মফস্সলের
শীতের বিকেল ঘেঁষে একটা ছাইরঙা ভুষো মাফলার গলায় পেঁচিয়ে যে সন্ধে নেমে আসে
প্রতিদিন, ঠিক সেই সময়টায় আমার বুবুপিসির
কথা খুব মনে পড়ে। লুকোচুরি খেলতে খেলতে প্রায়ই ঢুকে পড়া ওদের নিষেধের চৌহদ্দিতে।
অগোছালো ইতিউতি ঘাস। এককোণে অবহেলার বুনোকুল গাছ। ঝেঁপে কুল ধরেছে। লোভ খুব।
কিন্তু খেলেই যে গলা ব্যথা করে, জ্বর আসে... সরস্বতী পুজো
হয়নি এখনও।
আরেকটু কান
পাতলেই হাঁসমুরগির ডানা ঝটপট। জালঘেরা খুপরিগুলো পরপর সাজানো একতলা জুড়ে। খসে
যাওয়া পালক, গুয়েমুতে
বোঁটকা গন্ধ ঘিরে থাকে চারপাশ। পোলট্রিবাড়ির মেয়ে বুবুপিসি। বাড়ি বলতে মধ্য
চল্লিশের এক রুক্ষ নারী আর একপাল মুরগি।
আমাদের সবার
বাড়িতে একটা বারান্দা থাকে, খোলামেলা।
আলোহাওয়া খেলে, এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি দিব্যি হাঁক পেড়ে
গপ্পগাছা। বারান্দা জুড়ে কতরকম আচার। ঝুড়ি চাপা রোদ্দুরে জারিয়ে নিচ্ছে টাকরায়
টকাটক শব্দ তোলা স্বাদ...কিন্তু...
বুবুপিসির
বাড়িতে একফালি বারান্দাও ছিল না। একটা দেশলাইয়ের খোলের মধ্যে যেন পুরে রেখে দিয়েছে
কেউ বহু বছর ধরে তাকে। ওপরতলার জানালা ফাঁক করে মাঝেমাঝে ইশারায় ডাক দিত..."
এই তুই গণেশদার ভাইঝি না? কোন
ক্লাসে পড়িস? কুল খাবি? গাছে হাত দিস
না, ওগুলো কাঁচা। ওপরে আয়, ভাল ভাল
বেছে দেব..."
শুকনো খসখসে
গলা। গোছা গোছা কাঁচাপাকা চুল উড়ছে মুখের চারপাশে। হাসলে কালচে মাড়ি দেখা যায়। আচমকা
ভয় আসে খুব। বুবুপিসির বাড়িটাকে মনে হয় একটা আস্ত মিনার, যার
কোনও বারান্দা নেই। সেই মিনারের একদম ওপরের ছোট্ট ঘরের জানালা থেকে বুবুপিসি নয়,
এক মায়াবী রাক্ষুসি বুঝি তার হাতখানা ইয়া লম্বা করে ঝুলিয়ে দেবে
নিচে, আর আমিও হয়তো আটকা পড়ে যাব চিরকালের মতো ওই
ফাঁসে...বুবুপিসির মতোই...
প্রাণপণে ছুট
দিই। পেছন থেকে বুবুপিসির গলা..."এই,
এই, পালাচ্ছিস কেন, ধরে
ফেলবে কিন্তু ওরা...হাহাহা ধাপ্পা ধাপ্পা..."
সন্ধেয় ফিরে
আসি। আমার সন্ধে এখন যদিও অনেকটা অন্যরকম। অন্য দেশ। অন্য টাইমফ্রেম। রঙ,গন্ধ, মনকেমন...সবটাই ভীষণ
আলাদা। বাড়ি ফিরেছি প্রায় বছর তিনেক পর। আমার বয়স এখন ওই ছোটবেলার বুবুপিসির আশেপাশেই।
বুবুপিসির বয়স যদিও গত তিন বছরে বাড়েনি আর। ওদের বাড়িটা ভাঙা পড়েছে বছর দুয়েক হল।
অগোছালো ঘাস, বুনোকুলের ঝাঁকালো গাছ...নেই। বদলে
মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং উঠেছে সুন্দর রংচংঙে। পোলট্রিবাড়ির শৌখিন নাম এখন 'আকাশলীনা'। মুরগীর জালকাটা
খুপরিগুলোও এক সাঙ্ঘাতিক মন্ত্রবলে উধাও...একটি পালক অব্দি পড়ে নেই কোথাও, শুধু সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নামিদামি গোটাকয়েক
গাড়ি।
নতুন কোনও
গল্প লেখার ছুতোয় মুছে দিয়েছে কেউ আস্ত একটা গল্প। বুবুপিসির গল্প, যাকে আমি একদিন খুব ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছিলাম ভুল
করে।
"বুবুপিসিদের
বাড়িটা কারা বেচল, মা? কেউ তো ছিল না...মুরগীগুলো
ছাড়া কাউকে তো দেখিনি কখনও!"
"পোলট্রিটা
তো বুবু বেঁচে থাকতে থাকতেই শেষ হয়ে গেছিল...একা থাকত, কী
করে বা চলত কে জানে...মরেপচে পড়েছিল ঘরের মধ্যেই। দিন তিনেক পর গন্ধ ছাড়ে খুব।
পাশের বাড়ির ভোলাদা পাড়ার ক্লাবে খবর দেয়। ছেলেপুলের দল তখন দরজা ভেঙে দেখে...নেই
আর। তিনদিনের বাসি মড়া, তাড়াতাড়ি সৎকার করে হাঁফ ছাড়ে সবাই।
পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, তবে তেমন ঝামেলা কিছু
হয়নি।"
হাসলাম শুনে।
হাঁসমুরগি আর মানুষের বাঁচামরায় তেমন কোনও ফারাক হয় না আজকের দিনে দাঁড়িয়েও।
কিন্তু বাড়িটা...?
"মানুষকে
বাতিল করা সহজ, কিন্তু জমিবাড়ি তো আর ফ্যালনা নয়। গন্ধে
গন্ধে ঠিক সব চলে এসেছিল দখল নিতে সময়মতো...এত টাকার মামলা, কেউ
ছেড়ে দেয় নাকি! ক্লাবকেও কিছু দিয়েটিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে নিয়েছে সব..."
"কারা?"
"বুবুর
মা-কে তো শুনেছিলাম জোর করে গছিয়ে দিয়েছিল বুবুর বাবার ঘাড়ে। বিয়ের আগেই নাকি বুবু
পেটে... প্রথম বউ একবার এসে তুমুল শাপশাপান্তও করে গেছিল বুবুদের। সেসব অবশ্য
বহুকাল আগের কথা, আমি দেখিনি কখনও বুবুর বাবা-কে। ওই তরফের
লোকজনই পেয়েছে সব..."
সন্ধের চায়ের
কাপ জুড়িয়ে জল। বিস্বাদ। সমস্ত জিভ জুড়ে কেউ যেন তেতো নিম ডলে দিয়ে চলে গেছে
বেমক্কা অন্ধকারে।
ছাদে উঠে
তাকাই দূরে। বুবুপিসির বাড়ি মুছে দিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে সটান তার ঘরে ঘরে আলো, কলকল করছে কথার পিঠে কথা। আমি কিছুটা দেখছি,
আর বাকিটা ক্রমশ ঝাপসা। ভাবলাম চোখ কচলে নিই একবার, তাহলেই হয়তো আরও একবার, হয়তো শেষবার দেখে ফেলব এক
বন্দিনী রাজকন্যাকে, যাকে উদ্ধার করতে কখনও কোনও রাজপুত্র
মিনারের তলায় আসেনি। সব রাজকন্যা রূপবতী হয় না, তাদের সেই
মস্ত বেণীও থাকে না — যে জাদুসিঁড়ি বেয়ে কেউ ছুঁয়ে দেবে তাকে
ভালবেসে একটিবার, আর সে তার কালচে মাড়ি বের করে একগাল হেসে
বলবে, "কুল খাবি, কুল? আমার কাছে আয়, ভাল দেখে বেছে দেব..."
লুকোচুরি
খেলার দিন শেষ অনেক আগেই। এখন শুধুই 'ধাপ্পা'-র অপেক্ষা। বুবুপিসি জানতো খেলাটা। আমাদেরই
শিখতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল...
0 মন্তব্যসমূহ