“মেয়ের রেজাল্ট দেখেছ ? জানো কি করেছে তোমার
মেয়ে ?”
সামান্য দুটো কথা ।ঝড়ের মত আছড়ে পড়তেই তার মাত্রা এবং অভিঘাত বদলে গেল ।শমীকের মুখ
নিঃসৃত শব্দস্রোত বজ্রনাদের মত মনে হল ।খুন্তির শব্দ থামিয়ে ছুটে এল বিদীপ্তা
।কি হয়েছে কি ? শমীক কাঁপছে ।ওর চোখমুখ ভয়ঙ্কর রকমের কালো ।বডি লাঙ্গুয়েজে আক্রমনের আভাস তোলপাড় মনে ধাতব শব্দ টের পায় বিদীপ্তা ।“তোমার মেয়ে ” শব্দটা বারবার ধাক্কা দেয় ।কাঁটার মত বিঁধে থাকে মনের গোপন
কক্ষপথে ।শান্ত
বিদীপ্তা তার হাসিমুখের আড়ালে চাপা দেয় যাবতীয় অসহিষ্ণুতা ।
-মুখ কালো করে আছ যে ? কি করেছে তানিয়া ?
বিদীপ্তার সহজ প্রশ্নেও তেতে ওঠে শমীক - মুখ
কালো হবে না তো কি ? এরকম রেজাল্টে কি ধেই ধেই করে নাচব ?
- মাথা ঠাণ্ডা কর ।একটু শরবৎ করে দিই।পরে
....।কথাটা আর শেষ হয় না।তেড়ে আসে শমীক – তোমার আস্কারাতেই মেয়েটা উচ্ছনে গেল। দিনরাত
শুধু আড্ডা ।কবিতা আর ফেসবুক ।মা এরকম
করলে কি পড়ায় মন থাকে মেয়ের ? আর না পড়লে পাশ করবেই বা কি করে ?
ক্লাসে বসে শুধু ছবি আঁকে আর কবিতা লেখে ।
- পাস করতে পারেনি তানিয়া ? অবাক হয়ে জানলার
দিকে তাকিয়ে থাকে বিদীপ্তা – অসম্ভব ।
- আমি কি মিথ্যে বলছি না কি ? ভেরি ভেরি পুওর
ইন ইচ সাবজেক্ট ।অবশ্য তোমার মেয়ে এর চেয়ে আর কত বেশি নম্বর পেতে পারে ।
কড়াইয়ে ঝিঙে পোস্ত ।মৃদু বিষন্ন
বাস্প উঠছে ।থেমে যাওয়া খুন্তির নীরবতায় সারা ঘর গুমোট ।বাড়িটা
যেন থমথমে হয়ে আছে ।বিদীপ্তার মনে হল মেয়েটাকে খুব
বেশি দোষ দেওয়া যাবে না ।ওকে কতটুকুই বা সময় দিতে পারি
আমরা ? পয়সা আছে বলে চারটে টিউশন ।এতেই কি দায়িত্ব শেষ ? সে কি করছে
না করছে তার খেয়াল কোনদিন কি রেখেছে শমীক ? মেয়ের ব্যর্থতার দায় শুধু কি ওর একার ?
সবার নয় ? স্কুল থেকে ফিরে অল্প বিশ্রাম নিল কি নিল না শুরু হয়ে যায় টিউশন ব্যস্ততা ।বাবা মা
কে সারাদিনে কতক্ষনই বা পায় সে ।এক অদ্ভুত একাকীত্ব ওকে ক্লান্ত
করে । নিজেরাও
কি কখনও ভেবে দেখেছি তার সুখ অসুখ সীমাবদ্ধতা ? প্রশ্নগুলো
মনের ভেতর তোলপাড় করলেও তার মনে হল বলা ঠিক হবেনা ।আঁচটা
কমিয়ে দিল ।পোস্ত
সেদ্ধ হচ্ছে ।শুধু
তোমার মেয়ে এই শব্দটা কাঁটার মত ফুটে উঠল মনের গভীরে ।বিদীপ্তা
জানে মেয়ের যেকোন দোষ ত্রুটির দায় তার উপরই এসে বর্তায়।আর এই মেয়েই
যদি এমন কিছু করত ।যা
বেশ গর্বের,অহংকারের ।তাহলে ?
তাহলে শমীক সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত – কার মেয়ে দেখতে হবে তো ।তারপর নিজেদের বংশের গরিমা সাতকাহন করে বলত – সিংহের ঘরে কখনও ছাগল জন্মায়
না ।এখন ব্যর্থতার দায়ভার শুধু তার ।যেহেতু তোমার
মেয়ে ।
তানিয়ার বয়স সবে আট ।ক্লাস থ্রী ।এর
মধ্যেই ওর ব্যস্ততা যে কোন কর্পোরেট অফিসারের চেয়ে কম নয় ।তার সাথে
পাল্লা দিয়ে চলে বিদীপ্তার দৌড় ।ভোর সারে চারটা থেকেই শুরু হয়ে
যায় দিন ।মোবাইল অ্যালার্ম মনে করিয়ে দেয় যে ঘুমিয়ে থাকে তার ভাগ্যও ... ।বিদীপ্তা
সাথে সাথে উঠে যায় ।চোখে তখনও ঘুম লেগে থাকে ।অবশিষ্ট নিদ্রাকে রিসাইকেলবিনে রেখে মুখ হাত ধোয় ।টিফিনের
প্রস্তুতি শুরু করে । মেয়ের হোম ওয়ার্ক বাকি
থেকে গেছে ।হ্যান্ডরাইটিং আর স্পেলিং গুলো ঝটপট সেরে নিতে হবে ।আর এক
ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট সময় ।দ্রুত ছুটতে থাকে ঘড়ির কাঁটা ।বিছানায় উবু হয়ে আছে তানিয়া ।শরীর জুড়ে ক্লান্তির চাদর ।আলিস্যি ।ফলে ঘুম ভাব কাটতে সময় লাগে ।এলোমেলো বইপত্তর সাজাতে সাজাতে এঘর
ওঘর করে বিদীপ্তা ।- এখনও উঠিস নি ।ক্যুইক ক্যুইক ।এই নে হোম ওয়ার্ক গুলো করে নে ।হ্যান্ড রাইটিং ।স্পেলিং ।খাতাগুলো মেয়ের সামনে সাজিয়ে দেয় বিদীপ্তা ।তারপর
রান্নাঘর ।টিফিন
তৈরি হচ্ছে ।ম্যাগি
মেয়ে পছন্দ করে খুব ।কিন্তু সাহস হয়না দিতে ।কদিন ধরে টি
ভি তে যা বলছে ।রুটি
বানায় ।সামান্য
আলু ভেজে দেয় ।দুটো
সন্দেশ ।দুপুর
দুটোয় ফিরবে তানিয়া ।এই সামান্য খাবার ।খিদে তো
পাবেই ।থাকবে ক্লান্তিও ।তবু ক্ষমা নেই ।
এখনও ঘুম ভাঙেনি মহারাণীর ।তেড়ে আসে বিদীপ্তা ।
আমি কালই হোমওয়ার্ক সেরে রেখেছি মাম মাম ।এখন একটু শুয়ে থাকি ।আমার ভালো লাগছে না ।
শুয়ে থাকি বললে হবে ।আমি কখন
থেকে খেটে মরছি ।আর
তুই কী না ...
আর শুয়ে থাকতে পারেনা তানিয়া ।ঘড়ি ধরে হাতমুখ ধোয় ।বাথরুম টিফিন সারে ।ড্রেস পরে ।জুতোর ফিতে বাঁধে ।এর মধ্যে এসে যায় স্কুল বাস ।আর মেয়ের এই কাজগুলোর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে বিদীপ্তা ।
আমার জুতো কোথায় মাম মাম ?
নিজে ঠিকমতো গুছিয়ে রাখতে পারিস না ।সব
আমাকে খুঁজে দিতে হবে ।এই তো ... বলে খুঁজে নিয়ে আসে
নির্দিষ্ট দিনের সাথে ম্যাচ করা জুতো ।
সাদা মোজাগুলো ...
উফ,কোন কাজ
যদি গুছিয়ে করে ।
ওয়াটার বটল ? পেন্সিল ইরেজার ? ......
এতকিছু সামলে মেয়েকে স্কুল বাসে
তুলে দেওয়ার পরও নিস্তার নেই বিদীপ্তার ।এরপর শুরু হবে তার নিজের তোড়জোড় ।রান্নাবান্না ।স্নান ।তারপর
স্কুলের বাস ধরা ।দুঘণ্টা বাস জার্নির পর ঘাম মুছতে মুছতে সে যখন স্কুলে ঢুকবে হেডমাস্টারের
লালচোখে তখন এক গম্ভীর জিজ্ঞাসা – আজও পঁচিশ মিনিট লেট ?
শমীকের প্রশ্নের উত্তরে সে অনেককিছু বলতে পারত ।সে বলতে
পারত তানিয়ার প্রতিদিনের রুটিনের সাথে তার নিজের ব্যক্তিগত লিপ্ততার কথা ।বলতে
পারত তার ক্লান্তি ঘাম স্নেহ আর উৎকণ্ঠার কথা ।কিন্তু সে
কিছুই বলল না ।হেড
মাস্টারের লালচোখকে সে যেভাবে উদাসীনতায় পেরিয়ে এসেছে সেভাবেই অতিক্রম করে যেতে
চাইল সবকিছু ।
আড়চোখে
বিদীপ্তা দেখল শমীকের মুখ চোখ এখনও লাল ।রাগের প্রকোপ আমান্য কমেছে ।
-চা খাবে ? চিন্তাভাবনাগুলোকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে
দিতে চাইল বিদীপ্তা ।
হ্যাঁ বা না কোন উত্তর না দিয়ে তানিয়ার রিপোর্ট কার্ডটা টেবিলের উপর সজোরে
ছুঁড়ে মারল তারপর প্রতিদিন যে অভ্যাসে দরজা খুলে তার চেয়ে অধিক এবং বিরক্তিকর
শব্দে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল শমীক ।কাজকর্মের এই শব্দময় প্রকাশের
আলাদা তাৎপর্য আছে ।বারো বছরের দাম্পত্যে প্রতিটি
শব্দের বিচ্যুতিকে সুন্দরভাবে শনাক্ত করতে শিখেছে বিদীপ্তা এবং শিখেছে মনের ভেতরের
চিৎকারগুলো নিঃশব্দে ধামাচাপা দিতে ।
ঝিঙে পোস্ত হয়ে যাওয়ার পর মাছের ঝোল রান্না
করবে না কি ভাজা মাছগুলো রেখে দেবে রাত্তিরের জন্য ।এই বিষয়ে
ভাবতে ভাবতে তার মনে হল এক কাপ চা খাওয়া দরকার ।মাথাটা
ধরে আছে খুব ।আজ শমীকের অফ ডে ।বিদীপ্তা স্কুলে যায়নি ।কদিন
ধরেই খুব ক্লান্ত লাগছে শরীর ।শরীরেরই বা দোষ কি ।ডেলি
চার ঘণ্টা বাস জার্নির ধকল ।তারপরেও নিস্তার নেই ।ঘরে
এসে তানিয়াকে নিয়ে বসতে হয় ।এতদিন দুবেলা রান্নাও নিজের হাতেই
করত সে ।এতে
তানিয়ার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে ভেবেই একটা মেয়েকে রেখেছে ।ছুটির দিনগুলোতে নিজের হাতে রান্না না করলে তার শান্তি হয়না ।আর একটি শখ আছে তার ।অল্পস্বল্প লেখালেখি ।তাও এমন কিছু আহামরি নয় ।বছরে হয়তো দশ বারো খানা ছোট কাগজে
লেখে ।আর
হাতে গুনে তিন চারটি অনুষ্ঠানে যায় ।ফলে লেখালেখির সুত্রেই ফেসবুকে আলাপ
বেশ কিছু মানুষের সাথে ।এদের সাথে বন্ধুত্ব আর মান অভিমান নিয়েও আলাদা
দুনিয়া ।কবিতার
সংসার ।এর
জন্যও গা পিত্তি জ্বালানো কথা কম শুনতে হয় না তাকে ।তবু ও সে জানে এই ক্লান্তিকর জীবনে কবিতাই তার উজ্জ্বল দিগন্ত ।চাওয়া পাওয়া হীন এক অদ্ভুত বাঁধন ।
চাও বিস্বাদ লাগছে এখন ।তানিয়া একা একা বসে আছে ওর পড়ার ঘরে ।পায়ে
পায়ে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়াল বিদীপ্তা ।
-কি করছিস ?
মাকে দেখে বইটা লুকিয়ে ফেলল তানিয়া ।- কই কিছু না তো ।
-মিথ্যে বলছিস কেন ? আমি তো দেখলাম তুই বইটা
লুকিয়ে ফেললি ।
-ওটা একটা গল্পের বই মাম মাম ।তোমার টেবিলে ছিল ।কি সুন্দর টানটান লেখা ।তোমাকে না বলে নিয়েছি ।তোমার টেবিলে কত বই ।আমার সবকিছু পড়তে ইচ্ছে করে ।খুব পড়তে ইচ্ছে করে ।
আজ শনিবার ।তানিয়ার
ক্লাস নেই ।শনি রবি দুদিন ছুটি পায় মেয়েটা ।এই দুদিনই যা একটু দেরি করে ঘুম
থেকে উঠতে পারে ।সাতটায় ।তারপর এক নাগাড়ে পড়াশোনা চলে এগারোটা পর্যন্ত ।সারা
সপ্তাহের সমস্ত ক্লাসওয়ার্ক এই দিনগুলোতেই ঝালিয়ে নেয় সে ।রুটিন
অনুযায়ী ওর এখন ম্যাথস পড়ার কথা।তা না করে তানিয়া লুকিয়ে লুকিয়ে
গল্পের বই পড়ছে ।আগে কার্টু ন চ্যানেল দেখত বলে ওর বাবা কেবল কানেকশনই বন্ধ করে দিয়েছে ।মেয়েকে কি শাসন করা উচিত ? বলা উচিত তোমার জন্য অনেক অপমানিত হয়েছি আমি ? আর
তুমি কিনা তোমার কাজ না করে গল্প পড়ছ । বিদীপ্তা
দেখল মেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে ।ওর মুখে চোখে আতঙ্কের ফ্যাকাশে
আস্তরন ।মেয়েকে বকতে গিয়েও বকতে পারল না
বিদীপ্তা ।কতকিছু জানে এইটুকুন মেয়েটা ।বিদীপ্তা ভাবে - “ওর বয়সে কিছুই তো জানতাম না
আমরা ।কম্পিউটার কেমন হয় দেখতে তাই তো জানতাম না ।” মেয়ের অনেক কাছে এগিয়ে এল বিদীপ্তা ।ওর মাথাটা
নিজের কোলের মধ্যে রেখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ।তাড়াতাড়ি
রান্নাটা সেরে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে।
-তুই না কি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছবি আঁকিস ?
কবিতা লিখিস ? মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিদীপ্তা জানতে চাইল ।
- সে তো একদিন ।জানলার
বাইরে আকাশ দেখতে দেখতে মনটা কেমন হয়ে গেল হঠাৎ ।
- ওরকম করতে নেই ।
- আমার তো ভালো লাগে আকাশ দেখতে,পাখি দেখতে আর তোমার টেবিলের বইগুলো পড়তে ।
- সেসব বড় হলে পড়িস,কেমন ?
- তখন কি আর এসব ভালো লাগবে মামমাম ?
এর উত্তর বিদীপ্তার জানা নেই ।অনেকদিন হল সে পাখি দেখেনা,গান শোনে
না,আকাশ দেখেনা ।শুধু জানে সাতটা পঞ্চাশের বাস না এলে একদিন সিএল চলে যায় ।
- ওই গল্পটা বলো না মাম মাম ।সেই ছোট মানুষটার গল্প ।যে পাহাড়ে উঠতে চাইত ।ওর ছোট ছোট পা ।তবু ও ভয় পেত না ।সে
জানত এক একটা ধাপ পেরিয়ে সে একদিন পাহাড়ে উঠতে পারবে ।পারলও ।সেখানে এক ভয়ংকর দৈত্য ।ছোট ছোট হাত তবু সে দৈত্যটাকে হারিয়ে
দিল ।মানুষের মনের জোরই আসল তাই না মাম মাম ?
মাথা
নাড়ে বিদীপ্তা,বুঝতে পারে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসব
পড়ে মেয়ে ।অদ্ভুত
চোখে তাকিয়ে থাকে তানিয়ার দিকে ।
শমীক ফিরে এল
আবার ।বেশিদূরে সে যায় নি ।হয়তো এই সামনেই মোড়ের মাথায় আড্ডা
মেরে এল কিছুক্ষন ।ওর তো তেমন কোন নেশা নেই,লিপ্ততা
নেই ।চাকরি আর ঘর সংসারের বাইরে কোন দুনিয়ার সন্ধান পায়নি বলেই চিন্তার
লক্ষণরেখাগুলি মুখের মধ্যে ফুটে উঠে ।তার কোন শিল্পময় প্রকাশ সম্ভব
হয়নি ।কদিন ধরেই ওর মনের রুক্ষতা টের পাচ্ছে বিদীপ্তা ।সামান্য
ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেও রাগ একেবারে পঞ্চমে ।একটু
শান্ত না হলে কিছুই জিজ্ঞেস করা যাবে না ।ওর অন্তর্বর্তী শূন্যায়তনে কিসের
ছায়া ? জানা দরকার ।অথচ জেনে নিতে চাইলে আরও বেড়ে
যেতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর ।কদিন ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে
না শমীকের ।রাতে সাধারনত ঘুম ভাঙে না বিদীপ্তার ।সারাদিনের
ক্লান্তি তাকে একটি সুন্দর বিরতীবিহীন নিদ্রা উপহার দেয় ।তবু কাল ঘুম
ভেঙে গিয়েছিল ।বাথরুম যাওয়ার সময় বিদীপ্তা বুঝতে পেরেছিল শমীক এখনও ঘুমোয় নি ।ওর নড়াচড়া,ওর নিশ্বাসের শব্দপ্রবাহ
বলে দিচ্ছিল না মানুষটা ঘুমোতে পারছে না ।
এখনও জেগে আছ ? কটা বাজে জানো ?
তুমি চিন্তা করো না তো ।ঘুমাও
... বকবক করে আমার ঘুমটাকে তছনছ করে দিও না ।
রাত তাই আর আর বিশেষ কথা বাড়ায় নি বিদীপ্তা ।অথচ সে বুঝতে পারছে কোথাও একটা কিছু হচ্ছে ।যা
ক্রমাগত গোপন করে যেতে চাইছে শমীক ।
দুপুরে স্নান এবং খাওয়া দাওয়ার পর শমীককে কিছুটা শান্ত সহজ মনে হল ।তানিয়া বিছানায় শুয়ে আছে এখন ।বেশিক্ষন ঘুমোতে পাবে না ।একটু বাদে আবার উঠবে ।নাচের ক্লাস আছে ।একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে বসে আছে শমীক ।প্রকৃতি
দেখার যে খুব অভ্যাস আছে তাও নয় ।বরং একটু কেজো মানুষ ।আবেগ বরাবরই কম ।কারখানায় কাজ করার জন্য
যন্ত্রপাতির সাথে সহবাস করতে করতে যান্ত্রিক হয়ে গেছে তার মন ।জানলার ফাঁক দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল কুণ্ডলীকৃত ধুয়ো ।বিদীপ্তা
চেয়েছিল শমীকের মুখের দিকে ।চিন্তার বলিরেখাগুলো টের পাচ্ছিল
সে ।মেয়ের
ব্যর্থতা নয় ।তার
চেয়েও অসহনীয় হয়ে উঠছিল শমীকের মনের ভাঙচুর ।সৎ,পরিশ্রমী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেমে অফিসে বেশ সুনাম
আছে ।একটু রগচটা কিন্তু পরোপকারী ।ভালোবাসার দিক থেকেও নিখাদ এবং
দায়িত্বশীল ।রাগ বরাবরই একটু বেশি ।এসব গায়ে না মেখে শ্রদ্ধাই জীবন্ত
হয়ে উঠেছে বারো বছরে ।সিগারেট নিভে যেতেই আবার সিগারেট
ধরাল শমীক ।বিদীপ্তা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে বসল শমীকের পাশে ।অনেকক্ষণ
তারা নীরবে বসে রইল ।বিদীপ্তা বুঝতে পারছিল না একটা
সামান্য ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট কি করে এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ।একটা বাচ্চা মেয়ে যার সারাদিন খেলা করলেও কোন দোষ নেই ।হয়তো
পড়ার বইএর চেয়ে গল্পের বই নিয়েই সে মগ্ন হয়ে পড়েছিল এই কয়েক সপ্তাহ ।অথবা
পড়াশোনার মাঝেও বারবার তার মনে হানা দিয়েছে এক কল্প জগত ।কতকিছুই তো
হতে পারে ।ওর
সামনে এখন পড়ে আছে অনন্ত স্বপ্ন ।ভুল শুধরে নেওয়ার সীমাহীন সুযোগ
।এইসব ভাবনার ভেতর দিয়েই শমীকের কাঁধের কাছে নিজের হাতটা নিয়ে এল
বিদীপ্তা - এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এত ভেঙে পড়লে চলে ?
সিগারেট নিভিয়ে দিল শমীক তারপর সেই অবশিষ্ট
অংশ ছুড়ে ফেলল জানলার ওপাশে – আমি মেয়ের রেজাল্ট নিয়ে ভাবছি না দীপ্তা ।
তাহলে ?
এবারও আমি প্রমোশনটা পেলাম না ।মিস্টার প্রলয়
তালুকদার,এই সেদিনের ছেলে আমাকে টপকে ...
বিদীপ্তা শুনে যাচ্ছিল কথাগুলো ।নির্বিকার ।কোন
প্রতিক্রিয়া উঠে আসছিল না কণ্ঠস্বরে ।
ওকে আমি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছি ।কিছু জানত না ছেলেটা ।একদম সিন্সিয়ার নয় ।পাংকচুয়ালিটি তো নেই বললেই চলে ।টেকনিক্যাল স্কিল বলার মত কিছু নয় ।সে আমাকে টপকে আমার বস হয়ে গেল ।আমি মন থেকে মানতে পারছি না দীপ্তা ।আমার কষ্ট হচ্ছে ।এই
যে এত সময় দিলাম ।তোমাদের
দিকে না তাকিয়ে নিজেকে নিংড়ে দিলাম ।মানুষের এফিসিয়েন্সির কোন দাম নেই ।ট্যালেন্ট
বলে কোন শব্দ ... শমীক বলে যাচ্ছিল নিজেকে নিংড়ে ।গলার স্বর আর্দ্র হয়ে আসছিল শেষের দিকে কথাগুলো আর শুনতে পাচ্ছিল না
বিদীপ্তা ।ওর ক্ষোভ রাগ আর ক্ষতস্থান কোথাও না কোথাও উন্মুক্ত জায়গা খুঁজছিল ।বাড়িতে নয় বাড়ির বাইরে কোথাও কাউকে বলে সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে নিতে চেয়েছিল
সে,কিন্তু শমীক আর নিজেকে ধরে রাখতে
পারল না ।বিদীপ্তার
মনে হল শমীকের মুখটা যেন উজ্জ্বল হয়ে আছে আজ ।যেন
অনেক ভার এবং যন্ত্রনা সে দুহাতে সরিয়ে দিয়েছে দূরে ।
কখন তানিয়া এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে ।ওরা টের পায়নি ।
তুমি মন খারাপ করছ কেন বাপি ?
কই,না তো ।
তোমার মুখ শুকনো লাগছে ।ফ্যাকাশে
হয়ে গেছে ।
শমীকের কোলের কাছে চলে এসেছে তানিয়া ।তাকিয়ে
আছে চোখের দিকে ।একটা ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন মেঘলা আকাশের মত স্থির হয়ে বসে আছে চোখের কোণে ।
অজানা অচেনা এক নরম মানুষকে সে দেখছে ।এক অন্য বাবাকে ।তানিয়া আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল
প্রতিদিনের টুকরো টুকরো ছবি ।তারপর শমীকের গালের উপর নিজের নরম
হাতটা রাখল মাথায় হাত বুলিয়ে দিল – ভেঙে পড়ছ কেন বাপি ? মনের
জোরটাই আসল ।দেখো একদিন তুমিও ঠিক পাহাড়ের উপরে উঠতে পারবে ।কোন
দৈত্যের ক্ষমতা নেই তোমাকে আটকে দেওয়ার ।
শমীক দেখল চারপাশ অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে গেছে ।কালমেঘের
রসের মত একটা তিক্ত স্বাদ পেরিয়ে কি সুন্দর মিষ্টি লাগছে আবার সবকিছু ।যেন
সে স্মৃতির ভেতর ফিরে পেয়েছে তার হারানো পাসওয়ার্ড । দিগভ্রান্ত
এলোমেলো ভাবনাগুলোর উপর এসে পড়ছে সম্ভাবনার প্রসূতি আলো ।আর এই আলোয়
সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তানিয়া নয় তার মা যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এখন ।
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়