বহির্বঙ্গে বাংলাচর্চার এক অনন্য পথিকৃৎ -
শ্রী শিবব্রত দেওয়ানজী
[ প্রয়াণ - ৭ই আগস্ট- ২০২০ ]
বঙ্গ ও বহির্বঙ্গে থেকে যারা নিয়মিত সাহিত্য
চর্চা করেন কিংবা লিটল ম্যাগাজিন বের করেন, তাদের অনেকের কাছেই
শিবব্রত দেওয়ানজী একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব।
শিবব্রত দেওয়ানজীর জীবনে্র ষাট বছরেরও বেশী সময় অতিবাহিত হয় অধুনা ছত্তিশগড়ের ভিলাই শিল্প শহরে। ভিলাইতে পদার্পনের পর ১৯৫৭ সালে থেকেই তিনি মধ্যপ্রদেশের রুখাশুখা জমিতে সাহিত্যের তাগিদে অন্যান্য বাঙ্গালীদের সঙ্গে মিলে মিশে শুরু করেন নানাবিধ সাহিত্যচর্চা, ঘরোয়া সাহিত্য-আড্ডা। আমৃত্যু তিনি ছিলেন ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকার সম্পাদক ও ভিলাই বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার একজন মূল সংগঠক। বহির্বঙ্গে তিনি ছিলেন বহু মানুষের সাহিত্য চর্চার প্রেরণা! যদিও শেষের কিছু দিন তিনি শ্রবণজনিত সমস্যা ও নানান শারীরিক কারণে অসুস্থ ছিলেন। অবশেষে আমাদের সকলের এই প্রিয় মানুষটি প্রয়াত হন ২০২০র সাতই মে তারিখে।
শিবব্রত দেওয়ানজীর সাহিত্য জীবনের ইতিহাস
অনেকটাই দীর্ঘ। তার উদ্যোগে ভিলাইতে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়
হাতে লেখা পত্রিকা ‘অংকুর’। কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ভিলাই ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থা’। প্রকাশিত হয় ছাপা পত্রিকা ‘অংকুর’, সম্মিলিত কবিতা সংকলন ‘ইস্পাতের সুর’, ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ (১৯৭৩), ‘আনন্দধারা’, ‘সংস্কৃতি’-পত্রিকা
ইত্যাদি। অবশেষে প্রকাশিত হয় ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকা, যারও তিনি আমৃত্যু সম্পাদক
ছিলেন। তার সংগ্রহে আছে ১৮টি বই – গদ্য, কবিতা ও সম্পাদিত গ্রন্থ। তার
জীবনের শেষতম গ্রন্থ(২০১৯ সাল)- ইংরেজী ও হিন্দিতে অনূদিত
তার কবিতাগুলোর একটি সংকলন, যা কিনা অ-বঙ্গভাষীদের
জন্যে সংকলিত হয়েছিল।
শিবব্রত দেওয়ানজীর জন্ম ৭ই এপ্রিল, ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দ; অবিভক্ত ভারতের
ব্রহ্মদেশের রেঙ্গুনে। অল্প বয়সেই তার বাবা মারা
যান। এখানে থাকতেই তিনি দেখেছেন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা তিনি লিখে গেছেন তার
আত্মকথায়। এখানেই শৈশবের পাঁচ-পাঁচটা
বছর কাটিয়ে তিনি সপরিবারে চলে এসেছিলেন চট্টগ্রামে, যা কিনা অধুনা বাংলাদেশে।
চট্টগ্রামের গ্রামীন পরিবেশেই তার বড় হয়ে ওঠা। এখানে থাকতেই তিনি শৈশবে
দেখেছিলেন ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬-এর জাতিদাঙ্গা, ১৯৪৭-এর
স্বাধীনতা ও দেশভাগ। এখনেই
হাই স্কুলে থাকতে শুরু হয় তার কবিতা ও সাহিত্যচর্চা। তার চোখের সামনেই তখন ঘটেছিল ১৯৫২র ভাষা
আন্দোলন, স্কুলের ছাত্র হিসেবে তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে
অংশ নেন।
এরপর ১৯৫৪ সালে তারা সপরিবারে
পূর্ব পাকিস্থান ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। উঠেছিলেন বেলঘরিয়ার কাছে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে। তখন থেকেই শুরু হইয়েছিল
বেঁচে থাকার লড়াই। ছাত্র পড়ানো, এদিক ওদিকে চাকুরীর চেষ্টা। ছোটো খাটো কিছু আংশিক সময়ের বা অস্থায়ী ধরণের জীবিকা। কিছু দিন তিনি থেকেছিলেন
ঢাকুরিয়া লেকের কাছে রিফিউজি ক্যাম্পে। অবশেষে তার এক আত্মীয়ের সূত্র ধরে তিনি চলে আসেন
মধ্যপ্রদেশে(তখনও এ অঞ্চলটার নাম ছত্তিশগড় হয় নি)। ১৯৫৬ সালে ভিলাই ইস্পাতের
একটা ছোট অ্যান্সিলিয়ারী সংস্থায় তার জন্যে অস্থায়ী চাকুরীর জোগাড় হয়ে গেল। এর কিছু দিন পরেই পরে তিনি
অস্থায়ী ভাবে ঢোকেন সরকারী ভিলাই ইস্পাত কারখানায়; এখানেই থাকতে থাকতেই ১৯৬১ সালে তার চাকুরীটা স্থায়ী হয়। ছিন্নমূল রিফিউজী থেকে সরকারী সংস্থার স্থায়ী
চাকুরী – এই নিয়েই শিবব্রত
দেওয়ানজীর জীবনের প্রথম দিকটা ছিল বেশ সংঘর্ষময়!
১৯৫৭ সাল থেকেই শিবব্রত দেওয়ানজী আরো কিছু
উৎসাহী বাঙ্গালীদের সাথে মিলে রুখাশুখা, অনুর্বর, নির্মীয়মান একটি শিল্পশহর ভিলাইতে
শুরু করেন বাংলা সাহিত্য চর্চার একটা ক্ষীণ প্রয়াস। সাহিত্যের এই ক্ষীণ ধারাকে উল্লেখযোগ্য
স্রোতে পরিণত করতে যে মানুষটির কথা সর্বাগ্রে সবাই মনে রাখবে, তিনি এই মানুষটি।
শিবব্রত দেওয়ানজী লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, তিনি কবি, একই সঙ্গে তিনি সংগঠক, লেখক, নিবন্ধকার, সংকলক। তার নিজস্ব সাতটি
কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তার লেখা
উল্লেখযোগ্য তথ্যমূলক গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘স্মৃতির
মিছিলে চোখে দেখা ছত্তিশগড়’ ও ‘ভিলাইয়ে
বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস’। যৌথ ভাবে ভিলাই থেকে তিনি
সম্পাদনা করেছেন ‘বহির্বঙ্গের লেখক অভিধান’ ও ‘সারা ভারত বাংলা কবিতা
সংকলন’। তার লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মুকুট
বিহীন লেখকের আত্মকথা’টিও খুব মনোগ্রাহী ও ঐতিহাসিক ভাবে
গুরুত্বপূর্ণ। দেওয়ানজী দাদার বেশ কিছু
বাংলা কবিতার হিন্দী/ইংরেজীতে অনুবাদ একটি গ্রন্থের আকারে
প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে।
বিভিন্ন ভাবে তার সাথে যোগাযোগ ছিল বিভিন্ন
সাহিত্যিক ও বিদগ্ধজনের। যেমন বিষ্ণু দে, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দেবকুমার বসু, দক্ষিণারঞ্জন বসু, কবিরুল ইসলাম, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, গজেন্দ্র কুমার ঘোষ, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, নির্মল বসাক, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, সুবিমল বসাক, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, নব কুমার শীল, ডঃ উত্তম দাশ, রবীন সুর, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, সামসুল হক, যশোধরা রায় চৌধুরী, কিরণ শঙ্কর মৈত্র, বুদ্ধদেব গুহ, অজিত পাণ্ডে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ও আরো অনেকেই। শিবব্রত দেওয়ানজীকে উদ্দেশ্য করে লেখা এই সব
মাননীয়ের চিঠিগুলো অনেক তথ্য ও ঘটনার সাক্ষী। এই সব চিঠিগুলো সংকলিত হয়েছে শ্রী দেওয়ানজী
প্রণীত ‘সুধী জনের সান্নিধ্য ও সুখ স্মৃতি কথা’ শীর্ষক স্মৃতিমূলক গ্রন্থে।
তিনি যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের
সাথে। সম্মানিত ও পুরস্কৃত
হয়েছেন বহুবার এবং বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্ডিয়ান প্রেস কাউন্সিল (ভোপাল), নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, পি ই এন (কোলকাতা), ছত্তিশগড় বাংলা একাডেমী, কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন
লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ মুসলিম সাহিত্য
সমাজ (ঢাকা, বাংলাদেশ) ইত্যাদি।
তার ঘরটাই বই পত্তর ও ম্যাগাজিনের একটা বিশাল
লাইব্রেরী! আমরা দেখেছি, নিজের টেবিল চেয়ারে তিনি বসে আছেন। একান্তে লিখে চলেছেন। অথবা এক মনে বই পড়ছেন। টেবিলে একগুচ্ছ ডাকে
আসা চিঠি। না-লেখা
খাম বা পোষ্টকার্ড- তিনি চিঠি লিখবেন। কখনো
কখনো দেখেছি তিনি ভীষণ ব্যস্ত। সামনেই ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকা বেরোবে- ঘরে বসে ফোন করছেন, কাকে দিয়ে কি লেখাতে হবে, কার কার থেকে লেখা নিতে
হবে। পত্রিকার
জন্যে প্রেসে পয়সা বাকী। এদিক ওদিক ঘুরছেন- কী করে দুটো পয়সা উঠবে।
তাঁর তাগাদায় ভিলাইতে অনেক সাহিত্যসভা হয়েছে। সর্ব ভারতীয় স্তরের
সাহিত্য-অনুষ্ঠান হয়েছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় বয়স্ক অনেকে নতুন করে সাহিত্য-চর্চা শুরু
করেছেন ভিলাইতে। ভিন-প্রদেশের সাহিত্যিক কবি সংস্কৃতিমনষ্ক
গুণিজনেরা যোগাযোগ রেখেছেন মূল বাংলার বাইরে পড়ে থাকা এক শিল্পশহর ভিলাইএর সাথে। এ
জন্যেই বলা যেতে পারে, ভিলাইএর লোহা-ঘেরা রূঢ়
ভূমির সাহিত্যের ফুল বাগিচায় তিনি ছিলেন এক ক্লান্তিহীন পরিচর্যাকারী, একনিষ্ঠ অভিভাবক! অনেক দুঃখ জাগিয়ে শেষ হয়ে গেল একটা যুগ! অগণিত বন্ধু-বান্ধব, সাহিত্য অনুরাগী, নিজের দুই ছেলের সংসার, আত্মীয় স্বজন- এদের সবাইকে কাঁদিয়ে বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিনেই, (৭ই
আগস্ট- ২০২০) তিনি পাড়ি দিলেন
মহাপ্রয়াণের পথে! তিনি আত্মজীবনীতে নিজেকে বলেছিলেন ‘মুকুটহীন
লেখক’! আসলে তিনি ছিলেন ভিলাই তথা বহির্বঙ্গের বাংলা
সাহিত্যের লেখকদের অন্যতম গর্বের মুকুট।
4 মন্তব্যসমূহ
সুন্দর স্মৃতিকথা। বহির্বঙ্গ থেকে পত্রিকা প্রকাশ কত কঠিন ও শ্রমসাধ্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। উত্তর প্রদেশের কানপুর থেকে 'কানপুর খেয়া' সম্পাদনার সময় থেকেই শ্রীশিবব্রত দেওয়ানজীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। পারস্পরিক পত্রিকা ও রচনা বিনিময়ও চলত দীর্ঘদিন। 'কানপুর খেয়া'-র একাধিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা। এ স্মৃতিকথা তাই আমাকে ফিরিয়ে দিল অনেক পুরনো দিনের স্মৃতি। জানা গেল তাঁর জীবনের অজানা কিছু কথাও। লেখক সমরেন্দ্র বিশ্বাসকে ধন্যবাদ। শুধু লেখার শেষাংশে শ্রীদেওয়ানজীর মৃত্যুদিন ও পঁচিশে বৈশাখের অনুষঙ্গ বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনআমার লেখার শেষের প্যারাগ্রাফটা এভাবে পড়তে হবে "অগণিত বন্ধু-বান্ধব, সাহিত্য অনুরাগী, নিজের দুই ছেলের সংসার, আত্মীয় স্বজন- এদের সবাইকে কাঁদিয়ে বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিনেই, (৭ই আগষ্ট ২০২০) তিনি পাড়ি দিলেন মহাপ্রয়াণের পথে!" শিবব্রতদা'র মৃত্যুদিন ছিল ৭ই আগষ্ট -২০২০ ( বাংলা ২২শে শ্রাবণ -১৪২৭)। লেখার সময়ে এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যে অনুতপ্ত! স্বপন নাগ দা-কে ধন্যবাদ ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্যে। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ রইলো, ভুলটি সংশোধন করে দেবার জন্যে।
উত্তরমুছুনভুল সংশোধন করে দিলাম।
উত্তরমুছুন