শারদ-মধ্যাহ্নের একটি মেদুর মুহূর্ত
চিরপ্রশান্ত বাগচী
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা গদ্য ও কবিতায় যিনি
সব্যসাচী এবং প্রায় শতার্ধশত গ্রন্থের রচয়িতা,
তিনি বুদ্ধদেব বসু। তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী প্রতিভা বসুও নিজগুণে
উজ্জ্বল। কথাসাহিত্য ও অন্যান্য রচনা মিলে তাঁরও একাধিক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের
অনন্য সম্পদ। সোনালি বিকেল, সমুদ্র হৃদয়, সমুদ্র পেরিয়ে, সকালের সুর সায়াহ্নে, স্মৃতি সততই সুখের, যখন বেলা বারোটা, যখন বসন্ত, জন্মান্তর, অপেক্ষাগৃহ,
ঈশ্বরের প্রবেশ, কিশোর সঞ্চয়ন, গল্প সংগ্রহ ১।২, পদ্মাসনা ভারতী, আন্তোনিনা, অতলান্ত প্রভৃতি রচনা তাঁর অন্যতম
উদাহরণ। সমালোচকের চোখে ধরা পড়েছে, তাঁর লেখায় মৃদু স্নিগ্ধ
নারীসুলভ স্পর্শ। এইজন্য পাঠক তাঁকে এক মুহূর্তেই আপনজন বলে মনে করেন। তাঁর জন্ম
১৩ মার্চ ১৯১৫ ( বাংলা ২৯ ফাল্গুন ১৩২২)। অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার অন্তর্গত
হাঁসাড্ডা গ্রাম। বাবা ও মা যথাক্রমে আশুতোষ সোম ও সরযূবালা সোম। এক ভাই, এক বোন। তিনি ছোটো। অর্ধশতক ধরে আছেন কলকাতায়। তাঁর দাদাও সেখানেই।
বুদ্ধদেব বসুর জীবৎকালে তাঁর জন্মদিন পালিত হত। এবং সেটা ভোলবারও নয়, কারণ দিনটি ছিল দোলপূর্ণিমা আবার বৃহস্পতিবার। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপের
সূত্রপাত, তাঁর 'দুই মেরু' গল্প নিয়ে।
বস্তুত,
পড়াশুনা শেষ করে যখন চারিদিক অন্ধকার দেখছি তখন কলকাতায় কলেজ
সার্ভিস কমিশন অফিস থেকে ফিরে ভাবছি, যদি স্কুল সার্ভিস
কমিশন (সেটাই হল, তখন আমার কর্মজীবন প্রায় তের-চৌদ্দ পার হয়ে
গেছে। আমার আজও মনে পড়ে, জুতা আবিষ্কারের সেই ঘটনা। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়;
মন্ত্রীমশায় কেমন করে জানলেন এই মুচির মনের কথা?) থাকত, তাহলে ঘুষ আর রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতাম!
হাওড়ায় বাসাবাড়িতে ফিরে এবিপির সঙ্গে বিনামূল্যে বিতরিত একটি ক্রোড়পত্রে (নববর্ষ
আর দুর্গাপুজোয় তখন দু’টি বেরোত) অনেক লেখার ভিড়ে চোখ পড়ল
প্রতিভা বসুর উপর। সম্ভবত তাঁর সম্পর্কে কেউ সচিত্র প্রতিবেদনটি লিখেছেন। জানতে
পারলাম, প্রতিভা বসু জীবনে কোনও একটা সময় কিছু অভাবের মধ্যে
ছিলেন এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের পোশাকও তিনি সেলাইফোঁড়াই করেছেন। সত্যি বলতে, তখন পত্র-পত্রিকায় মহাশ্বেতা দেবীকে দেখে আমার বারবারই মনে হত, অ্যাংরি-টাইপ। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে আমার ঠিক সাহস হল না। তার আগে
মৈত্রেয়ী দেবীকেও দেখেছি। কিন্তু তখন তিনি শারীরিক দিক দিয়ে সম্ভবত সক্ষম নন।
আশাপূর্ণাকে দেখিনি, কিন্তু তাঁর কথা ভেবেছি। কিন্তু কীভাবে
কী করব ভেবে ঠিক করতে পারিনি। কী মনে হল, একমাত্র প্রতিভা
বসুই হয়তো আমার আহ্বানে সাড়া দেবেন। চাকরি নেই। কী করি! সত্যজিৎ রায়কে আমার
শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করে চিঠি লিখেছিলাম, যদি আপনার কোনও
ছবির কাজে (বিশেষত পেপার-ওয়ার্কস) আমাকে ব্যবহার করেন! উত্তর দেননি। বিদ্যাসাগরের
মতো মনে হল, এক্ষেত্রে স্ত্রী বা মাতৃজাতিই প্রধান। তাই
শেষপর্যন্ত ঠিকানা জোগাড় করে প্রতিভা বসুকেই একটা চিঠি লিখে ফেললাম। অন্তর্দেশীয়
পত্রে উত্তর এল; আমি নাকি খুব ভাল বাংলা লিখি! যেকোনও
স্কুল-কলেজ আমাকে আদর করে নিতে পারে! তাছাড়া, আমি যা লিখি,
তার চেয়ে হাল্কা রচনাও অনেক কাগজে বেরোয়; কারোর
আনুকূল্য লাভ করলেই, সেটা সম্ভব। ভাবলাম, নিয়োগ সম্পর্কে সম্ভবত বর্তমান ধারণা তাঁর নেই। এখানে ধারণা বলতে আমি ঘুষ
আর রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলছি। আরও অনেক কথা লিখেছেন তিনি। অবশেষে, আমার দেখা করার ইচ্ছা জেনে তিনি আমাকে দেখা করতে বললেন, শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে বুদ্ধদেব বসুর কাব্য-নামাঙ্কিত ‘স্বাগত বিদায়’ বাড়িতে। শরতের এক ঠা ঠা রৌদ্রে,
দুপুরে পৌঁছে গেলাম যথাস্থানে। লোহার গেটের বাম-স্তম্ভে বাড়ির নাম
আর দক্ষিণে কবি ও কবিপত্নীর নাম। নুড়িপাথর বিছানো প্রশস্ত উঠোন। নানারকম গুল্মগাছ।
কাঁচির শাসনে সব সভ্য-স্থির। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আগে আমি যে ঘরটায় গিয়ে বসলাম,
সে-ঘরে শোভা পাচ্ছে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের একটি পটচিত্র। ঘরের আসবাব,
গালিচা বা বস্ত্রজাতীয় সামগ্রী সব লাল-কালো-হলুদ-কমলার কম্বিনেশন।
ঘরদুয়ার সব ঝকঝকে তকতকে নয়। স্বাভাবিক, কারণ সেখানে তাঁরা
ধারাবাহিক থাকেন না। শান্তিনিকেতনে সাধারণত পৌষ-মেলা বা বসন্তোৎসবে তাঁদের আগমন
হয়। কিন্তু তিনি কেন শরৎকালে এসেছিলেন জানি না।
যথাসময়ে তাঁর মধ্যাহ্নভোজন বা বিশ্রামের পর আমি
পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। টেপ-রেকর্ডার নেই। ডায়েরিতে লিখে নিয়ে গেছি প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি
প্রশ্ন। জন্মদিন প্রসঙ্গের পরেই জানতে চাইলাম,
তাঁর সংগীতচর্চা সম্বন্ধে। “গান করতাম মূলত
ক্লাসিক। গান অনেকের কাছেই শিখেছি। শিক্ষক ছিলেন গোল মহম্মদ খান আর ছিলেন
লালবাজারের ওস্তাদ ভোলানাথ মহারাজ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখেছি, তাঁরই গান; দার্জিলিঙে। সেটা সম্ভবত ১৯৩৩ সাল। আমার
বিয়ের এক বছর আগে। দিলীপ রায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ আমার নাম শুনেছিলেন এবং সেজন্যই
আমাকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রথম গান দশ-এগারো বছর বয়সে। রেডিওতে গেয়েছি বিয়ের
আগে। রেকর্ডিঙও ওই সময়েই। এইচএমভিতে রেকর্ডিঙ হয়েছে বাংলা গান। এখন সে-সব রেকর্ড
আর নেই। গৌর (কিশোর)-এর কাছে নাকি গোটাকয়েক আছে। আর কার কাছে আছে, মনে নেই।”
লেখালিখির আদিপর্ব সম্পর্কে আলোকপাত করতে বললাম
তাঁকে। বললেন, “বয়ঃসন্ধিকালের
ধর্ম অনুযায়ী আমি সাহিত্যচর্চা করছি ছেলেবেলা থেকেই । অন্যেরা যেমন লেখে। গোপনে
লিখতাম, গোপনে পাঠাতাম। লেখা বেরোয় ‘ভারতবর্ষ’,
‘উত্তরা’ প্রভৃতি পত্রিকায়। তবে এগুলি ছোটখাটো
লেখা। এছাড়া বেরিয়েছিল বুদ্ধদেবের কাগজে। সে-সময় আমার দু’চারটে
লেখা হুমায়ুন কবীরের ভাল লেগেছিল। বলেছিলেন, ‘আপনি বেশ
লেখেন! তা আমাদের কাগজে একটি লেখা দিন না!’ দিয়েছিলামও ‘চতুরঙ্গ’তে। পড়ে বললেন, ‘বাঃ
চমৎকার হয়েছে!’
প্রথম প্রকাশিত রচনা? “প্রথম প্রকাশিত রচনা বারীণ ঘোষ ও সুভাষ (চন্দ্র
বসু) বাবু সম্পাদিত ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়।
গল্পটি পাঠিয়েছিলাম গোপনে। চোদ্দ-পনের বছর বয়সের লেখা। প্রতি সপ্তাহেই কাগজ দেখতাম,
কিন্তু আমার লেখাটি আর পাই না। অনেক পরে যখন পেলাম, তখন আমার বেশ বড় অহংকার। এই আনন্দ সংবাদটি শেষ অব্দি মাকে বলেছিলাম। এ
ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন দিলীপ রায়। ‘নবশক্তি’র প্রথম নাম ছিল ‘আত্মশক্তি’। সে-সময় উল্লেখযোগ্য কাগজ বলতে ছিল ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’,
‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘প্রাচী’ প্রভৃতি।”
প্রথম উপন্যাস সম্পর্কে বললেন, “রচনার মধ্যে উপন্যাসই বেশি। তবে প্রথম উপন্যাসের
ক্ষেত্রে একটি ইতিহাস আছে। ‘বসুমতী’ থেকে
একবার প্রস্তাব এসেছিল, আমরা দু’জনে
মিলে যদি একটি উপন্যাস লিখি, তাহলে কিছু পাওয়া যাবে এবং
কাটবেও ভাল। আমি তখন ঢাকায়। শরীরও অসুস্থ, কাজও কিছু নেই তাই
ওর (বু.ব) চিঠির নির্দেশমতো লিখতে লাগলাম। যখন লিখে কলকাতা ফিরে এলাম তখন উনি
বললেন, ‘তুমি তো শেষ করেই এনেছ! আমি আর কী লিখব? উপন্যাসটির নাম ‘মনোলীনা’। তার আগে আর উপন্যাস লিখিনি। পরে প্রথম ছাপা
উপন্যাস বেরোয় ‘কবিতা
ভবন’ (এই নামে পাবলিকেশনও ছিল) থেকে ‘সেতুবন্ধ’। ওই প্রকাশনীর ‘সুমিত্রা’, ‘পবিত্র’ প্রভৃতি বিখ্যাত গল্প। এগুলি পরে গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়। পরে নতুন
প্রকাশনী ‘নাভানা’ আমার প্রথম উপন্যাস
বের করে ‘সমুদ্র হৃদয়’। এছাড়াও ওরা সাত-আটখানা বই পরে বের করে।”
পত্র-পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে আপনার কোনও
ভূমিকা? —“হ্যাঁ, ‘বৈশাখী’র একবার সম্পাদিকা ছিলাম। সেটাই উনিশ শ’
তিপ্পান্ন-টিপ্পান্ন হবে। আর আমেরিকায় ও (বু. ব) থাকাকালীন ‘কবিতা’ও আমি চালিয়েছি হাতে-কলমে।”
বর্তমানে লেখকের সংখ্যার তুলনায় পাঠক কি তেমন
আছেন? —“অবশ্যই। না হলে এত লেখা হবে
কেন।”
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে এক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি
বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের দেশে
লিখে নাম করা অত সহজ নয়। পাঠক অত সহজ কাউকে মানতে চান না। এ সম্পর্কে আপনার ধারণা
কীরকম ? —প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, “রবীন্দ্রনাথের অত কঠিন লেখা বর্তমানে কে আর পড়ে?
শরতেরও লেখা বড়রা পড়ে কই? আমরা শরৎচন্দ্র
পড়েছি চোদ্দ-পনের বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পড়লে ওই
সঞ্জীবই কি নাম করত? আনন্দবাজারই তো ওকে তুলল।”
লেখালিখির বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে
জানতে চাইলাম, এবিষয়ে
তাঁর মত কী? বললেন, “বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আজ আর খাটে না। যশ-খ্যাতি টাকাপয়সাই
তো আজ মুখ্য। লেখা তো অনেকের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখকরা আগে প্রায় দরিদ্র ছিলেন,
এখন তো লিখে বেশ...। বর্তমানে একজন চিত্রকরেরই দাম সাংঘাতিক ! একটি
স্কেচ করতে গেলেই হয়তো চাচ্ছে হাজার টাকা।”
—পাঠক সমালোচক কর্তৃক সাহিত্যিকের গায়ে কোনও ‘ইজম্’ (ism)-এর লেবেল এঁটে দেওয়া কি ঠিক? উত্তরে জানালেন, “এর উত্তর এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়।”
—বর্তমান সমাজ পরিস্থিতিতে লেখকের কোনও দায়িত্ব...?
“লেখক -সাহিত্যিকমাত্রেই অনুভূতিশীল । কারও কম,
কারও বেশি। শৈলজানন্দের মনে সমাজের ছাপ পড়েছিল বলেই তো লিখেছিলেন ‘কয়লাকুঠি’। পড়ে বেদনা অনুভব করেছি। আবার সমাজ কী অন্ধকার, জাতিভেদ কী প্রচণ্ড, এগুলি
জেনেছি শরৎচন্দ্রের লেখায়। মানিকবাবু এই করতে এসে নষ্ট হয়ে গেলেন। উনি কি একখানাও
ভাল লিখেছিলেন? ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বা
‘পদ্মানদীর মাঝি’ লিখে তাঁকে
কম্যুনিস্ট হতে হয়নি। এব্যাপারে ভগবানপ্রদত্ত শক্তি হচ্ছে সাহিত্যিকের মূল
ব্যাপার।”
প্রশ্ন করলাম, আপনার দৃষ্টিতে বুদ্ধদেব বসুকে কীরকম মনে হত?
বললেন, “কী আর মনে হবে? এমনি
যা হয়! সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বানান নিয়ে তো বেশ খুঁটিনাটি— পিপীলিকার মতো পরিশ্রম। এই প্রসঙ্গে আমার দু’টি কথা
মনে পড়ে। ‘অংশীদার’ বানান নিয়ে একবার
একটি সাহিত্যপ্রেমী ছেলে চিঠি লিখেছিল আমাকে; বুদ্ধদেব-অনুসৃত
‘অংশিদার’ বানান পরীক্ষায় লিখলে শিক্ষক
তা কেটে দেন এবং তা মানতে পারেননি। আমিও দীর্ঘ-ই (ঈ) দিয়ে লিখি। উনি কোথায়
হ্রস্ব-ই লিখেছেন কী জানি! অজস্র লেখা! খুঁজে দেখলাম হ্রস্ব-ই দিয়ে ‘অংশিদার’। কী একটি অভিধানেও তার
সমর্থন পেলাম। এবং ছেলেটিকে তার সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিলাম। দ্বিতীয়টি হল:
রবীন্দ্রনাথের কথায় আমি একবার বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি ছোট ইসকুল করি। তখন ‘সন্ধ্যা’, ‘সূর্য্য’ এইসব বানান নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। একজনের খাতায় ‘সন্ধেবেলা’ লেখায় শিক্ষার্থীর অভিভাবক য-ফলার কথা
তুলেছিলেন। সংস্কৃত, বাংলা, সাধু-চলিত
এসব নিয়ে আমি তার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেছিলাম। এরকম আরও নানা সমস্যা।”
প্রশ্ন করি,
তিনি (বু. ব) কি একা থাকতেন? “না, সবসময় কাজ নিয়ে থাকতেন।”
আরও প্রশ্ন ছিল; কিন্তু সময় ছিল না। হাতের কাছে পুজোর ঘন্টা
বাজালেন তিনি। ভাবলাম, এ কী! কাজের মেয়েটি কাছে এল। বুঝলাম,
ওটি কলিংবেল। সংকেত ছিল লেবুজলের। ওদিকে বাইরে ছিলেন আর একজন
অপেক্ষমাণ। সুতরাং, তাঁকে প্রণাম জানিয়ে উঠে পড়ি।
বলা বাহুল্য,
কলকাতার ‘কবিতা ভবন’ বাসভবন
থেকে শান্তিনিকেতনের ‘স্বাগত বিদায়’ বাসভবনে
মাঝেমধ্যেই আসেন। কলকাতার কোলাহলমুখর পরিবেশ থেকে একটু শান্ত ও নির্জনতার জন্য।
থাকেন দু’তিন সপ্তাহ।
তাঁর ছায়াঘন বাড়ি ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে সমাগত
সন্ধ্যায় পৌঁছে যাই বোলপুর স্টেশনে। মনে পড়ে,
তাঁর কাজের কিশোরী মেয়েটির নাম শঙ্করী। মেদিনীপুরে তার বাড়ি। কী
সৌভাগ্য তার! লেখক-কবি-গুণী মানুষের বাড়িতে কাজ করা মাস-মাইনের চেয়ে অনেক বেশি
মূল্যবান। সে আমাকে তার অপটু হাতে নিবেদন করেছিল, একটি বড়
রেকাবিতে অনেকটা সুজি। অনেকটা শসাকুচি। দু’টি খাস্তা বিস্কুট
আর র-চা। মনে পড়ছিল, প্রতিভা বসু— যাঁর
অন্য নাম রানু সোম; তিনি শান্তিনিকেতনে সকলের কাছে 'মা' নামে পরিচিত।—যেমন ‘প্রভাতদা’ নামে পরিচিত রবীন্দ্র-জীবনীকার
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
এই সাক্ষাৎকারের (১৯৮৫-৮৬ সম্ভবত) পর প্রতিভা
বসুর সঙ্গে আবার আমার সাক্ষাৎ ঘটে আমার কর্মজীবনে প্রবেশের পর। সম্ভবত ১৯৮৭-র
ডিসেম্বরে। পৌষমেলা উপলক্ষ্যে তিনি শান্তিনিকেতনে আসছেন। চিঠিতে এমন খবর পেয়েই
সেখানে পৌঁছে যাই এক সন্ধ্যায়। গিয়ে দেখি পরিবেশটা একটু অন্যরকম। কোনও আলাপ-আলোচনা
করা কিংবা বসার মতো পরিস্থিতি নেই। আমি প্রতিভা বসুকে প্রণাম করতেই তিনি কাছেই
দণ্ডায়মান একজন মহিলার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন: এ মীনাক্ষী; আমার মেয়ে।
—ও। আমি নাম শুনেছি।
তখন তিনি পঞ্চাশোর্ধ্ব। অসম্ভব দেখতে। সুদর্শনা।
মাতৃপ্রতিম।
কিছুক্ষণ আগে এলে তুমি কঙ্কাকে দেখতে পেতে।
এইমাত্র বেরিয়ে গেল। কলকাতা।
কঙ্কাবতী দত্ত। তাঁর লেখা পড়েছি। তাছাড়া
বুদ্ধদেব বসুর কবিতাতেও কঙ্কাবতীর উল্লেখ আছে।
কয়েক ফুট দূরেই এক দীর্ঘকায় ভদ্রলোক। সামনে ঈষৎ
ঝুঁকে দু’পা এগিয়ে যাবেন, এমন সময় প্রতিভা বললেন, ওঁকে চেনো?
—ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বললেন,
হামদি বে। সাংবাদিক।
—আচ্ছা, ‘আজকাল’ পত্রিকায় ওঁর ধারাবাহিক একটা কলম আছে: ‘বে অফ বেঙ্গল’।
এরপর আর কী বা বলার থাকে!
আর কোনও যোগাযোগ ছিল না এরপর। শুধু এটুকু মনে
হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ আমার জন্মের আঠারো
বছর আগে প্রয়াত। সুতরাং, তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু
তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা ছিলেন; মৈত্রেয়ী দেবী বা প্রতিভা বসু,
তাঁদের কাছে যে কিছুটা সময় বসতে পেরেছি, তাতেই
আমি ধন্য।
0 মন্তব্যসমূহ