জীবননাট্যে স্বয়ং নট
দেখতে দেখতে প্রায় তিরিশ বছরেরও
বেশি নাটকের সাথে কাটিয়েছেন সুজিত বসাক। কখনও নিজে অভিনয় করেছেন,কখনও নির্দেশনা। নিজের গল্প নিয়ে
নাটক-তারও সংখ্যা কম নয়। আজ হঠাৎ কী যে হল!যে সংলাপ কবিতা আবৃত্তির মত মুখস্থ
ছিল,কেমন করে যে ভুলে গেলেন কে জানে। আর ধারা নাটকে সংলাপের লিঙ্ক ফেল করলে পরের
অভিনেতাকে কীরকম নাকানিচোবানি খেতে হয় তা ওনার চেয়ে আর কে বেশি জানে?
গ্রীনরুম থেকে বেরিয়ে রাস্তায়
এসে একটা ঝুপড়িতে চা খেতে ঢোকেন সুজিত। নাটকের কুশীলব দুটো ছেলে এসে সামনের
বেঞ্চ দখলে নেয় – রাজনীতিতে রিটায়ারিং এজ নেই শুনেছি।
কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-নাটক এসবেও নেই, তা আজ জানলাম মাইরি। গুরু আজ কীরকম ঝোলাল
দেখলি? – ডিরেকশান দিচ্ছিস দে,মঞ্চে আর্ট
মারাতে গেলে কীরকম মাল ছড়ায় সে বোধ নেই মাইরী। পয়সা নিয়ে শো করছি,নেকস্ট
শোগুলোতে আর ভিড় হবে ?
তাড়াহুড়োতে ওরা খেয়াল
করেনি,ওদের ঠিক দুটো বেঞ্চ পরেই চায়ের কাপ হাতে এতদিনের মঞ্চ শাসন করা সুজিত বসাক
ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন। বয়স বছর দশেক কম হলে ছোকরা দুটোর ঘাড়ে হাত দিতেন
নির্ঘাত,কিন্তু বড় ক্লান্ত লাগে এখন। রবিবার বিকেলের এই শোয়ে একেবারে সামনের
সারিতে বিপাশা এসে কেন যে বসেছিল! নাটক ছেড়েছে তা প্রায় বছর পনেরো হল। কিন্তু নাটক ওকে ছাড়ল
কৈ? আর কী আক্কেল দেখ,ওরকম ফ্রন্ট
রোয়ে বসে কেউ ফিক ফিক করে হাসলে স্বয়ং শিশিরবাবুও ভুল বকতেন! মাথা
নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে আসেন ফুরিয়ে যাওয়া মানুষটা।একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকেন।
কোন নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার জন্য নয়,কিন্তু একটু ফাঁকা হতে চাইছিলেন।
নাটক নয়,জীবনটাই কি ভুল পথে চালিত হল? আজ এতদিন পরে এসে বড় কু ডাকছে মনটা।
– এই যে, অত তাড়া
কীসের?
চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতে বাধ্য হন সুজিত।
– না,তাড়া কিছু নেই কিন্তু
ফিরতে তো হবেই।
– ও, বৌদি খুব রাগী বুঝি?
– ও প্রসঙ্গ থাক। ফার্স্ট
রো-তে বসে ওরকমভাবে হাসে কেউ?দিলে তো আমার নাটকটার বারোটা বাজিয়ে?
– ও, এখন এটা শুধু তোমার
নাটক? তোমার সঙ্গে যে কো-অ্যাক্টরগুলো কাজ করে তারা কেউ না? তোমার
কনসেন্ট্রেশন নেই সেটা বলছ না কেন? মফঃস্বল শহরে শিশির ভাদুড়ী সেজে বসলেই
লোকে মেনে নেবে – একথা মনে হওয়ার কারণটা জানতে পারি?
– ভুল ধারণা। আমি নিজের
সম্বন্ধে কোন সাজানো মনোভাব নিয়ে বসে নেই। শিশিরবাবু আমাদের সবারই প্রণম্য,তার
সঙ্গে আমার তুলনা টানাই উচিত নয়। আমি জানি আজকের শো ফ্লপ করার জন্য সবাই আমাকেই
দায়ী করবে। কিন্তু সত্যি করে বলো তো, দোষ কি শুধু একা আমার?নাটকে আমার
ডেডিকেশন নিয়ে,আমার ইনভলভমেন্ট নিয়ে,আমার পারফর্মেন্স নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ
দিয়েছি কোনদিন!
– না, আগে দাও নি, কিন্তু আজ
দিয়েছো বলেই কথা উঠছে। আগে শো চলাকালীন মঞ্চের সামনে মারপিট শুরু হলেও তোমার
অভিনয় সাবলীল থাকত,তাই গন্ডোগোল শুরু হলেও তা অচিরেই থেমে যেত। তোমার দাপটে অন্যেরা
কুঁকড়ে থাকত,যথেষ্ঠ আত্মগরিমা ছিল তোমার,নিজেকে ছাড়া কাউকে মানুষ বলে ভাবতেই কষ্ট
হত তোমার।
– তোমার এরকম অভিযোগের ব্যাখ্যাটা
জানতে পারি?
– রিহার্সাল থেকে একদিন একটু
আগে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম বলে তুমি হো হো করে হেসে ঠাট্টা করে বলেছিলে – এটা
মঞ্চের নাটক,এতে জীবনের কথা আছে কিন্তু জীবন নেই। রিহার্সাল তার নিজের সময়ে শেষ
হবে। তোমার প্রয়োজন না থাকলে তুমি বরং দর্শক হিসেবে এসো,ফ্রি পাসের ব্যবস্থা
করে দেওয়া যাবে।
– ঠিক,ডিসিপ্লিন ছাড়া একটা
রাজনৈতিক সংগঠন যেমন এগোতে পারে না,নাটকের দলও ঠিক তেমনি। যে যার ইচ্ছা মত আসবে
যাবে,এভাবে দল চালানো যায় নাকি?
– দেড় ঘন্টা ট্রেন জার্নি
করে একা একটা মেয়ে ফেরার সময় বিপদে পড়লে কী হবে ভেবে দেখেছিলে
কোনদিন? বাস্তবের থেকে অনেক দূরে তুমি নিজেকে ইচ্ছে করে সরিয়ে রাখতে,তোমাকে
সহজে যাতে কেউ ছুঁতে না পারে। আসলে তুমি চরম ভীতু ছিলে কিন্তু আপাত খোলসটাকে এমন
করে বজায় রাখতে যে লোকে ভাবত তুমি অবতার। আমিই প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারি,আর
তাই আমার ওপরেই তোমার দাপুটে অত্যাচার। তাই প্রথম যেদিন তোমাকে আমার ভালবাসার
কথা জানাই,তুমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে – আমার শরীর খারাপ কিনা।
এমনকী আমাকে সবার হাসির খোরাক করে তুলবার জন্য জোর করে সুবীরকে আমার বাড়ী ফেরার
সময় সঙ্গে দিয়েছিলে। বলেছিল আমাকে ঠিকঠাক বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ও যেন তোমায়
ফোন করে কনফার্ম করে দেয়। নিজেকে অন্য জগতের বাসিন্দা প্রমাণ করার জন্য তোমার
সেকি আন্তরিক চেষ্টা! অন্য সবাই তারিফ করেছিল তোমার,কী সংযম!
– আমার জায়গায় অন্য কেউ
থাকলে সেদিন নির্ঘাত তোমার সর্বনাশ করে ছাড়ত।
– সেটার জন্যও হিম্মত লাগে
হে,ছিল তোমার?
– কী বলছো এসব? আমি
তোমার সাথে ভদ্রতা করেছিলাম,সেটাকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করছ তুমি।
– ভদ্রতা,মাই ফুট। একটা
মেয়ের খারাপ হতে গেলে যেমন সাহস লাগে, একটি পুরুষেরও তাই। তোমার সাহসটুকু ছাড়া আর
সব ছিল। নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে শুধু অহংকার দেখিয়ে তুমি ভেবেছিলে আর সবার মত
আমিও মাথা নীচু করে থাকব। ভুল! আমি জানতাম, তুমি ফুরিয়ে আসছ। তোমার এই হঠাৎ
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা,যাকে যা খুশি বলা – এসবের আড়ালে চরম ভয়ের শিকার
হয়ে উঠেছিলে তুমি। তোমাকে ধন্যবাদ জানাই,অন্তত একটা ভাল কাজের জন্য।
– কী কাজ?
– ভয়ে হোক আর তোমার নিজস্ব
সংশয়ে হোক,তুমি যে আর কাউকে নিজের জীবনে এনে তাকে বিপদে ফেল নি সেই জন্য।
১
– তার মানে আমার সব খবরই
সহগ্রহে আছে তোমার।
– হ্যাঁ,একসময় ভেবেছিলাম
চরম বিপদে ফেলব তোমায়। শহরের সবার সামনে তোমার এই মেকি রূপটাকে ছিঁড়ে দেখাব।
– থেমে গেলে কেন,জানতে পারি?
– সময়। আসলে সময় মানুষকে
অনেক সংযত করে দেয়। তার ইচ্ছে অনুযায়ী চলার ক্ষেত্রে তাকে বাধা দেয়। আর সব চেয়ে বড়
কারণ – একটা ফুরিয়ে যাওয়া মানুষকে আর কী শাস্তি দেব?
– আমি ফুরিয়ে গেছি
বলছ?একদিনের ব্যাড পারফরম্যান্স দেখে আমার সন্মন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা ভুল
হচ্ছে নাকি!
– তুমি অভিনয় জগতের মানুষ।
তাই তোমাকে তোমার ভাষাতেই বোঝাই। সত্যজিৎ রায়ের নাকি উত্তম কুমারের – কী
বলব,নায়ক সিনেমাটার কথা মনে আছে? একসময়ের সেরা অভিনেতা কী করে প্রাক্তন হয়ে
যায়,মনে পড়ে?
– আমি প্রাক্তন নই!আমি এখনও
অনেকদিন বাংলা মঞ্চকে আমার অভিনয় দেখিয়ে যাব। আই ক্যান চ্যালেঞ্জ এনিবডি অ্যারাউন্ড।
– আবার সেই লোক ভোলান
কথাবার্তা। কিন্তু তোমার চারপাশে আর কেউ নেই,চেয়ে দ্যাখ – এখন তুমি
একেবারে একা।
হঠাৎ একটা কাঁপুনি দেয় সুজিতের শরীরে। খেয়াল করে দেখেন সত্যি ওঁর চারপাশে আজ আর
কেউ নেই। অন্ধকার রাস্তায় ওঁর নিজের ছায়াটাই দীর্ঘ হতে হতে ওকে যেন গিলে ফেলে। আর
কিছু মনে পড়ে না সুজিতের।
0 মন্তব্যসমূহ