মন্দবাসার গল্প
ক্লাইম্যাক্স আসার আগেই বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা শৌভিকের মোবাইল ফোনটাতে একটা ফোন এসে গেল। রিংটোনটা অনুশ্রীর চেনা, তাই কে ফোন করেছে বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। মনটা তেতো হয়ে গেল অনুশ্রীর। তার জন্য শৌভিকের অবশ্য কোনো মাথাব্যথা নেই, খেলা শেষ করে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল বিছানায়; কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়ল বাথরুমে যাওয়ার জন্য।
ফোনটা এসে অনুশ্রীর সব অনুভুতি, সমস্ত আনন্দ মাটি করে দিয়েছিল। শৌভিককে অনেকবার বলেছে এই সময় ফোন সাইলেন্ট মোডে রাখতে কিন্তু ও কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। কাছ থেকে না দেখলে যেমন গোলাপের কাঁটাগুলোকে দেখা যায় না, তেমনই কাছে আসার আগে পর্যন্ত রোম্যান্টিক শৌভিকের এই অবাধ্য স্বভাবটাকে একেবারেই দেখতে পায়নি অনুশ্রী।
কলেজের ফাংশন-এ প্রথমবার দেখেছিল শৌভিককে; দীঘল, ছিপছিপে চেহারা। ঘন কালো এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিল কাঁধের চারপাশে। উজ্বল শ্যামবর্ণের গালদুটো ঢাকা ছিল নরম, মোলায়েম দাড়িতে। ডেনিম আর ব্ল্যাক টি-শার্ট পরা শৌভিক গিটার হাতে স্টেজে উঠতেই হাততালির রোল উঠেছিল। গিটার বাজিয়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রেমের গান গাওয়ার সময় ওকে দেখে একেবারে রকস্টার মনে হচ্ছিল। গান শুনে ছাত্রীরা ফ্লাইংকিস-এর বন্যা বইয়ে দিয়েছিল।
খুশির আমেজে চাদরটা গলা অবধি টেনে নিল অনুশ্রী। এত বছর পরেও শৌভিক সেই আগের মতই আছে; অবশ্য, এখন আর সেই আগের মত কাঁধ অবধি লম্বা এলোমেলো চুল নেই এখন সেটা মার্জিতভাবে কাটা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো। আর সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ওর গোলমরিচ রঙা চুলের ওপর এসে পড়েছে বেশ কয়েক দানা নুনের ছিটে। কলেজের সেই বোহেমিয়ান শৌভিক আজ দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহশীল পিতা। তবুও, এখনও ওকে দেখলে অনুশ্রীর মনে সেই আগের মতই দোলা লাগে। দৈনন্দিন জীবনের বাঁধাগতের বিচারবুদ্ধিগুলোকে পাশে সরিয়ে রেখে অনুশ্রীর মনপাখি, নীড় খুঁজে পায় শৌভিকের অন্তরঙ্গ ভালোবাসায়।
(২)
বাথরুম থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো শৌভিক; এ সি বন্ধ করে জানালার স্লাইডিংটা অল্প সরিয়ে দিল। বিছানায় শুয়ে অনুশ্রী দেখল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে; না, আর শুয়ে থাকলে চলবে না, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। পোষাক ঠিক করে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দিল অনুশ্রী।
একটা ঘুম ভাব আসছে, গা টা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে, কড়া করে এক কাপ কফি বানানোর জন্য কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল অনুশ্রী। ফ্রিজ খুলে দুধ বার করতে গিয়ে খেয়াল হল, ফ্রিজের সবকটা তাক প্রায় ফাঁকা; শাকসবজি, মাছ-মাংস, পনির কিছুই আর নেই। কাল সকালে রাঁধুনি এসে কি রান্না করবে ?
এ বছর প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে মালা আর রিতা লাগাতার চাপ দিচ্ছে পার্টি দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই বাজারে সবাইকে রেস্তোরায় নিয়ে গিয়ে ভুরিভোজ করানোর খরচা অনেক। অনুশ্রী তাই ওদের বলেছিল বাড়িতেই একটা ছোটখাটো গেট-টুগেদারের ব্যবস্থা করবে। কাল, চার-পাঁচজন খুব ক্লোজ কলিগকে নিয়ে সেই গেট-টুগেদার হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আবার সাজগোজ করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বাজার করতে যেতে ইচ্ছা করছে না, অগত্যা...
(৩)
ছোট্ট ট্রে-তে দু'কাপ কফি আর একবাটি চিজলিং সাজিয়ে নিয়ে বেডরুমে ঢুকল অনুশ্রী।
"বললাম তো সোনা, মিটিং-এ ছিলাম, ফোন সাইলেন্ট করা ছিল তাই শুনতে পাইনি", মোবাইল ফোনটাকে কানের কাছে ধরে নিবিষ্টচিত্তে জবাবদিহি করে চলেছে শৌভিক। "ঠিক আছে, আমি ফেরার সময় হাফ কিলো টমেটো আর এক প্যাকেট ক্রিম বিস্কিট নিয়ে যাবো। মাম্পি কি করছে?
ট্রে-টাকে টেবিলে রেখে, একটা কাপ তুলে নিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো অনুশ্রী; ধানাই-পানাই কথাগুলো শেষ হতে আরও কিছুক্ষন সময় লাগবে।
"সব হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে রাখবে। আমি ফিরে চেক করবো। মামমাম-এর কাছ থেকে যদি তোমার নামে কোনো কমপ্লেন শুনি, তাহলে কিন্তু এই উইকেন্ড-এ মুভি দেখতে যাওয়া ক্যানসেল। এবার মামমাম-কে ফোনটা দাও।"
"বিস্কিট আর টমেটো ছাড়া আর কিছু লাগবে ?... ও কে হানি, আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করছি। লাভ ইউ, বা...ই"
ফোন নামিয়ে রাখতেই, শৌভিকের গা ঘেঁসে দাঁড়ালো অনুশ্রী; আদুরে গলায় বলল,"এই শোন না, আমার কয়েকটা জিনিস লাগবে, একটু এনে দে।"
"এখন! এই সন্ধ্যেবেলায় ওখানে কতো ভিড় হয় জানিস," শৌভিককে আর কিছু বলতে না দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে, গালে গাল ঘষতে ঘষতে অনুশ্রী বলল,"প্লি...জ, জিনিসগুলো এনে দে না।"
"ঠিক আছে, কি কি আনতে হবে বল", উপায়ান্তর না দেখে শার্টের বোতাম লাগাতে শুরু করল শৌভিক।
কফির সাথে লিস্টটাও তৈরি করে এনেছিল অনুশ্রী, মিষ্টি হেসে সেটা শৌভিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,'একটু ওয়েট কর। আমি টাকা আনছি।"
"থাক। ওই ভিড়ের মধ্যে ক্যাশ পেমেন্ট করলে আর দেখতে হবে না, ব্যালেন্স পেতে পেতে জান বেরিয়ে যাবে। আমি আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে পে করে দেবো, তুই বরং পরে দিয়ে দিস।"
(৪)
কলেজে পড়ার সময় শৌভিকের সাথে আলাপ হলেও, প্রেমটা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ, অতি রোম্যান্টিক শৌভিক ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই, বন্ধু কল্লোলের, দেড় বছরের ছোট বোন সুমনার সাথে প্রেম করছে। শৌভিক সুযোগ পেলেই পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে, তার মধ্যে সযত্নে রাখা সুমনার ফটোটা সবাইকে দেখাত; হাই-পাওয়ারের চশমা পরা, মোটা মোটা দুটো বিনুনিওয়ালা, অতি-সাধারন দেখতে একটা মেয়ের হাসিমুখের ফটো।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকালো অনুশ্রী। কলেজের পড়াশুনো শেষ করার পর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না শৌভিকের সাথে, আর সব ছেলেবন্ধুদের মতো শৌভিককেও প্রায় ভুলেই গিয়েছিল অনুশ্রী। বছর দুয়েক আগে নতুন অফিসে জয়েন করার পর আবার দেখা হল দুজনের। অফিস এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা, তাই ওদের এই ঘনিষ্ঠতাটা এখনও অফিসের কেউ আঁচ করতে পারেনি, সবাই জানে ওরা পুরোনো বন্ধু।
অবসরপ্রাপ্ত বাবা, সংসারের সব দায়িত্ব হাসিমুখে নিজের ঘাড়ে নেওয়া মা, প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী আর বছর ছয়েকের ছটফটে মেয়েকে নিয়ে, শহরতলীতে বাবার তৈরী করা দোতলা বাড়ীতে রয়েছে শৌভিকের সাজানো সংসার। সহকর্মীর পরিচয়ে একবার সেখানে গিয়েছে অনুশ্রী। পরমা সুন্দরী অনুশ্রীকে দেখে শৌভিকের মা আর বউ দুজনেই বার বার জানতে চেয়েছে, ও কেন এখনও বিয়ে করেনি ?
আত্মীয়স্বজন আর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ জানে না যে, অনুশ্রী একটা টিন-এজার ছেলের মা; সবাই জানে ও অবিবাহিত। এম,এ পাশ করার পর বাবার পছন্দ করা পাত্রের সাথে ওর বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সে বিয়ে বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ছোট্ট তিয়াস-কে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিল অনুশ্রী। প্রাক্তন স্বামীর দেওয়া খোরপোষের টাকায় জীবন কেটে যেত কিন্তু আশা-আকাঙ্খা মিটত না। তাই নতুন করে জীবন শুরু করল অনুশ্রী। প্রথমেই চাকরি জোগাড় করল। তারপর বাবা-মায়ের বারণ সত্বেও তিয়াস-কে একটা ভালো রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করে দিল। আবার বিয়ে করার জন্য চাপ আসতেই বাবা-মাকে ছেড়ে উঠে এল ভাড়ার ফ্ল্যাটে। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনুশ্রী বুঝেছিল বিয়ে করা মানে স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়া; তাছাড়া ছেলেটাও বড় হচ্ছে, ও কি পারবে মায়ের বিয়ে মেনে নিতে?
তার চেয়ে এই ভালো, পরস্পর সুবিধাভোগী মিথোজীবীর সম্পর্ক।
প্রতিবেশিরা মনে করে শৌভিক, অনুশ্রীর তুতো ভাই; মাঝে মাঝে বোনকে দেখতে আসে, বাজার-দোকান করে দেয়।
বাইরে অন্ধকার নেমেছে, আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে ধুপের গন্ধ। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল অনুশ্রী। এখন ওর জীবনে প্রকৃত ভালোবাসার চেয়ে পরকীয়ার এই মন্দবাসাটাই অনেক বেশী কাম্য।