মহীনের
ঘোড়াগুলি
(১)
দুপুর গড়িয়ে যাবে জেনেও মহীন রেডিওটা বুকে চেপে কারখানার গেটে বসে
থাকে । মাথার ওপর দিয়ে একটা কী পাখি তীক্ষ্ণ চিৎকার ছুঁড়ে বাজারের ওপর উড়ে যায় ।
আকাশের গায়ে হলদে ছোপ ধরতে শুরু করেছে দেখে ভাঙাচোরা চেয়ারটা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়
মহীন, আড়মোড়া ভাঙে । ওর দেখাদেখি কারখানার কেয়ারটেকার রিদ্দিমান বাবুর বেড়ালটাও
আড়মোড়া ভাঙে । বেড়ালটা হেব্বি নকল করে — সবাই বলে কপি-ক্যাট ! রিদ্দিমান বাবুর আসল
নাম-টা যে ঋদ্ধিমান, মহীনের কাছে এটা যেমন অপ্রয়োজনীয় বিষয়, তেমনি ও যেখানে
দারোয়ানের কাজ করে সেখানে ঠিক কী হয় তা নিয়েও ওর কোনো জিজ্ঞাসা নেই । এরকম একটা
প্রশ্নচিহ্নহীন নির্বিকার মানুষকে পেয়ে কারখানার বাবুদের লাভই হয়েছে বলতে হয় ।
নির্বিকার মহীন এক লাথিতে অবলা জীবটিকে দুহাত দূরে সরিয়ে দিয়ে হাই তোলে, ওর দেখাদেখি বেড়ালটাও । অদূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জিন্স আর টি-শার্টে ঝকঝকে
ঋদ্ধিমান কবিতা আওড়ায় । বেড়ালটাকে লাথি মারার ঘটনাটা দেখেও দেখে না । মহীনের এই
কবি-কবি লোকটাকে বশ লাগে ।
মহীনের বাবা ছিল ওস্তাদ ঘোড়সওয়ার, দারুণ ভালো ছিল তার চেহারা ।
কিন্তু লোকটা জীবনে কাজের কাজ কিছুই করল না । বউ-পালানো লোকটা তিনটে বাচ্ছা আর
একটা মাদী ঘোড়া নিয়ে এই পাহাড়ী
শহরতলির ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় ঘুড়ে বেড়াতো । বাচ্ছারাই বেশি চাপতো, দু-পয়সা আসতো
এভাবেই । মাদী ঘোড়া-টা লোকটার আগুপিছু
মরলো । ওরকমটা হতই কারণ তার বাপ বা ঘোড়াগুলো — কেউই সেই অর্থে খেতে পেত না । তারপর
বাপ-টা গেল জ্বরে ভুগে আর মহীন এই বিরাট জগৎটায় একেবারে একলা হয়ে গেল । রেডিওয়
কিশোরের গান শোনা আর তিনটে ঘোড়া আগলে আগলে রাখা ছাড়া মহীনের জগতে আর কর্তব্য বলে
কিছু রইলো না । উত্তর-আধুনিক যুগ না এসে
পড়লে এমন হতভাগা, বছর বাইশের যুবক-কে নিয়ে গল্প ফাঁদার সুযোগও হত না । কিন্তু গল্পটা তৈরি হল কারণ মহীন একটা বেমক্কা
ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো, আর তার ঘোড়াগুলোও !
বাজারের মুখটা অবদি টলতে টলতে নামে মহীন । ওর পা দুটো বরাবরই বড্ড
সরু । সেইজন্যই ওর ঘোড়ায় চাপা হয় নি । ওর হাঁটতে অসুবিধা হয় । তাই ছেলেবেলা থেকেই
ও বসে থাকতে বেশি পছন্দ করে । ওর বাবা সন্ধ্যা নাগাদ ওকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসে
পাকদন্ডী বেয়ে ঘুরতো । কিন্তু ওকে একা চাপতে দিত না । মহীন কখনো ডাক্তার দেখায় নি
। ওরা সাধারণত ডাক্তার-ফাক্তার দেখায় না । মরার আগে অবিশ্যি ওর বাপ ডাক্তারখানায়
একবার গিয়েছিল, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল । মহীনের যত বয়স বাড়ছে ততই ওর
শরীরের ওপর দিকটা ভারী হচ্ছে । আর ততই ওর হাঁটাচলা রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠছে ।
বাজারটা ঢালুপথে নেমে বাঁদিকে । প্রবেশপথে একটা রেশন দোকান । তার
সামনে ক্যারম বোর্ডের ওপর একথালা মোমো সাজিয়ে কয়েকটি ছেলে খাচ্ছে । সূর্যের নিভু
নিভু আলোয় মুখগুলো অচেনা লাগে । মহীনের সন্দেহ হয় ওরা তাকেই দেখছে । ওদের মধ্যে
দলপতি যে, সেই চরণ দাস কর্পোরেশনের স্যুইপার । সে এগিয়ে এসে বলে, কিরে শালো মোমো
কাবি ? ও ‘খ’-কে ‘ক’ বলে ।
মহীন অস্বস্তির সাথে ‘না’ বলে ।
চরণ হাসির সুর তুলে মন্তব্য করে, কিঁউ বে লেংড়া ?
মজিদ বলে একটা ছেলে অন্ধকার পিছনে রেখে এগিয়ে আসে, বলে — এবার কাজের
কথাটা হোক !
মহীনের চোখে এতক্ষণে একটা ছোট্ট প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয় । কী চায় এরা ?
চরণ বলে, মইন ছোট্ট কাজ বাই । সেরম কিছু না । জাস্ট কারকানার চাবিটা
কাল রাতে একটু আমাদের দিতে হবে ওই দেড়টা নাগাদ ।
মহীন অজানা কিছুর আশঙ্কায় দু-পা পিছিয়ে থেমে যায় । আগামীকাল যে তার
নাইট ডিউটি এরা তাহলে সেটাও জানে !
মহীন শুধু বলে, কেন ?
এবার আরেকটা চেহারা দোকানের অন্ধকার থেকে বাইরের আলোয় উদয় হয় । বিরাট
চেহারার নিমাই । নিমাই-এর হাতের গুলিগুলো যেন মহীন-কে সতর্ক করে । নিমাই ওর দিকে
চেয়ে থাকে, কিছু বলে না । মহীন আরেক পা পিছোতেই সে এগিয়ে এসে মহীনের চোয়ালের নীচটা
চেপে ধরে । মুখে বলে, এই বাল যা বলছে করবি, ব্যাস ।
মহীন সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে । চরণ দাস একটা পেনসিল টর্চ বের করে আলোটা
মাটিতে ফেলে । বলে, এই আলোটা রাত দেড়টা নাগাদ কারকানায় পৌঁছে যাবে । তুই শালো শুধু
আলোটার হাতে চাবিটা থামিয়ে দিবি । বুঝলা শালো ?
মহীন তার মুখটাকে নিমাইয়ের হাতের পাঁচটা শক্তিশালী আঙুল থেকে মুক্ত
করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে,
‘আচ্চা ।’
(২)
মহীন তার নড়বড়ে ঘরটায়
ঢোকে । তার শোবার ঘর আর রান্নাঘর মিলিয়ে যতটা জায়গা, তার দ্বিগুন জায়গা জুড়ে তিনটে
ঘোড়া থাকে । মহীন ওদের খাবার নিয়ে ওদের ঘরে ঢোকে । এই কাজটুকু সারলেই মহীনের আজকের
মত কর্তব্য শেষ । তারপর ও একটু নেশা করে ঘুমিয়ে পড়বে । তিন জনের মধ্যে যেটি সবচেয়ে
তাগড়া, সে সবার আগে এগিয়ে আসে । তার চোয়াল আর দাঁতগুলো বিশ্রীভাবে বের করে মুখ
বেঁকায় দু-তিনবার । মহীনের হাতের হ্যারিকেনের আলো ঝিলিক মারে ওর দাঁতগুলোয়, মনে হয়
যেন হাসছে । বাকি দুটো এবার তাদের বদন বাড়িয়ে দেয় । মহীন ওদের খেতে দেয়, ওদের জন্য
ছোট্ট চৌবাচ্চা আছে, তাতে মহীন জল ঢেলে দেয় । কিছু খাবার খায়, কিছুটা ছড়ায় । মহীন ওদের নাকের ওপর থেকে, বিস্তৃত
চোয়ালের বাইরেটা থেকে যেটুকু লেগে ছিল, ঝেড়ে দেয় । গায়ে-গলায় হাত বুলিয়ে দিলে বা
খামছে দিলে প্রথমে ওরা সামনের দুটো পা ঠোকে, তারপর লেজ নাড়ায় । একটা অদ্ভুত গন্ধ
এই ঘরে, এই গন্ধটা মহীনের মন থেকে বাইরের পৃথিবীর যাবতীয় শঠতা মুছে দেয় । মহীন
এরপর ওর একমাত্র বিলাসিতা চরিতার্থ করতে সবচেয়ে গায়ে-গতরে ঘোড়াখানার পিঠে ওঠে অতি
কষ্টে । এই ধরণের কাজগুলো করতে গেলেই ওর কোমর থেকে শরীরের বাকি অংশ তীব্র প্রতিবাদ
জানায় । কিন্তু মহীন জানে, জানোয়ারগুলোই তাকে একমাত্র সেইসব জায়গায় নিয়ে যেতে
পারে, যেখানে মহীন-ও একজন টগবগে ঘোড়সওয়ার । আধো অন্ধকারে ঘোড়ার পিঠে বসে সে দুচোখ
বন্ধ করে থেমে থেমে উচ্চারণ করে, চল্ দুলকি বিলের ধারে চল্ । তারপর ওর চারপাশ থেকে
মিনিটখানেকের জন্য ধীরে ধীরে সব মুছে যায় । ওর ঘোড়াটা হয়ে যায় পক্ষীরাজ । তার
ডানার ঝাপটায় ওর ঘরের টিনের বেড়া মড়মড় করে ওঠে । ও উড়ে যায় বিলের ধারে । সেখানে
সতেজ ঘাস । সূর্যরশ্মি অনেক অনেক প্রাণবন্ত । বাকি ঘোড়াদুটোও ওদের অনুসরণ করে । ও
চোখ বুজে এই আমেজটা অনুভব করে, একদম একলা, সেই ছেলেবেলা থেকে । এই ঘোড়াগুলোর সাথে
ও-ও বড়ো হয়েছে । এই তিনটে ঘোড়ার মা আর ওর বাপ আগুপিছু গত হয়েছে । এখন এই স্বপ্নটা
ওর একার । গত পনেরো বছর ধরে ও এই স্বপ্নটা দেখে চলেছে । ও নিশ্চিত জানে, ভাগ্য আর
যাই কাড়ুক, এই স্বপ্নটা ওর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না ।
(৩)
নিভন্ত কাঠকুটোগুলো লোহার আঁকশিটা দিয়ে খুঁচিয়ে আগুনটা একটু বাড়িয়ে
মহীন রেডিওটা ফের বুকের কাছে চেপে ধরে । রাত বাড়ছে । দেড়টা হয়েছে কিনা, তা ওর জানা
নেই । কিন্তু একটু আগে দূরে স্টেশনে একটা কুড়ির ট্রেনটা বেড়িয়ে গেছে । সপ্তাহে
তিনদিন এই আওয়াজটা একটু আগে-পরে শোনে ও । মহীন প্রাচীনপন্থী, মোবাইল নিয়ে নেড়েচেড়ে
দেখেছে বটে । কিন্তু বেজে উঠলেই ওর হাত কাঁপে । স্যুইচ টেপার ব্যাপারটা ওর ধাঁধার
মত লাগে । তাই ওর জীবনে ওসব বাদ । এফ্ এম্ চ্যানেলগুলো ওকে মানসিকভাবে নব্বইয়ের
দশকে বেঁধে রেখেছে ।
সহসা একটা আলো দুলতে দুলতে এসে ওর মুখে পড়ে । একটা গলা মৃদুকণ্ঠে বলে,
চাবি দে শালো । মহীন অসুস্থ বোধ করে । আলোটা তির্যকভাবে ওর মুখে এসে পড়ে আর
বিন্দুমাত্র দেরি না করে নাচতে থাকে । তারপর ফের হুমকি আসে, কি বে ! কাবি নাকি
কানের গোড়ায় থাবড়া ?
মহীন এবার ওর গোলমেলে পা দুটো টেনে উঠে দাঁড়ায় । চাবিটা দড়িবাঁধা
প্যান্টের পকেট থেকে বের করে চরণের হাতে দেয় । চরণ চাবিটা দেখবে বলে আলোটা ওর দিক
থেকে সরাতেই হঠাৎ মহীনের মাথাটা বেইমানি করে ওর সাথে । ওকে পালাতে বলে । মহীন ভুলে
যায় ওর পা দুটো ওকে পালাবার অনুমতি দেবে না । যে মানুষের শরীরের
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো এরকম বেইমান হয়, তার মত হতভাগা আর হয় না ! মহীন পা টেনে টেনে
কিছুটা এগোয়, তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে । আর তখনি ও একটা গলা শুনতে পায়, “আমরা যাইনি
ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয় / মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের
জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, / প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে / পৃথিবীর
কিমাকার ডাইনামোর ’পরে । / আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়… ”
রিদ্দিমান বাবুর গলা না ! কবিতা আর কেই-বা বলবে এ তল্লাটে ! আশ্বস্ত
মহীন ওঠার চেষ্টাও করে না । তার ভূলুন্ঠিত দৃষ্টিপথে কতকগুলো পা হিঁচড়ে বের করে
আনে কতকগুলো প্যাকিং বাক্স । একটু ওষুধ-ওষুধ গন্ধ ভেসে আসে মহীনের ঘ্রাণে । কেউ
কোনো কথা বলছে না । এসময় একটা মুখ ঝুঁকে পড়ে তার মুখের উপরে । মুখে চেনা সিগারেটের
গন্ধটাও সাক্ষী দেয় এ রিদ্দিমান বাবু-ই । রিদ্দিমান নিজের মুখে টর্চের আলোটা ফেলে
নিজেকে অচেনা করে তোলে । মহীন ওঠার চেষ্টা করে এবার । রিদ্দিমান ওর দিকে একটা হাত
বাড়িয়ে দেয় । মহীনও ওর বাইশ বছর বয়সী হাতটা বাড়িয়ে দেয় । কিন্তু একটা বিশ্রী
রসিকতার মত রিদ্দিমান ওর নিজের হাতটা সরিয়ে নেয় । মহীনের মাথায় কিছু ঢোকে না, কি
হচ্ছে কেন হচ্ছে ! আর ওর মাথাটাকে একেবারে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যই বোধহয় রিদ্দিমান
বলে ওঠে, ‘মার’ ।
চরণ দাসের গলাটা শেষতম কন্ঠস্বর হয়ে কানে আসে মহীনের, ‘মর্ শালো ।’
(৪)
একটা ঢালু উপত্যকায় মহীন দাঁড়িয়ে আছে । একটু দূরে নরম মাটির বুক থেকে
তাজা ঘাস ছিঁড়ে নেওয়ার শব্দ হয় । জ্যোৎস্নায় প্লাবিত সবুজে মহীন পা ফেলে এগিয়ে যায়
সেই শব্দের দিকে । ওর তিনটে ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে । দুলকি আরো নেমে যায় ঢালু বেয়ে ।
একটা সরু বিল । চাঁদের দুধ ঐ জলে মিশছে আর দইয়ের মত যেন জমে যাচ্ছে । মহীন ভাবে,
কোথাও হাওয়া নেই কেন ? চাঁদের আলোয় দৃশ্যমান বিলের জলের শব্দ গেল কই ? ব্যাপারটা
আজব লাগে তার । এসময় দুলকি ডেকে ওঠে । সে সাধারণত ডাকে না । আজ তার হ্রেষাধ্বনি
তীব্র, গগনভেদী । তার পিঠ থেকে দুদিকে ব্যপ্ত হয় দুটি বিশাল ডানা । পালকগুলো
তিরিতিরি কাঁপে । দুলকি ডানাদুটো ঝাপটায় । মহীনকে আহ্বান করে । মহীন অনুভব করে তার
দুপায়ে অমিত বল আজ । সে সাবলীল গতিতে এগিয়ে যায় দুলকির দিকে । দুলকি ডন দেবার
ভঙ্গিতে শরীরটা টানটান করে একবার ঝুঁকে । মহীন তার পিঠে হাত রাখে, সে বুঝতে পারে,
এই স্বপ্নটা কোনোদিন শেষ হবে না… ।
অভিষেক ঘোষ