সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সুবল দত্ত

  
 নির্বাণ পথ    (ধারাবাহিক গদ্য  /পর্ব -২)       




     ॥প্রথম অধ্যায়॥ 


                                                                           

                                             
Perineum/বিলয়/সাত সেকেন্ড 

মৃত্যু তার দেহ থেকে মাত্র পাঁচ সেকেন্ড দূরে। কোমরের নিচে এখনো ভার। এখনো রাত দিন আকাশ ও ভয়ের অনুভব। প্রাণশক্তি ছেড়ে যাওয়ার অনুভব গহন চেতনাতে এখনো আসেনি কিন্তু এবার স্পষ্ট টের পেল তার অন্তর্মন তাকে আর আমল দিচ্ছে না। আগে যেমন হতো,চিন্তার গভীরে...আরো গভীরে অন্তর্মনের ইচ্ছেমতো ভেসে যাওয়া বা কোনো চিন্তা আবর্তে ঢুকে যাওয়া টের পেতেই সে সহজেই টেনে এনে নিজের কর্ম মতন চিন্তা ও বিচারধারায় বসিয়ে দিতে পারতো। এখন সে কোনো কথাই শুনছে না। এখন তার অন্তর্মন অতীতের এলোমেলো আবেগ বিস্ময় ও ভালোলাগাগুলি অজানা অংকের নিয়মে ছন্দবদ্ধ করে প্রাণশক্তির পোঁটলাতে ভরতে........   (১ম পর্বের পরে এ সংখ্যায় ২য় পর্ব)

  বিচ্যুতি
                                           
Secral/উত্ক্ষেপণ/ছয় সেকেন্ড 

  যে মেরুদন্ডীয় রসক্ষরনে সে এখন মৃত্যুগামী,তার উত্সটি এইমাত্র শুকিয়ে গেল। অভ্যন্তরের দেহাংশ ও সেগুলোর স্বয়ংক্রিয়তা দেখা বা বোধ হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। প্রকৃতি তার মায়াপর্দা দিয়ে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অনুভব কেন্দ্র আজীবন ঢেকে রাখে। এই বিশেষ বিপাকীয় জ্ঞান ক্রিয়া ওই কেন্দ্রটিতে সক্রিয় হলে সে মস্তিষ্ক হৃদয় ফুসফুস যকৃত শিরাউপশিরা পাকস্থলী যৌনগ্রন্থি এইসবগুলো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নজররাখতে পারতো। বিশ্ব নিয়ামক সেই অন্তর্জ্ঞানটি কোনো প্রাণীকেই দেননি তাই সারাজীবন তার প্রয়োজনীয়তা জানতেই পারে না। এখন ক্ষণিকের জন্য সেই কেন্দ্রটি সক্রিয় হতেই শরীরবৃত্তীয় নানা বৃত্তপথগুলির পর্যবেক্ষণ বোধ সে জেনে গেল। সে দেখল, নিতম্বের কাছে মেরুদাঁড়ের প্রথম তড়িত্‍ জালিকা থেকে যে বৈদ্যুতিক রস উর্দ্ধমুখে মস্তিষ্কের জ্ঞানকেন্দ্র ছুঁয়ে আবার অন্যস্রোতে নিম্নগামী হচ্ছিল, সেই বৃত্তিয়পথটি বন্ধ হয়ে গেল। সে তো এখন মনশূন্য,ফাঁকা। মেরুদণ্ডের শেষপ্রান্তে এখনো নিবু নিবু উদ্দীপিত স্নায়ুজালিকাতে বৈদ্যুতিক রস। এইখানের উদ্দীপ্ত বিদ্যুতে সে চেতনায় যৌন পুরুষ ছিল। এইখানের বৈদ্যুতিক বিক্ষেপে তার পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হতো।বহির্মন চাইত যৌনতা এবং সেই উগ্র যৌনকামনা কখনো বিকৃতকাম এবং তারফলে হিংস্রতা ভীতি এবং পরে ধিক্কার। এখন বিলকুল ফাঁকা। মুহুর্তেই সে এইসব বোধগুলিকে শক্তি পুঁটুলিতে অন্তর্মন সহ গায়েব হতে দেখেছে। অন্তর্মন যখন এই বিদ্যুত্‍রস সিক্ত বহির্মনকে পোষ মানিয়ে ফেলতে পারত, তখন এইরস ফোয়ারার মত উর্দ্ধগামী হয়ে মস্তিষ্কে সৃষ্টিশীলতাকে ভিজিয়ে ফেলতো। কলম ধরতেই বেরত একের পর এক কাব্যভাবনা চিত্রকল্প বিচারধরা অধ্যাত্মিক বিস্ময়বোধ। রং তুলি দিয়ে রঙের বিন্যাস ও হাত দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি রক্ষার নিয়মশৃঙ্খলা। নিজের সৃজনস্পর্ধা দেখে তার অন্তর্মন আনন্দে নিজেকে বিস্তৃত করে ফেলতো। তখন অহংকার তার অতি উত্তম সহকারী। সে তখন বহির্মনের বিক্ষিপ্ততা দাবিয়ে রাখতো। তার অহমবোধ যেন অসীমে ছড়িয়ে পড়তে চাইত।

    এখন উদ্দীপন নেই প্রশমন নেই,নেই কোনো নিম্নগামী ইন্দ্রিয়সুখ,কোনো উদ্দেশ্য বা বিপথুমান হওয়া, না কোনো কর্মের আগ্রহ বা নিস্পৃহতা। যে গুচ্ছ মূল জালিকা থেকে জনন রস ও সৃষ্টিশীলতার উত্সেচক ক্ষরিত হোত সে দেখল তার উত্সটি থেকে কমলা আভায় কালোপদ্মের আকারে কৃষ্ণশক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এই পদ্মটি থেকে এখনো ছয়টি পুঞ্জ পুঞ্জ কমলা রঙের পাপড়ির মত ক্ষীণ উত্তেজক কামনা নির্গত হচ্ছে। কিন্তু নিভু নিভু। এই ছয়টি ভিন্ন মাত্রার কমলা প্রভা সে চিনতে পারলো। এই রঙ তার লিঙ্গ বোধের অহংকার।এই ছয়টি কমলাউষ্ণতা ছয় রকমের কামনা। ছয় রকমের অপ্রতিরোধ্য গাণিতিক ফর্মুলায় রয়েছে সৃষ্টিরহস্যের নির্দেশাবলী। সেই কামনা প্রদাহ ভেদ করে একদিন এই অজানা কৃষ্ণ পদ্মের কেন্দ্রে অজ্ঞাতেই ঢুকে পড়ে পেয়ে গেছিল সৃষ্টিশীলতা। তার শরীর মন প্রাণ সৃজনশীলতার স্রোতে উর্দ্ধগামী মস্তিষ্কের বুদ্ধিদীপ্ত কেন্দ্র ভেদ করে ফোয়ারার মত মানবসমাজে ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছিল। 

   সে দেখল শক্তি পদ্মের শিকড়টি কোমরের এক ত্রিকোণ অস্থি বর্মের গর্তে থাকা মেরুদাড়ের বাঁকানো শেষপুচ্ছের জালজটে শেষ হয়েছে। আগে সেখান থেকে সংবেদন প্রবাহবাহী স্নায়ুসুতোগুলি মস্তিষ্কের ঘোলাটে ধুসর তরলে নিরন্তর প্রবাহিত হতো একিই সাথে সৃষ্টিশীলতা আত্মজ্ঞান ঈশ্বরবোধ এবং লিঙ্গোথ্থানশক্তি। সে দেখল পদ্মের কেন্দ্রে একটি পারদর্শী লিঙ্গের আকারে সে নিজেই আধারভূত দেহপ্রকৃতিতে প্রোথিত হয়ে রয়েছে এবং তাঁকে পেঁচিয়ে রয়েছে দুটি সাপের মতো উজ্জ্বল তড়িত্‍ প্রবাহ। এই বিদ্যুতের শিখা দুটি তেমনিই তেজি এবং একে অপরের সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে উন্মুখ। তার বোধে দৃশ্যমান হলো কৃষ্ণ পদ্মের গভীর কেন্দ্রে এই দুইসাপ অটুট বজ্রবাঁধনে বাঁধা। অন্তর্মন যখন প্রাণশক্তিতে তার অতীত তথ্য ভরে  দিচ্ছিল তখন একটা ক্রিয়া দৃশ্য সে দেখেছিল। এই দুইশক্তি সাপের বজ্রবাঁধন খুলতে বহুবার সে সমাধির অভ্যাস করতো যাতে তার ব্রহ্মজ্ঞান হয়।  তার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েও ছিল কিন্তু তার সেটা বোধে আসেনি। এখন তার বোধগম্য হল। যদি এই শক্তিজট না খুলতো তাহলে কি সৃষ্টিশীলতার আনন্দে মজে থাকা তার মতন সংসারী মানুষের চাইলেই শব্দ ভাষা মর্মভেদীবোধ ভবিষ্যতে অমর হয়ে থাকার কোনো বিশেষ বার্তা আপনা আপনি কলম থেকে উত্সরিত হতো ? সে চাইত আর তার প্রগতিশীল মানবকল্যাণকর কর্ম অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। স্বয়ং প্রকৃতি পরিবেশ ও সময় তার উপযোগী আধার তৈরি করে দিত। এখন সেই দিব্য শক্তিজটের সাক্ষাতে সে অভিভূত হয়ে গেল। সেইজন্যেই তো জীবনযাপনে তার শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যেকোন স্তরে যেকোনো অনুভবে ও যেকোনো পরিস্থিতিতে তার পবিত্র যৌনতা ও ঈশ্বর চিন্তা তাকে আবেগে আপ্লুত করে রাখতো। আকর্ষণ, আবেগ, জাগরণ, সতর্কতা, আবেগ, আগ্রহ, অনুপ্রেরণা, উত্তেজনা, সৃজনশীলতা, উত্সাহের ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপে কম বেশি এই যৌনশক্তিই তো তাকে বারবার মনেকরিয়ে দিত যে সে এই পৃথিবীতে বেঁচে রয়েছে।

 এই আধার শক্তি স্ফুরনেই যে জীবনে প্রেমাবেগ অনুভবে এসেছে এখন সে তা প্রত্যক্ষ করল। যে যৌনশক্তিতে সারা যৌবন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সেটি একটি গভীরতম ও অন্তর্নিহিত অন্তরঙ্গ প্রেমের আধার এখন তার পরিষ্কার বোধগম্য হলোদুই সমর্পিত শরীরের যৌনমিলনে হয় অবিচ্ছেদ্য প্রেম। এই যৌনশক্তির প্রবাহকে ঠিকমত চালনা করতে পেরেই সে জীবনযাপনে লজ্জ্বা ভয় বিকৃতকাম অপরাধবোধ হিংসাকে সহজেই দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে এই গর্ব এখন অনুভূত হোল।ভালোখারাপ ভুলঠিক সত্যমিথ্যা মৃত্যু মৃত্যুহীনতা ঠান্ডাগরম আলোঅন্ধকার এইসব দ্বন্দ্ব সংকট থেকে এই যৌনশক্তিই তাকে মুক্ত রেখে আত্মবোধের পথে এগিয়ে নিয়ে যেত। এক সুবিন্যস্ত গাণিতিক নিয়মে স্তরে স্তরে যৌনতার গভীর খনির ভিতর থেকে আত্মবোধ ও ষষ্ঠইন্দ্রিয় তার জীবনপথকে পবিত্র করে রাখতো বলেই এই মৃত্যুমূহুর্তে তার প্রজ্ঞাদর্শন হচ্ছে। এই তড়িত্‍ বোধে সে কেঁপে উঠলো। 

         জন্মলগ্নে মাতৃগর্ভ থেকে মাতৃযোনির ভিতর দিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার পরই তার প্রথম পার্থিব ডাকের কম্পনে এই কৃষ্ণপদ্ম বিদ্যুতাধার থেকে কমলা রঙের বিদ্যুত্‍ প্রভা সক্রিয় হতেই সে প্রথমেই মুখে নিতে চেয়েছিল মাতৃস্তন। সেই থেকেই সারাযৌবন ধরে তার প্রাণ ও অপান শ্বাসবায়ুর মতই স্বাভাবিক যৌনচেতনার প্রবাহ। তাই শরীরের সংরচনা এমনই যে শ্বাস প্রশ্বাসের মতই ক্ষণে ক্ষণে যৌনশক্তি রূপান্তরিত হচ্ছিল কর্মক্ষমতায়। এই নিভন্ত বিদ্যুত্‍ প্রবাহটি ছিল বাঁচার ইচ্ছে, পৃথিবীকে জানার ইচ্ছে, পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে ও প্রেম প্রকৃতিপ্রেম বিশ্বপ্রেম অনুভব। 

      এখন কশেরুকার শেষপ্রান্তে দেখল কৃষ্ণপদ্ম থেকে কৃষ্ণউষ্ণতা নিভন্তের মুখে। তার বোধ হোলো, এই মহাবিশ্বে একটিই শক্তি অগণিত শাখা উপশাখা মেলে আছে। তার সৃষ্টি নেই বিনাশ নেই। শুধু তার অসংখ্য ডালপালার অসংখ্যবার একটি অপরটিতে রূপান্তরণ হতে থাকছে। তার অস্তিত্বের এই কৃষ্ণপদ্মটি নিখিল ব্রহ্মান্ডের মহাকৃষ্ণবিবরেরই একটি অনু অংশ। তার অস্তিত্বে এখনো যেটি রয়েছে সেটি ক্ষুদ্র প্রাণশক্তি তারই একটি কণা রূপান্তর। এই অথৈ মহাকৃষ্ণবিবর শক্তিসমুদ্রে মহাবিশ্বের সমস্ত আলো অস্তিত্ব যে কয়েকটি ছোট প্রদীপের মতো ভাসছে এটা সে জ্ঞানচোখ দিয়ে দেখল। সে বুঝল তার শরীরের অজ্ঞাত এই কৃষ্ণপদ্মটি উর্দ্ধমুখে তড়িত ক্ষরিত হয়ে ব্রহ্মান্ডের কৃষ্ণমহাশক্তি সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। এবং তার সাথে সাথে সেও সেই স্রোতে বহমান। 

     এই অপ্রতিরোধ্য অবর্ণনীয় ফোয়ারার মতো নানা শক্তিস্রোত তাকে তুলে নিয়ে চলল। ক্রমে ক্রমে কমলা কামনা থেকে হলুদের অনুভব। যত নিম্নজট থেকে উপরে উঠছিল তত তাকে স্বর্গীয় প্রশান্তি ও আনন্দের অনুভব ধুইয়ে দিচ্ছিল। যেন এ এক আনন্দময় নিস্ক্রমন। প্রকৃতির চাপচাপ মায়াবন্ধন খুলে খুলে যাচ্ছে আশ্চর্য রকমের দ্রুত একের পর এক গাণিতিক সমাধানে একটির পর একটি  স্তর অতিক্রম করার অনুভব। অর্বুদ অর্বুদ মায়াবন্ধন থেকে মুক্ত অনুভব হতেই দেখে হলুদ মায়াময় একটি রাসায়নিক বিদ্যুত্‍জঠরে সে আটকা পড়ে আছে। এই ক্ষণটি তার অনেক অসহনীয় দীর্ঘ লাগলো।তার বোধ হল এই বদ্ধ জঠরে এত প্রচণ্ড কালো লীন তাপ যেন পৃথিবীও সহ্য করতে পারবেনা। জঠরের এই পরম তাপে তো মহাবিশ্বে অগণিত নক্ষত্রের জন্ম হতে পারতো। কিন্তু তার জীবনকালে তো  কখনো এই তাপের সামান্যতম অনুভবও আঁচে আসেনি? প্রকৃতির এই আশ্চর্য নিয়মে সে ক্ষণিক অভিভূত হয়ে গেল।
(ক্রমশঃ)




সুবল দত্ত