশো বছর বাঁচবে পুরো / দুটো পয়সা দাও — / না যদি দাও তবে তুমি / যমের বাড়ি যাও ব্যাস্ আর যায় কোথা ! একখানা থান ইঁট তুলে সোজা ছুঁড়ে মেরে দিল একজনের লেগে রক্তারক্তি এরপর দিনের বেলা ওকে রাস্তায় ঘুরতে দেখলে বাচ্ছারা তো বটেই, বড়ো-রাও মারতে যেত লোকটা কী খেতো, আদেও কিছু খেতো কী নাবেঁচেই বা ছিল কী করেভাবতেই অবাক লাগে প্রতীকের  

()

সন্দীপের সাথে লোকটার ভাব নেহাত্ই কৌতূহলের বশে কুয়োতলায় এক দুপুরে বসে পরম মমতায় জংলা গাছ-পাতায় হাত বোলাচ্ছিলেন যেন কিছু একটা শুনতে চাইছেন ওদের থেকে আর বর্ষণ-স্নাত সবুজ যেন উন্মুখ হয়ে ওঁকে কিছু বলতেও চাইছে পাড়ার বাকি লোকেদের মতো সন্দীপ লোকটার ওপর খাপ্পা হয়ে ওঠেনি হয়তো একারণেই যে,  গ্রামে জন্ম হলেও ওর পড়াশোনা এখন অফিসসবই কোলকাতায় তাই লোকটার প্রতি ওর কৌতূহল থেকেই একদিন চলে গিয়েছিল কুয়োতলায় দেখা গেল সেই কুকুরটা লোকটাকে প্রভূ বলে মেনে নিয়েছে এবং তিনিও প্রভূত্বসূচক দু-একটা শব্দ করে তার সাথে বাক্যালাপ চালাচ্ছেন সন্দীপ এসে পড়তেই চমকে উঠে পড়লেন সে বিনীতভাবে জানিয়েছিল, “একটু কথা বলা যায় ?”
খসখসে গলায় অসন্তোষ ভেসে আসে, “আমার সাথে কী কথা ?”
আপনার কেউ নেই ! এরম একা থাকেন কেন ?”
তাতে তোমার কী হে !” তারপর একটু থেমে বলেন, “তাছাড়া একা নয় কে ? সঙ্গী থাকলে আসতে এখানে ?”
আপনার নামটা জানতে পারি ?”
কেন ! সবাই বলে শোনো নি, ঢ্যামনা বুড়ো ?”
ওটা তো রাগের কথা হল !”
রাগ ! চামড়া মোটা হয়ে গ্যাছে মানুষ নিজেকে কী ভাবে জানি না ! আসলে তো পশুই কামড়া-কামড়ি করবে এটাই স্বাভাবিক 
আপনি যদি এতটাই অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে এখানে থেকে গেলেন কেন ?”
আর কোথায় যাবো ?”
জানি না বুঝবেন কিনা আমার কথা, কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার সাথে যা হয়েছে তা সত্যিই আনফেয়ার আপনি ডিজার্ভ করেন না এসব ” -- সন্দীপ বলেছিলো  
উত্তরে অনেক থেমে থেমে বুড়ো ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলো — “ডিজার্ভ ? মানুষ ডিজার্ভ করে এই এতো সুখ ! বিলাসের এতো উপকরণ ? চারিদিকে নমুনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে সব আর ভাবছে সব বাপের সম্পত্তি ! কোনো বিষয় নিয়ে আজকাল কারো সাথে কথা বলা যায় না ! সবাই সব জানে গান, খেলাধূলা, আবহাওয়া, রাজনীতিসঅব জানে মামদোবাজি নাকি ? বাল ! মোড়ের মাথায় গিয়ে চিৎকার করে বলো, ‘দেশের কাজ কে কে করবেন, হাত তুলুন দেখবে সবাই ভোঁ ভাঁ তোমাকেই পাগল বলবে এরা কোনো কিছু মন দিয়ে শোনেই না যে, এদের তুমি কিছু বোঝাতে যাবে কিছু ভাবেই না সব ফাঁপা অথবা নিরেট ওদের চেয়ে এই গাছপালা ভালো... ..কোনো কিছুর মূল্যায়ন যে অপেক্ষাকৃত মূল্যবান কিছুর সাথে তুলনা করে স্থির করতে হয়, বোঝেই না এরা পড়ছে ভুলে যাচ্ছে, শুনছে ভুলে যাচ্ছে আগাছা সব জীবন আনফেয়ার- নিজের দুঃখ সমাজের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইনা কিন্তু এই সমাজ আমরা ডিজার্ভ করি না এখন মনে হয়, এই সমাজ, এই প্রজন্মের জন্য আমরা লড়েছিলাম ?”
সন্দীপ ভ্যাবাচাকা খেয়ে প্রশ্ন করেছিলো, “কীসের লড়াই ?”
বুড়ো বিব্রত সুরে উত্তর দিয়েছিলো, “ কিছু না বয়স হয়েছে, ভুল বকি


()

রাজনগর থেকে ডাঙ্গমল তিনঘন্টা কুমীর প্রকল্প আছে চান্দবালি থেকেও তিনঘন্টা অনেক হিসেব করে মোটর-বোটে সন্দীপরা পাঁচজন বুড়োকে নিয়ে এসেছিল ভিতরকণিকা- দুই বিখ্যাত সৈকতে কুমীর নিয়ে লোকটার আগ্রহ নেই অলিভ রিডলে দেখারই যত আগ্রহ হাবলিখাটি সংলগ্ন গরিমাতা ঘুরে বোট চলেছিল একাকুলার দিকে এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে নাকি প্রায় নয় লক্ষ কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে ! একঝাঁক কিসব পাখি সার বেঁধে উড়ছিল মাঝে মাঝে জলের উপর বসছিল, স্রোতের টানে অল্প ভাসিয়ে দিচ্ছিল শরীরটাকে বুড়োটা একাগ্র দৃষ্টিতে ওদের দেখছিল...  

জায়গাটা ভারি অদ্ভুতএই মনে হয় রাস্তা বন্ধসামনে একটা স্থলভাগ কিন্তু বোট একটু এগোতেই সামনে সহসা রাস্তা খুলে যায় দূরে একটা বাঁকা মতন স্থলভাগ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলোঐটিই আমাদের গন্তব্য বোট থেকে নড়বড়ে সেতুতে পা রেখে সামনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল দেখে বোঝার উপায় নেই, সেই দ্বীপে নেমে একটু হেঁটে গেলেই ওপারে সৈকত ম্যানগ্রোভ অরণ্য কেমন চোখের নিমেষে ঝাউ বনে বদলে যায়, দেখে তাক্ লেগে যায় ! খাঁড়ির গাছপালা সব জোয়ারের জলের দাগ ধরে রেখেছে সেই দাগের নীচে কাদা আর শ্যাওলা উপরে মসৃণ সবুজ বিকেল গড়াচ্ছে গোধূলির দিকে পাখিরা বাসায় ফিরছে চিৎকারে কান পাতা দায় অনেক জেলে নৌকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জাল ফেলে মাছ তুলছে ভাঁটার টান শুরু হয়েছে নৌকা এমন অবস্থায় ছাড়া যায় না বলে মাঝিরা জল ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে   

কুমীরের সংখ্যা এই অংশে কম সৈকতে অস্তগামী সূর্যের লাল, দীর্ঘ ক্যানভাসে জলরঙের ছবি ফুটিয়ে তুলেছে সোঁ সোঁ হাওয়ায় মৃত কচ্ছপ ছড়িয়ে পড়ে আছেগন্ধ ভাসছে বাতাসে কোনোটার চোখ খোবলানো, ভিতর থেকে মাংস টেনে বের করছে লাল কাঁকড়ার দল টেনে নিয়ে যাচ্ছে গর্তে পা গুলো গলে পচছে কুকুরে টানাটানি করছে অর্ক প্রশ্ন করে , “মাঝি ভাই কী ব্যাপার ? জলে বিষ টিস আছে নাকি ?” মাঝি উত্তর দেওয়ার আগেই বুড়ো বলতে শুরু করে, “কচ্ছপ মারা নিষিদ্ধ তাও জানো না ? স্থানীয় লোকজন তাই কচ্ছপগুলো উলটে দেয়, কুকুর শিয়ালেও দেয় সবাই অল্প অল্প মাংস কেটে নেয় গোটা জিনিস নিয়ে যেতে গেলে অর্থাৎ লোভ করলেই ধরা পড়বে কুবের-কে হোসেন মিঞা বিশ্বাস করতো কারণ পাঁচ টাকা চুরি করার ক্ষমতা কুবেরের ছিল না দু-আনা সরালে যে বিবেক চুপ করে থাকে পাঁচ টাকা সরাতে গেলে সেই বিবেকই গর্জন করে উঠবে এদের হয়েছে সেই দশা লোভও আছে ওদিকে পোঁদে ভয় বিবেকও চুপ থাকিবার পাত্র নয়স্মরণ করিয়ে দেয়, তোমাদেরই ঐতিহ্য

সন্দীপ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো লোকটার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর জ্ঞান দেখে !
বুড়ো ততক্ষণে একটি কচ্ছপের শুশ্রুষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার পরনের ঢলঢলে পাজামা, গায়ের হাফ পাঞ্জাবি আর গলায় জড়ানো গামছাহাওয়ার মৃদু উড়ছিল কেমন যেন দিগম্বর ভাব ! মনে হয় কিছুই পরে নেই যেন একটা হাওয়ার মানুষ ভাসছে লোকটাকে অবশ্য এরপর কিছুক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় নি একাকুলা সৈকতের অসামান্য সৌন্দর্যে ওরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো যে ডিম পাড়তে এসে মরে পচে যাওয়া কচ্ছপের ভিড়, নীলচে ঢেউয়ের ব্যাক্ ওয়াশ্এসব ভুলে ওরা সেলফি তোলায় মত্ত হয়ে পড়েছিলো যৌবনের ধর্ম কিন্তু এসব দেখেই বোধহয় বীতশ্রদ্ধ বুড়ো স্বেচ্ছায় সরে পড়েছিলো তারপর সন্ধ্যা নামে ওরা একটু খুঁজে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে ফেরার তোড়জোড় করছে কয়েকজন মাঝি একজায়গায় আগুন জ্বালিয়ে বসে কি রান্না চাপিয়েছে লাইটার ফেলে এসেছে বলে স্বর্ণাভ যায় ঐখান থেকে আগুন ধরাতে দলের মধ্যে সে একাই ধূমপায়ী অর্ক, মণীশ, কৌস্তভরা মাল খায় সন্দীপ সব কিছু থেকেই দূরে থাকে, যতদিন এভাবে পারা যায় আর কি ! 

বাতাসে তখন একটা একটানা দীর্ঘশ্বাস হঠাৎ প্রবল এক-একটা দমকা হাওয়া আসে কোনো দুর্ধর্ষ পেস্ বোলারের মতো দুরন্ত এক-একটা স্পেল নিয়ে আর ঝাউ বন মুহূর্তে অশান্ত হয়ে ওঠে, আহত ব্যাটসম্যানের মত নুয়ে পড়ে ডাক্ করে বাতাসের বেপরোয়া বাউন্সারগুলো যেন একটা চক্রান্ত চলছে দিকচক্রবালে এমনভাবে লাল মুছে ক্রমে কালো রঙের পোঁচ পড়ে মুঠোফোনে সিগন্যাল নেই বলে মণীশ অধৈর্য হয়ে অন্যদেরও ব্যস্ত করে তোলে মাঝিদের জ্বালানো আগুনটা তখন কালো চরাচরের প্রেক্ষাপটে নৃত্য করছে একটা সরসর শব্দ হয় কোথাও, কিছু একটা ছুটে চলে যায় বিবর্ণ একটা চাঁদ দেখা যায় একটা একটা করে তারা ফুটে উঠতে থাকে আকাশের গায়ে যখন সবাই ভাবছে এবার কী করণীয়, ঠিক তখনই বুড়ো লোকটা আবির্ভূত হয় প্রায় দিগম্বর কারণ পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছে গামছাও নিখোঁজ, সন্দীপ আসার আগে অনেকটা জোর করেই খড়ম ছাড়িয়ে স্যান্ডেল ধরাতে পেরেছিল সেটিও উধাত্ত হয়েছে এখনি কিছু একটা করার নেশায় উৎক্ষিপ্ত হয়ে  থাকা সন্দীপের বন্ধুরা বুড়োর অদ্ভুত শান্ত রূপ দেখে সম্মোহিত হয়ে পড়ে ওরা কেউই সন্দীপের এই বিদঘুটে বুদ্ধিতে সায় দিতে পারে নি বন্ধুরা আসছে, তাদের মধ্যে একটা সেয়ানা বুড়োকে ঢোকানো কেন ! কিন্তু খরচ যেহেতু সন্দীপের, তাই সরাসরি আপত্তিও করেনি "কচ্ছপ দেখে নিয়েচো এবার বাড়ি চলো" — তা নয় ! উধাত্ত এলো তো একেবারে অন্য মানুষ হয়ে এলো যেন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, যেন সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে ! 
সন্দীপ জিজ্ঞাসা করে, “আপনি ছিলেন কোথায় ?”

বুড়ো একতাল অন্ধকারে এগিয়ে গিয়ে পাজামার দড়ি খুলতে খুলতে উত্তর দেয়, “জেলে এবারে চললাম সাগরে
এই অন্ধকারে নামবেন ! পাগল নাকি ?”
পাগল ! তোমরা তোমাদের ক্ষোভ সমাজের ওপর চাপিয়ে দাও সমাজ একটা পাত্রের মতো তোমাদের মনের বিষে সেই পাত্রের তরল ভয়াবহ হয়ে ওঠে, ঘুলিয়ে ওঠে আমরা যারা স্বপ্ন দেখেছিলাম সমাজটা বদলাবে, সত্তর দেখেছিলাম, লড়েছিলাম সমাজের জন্য, আজ সেই আমরাই সমাজের বাইরে আমাদের বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই সমাজ বিধান দিয়ে দিয়েছে বহুকাল আগে, আমরা অপুষ্পক কিন্তু সত্যিটা হল তোমরা আর তোমাদের সমাজ ব্যর্থ হয়ে গেছ আর কোনোদিন কোনো ফুল ফুটবে না তোমরা ভ্রান্ত তোমরা অপচয় একদিন জানতে চেয়েছিলে আমার সাথে যা হয়েছে, আনফেয়ার কি না ? হু কেয়ার্স ! আমরা একদিন দেশজুড়ে আগুন লাগিয়েছিলাম আমরা আগুনের ফুল হতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভস্ম হয়ে গিয়েছি বুঝেছি আমরা ডিজার্ভ করি না সমাজ ডিজার্ভ করে না আনফেয়ার বলো কাকে ! জীবনটাই আনফেয়ার তোমরা তো সুখে আছো ভায়া গাছপালা নিয়ে, পশুদের নিয়ে, পরিবেশ নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু ঝরাও আর বাড়ির পাশে রেপ হলে এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বলো, মেয়েটার চরিত্র খারাপ ছিলো তোমাদের চরিত্র বলেই কি কিছু আছে ? সব লঘু হয়ে গেলো, সব শবদেহ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে কোথাও কোনো গভীরতা নেই এরজন্য লড়েছিলাম ? আগুন লাগিয়েছিলাম ফিউডাল আর বুর্জোয়াদের খড়ের গাদায় ? এই জন্য দৌড়ে ছিলাম কানাগলিতে আর মেঠো পথে ? দৌড়তে দৌড়তে কোথায় এলাম ! পায়ের নীচে ধ্বস ! সময়টার বুকে ধ্বস ! তোমরা তো ভালো করে রবীন্দ্রনাথ- পড়ো নি ! ঢিবঢিব করে গানবাজনা চালিয়ে নেচে-কুঁদে সময় নষ্ট করছো সব দেশভাগদাঙ্গামন্বন্তরভুখা মিছিল দেখতে হয় নি তাই ভাবো তোমাদের কষ্টের শেষ নেই অথচ আছো দিব্যি, খাচ্চো দাচ্চো সবথেকে ভয়ঙ্কর এই যে, তোমরা জানোই না খারাপ আর ভালো থাকার পার্থক্যফারাক করতেই শেখো নি সব শালা হারামি আর খচ্চর
অর্ক এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে বলে ফ্যালে, “এই আপনি চুপ করুন তো বাল্ !”

বুড়ো পাজামা খুলে ফেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এসে আগুনের সামনে দাঁড়ায় বলে ওঠে, “দ্যাখ এই আমার মতোই শুকিয়ে গেছিস তোরা ক্ষয়, সব ক্ষয়ে যাবে তারপর আগুনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, “একদিন এই আগুন ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছিলো আগুনের ইশারায় এমন তারায় ঢাকা আকাশের নীচে ঘর ছেড়েছিলাম আজ এই আগুনকে সাক্ষী রেখে ফের ঘরে ফিরবো

বিচলিত সন্দীপ লোকটার হাত চেপে ধরে বলেছিল, “করছেন কী ? ডুবে মরবেন যে !”

লোকটা এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে উদ্বাহু হয়ে জলের মধ্যে নেমে যেতে থাকে সকলে তখন দর্শক  

এদিকে বুড়ো তখন বলে চলেছে, “খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে / কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে  যখন জলের নীচে শরীরটা তলিয়ে যেতে বসেছে প্রায়... সন্দীপ সম্বিৎ ফিরে পায়  

মাঝিরা ততক্ষণে জলে নেমে গিয়েছে কিন্তু কেউ মরতে চাইলে তাকে বাঁচানো মুশকিল অন্ধকারে সলিল সমাধি আটকাতে ব্যর্থ হয় ওরা স্বাভাবিক ভাবেই সন্দীপ জন্য মূহ্যমান হয়ে ছিল নিজেকেই দায়ী করছিল পরদিন সকালে পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে মাঝিরাই তুলে এনেছিল এখানকার সৈকতে জলের মধ্যে বেশ কিছু গাছ আছে, শিকড়-বাকড়ে তাদের বিস্তার বালির নীচে আর জলের নীচে প্রহেলিকার মতো বুড়োর দেহ ওইরকম একটা গাছের শিকড় আর কান্ডের মধ্যে হাঁ-করা ফাঁকে রাতের অন্ধকারে আটকে গিয়েছিলো ফলে মৃত্যু জলে ডুবে হয়েছে কিনা, তা নিয়ে পুলিশও সন্দেহ প্রকাশ করে কেউই বুঝে উঠতে পারছিলো না, কোন মন্ত্রবলে একটা বুড়ো লোক এতগুলো জোয়ান ছেলেকে ভেলকি দেখিয়ে জলে নেমে গেলো !

কুয়োতলায় ফের এসে দাঁড়িয়ে প্রতীকও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলো বিহ্বল সন্দীপের চোখে ওর নির্বাক বন্ধুদের মধ্যে সন্দীপকে দেখে মনে হচ্ছিলো একটা বিমূঢ় বিস্ময় ওকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, যা অব্যক্ত এবং অনির্বচনীয়




 অভিষেক ঘোষ