সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মহুয়া চৌধুরী/পুরাণ সংখ্যা-জুন'২০২২/ উপন্যাস পর্ব -১




                            অলেখা অধ্যায়

          পর্ব -১


আরম্ভকথা 


যে মহাকাব্য রচিত হয়, আমরা পাঠককুল দেখি যার শব্দরাজি, সুবিন্যস্ত পংক্তিগুলি, তারও অন্তরালে থাকে আরও কত নিভৃত কল্পনা। প্রকাশ পায় না যা। অবন্ধনা, বর্ণময় কত ক্ষণিক উদ্ভব। শেষে কবির নির্মম  বিচারের প্রত্যাখ্যানে মিলিয়ে যায় অনন্ত মহাশূন্যে। 

নির্মমতা সৃষ্টির আদি শর্ত এবং  অতিকথন কাব্যকে স্থবিরতা দেয়।  শুনেছি সে কথা । তবু যে না-জানার অতৃপ্তি জাগে মনে!

 ভাবি তোমার প্রগলভ কত কল্পনা বিস্তার, কত না শব্দভ্রূণ থেকে গিয়েছে অজাত। অক্ষর-শরীর পায়নি তারা। তোমার হারিয়ে যাওয়া অলিখিত কল্পনার ছবিগুলিকে অনুসন্ধানের এক স্পর্ধিত বাসনা আচ্ছন্ন করেছে তাই। সেই খোঁজে অধীর হৃদয় আজ। হে কবিশ্রেষ্ঠ, কুরুকুলের রূপকার, মহা ঋষি ব্যাসদেব, প্রণমি তোমায়। অনিশ্চিত এই যাত্রাপথে  তোমার আশীর্বাদই শুধু প্রার্থিত। 

               

 প্রথম অধ্যায়

আসন্ন শীতের বেলা এখন আকাশ উজ্জ্বল নীল করেণুমতীর শয়ন ঘরের পূর্ব দিকে যে উন্মুক্ত বাতায়ন,  তাকে ছুঁয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষটি অজস্র সবুজ পাতায় ভরাতীব্র হাওয়া উঠছে মাঝে মাঝেআর নড়ছে তার পাতাগুলি একইসঙ্গে বিচিত্র শব্দ তুলছে যেন অনেকগুলি শিশুর ঝুম্‌ঝুমি বাজছে সমবেত সুরে করেণুমতী অবশ্য এসব কিছু দেখছিল না শুনছিল না সে এখন অন্য এক বিস্ময় ভাবনায় আচ্ছন্নআজ বড় আশ্চর্য এক তথ্য জেনেছে সে এমন যে কখনও সম্ভব হতে পারে এ ছিল তার কল্পনার অতীত 

আচার্য বীতিহোত্রের মুখে সে আজ প্রথম শুনলো, এই বিস্তীর্ণ পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন দিন, অন্য প্রান্তে নাকি তখন রাত শোনার পরে কয়েক মুহূর্ত হতবাক্‌হয়ে ছিল সে তারপর স্খলিত স্বরে কোনোমতে বলেছিল,-“কিন্তু আচার্যদেব,  তা জানা গেল কেমন করে? ধরুন, কোনো ব্যক্তি তো একই সঙ্গে পৃথিবীর দুই প্রান্তে বাস করতে পারে না কিম্বা দুটি মানুষের একজন যদি জম্বু দ্বীপে বাস করে, অন্যজন সেই মুহূর্তেই যবনদেশে, তবে তারা পরষ্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিভাবে? যে জানতে পারবে একজনের বাসভূমিতে রাত, অন্যত্র দিন?  

আচার্য বীতিহোত্র স্নিগ্ধ হাসি হাসছিলেন এই কন্যাটিকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন সে মেধাবী ও সরলা তার অন্তরটি সর্বদাই বহু প্রশ্নে  উন্মুখ হয়ে থাকে তিনিও ধৈর্যভরে তার আগ্রহী জ্ঞান তৃষাকে তৃপ্ত করে থাকেন কারণ তিনি জানেন জিজ্ঞাসাই প্রাণের শর্ত এখন বললেন,-“বহুকাল ধরে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা গবেষণা করেছেন এ সম্বন্ধে জটিল কত গণিতসূত্র আবিষ্কৃত হয়েছেতারই সাহায্যে নির্ণয় করা যায় দেশ কালের রহস্য

“সে গণিত আমি এখনই শিখতে চাই আচার্যদেব”- বিস্ফারিত দৃষ্টিতে এমন আকুল হয়ে বলে সে, যেন বিলম্ব করলে ঐ গণিতবিদ্যা মায়াহরিণের মতো ছুটে পালিয়ে যাবে তার দৃষ্টিসীমার বাইরেউত্তেজনায় তার নিঃশ্বাস প্রবল হয়ে উঠেছে বিন্দুমাত্র বিলম্ব সইছে না আর!

বীতিহোত্র এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন বললেন,-“বল তো করেণু, একটি লম্ফে তুমি কি ওই উদ্যানভূমি হতে প্রাসাদের ত্রিতলে পৌঁছে যেতে পার?”

তখন ঈষৎ লজ্জিত হয়ে হেসে ফেলল করেণুমতী সে আচার্যের বাক্যের অন্তর্লীন অর্থ বুঝেছে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো সে “না আচার্যদেব, পারি না তা তাই তো আমি এই মুহূর্ত থেকেই সোপানশ্রেণি আরোহনে আগ্রহী যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যেতে চাই শীর্ষদেশে” করেণু জানে আচার্যদেব শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কঠিন স্বভাবের হলেও তার প্রতি  প্রশ্রয়শীল

“জ্ঞানের শীর্ষদেশ বলে কিছু হয় না করেণু অন্তহীন এ আরোহন”- বীতিহোত্রের চোখে সত্য উচ্চারণের বিষাদ ঘনায়মান হয়ে উঠল কারণ এতো কথার কথা নয় এ তাঁর একান্ত উপলব্ধি

করেণু জানে এ তথ্য তবু সহসা বড় বিষন্ন লাগে তার মনে হয়, সে বুঝি দাঁড়িয়ে আছে এক অকূল প্রান্তরে তার সামনে সুদূর বিস্তৃত দিক্‌চক্রবাল যে দিগন্তরেখাকে সে কখনও ছুঁতে পারবে না সে কিশোরী কন্যা তবু এই মুহূর্তে সে অনুভব করে যে কোনো প্রাজ্ঞব্যক্তির গহীন অতৃপ্তিকে

ঠিক এমনই সময়ে তার দুয়ার প্রান্ত থেকে ভেসে এল সম্মিলিত উত্তেজিত কণ্ঠের কলরোল 

“সখি, ও প্রিয় সখি, শুনেছ খবর? সে কি কান্ডজন্মে কেউ শোনেনি যাতাই হল কিনা শেষে-” করেনু নিভৃত ভাবনার স্তর থেকে চমকিত হয়ে উঠে এল দুয়ার পথে ঘরে ঢুকছে তার সখীরালোলা, সুগন্ধা, বিশাখাসকলে দল বেঁধে তাদের মুখে বিস্ময় ও উত্তেজনা দ্রুত হয়ে উঠেছে শ্বাস প্রশ্বাস“কি হয়েছে?”- সে প্রশ্ন করে শ্বেত মর্মরের মেঝেতে বসে পড়ে সকলে হেসে লুটোপুটি খায়আর তাদের অসংলগ্ন বাক্যের কয়েকটি শব্দ শোনা যায়, কিছু আবার ভেসে যায় বাঁধনহীন হাসির তরঙ্গে হাসি সংক্রামক কারণটি না জেনেও করেণুমতীর মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি কিন্তু সে বিরক্তির ভান করে ভ্রু কুঞ্চন করে “উহ্‌আগে হাসি শেষ করে নে তো তোরাতারপর বলিস যা বলতে চাস

লোলা তখন সহসা বলে ওঠে,-“সেই পাঞ্চাল রাজকন্যের যে একই সঙ্গে পাঁচ পাঁচটা পতি হল গো!মাগো কেউ কোনোকালে শুনেছে অমনটি--” “সে কি কথা?” বিস্মিত হয়ে বলে করেনুমতী গত এক চন্দ্রমাস যাবত জম্বুদ্বীপের বাতাসে ভাসছে পাঞ্চাল রাজকন্যার আসন্ন স্বয়ম্বর সভার জল্পনাঅপরূপা সেই কৃষ্ণাঙ্গী কন্যার জন্মকাহিনী অতি বিচিত্র যজ্ঞের অগ্নি থেকে নাকি পূর্ণযৌবনারূপেই আবির্ভূতা সে বাল্যকালে ধাত্রীদের মুখে সেই গল্প মুগ্ধ বিস্ময়ে বারবার শুনত করেনুমতী পরে জেনেছে এ কাহিনীর আড়ালে থাকা সত্যটি! প্রকৃত প্রস্তাবে পাঞ্চাল রাজকন্যার জন্মবৃত্তান্ত এক উন্মুক্ত রহস্য রাজা দ্রুপদের ঔরসে এক সুন্দরী শবরীর গর্ভে নাকি তার জন্ম জম্বুদ্বীপ জুড়ে যা সকলেই নিভৃতে আলোচনা করে, কিন্তু প্রকাশ্যে যা  অকথিত থাকে পাঞ্চালরাজ তার বিবাহ দিতে উদ্‌গ্রীব, এমনটি শোনা যাচ্ছিল কিছুকাল ধরে কিন্তু এই অলোকসামান্যাকে তো কোনো সাধারণ ব্যক্তির পত্নীরূপে কল্পনাও করা যায় না তাই শোনা যায় পাঞ্চালরাজ  আরোপ করেছেন তাকে লাভ করার এক অতি কঠিন শর্ত! উপরে ঝুলন্ত এক ঘূর্ণমান ধাতব মৎস্য মাটিতে রাখা জলপাত্রে প্রতিবিম্বিত তার ছায়া দেখে বিদ্ধ করতে হবে মৎস্যচক্ষুটি এমন শর্ত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি করেণুর সে ভেবেছে নিশ্চয় কিছু অতিশয়োক্তি আছে এর মধ্যে কারণ এ কর্ম তো মানুষের অসাধ্য

তা সে যাই হোক, জম্বুদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রিত হয়েছেন রাজন্যবর্গ করেণুমতীর পিতা চেদিরাজ শিশুপাল আমন্ত্রণ পাওয়া মাত্র এই প্রবীণ বয়সেও বিপুল উৎসাহে গিয়েছিলেন সে সভায় গত পরশ্ব ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন বৃদ্ধ নৈরাশ্যের চাপা ক্রোধে সর্বদাই এখন ভ্রুকুটিকুটিল তাঁর মুখ প্রভুর ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি দেখে তাঁর সহচর যারা গিয়েছিলেন, তাঁরাও স্বয়ম্বর সভা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি কেউ কেউ হয়তো সকল তথ্য জেনেছে, কিন্তু পাঞ্চালীর বরমাল্য কে লাভ করেছেন এ সম্পর্কে সাধারণ নগরবাসী নিভৃতে কৌতুহলী আলোচনা শুরু করেছে! আর সহসা একি অদ্ভুত সংবাদ এসে উপস্থিত হল!

শুনে করেনুমতী দু একটি মুহূর্তর জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল তারপরই নিশ্চয়তার সুরে বলে উঠল,-“কত যে গুজব হাওয়ায় ভাসে আর এদেশ থেকে ওদেশে ছড়িয়ে পড়ে যত মিথ্যে কাহিনী তোরা কি না কি শুনে অমনি-”

“দেবাদিদেবের শপথ, মিথ্যে নয় গো সখিচক্ষু বিস্ফারিত করে সুগন্ধা বলেমাথা নেড়ে সায় দেয় অন্যেরাও “এইমাত্র এক চিত্রপসারিণী এসেছিল যে লোলার গেহে, তার পতি, পাঞ্চালকন্যার স্বয়ম্বর সভার নির্মাণে ইঁট, কাঠ যোগান দিয়েছিল তার মুখেই তো সব খবর শোনা গেল সে বললে সভায় বহু অনাহূত মানুষজনও ছিল বুঝি  রাজা, রাজপুত্রের দল হার মেনে গেল শেষে সবাই দেখল এক ব্রাহ্মণকুমার অসাধ্যসাধন করল নাকি! রাজকন্যা মালা দিলে ঐ গরীব ব্রাহ্মণকুমারের গলাতেই

“তবে? একজনই যদি লক্ষ্যভেদ করল, পাঁচজনে তার পতি হয় কি করে?”- সবিস্ময়ে করেণু প্রশ্ন করে

“এবারেই তো আসল গল্পের শুরু গো”- উত্তেজিত মুখে লোলা বলল,-“সে নাকি আসলে ব্রাহ্মণই নয় ছদ্মবেশে ছিল আসলে সে কুরুকুলের পান্ডুরাজার পাঁচ ছেলের মধ্যে একজন

“কি যে বলিস! তাঁরা তো কবেই নিহত হয়েছেন আহা কি ভয়ঙ্কর সে মৃত্যু সকলেই জানে বারণাবতে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন তাঁরা

“না গো না, তবে আর কি বলছি? আসল কথা তো সদ্য প্রকাশ পেয়েছে বেঁচেবর্তেই ছিল তারা এতকাল ঐ জ্ঞাতিশত্রুদের ভয়ে লুকিয়ে ঘোরাঘুরি করত দেশবিদেশে শেষকালে খবর পেয়ে এসে হাজির হয়েছিল স্বয়ম্বর সভায় ওদের মধ্যে একটা ভাই তীর চালানোয় ভারী পটু যে---”

করেণুর মনে পড়ছিল নিজের শৈশবে সে পান্ডব রাজপুত্রদের সম্বন্ধে অনেক কথা শুনতো তাঁদের বীরত্ব, অস্ত্রনৈপুন্যের কাহিনী কুরুকুলের জ্ঞাতিবিরোধের খবরও পান্ডবদের ও তাদের মাতা কুন্তীর মৃত্যু বুঝি সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না সকলেই জেনেছিল ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধনের ষড়যন্ত্র ছিল এ মৃত্যুর পশ্চাতে সিংহাসন লাভের জন্য সকল রাজকুলেই রক্তাক্ত ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের ইতিহাস আছে তারপরে অনেক দিন চলে গেছে এই নৃশংস হত্যার স্মৃতিও স্তিমিত হয়ে গেছে মানুষের মনে আজকাল আর কেউ এ নিয়ে তেমন আলোচনা করে না

সখীর দল কল্‌কল্‌করে নানান কথা বলেই চলেছিল চিত্রপসারিণীর মুখে যে এইমাত্র সমস্ত শুনে এল তারাপান্ডবেরা বুঝি পাঞ্চাল রাজ্যের সীমান্তে অরণ্য সংলগ্ন এক পল্লীতে বাস করছে আপাততসেখানেই নিয়ে এসেছিল তারা রাজকন্যাকে কিন্তু যে ভাই মাছের চোখে তীর বিঁধেছিল, সে ছাড়াও বাকি ভাইদের সঙ্গেও তার বিয়ে দেওয়া হল

করেণুমতী বহু পুরাণ ইতিহাস জানে প্রাচীন যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এমন ঘটনা কিছু কিছু ঘটেছিল বিভিন্ন পুঁথিতে উল্লেখ আছে তার অথবা এখনও কিছু অনুন্নত সমাজে, যেখানে নারীর সংখ্যা অল্প, সেখানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে কিন্তু এই সুসভ্য আর্য সমাজের অভিজাত কুলে একথা অকল্পনীয়! আজকাল প্রায় প্রতিটি পুরুষেরই বহু পত্নী যে যত সংখ্যক পত্নীর ভরণপোষণ করতে সমর্থ সে ততই বিবাহ করে! পুরুষ স্বভাবতই বহুগামী! তাছাড়া একাধিক পত্নী তার পৌরুষ ও সম্পদের বিজ্ঞাপনও বটে এই রাজগৃহেই তো রয়েছে এমন ঘটনার স্পষ্ট নিদর্শন করেণুমতীর জননীর মৃত্যু হয় তার জন্মের পরেই কিন্তু তার বহু বিমাতারা রয়েছেন অবশ্য করেণুমতীর একান্ত বিশ্বাস নারী অথবা পুরুষ কারুরই একাধিক বিবাহ কিম্বা যৌনসম্পর্ক বাঞ্ছনীয় নয় আশৈশব নিজের বিমাতাদের যাপিত জীবনের ভয়ঙ্কর সব জটিলতা ও গোপন ব্যাভিচার দেখে তার এমন বিশ্বাস জন্মেছে তার খুব আশ্চর্য লাগছিল এ যুগে এই সমাজেও এমন কি করে সম্ভব? আর এ বিবাহের কারণই বা কি!

তার এই সব ভাবনা চিন্তার মাঝে সখীর দল নিজস্ব নানা অভিমত দিচ্ছিল বিশাখা মেয়েটি সাংসারিক ব্যাপারে অভিজ্ঞ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতীও  অমাত্য দীপমাল্য তার পিতা বহু শাখা প্রশাখাময় নিজেদের বিশাল পরিবারে অনেক ঘটনা দেখেছে সে বলল,-“দেখ প্রিয় সখী, আমার মনে হয়,ওদের মাতার কোনো আশঙ্কা কাজ করছে এই বিবাহের মধ্যে

“পান্ডুপত্নী দেবী কুন্তীর কথা বলছিস?”

“হ্যাঁ গো

“কিন্তু কিসের আশঙ্কা তাঁর? আর আশঙ্কার সঙ্গে এমন বিবাহেরই বা কি সম্পর্ক?”

“ভেবে দেখ পতিহারা ওই নারী পুত্রগণই সম্বল

“হ্যাঁ তেমন পরিস্থিতি তো বহু পরিবারেই আছেকিন্তু সেজন্য কি শুনেছিস কোথাও যে একই কন্যার সঙ্গে     

 করেণুমতীর কথা মধ্যপথে থামিয়ে বিশাখা বলে ওঠে,-“ঐ পাঞ্চাল রাজকন্যা যে অপরূপ সুন্দরী, তা তো জান?”

“হ্যাঁ একটি আলেখ্য দেখেছিলাম তার জীবন্ত মানুষের লাবণ্য আর চিত্রে পুরোপুরি ফুটবে কি করে---তবু  মনে হয়েছিল এমন রূপবতী বুঝি আর দেখিনি আগেকতক্ষণ চোখই ফেরাতে পারিনি ভেবেছিলেম চিত্রেই যদি এমন তবে না জানি--”- মুগ্ধ আবেশে করেণু বলে ওঠে

“পুরুষ যে স্বভাবতই কামার্ত এ কথা মান তো?”- বিশাখার মুখে এবার গূঢ় হাসি ফুটে ওঠেঅন্য সখীগুলিও মুখ টিপে হাসছে করেণুমতী সামান্য লজ্জা পায় আদিরস সংক্রান্ত কথাবার্তার ধারা বর্ষণে সখীরা তার খুব পটু একবার শুরু করলে আর থামতে চায় না  লোলা একটি চক্ষু কুঞ্চন করে বলে ওঠে,-“তবে? গৃহশান্তি বজায় না রাখলে চলে? ঠিকই বলেছে বিশাখা ঐ সুন্দরীকে নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই বেঁধে গেলে কুন্তীর সংসার যে ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যেত!”

“অগত্যা! বুদ্ধি করে যুদ্ধের গোড়া মুড়িয়ে দিলে সে সকলেই পেলে অমন সুন্দরী রাজকন্যেকে! কারুর আর মনস্তাপের কারণ রইল না

এমন বিকট সম্ভাবনার কথা মস্তিষ্কে আসেনি করেণুর সে কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধির মতো চেয়ে থাকে তারপর তার মুখে ঘনিয়ে আসে বিষাদ ওই অদেখা রাজকুমারীর জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে তার এখন কি অসহায় অবস্থা ও মেয়েটির! করেণুর মনে হয় বিশাখা সম্ভবত এমন বিকট বিবাহ কারণের সঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছে নিশ্চয় কৃষ্ণার কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই এ বিবাহ ঘটেছে চরম আকস্মিকতায়! সে হঠাৎ দৃপ্ত স্বরে বলে ওঠে,-“কি অন্যায়, আমি নিশ্চিত পাঞ্চাল রাজকন্যার অসম্মতিতেই এমন হয়েছে তার জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিল অন্যেরা কেন সে কি একটি মাটির পুতুল!” তার বিষাদক্লিষ্ট মুখে জ্বলে ওঠে দুই চোখ মেঘমেদুর আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকানোর মতো

করেণুর এই ভাবান্তরে থেমে যায় তার সখীদের প্রগলভতা সে শুয়ে পড়ে শয্যার উপরে বাতায়নপথে আসা আলো ও বান্ধবীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য পাশে ফেরে সে আসলে তার দু চোখ এখন  ভরে উঠেছে লবণাক্ত জলেসে কারুর সামনে প্রকাশ করতে চায় না তা

সখীর দল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত তারা জানে কখনও কখনও কোনো ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে এই রাজনন্দিনীর এমন হয় তখন পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে যায় তার চোখের সামনে থেকে ম্লান হয়ে যায় তার সত্বা স্তব্ধ হয়ে যায় তার সমস্ত উচ্ছ্বাস সখীরা এও জানে সে সময়ে তাকে উত্যক্ত করতে নেই তখন তারা অপেক্ষা করে, কতক্ষণে আবার এই নিশ্ছিদ্র বিষাদ প্রাচীরটি ভেঙে পড়বে! আবার বেরিয়ে আসবে হাস্যমুখী কিশোরীটি নীরবে, দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে ঘর ছেড়ে যায় তারা

 

দ্বিতীয় অধ্যায়


গভীর রাত্রে চেদিরাজ্যের রাজধানী শুক্তিমতীর প্রাসাদ এখন প্রায় নির্বাপিতদীপ পুরবাসীরা নিদ্রার অতলে শুধু রুদ্ধদ্বার মন্ত্রণাকক্ষটি আলোকিত ভিতরে রয়েছেন তিনজন পুরুষ  একজন বিশালদেহী তিনি স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ অধৈর্য অন্য দুজনের মুখে উদ্বেগ ক্রুদ্ধ পুরুষটি চেদিরাজ শিশুপাল অন্য দুজন তাঁর সচিব দেবরূপ ও ভূধর মণিকুট্টিমে প্রবল বেগে মুষ্ট্যাঘাত করে শিশুপাল বলে উঠলেন,-“আমার সঙ্গে এই আলোচনার জন্য  এমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলে তোমরা! আমি বলছি এ অসম্ভব অসম্ভব রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে তোমাদের দেব জরাসন্ধ বিশাল ভূখন্ডের অধিপতি তাঁর পরাক্রমের কথা কার বা অজানা? কত নৃপতির ঔদ্ধত্য দমন করেছেন আজ কারারুদ্ধ তারা এত বড় স্পর্ধা কার যে স্বপ্নেও তাঁকে হত্যা করার কথা চিন্তা করবে?”

দেবরূপ মৃদু অথচ স্পষ্ট স্বরে এবার বললেন,-“বিশ্বস্ত চরচক্রই এ সংবাদ দিয়েছে রাজন!জম্বুদ্বীপের প্রান্তে প্রান্তে ভীষণ এক গুপ্ত ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে দেব জরাসন্ধের প্রতিষড়যন্ত্র চলছে তাঁর বিরুদ্ধে

শিশুপাল এ জগতে প্রভু বলে একমাত্র যাঁকে স্বীকার করেন তিনি মগধরাজ জরাসন্ধ এই অত্যাচারী, বলদর্পী মানুষটির চির অনুগামী তিনি শিশুপাল স্বভাবে এতই অহঙ্কারী, যে কেউ তাঁর অথবা তাঁর প্রভু জরাসন্ধের বিরুদ্ধাচারণের স্পর্ধা পোষণ করছে এ কথা মানতে পারেন না তিনি তিনি স্বভাবত নির্বোধ নন কিন্তু প্রবল অহঙ্কার মানুষের যুক্তিবোধকে বিনষ্ট করে দেয় তা ব্যতীত এই মুহূর্তে তাঁর মন অতিশয় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে বহু আশা নিয়ে সম্প্রতি পাঞ্চাল রাজকন্যার স্বয়ম্বর সভায় গিয়েছিলেন তিনি কিন্তু চরম অপদস্থ হতে হয়েছিল সেখানে লক্ষ্যভেদ তো অতি দূরকথা, বিশাল ধনুটিতে শর যোজনা করতে গিয়ে ভূতলে পতন হয়েছিল তাঁর জানুতে গুরুতর আঘাত লেগেছে বেদনার উপশম হয়নি এখনো সেই গ্লানিময় স্মৃতি যখন তখন প্রকাশ পায় তাঁর ভয়ঙ্কর ক্রোধের বিস্ফোরণে মাত্র গত কালই সামান্য অপরাধে এক বণিক পুত্রের প্রাণদন্ডাদেশ দিয়েছেন তিনি  

দেবরূপ ও ভূধর জানেন এ কথা তবু প্রভুর মঙ্গলার্থেই সাধ্যমতো তাঁকে ইষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করেন ভূধর বলেন,-“অনুমতি দিন আর্য, যে বক্তব্য অমঙ্গল আশঙ্কায় মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে, প্রকাশ করি তাএর পরে আপনার অভিরুচি মতো সিদ্ধান্ত নেবেন

অপ্রসন্ন মুখে মস্তকটি সামান্য হেলালেন শিশুপাল “শুনুন প্রভু, দেব জরাসন্ধের কার্যধারায় এ জম্বুদ্বীপ জুড়ে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে---আর্থিক ও শারীরিকভাবে---অসংখ্য পরিবারে হাহাকার উঠেছে--”

“যে মূর্খেরা তাঁকে প্রতিহত করার নির্বোধ চেষ্টা চালিয়েছিল তারাই অধৈর্য ভাবে বলে ওঠেন শিশুপাল রাজা জরাসন্ধের বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না তিনি

মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন দেবরূপ ও ভূধর তবু সসম্ভ্রমে দেবরূপ বলেন,-“পরিস্থিতি এবং কারণ যাই হোক, ফলাফলটিকে অস্বীকার করা যায় না প্রভু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জম্বুদ্বীপের এক বিস্তীর্ণ জনসমাজ আর সাধারণ মানুষ স্বভাবে প্রতিহিংসাপ্রবণ এও তো সত্য---তারা সুযোগের অপেক্ষায় আছেই যাতে--”

“তাই বলতে চাও তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে কেউ? তেমন দুঃসাহসী হয়ে ওঠে যদি কোনো ব্যক্তি, তবে বুঝতে হবে তারই বিনাশকাল আসন্ন সামান্য শৃগাল যেমন মহাগজের একটি অন্যমনস্ক পদপাতমাত্রে পিষ্ট হয়, তেমনি---”

“কিন্তু অজস্র মধুমক্ষিকা একত্রিতভাবে দংশন করলে সেই মহাগজেরও প্রাণসংশয়”- দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করেছিলেন ভূধর

“স্তব্ধ হও মূর্খ অমন উপমা দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতিকে অকারণ জটিল করে তুলতে চেও না- ”-ভূধরের বাক্যের মাঝখানেই গর্জণ করে ওঠেন শিশুপাল চেদিরাজের গৌরবর্ণ মুখ রক্তাভ হয়ে উঠেছে অসংযত ক্রোধে বারবার তিনি শালীনতার সীমা অতিক্রম করেন তবু ভূধর আরো কিছু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, দেবরূপ ইঙ্গিতে তাঁকে নিবৃত্ত হতে বললেন তিনি জানেন দাম্ভিক ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির সামনে যুক্তির কোনো মূল্য নেই তাঁরা দুজনে নিভৃতে পরামর্শ করেছিলেন এ নিয়ে দূরদর্শী পুরুষ তাঁরা জানেন জরাসন্ধের শত্রুগণ, স্বভাবতই চেদিরাজেরও শত্রু জরাসন্ধ আক্রান্ত হলে, চেদিরাজ্যও নিরাপদ থাকবে না কিন্তু কেউ যদি বস্ত্রখন্ডে চক্ষু আচ্ছাদন করে প্রোজ্জ্বল সূর্যকে অস্বীকার করতে চায় তবে কে তাকে আলো দেখাতে পারে!

দুজনেই বংশানুক্রমে চেদিরাজ্যের মন্ত্রীপদ লাভ করেছেন এই ভূখন্ডের ও রাজপরিবারের মঙ্গল অমঙ্গলের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতির সম্ভবনাও জড়িত উদ্বিগ্ন চিত্তে তাঁরা মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করার উপক্রম করেন তখন উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন শিশুপাল অনুগত মন্ত্রীদের প্রতি রূঢ়তার জন্য হয়তো বা সামান্য অনুতাপ হয় অপেক্ষাকৃত নরম সুরে বলেন,-“অধিক চিন্তা কর তোমরা তাই দুর্বল হয়েছে মন আমাকেও সেইসঙ্গে দুর্বল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা কোর না দেশের রাজা দুর্বলচিত্ত হলে সে দেশের দুর্দশা ঘনিয়ে আসে আর--আর”পরমুহূর্তেই আবার ভ্রূকুটি-কুটিল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ “ওই যাদবদের সর্দারটানিকষ কালোচরম ধূর্ত ঐ ভীরু---প্রভুর ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জম্বুদ্বীপের এ কোণ থেকে ও কোণে-ওর মাথাটা যতক্ষণ না ছিন্ন করতে পারি ততক্ষণ শান্তি নাই আমার প্রভু জরাসন্ধের প্রতি ওর মুন্ডখানা হবে আমার ভক্তির নিবেদন প্রভুর জামাতা মথুরাধিপতিকে হত্যা করেছে ও চতুরালি করে তার প্রতিশোধ নেব আমি” ক্রুরতর হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক নিষ্ঠুর-দর্শন মুখ  

 

তৃতীয় অধ্যায়


সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়া একটি হিমবাহ দেখলে যেমন জানা যায় না যে জলের নীচে রয়ে গেছে তার অনেকখানি অংশ, প্রতিটি মানুষও আসলে তেমনি ওই হিমবাহের মতো করেণুমতীকে দেখলে প্রথমেই মনে হয়, সরলা এক কিশোরী হাস্যমুখী কিন্তু তার মনের মধ্যে কত যে গূঢ় ভাবনার প্রবাহ বয়ে চলে, তা আচার্য বীতিহোত্রই শুধু জানেন করেণু তার পারিপার্শ্বিককে অবিরত প্রশ্ন করে অজস্র প্রশ্নের উত্তর এখনও পায়নি সে জানে না, কখনও পাবে কিনা! সে লক্ষ্য করেছে এ পৃথিবীর ঘটনাপরম্পরায় কোনো যুক্তির বিন্যাস নেই এ যুক্তিহীনতা দেখে সে কখনও কষ্ট পায়, কখনও আবার ক্রোধ হয় তারসে দেবাদিদেব মহেশ্বরের স্তবগাথা শোনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বরুণের উপাখ্যান বৃদ্ধ ব্যক্তিরা বলে থাকেন, দেবতাদের আরাধনায় তুষ্ট করতে পারলে মানুষ সকল কাম্য বস্তু লাভ করতে পারে করেণু দেখেছে বক্তাদের মুখে সে সময়ে গাঢ় বিশ্বাসের চিহ্ন ফুটে ওঠে বহু প্রাচীন কাল থেকে যজ্ঞের উপযোগিতার কথা শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে সেই সব মুহূর্তে করেণুমতীরও এমন সরল এক সমাধানের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে কিন্তু বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে নগরীর প্রান্তে প্রায়ই তার চোখে পড়ে শীর্ণ চেহারার দরিদ্রমানুষগুলিকে নগরীর পথে পথে ঘোরে এক উন্মাদিনী যুবতী  বহুবার করেণু দেখেছে তাকে ধূলিমলিন দেহ চুলে জট পড়েছে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে লোকে বলে তার পতি, উত্তরাপথ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল শোকে সে আজ উন্মাদিনী তার এই ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে বারবার দেখেছে বহু সজ্জন ব্যক্তি যন্ত্রণা ভোগ করেন, মন্দ মানুষ সুখে ও বিলাসে দিন কাটায় তখনই তার মনে সংশয় জেগে ওঠে অদ্ভুত এক হতাশা আচ্ছন্ন করে দেয় তাকে

অবশ্য প্রতি মুহূর্তেই যে সে এমন সব কথা ভাবে তা নয় এই যেমন এখন, সে সম্পূর্ণ অন্য রকমের একটি কারণে খুবই উত্তেজিত হয়ে রয়েছে       

এখন শেষ রাত আকাশের ঘন অন্ধকার সবেমাত্র ধূসর হতে শুরু করেছে আলো ফোটেনি নগর এখনো নিদ্রামগ্ন শুক্তিমতীর রাজপ্রাসাদ প্রায় অন্ধকার শুধু করেণুমতীর মহলটি অজস্র দীপে আলোকিত  এই মুহূর্তে বড় ব্যস্ততা সেখানে কুসুমপুরে বক্তৃতা সভা অনুষ্ঠিত হবে করেণু অংশ গ্রহণ করবে সেখানেএই প্রথম সে কোনো জনসমাবেশে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করবে আচার্য বীতিহোত্রও যাবেন তার সঙ্গে পরিচারিকার দল ছোটাছুটি করছে তার যাত্রার আয়োজনে করেনুমতীর মনে হচ্ছে এই দিনটি তার জীবনের এক সন্ধিক্ষণ উত্তরে কুসুমপুরের ধারা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ এক উদ্যানে এই আলোচনা সভার আয়োজন হয়েছে জম্বুদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মেধাবী যুবক আসবে আজ সেখানে আপন মতামত ব্যক্ত করতে আচার্য বীতিহোত্র বাইরে প্রাঙ্গনে অপেক্ষারত তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে যাবেন সেখানে এ সভায় করেনুমতীই এক মাত্র নারী কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গুরু-শিষ্যায় বহু আলোচনা হয়েছে করেণুর বক্তব্য বিষয় ব্যাকরণ

উত্তেজনায় মধ্য রাত থেকেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলসে বহুবার সংশোধন করেছে নিজের রচনা তারপর সেটি যত্ন সহকারে কণ্ঠস্থ করেছেব্যাকরণ যে কাব্য শরীরের অস্থি কাঠামো, তা সে জানে সুকঠিন ব্যাকরণ-নিয়মকে অবলম্বন করেই শুদ্ধ ও মধুর বাক্য নির্মিত হতে পারে বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা করেছে সে আচার্য বলেছেন নিজস্ব মতামত প্রকাশে যেন ভাষার ব্যবহার হয় স্বচ্ছ, এবং যুক্তিসঙ্গত তা তাকে মনে রাখতে হবে প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ হতে হবে স্পষ্ট ও নির্ভুল বক্তব্য যেন দীর্ঘ না হয় শ্রোতাকুল অধৈর্য হতে পারে তাতে এ বিষয় সে অনেক চিন্তা করে নিজের বক্তব্যের আঙ্গিককে, বারবার নতুন করে নির্মাণ করেছে বহু শব্দের ব্যবহারে বদল এনেছে

এখন তার স্নান সারা হয়েছে প্রসাধন বাকি কেউ জানে না করেণুমতীর একটি গোপন দুঃখ আছে আজ দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য প্রবল হয়ে উঠল সেই দুঃখটি সে জানে সে সুন্দরী নয়  সে একটু বেশী ত্বণ্বী ক্ষুদ্র তার শরীরের গঠন যৌবনে পদার্পণ করেও তার শরীর তেমন উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি হঠাৎ দেখলে তাকে একটি বালিকা বলে বোধ হয় তার গায়ের বর্ণ যদিও গৌর কিন্তু খুব উজ্জ্বল নয় অবশ্য ত্বক অতি মসৃণ সে পিতা শিশুপালের মতো নতনাসাতার চোখ দুটি ছোট কিন্তু  নিবিড় কালো আর ঘন পল্লবে ঘেরা  চোখের মণি দুটি দীপ্ত চিবুক আর গ্রীবা বড় কমনীয় সে বার বার শুনেছে তার মৃতা জননী অতি সুন্দরী ছিলেন, মাতৃরূপের ঐশ্বর্য সে পায়নি অবশ্য কেউ কেউ বলেছে তার মুখে এক কোমল লাবণ্য আছে তবু দর্পণ তাকে বরাবরই হতাশ করে এই প্রাসাদে তার বিমাতারা সকলেই অপরূপ রূপবতী তার অনেক সখীও তার চেয়ে অনেক বেশী সুদর্শনা

সে যুক্তি ভালবাসে মন খারাপ হলে সে নিজেই নিজেকে বলে, সুন্দরী না হওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই সুন্দরী হওয়ার মধ্যেও কোনো কৃতিত্ব নেই কিন্তু যুক্তি-বৃত্তের বাইরে থাকে আবেগ কখনও কখনও নির্জন ঘরে সে আবেগ উত্তাল হয়ে ওঠেপরিচিত যত রূপসী নারীদের মুখ মনে পড়ে তার আর তখন বিষাদ ঘিরে ধরে তাকে সে জানে না রূপের কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞা নাই সে জানে না তাকে দেখলেই দর্শকের মন স্নিগ্ধ আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে সে এখনও জানে না অদূর ভবিষ্যতে এক পরম রূপবান, প্রাজ্ঞ পুরুষ নির্জন রাত্রে এ কথা এক অলৌকিক বন্দনা গাথার মতো উচ্চারণ করবেন তার উদ্দেশে আর সেই আশ্চর্য রাত্রে অপূর্ব এক অনুভবে শিহরিত, রোমাঞ্চিত হবে সে বারে বারে   

অবশ্য এমনও নয় যে সে নিজের রূপের অভাব নিয়ে খুব বেশী চিন্তা করে! এমনকি প্রসাধনের ব্যাপারেও সে বিশেষ মনোযোগী নয় কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের অজ্ঞাত সৃষ্টিকর্তার উপরে তার বড় ক্ষোভ জেগেছিল        

যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে সে, আজকের আলোচনা সভায় যাঁরা আসবেন, সেই সব ধীমান, রূপবান যুবকদের চোখে, যতদূর সম্ভব সুদর্শনা হয়ে উঠতে চাইছিল পেটিকা খুলে তার দাসীরা একটির পর একটি বসন বার করে আনছিল কোনোটিই মনোমত হচ্ছিল না তার একজন একটি গাঢ় রক্তিম বর্ণের বসন বেছে দিতে ধমক দিল সে “একি এ বস্ত্র কেন? আমি কি কোনো উৎসব সভায় যাচ্ছি নাকি? তার উপর সময় সকাল কেউ কি এখন সোনার সুতার কারুকাজ করা রক্ত বসন পরে?” অনেকক্ষণ ধরে বেছে শেষ পর্যন্ত সে একটি শ্বেত বর্ণের রেশম বস্ত্রই পছন্দ করল মাথার উপরে চুড়া করে বেঁধে দিতে  বলল কেশগুলি তাতে একটি মাত্র শ্বেত কুরূবকের কলি সখীদের বারম্বার অনুনয় সত্বেও ওষ্ঠাধর রাঙালো না চোখে কেবল কাজলের সূক্ষ্ম রেখা ছাড়া অন্য প্রসাধন ছিল নাআর দুই ভ্রুর মাঝখানে নিজেই এঁকে নিল সযত্নে কুঙ্কুমের বিন্দু সখীরা মাখিয়ে দিল তার প্রিয় সুগন্ধি পুষ্পাসার তারপরে হাতে, গলায়, কানে পরল সে মুকুতা ও মরকত মণির কারুকাজ করা লঘু গহনা

আড়ম্বরহীন শ্বেত বসনের বিপরীতে খুব মানানসই হয়েছিল ওই অলঙ্কার সব শেষে একজন দাসী মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তার পায়ের নখগুলি রাঙিয়ে দিচ্ছিল লাক্ষারসে করেণুমতী সতর্ক ভাবে নিজের শ্বেত বসনটি পায়ের কিছুটা উপরে গুটিয়ে নিয়েছিল তার মনে হচ্ছিল নখরঞ্জনের পরেই তার বসন পরিবর্তন করা উচিত ছিল তার হাতে ধরা ছিল ধাতুর দর্পণটি সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে ভাবছিল কপালে কুঙ্কুমের নক্‌শাটি কি মুছে অন্য কোনো ধরনে আবার আঁকবে কিনা! একটু দ্বিধাণ্বিত ছিল যেন!

দাসী আপন মনে নিজের কাজ করছিল এই দাসীটি এক কুরূপা তরুণী নাম রেবা কোনো দূরের গ্রাম থেকে সদ্য এসেছে রাজ অন্তঃপুরে নিকষ কালো তার বর্ণ চোখ দুটি বড় বড় সামনের দিকে বেরিয়ে আসা সারা মুখে প্রকট শুধু বড় বড় উঁচু দাঁতগুলিমুখে নির্বুদ্ধিতার ছাপ কারণে অকারণে সে উচ্চস্বরে হাসে

সহসা ঘটল এক দুর্ঘটনা দাসীর অসাবধানতায় লাক্ষারসের পাত্রটি উলটে গেলআর রঙিন তরল ছিটকে এসে লাগল করেণুর শ্বেত বসনে মুহূর্তের মধ্যে বস্ত্রের অনেকখানি অংশ জুড়ে বড় বড় লাল ছোপ ফুটে উঠে নষ্ট হোল এত যত্নের সাজ করেণুর বাহু ও গলার নীচেও এসে লেগেছিল লাক্ষারসএমন আকস্মিক কান্ডে, অন্য পরিচারিকারা ত্রস্ত স্বরে অর্ধস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল কিন্তু ওই নির্বোধ যুবতী দাসীর পুরো ব্যাপারটিই এতই কৌতুকজনক মনে হোল যে সে নিজের এমন অকর্মে খিলখিলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল হাসতে হাসতে স্খলিত কণ্ঠে কোনোমতে বলল,-“এহ্‌মা গো এ কি করে বসলেম আমি---সমস্ত সাদা কাপড়খানা কিনা একেবারে লালে রাঙিয়ে গেল---”

আর সহ্য হোল না করেণুমতীর দাঁতে দাঁত চেপে হাতে ধরে রাখা ধাতুর দর্পণটি এক ঝটকায় সে ছুঁড়ে ফেলল আর সেটা মাটিতে পড়ে ধাক্কা খেল বসনের লৌহ পেটিকায় সেই প্রায় নিস্তব্ধ রাত্রি-শেষের পৃথিবীতে ঝন্‌ঝন্‌করে অনুরণিত হোল শব্দটা কয়েক মুহূর্ত ধরে বিকৃত মুখে কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল করেণুমতী,-“কোনো কর্মে মন নেই কেবলই নির্বোধের মতো হাসি সর্বদা আপনজনের মতো ব্যবহার করি কিন্তু সে দেখি আমারই ভুল কুকুর যেমন প্রশ্রয় পেলে মাথায় ওঠে---”

ততক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অন্য পরিচারিকার দল কঠোর ভর্ৎসনা করতে লাগল অপরাধিনীকে আর সে হতভম্বের মতো ব্যাদিত মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল তারপরেই আচমকা কেঁদে উঠে ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল অন্য মেয়েগুলি তার উদ্দেশে নানা রকম কটু কথা বলছিল কিন্তু তারপরেই তৎপর হয়ে উঠল তারা সময় অল্প এখন আবার নূতন করে খুব দ্রুত বেশ পরিবর্তন করতে হবে রাজকুমারীর বাইরে থেকে  এক নাগাড়ে ভেসে আসছিল তার কান্নাকরেণুমতীর খুব ক্লান্ত লাগছিল ঐ একঘেয়ে শব্দটা শুনতে শুনতে  সে নিজের সজ্জার ব্যাপারে এবারে আর কোনো উৎসাহ দেখাল না ভারী এক অবসাদ ঘিরে ধরেছিল তাকে   

                        

চতুর্থ অধ্যায়


ক্ষুদ্র সেই ঘরে জ্বলছিল ক্ষীণ শিখা প্রদীপটি ঘর প্রায় অন্ধকার মাটির সোঁদা গন্ধ আসছিল  ভূমি শয্যায় এই প্রথম রাত্রি যাপন কিন্তু অদ্ভুত এক উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন পাঞ্চালরাজনন্দিনী দ্রৌপদীকি আশ্চর্য আজকের দিনটি একের পর এক কত অপ্রত্যাশিত, অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটে গেলস্বয়ম্বর সভায় ওই অপূর্ব সুদর্শন শ্যামবর্ণের যুবকটি, যখন ধনুকে গুণ পরাচ্ছিলেন, মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন দ্রুপদ রাজকন্যা ইনিও যদি ব্যর্থ হন? প্রকৃত কথা প্রথম দর্শনেই অপরিচিত যুবকটির প্রতি অদ্ভুত এক ভাললাগার সঞ্চার হয়েছিল হৃদয়ে তাঁরতারপর লক্ষ্যভেদ করলেন সেই ব্রাহ্মণ যুবক সে এক আবেশঘন মুহূর্ত রোমাঞ্চিত হৃদয়ের কম্পন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন পাঞ্চালী নিজের প্রবল উচ্ছ্বাসকে সংবৃত রাখার প্রয়াস তখন বাদ্যকরেরা উল্লাসে উন্মত্তের মতো মহানাদে তূর্য্যবাদন শুরু করেছিলসভায় উপস্থিত বহু দর্শকের বিস্মিত জয়ধ্বনির মধ্যে পাঞ্চালী গুরুজনের নির্দেশানুসারে এগিয়ে গিয়ে ঈষৎ সলজ্জ ভঙ্গিতে মাল্যদান করলেন জীবনের প্রথম কাঙ্খিত পুরুষকে কিন্তু পর মুহূর্তেই সেই রেশটুকু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ততক্ষণে পরাজয়ের গ্লানিতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন জম্বুদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত রাজণ্যবর্গ ওই যুবককে হত্যা করতে চেয়ে রক্তলোলুপ শ্বাপদের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে তাঁদের মুখ খসে পড়েছে আভিজাত্যের আবরণতাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন উন্মত্তের মতো চীৎকার করে উঠল,- স্বয়ম্বরে ব্রাহ্মণের অধিকার নাই এই প্রবঞ্চক রাজার রাজ্য ছেড়ে যাবার আগে ওই মেয়েটাকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে যাব আমাদের অপমান করার শাস্তি পেতে হবে ওকে!”

উৎসব সভা নিমেষের মধ্যে পরিনত হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক সংগ্রামক্ষেত্রে পাঞ্চালীর পিতা ও ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন হতচকিত, আতঙ্কিত তখনই ঘটেছিল আশ্চর্য সেই ঘটনা লক্ষ্যভেদকারী যুবকটি দৃপ্ত ভঙ্গীতে প্রতিরোধোদ্যত হয়ে উঠেছিলেন সেই হিংস্র রাজজনতার বিরুদ্ধে এতক্ষণ তাঁর পাশে বসেছিলেন আর একটি বিশালদেহী ব্রাহ্মণ যুবকযিনি ঐ যুবকের সাফল্যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন  মহা ক্রোধে হুঙ্কার দিয়ে এবার তিনিও উঠে দাঁড়ালেন মনে হচ্ছিল পরাক্রমশালী দুই সিংহ ও গজরাজ যেন একজোট হয়ে সংহারে প্রবৃত্ত হয়েছেন সম্মুখের এক দল বন্য কুক্কুরকে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হোল তীব্র বারিপাতের মতো অবিরল শরবর্ষণ করতে লাগলেন শ্যামাঙ্গ, সুদর্শন যুবকটি আর তাঁর সহযোগী প্রকান্ডকায় অন্য যুবক সভাপার্শ্বের একটি বৃক্ষ থেকে বিশাল এক পত্রবহুল শাখা ভেঙে নিয়ে গদার মতো আস্ফালন করতে করতে এগিয়ে গেলেন দুই ব্রাহ্মণ যুবকের সেই যৌথ আক্রমণের সামনে আহত হয়ে একের পর এক ভূপাতিত হতে লাগলেন রাজারা শল্য, কর্ণ, দুর্য্যোধন, মহাবীর বলে খ্যাতিমান সেই সব রাজপুরুষ সভায় উপস্থিত ছিলেন বহু ব্রাহ্মণ বাহুবল ও যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ খ্যাতি নেই ব্রাহ্মণকুলের কিন্তু আজ নিজ বর্ণের দুটি মানুষের এই প্রবল পরাক্রম দেখে, তাঁরাও ভীষণ উল্লাসে উঠে দাঁড়ালেন দুই বীরের সহযোদ্ধারূপে  তখন গণরাজ্য দ্বারকার গোষ্ঠীপ্রধান কৃষ্ণ সেই যুদ্ধোন্মাদ জনতার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতির সামনে একটু যেন সংযত হলেন সকলে এই শ্যামবর্ণ, অপরূপ সুন্দর মানুষটির নাম ভারতবর্ষের সর্বত্রই উচ্চারিত হয় তাঁর অসামান্য বুদ্ধি ও শক্তির খ্যাতি আজ লোকমুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনীও প্রচলিত আছে তাঁর নামে এই সভায় তিনি আজ এসেছিলেন প্রতিযোগী নয়, শুধুই দর্শক রূপে

প্রথমে তিনি ইঙ্গিতে নিরস্ত করলেন ব্রাহ্মণ যুবক দুটিকে তারপর রাজণ্যবর্গের দিকে ফিরে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন,-“রক্তক্ষয়কারী যুদ্ধ বন্ধ করুন হে রাজগণ শুভবুদ্ধির আলোকে প্রত্যক্ষ করুন ধর্মকে যে ধর্মচেতনা মানবজীবনকে ধারণ করে থাকে দ্রুপদ রাজকুমারী এঁরই গলায় বরমাল্য দিয়েছেন অতএব ধর্মত তিনি এঁরই পত্নী

রাজারা এই দুই যুবকের পরাক্রম দেখে ইতিমধ্যেই প্রমাদ গুনছিলেন এখন কৃষ্ণের যুক্তিঋদ্ধ বাক্য শুনে যেন যুদ্ধবন্ধের এক সম্মানজনক সমাধান খুঁজে পেলেন তাঁরা                            

কোনো এক সুবুদ্ধি পুরুষ, কৃষ্ণের কথা শেষ হওয়া মাত্র বলে উঠলেন,-“ব্রাহ্মণ অপরাধী হলেও তাঁকে দন্ডদান অনুচিত শাস্ত্রে এমনই বলা আছে এই যুদ্ধপ্রয়াসী ব্রাহ্মণদের ক্ষমা করা হোক,এই আমার একান্ত ইচ্ছা তবে পুনরায় এঁরা যুদ্ধ করতে উদ্যোগী হলে, তখন তাঁদের প্রতিহত করতেই হবে

শোনামাত্র বিশালাকৃতি যুবকটি, ভীষণ ক্রোধে মুষ্টিবদ্ধ বাহু আস্ফালন করে কিছু প্রত্যুত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু লক্ষ্যভেদকারী যুবকের মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল, মৃদুস্বরে কি যেন বলে তিনি নিবৃত্ত করলেন ক্রোধী পুরুষটিকে কিন্তু তাঁর মুখের ভীষণ ভঙ্গী দেখে চতুর লোকটি নিমেষে সভার বিপুল জনতার মধ্যে মিশে লুকিয়ে পড়ল 

তারপর দ্রৌপদীর জীবনের এক আশ্চর্য পরিক্রমা শুরু হোল পিতা দ্রুপদরাজকে, ভ্রাতাদেরও সেই মুহূর্তে বিষণ্ন ও হতচকিত মনে হচ্ছিল পুরনারীদের ক্রন্দন ধ্বনি ও পুরোহিতের মঙ্গলমন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে তিনি রত্নময়  রাজপুরী থেকে বেরিয়ে এলেন ঐ দুই ব্রাহ্মণের সঙ্গে আরো তিনটি পরম রূপবান ব্রাহ্মণ যুবকও ছিলেন সে সভায় তাঁরাও উল্লসিত মুখে এসে যোগ দিলেন ওই দুজনের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত ভাবে অভিনন্দিত করতে লাগলেন, লক্ষ্যভেদকারীকে তাঁদের কথোপকথন থেকে সকলে বুঝেছিলেন পঞ্চ ভ্রাতা তাঁরা এগিয়ে চললেন, পাঁচটি পুরুষ, বীর্যশুল্কা অপরূপা সেই নারীকে ঘিরে মনে হচ্ছিল একদল অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ বুঝি পরম যত্নে রক্ষা করছেন প্রাণস্বরূপা বহ্ণিশিখাকে রাজপ্রাসাদের সিংহ তোরণ পর্যন্ত অনুগমন করল পুরজন ক্রমশ দূরবর্তী আরো দূরবর্তী হতে লাগল আকাশপটে আঁকা রাজপ্রাসাদের সৌধ শিখর, রাজপথে অপেক্ষারত বিস্মিত জনতা নগরের সুদৃশ্য প্রাকার পেরিয়ে নির্জন অরণ্যপথের দিকে চললেন তাঁরা

কি আশ্চর্য অনুভূতি রাজনন্দিনীর মনে অনাস্বাদিতপূর্ব মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে একটি দুটি কথা বলছিলেন তাঁরা মৃদু স্বরে প্রায় নিস্তব্ধ সে বনভূমিতে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল তাঁদের পায়ের চাপে শুকনো ঝরাপাতাদের চূর্ণ হয়ে যাবার মৃদু শব্দআর মাঝে মাঝে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠছিল নাম না জানা কত পাখীর ডাকে নির্জন বনের এক বিশেষ ঘ্রাণ আছে যেন পৃথিবীর আদিম গন্ধ তারই সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছে ঐ রহস্যময় যুবকগুলির দেহ-ঘ্রাণ রাজকুমারীর মনে হচ্ছিল আবিষ্টের মতো তিনি অজানা সেই পথে অনুগমন করছিলেন তাঁদেরপাঁচটি অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে তিনি একাকিনী কোনো অনুচরী, প্রহরী নেই কাছে বিহ্বল, রোমাঞ্চিত তিনি তখন, কিন্তু ভীতা নন স্বভাবত তিনি সাহসিনী ভাগ্যের অদেখা দেবতা কি গূঢ় লিপি লিখে রেখেছেন তাঁর ললাটপটে, তা জানতে প্রবল উৎসুক সেই মুহূর্তে নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলেন

দীর্ঘ পথের শেষে অরণ্যপ্রান্তের এক গ্রামে এক কুটিরদ্বারে পৌঁছালেন তাঁরা বিশালকায় যুবকটি মেঘগর্জনের মতো উল্লাস ধ্বনি করে উঠলেন,-“হে জননী, শীঘ্র এসে দেখুন, আজ কি পরম দ্রব্য ভিক্ষা করে এনেছি

অন্তরাল থেকে নারীকণ্ঠ শোনা গেল তার উত্তরে “যা এনেছ সকলে মিলে ভাগ করে নিয়ো বাছা” হেসে উঠলেন যুবকটি

পর মুহূর্তেই এক মধ্যবয়সিনী নারী কুটির দ্বারে এসে দাঁড়ালেন সাধারণ শুভ্র বসন পরনে তাঁর সম্পূর্ণ নিরাভরণা কিন্তু সুন্দর মুখে কি অনায়াস আভিজাত্য পাঞ্চালীর দিকে দৃষ্টি পড়া মাত্র, শিউরে উঠলেন তিনি“হায় না জেনে এ কি বললাম”-

প্রকান্ডকায় যে যুবকটি, তাঁর মুখে, ভাবভঙ্গীতে যেন শিশুর সারল্যের আভাসপাঞ্চালী ইতিমধ্যে শুনেছেন তাঁর নাম ভীমঅট্টহাসি হেসে উঠলেন তিনি “জননী নিশ্চয় ভেবেছিলেন আমরা কোনো ভোজ্যবস্তু নিয়ে এসেছি তাই--” অন্যেরা স্তব্ধ হয়ে রইলেন সেই নারী দ্রুত পদে কাছে এসে আবেষ্টন করলেন পাঞ্চালীকে নিজের দুই করতলে পাঞ্চালীর মুখখানি ধরে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,-“এমন কোন্‌উপায় আছে, যাতে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই বাক্যের সত্য রক্ষা হয়, অথচ, এই কন্যাকে ব্যাভিচার দোষ স্পর্শ না করে! কে বলে দেবে আমাকে?” কেমন হাহাকারের মতো শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর

তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যিনি, জননীকে ডেকে বললেন,-“মাতঃ সত্য রক্ষা সম্পর্কে কিসের উদ্বেগ? আপনি তো সম্পূর্ণ অজান্তে বলেছেন এ কথা, স্বাভাবিক ভাবে প্রতিদিন আমরা ভিক্ষা শেষে ফিরে এলে যা বলে থাকেন ইনি পাঞ্চাল রাজকুমারী স্বয়ম্বর সভায় লক্ষ্যভেদ করে অর্জুন এঁকে লাভ করেছেন ধর্মত ইনি অর্জুনেরই পত্নী

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখের দিকে নিমেষের জন্য তাকালেন জননী কিন্তু তাঁর উদ্বেগের উপশম হোল না

ভীম নামক যুবকটি এবার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন,-“অজান্তে বললেও সত্য রক্ষা ক্ষত্রিয় নারীর কর্তব্য" তাঁর দৃষ্টিতে অধীরতানিমেষে পাঁচটি পুত্রের মুখে ফিরে ফিরে এল মধ্যবয়সিনী নারীর বিহ্বল দৃষ্টি নিজের বক্ষে হাত রেখে আত্মগত ভাবে আতঙ্কিত কণ্ঠে তিনি বললেন,-“হা ঈশ্বর, কুন্তী কোনো দিন মিথ্যাচরণ করেনি, আজীবন সত্যকে সে রক্ষা করেছে, আপন প্রাণাগ্নির তুল্য তবে কেন তার মুখ থেকে এমন বাক্য বেরল, যার প্রয়োগ নারীকে পাপকুন্ডের অতলে তলিয়ে দেয়

স্তম্ভিত দ্রৌপদীর মস্তিষ্ক দুয়ারে এবারে শব্দগুলি আঘাত করল কারা এঁরা? এই সব নাম বহুবার শুনেছেন তিনি যেন অতীতে! কুন্তী, ভীম, অর্জুন! মৃত রাজা পান্ডুর পত্নী ও পুত্রদের এই নাম ছিল না? কিন্তু তাঁরা যে নিষ্ঠুর চক্রান্তে নিহত হয়েছিলেন, এমনই জনশ্রুতি তবে কি এ শুধু এক সমাপতন? নাকি সে জনশ্রুতি ছিল অলীক প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরা উদ্ধার পেয়েছিলেন কোনোক্রমে? এঁদের অবয়ব এবং ব্যক্তিত্ব যেন ক্ষত্রিয়সুলভ! তবে কি ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে এখন গুপ্তশত্রুর দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রয়েছেন তাঁরা? নিমেষের মধ্যে এই চিন্তাগুলি উদীত হোল ধীমতী দ্রৌপদীর মনে    

ঠিক তখনই, অশ্বক্ষুরধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল আসন্ন সন্ধ্যার বনতল তাঁদের কুটির দ্বারে নিমেষের মধ্যে এসে দাঁড়াল দুটি তেজবান অশ্ব তাদের পিঠ থেকে নেমে এলেন আরোহীরা রূপবান দুই যুবক একজন শ্যামকান্তি অন্যজন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দ্রৌপদী চিনতে পারলেন পূর্বে তাঁদের নাম বহুবার শুনলেও আজই প্রথম স্বয়ম্বর সভায় দেখেছেন এঁদের গণরাজ্য দ্বারকার দুই গোষ্ঠীপতি সম্পর্কে এঁরা বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কৃষ্ণ ও বলদেব

গৃহবাসীদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে তাঁরা প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়ালেন প্রথমেই নতজানু হয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন পঞ্চভ্রাতার জননীকে “আর্যা, আত্মপরিচয় দিই আগে আমি বাসুদেব অন্য নাম কৃষ্ণ আপনার ভ্রাতা বসুদেবের পুত্র ইনি আমার অগ্রজ বলদেব সম্পর্কে আপনি আমাদের প্রণম্যা পিতৃষ্বসা আপনার পুত্রগণ আমাদের ভ্রাতা বহু বিপর্যয়ের মধ্যে আজন্ম কেটেছে আমার তাই ইতিমধ্যে আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়নি

নিমেষে কুন্তীর মুখের ভাব বদলে গেল চোখের চাহনি বাষ্পাচ্ছন্ন কেঁপে উঠল ওষ্ঠাধর তিনি বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আগন্তুকের মুখের দিকে তারপর অতি মৃদু, প্রায় অস্ফুট স্বরে বললেন,-“ভ্রাতা বসুদেবের পুত্র! পিতা শূরের পৌত্র তোমরা! যাদব সন্তান!” যাদব’ – শব্দটি যেন একই সঙ্গে বড় অভিমান ও মমতায় উচ্চারণ করলেন তিনি “কতকালের কথা প্রায় ভুলে যাওয়া সেই পিতৃভবন তোমার চোখ দুটি যেন আমার ভ্রাতারই মতো বালিকা বেলায়, পিতা নির্মম হয়ে আমাকে দান করে দিলেন কুন্তীভোজের হাতে মুছে গেল আমার  পূর্বনাম পৃথাতখন থেকে পালক পিতার নামানুসারে আমি পরিচিতা হলাম কুন্তী নামে”গলার স্বর কাঁপছিল

তিনি দুই করতলে নিজের মুখ ঢাকলেন আশ্চর্য স্তব্ধতা নেমে এল কয়েক মুহূর্তের জন্য কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই এই ব্যক্তিত্বশালিনী নারী প্রবল চেষ্টায় সংযত করতে পারলেন নিজেকে অস্বস্তিকর এই পরিস্থিতি কাটিয়ে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন ততক্ষণে বহুকাল ধরে অবরুদ্ধ থাকা অশ্রুধারা গড়িয়ে এসেছে সুন্দর গ্রীবায় তবু মৃদু হেসে সহজ সুরে বললেন,-“কিন্তু বৎস, আমাদের পরিচয় জানলে কেমন করে?”

“অগ্নি কতকাল ভষ্মাচ্ছাদিত থাকবে মাতঃ?” উজ্জ্বল মুখে বাসুদেব বললেন“আপনাদের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছি রাজকন্যা, রাজবধূ হয়েও কত না দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিন কেটেছে আপনার এ জম্বুদ্বীপে সকলেই আজ জেনেছে, বারণাবতের সে ভয়াল অগ্নিকান্ড সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না ধূর্ত জ্ঞাতিশত্রুদের   নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের ফল  ঈশ্বরের করুণায় কোনোক্রমে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন কিন্তু আজ আপনাদের পরিচয় প্রকাশ পেলে, নির্মম জ্ঞাতিশত্রু আবার আপনার পুত্রদের হনন করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠবে তবে আর তা সহজসাধ্য নয়আপনার পুত্র মহাবীর অর্জুন দ্রুপদ রাজকন্যাকে জয় করেছেন স্বভাবতই রাজা দ্রুপদ বিপুল রণশক্তি নিয়ে জামাতার শত্রুগণের বিপক্ষে দাঁড়াবেন আর মাতঃ অঙ্গিকার করছি আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রদেরও আজ থেকে পান্ডব-সন্তানদের সহযোদ্ধা বলে জানবেন

আজ আশ্চর্য এক দিন কত অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল একের পর এক এমন সব ঘটনার আকস্মিকতায় পান্ডবগণ রুদ্ধবাক হয়েছিলেন কয়েক মুহূর্ত কৃষ্ণ যখন জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠিরের চরণ বন্দনা করতে এগিয়ে গেলেন তখন বুঝি সম্বিৎ ফিরে পেলেন তাঁরা ক্রমাণ্বয়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলি কি ফল উৎপাদন করবে তা যেন উপলব্ধি করতে পারলেন ঐশ্বর্য, রাজকীয় ক্ষমতার প্রকাশ, বিলাসভোগে অভ্যস্ত হননি তাঁরা প্রকৃতির কোলে সুদূর শতশৃঙ্গ পর্বতের অরণ্যময় উপত্যকায় বাল্যকাল পর্যন্ত কেটেছে কত না বিপর্যয় তারপরে পিতা পান্ডু ও মাতা মাদ্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পরে, পর্বতবাসী ঋষিদের সঙ্গে জননী কুন্তী ও তাঁরা পাঁচটি ভাই এসে পৌঁছেছিলেন তাঁদের পিতৃপুরুষের ভূমি হস্তিনাপুর নগরেরাজপ্রাসাদের বৈভবে বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁরা অনভ্যস্ত এই জীবন যাপনে অস্বস্তিও হোত পিতামহ ভীষ্ম ও তাত বিদুরের স্নেহ ছিল তবু সেই বালক বয়সেই তাঁরা বুঝতে পারতেন জ্যেষ্ঠ তাত ধৃতরাষ্ট্রের আচরণে কেমন এক কপটতা ঠোঁটের কোণে যখন মধুর হাসি, চোখে গূঢ় এক অশুভ অভিসন্ধি আজন্ম উন্মুক্ত পরিবেশে বসতি যাদের, তাদের দৃষ্টিশক্তি স্বচ্ছ হয়  ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, বিশেষত দুর্যোধনের প্রবল আক্রোশ প্রকাশ পেত অনাবৃত ভাবে ভীমকে গোপনে হত্যা করার চেষ্টাও করেছিল সে জিঘাংসা ছিল দুর্যোধনের সহজাত এক প্রবণতা জননী কুন্তীকে বালকগুলি সর্বদাই দেখত, কুণ্ঠিত, আতঙ্কিত আগলে রাখতে চাইতেন সন্তানদের সমস্ত অমঙ্গলের প্রকোপ থেকে ওই মণিময় বিশাল প্রাসাদে তাঁরা যে অবাঞ্ছিত সে বোধ ম্লান করে রাখত মনকে মাঝে মাঝে শুধু বিশালদেহী ভীমের অবদমিত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটত ভয়ংকর ভাবে খেলার ছলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নৃশংস প্রহার করত সে তখন কুন্তী ত্রাসে দিশাহারা হয়ে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করে কঠিন তিরস্কার করতেন তাকে শেষে তো বারণাবতে তাদের পাঠিয়ে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল দুর্যোধন তারপর ছদ্মবেশে পথে পথে এই গোপন পরিক্রমা---প্রাণভয়ে এই দুঃসহ অজ্ঞাতবাসের গ্লানিস্বজন-বন্ধুহীন এই দিন যাপন 

এবার কি তবে সুদিন এল তাঁদের জীবনে?

অল্পক্ষণ আলাপের পরে, ভীম অধীর ভাবে সহসা বলে উঠলেন,-“ওহে কৃষ্ণ, এস দেখি একবার এদিকে” কৃষ্ণ ও ভীম কুটির দ্বারের বাইরে যাবার কিছুক্ষণ পরেই অন্য ভ্রাতারাও তাঁদের অনুগমন করলেন 

বলদেব খুব উৎসাহ সহকারে কুন্তীকে শোনাচ্ছিলেন, আজকের স্বয়ম্বর সভার বিস্ময়কর সব কাহিনী দ্রৌপদী এক প্রান্তে বসেছিলেন কুন্তীকে কিন্তু অত্যন্ত বিচলিত মনে হচ্ছিল বলদেবের বাক্যে যেন সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছেন না উদ্বিগ্ন ভাবে বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন বার বার অল্পক্ষণ পরেই আবার কৃষ্ণের সঙ্গে পঞ্চভ্রাতা ভিতরে এলেন তাঁদের মুখের ভাব উল্লসিত

কৃষ্ণ কোমল স্বরে কুন্তীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,-“মাতঃ শুনেছি আপনার অপূর্ব এই ভ্রান্তির আখ্যান শঙ্কিত হবেন না, আপনার মুখের বাক্য মিথ্যা হতে পারে না”- কুন্তী নীরবে তাকালেন সদ্যোপরিচিত ভ্রাতুষ্পুত্রের দিকে কৃষ্ণ বলতে লাগলেন,-“হে জননী, আমি নিশ্চিত, যে  আপনার মুখ থেকে যে বাক্য বেরিয়েছে তা স্বয়ং ঈশ্বরেরই অভিপ্রেত ছিলএই পরম রূপবতী তেজস্বিনী কন্যা আপনার পঞ্চপুত্রের জায়া হবেন সাধারণ সামাজিক প্রাণীর ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য, আপনারা তার ঊর্ধ্বে জানবেন এই বিশেষ ক্ষেত্রে একমাত্র এইরূপ অভিনব বিবাহই  মঙ্গলজনক অন্যথায় গভীর অকল্যাণ গ্রাস করবে আপনার সংসার, সমাজ ও সমগ্র দেশকে অন্তরে কোনো দ্বিধা রাখবেন না আর্যাদেখবেন সকল প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই এ বিবাহকে সমর্থন করবেন আর মূঢ়জনের নির্বোধ সমালোচনাকে উপেক্ষা করুন

দ্রৌপদী দেখলেন, নিমেষের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কুন্তীর বিষণ্ণ, চিন্তাকুল মুখ অন্তরে গাঢ় স্বস্তি পেলেন যেন কিন্তু এই অভিজাত রমণীর আচরণে কোনো উচ্ছ্বসিত আবেগের চিহ্ন দেখা গেল না সুন্দর হাত দুটি জোড় করে উপর দিকে দৃষ্টিপাত করে সংযত স্বরে শুধু বললেন,-“করুণাময়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক তবে যাতে শান্তি ও মঙ্গল, তাই যেন হয় প্রভু

আর সেই আশ্চর্য মুহূর্তে দ্রৌপদীর সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে গেল কোনো অলৌকিক দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পেলেন তিনি, নিজের মনের প্রতিচ্ছবি তিনি আনন্দিত, হ্যাঁ, নিজের মনকে, নিজের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায় না তাঁর মনে হোল শরীরটি যেন লঘুভার হয়ে উঠেছে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে! উন্মত্ত করে দেওয়া কোন্‌রাগিণী ধ্বনিত হচ্ছে চরাচর ভরে নিজেকে মনে হোল তাঁর এক গর্বিতা হস্তিনীর সমান পাঁচটি বিস্তীর্ণ জলাশয়ে অবগাহন স্নানের শেষে স্নিগ্ধ হবে যে!

সহসা চকিত হয়ে তিনি শুনতে পেলেন, আর্যা কুন্তীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে যেন কত দূর থেকে “ভদ্রে, এই ভিক্ষান্ন দুটি সমান ভাগে ভাগ কর একটি অংশ দাও ভীমকে সে চিরকালই অধিক ভোজন করে বাকি অংশ---”

দ্রৌপদী আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন গৃহকর্ম পালনের নির্দেশ দেওয়া হোল তাঁকেকিন্তু কি মধুর, কি সস্নেহ এই কণ্ঠস্বর মাতৃকণ্ঠ শুনতে পেলেন যেন তিনি কত দূর থেকে দ্রৌপদী স্বভাবতই কর্মপটিয়সী তাঁর রক্তাভ সুন্দর দক্ষিণ করতল নিপুণ ভঙ্গিতে কাঠের দর্বি তুলে পরিবেশন করতে শুরু করল কিন্তু চিত্ত হয়ে রইল আবিষ্ট

ভোজন পর্ব শেষ হলে কনিষ্ঠ ভাই দুটি নকুল ও সহদেব, মাটিতে কুশ শয্যা বিছিয়ে দিলেন দ্রৌপদী শুনেছিলেন, তাঁরা কুন্তীর পুত্র নন কিন্তু দেখলেন কুন্তী যেন তাঁদের প্রতি বিশেষ করে স্নেহশীলা পঞ্চভ্রাতা শয়ন করার পরে, দ্রৌপদী আপন হাতে কুন্তীর শয্যা প্রস্তুত করলেন পুত্রদের মাথার কাছে বিনয় বচনে বললেন,-“মাতঃ আপনি এবার শয়ন করুন” বহু ক্ষেত্রেই পুত্রবতী রমণীর কন্যাকাঙ্খা থাকে কুন্তীর মনে হোল এ স্বর যেন তাঁর জন্মান্তরের কোন অর্ধবিস্মৃত অতীত দিন থেকে ভেসে এল কবে যেন দেখেছিলেন তিনি এই অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি, শুনেছিলেন মধুর এই স্বর স্বল্পস্থায়ী মানব জীবনে ক্বচিৎ কখনও আসে এমন কিছু ক্ষণিক পূর্ণতার অনুভব

গভীর স্নেহে তিনি আলিঙ্গন করলেন অপরূপা কন্যাটিকে কিছুক্ষণ পরে আশ্চর্য এই পঞ্চপুরুষের পদতলে ভূমিশয্যায় শয়ন করলেন দ্রৌপদী তাঁর মনে হচ্ছিল আজকের রাত্রি বুঝি অনন্ত স্রোতস্বিনীর মতো তাঁকে বহন করে নিয়ে চলেছে অজানা কোন অলৌকিক দেশের তটে!কোন বাঁকে গিয়ে ভিড়বে তাঁর জীবন তরণী!


পঞ্চম অধ্যায়


নগরসীমা পেরিয়ে এসেছেন তাঁরা সাদা ঘোড়ায় টানা রথ ছুটে চলেছিল পূর্বমুখী চেদিরাজ্যের রাজধানী শুক্তিমতীর দিকে ফিরছে তারা খুব আনন্দ এখন করেনুমতীর মনে গতকাল কুসুমপুরের বক্তৃতাসভায় তার বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছে প্রথম মঞ্চে উঠে তার পা কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল কিন্তু দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে, আচার্য বীতিহোত্রের সঙ্গে আলোচনা করে যে বক্তৃতা সে তৈরি করেছিল, তার প্রথম পংক্তিটি উচ্চারণ মাত্র তার সমস্ত ভয় কেটে গেল সে যেন সামনের আকাশপটে আঁকা একটি চিত্রের মতো নিজের সমস্ত ভাবনাগুলিকে দেখতে পেল বক্তৃতাশেষে বিচারকমন্ডলী, তাকে নানা কূটপ্রশ্ন করলেন সে কি শুধু অন্য কারো রচিত পংক্তিগুলি মুখস্থ করে এসেছে, না বিষয়টির গভীরে সত্যই প্রবেশ করেছে, তা বোঝার জন্য প্রশ্ন শুনে স্বতস্ফূর্ত ভঙ্গীতে উত্তর দিল সে প্রসন্ন হয়ে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন সেই সব প্রাজ্ঞজন 

আজও রাত্রি শেষ হবার আগেই বেরিয়েছে তারা গাঢ় বর্ণে জল মেশালে তা যেমন ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে, তেমনি ক্রমশ অল্প অল্প আলো মিশছিল শেষ রাতের অন্ধকারে হালকা হয়ে যাচ্ছিল আকাশের রঙ এক সময়ে লাল আভায় মাখামাখি হয়ে গেল গগনপট তারপর অলৌকিক এক পুষ্পের মতো সহসা ফুটে উঠলেন বিবস্বান কী অপরূপ সেই বিভামুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল করেনুমতী তার মনে হোল ইচ্ছা করলে তো সে রোজই দেখতে পারে এ দৃশ্য প্রকৃত কথা আলস্য  মোহময় এক আলস্য রোজই ঘিরে ধরে তাকে এমন সময়ে গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় সে উপাধানটিকে আর ঘুম ও জাগরণের মধ্যে বাস করা তন্দ্রা নেমে আসে তার দু চোখ ভরে

এখন নদীর তরঙ্গের মতো বাতাস বয়ে চলেছিল তার দুপাশ দিয়ে ছুটে পিছন দিকে যেন পালিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ, দীঘি, মাটির কুটিরগুলি আগেও কত বার দেখেছে আজ হঠাৎই চকিতে মনে প্রশ্ন জেগে উঠল কেন হয় অমন? মনে হওয়া মাত্র এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বড় কৌতুহল হোল হে আচার্যদেব—’ – খুব উত্তেজিত মুখে পাশ ফিরে সে দেখল, বীতিহোত্র ঘুমে ঢুলে পড়েছেন সে আর কোনো শব্দ না করে, বাইরের দৃশ্যের দিকেই মন দিল ভোরের আকাশে এখন পাখির দল ওড়াউড়ি করছে তাদের মিলিত কলতান ধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে একটি কুটির থেকে কলস কাঁখে বেরিয়ে এল এক যুবতী এক গৃহের প্রাঙ্গনে হামাগুড়ি দিচ্ছে মোটাসোটা একটি শিশু উন্মুক্ত ক্ষেত্রে চাষীরা শস্যের চারা রোপণ করছে কোনো কুম্ভকার পল্লীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে দেখল অর্ধ নগ্ন মানুষগুলির নিপুণ হাতের কারিকুরিতে ঘুরন্ত চাকে নিমেষে তৈরি হয়ে উঠছে মাটির পাত্র এমন কত ছবি মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল তার পরিচয়সীমার বাইরের এই জীবনযাত্রার ছবিগুলি খুব উৎসুক হয়ে দেখছিল সে

খানিকক্ষণ পরে সামনে পড়ল একটি বৃহৎ দীঘি সারথি কপোত তখন রথ থামাল অশ্ব দুটি  কাছে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে জল পান করতে লাগল ঝাঁকুনি লেগে বীতিহোত্রের ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে করেনুমতীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন,-“এক ঘুম দিয়ে দিলাম না? তা আমার নাসিকাটি সঙ্গীত শোনায়নি তো?” তিনি সর্বদাই কঠোরমূর্তি নন মাঝে মাঝে এই প্রিয় শিষ্যাটির সঙ্গে রঙ্গ কৌতুকের কথাও বলে থাকেন করেনু সামান্য লজ্জিত হয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল,-“দেখুন দেখুন আচার্যদেব, ঘোড়া দুটি কেমন চোঁ চোঁ করে জল পান করছে আহা কত পিপাসাই না পেয়েছিল ওদের” তারপর ঈষৎ উচ্চস্বরে সারথিকে ডেকে বলল,-“কপোত তুমি তো সে খোঁজ রাখ না গতি সামান্য কমালে কেবল চাবুক মেরে মেরে ছুটিয়ে আন আচ্ছা ওরাও তো জীব কত কষ্ট হয় বল তো ওদের

সারথি কপোত, রাজকুমারীর জন্মের আগে থেকেই এই রাজগৃহে আছে করেনু ও তার ভাই ধৃষ্টকেতুকে শৈশবে সে রথে করে বৈকালিক ভ্রমণে নিয়ে যেত রাজকন্যার তখনকার বলা আধো আধো কথাগুলি, নূতন কোনো দৃশ্য দেখলে বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যাবার সেই ভঙ্গি, তার এখনও মনে আছে সে হেসে বলল,-“ও কুমারী, চাবুক না চালালে, রাজপুরে পৌঁছাতে তোমার হয়ে যাবে গিয়ে তিন পহোর

অল্পক্ষণ পরেই আবার রথ চলতে শুরু করল তৃষ্ণা মিটতে অশ্বগুলিও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল কপোতের সেই মুহূর্তে আর চাবুক চালানোর প্রয়োজন হয়নি রথ ক্রমশ নগরীর সীমান্তে প্রবেশ করল জনবসতি ক্রমে ঘন হয়ে উঠছিল করেণুমতী আর কথা বলেনি নিজের সদ্য পাওয়া এই সাফল্যের স্বাদ নিচ্ছিল বুঝি মনে মনে তার চোখের সামনে গত দিনের সভার মুহূর্তগুলির ছবি ভেসে উঠছিল বারে বারে শংসার প্রতিটি শব্দ সে যেন শুনতে পাচ্ছিল

হঠাৎ বীতিহোত্র মৃদু স্বরে বললেন,-“একটু আগে যে কথাটি বললে, কখনও ভেবে দেখেছ কি?”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আচার্যের মুখের দিকে তাকাল করেণু

“এ বিশ্বে এমনই হয়ে থাকে সবল ব্যক্তিগত প্রয়োজনের চাকায় জুতে নেয় দুর্বলকে বল বহু প্রকার শারীরিক শক্তি যেমন, তেমনই মেধা বা বৈভবের জোরও সামাজিক অবস্থানের জোরও পশুর চাইতে মানবের মেধা অধিক, তাই সে তার উপর প্রভুত্ব করতে পারে মানব সমাজের বিভিন্ন ক্রমণীতেও কি তারই প্রতিফলন দেখ না?”- তাঁর স্বরে বিদ্রূপ

বীতিহোত্র বলে চলেন,-“নিজের ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে বিচার কর তো কাল তোমার এই সভায় যাত্রা উপলক্ষ্যে, রাজভবনে ছিল কত ব্যস্ততা তোমার সাজসজ্জা, তোমার প্রস্তুতির আয়োজনে   তোমার প্রতিদিনকার অনায়াস জীবন যাপনে কতগুলি মানব-মানবীর নিবিড় শ্রম যুক্ত থাকে, ভেবেছ কি কখনও?

এই যে গুরুত্ব পাও তুমি প্রতি মুহূর্তে, কখনও কি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছ তার জন্য? করনি করনি কারণ চারপাশের আলো বাতাসের মতো আজন্ম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছ এই জীবনে অথচ এই সম্পদ, সম্মান ও আয়েস অর্জন করনি তুমি বিশেষ কোনো দক্ষতায়লাভ করেছ কেবল জন্মসূত্রে এতে কি কৃতিত্ব আছে করেণু? কিছু নাই আছে শুধু ভাগ্যের পাশাখেলা তবু নিজের সামান্য অসুবিধাতেই রূঢ় হও তোমার অসহিষ্ণুতা কত অসহায় চিত্তে যে বেদনা সৃষ্টি করে, তা যদি বুঝতে!” করেণুমতীর চোখ দুটি নত হোল ভুলে গিয়েছিল সে গত কাল সেই রেবা নাম্নী দাসীটির প্রতি তার তীব্র ভর্ৎসনা, যে বীতিহোত্র শুনতে পেয়েছিলেন, বোঝেনি সে

বীতিহোত্র তখনও স্তব্ধ হলেন না “তোমার জন্মসূত্রে লাভ করা বৈভব ও ক্ষমতার কারণে তুমি মানুষের মূল্যায়ন করতে পারছ না নিজেকে যাবতীয় ঘটনার কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে ভাবছ, তোমার প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ীই পৃথিবীর চলা উচিত তোমার অধস্তন মানুষগুলিকে, তাদের অস্বচ্ছলতা ও দুর্বলতার কারণে মনে করছ চলন্ত পুতুল, যারা পরিচালিত হবে, তোমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে ভুল এ ভাবনা কন্যা অবাস্তব এবং বিধ্বংসী তোমার নিজের পক্ষে যেমন, তেমনি বিশ্বচরাচরের পক্ষেও

নিমেষে ম্লান হয়ে গেল করেণুমতী গাঢ় হীনমন্যতা আক্রমণ করল তাকে ঐ বিগত মুহূর্তগুলিতে, শুভবোধ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল সে, তাই গ্লানি আচ্ছন্ন করল তাকে

বীতিহোত্রের নিঃশব্দ মন শুধু বলে চলেছিল একটি বীজ বপন করলাম মঙ্গলচেতনার বীজ জানি না দীর্ঘজীবি  মহীরুহ হয়ে উঠবে কিনা! শুধু এক প্রয়াস আর কিই বা করতে পারি এই উচ্ছৃঙ্খল, নিষ্ঠুর, ভোগসর্বস্ব রাজপরিবারের আবহে হে ঈশ্বর, এই কন্যা যেন নষ্ট হয়ে না যায়, এর মুখে আমি স্বর্গের আলো দেখেছি


ষষ্ঠ অধ্যায়


এই তো সেদিন, অল্পকাল আগের কথা, এখানে ছিল গহন অরণ্য বাস করত বন্য প্রাণী আর অসভ্য উলঙ্গ মানুষের দল এই খান্ডব বনের সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকেরা বলত, রাত্রে জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসত হিংস্র জন্তুর গর্জন বনের সীমানা পেরিয়ে কখনও বাঘ এসে নিয়ে গেছে তাদের গৃহপালিত পশুকে, এমনও হয়েছে আগে সতর্কতা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলসন্ধ্যা ঘনাবার আগেই কুটিরের দুয়ার দিত তারা গরু, বাছরগুলিকে গোহালে ঢোকাত

কিছু দিন আগে অরণ্যের অনেকখানি অংশের বৃক্ষগুলি বিনষ্ট করে, শুরু হয়েছে প্রাসাদ নির্মাণ রাজাদের প্রমোদ ভবন লোকজন মিস্ত্রি মজুরের আসা যাওয়ায় সে স্থান সারা সকাল মুখরিত হয়ে থাকত 

কিন্তু গত বছর এক ঝক্‌ঝকে শীতের দুপুরে  ঘটল ভয়ঙ্কর এক ঘটনা  দুঃস্বপ্নেও যা ভাবা যায়নি ঐ নির্মাণের অঞ্চল থেকে সামান্য দূরবর্তী এক জনপদে গ্রামের সমর্থ পুরুষেরা সকলেই তখন শস্যক্ষেতে কাজে গিয়েছিল একটি কমবয়সী বৌ নিজের ঘুমন্ত শিশুকে দাওয়ায় শুইয়ে রেখে পাশে বসে কুলোয় চাল ঝাড়ছিল দু চার মুহূর্তের জন্য ঘরের ভিতরে গিয়েছিল সে ফিরে দেখে শিশু নাই তার চিৎকার শুনে আশেপাশের অন্য কুটিরগুলি থেকে মেয়েরা ছুটে এল তারপরেই একটি ত্রস্ত মুখের বালক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে বলল,- দক্ষিণের পুকুর পাড় দিয়ে একটা বুনো লোককে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখেছে সে এইমাত্র তার কাঁধে ঝুলছিল শিশুর নিথর শরীর আতঙ্কিত কান্নার রব ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে খবর পেয়ে গ্রামের পুরুষেরা দ্রুত ফিরে এল লাঠি, বল্লম, তির, ধনুক নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকেছিল তারা বেশী দূর যেতে হোল না একটা গাছের গোড়ায় পড়েছিল কচি শিশুটির রক্তাক্ত শরীর সে কি বীভৎস দৃশ্য! নিষ্ঠুর ভাবে তার নাক, কান, হাত, পায়ের আঙুলগুলো কামড়ে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল নরখাদক মানুষের কাহিনি বিদ্যুদ্বেগে ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে আতঙ্কে কাঁটা হয়ে গিয়েছিল গ্রামবাসীরা তড়িঘড়ি এক জমায়েত বসল রাজসভাতে খবর দিতে হবে!

এখন নূতন রাজা এখানে পান্ডুরাজার ছেলেরা সদ্য কয়েক বছর হোল এসেছেলোকে এতকাল জানত, হস্তিনাপুরের অন্ধরাজার মরা ভাইয়ের বৌ আর ছেলেগুলিও সব ঘরে আগুন লেগে পুড়ে মরেছে কেউ বলত  অন্ধ রাজার গোঁয়ার বড় ছেলেটাই নাকি ষড় করে এমন কান্ড ঘটিয়েছে তারপর কত আজব কথা শোনা গেল ওরা বুঝি জ্যান্তই ছিল দেশে দেশে লুকিয়ে ঘুরে বেড়াত, অন্ধরাজার ছেলেদের ভয়ে তারপরে কি আজব কান্ড! এখন শোনা যাচ্ছে, পরমা সুন্দরী এক রাজকন্যেকে সব কটা ভাই মিলে বিয়ে করে হঠাৎ হাজির হয়েছে জ্যাঠার বাড়িতে অন্ধ রাজা ইদানীং বুঝি খুব খাতির করছে ভাইপোদের রাজা শ্বশুর এখন তাদের মুরুব্বি যে! লোক লসকর সেপাই সান্ত্রী কিছুরই আজকাল অভাব নেই কিনা তাদেরঅন্ধরাজা তাই ভয়ে ভয়ে ভাইপোদের নিজের রাজ্যির আদ্ধেক দিয়ে দিয়েছে এসব কথা ভাসা ভাসা উড়ো খবর হয়ে কানে আসে গাঁয়ের লোকের তা রাজাগজার কান্ডকারখানা নিয়ে অত মাথা ব্যথা নেই তাদের যে রাজাই রাজত্ব করুক না কেন, শান্তিতে থাকতে পারলেই তারা খুশীকয়েক গাঁয়ের মোড়ল একজোট হয়ে পরামর্শ চালাল, তারপর যুধিষ্ঠির রাজার সভায় খবরটি পৌঁছে দেওয়া হোল  পরের দিনই এক রাজপুরুষ এসে হাজির এক দল সেপাই নিয়ে লম্বা চওড়া চেহারা তাদের পাকানো গোঁফ মাথায় পাগড়ি হাতে নানান রকমের অস্ত্র গাঁয়ের লোক অমন সব অস্তর চোখেও দেখেনি আগে

গ্রাম আর বনের সীমান্তে যে মাঠ আছে সেখানে সৈন্যদের ছাউনি পড়ল শুরু হোল জোরদার পাহারা কিছু দিন শান্তিতেই কাটল বটে, কিন্তু কয়েক দিন পরেই আবার হাহাকার জেগে উঠল ওই অঞ্চলে পাশের গ্রামের শিশু চুরি গেছে তারও ঐ প্রথমজনের মতোই ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল বনের মধ্যে সৈন্যরা বনের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েও কারোর দেখা পেল না গভীর সে অরণ্য দিনের বেলাতেও আলো আসে না সে জটিল বনপথেঅচেনা মানুষ দিশা পায় না সেখানেহঠাৎ ঝাঁকড়া  মাথা গাছের উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসতে লাগল অজস্র বিষ তির অনেক সৈন্য নিহত হোল মুহূর্তের মধ্যে বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বাঁচল ঐ অসভ্য জংলি মানুষেরা যে, সুশিক্ষিত সৈন্যদলকে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে ধ্বংস করতে পারে তা ভাবেনি কেউ আরো বৃহৎ ও দক্ষ সৈন্যদল এল কিন্তু এই অরণ্যসীমা এত বিস্তীর্ণ যে তা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রাখা কঠিন গাঁয়ের মানুষ জানে যে, এত ঘন এ বনপথে, অশ্বারোহী সৈন্যের পক্ষে  প্রবেশ করা অসম্ভব এরই মধ্যে তৃতীয় শিশু হত্যার খবরটি এল 

তীব্র আলোড়ন জাগল সারা অঞ্চল জুড়ে বন্য মানুষেরা বহু শতাব্দী ধরেই গভীর অরণ্যে বাস করে আসছে গ্রামের সীমানায় তো পা দেয়নি তারা আগে হঠাৎ গ্রামবাসীদের প্রতি এমন তীব্র আক্রোশ জেগে উঠল কেন তাদের! তবে কি নরমাংসলোলুপ কোনো রাক্ষসের আবির্ভাব হয়েছে? নানা গল্পকথা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে অনেকে আবার বলতে লাগল, কে না জানে যে রাজার পাপে প্রজার শাস্তি! পাপ ঢুকেছে যে রাজসংসারে যে গৃহে একটা স্ত্রীলোক পাঁচ পাঁচটা পুরুষকে নিয়ে ভোগলীলা চালায় সেখানে তো সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবেই নয়তো আগে কি কখনও এ অঞ্চলে ঘটেছে এমন বীভৎস ঘটনা! আর যেই না পান্ডবভাইরা এ দেশে এল তখনই যত অঘটনের শুরু! “শেষের দিন ঘনিয়ে এসেছে হে রাজার পাপে মরে উজোড় হয়ে যাবে সব হাওয়ায় পোড়া গন্ধ পাচ্ছ না? আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়েছে প্রলয়কালের আর দেরি নেই বলাবলি করতে লাগল মানুষজন ধিকিধিকি আগুনের মতো চাপা অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে

সুদক্ষ চরেরা রাজপুরীতে পৌঁছে দিলে সে খবর যুধিষ্ঠির মুহ্যমান রাজনীতি সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অল্পপুঁথিগত বিদ্যাই সম্বল একটি রাজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে কত যে সূক্ষ্ম ও জটিল পরিকল্পনার প্রয়োজন তা এখন বুঝতে পারছেন তাঁরা ক্ষিপ্রবেগা অশ্বারোহী সংবাদবাহক যুধিষ্ঠিরের পত্র নিয়ে ছুটে চলল দ্বারকাপুরীতে সেই প্রথম দেখার দিনটি থেকে কৃষ্ণ, হয়ে উঠেছেন এঁদের বন্ধু ছাড়াও অভিভাবকস্বরূপও যেন পান্ডবদের মনে শ্রদ্ধা প্রীতিতে এই মানুষটির স্থান খুব উঁচু  স্বয়ং কুন্তী পর্যন্ত তাঁর সদ্যোপরিচিত এই ভ্রাতুষ্পুত্রটির উপর বড় আস্থাবতী

খুব দ্রুত ও আকস্মিক ঘটে যাওয়া তাঁদের এই উত্থান পর্বে, ভ্রাম্যমান গুপ্ত জীবন থেকে তাঁরা এমন সমৃদ্ধপূর্ণ অবস্থায় স্থিতিলাভ করেছেন জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র খুবই চতুরপাঞ্চালরাজকন্যাকে পান্ডুপুত্রেরা পত্নীরূপে পেয়েছেন এ তথ্য শোনার পরই তিনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন ভাগ্যের দান উলটে গেছে সেই সহায় সম্বলহীন বালকগুলি এখন বিপুল ঐশ্বর্য ও সামাজিক প্রতিপত্তির অধিকারী রাজা দ্রুপদের রণশক্তি তাদের সঙ্গে রয়েছে এই মুহূর্তে তাদের বিরোধিতা করার আর আত্মহননের দরজা খুলে দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য নাই কুটিল অন্ধ মানুষটি তাই কপট হাসিতে মুখ ভরিয়ে সমাদর করে ভ্রাতুষ্পুত্রদের ডেকে এনেছেন আন্তরিক অনিচ্ছা সত্বেও কুরুকুলের একটি অংশ, খান্ডবপ্রস্থ প্রদান করতে বাধ্য হয়েছেন

জীবনের এই পর্ব থেকে পর্বান্তরের মধ্যে বারবার তাঁরা কৃষ্ণের পরামর্শ পেয়েছেন বড় শান্তিতে,  সমৃদ্ধিতে দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল পরমা রূপবতী মনস্বিনী দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর প্রতিই প্রীতিমতী তাঁর আচরণে কারোর প্রতি পক্ষপাত দেখা যায় না পঞ্চভ্রাতারই পুত্র লাভ হয়েছে ভাইদের পরস্পরের মধ্যে সেই বাল্যকালের হৃদ্যতা আজও অক্ষুন্ন নিকটবর্তী রাজ্যগুলির রাজারা সকলেই তাঁদের বশংবদ প্রজাকুল অনুগত আর কি চাইবার থাকে এই  মানবজীবনে! তারই মধ্যে সহসা এ কি অশান্তি? বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তাঁদের মন

দূতের হাতে যুধিষ্ঠিরের পত্র পেয়ে কৃষ্ণ এলেন দীর্ঘ পথে আসার সময়েই এ সমস্যা সমাধানের একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি কিন্তু মানুষটি তীক্ষ্ণধী রাজনীতি, মানব মনস্তত্ব সকল বিষয়েই জ্ঞান প্রচুর খান্ডবপ্রস্থের রাজভবনে পৌঁছে, প্রথমেই যুধিষ্ঠিরকে নিজের পরিকল্পনার কথা খুলে বললেন না তাই প্রথম দু দিন স্বজনদের গাঢ় অভ্যর্থনা ও বিশ্রামে কাটল তিনি যে এখন সম্পর্কে অর্জুনের শ্যালকও তাঁর ভগিনী সুভদ্রা অর্জুনের পত্নী হয়েছেনএই পান্ডুপুত্রটির সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা যেন একটু অধিক আর পঞ্চপান্ডবের পত্নী, পাঞ্চাল রাজকুমারীকে তিনি সখি বলে সম্বোধন করেন দুজনের মধ্যে রয়েছে সুন্দর এক সম্পর্ক দুটি মানুষের মানস-তরঙ্গ মিলে গেলে যেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠে গভীর ভাবনার বিনিময়, রঙ্গ, কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁদের একত্র থাকার মুহূর্তগুলি শুধু রূপ নয়, এই অসামান্যা নারী অসাধারণ বুদ্ধিমতীও নারীর রূপের অপেক্ষা মননের বিভা তাঁর মতো পুরুষকে অধিক আকর্ষণ করে  খান্ডবপ্রস্থে আগমনের তৃতীয় দিনে, অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণ যমুনাতীরে ভ্রমণে গেলেন নিভৃতে কিছু বাক্য বিনিময়, গূঢ় আলোচনা হোল

পরের দিন অরণ্যসীমান্তবর্তী গ্রামে গ্রামে ঘোষণা করা হোল রাজার বার্তাআগামী পূর্ণিমার সকালে, গ্রামপ্রধানদের অরণ্য সংলগ্ন বিশাল প্রান্তরে সমবেত হবার নির্দেশ এসেছে   

নিদাঘ কাল এখন তাই দিনের প্রথম প্রহরেই সম্মিলিত হয়েছিলেন সকলে গাঁয়ের লোকে সেই প্রথম দেখলে কৃষ্ণাজুর্নকে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল তারা আহা কি রূপ! কি রূপ! আর চেহারাতেও কি মিল! তারা প্রথমে ভেবেছিল আপন মায়ের পেটের ভাই বুঝি পরে জেনেছিল তা নয় শালা-ভগ্নিপোত দুজনেই দীর্ঘকায়, সুঠাম গড়ন, আষাঢ়ের মেঘের মতো গায়ের বণ্ণ টানা টানা চোখ টিকলো নাক দৃঢ় চিবুক আর গ্রীবা উঁচু মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা পাশাপাশি, যেন কোন অচিন পুরীর জোড়া থামগ্রামবাসীদের মনে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে, গত কয়েক মাস ধরে যে বিদ্বেষ ঘনিয়ে উঠেছিল, তাঁদের দিকে চোখ পড়তে নিমেষে মিলিয়ে গেল তা তাঁদের সুন্দর মুখে বিষাদ সামনের মানুষগুলির যন্ত্রণা যেন অনুভব করছেন তাঁরা গ্রামবাসীদের সকল বিপদের ত্রাতা তাঁরাই বুঝি! সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল গ্রামের মানুষ

কৃষ্ণ নিজের ডান হাতটি বরাভয়ের ভঙ্গীতে উপরে তুললেন জনতার গুঞ্জন শুরু হোল “ইটি কেষ্ট গো, সুমুদ্দুরের ধারে দ্বারকা রাজ্যি আছে, সেখানকার রাজা খুব ভাবসাব পান্ডু রাজার ছেলেদের সঙ্গে”- মৃদু গুঞ্জন শুরু হোল

তারপর কৃষ্ণ শুরু করলেন নিজের বক্তব্য তাঁর উদাত্ত, মধুর কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল নদীতীরের সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে থেমে গেল সব গুঞ্জন গ্রামবাসী মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্তব্ধ হয়ে রইল

“আমার প্রিয় মানুষগুলি, আমি মর্মাহত আমরা তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমরা রক্ষা করতে পারিনি তিনটি নিষ্পাপ শিশুকে আমাদের সন্তান যারা মাংস-লোলুপ রাক্ষস তাদের কচি শরীর তীক্ষ্ণ দাঁতে চিবিয়ে খেয়েছে সে ভয়ানক পাপে স্বর্গের দেবতারা পর্যন্ত শিউরে উঠেছেন ক্রুদ্ধ অগ্নি দেবতা আজ আমাদের সহায় মহাক্ষুধায় তিনি অধীর ওই বনভূমি দগ্ধ করে, নির্মম রাক্ষসদের জীবন্ত গ্রাস করলে তবেই তাঁর ক্ষুধা-শান্তি আমরা সে ইঙ্গিত পেয়েছি তোমাদের আতঙ্কের মূল উপড়ে ফেলতে হবে অগ্নিদেবতার করুণায় ধ্বংস হবে অন্ধকারময় এই মহারণ্য সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠবে চারি দিক বিশাল যজ্ঞসভা গড়ে তুলব আমরা এই স্থানে আকাশে ধ্বনিত হবে দেবতার বন্দনা গাথা হোমের পবিত্র ধূমের গন্ধে ছেয়ে যাবে আকাশতল আরো ভাব হে গ্রামবাসীগণ বুদ্ধিমান পুরুষ তোমরা ভেবে দেখ এই নির্মাণের বিনিময়ে কত লাভবান হবে তোমরা ভবিষ্যতে তোমাদের মধ্যে আছ যে সব নিপুণ কারিগর, দক্ষ শিল্পী, কুশলী স্থপতি এই মহা কর্মকান্ডে নিযুক্ত হবে তারা উচ্চ হারে পারিশ্রমিক পাবে মাটির কুটিরের বদলে তখন ইঁটের তৈরি সুন্দর ভবনে বাস করবে ক্ষীর, মাংস খাবে প্রত্যহ তোমাদের নারীরা গলায় ঝোলাবে মুকুতার মালা এখানে স্থাপিত হবে কত বিপণি নৃত্যগীতশালা নাট্যসভা আলোক ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে চারি দিক নয়তো সর্বদাই এমন আতঙ্ক বুকে পুষে রেখে কতকাল কাটাবে তোমরা? প্রতিমুহূর্তে ত্রস্ত হয়ে উঠেছে যে তোমাদের জীবন! তোমাদের দিনে শান্তি নাই রাত্রে নিদ্রা নাই তোমাদের মুখে যে আমি দেখছি চরম ক্লান্তির ছাপ চোখের কোলে কালি আর অধিক অপেক্ষা করতে হবে না তোমাদের জীবনে সুন্দর এক শান্তিময়, সমৃদ্ধ কাল আসন্ন”- সমস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠল জনতা  

 

ক্রমশ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ