সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সুবল দত্ত


                              

                              নির্বাণ পথ  
                        ধারাবাহিক গদ্য  (পর্ব -১)       

     ॥প্রথম অধ্যায়॥ 

  বিচ্যুতি

Perineum/বিলয়/সাত সেকেন্ড
মৃত্যু তার দেহ থেকে মাত্র পাঁচ সেকেন্ড দূরে। কোমরের নিচে এখনো ভার।এখনো রাত দিন আকাশ ও ভয়ের অনুভব।প্রাণশক্তি ছেড়ে যাওয়ার অনুভব গহন চেতনাতে এখনো আসেনি কিন্তু এবার স্পষ্ট টের পেল তার অন্তর্মন তাকে আর আমল দিচ্ছে না। আগে যেমন হতো,চিন্তার গভীরে...আরো গভীরে অন্তর্মনেরইচ্ছেমতো ভেসে যাওয়া বা কোনো চিন্তা আবর্তে ঢুকে যাওয়া টের পেতেই সে সহজেই টেনে এনে নিজের কর্ম মতন চিন্তা ও বিচারধারায় বসিয়ে দিতে পারতো। এখন সে কোনো কথাই শুনছে না। এখন তার অন্তর্মন অতীতের এলোমেলো আবেগ বিস্ময় ও ভালোলাগাগুলি অজানা অংকের নিয়মে ছন্দবদ্ধ করে প্রাণশক্তির পোঁটলাতে ভরতে ব্যস্ত। যতক্ষণ জীবন থাকে,প্রাণশক্তির কোনো পরিমাপ হয়না, ক্ষতি বৃদ্ধির হারও হয়না। সে আদি অকৃত্রিম না শূন্য না অসীম না সঞ্চারণশীল না স্থির। যখন শরীর মন তার থেকে বিচ্যুত হয় তখনও সে তেমনিই থাকে। এখন মৃত্যুর আগে অন্তর্মন জাতীয় বিজাতীয় অজস্র বোধ ও অনুমানের সারগুলি এক আধারহীন শক্তিতে পুরে দিয়ে তার মধ্যেই নিজেকে বিলীয়মান হতে চায়। যেন এই কর্মছকটি অবশ্যম্ভাবী পূর্ব নির্ধারিত। প্রাণশক্তি ত্যাগের এই কি সূচনা? কিন্তু এখন তার মধ্যে প্রশ্ন নেই বিচার নেই চিন্তা নেই তাই যা হচ্ছে সেটার নিস্তার বেগ নেই। সবই এখন সমান্তরাল।
    তার বহির্মনের আকাশ এখন শূন্য, তরঙ্গহীন। একদম সপাট বর্ণহীন নিখাঁজ। বহির্মন সারাজীবন ধরে অস্থির করে রেখেছিল।এমনকি ঘুমের মাঝেও তাকে খুঁচিয়ে তুলে ছোটো ছোটো স্বপ্নের আকারে সমস্যা ও প্রশ্ন হাজির করত। ঘুম থেকে জেগে উঠে খুব অস্পষ্ট হলেও জানা অজানা ভয় রাগ দুশ্চিন্তা বা লোভ সাময়িক তাকে অস্থির করে তুলতো। বহির্মনের এত তীব্র শক্তি যে কখনো ঘুম থেকে উঠে দেখত তার অন্তর্বাস শুক্ররসে ভিজে গেছে। কী এমন অদৃশ্য শক্তি যে বাহ্য বিষয়বস্তুকে চালনা করতে পারে? ভাবা যায়না। কী এমন শক্তি যার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় পঁচিশ মিটার দূরে থাকা কোনো একটি মানুষের গালাগালিতে ক্রোধে তার শরীর গরম হয়ে উঠত? কর্মমুখর থাকতে থাকতে কতবার যে বহির্মনের অসংখ্য রকমের অদৃশ্য অন্তর্ঘাতে দুর্বল হয়ে গেছে তার হিসেব নেই।
    কেবল গভীর ঘুমে যখন তার চোখের পাতা দু চারবার কেঁপে স্থির হয়ে যেত তখন বহির্মন অন্তর্মনে বিলয় হতো।
সেই ক্ষণগুলি ছোটো ছোটো মৃত্যু। সেই বিলয় ছোটো ছোটো পর্যাবৃত্ত মৃত্যু। কিন্তু এখন তা পূর্ণতাগামী। সমস্ত সারগুলি একে অপরের সাথে বিলীয়মান হয়ে সে এখন শূন্যতা প্রাপ্ত হতে চলেছে। এই পূর্ণ শূন্যতাবোধে সে তার স্বরূপের আভাস পাচ্ছে। বুঝতে পারছে এই নেই বোধটিই অমূর্ত আমিত্বের প্রকাশ। যার স্বভাব অচল। যে দেশ কাল পাত্রের উপর নির্ভরশীল নয়। সে অচল থেকে যেমন খুশি স্থান সময় আকার বানিয়ে নিতে পারে। সময় সেখানে বিলকুল অর্থহীন।
বহির্মন যখন তখন ঘটনা বানিয়ে ফেলত। যখন তখন অতীতে ঢুকে টেনে বার করতো ছোটো ছোটো অশান্ত অগভীর স্মৃতি। কল্পনা মিশিয়ে উত্তেজক করে তুলত। শরীরকে কষ্ট দিত আর পরিবেশকে দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত করে তুলত। শরীর বরং তাকে বিশেষ কষ্ট দিত না। সুস্থ সবল থাকার জন্য শরীর নিজের বিপাকীয় ক্রিয়াগুলো নিজে নিজেই করত। বরং শরীর ভাঙার কাজে বহির্মন অন্তর্মনকে প্রলোভন দিত। শরীর নষ্ট করার কাজে জিতেও যেত। শরীরকে অনেকরকম ক্ষতিকারক নেশায় আসক্ত করার কাজে বহির্মন নিজেকে খরচ করতে অনেক সময় নষ্ট করত।
     এখন বহির্মন নিঃশেষ। শরীর এখন নিশ্চিন্ত আর অতি বিচক্ষণ স্বয়ংক্রিয় কুশলী যন্ত্রের মত নিজেকে স্তব্ধ করার কাজ করে চলেছে। নিজের ভিতরে অসংখ্য অর্বুদ অর্বুদ জৈব ঘড়িগুলির অর্বুদ অর্বুদ নির্দেশগুলি নিমেষে পালন করে যাচ্ছে। শেষ হচ্ছে অসংখ্য জৈবিক রস। সারাজীবন ধরে মাথার ভিতরে নিরাসক্ত নিষ্ক্রিয় বেকার কিছু কোষকলাকে তার শরীর সযত্নে লালনপালন করে এসেছে সেইগুলি জেগে এখন মারমুখী সংহারকর্তা হয়ে শরীরনাশের কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবং আশ্চর্য! শরীর নিজেকে তাদের হাতে সমর্পণও করে দিচ্ছে !
প্রকৃতি ও অপ্রাকৃত অলৌকিক দেশের মাঝে অবর্ণনীয় অজ্ঞাত আড়ালটি ইতিমধ্যে তার কাছে স্পষ্ট পরিষ্কার। তাই শরীরকে বাধা দেবার কোনো উপায় নেই কারণও নেই। শুধু তার নাসিকার ভিতরে কোষকলাগুলি বেঁচে থাকার একটি আনুষ্ঠানিক স্বয়ংচালিত ইচ্ছাকে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। তাই হিক্কার ও সোঁ সাঁ শব্দ। তবে অন্তর্মনের গভীরে এই অজ্ঞাত প্রাচীরটির তথ্য ছিলো,কিন্তু অন্তর্মনের কাছে সেটির উন্মেষের সংকেত ছিল না। তাই সে জীবনে এক আধবার  অন্তর্মনের গভীরতলের খোঁজ পেলেও এই বোধটি তার কাছে একেবারে অজ্ঞাত ছিল। বরং সে মনের প্রত্যন্ত গভীরে গিয়ে মৃত্যুভীতি ছুঁয়ে এসেছিল। তাই শরীরনাশের চিন্তা হতনা। সেই প্রাচীরটির বোধ ভেদ করে প্রকৃতি থেকে অপ্রাকৃতেযাবার জন্যেএখন সে তৈরি। শরীর থেকে নিজেকে আলাদা করার সংকেতগাঁঠ খুলে দৃশ্য ব্রহ্ম থেকে অদৃশ্য মহাব্রহ্মের অসীম শক্তি সমুদ্রে মিশে যাওয়ার এক অপার্থিব স্বয়ংক্রিয় অবশ্যম্ভাবী ঘটনার জন্যে সে পুরোপুরি তৈরী।
বহির্মন অন্তর্মনে লীন হবার ঘটনাটি তার অনুভবে এখন স্থিরচিত্রপ্রাণশক্তিতে সমস্ত প্রেম অপ্রেম বোধসংস্কারগুলি ভরে দেবার জন্যে অন্তর্মন উন্মুখ এবং এই যে,ভরে দিচ্ছে এবং সে ক্রমশ শেষও হয়ে যাচ্ছে,তাও সে প্রত্যক্ষ করল। অন্তর্মন তো প্রাণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু শরীর প্রবাহ থেমে যাওয়া অব্দি তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। তাই সে এখন নিস্পন্দ আলোড়নহীন। এখন নিজের শারিরীক জীবনযাত্রার স্মৃতিগুলির সাথে একটি অনন্ত শৃংখলের  মত তার বংশ পরম্পরা, মানব সমগ্র, পার্থিব প্রাণীকূল আদি জৈব প্রকৃতির সমস্ত স্মৃতি সংকেতগুলি দ্রুত গাণিতিক ছন্দেপ্রাণের ভিতরে নিজে নিজেই বিন্যস্ত হচ্ছে সেটা সে সাক্ষী হয়ে প্রত্যক্ষ করল।রাগ অনুরাগ সত্য মিথ্যা এইসব ভাবগুলি, অনুকূল প্রতিকূল আবেগ, দৈহিক ও মনোরম প্রেমের সমস্ত স্তরগুলি এক একটি অবাস্তব শক্তি পুঁটুলিতে সামঞ্জস্যে জমা হতে লাগলো। এই সব মুহুর্তের মধ্যেই দেখতে দেখতে সে জীবিতকালের অতীতের সীমাপ্রান্তে পৌঁছে গেল। সে তার শূন্যকাল প্রত্যক্ষ করল। চেতনের গর্ভ আবরণ তখনও বিলীন হয়নি। গর্ভের ভিতরে অগণিত মাতৃ চেতননাড়ির স্রোত প্রবহমান। গর্ভ আবরণের বাইরে অসংখ্য পার্থিব প্রাকৃতিক আলো গন্ধ শব্দ তরংগের অনুমান। এখন মৃত্যু সীমানায় সেইগুলির নিমেষ বোধ। জন্মলগ্নের শূন্যকালে ভ্রূণগত হওয়ার সংকেত মুহূর্তের সাথে এখনকার শূন্যকালের মৃত্যু সংকেতের আশ্চর্য মিল ! একদম এক ! এই বোধ। সে যেন নির্দেশ পেল এই দুই সংকেত একে অপরে উপরিপন্ন হয়ে গেলেই সে নিশ্চিত এক বৃহত্তর শূন্য দেশে প্রবিষ্ট হয়ে যাবে।
     এই বৃহত্তর শূন্যতা যে অসীম আনন্দ চেতনা তার এক ঝলক আবেশ পেল সে। যখন জীবনযাপন ছিল তখনকার হতাশ ও অসহায় ক্ষণে আতঙ্কের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে নিশ্চিন্ত নির্ভয় হবার অদৃশ্য অবলম্বন তার অন্তর্মনে আলো ভাব হয়ে আসতো সেই একটুকরো আলোহীন আলোর সাথে এই আভাসের মিল। সে বুঝলো এটি একটি আনন্দ শূন্যতা। এই আনন্দ শূন্যে শূন্য হয়ে মিশে যাওয়ার মুহূর্ত। এই মূহুর্তে জীবনযাপনের পরিশ্রুত ছবিগুলি প্রাণের এক একটি শক্তি পুটুলিতে অপসৃয়মান হওয়ার সময় এক দুটো সময় থেমে যাওয়ার মত আনন্দঘন ক্ষণ বোধে এল। এইগুলি এক একটি বিশেষ আনন্দ পুঁটুলিতে থাকা মানেই হল এগুলোর মহাব্রহ্মে কখনো পুনরাবৃত্তি হবেনা,এগুলো শাশ্বত ছোটো ছোটো অমৃত। ছোটো ছোটো মৃত্যুহীনতা। জীবন থাকতে তার এই জ্ঞান হয়নি। কারণ বহির্মনের সম্মোহক আবেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ইন্দ্রিয় উত্তেজক কল্পনাতে সে ফেঁসে থাকত আর আপাত বর্ণালী উষ্ণতায় বিভোর হয়ে থাকত। কিন্তু...এইযে...এই তো ! একটুকরো ভালোলাগা অতীত নিমেষে অপসৃয়মান হতে হতে তার বিলীয়মান অস্তিত্ব ছুঁয়ে গেল। একটি ভিন্ন মাত্রিক ক্ষণবোধ। আর...এইযে,আর একটি অপসৃয়মান দৃশ্য। আয়নায় তার একটি কৌতুহলী প্রতিবিম্ব। বিস্মিত ভাবনায় বুঁদ। আমি কে? আর একটি কৈশোর প্রতিবিম্ব। স্বমেহনের সময়কার একটি মুহূর্ত। শরীরের ভিতরে অজস্র লোহিত নদীর লক্ষ উপনদী উপউপনদী বেয়ে নিজেরই অসংখ্য অনুদেহ টেনে বেরকরে অসহ কষ্টের শ্বেত শুক্রস্রোতে নিজেকে বইয়ে দেবার বিক্ষেপ যন্ত্রনা। নিজেই নিজেকে ভিতর থেকে বাইরে বার করে দিচ্ছে তার কয়েক লক্ষ অনুশরীর বীজ। কয়েক লক্ষ অনুশরীরের মৃত্যু আক্ষেপ। এই তো ! ঠিক এখনকার বোধের মতই হুবহু। মৃত্যুজ্ঞান?
এইরকম অসংখ্য ঘটমান অতীত পরিবেশ দৃশ্যাবলী সময় সম্পর্কএমনকি সেগুলির সংশ্লিষ্ট আকাশ বোধের মুক্ত শৃঙ্খলগুলি এমন ভাবে দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে যে সে বুঝল সে অনন্তকাল ধরে অপরিবর্তনীয় অটল অক্ষর এমনিভাবে একই জায়গায় রয়েছে আর অর্বুদ অর্বুদ জীবনযাপন এই ভাবে তার সামনে চিত্রকল্পের মত প্রাণগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শরীরে এখনো আভ্যন্তরীণ বেগবান রক্তপ্রবাহ কুলকুল। এই একটি বৃত্তীয় প্রাণ সংকেত। আবর্ত। বেগবান লোহিত কোষগুলিও এক একটি ঘূর্ণায়মান জীবনবৃত্ত। সেই অর্বুদ অর্বুদ জীবনবৃত্তে সমগ্রভাবে ঢুকে পড়ল সে। তাকে ঢুকতে হলএটি একটি অবশ্যম্ভাবী আদেশ। যেকোনো একটি জীবনকোষে ঢুকে সে পেল অনুবৃত্ত তার ভিতরে পরমাণুবৃত্ত কণা উপকণা আলো তড়িত এইসব পরপর বেগবান ক্ষণবৃত্তের মুহূর্মুহু শক্তি রূপান্তর। সে বুঝতে পারছে সব শক্তির রূপান্তরণ এবারে শূন্যশক্তির দিকেই। আর সময় নেই। একের পর এক সে এইসবের ভিতর দিয়ে নিমেষে পার হয়ে এক অজ্ঞাত জ্ঞানের আবেগে থরথর কাঁপতে কাঁপতে প্রবল ঘূর্ণায়মান শূন্যশক্তির বেগে এক বিশালতায় এসে পড়ল। (ক্রমশঃ)


   

  সুবল দত্ত