পুরাণই হোক
বা মিথ, জনমানসে এর প্রভাব অসীম , গভীর এবং দীর্ঘ সময়ের। এই প্রভাব শুধু লিখিত সাহিত্যে
নয়, আমাদের চিন্তাচেতনায়, ভাষায়, সামাজিক
আচার আচরণে আছে। শিল্পকলার অন্যান্য শাখাতেও আছে। গানে আছে, আঁকায় আছে, লোকসাহিত্যে
আছে, কথকথায় আছে। আমাদের দৈনন্দিনের মুখের ভাষাতেও এর প্রভাব আছে। জেনে, না জেনে, আমরা
এর ব্যবহার করে থাকি নিয়ত। তাই পুরাণ নির্ভর কিছু লিখতে না চেয়েও, সাহিত্যে পুরাণের
ব্যবহার করতে না চেয়েও বা সমকালকে
পুরাণের বিভিন্ন কাহিনির আলোয় দেখতে না চেয়েও এমন কিছু লিখে ফেলি যাতে পুরাণের প্রভাব
কোথাও না কোথাও দেখা যায়। অগস্ত্যের যাত্রা, ত্রিশংকু বা মধ্য পথে হরিশচন্দ্র,
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, ধর্মপুত্র
যুধিষ্ঠির , মান্ধাতার আমল , দাতাকর্ণ , শকুনের দৃষ্টি, ঘরের শত্রু বিভীষণ, লঙ্কাকাণ্ড,
শিবহীন যজ্ঞ - এসব কথা উপমা,
ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও আরও নানান কারণে লেখার মধ্যে ব্যবহার করে থাকি।
সাহিত্যের
ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মেঘনাদবধ কাব্যটিই মহাকাব্য তথা পুরাণ নির্ভর। তার পরিবেশনের ধরন, ভাষার প্রকরণ এবং চেতানায়
দৃষ্টভঙ্গির বিপ্লব আলাদা। কিন্তু মূল মসলা, যাকে উপলক্ষ করে তিনি নতুন কথা ,নতুন করে
বলতে কলম ধরলেন , তা পুরাণ নির্ভর। কল্পনার অতিকায় দেবচরিত্র বা দেবতাকে উজ্জ্বল করে
তোলার জন্য সৃষ্ট রাক্ষস চরিত্রদের নিয়েই লেখা। এই মহাকাব্য ছাড়াও, তাঁর অন্যান্য কবিতা
ও নাটকেও এর স্পষ্ট নজির রয়েছে।এই আলোচনায় মধুসূদনকে আলাদা করে উল্লেখ করছি না। আমার
সে ক্ষমতা ও এই প্রবন্ধের পরিসর ,কোনোটিই নেই।
আলাদা করে
উল্লেখ করব না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। তাঁর সাহিত্যেও এর ভূরিভূরি প্রয়োগের প্রমাণ
আছে। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রমানসই আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত ইউরোপীয় চিন্তাচেতনার প্রভাবের সঙ্গে
সঙ্গে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদের দ্বারাও ঋদ্ধ ছিলো।তার প্রভাব তাঁর গানে, প্রবন্ধে এক
অতি উজ্জ্বল বর্ণময় দ্যুতির সৃষ্টি করেছে।
আলাদা করে
উল্লেখ করব না নজরুল ইসলামের কথা। তাঁর রচনাতেও পুরাণের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। এক
বিদ্রোহী কবিতাতেই অসংখ্য পুরাণ চরিত্র, ঘটনা ও স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের বিভিন্ন স্থানের
উল্লেখ আছে। এইসব পুরাণ বা মিথের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি সবচেয়ে বড় যে কাজটি করতে
চেয়েছেন তা হলো ধর্মের সীমিত গণ্ডির বাইরে বার হওয়া, উর্দ্ধে ওঠা।
তাছাড়া বিদ্যাসাগর
সহ বহু বিদগ্ধ জনের সাহিত্য কর্মে, অনুবাদ
সাহিত্যে এর নজির আছে। বিদেশী পুরাণের বা মিথেরও ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন
লেখকের মাধ্যমে। সাহিত্যে পুরাণের বা মিথের ব্যবহার কতটা ইতিবাচক, তা নিয়েও মতান্তর
আছে পণ্ডিতদের মধ্যে। মতান্তর যাই থাক, এই শতকের এই সময় পর্যন্তও পুরাণের ব্যবহার লক্ষ্য
করা যাচ্ছে কবিতার মধ্যে, হাল আমলের নবীন এবং প্রবীণ কবিদের কবিতাতেও। পুরাণাশ্রিত
উপন্যাসগুলো তো উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠছে বহু ক্ষেত্রেই ।
আমি কিছু খ্যাত
অখ্যাত কবির কবিতায়(যত কম সংখ্যক কবি ও কবিতার উল্লেখ করা যায়)পুরাণের ব্যবহারের কথা
বলব।
বাংলার মুখ
আমি দেখিয়াছি
জীবনানন্দ
দাশ
"...;
বেহুলাও একদিন গাঙুরের জলে ভেলা নিয়ে -
কৃষ্ণা দ্বাদশীর
জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের
পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়
শ্যামার নরম
গান শুনেছিল,- একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার
মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী
মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।"
জন্মভূমি
,মাতৃভূমি, প্রিয় স্বদেশের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি মিথের ব্যবহার করেছেন। শিব, ইন্দ্র,
ইন্দ্রের সভা পুরাণের চরিত্র বা স্থান। অতি সুন্দর, অতি পবিত্র, অতি বর্ণনাতীতকে বর্ণনা
করার জন্য এইসব চরিত্র বা স্থানকালের আশ্রয় নেওয়া হয়, পাঠক নিজের কল্পনা মতো, তার অসীমের
সীমা পর্যন্ত তাকে বাড়িয়ে নিতে পারে। লিখিত বিষয়ের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বেড়ে যায়।পুরাণের
কল্পিত চরিত্রগুলোর রূপ ও ক্ষমতার যেহেতু কোনো সীমিত মাপ ছিলো না, অসীম ছিলো, তাই বর্তমান
লিখিত কবিতার বিষয়টিও অসীম হয়ে উঠল।
অমিয় চক্রবর্তীর
কবিতা 'বৈদান্তিক' পুরোটাই পুরাণের সম্পর্কে কিছু বলছে, কিন্তু পুরাণের কোনো গল্প,
চরিত্র বা সময়ের কথা না উল্লেখ করে। বেদবেদান্তের কোনো কথাই নেই সরাসরি, ওই নামকরণটুকু
ছাড়া।
" প্রকাণ্ড
বন প্রকাণ্ড গাছ,-
বেরিয়ে এলেই
নেই।
ভিতরে কত লক্ষ
কথা, পাতা পাতায়, শাখা শাখায়
সবুজ অন্ধকার;
জোনাকি কীট,
পাখি পালক, পেঁচার চোখ, বটের ঝুরি,
ভিতরে কত আরো
গভীরে জন্তু চলে, হলদে পথ,
তীব্র ঝরে
জ্যোৎস্না-হিম বুক-চিরিয়ে,
কী প্রকাণ্ড
মেঘের ঝড় বৃষ্টি সেই আরণ্যক-
বেরিয়ে এলেই
নেই।"
"জগৎ
মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য" - এর বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ - "অনাসক্ত নদীর জলে সিক্ত
মাটি "
মান্ধাতার
পিতা যুবনাশ্ব, 'দা প্রেগন্যান্ট কিং' , রাজা যুবানাশ্বের গর্ভবান হওয়া ও
মান্ধাতার জন্মের আজব গল্পকে উদ্দেশ্য করে লেখা মণীশ ঘটকের কবিতা 'যুবনাশ্ব না? ' ।
কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে নরক-গুলজার, কুম্ভীপাক,
পুন্নাম, রৌরব- এইসব শব্দ । শব্দগুলোর সুদক্ষ ব্যবহারে এক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা।
একই রকম একটি
শ্লেষাত্মক কবিতা 'চেলা উপনিষদ' , কবি মনীন্দ্র রায়।
" যখন
বশিষ্ঠ বিজ্ঞ, সুতপা বাল্মীকি, ব্যাস ধীর,
এবং অজস্র
আরও উপঋষি-আধাঋষি মিলে
গূঢ় ব্রহ্ম-সাধনার
মধ্যপথে সহসা অস্থির
ভাবেন, থাকে
কি নাম মৃত্যু এসে দোরে হানা দিলেও?
তখন অজিন চর্ম,
আরণ্যক, কাব্যচিন্তা ছেড়ে
কমণ্ডলু হাতে
সব, জটা বেঁধে দু পায়ে খড়ম ,
নগরের পথে, গ্রামে, বলে যান; শুনহ অরে রে ,
আমার শরণ নাও,
কেশাগ্রও নাহি পাবে যম।" মানুষের ধর্মভয়কে মূলধন করে জীবন ধারণের এক সহজ, শ্রমবিমুখ
উপায়।
মনীন্দ্র গুপ্তের
'ভীষ্ম' ও 'রামায়ণের সন্ধ্যা' দুখানা অসাধারণ কবিতা আছে। 'ভীষ্ম' কবিতাটির মধ্যে 'শিখন্ডী'
শব্দটি ছাড়া মহাভারতের আর কোনো চরিত্রের কথা বলা নেই। মহাভারতের কোনো কাহিনিও নেই।
নাতবউকে নিয়ে লেখা কয়েকটি লাইন, দাদু যেখানে কবি নিজে। স্পষ্ট বোঝা যায় কবি নিজেকে
স্বয়ং ভীষ্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন।এবং কোথাও যেন ভীষ্মের সঙ্গে শিখন্ডী তুলনীয় হয়ে
উঠেছে।
অন্য কবিতাটিতে
হনুমান স্বয়ং সীতার, কোথাও বলা নেই তবু যেন, প্রেমাস্পদ। সে কবিতায় রাম, লক্ষ্মণ, সীতা
ও অযোধ্যার পুরো রাজ্যসভা "মাথা নিচু করে নির্বাক হয়ে আছে" নিজের বুক চিরে
মেলে ধরা হনুমানের সামনে। হনুমানের যেন বিশ্বাস রয়েছে - " সীতা বর দিয়ে হাত বুলিয়ে
/ তাঁর বুকের অতখানি ছেঁড়া চামড়া কখন জোড়া দিয়ে দেন।"
ফাটা বুকে
ওষুধের প্রলেপ দেবেন।
বুদ্ধ পূর্ণিমার
রাত্রে
অলোকরঞ্জন
দাশগুপ্ত
মাঠের পিঞ্জর
ভেঙে কখন সহসা
কে অনন্যা
উঠে এল,দীপ্তি যার অহল্যার চেয়ে
উত্তীর্ণ হয়েছে
আরও দুর্বিষহ ধৈর্যের তমসা
গৌরীর চেয়েও
যার রুচিরাক্ষমালা
প্রতিজ্ঞার
প্রতিভার জ্বালা -
এবার আমায়
দেখে ভ্রূকুটির ভস্মরেণু ছেয়ে
দুচোখে শুধাল
কী নাম তোমার
বলো,হোমাগ্নিশিখায় তাকে জ্বালো।"
কবিতাটি শুরু
হয়েছে
" সুগত, এ-জন্মে আমি কেউ না তোমার " এ কথা বলে।
শেষ হয়েছে
-
" এ-জন্মে
জানি না - তবু আর-জন্মে সুজাতা ছিলাম।"
সুগত তথা বুদ্ধ
সমালোচিত হয়েছেন সুজাতা তথা নারীর দৃষ্টিতে।
অন্য একটি
কবিতা 'যে-রাখাল দূরদেশী' তে দেখি-
" রাখালিয়া
গীতি হাতে নিয়ে ভার্জিল
সারা বিশ্বেরে
শোনালেন সেই গান ,
যমুনাপুলিনে
কৃষ্ণের সম্মান,
রাখালের হাতে
গীতিকবিতার মিল।"
স্বদেশের সাহিত্য
,শিল্প ,কৃষ্টি নিয়ে আমরা উন্নাসিকতা দেখিয়ে থাকি। বিদেশের আলোয়, বিশেষত ইউরোপীয় আলোয়
দেখতে চাই সবকিছু।মূল্যায়ন করতে চাই না কাছের জিনিসকে । বিলেত ফেরত হয়ে আসা স্বদেশী
রত্নকে আবিষ্কার করি তাদের চোখ দিয়ে।
শকুন্তলা
ভাস্কর চক্রবর্তী
" ঋষি
বালকেরা ছিলো
ছিলো তাল তমালের
সারি
আর ছিলো মালিনী
নদীটি।
পাতার কুটির
ছিলো
ছিলো হাঁস,
হরিণেরা
আর ছিলো কচি
ঘাস, বর্ষার ময়ূর।
তিন হাজার
বছরের বৃদ্ধ বটগাছ
কণ্বদেব, মা
গোতমী,
সামবেদ গান।
আমি আজ অন্ধ
হয়ে গেছি
বধির হয়েছি
আমি -
শকুন্তলা,
এখন কোথায়? "
সম্পূর্ণ কবিতাটিই
তুলে দিলাম। অবনীন্দ্রনাথ-ঢঙে সহজ, সরল উপস্থাপনা। কেবল একেবারে শেষে প্রেমিক কবির
শকুন্তলার জন্য আর্তি প্রকাশ পেয়েছে। মহাকাব্যের শকুন্তলা হয়ে উঠেছেন কবির প্রেমের
আধার এক সাধারণ মানবী। পাঠক যেন তাঁকে দেখতে পেলেন ,উপস্থিতি অনুভব করলেন ।
এই কবিতাটি
প্রসঙ্গে কবি ৮৫ সালে তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন - "কবিতা লিখলাম। একটা॥ -
প্রাচীন ভারতবর্ষ আজ সর্বপ্রথম আমার কবিতায় ঢুকে পড়লো ॥" অর্থাৎ তিনি তাঁর লেখায়
পুরাণ বা মিথকে ব্যবহার করেননি তেমন।
অন্য একটি
কবিতা 'মৃতসঞ্জীবনী'-তে শত নৈরাশ্যেও
ভালোবাসা স্বয়ং হয়ে ওঠে মৃতসঞ্জীবনী। যে কথা আমি এই লেখার শুরুর দিকে বলেছি, দুএকটি
শব্দের ব্যবহারই লেখাটিতে পুরাণের প্রাসঙ্গিকতা দেয়। মৃতসঞ্জীবনী শব্দটি যে কাহিনির
সঙ্গে জড়িত আছে বা ছিলো, তাকে ছেড়েও এখন সে বহুদূর এগিয়ে গেছে। জীবনদায়ী ওষুধ বলতে
এখন আমরা যা বুঝি তা তো মৃতসঞ্জীবনীই। এই কবিতায় ভালোবাসার মতো একটি মানবিক গুণ মহৌষধের
মতো কাজ করছে। বাস্তবে তা করেও। চিকিৎসকরাও মানুষের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করার কথা
বলেন।এতে চিকিৎসার একটি বড় দিক সম্পন্ন হয়। মানসিক ক্ষেত্রে, সামাজিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্রেও
ভালোবাসা এক মৃতসঞ্জীবনীর মতো কাজ করে।
কবি শঙ্খ ঘোষ
'আরুণি উদ্দালক' নামে একটি দীর্ঘ কবিতায় আরুণি ওরফে উদ্দালক প্রসঙ্গকে
সমকালীন দেশ ও সমাজে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন ।
'জাবাল সত্যকাম
' নামের আরও একটি কবিতা আছে কবির। জাবালা-পুত্র সত্যকামকে কেন্দ্র করে কবি সম্পূর্ণ
কবিতাটিতে সত্যকামের গুরুর আশীর্বাদকেই গুরুত্বদেন। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা
মানুষ তার পরিচয় তৈরি করে নিতে পারে, তারজন্য কোনো পূর্ব পরিচয় একান্ত প্রায়োজনীয় নয়।
আরবের হাতেম
আল তায়ী বা হাতেম তায়ী বা হাতেম তাই ছিলেন এক পরম দাতা। দানশীলতার জন্য সেই মহান মানুষটি
মিথে রূপান্তরিত হয়েছেন। 'হাতেমতাই' নামে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা আছে।
'নচিকেতা'
নামে কবির আর কবিতা উল্লেখযোগ্য। দেশের কর্মযজ্ঞে যারা তাদের সর্বস্ব আহুতি দেয় তাদের
কথাই রয়েছে এখানে।
"দিয়ে
যেতে হবে আজ এই দুই চোখ
ঘ্রাণ শ্রুতি
স্পর্শ সব দিয়ে যেতে হবে।" এমনকি নিজের সন্তানকেও দিয়ে যেতে হবে।
"আর তোকে
যমের দক্ষিণ
হাতে দিতে হবে আজ
চায় তোকে দৃষ্টিহীন
বধির সমাজ।"
মহাদেব সাহার
'বেহুলার ভেলা' কবিতায় কবি বলছেন -
" আমার
পশ্চাতে আছে কতো কুশল কুমারীব্রত, উপাখ্যান,
কতো ষষ্ঠীপূজার
মন্ত্র
লক্ষ্মীর পাঁচালী,
কতো ব্রতকথার শুদ্ধ মঙ্গলঘট,
ধানদূর্বা,
শান্তিজল, ঘৃতের প্রদীপ
আমি হারাবো
না, ডুবো না ভরা গাঙের জলে, আমি
বেহুলার আয়ুষ্মান
ভেলা"
এখানে বেহুলার
ভেলার সঙ্গে বাঙালি মেয়েদের মঙ্গল-সাধনা লব্ধ শক্তির তুলনা করেছেন কবি।
পুরাণ বা মিথের
ব্যবহার দেখা যায় বোধহয় বিষ্ণু দের কবিতায়। মুখ্যত নারী চরিত্রে। উর্বশী, ওফেলিয়া
,মহাশ্বেতা, ক্রেশিডা ,প্রসার্পিনা, কাসান্ড্রা। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই কবি নিজেই এদের
প্রণয় প্রার্থী। হয় চাইছেন, নয়তো পেয়েছেন। সাধারণ মানুষ হিসাবেই তাঁর এই চাওয়া। 'পলায়ন'
কবিতায় লিখছেন-
" উর্বশী
আর উমাকে পেয়েছি এ-প্রেমপুটে ।"
আবার 'উর্বশী'
কবিতায় বলছেন-
" আমি
নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
ক্ষণিকের মর
অলকায়
ইন্দ্রিয়ের
হর্ষে, জানো, গ'ড়ে তুলি আমার ভুবন?
এসো তুমি সে-ভুবনে,
কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।"
'ওফেলিয়া'
কবিতা শেষ করছেন এই বলে -
" অমরাবতীর
দৈব প্রাচীর চুরমার হলো মর্ত্যলোকেই।
ধূমকেতু এই
বিরাট দাহন বিশ্ব আমার তোমার চোখেই
পেয়েছিল তার
পরমাগতি।"
এছাড়াও আছে
যযাতি, বিভীষণ, বজ্রপাণি, মৈনাক, ইলোরা, কোণার্ক প্রসঙ্গ।
পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের
কবিতাতেও পুরাণের ব্যবহার পাই অনেক । 'বিকর্ণ উবাচ ' কবিতায় বিকর্ণের মুখে এক প্রশ্ন
শোনা যায়, যা আসলে ধিক্কার, কুরুরাজের অন্ধ-রাজসভার প্রতি ঘৃণা মাত্র।
" কার
কাছে সুবিচার চাইছ দ্রৌপদী?
কেউ নেই, সকলেই
সামাল সামাল;
জাহাজ ডুবছে
,দেখো ইঁদুরেরা ঝাঁপ দিচ্ছে জলে
অশক্ত বৃদ্ধ
বা নারী, শিশু আজ তাদের বাঁচায়
এরকম কেউ আছে? "
পৌরাণিক যুগের
অন্ধ-কুরুরাজের রাজসভা যেন আজকের ভারত
যুক্তরাষ্ট । একই পরিস্থিতি আজ সারাদেশে প্রত্যক্ষ করছি আমরা প্রতিমুহূর্তে। মানুষের
অবরুদ্ধ বিবেক যেন আজ বিকর্ণের হয়ে এই প্রশ্ন তুলতে চাইছে, ধিক্কার জানাচ্ছে।
বীমা
তারক সেন
"কিছু
রেখে যেতে হয়।
নদীকে আড়াল
করে
রেখে যাব আয়োজন
বালি
মাঠে মাঠে
রেখে যাব এত ভাঙা আল
শত শত উদ্দালক
- নাজেহাল
ফিরে যাবে
ঘরে।"
উদ্দেশ্যকে
আড়াল করে উপলক্ষ যখন বড় হয়ে ওঠে আমাদেরই উদ্দেশ্যমূলক আচরণে ,তার সমালোচনা করেছেন কবি।
আমাদের সেই আয়োজিত ভুলের বলি করতে চেয়েছেন উদ্দালক রূপী কোনো নিষ্ঠ-মানুষকে ।
আচার্য দ্রোণ
অথবা সুকুমার সেন
বিমান মাজি
" অভিমন্যুকে
হত্যা করেছিলেন যে সপ্তরথী তাঁদের প্রধান ছিলেন আচার্য দ্রোণ;
অথবা দু'পা
পিছিয়ে এসে এমনও বলা যায়
সত্তরের দশক
মুক্তির দশক - এই কথা বলে উঠোনের অন্ধকারে যারা নক্ষত্র হয়ে গেল,
ডক্টর সুকুমার
সেন মনে মনে তুমুল আলোড়িত হলেও
প্রকাশ্যত
তাদের পক্ষে একটি কথাও বলেননি;
একটি পঙক্তিও
রচনা করেননি তাঁর বাংলা সাহিত্যের নতুন সংস্করণে "
সরাসরি এমন
একজন প্রখ্যাত মানুষের সমালোচনা ,এমন সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে, বড় একটা দেখা যায় না।
তাঁর 'জরাসন্ধ'
নামের আরও একটি কবিতা আছে।
" জরাসন্ধ,
তুই নোস ছেলে, আমি তোর মা
সুয়োরানী তোকে
ফেলে গেছে, জরাসন্ধ দূর হয়ে যা।
...
...
সুয়োরানী ফেলে
গেছে দুয়োরানী নয় তোর মা
জরাসন্ধ দু'
টুকরো মাংসখণ্ড দূর হয়ে যা! " এখানে জরাসন্ধ সৃষ্টিকারীদের কথা বলা হয়েছে। জরাসন্ধ
এখানে পজেটিভ চরিত্র। তাঁর সুয়োরানী মা দুষ্ট চরিত্র। এই কবিতাটির উল্লেখ করার সময়
অনিবার্যভাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটির কথা মনে এসে যায়। সেখানে জরাসন্ধ নিজেই
প্রতিবাদ করছে- " আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।"
কে আবার বাজায়
বাঁশি
মৃণাল বণিক
" এখনও
সতেজ সজাগ যারা আলিঙ্গন দিতে চায়
তাদের সব খেলা
শেষ হলো।তবু, কি আশায় আছি, এই নিধুবনে।
ভাবি কে আবার
এখনো বাজায় তবে বাঁশি।"
এই কবিতা পড়তে
গিয়ে মনে পড়ে যায় -
"কে না
বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী
বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে॥"
পোশাক বিষয়ক
বর্ণমালা
অমিত কাশ্যপ
"শ্রীকৃষ্ণের
অষ্টোত্তর শতনামের পেছনে যতগুলো ড্রেস
একটা একটা
করে সরালে তাঁর মনে থাকবে না
তাঁর স্ত্রীরাও
মনে করিয়ে দিতে পারবেন না
তাঁর স্ত্রীর
সংখ্যাও তো তিনি মনে রাখতে পারেন না"
অস্থায়ী ছদ্মবেশের
আড়ালে ইষ্টজনদের ভঙ্গুর অস্তিত্বের কথা। কবির আর একটি কবিতা
'জোনাকি কেবিন
আর ছাতিম গাছ' -এ প্রযুক্তির অধীনস্থ সময়ে প্রেমিক প্রেমিকার তথা প্রেমের বিপন্ন অবস্থার
কথা বলা হয়েছে।
" ওদের
আড্ডায় এখন মুড়ি-চানাচুরের ওপর শীত
ছাদের আড্ডায়
শীত
জোনাকি কেবিন
আজ ফাঁকা, পাশে নেড়ি শুয়ে
রাই'র আজ মন
ভালো নেই
বাইকের ওপর
কৃষ্ণ সিটি দিতে দিতে অনেকবার ডেকেছে
এখন বাল্যবন্ধু
মোবাইলে ডেকে নেয়
ফাঁকা ছাতিমগাছের
নিচে বাৎসায়ণ সংগীত "
জয়দেব বসুর
একটি নামহীন কবিতা
" ধর্মবক:
ইশারাগ্রাহক, বলো, সন্ধ্যা কী?
উত্তর : দিন
ও রাতের রসায়ন।
ধর্মবক : কাকে
বলে প্রেম?
উত্তর : দূর
থেকে যাকে
ভালোবাসা বলে ভুল হয়।
ধর্মবক : অনিচ্ছা
সত্ত্বেও কারা পাপ করে?
উত্তর : বিপন্নরা
"
এরকম আরও কিছু
প্রশ্ন এবং উত্তর। পাঠক ধর্মবক রূপী যক্ষের যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন ও যুধিষ্ঠিরের উত্তরের
কথা স্মরণ করুন।
এখনো প্রতিদিন
যত কবিতা লেখা হয়, তাতেও, কোথাও কখনো পুরাণের প্রসঙ্গ দেখা যায়। তবে বিস্তৃত অর্থে
মিথ অনেক বেশি সক্রিয়। মিথ যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চরিত্র ও ঘটানাকে কেন্দ্র
করে নতুনভাবে জন্ম নেয় ,তার ব্যবহার-ক্লিষ্ট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম। কিন্তু পুরাণের
গল্প ও চরিত্রগুলো যেহেতু নির্দিষ্ট, তার ব্যবহার-ক্লিষ্ট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।খুব
দক্ষ হাতে তার ব্যবহার না হলে সেই সম্ভাবনা অনেক বেশি। পুরাণ প্রসঙ্গ যে শব্দ বা শব্দযুগলের
মধ্যে ধরা আছে তার ব্যবহার জেনে বা না জেনে আরও বহুকাল চলবে। কিন্তু কবিতায় পুরাণের
কাহিনি নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমে যাবে, কমে গেছে এবং কমে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কবিতাকে স্বাবলম্বী
হয়ে উঠতে, কবিতার রসায়নকে পাঠকের মেধা নির্ভর হতে পুরাণ-ব্যবহার সাহায্য করে না,পুরাণের
নির্দিষ্ট কাহিনিটি লেখক ও পাঠককে নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিক ও সাম্প্রতিক লেখা যেহেতু
অনেক বেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সর্বোপরি যুক্তি নির্ভর, তাই পুরাণ ব্যবহার
ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়াই যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার বিশ্বাস বা অভিমত।
1 মন্তব্যসমূহ
সমৃদ্ধ লেখা।
উত্তরমুছুন