গরুড় – এক রক্ষক
পৌরাণিক সাহিত্যে অসংখ্য রহস্যময় ও অদ্ভুত চরিত্রের সমাহার লক্ষ্য করা যায়। সেই সকল চরিত্রের মধ্যে গরুড় অত্যন্ত চিত্রময় এবং উল্লেখযোগ্য। গরুড় হলেন এমনই এক বলশালী চরিত্র যাঁর মুখ, মাথা ও ঠোঁট বাজ বা ঈগল পাখির
ন্যায় এবং শরীর সুঠামদেহী পুরুষের মতো। পুরাণে গরুড়কে একজন রক্ষক হিসাবে
চিত্রিত করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে ইনি রিক (ছন্দ), সমন (শব্দ), যজ্ঞ (বলি) এবং আত্মার (আত্ম, চেতনার গভীরতম স্তর) রূপক। পুরাণে গরুড় সেই আত্ম যিনি পরম আত্মার (বিষ্ণু) সাথে সংযুক্ত এবং
অবিচ্ছেদ্য। গরুড় বৈষ্ণবধর্ম ও পুরাণের একটি অপরিহার্য অংশ। তিনি বিশিষ্টভাবে শৈবধর্মেরও বৈশিষ্ট্যযুক্ত। গরুড়-তন্ত্র এবং কিরানা-তন্ত্রের মতো
শৈব গ্রন্থগুলি, এবং শিব মন্দিরগুলি একটি পাখি এবং আত্মার রূপক হিসাবে অধিষ্ঠান করে
থাকেন।
অধিকাংশ বর্ণনা ও প্রাচীনকালের চিত্রকলা থেকে দেখা যায়, গরুড়ের মধ্যে বাজপাখির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বর্ণনা
অনুসারে, গরুড়ের দেহ স্বর্ণের মতো, মুখমণ্ডল সাদা বর্ণের, দুটো বিশাল বিস্তৃত ডানার রঙ লাল। তার আছে ঈগলের মতোই বিশাল ঠোঁট, মাথায় মুকুট পরা, এবং পা দুটোও ঈগলের মতো। পুরাণ মতে, তার ডানা দু'খানি এতই বিশাল ছিলো যে, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট এলাকার সূর্যালোককে ঢেকে ফেলতে পারতো। গরুড় যে শুধু বাজপাখির মতো বৈশিষ্ট্যময় ছিলো তা নয়, বাজপাখির মতোই সাপের সাথে তাঁর
সম্পর্ক মোটেও মধুর ছিল না।
পুরাণে অধিশেষ নাগকে গরুড় তাঁর বাম
পায়ের নখড়ের উপরে এবং গুলিকা সর্পকে মস্তকের অলঙ্কার হিসেবে পরিধান করেন। নাগরাজ বাসুকি তার গলার মালা। তক্ষক তাঁর কোমর-বন্ধনী, কর্কোটকা সর্প তাঁর কণ্ঠহার, পদ্ম ও মহাপদ্ম সর্পদ্বয় তাঁর দুই কর্ণের দুল, শঙ্খচূড় তার ঐশ্বরিক চুলের সৌন্দর্য
বৃদ্ধি করেছে।
ভারতবর্ষের পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে
কয়েকটি ধারা লক্ষ্য করা যায়।
প্রধান শাখা বা মূল অংশ – বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, বিভিন্ন পুরাণ, মহাকাব্য (রামায়ন ও মহাভারত) প্রভৃতি।
বিবর্তিত শাখা - ভারতীয় পৌরাণিক বিশ্বাস এবং নিজস্ব বিশ্বাসের সংমিশ্রণে সৃষ্ট
পুরাণ-কথা। এর ভিতরে রয়েছে উল্লেখযোগ্য কিছু ধর্ম বিশ্বাস, যেমন- বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ইত্যাদি।
প্রকৃতি পূজারি - ভারতের আদিবাসীদের ভিতরে
প্রচলিত পুরাণ-কথা।
গরুড় মূলতঃ প্রথম শাখার
অন্তর্ভুক্ত। যদিও বৌদ্ধধর্ম (গরুড় বা গারুলা নামে
উল্লেখ করা হয়েছে) ও জৈনধর্মে (গরুড় হলেন শান্তিনাথের যক্ষ বা অভিভাবক) গরুড়ের উল্লেখ রয়েছে।
কিং রাজবংশের কল্পকাহিনী ‘দ্য স্টোরি অফ ইউ ফেই’ অনুযায়ী গরুড়কে বুদ্ধের সিংহাসনের
মাথায় অবস্থান করতে দেখা গেছে। গরুড়ের চীনা নাম গ্রেট পেং (একটি দৈত্যাকার পৌরাণিক পাখি), গোল্ডেন-উইংড ইলুমিনেশন কিং।
পুরাণ অনুসারে গরুড়ের জন্মবৃত্তান্ত
যে কাহিনীটি প্রচলিত আছে তা হল –
প্রজাপতি দক্ষের দুই কন্যা, বিনতা ও কদ্রুর সাথে বিবাহ হলো
ঋষি কশ্যপ মুনির। কশ্যপ মুনি দেবতা এবং দৈত্যকুলের পিতা হিসেবে জ্ঞাত। বিনতা ও কদ্রু ছাড়াও তাঁর আরো দুজন পত্নী ছিলেন; তাঁরা হলেন দিতি ও অদিতি।
দিতির পুত্রদের বলা হত দৈত্য আর অদিতির পুত্রদের দেবতা।
বিবাহের পর বিনতা ও কদ্রু কশ্যপ মুনির
নিকট সন্তান প্রার্থনা করলেন। কদ্রু এক হাজার নাগ সন্তান চেয়েছিলেন, আর বিনতা চেয়েছিলেন মাত্র
দুটি পক্ষী, কিন্তু তাঁর প্রতিটি যেন কদ্রুর হাজার পুত্রের সমান হয়। কশ্যপ তাঁদের আশীর্বাদ করলেন, এবং ধ্যান করার জন্য একটি বনে ফিরে
গেলেন।
যথাসময়ে তাঁরা দুজনই ডিম প্রসব করলেন।
কদ্রুর ডিম থেকে হাজার নাগ সন্তানের জন্ম হলেও বিনতা প্রসব করা ডিম দুটি অক্ষত রয়ে
গেল। মহর্ষি কশ্যপ আদেশ দিয়েছিলেন, যেন হাজার বছরের আগে ডিমগুলিকে
কোনভাবেই ভাঙ্গা না হয়, তা না হলেই চরম অনর্থ হবে।
বছরের পর বছর এমনই চলতে লাগলো। বিনতার মাতৃমন ক্রমেই উতলা হয়ে উঠতে
লাগলো। একদিন বিনতার ধৈর্যের সকল বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। পাঁচশ বছর পর আর অপেক্ষা করতে
না পেরে একটি ডিম ভেঙ্গে ফেলেন বিনতা। বিনতা, তার নিজের ছেলেদের জন্য আগ্রহী, অধৈর্য হয়ে তার একটি ডিম ভেঙে
ফেলল। এই ডিম থেকে আংশিকভাবে গঠিত অরুণার আবির্ভাব ঘটে, দেখতে সকালের সূর্যের মতো
দীপ্তিময় এবং লালচে - কিন্তু মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো উজ্জ্বল নয় যতটা তাকে
প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ঐ ডিমের ভেতরে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পাখির মতো বৈশিষ্ট্যের এক অপরিপক্ক সন্তান রয়েছে। অরুণ নিজের মা-কে বলেন যে, বাবার পরামর্শ সত্ত্বেও তিনি নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে তাঁর
শরীরের বিস্তার হয়নি। তাই অরুণ নিজের মা বিনতাকে অভিশাপ দেন যে, তাঁকে নিজের সমগ্র জীবন একটি
সেবিকার মতো কাটাতে হবে। তিনি মাকে ভর্ৎসনা করে সূর্যদেবের রথের সারথি হয়ে
সূর্যদেবের কাছে চলে যান। তিনি আরও বলে যান যে, বাকি ডিমটি যেন তাঁর মা ভেঙ্গে না
ফেলেন, কারন ওর মধ্যে থেকে মহাশক্তিশালী এক পুত্র জন্ম নেবে যে তাঁর মায়ের
দাসত্ব ঘোচাবে।
এর পাঁচশ বছর পর ওই ডিমটি থেকে গরুড়
এর জন্ম হয়। তিনি বড় হয়ে মাকে এই দাসত্বের কথা জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মা তাঁকে
সম্পূর্ণ ঘটনা বলেন। গরুড় তখন তাঁর সাপ ভাইদের এবং বিমাতা কদ্রুর কাছে গিয়ে
জিজ্ঞাসা করলেন, কী করলে তাঁরা তাঁর মাকে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবেন? সাপেরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে
চাইল না। তারা বলল, তুমি স্বর্গ থেকে যদি আমাদের অমৃত এনে দিতে পারো তবে আমরা তোমার মাকে
মুক্তি দেব। একথা শোনামাত্র গরুড় রওনা স্বর্গলোকে উদ্দেশ্যে। পথে তিনি পিতা কশ্যপ এর সাথে দেখা করে তাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য
কিছু খাবার চাইলে, কশ্যপ তাঁর পুত্রকে বিশালকায় দুটি গজ ও কচ্ছপ ভক্ষণ করতে বললেন।
গরুড় গজ কচ্ছপ ভক্ষণ করে বায়ুবেগে স্বর্গের দিকে ধাবিত হলেন।
স্বর্গে পৌঁছানমাত্র দেবতারা নানাবিধ
অস্ত্র দিয়ে গরুড়কে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। কিছুক্ষণ পরে গরুড়ের পরাক্রমতায় ভীত
হয়ে দেবতারা পালাতে লাগলেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা অমৃতভাণ্ড পাহারা দিচ্ছিলেন।
তিনি গরুড়ের সাথে যুদ্ধ করতে এসে ক্ষতবিক্ষত হলেন। গরুড় তখন স্বর্ণময় ক্ষুদ্ৰ
দেহ ধারণ করে অমৃতভাণ্ড নিতে গিয়ে দেখলেন দুটি বিষাক্ত সর্প ওই ভাণ্ডটি পাহারা
দিচ্ছে। গরুড় তৎক্ষণাৎ তাদের ভক্ষণ করে অমৃত আহরণ করে আকাশপথে ধাবিত হলেন।
গরুড় অমৃত পাওয়ার জন্য, দেবতাদের নানাভাবে
উত্যক্ত করা শুরু করেন। গরুড়ের উৎপাতে ইন্দ্রের বজ্র ভয়ে আপনা-আপনি প্রজ্বলিত হলো।
আকাশ থেকে উল্কাপাত শুরু হলো। সেই সাথে প্রবলবেগে বাতাস প্রবাহিত হতে থাকলো। আকাশ
থেকে রক্তবর্ষণ হতে থাকলো। দেবতার এই উৎপাতের কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। ফলে দেবতারা
এর কারণ জানার জন্য বৃহস্পতির কাছে যান। বৃহস্পতি জানান যে, কশ্যপের
পুত্রলাভের যজ্ঞের সময় ইন্দ্র বালখিল্যদের অপমান করেছিলেন। এই কারণে, ইন্দ্রের চেয়ে ক্ষমতাশালী পুত্রের জন্য বালখিল্যরা যজ্ঞ করেছিলেন। সেই
সূত্রে কশ্যপের ঔরসে বিনতার গর্ভে অরুণ ও গরুড় নামক এক পক্ষীদ্বয়ের জন্ম হয়েছে। এই
পক্ষী অমৃত হরণের ক্ষমতা রাখে। ইন্দ্র এই কথা শুনে, ইন্দ্র
অমৃতরক্ষক দেবতাদের বিশেষভাবে সাবধান করে দেন।
এরপর অমৃত পাওয়ার জন্য গরুড় দেবতাদের
সামনে এলে, দেবতারা তাঁকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে প্রচুর দেবসৈন্য হতাহত হলেও গরুড় অক্ষত
থাকেন। যুদ্ধে দেবতাদের পরাজিত করে, অমৃতভাণ্ডের কাছে দেখলেন,
অমৃতভাণ্ডকে ঘিরে রয়েছে অগ্নিবলয়। গরুড় সহস্র মুখ সৃষ্টি করে,
সহস্রমুখে জলবর্ষণ করে, আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
এরপর গরুড় স্বর্ণময় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে অমৃতভাণ্ডের কাছে চলে আসেন। এবার তিনি
দেখলেন লোহার তৈরি ক্ষুরধার চক্র, অমৃতভাণ্ডকে ঘিরে আবর্তিত
হচ্ছে। গরুর নিজদেহকে সঙ্কুচিত করে ওই লৌহচক্রের ফাঁক গলে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
এবার তিনি দেখলেন, দুটি ভয়ঙ্কর সাপ অমৃতভাণ্ডকে রক্ষা করছে।
এই সাপের মুখ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। এর দৃষ্টিও ছিল বিষযুক্ত। একবার
এই সাপ দুটির যে তাকাবে সে ওই বিষের প্রভাবে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গরুড় প্রথমে ধূলি
নিক্ষেপ করে, সাপ দুটির চোখ অন্ধ করে দিলেন। এরপর নখ ও চঞ্চু
দিয়ে সাপ দুটিকে ছিন্নভিন্ন করে, অমৃতভাণ্ড নিয়ে আকশে উঠে
এলেন।
স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র গরুড় এর পথ
আটকালেন। তিনি গরুড়ের থেকে অমৃতভাণ্ড ফেরৎ চাইলেন। গরুড় তা দিতে অস্বীকার করলে
ইন্দ্র তাঁর ত্রিকালজয়ী অস্ত্র দধীচি মুনির পাঁজর দিয়ে তৈরি বজ্র দিয়ে গরুড়কে
প্রহার করলেন। কিন্তু এই অস্ত্রের প্রহারে গরুড় এর কোনো ক্ষতি হল না। তিনি মহর্ষি
দধীচির সন্মান রক্ষার্থে তাঁর শরীর থেকে একটি পালক খসিয়ে দিলেন। তাঁর এই অত্যভূত
ক্ষমতা দেখে দেবতারা তাঁর নাম দিলেন ‘সুপর্ণ’।
বিষ্ণুদেব গরুড়ের এই বীরত্বে প্রীত
হয়ে তাঁকে বরদান করতে চাইলেন। গরুড় বললেন – “হে ভগবান, বর দাও আমি যেন অমৃত পান না
করেই অমর হতে পারি। সর্পগণ যেন আমার ভক্ষ্য হয়।” ভগবান বললেন, “তথাস্তু”।
শ্রী বিষ্ণু গরুড়কে বললেন, “তুমি অমৃত পেয়েও তা
নিজে না খেয়ে তোমার সাপ ভাইদের জন্য নিয়ে যাচ্ছ। তোমার এই সততায় আমি ভীষণ
প্রীত। আমি চাই তুমি আমার বাহন হও।” গরুড় বিষ্ণুর এই প্রস্তাবে সম্মতি
জানালেন।
দেবরাজ ইন্দ্র গরুড়কে অনুরোধ করলেন, যাতে অমৃত সাপেরা ভক্ষণ করতে
না পারে। গরুড় বললেন, “আমি অমৃত নিয়ে গিয়ে সাপেদের দেবো। আপনি সেখান থেকে অমৃতভাণ্ডটি নিয়ে
চলে আসবেন, আমি বাধা দেবো না।” ইন্দ্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে
গেলেন।
গরুড় সাপেদের অমৃতভাণ্ড দিলেন। সাপেরা
তাঁদের কথামতো বিনতাকে মুক্তি দিয়ে স্নান করতে গেল। ইত্যাবসরে ইন্দ্রদেবও ভাণ্ড
থেকে অমৃত নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। শুধু ভাণ্ডটি রয়ে গেল। সাপেরা স্নান
করে এসে অমৃত কাড়াকাড়ি করে খেতে গেল এবং ভাণ্ডটি ধারালো হওয়ার কারণে তাদের
জিভগুলি মাঝ বরাবর চিরে গেল। সেই থেকে সাপেদের জিভ চেরা।
রামায়নে লঙ্কা যুদ্ধে
ইন্দ্রজিৎ রাম - লক্ষ্মণকে নাগপাশে বন্ধন করলে গরুড় এঁদেরকে মুক্ত করেছিলেন।
গরুড়কে মহাভারতেও সাপেদের ভক্ষক
হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মহাভারতে দ্রোণ গরুড়ের নামে একটি
সামরিক বাহিনীও প্রস্তুত করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ধ্বজাতে
গরুড়ের নিশান ব্যবহার করেছিলেন।
মহাভারতের আদিপর্বে অরুণ ও গরুড়ের
জন্মের একটি কাহিনী পাওয়া যায়। কশ্যপ পুত্রলাভের আশায় একটি মহাযজ্ঞ করেন। সেই
যজ্ঞে সাহায্য করার জন্য দেবতাগণ, ঋষিগণ ও গন্ধর্বগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইন্দ্র নিজের
ক্ষমতাবলে প্রচুর কাঠ যোগাড় করে আনার সময় দেখতে পান যে, ক্ষুদ্রাকার
বালখিল্য ঋষিরা সমবেতভাবে একটি পত্রবৃন্ত আনার চেষ্টা করছিলেন। বালখিল্য ঋষিরা
উপাসনার জন্য প্রায়শই অনাহারে থাকতেন; সেই কারণে তাঁরা খুব
দুর্বল ছিলেন। এছাড়া এঁদের আকারে এতটাই ক্ষুদ্র ছিলেন যে, গরুর
পায়ের চাপে মাটিতে যে গর্ত হয়, তাতে জমে থাকা জলে এনারা
প্রায়শই ডুবে যেতেন। বলাই বাহুল্য যে বালখিল্যদের পক্ষে একটি পত্রবৃন্ত জোগাড় করা
এবং তা বহন করে নিয়ে যাওয়াটা যথেষ্টই কঠিন কাজ ছিল। ইন্দ্র বালখিল্যদের এই
পত্রবৃন্ত সংগ্রহের দৃশ্য দেখে উপহাস শুরু করেন। এতে বালখিল্যরা অপমানিত হন,
এবং ইন্দ্রের চেয়ে শক্তিশালী পুত্র কামনায় যজ্ঞ করেন। বিষয়টি দেবরাজ
ইন্দ্রর গোচরে আসতেই তিনি কশ্যপের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কশ্যপ ইন্দ্রের
অনুরোধে বালখিল্যদের কাছে এসে কার্যসিদ্ধির প্রার্থনা করলেন। বালখিল্যরাও এই
প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এরপর কশ্যপ বালখিল্যদের জানান যে, ইন্দ্রকে
ত্রিভুবনের নিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বয়ং ব্রহ্মা দিয়েছেন। সুতরাং ইন্দ্রের চেয়ে
শক্তিশালী কেউ হলে, ব্রহ্মার নিয়ম লঙ্ঘিত হবে। তাই
বালখিল্যদের ইন্দ্র হবে পক্ষীদের ইন্দ্র। যেহেতু বালখিল্যরা কশ্যপের পুত্রকামনায়
যজ্ঞ করছিলেন, তাই এক্ষেত্রে ঠিক কী করা উচিৎ, তা বিবেচনার ভার কশ্যপকেই প্রদান করেন। এর কিছুদিন পর বিনতা যখন
পুত্রকামনায় ঋতুস্নান শেষে কশ্যপের কাছে আসেন। তখন কশ্যপ বিনতাকে জানান যে,
বালখিল্যদের প্রার্থনা অনুসারে তাঁর গর্ভে দুটি পুত্র জন্মগ্রহণ
করবে। এই পক্ষীরূপী ওই দুই পুত্র পক্ষীজাতির ইন্দ্র হবে। এর পরের কাহিনীটি প্রচলিত
পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপুর্ণ।
গরুড়ের স্ত্রী হলেন উন্নতি (প্রগতি)
যাকে বিনায়াকা (জ্ঞানের রানীও) বলা হয়। তাঁর ছয় পুত্র আছে; সুমমুখ (সুন্দর-মুখ), সুনামা (সুন্দর-নাম), সুনেত্রা (সুন্দর চোখ), সুভারকাস (সুন্দর শক্তি), সুরুক (সুন্দর উজ্জ্বলতা) এবং
সুবালা (সুন্দর শক্তি)।
পুরাণে গরুড় বিভিন্ন নামে উল্লেখিত হয়ে থাকেন। যেমন -তক্ষ্য, চিরদা, গগণেশ্বর, কামায়ুশা, অমৃতাহরণ, অরুণাগ্রজ, অরুণানুজ, অরুণাবরজ, অহিদ্বিট্, অহিভুক্, অহিমার, অহিরিপু, কাশ্যপী, খগপতি, খগরাজ, খগেশ্বর, গগনেশ্বর, বজ্রজিৎ, বিষ্ণুরথ, বৈনতয়, রক্তপক্ষ, সুধাহর, সুপর্ণ, সুবর্ণকায়, সুরেন্দ্রজিৎ ইত্যাদি।
গজেন্দ্র নামে একটি হাতি একটি হ্রদে
গিয়ে খেলছিল। এটি খুব পছন্দ করে এবং অনেক ঘন্টা পরেও তা থেকে বেরিয়ে আসে না
.হঠাৎ একটি কুমির তাকে ধরে ফেলে এবং গজেন্দ্র নড়াচড়া করতে না পেরে সাহায্যের
জন্য বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করে। বিষ্ণু তার ভক্তদের যত্ন নেওয়ার সাথে সাথে তিনি
গরুড়ের উপর পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং গজেন্দ্রকে সাহায্য করেন। গজেন্দ্র একটি
স্তোত্র গায় যা গজেন্দ্র মোক্ষ স্তোত্র নামে পরিচিত। গল্পের তাৎপর্য হল গজেদ্র প্রতিটি মানুষ মায়ার মায়ায় রয়েছে এবং
সে এর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং এটি করতে থাকে। কিছু সময়ে এটি মানুষকে আটকে
রাখে এবং এর কারণে সে কষ্ট পায়। তাই তিনি সাহায্য চাইলে বিষ্ণু তাকে উদ্ধার করতে
বাহন গরুড়ের উপর আসীন হয়ে আসেন এর মানে যখন জীব সমস্যায় পড়েন তখন পরমাত্মা
সাহায্য করেন এবং মায়া থেকে মুক্তি দেন .সুতরাং গরুড়ত্মা হল ঈশ্বর ও মানুষের
মধ্যে সংযোগ বিন্দু বা বাহন।
তাই বিষ্ণু মন্দিরে আমরা মন্দিরের
সামনে বা মন্দিরের দরজায় গরুড় দেখতে পাই যা দেবতা ও মানুষের মধ্যে সংযোগ নির্দেশ
করে। মন্দিরে প্রবেশ করার সময় প্রত্যেক মানুষকে গরুড় অতিক্রম করতে হয়।
গরুড়ের চিত্রায়ণ শুধু পুরাণে সীমাবদ্ধ
নয়। দক্ষিণ ভারতের হোয়সল,
চোলা ও বিজয়নগর মন্দিরগুলিতে বিশালাকৃতির গরুড়মূর্তি এখনও ভক্তদের
আকর্ষণের কেন্দ্র। গরুড়স্তম্ভ বা "গরুড় খাম্বা"
অনেক মন্দিরের সামনে স্থাপিত—যেমন কুম্ভকোনম
বা তিরুপতির মন্দিরে, যা একধরনের রক্ষাকারী প্রতীক। উত্তর ও
পশ্চিম ভারতের মন্দিরে গরুড় বহুবার শঙ্খ, চক্র, ও মকরধ্বজ বহনকারী এক পূর্ণ-পুরুষ রূপেও আবির্ভূত হয়েছেন।
বাংলার মন্দিরশিল্পেও গরুড়ের স্থান
আছে। টেরাকোটার মন্দিরের অলংকরণে বিষ্ণুর বাহন হিসেবে গরুড়ের উপস্থিতি চিত্রিত
হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর বা নদিয়ার অনেক প্রাচীন মন্দিরে গরুড়কে মূর্তির
পাদদেশে অথবা একক মূর্তিতে দেখা যায়—যেখানে তিনি বিষ্ণুর উদ্দেশে প্রণতি জানাচ্ছেন অথবা
সর্পদমন করছেন।
লোকসাহিত্যে গরুড়কে অনেকসময় ‘বিশ্ণুর পাখি’ রূপে উপস্থাপন করা হয়। বাংলা অঞ্চলের কীর্তন ও মঙ্গলকাব্যে গরুড় কখনও
কৃষ্ণের সহচর, কখনও আবার দৈত্যদমনকারী এক অলৌকিক পাখি। কিছু
কিছু আদিবাসী লোককথায় গরুড়কে বজ্রের মতো এক দেবদূত হিসেবে দেখা যায়—যিনি আকাশভেদ করে নিচে নেমে আসেন, অসুর বা সর্পের
সঙ্গে যুদ্ধ করেন, এবং পরে অদৃশ্য হয়ে যান। এইসব কাহিনি
লোকচেতনায় গরুড়কে করে তোলে জনরক্ষক ও অতিমানবিক এক রক্ষাকবচ।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে প্রাচীন সৌম্য
কেশব মন্দিরে গরুড় দুই পাশে তার সঙ্গী রুদ্র ও সুকীর্তি-সহ
পূজিত হয়ে থাকেন। গরুড় অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন ও নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বরূপ
পরিবর্তন করতে পারতেন। বেদব্যাস মোট আঠারোটি পুরাণ
লিখেছিলেন। যা ‘অষ্টাদশ মহাপুরাণ’ নামে পরিচিত। এই পুরাণের মধ্যে অন্যতম হল গরুড় পুরাণ। যা মৃত্যুর পর
পাঠ করা হয়। হিন্দু শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে যে গরুড় পুরাণ দ্বারাই মৃত ব্যক্তির
আত্মা শান্তি লাভ করে এবং সে সমস্ত মোহমায়ার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র –
১. বিভিন্ন পুরাণের সারসংক্ষেপ।
২. উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র - গরুড়ের কথা।
৩. রামায়ন ও মহাভারত।
৪. এই সময় – ১২-ই সেপ্টেম্বর, ২০২২
৫. উইকিপিডিয়া - https://en.wikipedia.org/wiki/Garuda
৬. http://onushilon.org/myth/hindu/gorur.htm
৭. গুগুল।
0 মন্তব্যসমূহ