অগ্নিকালের উপন্যাস-অভিজিৎ চৌধুরী
গ্রন্থ আলোচনায় শীর্ষজিৎ চৌধুরী
অগ্নিঋষি এক অগ্নিময়
সময়ের আখ্যান। ১৯০৮-এ বোমার মামলা, অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্ব ভারতবর্ষের পূর্ণ
স্বাধীনতার লক্ষে সহিংস সংগ্রাম এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। অভিজিৎ চৌধুরী মূলত
একজন ঔপন্যাসিক। ধর্মান্তর , অনুগামিনী, সমাগত মধুমাস ২ টি খণ্ডে তাঁর এ পর্যন্ত
প্রকাশিত উপন্যাসগুলির মধ্যে ব্যক্তি জীবনের আলো, ঋগ্ধ সময় এবং নিজস্ব কল্পনার
চারণ-ভূমি ছিল। সময়গুলি উপল খণ্ডের মতোন ১৮১৭ থেকে ১৮৮৩-৮৪ অবাধি কখনও ব্যাপ্ত
ছিল, আবার কখনও পরিধি বিস্তৃত হতে হতে ১৯০২ অবাধি বিস্তার ঘটিয়েছিল। ভারতবর্ষের
বিপ্লবাত্মক স্বাধীনতা আন্দোলনের এবং চরমপন্থার প্রকাশ অরবিন্দের নেতৃত্ব যে
নান্দীমুখ রচনা করেছিল – সত্যিকারের ইতিহাসে এমন কথাই বলে। তবে সেই বিপ্লবের বীজতলা
তখনও তেমন আবেগ দ্বারা পুষ্ট হলেও বিপ্লবের গোপনীয়তা, শীলন-নীতির সূচি সম্পর্কে
অবহিত ছিল না। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে
অরবিন্দ খানিকটা দুর্বলই ছিলেন – এই উপন্যাস এর তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে
নির্দিষ্ট কোন অভিমতে না গিয়ে। তিনটি কেন্দ্রীয় চরিত্র
উপন্যাসের দ্বান্দ্বিক মর্যাদা দিয়েছে – ১) অরবিন্দ ২) বারিন ৩) হেমচন্দ্র। অরবিন্দ সু-বক্তা ও
জ্ঞানী। বিপ্লবাত্মক কর্মসূচীর চাইতেও তিনি সারস্বত সাধনার পথিক। ‘সাবিত্রী’
মহাকাব্যের কিছু ঝলক উপন্যাসকে ঋদ্ধ করেছে। তিনি বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন
মহারাজার অধীনে। বেতন ছিল তখনকার দিনে যথেষ্ট লোভনীয়। এছাড়া বাংলো এবং অন্যান্য
সুবিধাও ছিল। বারিন বরাবরই ভবঘুরে ,
দিশাহীন যুবক। পাটনায় তাঁর চায়ের দোকানও ছিল ~ ‘ ঘোষ টি স্টল ’। তিনি কলকাতায় ‘মনোহারি’ স্টলও খুলেছিলেন । Inconsistencies তাঁর চরিত্রের অন্যতম
লক্ষ্মণ। সেই বারিন এলেন বরোদায়।
সান্নিধ্য পেলেন সেজ-দা এবং অরবিন্দ ঘোষের। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
হয়েছিল ১৮৮৫-এ , বেশ কয়েকটি বেশ কয়েকটি অধিবেশন হয়ে গেছে । কংগ্রেস তখনও ব্রিটিশ
সরকারের প্রতি আনুগত্যে বেশী আগ্রহী। আবেদন – নিবেদন নীতির পক্ষপাতি কংগ্রেসের
বর্ষীয়ান নেতারা।য়ূরোপের শিক্ষা ও চেতনা
অরবিন্দের ছিল। কংগ্রেস এরকম একজন শিক্ষিত বাগ্মীকে আহ্বান করলো। ততোদিনে ইন্ডিয়ান সিভিল
সার্ভিস পরীক্ষার কৃতকার্য হওয়ার দোরগোড়ায় এসেও এক রকমের ব্রিটিশ প্রশাসনিক
স্ট্রাকচার উপেক্ষা করলেন অরিবিন্দ। স্বাধীনতা যে আবেদন –
নিবেদন নীতিতে আসবে না তরুণদের মধ্যে সোচ্চার হচ্ছে সেই অভিপ্রায় কিন্তু নেতা নেই
। অনুশীলন , যুগান্তরের গঠন
পর্ব চলেছে । উল্লাসকর , উপেন্দ্রনাথ এবং কিছু যুবক ভারতবর্ষের স্বাধীনতার
অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিতে আগহী ।অরবিন্দ হয়ে উঠলেন নতুন
ঋত্বিক । তিনি মেদিনীপুর গেলেন ২ বার। শেষবার হেমচন্দ্রকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা
দিলেন ।ঔপন্যাসিক অরবিন্দের
দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে Detailing এ যত্নবান ছিলেন। বরোদার মহারাজার দৌত্যে তিনি
এই বিবাহ করেছিলেন ।রাজার কলেজের চাকরি
ছাড়লেন কিন্তু স্ত্রীকে তো তিনি তখনও ত্যাগ করেননি , এমনকি পণ্ডিচেরী আত্মগোপনের
যাত্রাপর্বের অন্তিম মুহূর্তেও স্ত্রী মৃণাল সঙ্গিনী ছিলেন ~ সুখ- দুঃখ, সাফল্য
ব্যর্থতা সব কিছুর । ইতিমধ্যে হেমচন্দ্র দাস
কানুনগো বিদেশে গিয়ে বোমা নির্মান শিখে এসেছেন । সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও তাঁকে
আকর্ষণ করেছে ।উপন্যাসে সবচেয়ে হঠকারী
চরিত্র ‘বারিন’ । অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে অন্যান্য বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের
মধ্যবর্তী পাঁচিল। অরবিন্দ ঘোষও কখনও Mystic
সাধনায় মগ্ন, কখনও বা রাজনৈতিক কর্মধারায় ব্যাপৃত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা
আন্দোলনের পক্ষে দ্বান্দ্বিক চরিত্র। লেখক ভগিনী নিবেদিতাকে
উপস্থাপন করেছেন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে । তিনি চান ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও বিপ্লবীদের
পরম সুহৃদ হতে কিন্তু তাঁর চরিত্রও বড্ডো বেশী ভাবালুতা এবং আবেগে মথিত। ফলে
অরবিন্দের নিস্পৃহ মূল্যায়ন – তিনি অনেক গোপন খবর আবেগের বশে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন
।অথচ এই মূল্যায়নের দৃঢ়তা
অরবিন্দ ঘোষ বারিনের ক্ষেত্রে দেখাতে পারছেন না।একের পর এক আত্মাহূতি
হচ্ছে কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের বিন্দুমাত্র অগ্রসরন হচ্ছে না ।একাটিও বোমা না ফাটিয়ে
মুরারিপুকুর , গ্রে স্ট্রিট থেকে বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হলেন ।অরবিন্দের মুক্তির দাতা
হিসেবে আমরা সকলেই জানি চিত্তরঞ্জনের বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাম কিন্তু
উপন্যাসের শর্ত মেনেই এক ঐতিহাসিক সওয়াল – জবাব লিপিবদ্ধ করেছে উপন্যাস – অগ্নিঋষি
।দ্বীপান্তরের জীবনও খুব
সংক্ষেপে কিন্তু নিষ্ঠা, আবেগ আবার কখনও লঘুচালে চিত্রিত হয়েছে ।ঔপন্যাসিক কুশলী , ক্রান্তদর্শিতা
যে রয়েছে সমকালের দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। উপন্যাস মেদ-বহুল নয় ।
বরং আরো একটু পৃথুলা হলে মন্দ হতো না ।অরবিন্দ ঘোষ আর ফিরবেন
কিনা ~ এমন ইংগিত উপন্যাসে স্পষ্টভাবে নেই। তবে কারাবাসের অন্তরালে অন্য অরবিন্দ
উন্মোচন শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে অন্য রকমের আত্ম-বীক্ষণ
ও জিজ্ঞাসার ।তবে ভারতবর্ষের সহিংস
পথের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনি যে প্রথম কিংকর ~ সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।প্রচ্ছদ আরো একটু
সাংকেতিক হলে ঔপন্যাসিকের ভাষা ও চারিত্রায়নের গূঢ়তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতো।
অগ্নিঋষি প্রকাশক – পুনশ্চ
মূল্য – ১৭৫ টাকা