সপ্তম অধ্যায়
দৃঢ় অথচ ধীর পদপাতে পান্ডবমহিষী দ্রৌপদী প্রবেশ করলেন কক্ষে। এখন মধ্যরাত। শুক্লা ত্রয়োদশী আজ। আকাশে রজত গোলকের মতো
উজ্জ্বল চাঁদ। পুষ্পের সৌরভবাহী মৃদু বাতাস আসছে বাতায়ন পথে। স্বামীদের
সঙ্গে এক অলিখিত, অকথিত শর্ত আছে তাঁর। রাত্রে মিলন শয্যাতে তাঁরা অপেক্ষা করবেন। দ্রৌপদী আসবেন বিলম্বে। কখনই এ রীতির হেরফের হয়
না। এই সামান্য রীতিটি, তাঁর জন্য স্বামীদের প্রতীক্ষা, তাঁকে
এক ধরনের আত্মতৃপ্তি দেয়। তিনি উপভোগ করেন পতিগণের উন্মুখ আগ্রহ। আজ কিন্ত
ঘরে পা দিয়ে, দ্রৌপদী দেখলেন তাঁর চতুর্থ পতি নকুল গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। শিয়রের কাছে জ্বলছে
দীর্ঘ দন্ড সুবর্ণ প্রদীপ। স্ফটিকের আচ্ছাদনের আড়ালেও ঈষৎ কম্প্র তার শিখা। সেই মৃদু আলো নকুলের
ঘুমন্ত মুখে আলো আঁধারির তরঙ্গ তুলছে। ক্লান্তি ও বিষাদ সে
মুখে। দু এক নিমেষ সেদিকে তাকিয়ে দ্রৌপদী নিজের স্বাভাবিক রক্তিম
অধর দংশন করলেন। আশ্চর্য এক বিতৃষ্ণায়, অপমানবোধে ছেয়ে গেল তাঁর অন্তর। নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস
পড়ল। অঙ্গুলিতে কর গণনা করলেন। আপাতত এই পতিটির সঙ্গে
তাঁর যাপনকাল চলছে। শেষ হতে আরও তিন চান্দ্রমাস বাকি। শীলিত সমাজে নারীর
অন্তরের কথা অনুচ্চার্য রাখতে হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে গোপন ক্ষোভের এক তরঙ্গ যে বহতা তাঁর
বুকের গভীরে দ্রৌপদী নিজে ছাড়া কেই বা জানবে সে কথা?
পঞ্চপতির জায়া তিনি। প্রতি সৌর বৎসর এক এক স্বামীর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যকাল যাপন। সেই অভিনব বিবাহ রাত্রে
প্রথম যখন দেখেছিলেন এই মাদ্রীতনয়কে, মুগ্ধতা জেগেছিল। কি বিচিত্র সৌন্দর্য!
ত্বক উজ্জ্বল গৌর নয়, তাম্রবর্ণ। মুখের প্রতিটি রেখায়, সুঠাম, বলশালী শরীরে অপূর্ব এক
লাবণ্য। অর্জুনও বড় সুন্দর, সুন্দর প্রতিটি পান্ডবভ্রাতাই। তবু এই পুরূষের রূপ যেন
অন্য গোত্রের। এ রূপে আশ্চর্য এক রহস্যময়তার দ্যুতি। মাদকের মতো আবিষ্ট করে
তোলে নারীর শরীর ও মনকে। বিবাহের চতুর্থ বৎসরে অনেক আগ্রহভরে শুরু হয়েছিল দ্রৌপদীর
সঙ্গে জ্যেষ্ঠ মাদ্রীতনয়ের যুগ্মজীবন। অল্প কালের ভিতরেই কিন্তু মোহভঙ্গ হয়েছিল দ্রৌপদীর। পুরুষের যে প্রেমের প্রকাশভঙ্গিমার সঙ্গে তিনি বিগত
বছরগুলিতে পরিচিত হয়েছিলেন, যা তীব্র, আগ্রাসী ও উন্মত্ত। তা থেকে এই মানবটি যেন
বহু দূরবর্তী। দ্রৌপদী অনুভব করতেন এই মানুষটির সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে
অন্তঃসলিলা নদীর মতো বয়ে যায় বিষাদস্রোত। তাঁর এখনো বড় ক্ষোভের সঙ্গে মনে পড়ে সেই নিবিড় পরিচয় শুরু
হবার প্রথম দিকের একটি দিনের কথা।
সেই বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রে নির্মেঘ আকাশে নিটোল চন্দ্র
জেগেছিল তীব্র উজ্জ্বলতায়। উন্মুক্ত বাতায়নপথে ছুটে আসছিল উন্মাদ বাতাস। দ্রৌপদীর পরণে ছিল একটি
মাত্র সূক্ষ্ম রক্তিম বসন। উজ্জ্বল লাল নয়। জমাট রক্তের মতো তার বর্ণ। সমস্ত রত্নালঙ্কারগুলি
খুলে রেখেছিলেন সে রাত্রে। নিরাভরণ হয়ে যেন পূর্ণ শোভায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল তাঁর
অনুপম দেহ। শুধু স্বর্ণাভকৃষ্ণ কেশের চূড়ায় গাঁথা একটি রক্ত কুসুম। পুষ্পসারে সুরভিত
করেছিলেন আপন বরতনু। নকুল বসেছিলেন বাতায়ন পাশে। দ্রৌপদী ভেবেছিলেন,
আলোআঁধারিময় নির্জন কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন তিনি প্রিয় নারীটির জন্য। পুরুষের ঝঞ্ঝার মতো
আলিঙ্গনপাশে নিজেকে বিলীন করে দিতে চেয়ে প্রতিবারের মতোই উদ্দাম হয়ে উঠেছিল
দ্রৌপদীর রক্তস্রোত। কিন্তু সেই মুহূর্তে নকুলের মুখে তিনি দেখলেন বিষাদ। দুই চোখে অন্ধতা। নকুল যেন
দেখতে পাচ্ছেন না প্রেয়সীর এই অপরূপ সৌন্দর্যকে। তাঁর দৃষ্টি বহুদূরে।
“মানুষ বড় বিপন্ন”- আত্মগতভাবে বলে উঠলেন নকুল। বিস্মিত পাঞ্চালকন্যা
শুনলেন মৃদু স্বরে তাঁকে বলতে,-“এবার অনাবৃষ্টিতে ফসল শুকিয়ে গিয়েছে। আজই রাজসভায় সংবাদ
এসেছে, পশ্চিমপ্রান্তের চিত্রপুর গ্রামে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে শতাধিক কৃষকের। এই আর্যাবর্তে এমন
উন্নত সভ্যতার অহঙ্কার করি আমরা, অথচ দেখ প্রিয়ে, আজও মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলি
মেটাতে পারি না। একান্ত অসহায় ভাবে প্রকৃতির খেয়ালিপনার উপর তা নির্ভরশীল। কোনো কৃত্রিম উপায়ে কি
বৃষ্টিহীন দেশে পর্যাপ্ত জলসিঞ্চনের ব্যবস্থা করে শস্য রক্ষা করা যায় না! প্রাজ্ঞ
ব্যক্তিদের এ বিষয়ে গবেষণা চালানো উচিত। কিন্তু হায় তার পরিবর্তে শুধু গবেষণা চলছে
অস্ত্রশস্ত্রগুলিকে কিভাবে আরো আরো আরো ভয়ঙ্কর করে তোলা যায়। নিমেষের মধ্যে কত অধিক
সংখ্যক মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা সম্ভব, কোন্দুর্বল রাজার ভূমি আত্মস্যাৎ করা
যায় এই নিয়ে। শোন প্রিয়ে---”- আরো অনেক কথা বলেছিলেন নকুল।
দ্রৌপদী নিজেকে সেদিন বড় অপমানিতা মনে করেছিলেন। নকুলের মুখে বার বার
উচ্চারিত ঐ ‘প্রিয়ে’ শব্দটি যেন
বিদ্রূপের মতো আঘাত করেছিল তাঁকে। আর পরমুহূর্তেই ভীষণ ক্ষোভে মনে হয়েছিল এই ব্যক্তি প্রকৃত
প্রস্তাবে ‘পুরুষই’ নয়। এমন অপরূপ রাত্রি। সম্মুখে এই সুগন্ধি, সুন্দরী নারী! আর তবু যাঁর
ইন্দ্রিয়গুলি আবেশে বিহ্বল হয়ে ওঠে না, যিনি এমন মুহূর্তেও বৃদ্ধ তাত্ত্বিকের মতো
অপরিচিত কিছু মানুষের মৃত্যু শোকে বিভোর হয়ে যেতে পারেন, তাঁর পৌরুষকে দ্রুপদকন্যা
শ্রদ্ধা করতে পারেননি কিছুতেই।
নারী কখনও অপ্রিয় অতীতের কথা বিস্মৃত হয় না। দ্রৌপদীও
নকুলের সেই অনৈচ্ছিক অবজ্ঞার ইতিহাস ভোলেননি। তাঁর একটি নিজস্ব গোপন
অভিমত আছে। অনর্থক করুণা, ক্ষত্রিয় পুরুষের পৌরুষকে ক্ষয় করে দেয় এমনই
দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর। অধিক মমত্ববোধ, অতিরিক্ত দয়া তার পৌরুষের পরিপন্থী। যে কারণে তাঁর জ্যেষ্ঠ
পতি যুধিষ্ঠিরের প্রতিও তাঁর এক ধরনের অব্যক্ত উপেক্ষা আছে।
সেই সব কথা বড় তীক্ষ্ণ স্মৃতি হয়ে জেগে উঠল আবার। আর কেমন এক অধীরতায়,
দ্রৌপদী নিজের কেয়ূর, কঙ্কণ, কন্ঠের স্বর্ণমালিকা খুলে খুলে সশব্দে শয্যাপার্শ্বের
বেদিতে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। আর সেই শব্দে জেগে
উঠলেন নকুল। আজকের দিনটিতে দ্রৌপদীর প্রচুর পরিশ্রম হয়েছিল। বৃহৎ ও জটিল
রাজসংসারকে কেন্দ্র করে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলে প্রতিদিন। জননী কুন্তী, স্বভাবে
কিছু নির্লিপ্ত। নিজের মুষ্টির মধ্যে কর্তৃত্ব ধরে রাখার মোহ নাই তাঁর। পুত্রবধূর প্রতি যেমন
স্নেহ, তেমনি ভরসা আছে তাঁর। দ্রৌপদীর উপরই সমস্ত কর্ম ব্যাপারে, কর্তৃত্বের ভার অর্পণ
করেছেন তিনি। দ্রৌপদীও এই ব্যবস্থায় পরম তৃপ্ত। শাসন, পালন এবং সুষ্ঠু
ভাবে কর্ম সম্পাদনার ক্ষমতা তাঁর সহজাত।
এখন ব্যস্ততা আরো বেড়েছে। ময় নামে এক অনার্য
স্থপতি রাজপরিবারের জন্য নির্মাণ করছে আশ্চর্য একটি প্রাসাদ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে
নাকি তেমন কোনো সৌধ আগে নির্মিত হয়নি। তার পরিকল্পনা চিত্রটি স্বামীদের সঙ্গে দ্রৌপদী নিজেও
দেখেছেন। সকলেই বিস্মিত হয়েছিলেন দেখে। এ প্রাসাদ অতি চমকপ্রদ
হবে সন্দেহ নাই, কিন্তু এর নির্মাণ বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ। রাজভান্ডারও ক্ষয়ীভূত
হবে এমন ব্যয়বাহুল্যে। চিন্তিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শুনলেন প্রাসাদ
নির্মাণের শেষে তাঁর পতিরা রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করবেন। দিকে দিকে বিভিন্ন
রাজাদের কাছে সসৈন্যে গমন করে প্রথমে মধুর বাক্যে কর প্রদানের দাবি করতে হবে। যাঁরা দেবেন, তাঁরা
পান্ডববন্ধু বলে স্বীকৃতি পাবেন। নচেৎ যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁদের করপ্রদানে বাধ্য করা হবে। সভার প্রাজ্ঞজনেরা নাকি
এমনই পরামর্শ দিয়েছেন।
দ্রৌপদী খুব উত্তেজিত বোধ করছিলেন। তাঁর দেহে প্রবাহিণী
ক্ষত্রবধূর রক্ত নৃত্য করে উঠেছিল সহসা। যুধিষ্ঠিরও দেখা গেল এ প্রস্তাবে সম্মত ও উৎসাহী।ভীম ও অর্জুন খুব আগ্রহ
সহকারে, কোন ভ্রাতা কোন অঞ্চলে যাবেন, রণকৌশলের রীতি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কেমন
হবে, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন দ্রৌপদীর দৃষ্টি চকিতে গিয়ে পড়ল, নকুলের উপর। দেখলেন বিবর্ণ তাঁর মুখ। ম্লান স্বরে অগ্রজদের
উদ্দেশে বললেন,-“কি উপযোগিতা এত ব্যয়ে এ বিচিত্র পুরী নির্মাণের? যে ব্যয় পূরণ
করতে, শেষে যুদ্ধযাত্রায় যেতে হয়! যুদ্ধ মানেই তো মৃত্যু, রক্ত আর হাহাকার!”- ভীম
অট্টহাসি হেসে উঠলেন,-“আমাদের এই ভাইটির এখনও শৈশবকাল কাটল না। যাও ভাই জননী কুন্তীর
আঁচলতলই তোমার সেরা আশ্রয়।” নকুল ম্লান মুখে নীরব রইলেন। দ্রৌপদী লক্ষ্য করছিলেন
তাঁকে। এঁর বলিষ্ঠ দেহের ভিতরে কি তবে রয়েছে এক ভীরু মন? ধিক্!
প্রাণভয়ে ভীত এক কাপুরুষ! তাঁর প্রায় ঘৃণা জেগেছিল সেই মুহূর্তে।
কিন্তু তিনি কতকগুলি নীতিতে বিশ্বাসী। সারা দিনের শ্রমের
শেষেও পতিশয্যায় গমনের পূর্বে প্রতিদিন
নিপুণ ভাবে সজ্জিত করেন নিজেকে। এখন নকুলের এই নিদ্রা এবং সহসা জেগে উঠে বিভ্রান্ত চোখের
দৃষ্টি দেখে, বিকর্ষণ বড় তীব্র হয়ে উঠল দ্রৌপদীর।
নকুল নিদ্রার আবেশ লেগে থাকা, অপ্রস্তুত মুখে একটু হাসলেন। দ্রৌপদী শীতল দৃষ্টিতে
একবার পতির দিকে তাকিয়ে, অলঙ্কারগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্তাতেই রেখে অন্য পাশ ফিরে
শয্যায় শয়ন করলেন। নকুল তাঁকে স্পর্শ করলেন,-“প্রিয়ে”, কিন্তু নকুলের মুখে এই
শব্দটিতে তাঁর একান্তই অনীহা। দীর্ঘপঙ্খ নয়ন দুটি মুদিত করে শুষ্ক স্বরে শুধু
বললেন,-“সারাদিনের শ্রমে বড় ক্লান্ত আমি। বিশ্রামের প্রয়োজন এখন।”
নকুল পত্নীকে বেষ্টন করে রাখা হাতটি সরিয়ে নিলেন। এই মাত্র দেখা অদ্ভুত সেই
স্বপ্নটার কথা মনে হচ্ছিল। একেবারে বাস্তবের মতো স্পষ্ট সে স্বপ্ন। এত স্পষ্ট যেন ঘুমের
মধ্যেও ভেসে আসছিল আগুনের প্রচন্ড উত্তাপ আর মাংস পোড়া গন্ধ। উজ্জ্বল দিনের আলোয় যে
দৃশ্য দেখেছিলেন কয়েক মাস আগে, তাই আজ ফিরে এসেছিল আবার।
অষ্টম অধ্যায়
অরণ্যের সীমান্ত ঘিরে আগুন জ্বলছিল দাউ দাউ করে। নিদাঘ মধ্যাহ্নতাপ
শতগুণে প্রখর হয়ে উঠেছিল। চোখ ঝলসে যায়। চড়্চড়্শব্দে ফেটে যাচ্ছিল প্রাচীন সব বনস্পতি। মরণ ডাক ছেড়ে ছুটে
বেরিয়ে আসছিল কত বন্য জন্তু। আর মারা পড়ছিল সৈন্যদের তিরের ঘায়ে। তাদের নেতৃত্ব
দিচ্ছিলেন কৃষ্ণ ও অর্জুন। আগুনের বলয় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল অরণ্যের আরো গভীরে। বন্য
মানুষদের বসতি সেখানে। আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছিল তারাও। অমনি সৈন্যেরা ছুটে
গিয়ে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছিল। আর ভয়ানক আক্রোশে জীবন্ত মানুষগুলির হাত পা ধরে ঝুলিয়ে
খেলার ছলে ছুঁড়ে দিচ্ছিল জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডে। আগুনের থাবা নিমেষের
মধ্যে বার বার থামিয়ে দিচ্ছিল তাদের আর্তনাদ। আর সৈন্যরা হেসে উঠছিল
খল্খল্করে। সুরার মতো হত্যা ও ধ্বংসেরও এক নেশা আছে। সেই নেশায় মেতে উঠেছিল
তারা। সেই বধ্যভূমি, হননভূমির বিবরণ কত কাল পরেও, এই জম্বুদ্বীপে
জীবন্ত হয়ে ছিল চারণ কবিদের গানে আর লোককথায়।
সে সব আজ অতীত দিন। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সে মহারণ্য। আর তার বিস্তীর্ণ এলাকা
জুড়ে নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। প্রধান স্থপতি ময় এই প্রাসাদ নির্মাণের যাবতীয় বিচিত্র
উপকরণও দূর দূর দেশ থেকে সংগ্রহ করে আনার ভার নিয়েছে। মানুষটি আপন কর্মের
ব্যাপারে অহংকার করে বটে, কিন্তু সে যে করিৎকর্মা, তাতে সন্দেহ নাই। প্রাসাদের সমগ্র
পরিকল্পনা চিত্রটি, সে যখন পান্ডব ভাইয়েদের সামনে মেলে ধরেছিল, তাঁরা কিন্তু
একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এমনই অভিনব ছিল তা। এই কালো কুৎসিত লোকটার এমন অদ্ভুত সৃজন ক্ষমতা!
যে সোনার তৈরি অজস্র গাছ দিয়ে সম্পূর্ণ প্রাসাদসীমা ঘিরে
ফেলা হবে তার গঠন শৈলী অনবদ্য। প্রাচীরের গায়ে রঙিন মণি রত্নের অমন অপরূপ নক্শা তাঁরা
আগে কোথাও দেখেননি। আর স্ফটিক দিয়ে এমন এক দীঘি নাকি তৈরি করবে সে, যা লোকে
দেখলে ভাববে সমতল প্রাঙ্গন।
“রগড়টা তখন দেখবেন একবার। নতুন মানুষজন চলতে
ফিরতে আহাম্মক বনে গিয়ে জলের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাবে একেবারে।”কুৎকুতে চোখে মজাদার
ভাব ফুটে উঠেছিল ময়ের। তার কথা শুনে সবচেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন ভীমসেন। রগচটা, গোঁয়ার, মারকুটে
বলে তাঁর অখ্যাতি আছে। কিন্তু তাঁর অন্তরে বাস করে এক কৌতুকপ্রিয় বালক। তখনই সেই ‘বালকটি’ দু হাতে
তালি দিয়ে জোরে হেসে উঠেছিল। -“হাঃ হাঃ দুর্যোধনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঐ দীঘির কাছে নিয়ে
গিয়ে নাকানি চোবানি খাওয়াতে হবে জলে।” যুধিষ্ঠিরও কিন্তু সেদিন নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে বড়
উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, দেখুক দেখুক ওরা। এমন প্রাসাদ যে সম্ভব
তা কল্পনাও করতে পারছে না। চিরকাল আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে যেন আমরা ওদের
আশ্রিত। আর বারণাবতে—আমাদের আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। ধিক্ধিক্কাপুরুষ---”ক্রোধে
লাল হয়ে গিয়েছিল তাঁর মুখ মুহূর্তের জন্য। তবে তিনি সংযমী পুরুষ। ক্ষমাশীলও বটে। আবাল্য সঞ্চিত ক্ষোভ ও
গ্লানিকে সংযত করে নিতে পেরেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি।
এখন ময়ের অধীনে দানবীয় চেহারার সব লোকেরা কাজ করছে। ঘোর কালো গায়ের রঙ। বড় বড় লালচে চোখ। লম্বা শক্তপোক্ত গড়ন। খুব শক্তি ধরে। ভারি ভারি ইঁটের বোঝা,
পাথর খন্ডগুলি অনায়াসে এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় হাতুড়ি দিয়ে পাথর
ভাঙছে। শব্দ ও ধূলোতে চারিদিক আচ্ছন্ন। পান্ডব ভাইয়েরা
প্রতিদিনই কেউ না কেউ এখানে আসেন, কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে।
যেমন আজ এসেছেন নকুল। প্রিয় অশ্ব রুরুর পিঠে চড়ে এই বিশাল কর্মভূমি প্রদক্ষিণ
করছেন তিনি নিয়ম মতো। কিন্তু বিক্ষিপ্ত তাঁর মন। অরণ্য-ধ্বংসে সায় ছিল
না তাঁর। কত বিচিত্র প্রাণী নিহত হোল। আশ্চর্য সুন্দর পাখিরা। আর বনের গভীরে বাস করা
মানুষের দলও। কি মর্মান্তিক ছিল সেই সব মৃত্যু। অথচ নকুল জানেন, বুনো
মানুষগুলিরও নাকি এমন বহু নিজস্ব বিদ্যা আছে, যা তথাকথিত সভ্য সমাজের বিস্ময়ের
কারণ। তারা আগে কখনই অরণ্যের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আসত না। হঠাৎ তারা কেন গ্রামে
হানা দিতে শুরু করল, তার উত্তর খোঁজারই কোনো চেষ্টা করা হয়নি। প্রকৃত কথা, রাজশক্তি,
তাদের মূল মানব ধারার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো প্রয়াসই করেনি।
ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনি কানে আসতে নকুল ফিরে উত্তর দিকে
তাকালেন। তখনও মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না। শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে
ক্রমশ। ইঁটের স্তূপের ওপার থেকে আরোহীর অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ চোখে পড়ল আরোহীর
অশ্বটির উপর। গাঢ় বাদামি ও কালোয় মিশ্র বর্ণ। এ অশ্ব বিকর্ণের না?
নিমেষের মধ্যে খুব কাছে চলে এসেছে। হাত তুললেন বিকর্ণ। দুর্যোধনের এক ভ্রাতা। বাতাসে ভেসে এল তাঁর
গলার স্বর। “ওহে রূপবান পুরুষ কি কর্ম এখানে?” – আরো কাছে
এসে অশ্বারোহী বেগ সংযত করলেন। নকুল বলগা চেপে ধরতে লাফিয়ে নামলেন বিকর্ণ। ঘাম ও ধূলোয় মাখামাখি
মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ।
“প্রকান্ড জঙ্গলটাকেই উড়িয়ে দিয়েছিস যে রে। কবে? এ কি জাদুর খেলা
নাকি? আমি দুই চান্দ্রমাসের জন্য বারানসী গিয়েছিলাম। ফেরার পথে মনে হোল
একবার দেখা করে যাই তোর সঙ্গে। তা ইন্দ্রপ্রস্থের পথ ধরে খুঁজে পাই না আর গোটা বনটাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম পথ
ভুল করেছি বুঝি।” বিকর্ণ জড়িয়ে ধরলেন নকুলকে। তাঁর চোখে এবার প্রশংসার
আভাস দেখা দিল। “নাহ্অদ্ভুতকর্মা বটে তোরা। মানতেই হয়। ওহ্কি অপূর্ব হবে রে এ
সমস্ত প্রাসাদ। সবে তো শুরু মাত্র হয়েছে, তবু এখনই দেখলে বোঝা যায়---”
এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে বিকর্ণের দেখা পেয়ে নকুলেরও খুব আনন্দ
হয়েছে। বহুকাল আগে হস্তিনাপুরে, তাঁরা যখন বালক, তখনই জানতেন,
কৌরব ভ্রাতারা তাঁদের বিরুদ্ধ পক্ষ। চাপা দ্বন্দ্বে, জননী কুন্তীর ভীত মুখ দেখে তাঁরা বুঝতে
পারতেন এ প্রাসাদে তাঁরা নিরাপদ নন। তবু তখন থেকেই বিকর্ণর সঙ্গে তাঁর গাঢ় হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল।
বহু সময়েই দেখা যায়, শৈশবের বন্ধুত্ব পরিণত বয়সে বিবর্ণ হয়ে
গেছে। কিন্তু এত বছর পরেও নূতন করে দেখা হবার পরে নকুল অনুভব
করেছেন, বিকর্ণের মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি আজও তেমনি স্বচ্ছ
মনের মানুষ রয়ে গেছেন। ঈর্ষাহীন, আবেগপ্রবণ। মাঝে মাঝে ইদানীং
নকুলের মনে হয়, একটু নির্বোধ হয়তো বা। কিন্তু মলিনতাবিহীন। এখনও বিকর্ণের মুখটি স্মরণে এলে, নকুলের মন স্নিগ্ধ হয়ে
ওঠে।
এই বিপুল কর্মযজ্ঞ দেখে বিকর্ণ একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে
উঠেছেন। বললেন,-“ভ্রাতা দুর্যোধন যদি এ কান্ড দেখে একবার, কি হবে
বল তো? তার মুখের গোরা রঙ একেবারে কালো হয়ে যাবে রে ঈর্ষাতে।”- দুষ্ট বালকের মতো
ভুরু নাচালেন তিনি।
নকুল হেসে ফেললেন। “নিজেই প্রশ্ন করলি। নিজেই উত্তর দিলি। তা চল এবার প্রাসাদে। জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির যে
কত খুশী হবেন তোকে দেখলে আর জননী কুন্তীর তো তুই বড় প্রিয়। আমি অবশ্য গোড়ায়
চিনেছিলাম তোর অশ্বটিকে, তারপরে তোকে—”- কিছুক্ষণ হাসি তামাসা আর পরিজনদের কুশল সংবাদ বিনিময়ের
পর, হঠাৎ বিকর্ণ বলে উঠলেন,-“একটি কথা মনে হোল, তাই জিজ্ঞাসা করছি। ভ্রাতা যুধিষ্ঠির কি
রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করতে চলেছেন?”
এ পরিকল্পনা গোপন আছে এখনও পর্যন্ত। নকুল তাই খুব বিস্মিত
হলেন। “তোর মনে হঠাৎ এমন প্রশ্ন জাগল কেন?”
বিকর্ণ তখন উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। “বাহ্মানুষ সুন্দর
সাজসজ্জা করে কেন? সুন্দর গৃহ নির্মাণ করে কেন? মণিমাণিক্যের অলঙ্কার সঞ্চয় করে
কেন? অপরে দেখবে বলেই তো! কেউ না দেখলে
বহু ধন ব্যয়ে এমন সুন্দর প্রাসাদ নির্মাণের অর্থ কি? তা রাজসূয় যজ্ঞ তো,
বহু লোককে একত্রে কিছু দেখানো আর প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উপায়।”- স্বভাবসিদ্ধ সরল
ভঙ্গিতে সে কথাগুলি বলল বটে, কিন্তু তা হঠাৎ প্রবল এক ধাক্কা দিল নকুলের
মস্তিষ্কের গহনে। তিনি না বিকর্ণকে স্বল্পবুদ্ধি ভাবতেন! সত্যই তো মুখে
প্রকাশ করে না বললেও প্রকৃত প্রস্তাবে শত্রুপক্ষকে জানানোর উদ্দেশ্য আমাদের সম্পদ
আছে। ক্ষমতা আছে। যে পিতৃহীন বালকগুলি পরাশ্রয়ে জীবন কাটিয়েছে। যাদের গুপ্ত হত্যার
ষড়যন্ত্রের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে বহু কাল, তারা যদি যৌবনে
অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে পেয়ে যায় বৈভব ও ক্ষমতা, তবে একটু উগ্রভাবেই প্রদর্শন করতে
চাইবে তা। হঠাৎ রোমাঞ্চিত হলেন নকুল। ভ্রাতাদের মুখগুলি যেন
সহসা স্পষ্ট হয়ে উঠল এই বিপুল আয়োজনের অন্তরালে। বিকর্ণ কি তাঁদের
আত্মদর্শন করাতে পারে?
নবম অধ্যায়
এ বড় অস্থির
সময়। সমস্ত জম্বুদ্বীপ
এখন আলোড়িত! প্রবল ক্ষমতাশালী মগধরাজ জরাসন্ধ নিহত হয়েছেন। দ্বারকার গণনায়ক কৃষ্ণ, পান্ডব
ভাইয়েদের সাহায্যে অতি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন তাঁকে। জরাসন্ধ অত্যাচারী শাসক বলেই পরিচিত ছিলেন। বহু দেশের রাজাকে
যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁরা মুক্তি পেয়ে, পান্ডব ভাইয়েদের খুব অনুগত
হয়ে পড়েছেন। কৃষ্ণ ও পান্ডবদের জয়ধ্বনিতে জম্বুদ্বীপ এখন মুখরিত। কিন্তু জরাসন্ধের মৃত্যুতে চেদী রাজ্যে আশঙ্কার
কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। করেণুমতীর পিতা শিশুপাল জরাসন্ধের একান্ত বশ্য ছিলেন। জরাসন্ধ তাঁকে প্রধান সেনাপতির পদে নিয়োগ করেছিলেন। শিশুপাল প্রভুর মতো ভক্তি
করতেন তাঁকে। ক্রোধে ও যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন তিনি।
কিভাবে
পান্ডব তথা কৃষ্ণকে হত্যা করা যায়, সেই আলোচনা করতে মন্ত্রী দেবরূপকে ডেকে পাঠালেন শিশুপাল। দেবরূপ মানুষটি
বিচক্ষণ ও সৎ। দূরদর্শীও। তাঁর সুপরামর্শ, শিশুপালের হঠকারীতায় ভরা জীবনে অনেকবার অনেক বিপর্যয়কে রোধ
করেছে। নিজের অন্তরে এ কথা
জানেন শিশুপাল। প্রকাশ করে বলেননি কখনও। দাম্ভিক মানুষ কখনও অন্যের প্রশংসা করেন না। দেবরূপ অবশ্য
স্বীকৃতির প্রত্যাশাও করেন না আর। বয়স বেড়েছে। আজকাল একধরণের
নৈরাশ্য ও নির্লিপ্তি এসেছে তাঁর মনে। তিনি নিশ্চিত সংবাদ পেয়েছেন, সামনে এক মহাদুর্দিন আসন্ন। কিন্তু তিনি খুব
উদ্বিগ্ন নন আর! তিনি হয়তো নিয়তিবাদী হয়ে উঠেছেন। তাঁর এখন মনে হয়, সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্ট। যা হবার তাইই হবে। এ জগৎ চলে,মানুষের
না জানা কোনো দৈব শক্তির বশে। পার্থিব প্রয়াস, যেন তপ্ত মরুভূমিকে এক বিন্দু জল ঢেলে ভিজিয়ে দেবার মতোই এক হাস্যকর ভাবনা। তবু মানুষ হাত পা
গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনা। নিজস্ব বোধ অনুযায়ী
কর্ম করতেই হবে তাকে।
দেবরূপ
দেখছেন একদার সেই দুর্দম পুরুষ এখন অসহায়। জরাসন্ধের মৃত্যু যেন তাঁর শক্তি কেড়ে নিয়েছে। তবু নম্র হননি তিনি। মুখে অন্তঃসার
শূন্য আস্ফালন। দেহ খুব সুস্থ নয়। সর্বদাই ক্লান্ত লাগে। শুয়ে থাকেন শয্যাতে। মুখের পেশীতে
শিথিলতা। চোখ দুটি রক্তবর্ণ। হাত কাঁপে যখন তখন। তবু রাজবৈদ্যের নিদান না মেনে সারাদিন ধরে মদ্যপান করেন। জরাসন্ধ নিহত হবার পরেই, মাত্র কয়কদিনের ভিতরে
এমন অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে তাঁর। দেবরূপকে দেখেই শিশুপাল উত্তেজনায় বিকৃত মুখে ভাঙা গলায়
চীৎকার করে উঠলেন,-“কি? খবর পেয়েছ কিছু? ঐ কপট, শঠ লোকগুলো আবার কোন ফন্দি এঁটেছে? এই চেদিরাজ্যের
সীমানার মধ্যে পা দিলে শূলে চড়াব তাদের। রক্ষীদের সতর্ক থাকতে বল।” দেবরূপের হঠাৎ বড় মায়া হয়। দীর্ঘজীবন এই অহঙ্কারী, অন্যায়কারী লোকটির সাহচর্যে কেটেছে,
ঘৃণা জেগেছে কতবার, কতবার মনে হয়েছে এর দাসত্ব আর করব না, তবু অন্তঃসলিলা অদ্ভুত
এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে কবে যেন! আবেগহীন স্বরে তিনি বললেন,-“মধ্যম পান্ডব ভীম, দিগ্বিজয়ে
বেরিয়ে বিদেহ, গন্ডক, দশার্ণদেশ জয়
করেছেন,পূর্বদেশের অধিপতি রোচমান, পুলিন্দনগরের দুই ভূপতি সুকুমার ও সুমিত্র এঁরাও
পরাজিত হয়েছেন তাঁর বাহুবলের কাছে। এখন তাঁর বহু অশ্বগজযুক্তবাহিনী চেদিরাজ্যের অভিমুখে। চরের মুখে সংবাদ পেয়েছি, আজ হতে তৃতীয় দিনের প্রভাতে এ
রাজ্যের সীমান্তে এসে পৌঁছবেন তাঁরা।’’ -কয়ক মুহূর্ত
শিশুপাল কোনও কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবরূপের মুখের দিকে। এ সংবাদ
অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু মানুষ শেষ মুহূর্ত অবধি আশা করে হয়তো বা বিপদ কেটে যাবে। এখন শিশুপাল যেন
সামনে দেখলেন এক ব্যাদিত মুখ হিংস্র শ্বাপদকে। দুই হাতের পাতায় মুখ ঢেকে আর্তস্বরে কেঁদে উঠলেন
এই নির্মম পুরুষ। কত যুদ্ধ, কত হত্যার নায়ক! কত মানুষের রক্তে রঞ্জিত তাঁর ঐ কঠিন করতল। এই মুহূর্তে দেবরূপের মনে হোল
তাঁর পিঠে নিজের হাতখানি রাখেন। মমতা ও সান্ত্বনার হাত। কিন্তু এই লোকটি যে তাঁর অন্নদাতা প্রভু। দীর্ঘ দিনের
সংস্কার এমন ঘনিষ্ঠ হতে বাধা দিল তাঁকে।
শান্ত স্বরে
দেবরূপ বললেন,-“একটি মাত্র উপায় আছে। পান্ডবদের বশ্যতা স্বীকার। ভীম উপস্থিত হলে----”-
“অসম্ভব।” দেবরূপকে অর্ধপথে
থামিয়ে ভাঙা গলায় চীৎকার করে উঠলেন শিশুপাল। দেবরূপ নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রাসাদের প্রাচীরকে বললেন,-“দ্বিতীয় উপায় নাই।”- কতক্ষণ কোনও শব্দ ধ্বনিত হল না সে ঘরে। শিশুপাল নত মুখে
বসে রইলেন। “আমি আপন বুদ্ধিমত বলেছি, এবার আপনার অভিরুচি। অনুমতি দিন তবে—”- উঠে দাঁড়ালেন
দেবরূপ। তাঁর বসনের প্রান্ত
শক্ত মুঠোয় ধরে আর্তনাদ করে উঠলেন অতীতের দোর্দন্ডপ্রতাপ মানুষটি। - “আমায় ছেড়ে যেওনা। তোমার বিবেচনা
অনুযায়ীই আমি চলব। শুধু শুধু আমার ন্যুনতম সম্মানটুকু যেন থাকে। যেন---”- তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আর কোনও শব্দ খুঁজে পান না। তাঁর সমস্ত শব্দ শেষ হয়ে গেছে। ভাষাহীন আতঙ্কের
সঙ্গে মিশে আছে, দম্ভের করুণ তলানি। উলটে গেছে পাশার দান। পড়ে আছে একটা খড়ের পুতুল। -“শুনুন মহারাজ। রাজ্যসীমার বাইরে নর্মদা নদীর তীরে যে মনোরম উদ্যান, সেখানে
অপেক্ষা করুন মধ্যম পান্ডবের জন্য। তিনি রণহুঙ্কার দেবার আগেই আপ্যায়ন করুন তাঁকে। যেন তিনি এক মাননীয়
অতিথি। উপাদেয় খাদ্য ও
মহামূল্য উপহারের আয়োজন রাখুন। এমন একটি আবহ নির্মাণ করুন যেন যুধিষ্ঠিরের এই রাজসূয়
যজ্ঞের ব্যাপারে আপনার সম্পূর্ণ সমর্থনই শুধু নয়, উৎসাহও আছে। যেন এটি একটি মহৎ পরিকল্পনা বলেই আপনি এই বিষয়টির
সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। দেখবেন পরিবর্তে ভীমও সম্মান জানাবেন আপনাকে। ”- দেবরূপ নিজের করতল দুটি যুক্ত করেন,-“মহারাজ—আপনার পুত্র, কন্যা, পরিবার পরিজন,সমগ্র এ চেদি রাজ্যের জন্যই এমন করতে হবে আপনাকে। সময় বিশেষে সকল
মানুষকেই কপট আচরণ করতে হয়। নতুবা এ ধরণী এক
বন্ধুহীন, আত্মীয়হীন অবিরাম যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হোত। এক্ষেত্রে নিজের মনের অনুভূতিকে গোপন রাখা, আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়।”
আত্মগ্লানিতে
কঠিন দাঁতে নিজেরই ওষ্ঠ ক্ষত বিক্ষত করেন শিশুপাল। ঈষৎ রক্তাভ উদ্ধত সেই চোখের কুলে অসহায় অশ্রুর
আভাস। উদাসীন কালপ্রবাহ
বয়ে চলে।
দশম অধ্যায়
খুব বৃষ্টি
হচ্ছিল কদিন ধরে। অসময়ের বৃষ্টি। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন পান্ডব ভ্রাতারা। এত আয়োজন শেষে পন্ড না হয়! লড়াইবাজ ভীম মাঝে
মাঝে ক্রোধে মুখ বিকৃত করছিলেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপর পানে ছুঁড়ে বর্ষণরত আকাশের উদ্দেশে
হুঙ্কার দিয়ে উঠছিলেন থেকে থেকে। কিন্তু অনন্ত ঐ মহাশূন্যের বিরুদ্ধে তো আর যুদ্ধ চলে না। দর্শনা নদীর জল এদিকে অনেকখানি
বেড়ে গিয়েছে। কূল ছাপিয়ে বন্যা এলে যে কি মহা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে, সে কথা ভেবেই চিন্তিত
পুরবাসী। এমন সময়ে যজ্ঞানুষ্ঠানের তিন দিন আগে বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। সূর্যের আলো এখন কোমল, উজ্জ্বল। আগামী কাল থেকেই হস্তিনাপুর
থেকে জ্ঞাতি ভ্রাতারা সপরিবারে আসতে শুরু করবেন। উৎসব দিনের ব্যবস্থাপনার একটি নিখুঁত পরিকল্পনা
চিত্র রচিত হয়েছে। যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ কুরু ভ্রাতা দুর্যোধনের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই এই ব্যাপারে
পত্র বিনিময় করেছেন বার বার। তাঁকে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে তাঁর মূল্যবান মতামত প্রার্থনা
করেছেন। কোনো বিষয়ে যদি
ব্যবস্থাপনার কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন মনে করেন দুর্যোধন, তবে সাদরে গৃহীত হবে
তা।
যুধিষ্ঠির
স্থির করেছেন যথাযথ সম্মানের সঙ্গে কুরুভ্রাতাদের মধ্যে কর্মের দায়িত্ব ভাগ করে
দেবেন তিনি। এই ভাবেই আত্মীয় পরিজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যাতে তাঁরাও এই উৎসবের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন।
“তারা
একাত্মবোধ করবে? আমাদের সঙ্গে? মনে রাখবেন, ঐ দুর্যোধন আজ আমাদের সমৃদ্ধির বার্তা
পেয়ে আরো অনেক বেশি ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছে। এবং স্বভাবে সে খল। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কালসর্পের তুল্য। সুযোগ পাওয়া মাত্র ছোবল মারতে উদ্যত! হে অগ্রজ,
তা কি জানেন না আপনি? অজস্র অভিজ্ঞতা কি নেই আপনার এ ব্যাপারে?” – ক্রুদ্ধ বিদ্রূপ
ঝলসে উঠেছিল ভীমের মুখে।
“অতীত কথা
মনে রেখ না ভাই। কারণ অতীতকে তো আমরা পরিবর্তিত করতে পারি না। তাদের সেই এককালের আক্রোশ, ঈর্ষা বিদ্বেষ ভরা
দিনগুলি আজ মৃত। আমাদের হাতে আছে শুধু বর্তমান। শান্ত মনে সযত্নে প্রতি মুহূর্তে সেই বর্তমানকে লালন কর। তবেই তা সুন্দর বন্ধুতায়পূর্ণ
এক ভবিষ্যৎকে গঠন করবে। দ্বন্দ্ব কলহ কখনই সমাধান নয়। আর ক্ষমা মঙ্গলময় আলোকধারার সমান। যার প্লাবনে ধুয়ে মুছে যায় সকল বিদ্বেষ, মালিন্য।” – যুধিষ্ঠিরের শান্ত কণ্ঠস্বরে, ভীম গম্ভীর মুখে
স্তব্ধ হয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর মন কুরুভ্রাতাদের উদ্দেশে অশ্রাব্য সব গালি
বর্ষণ করতে লাগল অবিরাম।
আজ নকুল এই
প্রবল কর্মব্যস্ততার মধ্যে থেকেও একটু অবসর বার করে অশ্বশালায় গিয়েছিলেন। তাঁর বড় প্রিয় দুটি অশ্ব আছে
রুরু ও সিন্ধু। মধ্যপ্রাচ্যের এক বণিকের কাছ থেকে তাদের ক্রয়
করেছিলেন তিনি।
প্রথম দর্শনে নামকরণও তিনিই করেছিলেন। রুরুর বর্ণ শ্বেত। সিন্ধুর পাটল। আর তেমনি দ্রুতগামী। নকুল অশ্বপ্রেমী। প্রতিদিন অশ্বশালে গিয়ে
পোষ্যগুলির যত্ন করেন তিনি নিজ হাতে। পরিচারকদের উপর নির্ভর
করতে পারেন না। তাঁর মনে হয় বেতনভোগী মানুষগুলি
হয়তো দায়সারা ভাবে কাজ করবে। আন্তরিকতা থাকবে না তার
মধ্যে। নকুল স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, তাঁকে দেখেই তাদের চোখের
দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সাধারণ কোনো মানুষ পশুর মুখের এমন
সূক্ষ্ম বদল হয়তো বুঝবে না। শুধু যারা তাদের অন্তর
থেকে ভালবাসতে পেরেছে তারাই বুঝবে।
নকুল রোজকার মতো অশ্ব দুটির পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে
দিচ্ছিলেন। আরামে পশুগুলির চোখ বুজে আসছিল। গলায় অর্ধস্ফুট শব্দ করছিল তারা। নকুল জানেন সুখানুভূতির প্রকাশ এই শব্দ। হঠাৎই আশ্চর্য এক কৃতজ্ঞতাবোধ জেগে উঠল তাঁর মনে। তিনি ভাবলেন তাঁর আত্মপরিজনেরা তাঁকে স্নেহ, প্রীতি
দেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবু তার মধ্যেও যেন থেকে যায় নীরব
প্রত্যাশা। প্রত্যাশা মানেই এক অকথিত বিনিময়
আকাঙ্খা। কিন্তু এই ভাষাহীন পশুগুলির
ভালবাসা সম্পূর্ণই শর্তহীন। তাঁর অন্য ভ্রাতারা,
পান্ডবমহিষী, তাঁর পশুপ্রেম নিয়ে কৌতুক
করে থাকেন। মধ্যমাগ্রজ ভীম অট্টহাস্যে মাঝে
মাঝে বলেন,-“আমাদের এই ভ্রাতাটির দেখি মনুষ্য সংসর্গে তেমন রুচি নাই। অশ্বগুলির সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপেই অধিক তৃপ্তি।”
তারপরেই নকুলের মুখে বিদ্রূপের ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। অগ্রজ যুধিষ্ঠির মহান ব্যক্তি। আত্মীয়কুটুম্বের সঙ্গে সৌহার্দ্য রাখতে চান সর্বদা। তাদের তুষ্ট করতে চেয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন আজকাল। একটি মাটির তালকে টিপেটুপে গোল পাকাবার মতো করে কৌরব ভ্রাতাদের মনের ঈর্ষা,
দ্বেষকে মসৃণ, নিটোল এক সম্পর্কে পরিণত করতে চাইছেন তিনি। অথচ কি জটিলতা তাঁর ভিতরে। এই আড়ম্বরময় যজ্ঞ
সম্পাদনের মধ্য দিয়ে, বিপুল এই প্রাসাদ স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকাশ
পাচ্ছে তাঁর এই সম্পদ প্রদর্শনের আগ্রহ। পশুরা
কাপট্য জানে না।
তাঁর কানে এসেছে
প্রাসাদের পরিচারকের দল মনে করে, চতুর্থ পান্ডব পশুভাষা বুঝতে পারেন। অবলীলায় পশুদের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে সক্ষম বুঝি!
আজ অশ্বাগারে এসে এই সব কথা মনে পড়ছিল নকুলের। আর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। সত্য বটে তাঁকে নিয়ে কত রটনাই না আছে। গ্রাম্য মানুষ তাঁর তীব্রগতিতে অশ্বচালনা দেখে মনে
করে বৃষ্টির দিনে প্রবল বারিপাতের মধ্যে উন্মুক্ত প্রান্তরে অশ্বারোহন করলেও তাঁর
শরীরে জলের বিন্দু লাগবে না। কারণ এত তীব্র তাঁর গতি
যে বৃষ্টির ধারা আকাশ থেকে নীচে নেমে তাঁকে স্পর্শ করার আগেই তিনি পৌঁছে যেতে
পারেন কোনো গন্তব্য স্থানে।
এই মুহূর্তে নকুলের ইচ্ছা জাগছিল অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে
অরণ্য প্রান্তর অতিক্রম করে যেতে। তাঁর পচন্ড বেগে দু
পাশের পুষ্করিণী, নদীতীর, জনপদগুলি দূর
থেকে দূরতর হয়ে যেতে থাকুক প্রতিমুহূর্তে। অনেক
পিছনে পড়ে থাকুক এই বৈভবে ভরা উৎসব আয়োজন।
ঠিক সেই সময়ে হঠাৎই নিজের দুই ভ্রুর মধ্যে তীক্ষ্ণ শলাকা
বিঁধে যাবার মতো এক যন্ত্রণা অনুভব করলেন নকুল। মস্তিষ্কের গহনে কোনো রোষাবিষ্ট দেবতা অকস্মাৎ তান্ডব নৃত্য শুরু করলেন যেন!
পরিচিত এ অনুভূতি। কখনও কখনও হয় এমন। বহুকাল আগে সুদূর বাল্যকালে সেই অরণ্যঘেরা উপত্যকায়—একদিন প্রথম এমন হয়েছিল। তারপরে কদাচিৎ হয়েছে মাঝে মাঝে। খুব ক্ষীণ এক স্মৃতি
ঝলকে উঠল নিমেষের জন্য। অর্ধস্ফুট স্বরে শুধু বলতে
পারলেন,-“আবার! আবার তেমনি!” – তারপরেই তাঁর চারপাশ
থেকে মুছে গেল এই পশুশালা, অশ্বগুলি, চারপাশের সকল দৃশ্য, গন্ধ, শ্রবণ ও স্পর্শানুভূতি।
চতুর্থ পান্ডব, মাদ্রীতনয় নকুল যেন অকস্মাৎ জেগে উঠলেন
স্বপ্নসম এক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। পূর্ণ এক সভাকক্ষ। বহু মানুষ। তাদের অভিব্যক্তিতে উত্তেজনা। কিন্তু শব্দহীন এই
চলমান দৃশ্য সকল। নকুল দেখছেন কিছু পরিচিত মুখ। তাঁর জ্যেষ্ঠাগ্রজ
যুধিষ্ঠির। বিহ্বল মূর্তি! চরম অপ্রস্তুত যেন! ধৃতরাষ্ট্রপুত্রেরা
নাকি দূরে? মুখগুলি অস্পষ্ট। কে ঐ প্রৌঢ় ব্যক্তি? মহামূল্য বস্ত্র, অলঙ্কারে ভূষিত। সম্ভবত কোনো রাজন্য। কিন্তু মাংসল মুখে
আভিজাত্যের পরিশীলন নেই। প্রকট হয়ে রয়েছে দম্ভ। ভীষণ আক্রোশ ফুটে উঠেছে
তাঁর মুখের ভাবে। শূন্যে মুষ্টি নিক্ষেপনে। তিনি চিৎকার করে কিছু
বলছেন। শোনা যায় না। তবু সন্দেহ থাকে না, কারুর উদ্দেশ্যে কটুক্তি--। কার উদ্দেশ্যে? বহু
উত্তেজিত মুখ। পরিচিত, অপরিচিত! চকিতের জন্য একবার দেখলেন পান্ডবসখা
কৃষ্ণকে। কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর কমনীয় মুখের প্রতিটি রেখা। কেউ একজন, সম্ভবত তাঁরই
কোনো অনুচর, শান্ত করতে চেষ্টা করছে ঐ দুর্বিনীত প্রৌঢ়কে। পরমুহূর্তেই সেই
ব্যক্তিটি ছিটকে পড়ল, প্রৌঢ়ের অসহিষ্ণু হস্তসঞ্চালনে।
অলৌকিক এক চলমান চিত্রস্রোত দেখছেন নকুল। অন্য সকল মানুষ আবছা
হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে চারপাশ থেকে, প্রকট হয়ে উঠছে শুধু প্রৌঢ়ের নৃশংস মুখ। দন্তে দন্তে ঘর্ষিত
করছেন ভয়ানক জিঘাংসায়। হিংস্র শ্বাপদের মতো দেখাচ্ছে সে মুখ! কণ্ঠের শিরা ফুলে
উঠেছে। কোনো অশালীন, রুক্ষ বাক্য উচ্চারণ করছেন যেন। বিকৃত মুখের ভাব। এরপরেই এক মুহূর্তের
মধ্যে ঘটল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। কোথা থেকে ছুটে এল বিশাল একটি লৌহ চক্র। শানিত সেই চক্র আঘাত
করল প্রৌঢ়ের গলদেশে! নিমেষেরও ভগ্নাংশ সময়ে স্কন্ধচ্যুত হল মস্তক। নকুল দেখলেন তীব্র
রক্তের প্রবাহ। তাঁর মনে হচ্ছিল ওই রক্ত যেন এখনই তাঁর শরীরে এসে লাগবে!
তিনি রক্তের ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন। ক্রমশ সেই রক্ত ব্যাপ্ত
করল তাঁর দৃষ্টিকে। ঢেকে গেল সকল দৃশ্য। রক্তাভ অন্ধকার গ্রাস করছে তাঁর চেতনা। দূর থেকে যেন ভেসে এল
সম্মিলিত হ্রেষ্বা রব। বহু অশ্ব একই সঙ্গে আর্তনাদ করছে। তারপরই নিভে গেল তাঁর
সকল অনুভব।
অন্যরকমের এক দিন। বহুকাল পরে তাঁর আবার বুঝি এক অলৌকিক দর্শন হয়েছিল। শৈশবে এমন হয়েছে কখনও
কখনও। মাতা কুন্তীর মুখে শোনা। ভবিষ্যতের কোনো ঘটনাকে
দর্শন করেন তিনি এই সময়ে। তারপর আচ্ছন্ন হয়ে
যান। কি দর্শন করেছিলেন সে কথা আর স্মরণ থাকে না চেতনা ফিরে
আসার পরে। কিন্তু জননী বলতেন সেই আচ্ছন্ন অবস্থায় উচ্চারিত কিছু কিছু
বিক্ষিপ্ত বাক্য থেকে নাকি কোনো ঘটনা ঘটবার আভাস পাওয়া যেত। যুধিষ্ঠির ও মাতা
কুন্তী বলতেন, পিতা পান্ডুর মৃত্যুর পূর্বেও তিনি নাকি সে অশুভ ঘটনার ইঙ্গিত
পেয়েছিলেন।
কিন্তু আজ অশ্বাগারে ছিলেন নকুল একাকীই। তারপরে অশ্বদের ভীষণ
হ্রেষ্বা রবে পরিচারকের দল বিপদের আশঙ্কায় ছুটে এসেছিল। তারা এসে তাঁকে ভূতলে
লুটিয়ে পড়ে তাকতে দেখে।জ অর্ধ অচৈতন্য অবস্থা।তারা শুনেছিল ঘোরের
মধ্যে তিনি শুধু বারম্বার বলে চলেছিলেন,-“রক্ত---রক্ত—ওহ্রক্ত্রের স্রোত যেন—ছিন্ন
মস্তক-- কে? কে ও?” স্বভাবতই আতঙ্কিত অবস্থায় তারা তাঁর মুখে চোখে জল দিয়ে চেতনা
ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। পরে প্রাসাদ কক্ষে বহন করে আনা হয়।
রাজবৈদ্য এসে স্নায়ুস্নিগ্ধকর কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন। ভ্রাতাগণ উদ্বিগ্ন মুখে
তাঁর শয্যাপার্শ্ব ঘিরে রেখেছিলেন কতক্ষণ। কুন্তী তাঁর ললাট স্পর্শ করে শান্ত স্বরে বলেছিলেন,-“বৎস
নিদ্রা যাও। এমন দর্শনের পরে তোমার ক্লান্তি আসে বড়। আগেও দেখেছি। গভীর নিদ্রা সব গ্লানি
দূর করবে।”
কতক্ষণ মৃত্যুপম এক নিদ্রায় মজ্জমান ছিলেন তিনি। এখন আবার আপন শয্যায়
জাগ্রত হলেন। আচ্ছন্ন অবস্থায় কি দৃশ্য দেখেছিলেন তা সম্পূর্ণ মুছে
গিয়েছে স্মৃতিপট থেকে। তাঁর চোখ পড়ল সুদর্শনা পত্নীর দিকে। তাঁর দৃষ্টিতে যেন
কৌতুহল। দ্রৌপদী কখনও এমন দৃশ্য দেখেননি।
“এখন সুস্থ বোধ করছেন তো?” – দ্রৌপদী প্রশ্ন করলেন।
“আর কোনো ক্লান্তি নাই।” নকুল উত্তর দিলেন। নিদ্রার জড়িমা মুছে
যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তিনি শয্যায় উঠে বসলেন।
“আর্যপুত্র, পরিচারকগণ বলেছিল আপনি বারবার ‘রক্ত’ শব্দটি
উচ্চারণ করেছিলেন। আমি দেখেছিলাম আপনার অচৈতন্য মুখে কি গভীর ত্রাসের
অভিব্যক্তি!”
“হে বরাঙ্গনে, আর কোনো স্মৃতি নেই আমার সেই আশ্চর্য দর্শনের। জননী বলেন প্রতিবারই
এমন হয়। আমি নাকি দেখতে পাই কোনো ঘটনার পূর্বাভাস। কিন্তু বিস্মৃত হয়ে যাই
তা। শুনেছি সেই সময়ে
আমি নাকি বারবার উচ্চারণ করেছিলাম ঐ শব্দ। হ্যাঁ আমি আতঙ্কিত বটে।এখনও। কারণ রক্ত যে সর্বদাই
কোনো অশুভ ঘটনার প্রতীক। এর সঙ্গে জড়িত থাকে হিংসা ও ঘৃণা। নির্মম লুণ্ঠণ ও হত্যার
আকাঙ্খা, জগতের মঙ্গলকে যা বিধ্বস্ত করে।---না জানি কোন ভয়ঙ্কর
ভবিষ্যতের পূর্বাভাস প্রত্যক্ষ করলাম!”
“রাজগৌরবের
সঙ্গে নির্মমতা সর্বদাই জড়িত থাকে হে স্বামীন, যেমন
অচ্ছেদ্যবন্ধনে থাকে পুষ্পে গন্ধ, আদিত্যে তেজরাশি। নগর সভ্যতা তপোবনের নির্জীব ঋষিদের দান নয়।”
পত্নীর মুখের তীব্রতার অক্ষরগুলি পড়তে পারলেন নকুল। আশ্চর্য তীক্ষ্ণ
সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হয় এই রাত্রিবর্ণা রমণীর অবয়বে, আননে, বাক্য ও গতিভঙ্গিতে। প্রায় ত্রাসের মতো এক
ধরণের সম্ভ্রম উদ্রেককারী। আসমুদ্রহিমাচল বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপে শ্যামাঙ্গী সুন্দরী
বিরল নয়। কিন্তু এই নারীর রূপ তাঁদের থেকে পৃথক। এ রূপ অনন্য তার
বর্ণবৈচিত্রে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধরোষ্ঠের বর্ণ সাধারণত বাদামি। কেশ ও চক্ষু
তারকা নিবিড় কৃষ্ণ। কিন্তু দ্রৌপদীর রূপে সবচেয়ে আকষর্ণীয় যা, তা হোল অনন্য বর্ণবৈচিত্র। তাঁর মসৃণ শ্যামল
ত্বকের মধ্যে থেকে বিচ্ছুরিত হয় যেন খুব মৃদু রক্তিম আভা। দুর্লভ নীল পদ্ম সদৃশ। তাঁর ওষ্ঠ, করতল ঘন
রক্তিম। তরঙ্গায়িত কালো কেশে ঈষৎ স্বর্ণাভা। চক্ষুতারকা ঘন নীল। প্রতি মুহূর্তে বড়
উজ্জ্বল তাই তাঁর উপস্থিতি।
নকুলের মনে পড়ে তাঁদের অদ্ভুত সেই বিবাহ রজনীর কথা। স্বয়ম্বর সভায়
মরালগ্রীবা এই রমণীকে দেখে তাঁর শরীরের রক্তস্রোত উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি জানতেন ইনি
অগ্রজ অর্জুনের পত্নী। তাই তাঁর প্রণম্যা। আবাল্যলালিত সংস্কার, নীতিশিক্ষা তাঁকে সংযত করেছিল। কিন্তু কয়েক দন্ড পরেই
ঘটনা প্রবাহ ভিন্ন পথে বাঁক নিয়েছিল। এখন মনে হয় যেন অসংলগ্ন স্বপ্নের মতো ছিল সে রাত্রি। মধ্যমাগ্রজ ভীমের
উচ্ছ্বাসের উত্তরে কুটিরের অভ্যন্তর থেকে জননীর নিজের অজান্তে উচ্চারিত সেই
নির্দেশ- যা এনেছ সকলে ভাগ করে নাও। তারপর রক্তাম্বরা
নারীকে দেখামাত্র তাঁর সেই স্তম্ভিত মুখের ভাব----পরমুহূর্তেই নিজের অজ্ঞাতে বলা
বাক্যের সত্যরক্ষার আর্তি--। তারপর তো বিচিত্র ঘটনার আবর্তে তাঁদের পঞ্চভ্রাতার সঙ্গেই
বিবাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল সেই অপরূপা তরুণীর। বিবাহক্ষণে অপ্রত্যাশিত
তীব্র আনন্দ প্রবল বন্যার মতো নীরবে প্লাবিত করছিল নকুলকে। কি আশ্চর্য ছিল সেই
রাত্রি। কি উজ্জ্বল। বিচিত্র! সুগন্ধি। কি মাদকতাময়!
কিন্তু সময় বড় নির্মম। পূর্ণ দৃষ্টিতে পত্নীর
দিকে তাকালেন নকুল। সেদিনকার সেই নববধূ আজ বৃহৎ এই রাজপরিবারের গৃহিণী। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে
সুচারুরূপে চলে এ সংসারের কর্মচক্র। ত্রুটিহীন তাঁর আচরণ। দৃঢ় তাঁর ব্যক্তিত্ব। সযত্ন পরিচর্যায় তাঁর সেদিনের রূপ আজও অম্লান
রয়ে গেছে। কিন্তু পত্নীর
সঙ্গে যাপিত জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলি বড় নিশ্চিতভাবে নকুলকে
বুঝিয়েছে তিনি এই নারীর মানস তরঙ্গকে স্পর্শ করতে পারেননি কখনই।
জৈবিক নিয়মে তাঁদের শরীর মিলিত হয়েছে বারবার, তাঁর সন্তানের
জননী এই নারী। কিন্তু দ্রৌপদীর কিছু সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি থেকে অনুভব
করেছেন নকুল, যে একটি শূন্যতার নদী তাঁদের দুজনের মধ্যে সতত প্রবাহিণী।
দ্রৌপদী তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে। উত্তরের প্রত্যাশী। রক্তিম ওষ্ঠাধরে গূঢ়
বিদ্রুপ। কিন্তু তর্ক-বিতর্ক,
কথার জটিল দ্বন্দ্ব বড় ক্লান্ত করে আজকাল নকুলকে। তিনি ঈষৎ হাস্য করলেন
কেবল। পত্নীর বাক্যের উত্তর দিলেন না। শুধু স্মিত মুখে
তাকালেন।
মনস্বিনী দ্রৌপদীর সুন্দর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।
একাদশ
অধ্যায়
এখন সন্ধ্যা
ঘনিয়ে এসেছে। করেণুমতীর বিশাল ঘরে জ্বলছে অনেকগুলি উজ্জ্বল প্রদীপ। মাটিতে আসন পেতে বসে আছে সে। পাশে অনেক পুঁথি স্তুপীকৃত হয়ে রয়েছে। তার সামনে বসে আছেন
আচার্য বীতিহোত্র। কয়েকটি বছর চলে গেছে। বীতিহোত্রের দেহে এখন সেই সময়ের চিহ্ন। কেশগুলি সবই সাদা হয়েছে। শিথিল হয়েছে পেশী। কিন্তু করেণুমতী এখনও তেমনি তণ্বী, তেমনি সুকুমার
তার মুখশ্রী। বীতিহোত্র তাকে বলছেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতির কথা। এই চেদি রাজ্য, ইন্দ্রপ্রস্থ,সুদূর দ্বারকাপুরী,
সমগ্র জম্বুদ্বীপই জড়িয়ে আছে এই আলোচনায়। করেণুমতীর মুখে উদ্বেগ।
তার মনের
অবস্থা অবর্ণনীয়। সর্বদাই যেন দোলাচলে দুলছে। পিতা শিশুপাল বরাবরই তার কাছে দূরের মানুষ। কোনও হৃদ্যতা গড়ে
ওঠেনি পিতাপুত্রীর মধ্যে। তার উপর করেণুমতী মেধাবিনী। তার পর্যবেক্ষণ শক্তি আছে। কোনও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে যথেষ্ট। ন্যায় ও অন্যায়
সম্পর্কে তার মধ্যে কাজ করে তীক্ষ্ম বোধ। তবু পান্ডবদের কাছে
তার পিতাকে যে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে এজন্য বড় গ্লানি জাগে তার মনে। সে নিজের অন্তরে
বোঝে তার পিতা নিষ্ঠুর, ও লোলুপ মানুষ। এই চেতনা নিরন্তর
এক চাপা কষ্টের জন্ম দিয়েছে তার মধ্যে। এ কষ্ট কারুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। অথচ ‘পিতা’ –এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক
প্রাচীন সংস্কার। অন্যায়কারী জেনেও সে আপন পিতাকে সমর্থনের যুক্তি সাজায়।
বীতিহোত্র
বলছিলেন,- “কৃষ্ণ মানুষটি অত্যন্ত চতুর বুঝেছ! জরাসন্ধের অত্যাচারে মথুরা ত্যাগ করে তাঁকে
দ্বারাবতীতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তাই জরাসন্ধের মৃত্যু প্রয়োজন ছিল তাঁর পক্ষে। আর তিনি জানতেন
জরাসন্ধকে হত্যা করতে হলে পান্ডবদের শক্তির উপরই তাঁকে নির্ভর করতে হবে। তিনি তখন----তবে হ্যাঁ একটি
বৃহৎ স্বার্থ’একটু থেমে বলেন বীতিহোত্র, “তাঁর নিজস্ব ক্ষুদ্র স্বার্থের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল
জম্বুদ্বীপের বৃহৎ স্বার্থ, তার ফলে---’’
“ কিন্তু তিনি তো শঠ, খল। তিনি—তাঁরা অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছেন জরাসন্ধকে। ব্রাহ্মণের বেশে
রাজপুরীতে ঢুকে----ছিঃ ছিঃ ধিক, তাঁরা না ক্ষত্রিয়----। জরাসন্ধ পাপী সন্দেহ নাই তাতে, কিন্তু সে তো অন্য
প্রশ্ন। সত্যকারের
ধর্মপ্রাণ পুরুষ অন্যায়কারীকেও ধর্মযুদ্ধেই হত্যা করেন।”- বীতিহোত্রের কথায় মনযোগ না দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল করেণুমতী।
“ওঃ সেই বাল্যকালের স্বভাবের এখনও পরিবর্তন হোল না রেণু। সেই কথার মাঝে কথা! অপেক্ষার ধৈর্য নাই।” বীতিহোত্র হাসেন। বিষাদে মাখা এক হাসি। “ এখনও একটি বালিকাই রয়ে গেলে, কল্পলোকে যার আবাস। বাস্তবকে চিনলেনা
এখনও। ধর্মযুদ্ধ এক
অর্থহীন শব্দ। ধর্মযুদ্ধ বলে কিছু হয় না। এ পৃথিবী স্বার্থময়। সুযোগ ও ভাগ্যের সদ্ব্যবহার করতে পারে যে, সেই বিজয়ী হয়। ব্যক্তিগত আবেগকে দূরে সরিয়ে রেখে এখন শোনো যা
বলি---পান্ডবেরা কৃষ্ণের বড় প্রিয়, সমগ্র জম্বুদ্বীপ জানে এই কথা। কিন্তু কৃষ্ণ
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়াকেই আপন স্বার্থসাধনের অস্ত্ররূপে
ব্যবহার করলেন। তিনি বললেন, রাজসূয় যজ্ঞ শুরু করার আগে জরাসন্ধকে হত্যা করা একান্ত প্রয়োজন। জরাসন্ধ যতই
শক্তিশালী হোক না কেন,তাকে হত্যা করার ক্ষমতা অর্জুন ও ভীমের আছে। এই দুটি যুবকের স্বভাব তো তাঁর অজানা নয়। দুঃসাহসিক কর্মেই
এদের আনন্দ। তাদের তাই উদ্দীপিত করতে লাগলেন কৃষ্ণ। স্থির বুদ্ধি যুধিষ্ঠির ভাইয়েদের ক্ষতির আশঙ্কায় আপত্তি
জানালেন তখন। কিন্তু কৃষ্ণ জানেন যে তিনি ধর্মপ্রাণও বটে। তোমার পিতা শিশুপালের সহায়তায় জরাসন্ধ, বহু রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করে
রেখেছেন কৃষ্ণ, সে ঘটনার উল্লেখ করলেন। বলি দেওয়া হবে তাঁদের এক মহাযজ্ঞে। জরাসন্ধকে হত্যা না করলে, তাদের উদ্ধার করা সম্ভব
নয়। এমন ঘোর অন্যায়কেই যদি প্রতিহত করা না যায়, ক্ষাত্রতেজ তবে
কোন কর্মে লাগবে! কিন্তু এত জটিল এই রাজনীতি---সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে-----জানি
না কি শ্রেয়---কিন্তু সমাধানের অপর এক পথ যদি হয় হিংসা, তবে তা শেষ পর্যন্ত কোন
সার্থকতা আনে জীবনে?---হিংসা---প্রতিহিংসা-- আবার পুনরায় হিংসা---হিংসা ত্যাগ করেও
অন্যায়কে প্রতিরোধ করা কী সম্ভব? জানি না—এ প্রশ্ন ভাবায় আমাকে বারবার---’’তিনি অন্যমনস্ক হয়ে
পড়েছিলেন। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। কম্পমান প্রদীপের আলোর বিপরীতে ঘরের স্তম্ভগুলির বিকৃত
ছায়া প্রেতের মতো নাচছে দেওয়ালের গায়ে। বীতিহোত্রর
কন্ঠস্বর ছাড়া চারিদিকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ। বীতিহোত্র বলে
চলেছিলেন,-
“ এক মহা দুর্যোগের আভাস পাচ্ছি। ঘোর যুদ্ধ, অবধারিত
লোকক্ষয়। পান্ডবগণ এখন কৃষ্ণ ও পাঞ্চালদের সহযোগিতা পেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেই ক্ষমতা প্রদর্শন করতেও
চাইছে। ধার্তরাষ্ট্ররা চিরকালই ঈর্ষা করে তাদের। স্বভাবতই গাত্রদাহ হচ্ছে এখন
তাদের আরো বেশী। এই বৃহৎ যজ্ঞে ধৃতরাষ্ট্রের
ছেলেগুলিকে আমন্ত্রণ করে আনা হবে শুনি মহাসমাদরে, আর তাদের সামনে প্রদর্শিত
হবে অতুল ঐশ্বর্য। বিভিন্ন রাজ্য জয় করে যা এনেছেন পান্ডব ভাইয়েরা। যেমন করে মাংসের খন্ড,ক্ষিপ্ত কুকুরের মুখের
আগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়, মজা দেখবার জন্য-----’’- ক্ষোভে মাথা নাড়েন বারবার বীতিহোত্র। “ওঃ রেণু আমি এক স্পষ্ট চিত্রের মতো চোখের সামনে দেখতে
পাচ্ছি---তার পরিনামে আরো ঈর্ষা, আরো বিদ্বেষ, ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ। ঐ যজ্ঞের আগুন থেকে
গাঢ় অমঙ্গলের ধোঁয়া বেরিয়ে আসবে রেণু। জম্বুদ্বীপ জুড়ে
রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। পান্ডবদের এখন সংযত হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে এমন
চপলতা---। কত সময়ে যে খেলার ছলে বিষবৃক্ষের বীজ রোপন করা হয়ে যায়-”-
করেণুমতীর
খুব অস্থির লাগছিল। তীব্র কোনও আতঙ্ক যখন গ্রাস করে মানুষকে তখন সে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে সে
বৃহৎ জম্বুদ্বীপের সমস্যা নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। কুরুকুলের জ্ঞাতিভাইদের পারষ্পরিক ঈর্ষা ও
বিদ্বেষ কথা শুনেই বা তার লাভ কি! শুধু এই
চেদিরাজ্য, এই মনোরম প্রাসাদ, তার প্রিয় ভাই, তার পরম শ্রদ্ধার মানুষ এই আচার্যদেব,
অনুগত দাসদাসীগুলি, বারবার করে পড়া এই পুঁথির স্তুপ এরা সব অক্ষত থাকুক। আর তার পিতা! পিতা
শিশুপালের সঙ্গে তার মনের যোজনব্যাপী দূরত্ব। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে এই রূঢ়,
নীতিহীন মানুষটির শক্তি ও সম্পদ তাকে
আজন্মকাল এক নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিয়েছে। তার পিতা এখন অসহায়,দুর্বল। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে তিনিও আমন্ত্রিত। কিন্তু এই নিমন্ত্রণও তাঁর
অপমানজনক মনে হচ্ছে। তাই সর্বদাই উত্যক্ত হয়ে থাকছেন তিনি। নিঃশব্দে আর্ত
চীৎকার করে উঠল করেণুমতীর মন,-হে দেবাদিদেব মহাদেব আমার পিতাকে রক্ষা কর সকল বিপদ
ও অপমান থেকে! মঙ্গল হোক প্রভু। মঙ্গল হোক আমার পিতার, ভ্রাতার, আমার আচার্য দেব, এ
প্রাসাদের সকল পুরজনের। শান্তিধারা বর্ষণ কর প্রভু।
দ্বাদশ অধ্যায়
(দুর্যোধনের
উক্তি)
মানুষে
মানুষে কিসে পার্থক্য সৃষ্টি হয়? পন্ডিতেরা অতি দীর্ঘ আলোচনায় তার বায়বীয় কোনও কারণ খুঁজতে পারেন,
কিন্তু আমি দুর্যোধন। আমি জানি, এই পার্থক্য নির্ণীত হয়ে
থাকে শুধুমাত্র শক্তি ও সম্পদের তারতম্যে। এ কোনও পোকায় কাটা গ্রন্থ থেকে পাওয়া মুখস্থ বিদ্যা নয়। এ আমার বাস্তব
অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এক উলঙ্গ উপলব্ধি। সভ্যতা ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে মানুষকে মনের ভাব গোপন করতে
শেখাচ্ছে। যার অন্য নাম ভন্ডামি। মানুষ নিজের ভিতরকার, আদিম সেই গুহা মানবের রোমোশ শরীর ঢেকে দিচ্ছে
রেশম বস্ত্রে, ঈর্ষা ও রিরংসার মুখ ঢেকে দিচ্ছে সৌজন্যের দামি মুখোশে কিন্তু আসল
মানুষটার কি বদল হচ্ছে তাতে!
আমি নিজের
অন্তরস্থল পর্যন্ত দেখতে পাই নিজেকে! একেবারে স্পষ্ট। আমার লোভ আছে। ঈর্ষা আছে। অপরের সম্পদ দেখলে তা আত্মস্যাৎ করার বাসনা জাগে আমার। আমি তা কেড়ে নিতে
চাই। যা আমার নাই, তা
কেন অন্যের থাকবে! এমন মনোভাবের জন্য লজ্জা নাই আমার! কারণ আমার ক্ষমতা আছে। কারা লেখে নীতি
কথা? ঐ রোগা ব্রাহ্মণগুলো। যাদের লোভ আছে, অথচ সামর্থ নাই। তারা সমস্ত পৃথিবীকে জোলো আবেগ দিয়ে ধুয়ে মুছে
নেতিয়ে রেখে দিতে চায় বরাবর। ঐ রক্তাল্পতায় ভোগা, ফ্যাকাশে জগৎ আমার নয়। আমার নিজস্ব
পৃথিবীর চিত্র আঁকি আমি প্রতিদিন, লাল রক্তে, সোনালি আগুনে, রূপালি অস্ত্রের ঝলকে। জ্বলজ্বলে সব ছবি। বিচিত্র রঙের
মণিমাণিক্য, পেলব মুক্তা, সুবর্ণের স্তূপ,স্বর্গ সুন্দরীদের সমান সব নারী।। হিমবান পর্বতের মতো
উঁচু সৌধ। সেখান থেকে নীচের মানুষগুলিকে এত ক্ষুদ্র দেখায়, যেন তারা কীটের সমান। হাঃ হাঃ অমন চিন্তা
কি আমোদই না জাগায় প্রাণে! আমি নিমগ্ন হয়েছিলাম আমার চিন্তায়।
“ভাই তুমি তবে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা যে উপঢৌকন
আনবেন সেগুলি গ্রহণ কোরো। মূল্যবান সব বস্তু, যাকে তাকে তো আর এ ভার দেওয়া যায় না। তুমি এ দায়িত্ব নিলে যে বড় নিশ্চিন্ত হই।”- আমার চিন্তার ঘোর ভেঙে গেল। সামনে কে দাঁড়িয়ে ওটা? একটা শ্বেত অজ না! তেল চোয়ানো শরীর। মরা মরা চোখের
চাহনি। ওঃ না, এ তো সেই
পাঁচ ভাইয়ের বড়টা! যুধিষ্ঠির! সেই ভীরু, নির্বোধ মানুষটা। কোনও ক্ষমতা নাই যার। তবু কি ভাগ্য! বাকি চারটে ভাই নিজেরা কেমন
রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে অমন খড়ের পুতুলটার মাথায় মুকুট পরিয়ে রাজা সাজিয়ে তার
সামনে জোড় হস্ত হয়ে আছে।
লোকটা আবার
আমাকে ভাই বলে ডাকে কেন! ওর পিতা আর আমার পিতা পরষ্পরের বৈমাতৃক ভাই,এমন একটা
বিবর্ণ সম্পর্কের কারণে? ওরা এসেছিল একদিন কপর্দকশূন্য, মলিন বসন। আশ্রয় চেয়ে! অথচ কি
জটিল সব গণিত থাকে ভাগ্যের! আমাদের মাথায় চড়ে নৃত্য করতে লাগল অল্পকালের মধ্যেই। দুধ ও কদলী দিয়ে
কালসাপ পোষার সেই পুনরাবৃত কাহিনী। চারিদিকে ধ্বনিত হতে লাগল এই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা
লোকটার গৌরবগাথা। কি গুণ ছিল লোকটার? এখনই বা কোন গুণ অধিকার করেছে
সে? বিনয় বা ক্ষমা কি কোনো গুণ না অক্ষমতা? অপটু ও অদক্ষ মানুষের উপর আরোপিত হয়
ওসব শংসা। একতাল গোধূমের মন্ড কি দুর্বিনীত হবার ক্ষমতা রাখে? বলদ কী ঈর্ষা করে কাউকে?
আর ভীম! ঐ দানবের সমান লোকটা, বাল্যকাল থেকেই রাক্ষসের মতো শক্তি ওর শরীরে। খেলার ছলে পিষে দিত
আমাদের বারবার। জলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে চেপে ধরে রাখত। মনে পড়ে এখনও রাজ উদ্যানের উঁচু রসাল বৃক্ষে উঠেছিলাম আমি ও
দুঃশাসন, হঠাৎ কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয়েছিল ও। উপর থেকে আমরা হাসতে হাসতে বলেছিলাম ভীম এ গাছে ওঠার চেষ্টা করিস না যেন। গাছের ডাল কি কখনও
হাতির ভার নিতে পারে! – এখনও মনে পড়ে রাগে লাল হয়ে গেল ওর মুখ। নিজের শরীর নিয়ে কোনও কৌতুক সহ্য করতে পারত না ও!
দাঁতে দাঁত ঘষে বলল,- না হাতির ভার এ গাছ নিতে পারবে না বটে, কিন্তু কেবল হাতিই
পারে গাছকে উপড়ে ফেলতে। তারপর গাছের গোড়ার অংশটা ধরে প্রাণপণ শক্তিতে ঝাঁকাতে লাগল ক্রমাগত। ক্ষ্যাপা একটা
মোষের মত দেখাচ্ছিল ওকে। ভীষণ আতঙ্কে তখন আর্তনাদ করছি আমরা। গাছের ফলগুলো ছিটকে ছিটকে পড়ছে চারিদিকে। আরও একটা প্রচন্ড
ঝাঁকুনিতে আলগা হয়ে গেল আমার গাছের ডাল ধরে থাকা হাতের মুঠি। ঐ খসে যাওয়া ফলগুলোরই মতো শূন্য পথে বেগে নেমে
আসছিল আমার শরীর। শক্ত মাটিতে ঠুকে মাথার পিছনে ভয়ানক আঘাত লাগল। এক মুহূর্তের জন্য কানে এল খলখলে হাসিটা। না শুনলে কেউ
বিশ্বাস করবে না যে একটা কিশোর এমন বীভৎসভাবে হাসতে পারে। তারপরেই অন্ধকার নেমে এল চোখে। প্রচন্ড আঘাত
লেগেছিল মাথার পিছনে। এক চান্দ্রমাসেরও বেশী সময় ধরে ছিল সে যন্ত্রণা। আমি পিতামহ ভীষ্মের কাছে পরে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম সমস্ত
ঘটনা। তিনি কিন্তু
গুরুত্ব দেননি। বলেছিলেন,-তুমি না ক্ষত্রিয় পুরুষ। নারীর মতো অভিযোগ জানাতে এসেছ? খেলার সময় কত আঘাত লাগে,তা
নিয়ে ভাবতে নাই।
এই মানুষটি
চিরকাল সমদর্শীতার অভিনয় করে চলেছেন। অথচ ভিতরে ভিতরে পান্ডবদের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ পক্ষপাত
দেখেছি! কেন? তারা পিতৃহীন বলেই কি? অথচ হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদের কেউ তাদের চোখে
দেখেনি কখনও আগে। তাদের কথা আলোচনা হতেও শোনা যায়নি। হঠাৎ একদিন এসে উপস্থিত হোল অচেনা একদল ছেলে আর তাদের বিধবা
মা। যেন শূন্য থেকে উদয়
হোল। আর এই প্রাসাদের সমস্ত কিছুর উপর অধিকার বিস্তার করে নিতে
লাগল কি মসৃণভাবে। ভীমের জন্য বিশেষত আমরা ক্রমশ বিপন্ন বোধ করতে লাগলাম। আমি পিতামহের কাছে এর কোনও প্রতিকার পেলাম না---। আর ওদের প্রতিরোধ
করার জন্য আমার গোপন চেষ্টা! বারবার সেই চেষ্টায় বাধা দিয়ে ভাগ্য নামের এক অদেখা
শক্তি এসে দাঁড়াতে লাগল ওদের পিছনে। যার ব্যাখ্যা নাই। কিন্তু ভাগ্যের অনেক উপরে নিশ্চয় আছে অন্য এক শক্তি, যার
নাম পুরুষকার। প্রবল প্রয়াস বৃথা যায় না! অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠেছিল আমার হাতের মুঠো। মুখে কথা উচ্চারণ
করতে সময় নিল। তারমধ্যেই ও আবার বলে উঠল,-
“ভাই তুমি সুস্থ আছ তো? আমি
বলছিলাম----”- ওঃ লোকটার মুখের ভাবে কি উদ্বেগ! নাঃ এই মহাসভা, চারপাশে ঐশ্বর্যের চীৎকার,
অতিথিরা আসতে শুরু করবেন, এবারে আমাকে পরে নিতে হবে সৌজন্যের মুখোশটা। সকলেই জানে
দুর্যোধন দুর্বিনীত। তবু সমাজকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। আমি হাসলাম। বললাম, নাঃ সুস্থই আছি ভ্রাতা। কত কর্ম বাকি রয়েছে
বল! পরিকল্পনা মতো সুষ্ঠুভাবে করতে হবে তো সব কিছু,তাই সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে
গিয়েছিলাম মাত্র। - কে জানে সে বুঝল কিনা আমার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ।
ক্রমশ
0 মন্তব্যসমূহ