সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

       


উদিপুরের ছোটোরানী
      
            
।।প্রথম দৃশ্য।।

উদিপুর রাজ্যের রাজা উদিতনারায়ণ রাতে ছদ্মবেশে নগরভ্রমণে বেরিয়ে একসময়ে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে  একটা ভাঙা মন্দিরের  চাতালে
বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।সঙ্গে শুধু তাঁর দেহরক্ষী।সেও ছদ্মবেশে। পূর্ণিমারাত। সহসা রাজার কানে এল সুমধুর নৃত্যগীতের দূরায়ত ধ্বনি।
রাজাঃ রক্ষী, নাচগানের শব্দ  মনে হচ্ছে। দেখো তো কোথায়?
রক্ষীঃ আজ্ঞে মহারাজ,দেখছি।(রক্ষী বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই ফিরে এসে) আজ্ঞে মহারাজ, কুলিক নদীর ধারে ওই বটগাছটার নীচে
কয়েকটি মেয়ে......
রাজাঃ চলো তো দেখি।কিন্তু খুব সাবধান।পা টিপে টিপে যেতে হবে যেন কোনো শব্দ না হয়।চুপিচুপি গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াতে
 হবে।কাছথেকে ওদের নাচ দেখবো,গান শুনবো।
রক্ষীঃ বুঝেছি মহারাজ,চলুন(উভয়ের প্রস্থান)

।।দ্বিতীয় দৃশ্য।।

[পূর্ণিমারাতে জ্যোৎস্নালোকে একদল তরুণী হাতধরাধরি করে নাচগান করছে]
গানঃ আয় তোরা সহচরী /হাতে হাত ধরিধরি...(রবীন্দ্রসংগীত)
নাচ গানের শেষে  তরুণীরা ইতস্ততভাবে বসে পড়ল।একএকজন একএক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।যেমন আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম
 মোছা,চুল,বেশবাস ঠিককরা ইত্যাদি। সহসা পূর্ণিমা  উঠে দাঁড়ালো।
পূর্ণিমাঃঅ্যাই,আচার খাবি?
কঙ্কনাঃ  আচার! এই রাতের বেলা এই বিজন ঘাটে আচার কোথায় পাবি?
সুরুচিঃ  আছাড় খাওয়ার কথা বলছিস না তো!
ঈশানীঃ তাই হবে মনে হয়। (পূর্ণিমা ছাড়া সকলের খিলখিল হাসি)
পূর্ণিমাঃ না রে,সত্যি বলছি।আমি লুকিয়ে এনেছি পদ্মপাতায়।খাবি তো বল্।
সুরুচিঃ  তাহলে বের কর হতভাগী।জিভে যে জল
 এসে গেলো।
[পূর্ণিমা পদ্মপাতায় মোড়া আচার বের করে সবাইকে বিলোতে থাকে।]
পূর্ণিমাঃ নে,ধর্।হাত পাত সবাই।ও বাবা,তুই যে আগে থেকেই হাত পেতে বসে আছিস রে কঙ্কনা!(সকলের হাসি)ও কী রে ঈশানী, তোর
 যে হেলদোল নেই।খাবিনে আচার?
ঈশানীঃ খাবো না আবার!নিশ্চয়ই খাবো।কিন্তু আচারের নাম শুনলেই সুরুচির মতো আমার জিভদিয়ে টসটস করে জল গড়ায় না।[
আবার সকলের একপ্রস্থ হাসি।ঈশানী হাত পেতে বলে,ঃদে।(আচার নেয়)]
সুরুচিঃ সত্যি রে,আচার খেতে আমার খু-উ-ব ভালো লাগে। 
পূর্ণিমাঃ আচ্ছা,তোরা কেউ বলতে পারবি সারা পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে মুখরোচক কী?
সুরুচিঃ ঠিক জানি না।তবে ইলা শীলারা বলে মাংসের স্বাদের নাকি তুলনা নেই।
কঙ্কনাঃআমি তো শুনেছি সুরার স্বাদ নাকি অপূর্ব।
পূর্ণিমাঃ ভুল, সবই ভুল।এসব তো কেবল জিভের স্বাদ। জীবনের নয়।প্রেমের স্বাদ ধরায় অতুল।
সুরুচিঃ তুই আবার কবি হলি কবে রে?
পূর্ণিমাঃ কেন?কবিত্বের কী দেখলি?
সুরুচিঃ ওই যে বললি,(সুর করে)ভুল...সবই ভুল/প্রেমের স্বাদ ধরায় অতুল।
(সকলের হাসি)
কঙ্কণাঃ কী রে,ঈশানী। তোর কি স্বাদবোধ নেই? তুই যে কিছুই বলছিস না?
ঈশানীঃ বলবো?
সবাই( সমস্বরে)ঃহ্যাঁ,বল্।
ঈশানীঃ  সবচেয়ে সুস্বাদু, সব চেয়ে মুখরোচক হল মিথ্যা কথা।মিথ্যার মতো মুখরোচক কিছু হয় না।
[আড়ালে থাকা রাজা ও তার দেহরক্ষী  হো-হো করে হেসে উঠলেন।সেই হাসির শব্দে ত্রস্তা হরিণীর মতো মেয়েরা যে যেদিকে পারে ছুটে
 পালালো।তাদের পায়ের নূপুরধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই রাজা ও দেহরক্ষী হাসতে হাসতে মঞ্চে প্রবেশ করবেন]
দেহরক্ষীঃ প্রভু,ওরা যে সব পালিয়ে গেলো!
রাজাঃ  চলো,আমরাও পালাই। না,না।তুমি এক কাজ করো।তুমি ছুটে গিয়ে ওদের পিছু নাও।দেখে এসো ওরা কোথায় থাকে।যাও।
রক্ষীঃ  আর আপনি, প্রভু?
রাজাঃ   আমি রাজপ্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি।
রক্ষীঃ   আপনি একা যাবেন,প্রভু?
রাজাঃ   যা বলছি তাই করো। 
রক্ষীঃ   যথা আজ্ঞা, প্রভু।কিন্তু খুব সাবধানে যাবেন,প্রভু।আমি চললাম।।[দুজন দুদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়।]

 ,।।  তৃতীয় দৃশ্য।। 
      ------------------
[রাজা সিংহাসনে আসীন।পাত্রমিত্ররা উপস্থিত। ]
মন্ত্রীঃ রাজামশাইকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।কী হয়েছে প্রভু?
বিদূষকঃ হ্যাঁ,ঠিক।মেঘে ঢাকা তারার মতো দেখাচ্ছে মহারাজকে। এই সময় গানবাজনা খুব কাজে দেয়। ডাকবো মহারাজ? ডাকি?
রাজাঃ না।সে সবের প্রয়োজন নেই।তুমি বরং আমার প্রধান দেহরক্ষীকে ডেকে আনো।(রক্ষীর প্রস্থান)
মন্ত্রীঃতাই তো!মহারাজের প্রধান দেহরক্ষীকে তো আজ সকাল থেকে দেখছি নে।এমনটা তো হওয়ার কথা নয়!
বিদূষকঃ মরা এসে গেছি মন্ত্রীমশাই!(রক্ষীসহপ্রবেশ)
রাজা(সাগ্রহে)ঃ এসো,রক্ষী,এসো।কোনো খবর পেলে?
রক্ষীঃ পেয়েছি মহারাজ।এখানেই বলবো?
রাজাঃসকলে একটু বাইরে যান।মন্ত্রণাকক্ষের দরজা বন্ধ করে দিন।(রক্ষী ব্যতীত সকলের প্রস্থান) 
রাজাঃ বলো।
রক্ষীঃ মহারাজ, আমি প্রথমে যে মেয়েটির পরিচয় পাই সে এক কণ্ঠিধারী বৈষ্ণবের মেয়ে।বড় রাস্তার ধারে যে অাখরাটি আছে
 সেখানেই সে থাকে। সেই আখরার কাছাকাছি  বাড়ি এক শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণের।দ্বিতীয় মেয়েটি তাঁর একমাত্র সন্তান।
রাজাঃআর বাকি দুজন?
রক্ষীঃএকজন বাউলের মেয়ে, অন্যজন এক কৃষক কন্যা।চার জনের খুব ভাব।
রাজাঃমন্ত্রীকে ডেকে আনো।(রক্ষী বাইরে গিয়ে মন্ত্রীকে ডেকে আনে)
রাজাঃমন্ত্রীমশাই,আপনাকে খুব গোপনে একটা কাজ করতে হবে।
রাজাঃআদেশ করুন রাজা।
রাজাঃরক্ষী আপনাকে চারটি মেয়ের বিবরণ দেবে।আপনি তাদের বাবামাকে বুঝিয়ে মেয়ে চারটিকে রাজবাড়িতে পরশু বিকেলে নিয়ে
 আসার ব্যবস্থা করবেন।পারবেন তো।
মন্ত্রীঃ আপনি আদেশ করলে পারতেই হবে মহারাজ।
রাজাঃআপনি চারজনের জন্য চারটি সুসজ্জিত পাল্কির ব্যবস্থা করবেন।
রক্ষীঃ চারটি পাল্কির দরকার নেই মহারাজ,দুটিই যথেষ্ট। ওদের তো কাছাকাছি বাড়ি।
রাজাঃ না,ওরা পৃথক পৃথক পাল্কিতে আসবে।সসম্মানে ওদের নিয়ে আসবেন।মনে রাখবেন ওদের ধরে আনতে নয়,বরণ করে আনতে
 যাচ্ছেন।
মন্ত্রীঃবুঝেছি মহারাজ।আর বলতে হবে না।আমি সমস্ত ব্যবস্থা করছি।
দৃশ্যান্তর
--------------
।।চতুর্থ দৃশ্য।। 

*[পাল্কিবাহকের বিচিত্র  কণ্ঠধ্বনি: হুম্ নারে...হুম্ না..হুমনা.. আ.. প্রথমে অষ্পষ্ট, পরে  তীব্র  থেকে তীব্রতর, পরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে
যাবে।মঞ্চে প্রবেশ করবেন রাজা।আসনে উপবিষ্ট হলে রক্ষীর প্রবেশ।]
রক্ষীঃ প্রভু,চারটি পাল্কিতে চার কন্যা  উপস্থিত। 
রাজাঃ ও, ওরা এসে গেছে! কোথায় ওরা?
রক্ষীঃ মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশ মতো ওদের বিশ্রামকক্ষে বসানো হয়েছে।
রাজাঃ ওদের জন্য জলযোগের ব্যবস্থা করো।
রক্ষীঃ তা-ও করা হয়েছে প্রভু।
রাজাঃ বেশ! তাহলে ওদের একে একে পাঠিয়ে দাও।একজন ফিরে গেলে তবেই অন্যজনকে পাঠাবে। মনে থাকবে?
রক্ষীঃ থাকবে প্রভু।বিলক্ষণ থাকবে।
রাজাঃতাহলে যাও,আর দেরি কোরো না।(রক্ষীর
 প্রস্থান)
[রাজা কিছু একটা চিন্তা করতে করতে পদচারণা করতে থাকবেন।অবশেষে আসনে বসতে না বসতেই
একটি মিষ্টিকণ্ঠ]:আসবো?
রাজাঃ এসো মা,এসো।বোসো ওই চেয়ারটায়।
সুরুচিঃ বসার দরকার নেই,মহারাজ। আপনি কী বলতে চান বলুন।
রাজাঃভয় পেয়ো না,মা। আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে তা জানা হয়ে গেলেই তোমাকে সসম্মানে তোমার বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।
সুরুচিঃ বলুন,কী জানতে চান।
রাজাঃতোমার নাম কী মা?
সুরুচিঃ আমার নাম সুরুচি।
রাজাঃ বাঃ! সুন্দর নাম।কিন্তু শুধুই সুরুচি?পুরো নাম বলো।
সুরুচিঃ সুরুচি অধিকারী।
রাজাঃতা পরশু রাতে সখীদের সাথে কী বলাবলি করছিলে? 
সুরুচি(ভীতকণ্ঠে)ঃকোথায়? কখন?
রাজা ঃ নগরের শেষপ্রান্তে,কুলিক নদীর ধারে,বুড়ো বটতলায়।নাচগানের শেষে আচার খেতে খেতে।মনে পড়ছে?
সুরুচিঃ  আপনার নামে কিছু বলিনি মহারাজ।সত্যি, বিশ্বাস করুন।
রাজাঃ আমার নামে কেন কারে নামেই তুমি কিছু বলো নি--সে আমি জানি।কী বলেছিলে শুধু সেটাই জানতে চাইছি।
সুরুচিঃ (দ্বিধান্বিত) না---মানে--বলতে লজ্জা করছে।
রাজাঃ  লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু বলেছিলে কি? নিশ্চয়ই না।কী বলো?
সুরুচিঃ   (হেসে)স্বাদের বিষয়ে কথা হচ্ছিলো মহরাজ।আমি বলেছিলাম,..
রাজাঃ  থামলে কেন?বলো....
সুরুচিঃ  মাংসের স্বাদ নাকি সব চেয়ে  ভালো।
রাজাঃ তুমি তো এক পরম বৈষ্ণবের মেয়ে।তোমরা কি মাংস খাও?
সুরুচিঃ  রাধে,রাধে। মাংস খাওয়া তো দূরের কথা,মাংস স্পর্শ করলেও আমাদের স্নান করতে হয়।
রাজাঃ  তাহলে মাংসের স্বাদ তুমি জানলে কী করে? কেনই বা বললে, মাংসের স্বাদ সবচেয়ে ভালো?
সুরুচিঃ আমাদের পাড়ায় এক মাংসের দোকান আছে।সেখানে প্রায় প্রতিদিন  মাংস কেনার জন্য লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
খুব সুস্বাদু না হলে মাংসের এত চাহিদা হবে কেন মহারাজ? তাছাড়া..  
রাজাঃ  তাছাড়া ---তাছাড়া কী?
সুরুচিঃ  মানুষ মাংস খায়।তার হাড়হাড্ডি খায় কুকুরে।মানুষ যে অংশ ফেলে দেয় তা কাক এসে নিয়ে যায়।যা পড়ে থাকে তা নিয়ে
 যায় পিঁপড়ে।তাই আমার মনে হয়েছে মাংস নিশ্চয়ই খুব সুস্বাদু।
রাজা(হেসে)ঃতোমার কথায় যুক্তি আছে।সত্যি মা,মাংস খুবই সুস্বাদু। (উচ্চকণ্ঠে) রক্ষী-ই-ই।
রক্ষী(প্রবেশ)ঃ আজ্ঞা করুন প্রভু।
রাজাঃ এই মেয়েটিকে মিষ্টান্ন, বস্ত্র, ও একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে সসম্মানে গৃহে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করো। যাও মা তুমি।অন্য একজনকে
পাঠিয়ে দাও।
[রাজা পেছন ফিরে কিছু একটা ভাবছিলেন। সহসা নারীকণ্ঠ]
কঙ্কনাঃ   মহারাজের জয় হোক।
রাজাঃ  কী নাম মা তোমার?
কঙ্কণাঃ  কঙ্কণা ভট্টাচার্য।
রাজাঃ  ও,তুমি সেই পুরুতঠাকুরের মেয়ে? 
কঙ্কণাঃ আজ্ঞে  হ্যাঁ।
রাজাঃ পরশু রাতে আচার খেতে খেতে সখীদের কী বলেছিলেে?
কঙ্কণাঃ না মহারাজ,আমি কিছু বলি নি।
রাজাঃ  তুমি পুরুতঠাকুরের মেয়ে, মিথ্যা বলা তোমাকে মানায় না।সত্যি করে বলো,কী বলেছিলে।
কঙ্কণা ঃঈশ্বরের দিব্যি,আপনার সম্বন্ধে কিছু বলি নি।
রাজা ঃস্বাদের সম্বন্ধে কী বলেছিলে?
কঙ্কণা ঃস্বাদের সম্বন্ধে!ও,সে তো একটা কথার কথা।
রাজা ঃকী কথা?
কঙ্কণা ঃ বলেছিলাম,সুরা খুবই সুস্বাদু।
রাজা ঃ তুমি কি সুরা পান করো?
কঙ্কণা ঃছি,ছি,মহারাজ,এ কী বলছেন? আমি পুরুত ঠাকুরের মেয়ে ; নিম্নবর্ণের মেয়েদের মতো সুরাপান করবো?
রাজা ঃতাহলে বললে কেন যে সুরা খুবই সুস্বাদু? 
কঙ্কণা ঃএকটা ভাটিখানার পাশ দিয়ে রোজ আমাদের যাতায়ত করতে হয়।প্রায়ই দেখি,ইতরভদ্র অনেকেই সেখানে বসে মদ্যপান
 করে।ও পাড়ার সুরেন দত্ত,যার একছেলে কাউন্সিলার, প্রায়ই ওখানে যান,টলতে টলতে ফেরেন। একদিন তো নর্দমায় পড়ে গিয়ে কী
অবস্থা!  ভাবলাম,আর হয়তো এমনটি করবেন না।ওমা, পরদিনই আবার....আমাদের পাশের বাড়ির হ্যাবলাকাকু তো মদ খেয়ে রাজা
 বনে যান। তাঁর মনে কী ফুর্তি! টলতে টলতে গান ধরেন।
রাজা ঃগান! মাতলামির গান! সে কেমন শুনি?
কঙ্কণা ঃগেয়ে শোনাবো?
রাজা ঃ দুকলি গাও তো শুনি।
কঙ্কণা ঃ(গান)
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার বাংলা মালই চাই।
সে যে হাওয়ায় দোলায়,বাক্য জড়ায়
যায় না তারে ছাড়া
সে যে পেটে গেলে উঠবে ঠেলে
দৃষ্টি ছন্নছাড়া
আমি ছুটবো পিছে যেথায় আছে
চোলাই মদের ঠাঁই।
আমি খুশি মনে  সংগোপনে ঢুকুস ঢুকুস খাই
তোরা যে যা বলিস ভাই.......
(গান শেষে রাজা হো হো করে হেসে ওঠেন)
রাজা ঃ রক্ষী!(রক্ষীর প্রবেশ) একেও বস্ত্র, মিষ্টান্ন  ও স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে সসম্মানে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
রক্ষী ঃ যথা আজ্ঞা মহারাজ। আসুন মা।(কঙ্কণা সহ প্রস্থান)
রাজা ঃ তাহলে কে, কে বললো  কথাটা?
[সহসা পদশব্দে ফিরে দেখেন,অন্য একটি মেয়ে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে]
পূর্ণিমা ঃপ্রণাম মহারাজ।
রাজা ঃকী নাম মা তোমার?
পূর্ণিমা ঃ পূর্ণিমা দাস।
রাজা ঃ পরশুরাতে সখীদের সঙ্গে আচার খেতে খেতে কী বলেছিলে?
পূর্ণিমা ঃ আপনার সম্বন্ধে কিছু বলি নি মহারাজ, বিশ্বাস করুন।রাধাগোবিন্দের দিব্যি।
রাজা ঃ সে আমি জানি পূর্ণিমা। কিন্তু স্বাদ সম্পর্কে কিছু একটা বলেছিলে।বলো নি?
পূর্ণিমা ঃ হ্যাঁ,বলেছিলাম।
রাজা ঃকী বলেছিলে?
পূর্ণিমা ঃ উঁ....উঁ...হ্যা মনে পড়েছে।বলেছিলাম,প্রেমের স্বাদ ধরায় অতুল।
রাজা ঃতুমি তো খুব কচি মেয়ে গো,প্রেমের তুমি কী বোঝো?
পূর্ণিমা ঃ আমি বাউলের মেয়ে।মাঝেমাঝে বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাকেও কৃষ্ণপ্রেমের গান গাইতে হয়।
রাজা ঃ তুমি গান জানো?একটু গাও তো শুনি।
পূর্ণিমা ঃএখানে দোতারা, খমক কিছু নেই।তবু আপনি যখন বলছেন দুকলি গেয়ে শোনাচ্ছি।
।।গান।।প্রেম করো ভাই,পীরিত কোরো না.....
রাজা ঃ বাঃ! তোমার গানের গলা ভারি মিষ্টি। খুব ভালো লাগলো।রক্ষী....
রক্ষী ঃ আজ্ঞা করুন প্রভু।
রাজা ঃএকেও উপঢৌকনাদি দিয়ে গৃহে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
রক্ষী।।এসো গো বাউল মেয়ে।
(পূর্ণিমা সহ প্রস্থান)
[রাজা  শান্তভাবে সিংহাসনে বসে রইলেন।কৃষককন্যা ঈশানীর প্রবেশ।]
ঈশানী ঃআমাকে কেন ধরে এনেছেন রাজামশাই?
রাজা ঃ এ কী বলছো!ধরে আনা হয়নি তো।কেউ কি তোমার অসম্মান করেছে?
ঈশানী ঃ তা করে নি।কিন্তু রাজামশাই,সামান্য কৃষককন্যা আমি।আপনার অনুগ্রহে সুসজ্জিত পাল্কিতে চড়ার সুযোগ পেয়েছি। এখন
 কি শূলে চড়াবেন?
রাজা ঃতোমার কথায় বিনয়ের ছিটেফোঁটাও নেই।তবে তুমি যে বাকপটু তা স্বীকার করতেই হবে।
ঈশানী ঃধন্যবাদ রাজামশাই।এখন বলুন, আমার উপর আপনার কৃপাদৃষ্টির কারণ?
রাজা ঃ তুমি তো দেখছি আমার উপর রুষ্ট হয়েই আছো।তোমাকে কীকরে বোঝাই যে তোমাদের ডাকার পেছনে আমার কোনো
বদমতলব নেই!
ঈশানী ঃ তো?
রাজা ঃ আমি একটা কথা জানার জন্যই তোমাদের ডেকেছি।
ঈশানী ঃ কী কথা?
রাজা ঃপরশু রাতে নদীপারে সখীদের সঙ্গে আচার খেতে খেতে কী বলেছিলে?
ঈশানী  ঃ সখীদের সঙ্গে তো অনেক কথাই বলেছিলাম।আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো?
রাজা ঃস্বাদের বিষয়ে কী বলেছিলে?
ঈশানী ঃ যা সত্যি তাই বলেছিলাম।
রাজা ঃ সত্যিটা কী?
ঈশানী ঃ মিথ্যার মতো মুখরোচক আর কিছু নেই।
রাজা ঃ অর্থাৎ মিথ্যা কথা বলে মানুষ খুবই তৃপ্তি পায়, এই তো?কেন তোমার এমনটা মনে হল বলো তো!
ঈশানী ঃ তৃপ্তি যদি না-ই পাবে তা হলে মানুষ  অহরহ মিথ্যাকথা বলে কেন?
রাজা ঃভুল,ভুল।সবাই মিথ্যা কথা বলে না।আমি তো কখনও মিথ্যে  বলেছি বলে মনে পড়ে না। আসলে আমি কখনই মিথ্যে  বলি না।
ঈশানী ঃ এইমাত্র তো বললেন।
রাজা ঃএইমাত্র  বললাম! কী বললাম?
ঈশানী ঃ আমি মিথ্যা বলি না--এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর হয়না রাজামশাই।
রাজা ঃ তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! তুমি রাজাকে মিথ্যাবাদী বলো!প্রমাণ করতে পারবে যে সবাই মিথ্যা কথা বলে,রাজাও মিথ্যাবাদী? 
ঈশানী ঃ আমাকে দুলাখটাকা আর মাস তিনেক সময় দিন।আমি ঠিক প্রমাণ করে দেবো।
রাজা(সকৌতুকে)ঃঅাচ্ছা! এখনও ভেবে দেখো, পারবে তো প্রমাণ করতে?
ঈশানী ঃ পারবো,অবশ্যই পারবো। 
রাজা ঃ রক্ষী!
রক্ষী ঃ আদেশ করুন প্রভু।
রাজা ঃ মহামন্ত্রীকে বলো  এই মেয়েটিকে দুলাখ টাকা দিয়ে সসম্মানে বাড়িতে রেখে আসতে।
রক্ষী ঃ যথা আজ্ঞা প্রভু।
রাজা ঃকিন্তু  মনে রেখো সুভদ্রে..
ঈশানী ঃ আমার নাম ঈশানী  রাজন।ঈশানী রাজবংশী।
রাজা ঃ কিন্তু মনে রেখো ঈশানী, প্রমাণ করতে যদি না পারো তাহলে রাজাকে মিথ্যাবাদী বলার অপরাধে তোমাকে কঠিন শাস্তিভোগ
  করতে হবে।
ঈশানী ঃ যদি প্রমাণ করতে না পারি তাহলে আপনার দেওয়া যে কোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো রাজামশাই।
রাজা ঃ তথাস্তু। যাও।

।।পঞ্চম দৃশ্য।।
 +++++++++
[রাজা সিংহাসনে আসীন।পাত্রমিত্ররাও উপস্থিত]
মন্ত্রী ঃ রাজা মশাইকে কেমন বিমর্ষ মনে হচ্ছে।শরীর ঠিক আছে তো,রাজামশাই? নাকি কিছু ভাবছেন?
রাজা ঃশরীর ঠিক আছে,মন্ত্রীমশাই।তবে...
মন্ত্রী ঃ তবে কী রাজামশাই?
বিদূষক ঃ মন খারাপ? নাকি পেট খারাপ?নাকি খিদে পেয়েছে?
রাজা ঃ আহ্ ! বিদূষক! 
বিদূষক ঃ না,মহরাজ! খিদে তো অনেক রকম হয়।যেমন  পেটের খিদে,চোখের খিদে, মনের খিদে.....
রাজা ঃ বাজে বোকো না তো বিদূষক। এ তোমার পরিহাসের বিষয় নয়।
বিদূষক ঃ তাহলে আমি আমার মুখে তালা মেরে দিলাম। [রক্ষীর প্রবেশ]
রাজা ঃকী খবর রক্ষী?
রক্ষী ঃ মহারাজ, দূত আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
রাজা ঃ ডাকো,ডাকো তাকে।আমি তো তার জন্যই উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছি।(রক্ষীর প্রস্থান ও দূতের প্রবেশ)
দূত ঃ মহরাজের জয় হোক
রাজা ঃ কী খবর দূত?
দূত ঃ মহারাজ, ঈশানী নামের সেই মেয়েটি তার গ্রামে নেই।
রাজা ঃ নেই!
বিদূষক ঃতার মানে দুলক্ষ টাকা নিয়ে সে গা ঢাকা দিয়েছে।
মন্ত্রী ঃ গ্রামে নেই।তো কোথায় গেছে সে?
বিদূষক ঃ ওই যে বললাম,গা ঢাকা দিয়েছে।হয়তো দেশ ছেড়েই পালিয়েছে।দুলক্ষ টাকা।ভাবা যায়!
রাজা ঃ থামো তো তুমি।বাঁচাল কোথাকার। (দূতকে) তার কোনো খোঁজ পাও নি?
দূত ঃ পেয়েছি মহরাজ।
সমস্বর ঃ পেয়েছো!!
দূত ঃ হ্যা,মহারাজ,অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার হদিশ পেয়েছি।
রাজা ঃকোথায়,কোথায় তার দেখা পেলে? কী বললো সে?
বিদূষক ঃ টাকা ফেরৎ দেবে বলেছে?
দূত ঃ না,আমি তার দেখা পাইনি।
সমস্বর ঃ পাও নি!!
দূত ঃ না।দেখা পাই নি।শুধু তার খোঁজ পেয়েছি।
রাজা ঃ কোথায় সে?
দূত ঃ এক নির্জন টিলায়।
সমস্বর ঃ টিলায়!!
রাজা ঃসেখানে সে কী করছে?
বিদূষক ঃ তপস্যা?
দূত ঃ সেখানে সে নাকি এক মন্দির নির্মাণ করছে।
রাজা ঃ মন্দির!?
মন্ত্রী ঃ কোন্ দেবতার মন্দির? 
দূত ঃ তা তো জানি না, মন্ত্রীমশাই।
রাজা ঃতুমি সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে না কেন?
দূত ঃ চেষ্টা করেছিলাম মহারাজ।অনুমতি পাইনি।সে নাকি কারো সঙ্গেই দেখা করে না।
রাজা ঃ আচ্ছা তুমি যাও।তোমাদের দিয়ে হবে না।(দূতের প্রস্থান) মন্ত্রীমশাই,এখন কী করা যায় বলুন তো?
মন্ত্রী ঃ এ কাজ দূতকে দিয়ে হবে না রাজা মশাই।আপনি বরং দায়িত্বশীল  কাউকে পাঠান। যার নাম শুনলে সে আর না বলার সাহস
পাবে না।
রাজা ঃ ঠিক বলেছেন। আমি বরং আমার দেহরক্ষীকেই পাঠাই। ঈশানী ওকে চেনেও।সে ঠিক খোঁজ আনতে পারবে।
সমস্বর ঃ তাই করুন মহারাজ।।
++++++++++
।।ষষ্ঠ দৃশ্য।। 
+++++++++
[দেহরক্ষীর প্রবেশ।সে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে ইতস্তত পায়চারি করছে।বিদূষকের প্রবেশ।]
বিদূষক ঃআরে দেহরক্ষী যে!
রক্ষী ঃ হ্যাঁ,ভাঁড় মশাই আমি।
বিদূষক ঃএ্যাই, খবরদার আমাকে ভাঁড় বলবে না।
রক্ষী ঃতাহলে কী বলবো?
বিদূষক ঃ সবাই যা বলে-- বিদূষক!  
রক্ষী ঃসে তো রাজসভায় বলে।আড়ালে সবাই আপনাকে ...যাকগে....
  (মন্ত্রীর প্রবেশ)
মন্ত্রী ঃ ও,দেহরক্ষী !  তুমি এসে গেছো? কখন এলে?
(সহসা রাজাকে দেখে) আসুন,রাজামশাই,...
(রাজা আসন গ্রহণ করেন)
রাজা।কী খবর দেহরক্ষী?  তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে!ঈশানীর দেখা পাওনি?
দেহরক্ষী ঃ না,মহারাজ।
রাজা ঃ তোমার সাথেও দেখা করলো না?
দেহরক্ষী ঃ দেখা করে নি,তবে খবর পাঠিয়েছে।
রাজা ঃ কী খবর?
দেহরক্ষী ঃ চৈত্রসংক্রান্তির দিন তার প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের দ্বারোদঘাটন হবে।আর দ্বারোদঘাটন  করবেন আপনি।
বিদূষক ঃ মহারাজ, যদি না হয় ভ্রান্তি।
আগামী পরশুই তো চৈত্রসংক্রান্তি।।
রাজা ঃ আশ্চর্য! আমাকে তো কোনো খবর দেয়নি!তুমি ঠিক শুনেছো তো দেহরক্ষী , আমাকে দিয়েই..
দেহরক্ষীঃহ্যাঁ,মহারাজ, যাকে দিয়ে সে বলে পাঠিয়েছে সে তো স্পষ্টই বললো।
মন্ত্রী ঃকী বললো?
দেহরক্ষী ঃবললো যে মহারাজকে দিয়েই মন্দিরের দ্বারোদঘাটন  হবে।
বিদূষক ঃ তাহলে হয়তো হবে কোনো মঠের মহরাজ ।মেয়েটা কি ধড়িবাজ!
রাজা ঃ মন্ত্রীমশাই।
মন্ত্রী ঃ বলুন রাজা মশাই।
রাজা ঃ এখন কী করা যায় বলুন তো?
মন্ত্রী ঃ সেপাইসান্ত্রি পাঠিয়ে ধরে আনি মেয়েটাকে।
কতো ধানে কতো চাল বুঝিয়ে দেই তাকে।।
[নেপথ্যে ঈশানী ঃ ধরে আনতে হবে না রাজন।
সকলে(বিস্ময়ে)ঃ ঈশানী!!
ঈশানী ঃ হ্যাঁ,রাজন।
রাজা ঃ তিনমাস কি হয়নি পূরণ?
ঈশানী ঃপরশুই পূর্ণ হবে মহারাজ।
তাই তো আপনাকে নিতে এসেছি আজ।
রাজা ঃ কোথায় যেতে হবে?
ঈশানী ঃউদয়ন টিলায়।
রাজা ঃ কী আছে সেখানে?
ঈশানী ঃ ঈশ্বরের এক মন্দির গড়েছি আমি।আগামীকাল শুদ্ধাচারে স্নানধ্যান পূৃজাপাঠ শেষে হবে তার উদ্বোধন।কৃপাকরে চলুন
রাজন। আপনার দ্বারাই হবে মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন।
রাজা ঃকিন্তু তুমি যা প্রমাণ করতে চেয়েছো তার কী হল?
ঈশানী ঃ সেখানেই ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে তার প্রমাণ দেবো রাজন।
রাজা ঃ বেশ।তুমি পথশ্রমে ক্লান্ত।এখন বিশ্রাম নাও।আমি যাত্রার আয়োজন করছি।চলো,অন্তঃপুরে চলো।(সকলের প্রস্থান) 
 *******************
।।সপ্তম দৃশ্য।।
++++++++
[ঈশানী  তার কয়েকজন সাথীকে নিয়ে কর্মব্যস্ত।দ্বারোদ্ঘাটনের জন্য ফুল, লতা পাতা দিয়ে প্রবেশদ্বার সাজানো হচ্ছে।একজন দরজায়
 রিবন ফিতা দিয়ে,একজন কাঁচি নিয়ে,অপর একজন শঙ্খ নিয়ে প্রস্তুত।] 
ঈশানী ঃ তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো।তোরা এদিকটা দ্যাখ্,আমি রাজা মশাইকে ডেকে নিয়ে আসি।[প্রস্থান। সখীরা কর্মব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পরে রাজাকে নিয়ে ঈশানীর প্রবেশ]
ঈশানী ঃ আসুন,রাজা মশাই।আগে মন্দিরের দ্বার উন্মোচন করুন।[রাজা ফিতে কেটে দ্বারোদ্ঘাটন করেন।শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি।]
রাজা ঃ ঈশানী!
ঈশানী ঃ বলুন রাজামশাই।
রাজা ঃ মন্দিরের দ্বার তো উদ্ঘাটন করলাম।কিন্তু  বিগ্রহ  কোথায়?
ঈশানী ঃ বিগ্রহ তো নেই মহারাজ। 
রাজা ঃবিগ্রহ  নেই!? তাহলে?[মন্ত্রী, বিদূষকের প্রবেশ]
মন্ত্রী ঃএ কেমন মন্দির,রাজামশাই। কোনো মূর্তি নেই।কোনো দেবতা নেই!
ঈশানী ঃএ তো ঈশ্বরের আবাস।ঈশ্বরের মন্দির।
রাজা ঃ তার মানে এখানে স্বয়ং ভগবান থাকেন।তাই তো?
ঈশানী  ঃঠিক তাই রাজা মশাই।
বিদূষক  ঃতাকে দেখা যাবে না?
ঈশানী ঃকেন যাবেনা?
মন্ত্রী ঃ মন্দিরের ঠিক কোন্ জায়গায় আছেন তিনি?
ঈশানী ঃ গর্ভগৃহে।
রাজা ঃতার মানে ভেতরের ওই ছোট্ট কুঠরিটায়,যেখানে একটা প্রদীপ জ্বলছে?
ঈশানী  ঃঠিক তাই প্রভু।
মন্ত্রী ঃ ওর ভেতরে গেলে স্বচক্ষে ঈশ্বরকে দেখতে পাবো?
ঈশানী ঃ পাবেন,অবশ্যই পাবেন।
বিদূষক ঃ কীভাবে চিনবো তাকে?
ঈশানী ঃ তিনিই চিনিয়ে দেবেন।কাউকে চেনাতে হবে না।
বিদূষক ঃ আসল,না নকল বুঝবো কী করে?
ঈশানী ঃ উনিই বুঝিয়ে দেবেন
মন্ত্রী ঃ অতো কথায় কাজ কী?চলুন রাজামশাই,গর্ভগৃহে প্রবেশ করে চক্ষু- কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করি।
রাজা ঃ চলুন।এসো ঈশানী।
ঈশানী ঃ গর্ভগৃহে প্রবেশের পূর্বে ঈশ্বরের অনুমতি নিতে হয় প্রভু।
রাজা ঃ অনুমতি!কীভাবে অনুমতি চাইবো?কার কাছে চাইবো?
ঈশানী ঃআমি প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছি।আপনারা আমার সঙ্গে গলা মেলান।
মন্ত্রী ঃ আমরা গাইবো?এই বুড়ো বয়সে হেঁড়ে গলায় গান ধরলে ভগবান মন্দির ছেড়ে পালাবেন না তো?
বিদূষক ঃভগবানও যদি বুড়ো হয়ে থাকেন তাহলে না-ও পালাতে পারেন।
ঈশানী ঃ আপনাদের গলা ছেড়ে গাইতে হবেনা।মনে মনে গাইলেই হবে। ভগবান তো অন্তর্যামী। 
রাজা ঃতুমি কৃষক কন্যা।কিন্তু বোধ ও বুদ্ধিতে তুমি ঋষিকন্যার সমকক্ষ। নাও শুরু করো।
[সকলে হাঁটুগেড়ে প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বসে]
গান(রবীন্দ্রসঙ্গীত) 
এসো আমার ঘরে এসো......
রাজা ঃবাঃ!ঈশানী, তোমার গায়কী খুব সুন্দর।
মন্ত্রী ঃ তাহলে এখন আমরা গর্ভগৃহে প্রবেশ করি?
ঈশানী ঃ অবশ্যই। তবে একে একে। একজন দর্শন করে বেরিয়ে এলে তবেই আর একজন।
রাজা ঃ কেন?
ঈশানী ঃ রাজামশাই,ঈশ্বর কি এতই সহজলভ্য?  একসঙ্গে অনেককে দেখা দিলে তো তার মাহাত্ম্যই থাকবে না।
রাজা ঃ তাও তো বটে।
ঈশানী ঃ ঈশ্বর  একবার মাত্র একজনকেই দেখা দেন।একাধিক ব্যক্তি গর্ভগৃহে প্রবেশ করলে ঈশ্বর থাকেন অদৃশ্য।বিশ্বাস নাহলে
পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। তা হলে যান কে কে যাবেন?
বিদূষক ঃনা-দেখার জন্য যাওয়া?
মন্ত্রী ঃনা,না।অমন গিয়ে কাজ নেই। রাজামশাই, সর্বপ্রথম আপনিই যান।
বিদূষক ঃমহারাজ গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেই ঈশ্বরকে দেখতে পাবেন তো?
ঈশানী  ঃ নিশ্চয়ই পাবেন।মহারাজ তো আর বেজন্মা নন্।
মন্ত্রী ঃ তার মানে?
রাজা ঃ কী বলতে চাও তুমি?
ঈশানী ঃ মহারাজ,তিন ধরণের লোক ঈশ্বরের দর্শন পাবেন না।
বিদূষক ঃতিন ধরণ! তুমি আমাদের কথা বলছো না তো?
ঈশানী ঃআপনারা  আবার তিন ধরণ হবেন কী করে?
বিদূষক ঃ কেন,একজন রাজা,একজন মন্ত্রী, একজন বিদূষক। হল না তিন ধরণ?
রাজা ঃ থামো তো তুমি।বলো ঈশানী কোন তিন ধরণের লোকের কথা বলছো তুমি।
ঈশানী ঃ  বেজন্মা,পরস্বাপহারী  আর নারী নির্যাতনকারী। আপনি তো এর কোনোটাই নন্। আপনি কেন ঈশ্বরের দর্শন পাবেন না?
নিশ্চয় পাবেন। যান মহারাজ, আপনি নিশ্চিন্তে ভেতরে যান।
রাজা ঃনা,না। তা হয়না।মন্ত্রী মশাই বয়োজ্যেষ্ঠ। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা উচিৎ। যান মন্ত্রীমশাই।দ্বিধা করবেন না।আপনি
সদ্বংশজাত পুণ্যাত্মা। ভগবান আপনাকে দর্শন দেবেনই।যান।
বিদূষক ঃ স্বচক্ষে ঈশ্বর দর্শন!মন্ত্রীমশাইর মানবজন্ম ধন্য হয়ে যাবে।
রাজা ঃএরপর তুমি যাবে।তোমার মানবজন্মও সার্থক হবে।
বিদূষক ঃধ্যাৎ,তাই হয় নাকি!  রাজা মশাইয়ের আগে আমি?
রাজা(দৃঢ়কণ্ঠ) ঃ হ্যাঁ,হ্যাঁ।তুমি।আমাকে রাজধর্ম পালন করতে দাও।আমি যাবো সবার শেষে।সব কিছু সবার আগে ভোগ করা রাজধর্ম
নয়।
বিদূষক (জনান্তিকে)ঃআসলে রাজা মশাই ভয় পাচ্ছেন।উনিও তো পরস্বাপহরণকারী।কে না জানে,রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের
ধন চুরি।
রাজা ঃকী বকছো বিড়বিড় করে?
বিদূষক ঃ আমি মন্ত্রীমশাইয়ের সাফল্য কামনা করছি।
ঈশানী ঃ ঈশ্বর দর্শনের জন্য নিবিষ্ট চোখ চাই।শুধু একথাটাই খেয়াল রাখবেন, মন্ত্রী মশাই।
মন্ত্রী (আনমনা)ঃতা...হলে..আমি যাই?
সমস্বরে ঃ হ্যাঁ,যান মন্ত্রীমশাই,যান।(দ্বিধান্বিত মন্ত্রীর প্রস্থান)
ঈশানী ঃ আসুন আমরা মন্ত্রীমশাইয়ের সাফল্য কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি।।
রাজা ঃবেশ।তাই হোক।
[তিনজনই প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে প্রার্থনাসঙ্গীত শুরু করে।]
গান।।আগুনের পরশমণি  ছোঁয়াও প্রাণে..... (রবীন্দ্রসঙ্গীত)

।। অষ্টম  দৃশ্য।।
++++++++++
প্রার্থনারত রাজা ও অন্যরা হাত জোর করে বসে আছেন।
ঈশানী ঃ ওই তো মন্ত্রীমশাই ফিরে এসেছেন।
রাজা ঃ(সাগ্রহে) মন্ত্রীমশাই,দেখলেন? ঈশ্বরকে দেখলেন?
মন্ত্রীঃ(দ্বিধাভরে)এ্যাঁ...হ্যাঁ...হ্যাঁ...দেখলাম বৈকি!
ঈশানী ঃ দেখলেন!
রাজা ঃকেমন দেখলেন?ঈশ্বর দেখতে কেমন?
মন্ত্রী ঃভালো।
রাজা ঃ ভালো মানে?
মন্ত্রী ঃ শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।... আমাকে আশীর্বাদ  করলেন।
বিদূষক ঃ কিছু বলেন নি?
মন্ত্রী ঃ অ্যাঁ!
বিদূষকঃ কোন্ ভাষায়? সংস্কৃতে,না বাংলায়,নাকি ইংরেজিতে?
ঈশানী ঃ(হাসি গোপন করে) ছাড়ুন তো।বুড়ো মানুষ, ঈশ্বরকে দেখে হকচকিয়ে গেছেন।ওনাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিন। এবার কে
যাবেন?
রাজা ঃ যাও হে বিদূষক। 
মন্ত্রী ঃ এটা কি ঠিক হচ্ছে প্রভু?
রাজা ঃ যাও তো তুমি।
বিদূষক ঃ তা হলে যাই? যাচ্ছি।
ঈশানী ঃ হ্যাঁ, যান।আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছি।
[বিদূষকের প্রস্থান।সবাইকে নিয়ে ঈশানীর প্রার্থনা সঙ্গীত। 
গান(রবীন্দ্রসঙ্গীত)
গান শেষে পূর্ববৎ সবাই বসে থাকবে।বিদূষকের প্রত্যাগমন।]
রাজা ঃ কী হে,বিদূষক, দেখতে পেলে?
বিদূষক ঃ হ্যাঁ।দেখতে পাবো না কেন?
মন্ত্রী ঃ বলি,ঈশ্বরকপ দেখতে পেলে?
বিদূষক ঃ আপনি বুড়ো মানুষ দেখতে পেলেন,আর আমি পাবো না?
রাজা ঃ  কেমন দেখলে?
বিদূষক ঃ স্পষ্ট দেখলাম।এই যেমন আপনাকে দেখছি।
রাজা ঃ হেঁয়ালি কোরো না তো।বলো,ঈশ্বর দেখতে কেমন।
বিদূষক ঃ আমি দেখলাম,নররূপী নারায়ণ কে।অবিকল আমার অন্নদাতা মহারাজের মতো দেখতে।ঈশ্বর বহুরূপী কিনা।
ঈশানী ঃ আপনি ভাগ্যবান।
রাজা ঃভগবানের কাছে কী চাইলে তুমি?
বিদূষক ঃ আমি? আমি আমার অন্নদাতার দীর্ঘায়ু কামনা করলাম।
ঈশানী ঃ নিজের জন্য কিছুই চাইলেন না? আশ্চর্য!
বিদূষক ঃ চাইলাম তো।আমার অন্নদাতা দীর্ঘায়ু হলে আমার কখনো অন্নাভাব হবে না।
ঈশানী ঃ এবার তাহলে.... রাজামশাই.......
রাজা ঃ যেতেই হবে?
সমস্বরে ঃ হ্যাঁ,হ্যাঁ, যান।
রাজা ঃ যাই তাহলে।
ঈশানী ঃ আসুন রাজামশাই।আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছি।
[পূর্ববৎ সকলের প্রার্থনা--- রবীন্দ্রসংগীত। ]

।।নবম দৃশ্য।।
++++++++++
[মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে রাজা উদিত নারায়ণ। ]
রাজা ঃএটাই তো মন্দিরের গর্ভগৃহ। ওই তো সেই প্রদীপটা।টিমটিম করে জ্বলছে। কিন্তু.. গর্ভগৃহের ভেতরে তো কোনো আলো নেই!
ঘুটঘুটে অন্ধকার।ঈশ্বর কি অন্ধকারে লুকিয়ে থাকেন!হতেও পারে। আর একটু এগিয়ে দেখি তো।(এগোন)কই,কোথায়?কোথায় হে
ঈশ্বর? মন্ত্রী দেখলেন,বিদূষক দেখলো,আমি রাজা।আমি দেখতে পাচ্ছিনা কেন?দেখা দাও,দেখা দাও হে ঈশ্বর! জ্ঞানত আমি পরস্ব
অপহরণ করিনি।আমার তো কখনও অভাব ছিলো না।আমি কেন পরের ধন চুরি করবো?আমি কখনও কাউকে খুন-ধর্ষণ করিনি।
তাহলে আমি কি বেজন্মা? তাই বা কী করে হবে! মহান শতানীক বংশে আমার জন্ম। বিদূষী পুণ্যবতী কমলাবতী আমার গর্ভধারিনী
জননী। আমার পিতা দেবতুল্য রাজরাজেন্দ্র দিনেন্দ্রনারায়ণ দেববর্মন।আমি বেজন্মা হবো কেন? ও-হো-হো-ও(কান্না)আমার প্রতি এত
নির্দয় হলে কেন ভগবান!?কেন?কেন?কেন?(কান্না)।এখন আমি কী করি?বাইরে গিয়ে কী বলবো?যদি বলি,আমি ঈশ্বরের দেখা পাই নি,
তাহলে কে কী ভাববে!কেউ ভাববে আমি চোর, কেউ ভাববে আমি খুনি,কেউবা ভাববে রাজা তার মায়ের অবৈধ সন্তান।  উঃ,আমি আর
 ভাবতে পারছি না। (একটু থেমে)না, বাইরে সত্যি কথাটা বলা যাবে না। তাহলে কী বলবো?(একটু চিন্তা করে) বলবো,দেখেছি।আমিও
ঈশ্বরকে দেখেছি।তারপর বানিয়ে বানিয়ে যা বলতে হয় বলবো। হায় ঈশ্বর,আমাকে এ কী ফ্যাসাদে ফেললে![ মাথার চুল আঁকড়ে ধরে
 মাটিতেই বসে পড়ে।আলো নিভে যায়।]
-------------------------------------
।।শেষ(দশম)দৃশ্য।।

[রাজার ফেরার অপেক্ষায় মন্ত্রী  ও অন্যান্যরা।ঈশানী ছাড়া সকলে উদ্বিগ্ন। ]
মন্ত্রীঃ রাজামশাই এখনও ফিরছেন না কেন?
ঈশানীঃ ঠিকই ফিরবেন।চিন্তার কোনো কারণ নেই।
বিদূষকঃ হয়তো ঈশ্বরের সঙ্গে কোনও বিষয়ে পরামর্শ করছেন।
রক্ষীঃ ওই তো রাজামশায় এসে গেছেন।
মন্ত্রীঃ  রাজাকে এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন?
রক্ষীঃ কেমন পাগল-পাগল  লাগছে। আমি কি ছুটে গিয়ে মহারাজের হাত ধরবো?
ঈশানীঃ  আপনারা চিন্তা করবেন না। যা দেখতে পাওয়া যায় না তার দেখা পেলে অনেকেরই এমন হয়।সব ঠিক হয়ে যাবে।
   [রাজার প্রবেশ]
মন্ত্রীঃ  রাজামশাই! রাজামশাই!
রাজাঃ এ্যাঁ....
মন্ত্রীঃ আপনি ঠিক আছেন তো?
রাজাঃ  এ্যাঁ...হ্যাঁ...
বিদূষকঃ  ঈশ্বরের দেখা পেলেন,মহারাজ?
রাজাঃ হ্যাঁ,হ্যাঁ..
ঈশানীঃ  দেখলেন?
রাজাঃ (মাথা ঝারা দিয়ে) কেন দেখবো না?মন্ত্রী দেখলেন,বিদূষক দেখলো আর আমি দেশের রাজা,আমি দেখবো না?
রক্ষীঃ  মহারাজ, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি এই আসনটায় বসুন।
রাজাঃ  সত্যি আমি ক্লান্ত,বড় পরিশ্রান্ত। দাও,দাও।[রক্ষী চেয়ার এগিয়ে দেয়।রাজা বসেন]
  ঈশানী, ক্লান্ত তো হওয়ারই কথা।কিন্তু মহারাজ,আপনিও ঈশ্বরকে দেখলেন?
রাজাঃ  দেখলাম তো, স্পষ্ট দেখলাম।
ঈশানীঃ  কীভাবে দেখলেন?
রাজাঃ  এই যেভাবে তোমাকে দেখছি।
ঈশানীঃ  সত্যি দেখেছেন?
মন্ত্রীঃ  অ্যাই মেয়ে,তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! রাজার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করো।
রাজাঃ  মন্ত্রীমশাই,আপনি থামুন। আমাকে বলতে দিন।তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো না, ঈশানী?
ঈশানীঃ  যা বিশ্বাসযোগ্য নয়,তা কেমন করে বিশ্বাস করি, বলুন?
মন্ত্রীঃ  রাজামশাই,এ অসহ্য। এ প্রকারান্তরে আপনাকে মিথ্যাবাদী  বলছে।
রক্ষীঃ ও বলতে চাচ্ছে, আপনি ঈশ্বরকে দেখেন নি
বিদূষকঃ  কারণ আপনি হয় মিথ্যাবাদী,নয় নরহত্যাকরী, নয়তো......
মন্ত্রীঃ  ও আপনাকে বেজন্মা মনে করে।
রক্ষীঃ  মহারাজের আদেশ পেলে আমি এক্ষুনি.....
রাজাঃ তোমরা থামো।আমি ভগবানকে দেখেছি,আমার এ কথা তুমি বিশ্বাস করছো না কেন,ঈশানী? 
ঈশানীঃ বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে। রাজামশাই, ভগবানের দেখা পাওয়া কি অতই সহজ?মুনি -ঋষিরা দীর্ঘ তপস্যা করেও যাঁর দর্শন পান
না,মানুষের তৈরি একটা মন্দিরে প্রবেশমাত্রই আপনি তাঁর দেখা পাবেন এটা ভাবলেন কীকরে?
রাজাঃ  তবে মন্ত্রীমশাই দেখলেন কী করে?
ঈশানীঃ  মন্ত্রী মশাই মিথ্যাকথা বলেছেন।(রাজা,মন্ত্রী, বিদূষক কেঁপে ওঠে)
রাজাঃ বিদূষকও তো বলেছে!
ঈশানীঃ উনিও মিথ্যে বলেছেন। দেখুন,দুজনই কেমন মাথা হেঁট করে বসে আছেন।
রাজাঃ  কিন্তু তুমিও তো বলেছো -এ মন্দিরের গর্ভগৃহে  ঈশ্বর আছেন।
ঈশানীঃ  আমিও মিথ্যাকথা বলেছিলাম।
রক্ষীঃ  কী দুঃসাহস!
রাজাঃ কেন? মিথ্যাকথা বলে আমাকে ধোকা দিলে কেন?
ঈশানীঃ (হেসে)সবই ভুলে গেলেন মহরাজ?
রাজাঃ  কী? কী ভুলে গেলাম?
ঈশানীঃ  সবাই মিথ্যাকথা বলে।মহারাজও মিথ্যে বলেন।এবং মিথ্যা বলার যে স্বাদ,যে তৃপ্তি তার জুড়ি নেই।আমি একথা প্রমাণ করেছি
 রাজন।
রাজাঃ (চমৎকৃত)ও রে,দুষ্টু মেয়ে!তলে তলে এই মতলব নিয়ে তুমি ঈশ্বরের মন্দির বানিয়েছো?
ঈশানীঃ  মহারাজ,আমরা গরিব প্রজারা ধনপ্রাণ বাঁচাবার জন্য অনেক সময় মিথ্যা বলতে বাধ্য হই।বিত্তবান ও ধনবান ব্যক্তিরা অন্যের
 ধন অপহরণের জন্য কিংবা মান বাঁচাবার জন্য মিথ্যাকথা বলে থাকেন। কিন্তু আপনি তো রাজা
আপনার তো ধনের অভাব নেই,মান হারাবারও ভয় নেই।আপনি কেন অকারণে মিথ্যা বলেন?(একটু অপেক্ষা করে)ব-লে-ন তার কারণ
হোলো মিথ্যার মতো মুখরোচক আর কিছু নেই।
রাজাঃ  চমৎকার!তোমারই জয় হোলো,ঈশানী। আমার গলার এই মোতিহার তোমার গলায় পরিয়ে দিয়ে আমি তোমাকে বিজয়ী
 ঘোষণা করলাম। জয় কৃষককন্যার জয়(মালা পরিয়ে দেয়)
মন্ত্রীঃ  এ কী করলেন,রাজামশাই!?
রাজাঃ অন্যায্য কিছু করলাম কি ? এই বুদ্ধিমতী তরুণী  কি পুরস্কারের যোগ্য নয়?
মন্ত্রীঃ  নিশ্চয়ই পুরস্কারের যোগ্য।কিন্তু রাজামশাই, মহান শতানীক বংশে আপনার জন্ম।এই বংশের রীতি হোলো চৈত্রসংক্রান্তির
 পূর্ণিমা তিথিতে এই বংশের কোনো পুরুষ কোনো নারীর কণ্ঠে মাল্যদান করলে এবং সেই নারী বিনা বাধায় তা গ্রহণ করলে  তিথি
মাহাত্ম্যে সেই মাল্যদান পাণিগ্রহণ  রূপে গণ্য হয়।
বিদূষকঃ  তাই তো!তাইতো! আজ তো চৈত্রসংক্রান্তি এবং পূর্ণিমাতিথি।রাজা মশাই নিজের  কণ্ঠহার এই তরুণীর কণ্ঠে পরিয়ে
দিয়েছেন আর তরুণীও তা বিনাবাধায় কণ্ঠে ধারণ করেছেন।
রক্ষীঃ  তার মানে ইনি আজ থেকে আমাদের ছোট রানীমা হলেন!
ঈশানীঃ  (দৃঢ়কণ্ঠে) না,না।কিছুতেই না।
 মন্ত্রীঃ  এখন আর আপত্তি করে লাভ নেই মা।নিয়তি কেন বাধ্যতে! এ হোলো বংশের বিধান।অমান্য করার সাধ্য কারো নেই।রাজারও
 না।
ঈশানীঃ  এ বিধান আমি মানি না। শোষিত উৎপীড়িত কৃষককন্যা আমি।শোষক শাসকের ঘরণী হওয়ার কেনা বাসনা আমার নেই।
বিদূষকঃ  এভাবে বলবেন না ছোটোরানী মা।
ঈশানীঃ  খবরদার! আমাকে রানীমা বলবেন না।
বিদূষকঃ কী বলবো তাহলে?
ঈশানীঃ আমার নাম ঈশানী। যা বলার নাম ধরেই বলবেন।
মন্ত্রীঃ  রাজামশাই সম্পর্কে তোমার ধারণা ভুল মা।উনি শাসক অবশ্য ই,কিন্তু শোষক একদম নন।
ঈশানীঃ নন্? তাহলে তাঁর রাজ্যে কৃষকদের এমন দুরবস্থা কেন? কেন তাদের উৎপন্ন ফসলের দাম নেই?কেন প্রতিবছর সার বীজ
আর প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে?নিত্যনতুন ট্যাক্স বসিয়ে রাজামশাই প্রজাদের অর্থসম্পদ লুঠ করছেন,অস্বীকার
করতে পারেন?
মন্ত্রীঃ  ভুল,ভুল। প্রচণ্ড ভুল করছেন আপনি।প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য রাজামশাই ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ করেন।প্রজাদের
দুঃখকষ্ট দেখলে তার প্রতিকারেরও ব্যবস্থা করেন।ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ কালেই তো রাজামশাই আপনাদের দেখেছিলেন, আপনার কথা
শুনেছিলেন।এমন প্রজাদরদী রাজাকে আপনি অযথা দোষারোপ করছেন মা।
ঈশানীঃ প্রজাদরদী!(বিদ্রূপাত্মক হাসি) প্রজা কি কেবল নগরবাসীরা?গ্রামের কৃষকরা প্রজা নয়? গ্রামের মানুষদের সুখদুঃখের কোনো
 খোঁজ রাখেন আপনাদের প্রজাদরদী  মহারাজা?খরায়- বন্যায় রোগ-মহামারীতে কৃষকদের পাশে দাঁড়ান কি তিনি?তাঁর যত চিন্তা
 শহরবাসীদের নিয়ে।গ্রামে ভালো স্কুল নেই,হাসপাতাল নেই,রাস্তাঘাট নেই সে খবর কি রাখেন আপনাদের প্র-জা-বৎ-সল  রাজা?
রাজাঃ বেশ তো, রাজরানী হয়ে তুমিই না হয়  গ্রামের মানুষদের কথা ভাববে।উদিপুরের রাজার পরামর্শদাতার পদ দেওয়া হবে
তোমাকে।
ঈশানীঃ  লোভ দেখাচ্ছেন? তা ওই পদে কতো সম্মানদক্ষিণা পাওয়া যাবে?মোটা টাকা হলে ভেবে দেখতেও পারি।
মন্ত্রীঃ আপনি কি বেতনের কথা বলছেন? তা কি রাজরানীর পক্ষে সম্মানজনক হবে?
রাজাঃ তুমিই বলো তুমি কী চাও!
ঈশানীঃ মি যা চাই দেবেন? 
রাজাঃ চেষ্টা করবো।
ঈশানীঃ  পারবেন না রাজা,পারবেন না।বিলাসবহুল জীবনযাত্রার হ্যালোজেন আলোয় নারীকে আপনারা দেখে এসেছেন চকচকে
 পেয়ালায় ঝকঝকে পানীয়রূপে।স্বাধিকারপ্রমত্ত পুরুষ কখনই  নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয় না।আপনিি দেবেন না।
রাজাঃ (রাগত)থামো, থামো।অনেক বলেছো তুমি।তোমার রূপযৌবনের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই।নেহায়েত ভুল করে একটা
কাজ আমি করে ফেলেছি। সে য়ভুলের খেসারত আমাকে দিতেই হবে।মহান শতানীক রাজ বংশের রীতিঐতিহ্য অবমাননা করা আমার
 পক্ষে সম্ভব নয়।আজই আমি তোমার বাবাকে আনতে লোক পাঠাচ্ছি। তিনি যদি রাজি হন ভালো।নইলে..
ঈশানীঃ  নইলে বলপ্রয়োগ?  তাই তো?
মন্ত্রীঃ  আপনিই বলুন,মা, রাজামশাই কীভাবে তাঁর বংশের রীতি ঐতিহ্য  রক্ষা করবেন।
ঈশানীঃ  আমাকে ভাবার জন্য একটাদিন সময় দিন।
মন্ত্রীঃ  তা কী করে সম্ভব? কাল পর্যন্ত তো পূর্ণিমা থাকবে না,সংক্রান্তিও না।যা করার আজই করতে হবে।
ঈশানীঃ  তাহলে আর আমি কী বলবো?বলির পশুর কাছে সম্মতি চাওয়ার কোনো অর্থ হয়?
রাজাঃ  এভাবে বলছো কেন,ঈশানী? 
ঈশানীঃ  বলির পাঁঠার সঙ্গে আমার কী পার্থক্য, মহারাজ?প্রথার যূপকাষ্ঠে যেমন করে পশু বলি দেওয়া হয় তেমনি করেই তো
আপনারা আমাকে আপনার বংশের প্রথার হাড়িকাঠে বলি দিতে চাইছেন।সম্মতি দিলে ভালো,নইলে বলপ্রয়োগ। পার্থক্যটা কোথায়
বুঝিয়ে বলবেন?
রাজাঃ (আপন মনে) তাই তো!এভাবে তো কখনও ভেবে দেখি নি।মন্ত্রীমশাই!
মন্ত্রীঃ বলুন রাজামশাই।
রাজাঃ চলুন,আমরা ফিরে যাই।ঈশ্বরহীন এই মন্দিরে আর নয়।আপনি প্রত্যাগমনের ব্যবস্থা করুন।
মন্ত্রীঃ কিন্তু উনি তো এখনও সম্মতি দেন নি।বংশের বিধান তো রক্ষা করতে হবে।তবে কি....
রাজাঃ না। ওকে ওর মতো থাকতে দিন। যে বিধান, যে রীতি বা প্রথা  কারো ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে,মানুষকে মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ
 করে না, তা কখনোই শতানীক বংশের বিধিবিধান হতে পারে না।আপনি এক কাজ করুন,এই মন্দিরের জন্ঢ় আরো এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা
 বরাদ্দ করুন।যাতে উনি ওনার পছন্দমত  যে কোনো বিগ্রহ এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।চলুন...
মন্ত্রীঃ  যথা আজ্ঞা। চলুন তাহলে...(প্রস্থানোদ্যত)
ঈশানীঃ না,না,যাবেন না।
মন্ত্রীঃ কেন মা?আপনি তো আমাদের রাজামশাইয়ের পাণি গ্রহণে  সম্মতি দিচ্ছেন না।তা হলে যেতে নিষেধ করছেন কেন?
ঈশানীঃ রাজামশাইয়ের দেওয়া বরণমালা  আমি তো গলা থেকে খুলে ফেলিনি।এই দেখুন,এখনো সেই মোতিহার আমার গলায় শোভা
পাচ্ছে। 
বিদূষকঃ  তা..তা...তার মানে?
মন্ত্রীঃ  তাহলে?
ঈশানীঃ  আমি রাজার এই মানবিক মুখটাই দেখতে চেয়েছিলাম।প্রথার  চেয়ে হৃদয়ধর্মকে যিনি বেশি গুরুত্ব দেন তিনিই তো হৃদয়েশ্বর
 হওয়ার যোগ্য। দয়া করে আমার বাবামাকে আনার ব্যবস্থা করুন।এই মন্দিরেই হবে বিবাহ অনুষ্ঠান।
বিদূষকঃ জয়, উদিপুরের ছোটোরানীমার জয়।
[মন্দিরের ভেতর থেকে মহিলাদের শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি।]

                  বিঃদ্রঃ নাট্যকারের অনুমতি ছাড়া এই নাটক অভিনয় করা বা নাটকটি বা নাটকের কোনো
                         অংশ মুদ্রণ করা চলবে না
               অন্যতম স্বত্বাধিকারী :পুষ্পিতা নন্দী, দক্ষিণ হাবরা, উত্তর চব্বিশ  পরগণা০৬/০৭/২০১৮ 


                          নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত