সে এক রূপকথারই দেশ
(১)
সেদিন সকাল থেকে উফাউফা নগরে সাজো সাজো রব।
হওয়ারই কথা, প্রায়
দশ বছর পর নগরে মন্ত্রী নির্বাচন! আসলে মুশকিল হল, এখানে যে
কেউ মন্ত্রী হতেই চায় না। মন্ত্রী হওয়ার ঝামেলাও যে অনেক! কে আর সাধ করে সেই
ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চায়? একবার মন্ত্রী হলেই হয়েছে, যত দিন না জনতা সেই মন্ত্রীর মুখ দেখে দেখে, দেখে
দেখে বিরক্ত না হয়ে যাবে, ততদিন মন্ত্রিত্ব ছাড়া যাবে না।
ভাবুন দেখি! এ তো আর আমার - আপনার দেশ নয়, যে মন্ত্রিত্ব
কেউ ছাড়তেই চায় না! এ হল গিয়ে উফাউফা নগর। এখানকার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।
সেই কবে... এক যে ছিল রাজাদের সময়ে.. মহান রাজা
তয়ুতাফা মৃত্যুর আগে এক চমকপ্রদ বিধান দিয়ে গিয়েছিলেন, ক্রমে সেই বিধানই হয়ে দাঁড়ায় সংবিধান।
নিকটবর্তী বৃষ্টি অরণ্য থেকে সাতটা পরিপুষ্ট হরিণ ও হরিণী ধরে এনে তিনি প্রাসাদের
সামনের বাগানে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেদেশে হরিণ-হরিণীদের অত্যন্ত জ্ঞানী বলে মানা
হয়, তাই এমনিতে হরিণ ধরা বা শিকার করা মানা। সত্যি, অমন চমৎকার প্রাণি বোধকরি আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না! সেকালে মানুষ
অনেক মন্ত্রতন্ত্র জানত। রাজা ঘোষণা করেছিলেন যে, ঠিক সাতটা
দিন যদি প্রতিটি হরিণ-হরিণী ওই বাগানের সীমানার মধ্যেই বেঁচে থাকে, তবে আর কোনোদিন দেশে রাজার প্রয়োজন হবে না। কারণ সাতদিন পর ওই
হরিণ-হরিণীগুলি যাদু মন্ত্রে আপনা থেকেই প্রাণ ত্যাগ করবে। আর তাদের সম্মিলিত
প্রাণকণা থেকেই জন্ম হবে এক ইউনিকর্নের, যে হবে আশ্চর্য
বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী, কর্তব্য পালনে সর্বোত্তম। যার দুটি
অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার মধ্যে একটি হবে ইচ্ছামৃত্যু এবং অপরটি হবে ইচ্ছামতো রূপ ধারণ
করার ক্ষমতা। ব্যাস, এই বিধান দিয়ে রাজা তো চলে গেলেন।
কিন্তু তাঁর অপার্থিব মন্ত্র শক্তির জোরে তিনি সৃষ্টি করে গেলেন মহাবিজ্ঞ
আমুনাফাকে। আমুনাফা আসলে নাকি এক ইউনিকর্ন! সবাই একথা জানে, কিন্তু
কেউ তাঁকে সেই গুহ্য রূপে দেখেনি। তয়ুতাফার মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২০০ বছর হল। তাহলে
আমুনাফার বয়সও ২০০ বছরই হয়। কিন্তু দেখতে তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ, স্বাস্থ্যও ভালো, বয়সজনিত কোনোরকম সমস্যা এখনো
তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। সমগ্র উফাউফা-তে নগরবাসী সবচেয়ে বেশি সম্মান করে
তাঁকে। রাজার মৃত্যুদিন অর্থাৎ 'এনামনাফা' বার-এ প্রতিবছর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। সেদিন নগরীর সমস্ত জ্ঞানী,
গুণী, পন্ডিত, শিল্পী ও
প্রতিভাবানদের বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়। সেদিন সকালে প্রাসাদের উদ্যানে আমুনাফা
নিজের হাতে তাঁদের প্রত্যেকের মুখে তুলে দেন, মরশুমের প্রথম
উৎপাদন থেকে, দিনের প্রথম অন্ন। সবার খাওয়া শেষ হলে তবে
তিনি খেতে বসেন। কেবল তাঁর হাসিমুখটুকু দেখবে বলেই দূর দূর থেকে কত লোকজন আসে
সেদিন।
এদেশের মানুষ একবার কাউকে মন্ত্রী নির্বাচন করলে, তাঁর আর ছাড় নেই। যতই তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়তে চান না কেন, মানুষ
তাঁকে ছাড়বে না। 'জমথপা' অর্থাৎ
এদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প পরিষদে তাই প্রত্যেকেই সারা বছর ভারি বিষণ্ন হয়ে
থাকেন। এদেশের মানুষও ভারি বেয়াক্কেলে। কেবলমাত্র চিন্তা করা ও প্রশাসনিক
ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া মন্ত্রীদের আর কোনো কাজই তারা করতে
দেয় না। অর্থাৎ একবার মন্ত্রী হলেই গেঁটে-বাত, হাঁটুতে বাত
হয়ে যাওয়ার উপক্রম। জলটি পর্যন্ত মন্ত্রীদের গড়িয়ে খেতে দেওয়া হয় না, খেলাধুলাও বন্ধ। সত্যি বলতে কী, এদেশের কোনো মানুষই
এটা পছন্দ করে না।
এদেশে কেবল মন্ত্রী বলে না, কারোরই কোনো পারিশ্রমিক নেই। সকলেই খুব পরিশ্রমী
এবং শ্রমের বিনিময়ে প্রত্যেকেই শ্রম নিয়ে থাকে। একান্তই যদি শ্রমের বিনিময়ে
উপযুক্ত 'বিকল্প শ্রম' খুঁজে না পাওয়া
যায়, তখন বাধ্য হয়ে শ্রমে ব্যয়িত সময়ের বিকল্প হিসেবে
শ্রমদাতাকে বুদ্ধি বুঝে নিতে হয়। যেমন ধরুন আপনি একজন শিক্ষক, নগরীর বিশিষ্ট কারিগর লাফাঝাঁপার মেয়েকে সপ্তাহে চারদিন জ্যামিতি শেখালেন।
তাহলে চুক্তি হতে পারে, ওই লাফাঝাঁপা সপ্তাহে দুদিন আপনার
বাড়িতে গিয়ে আপনার প্রয়োজন মতো কোনো কিছু বানিয়ে দিয়ে আসবেন। এবার ধরুন আপনার
তেমন কিছুর প্রয়োজনই নেই। তখন উপায়? তখন অগত্যা শ্রমের
পরিবর্তে বুদ্ধি নিতে হবে। আপনার প্রয়োজন মতো লাফাঝাঁপা তখন আপনাকে বুদ্ধি দেবেন।
অবশ্য এমনও কখনো কখনো হয়, যখন বিনিময়ের ঠিকঠাক মাপজোক করা
সম্ভব হয় না। তখনই ডাক পড়ে পরামর্শ-মন্ত্রীর। তিনি চুলচেরা হিসাব করে দু-পক্ষকেই
সব বুঝিয়ে দেন, সব গোলযোগ মিটিয়ে দেন।
একবার যেমন একটা খাল কাটা নিয়ে খুবই সমস্যা
হয়েছিল। তিন দিন উদয়াস্ত শ্রম দেওয়ার পরও দমদাফা নামের এক যুবক কিছুতেই কাজ
ছাড়তে রাজি হয়নি। কারণ তার বক্তব্য ছিল,
সে যথেষ্ট শ্রম দিয়ে উঠতে পারেনি। শারীরিক ক্লান্তিবশতঃ সে,
কাজে কিছু কিছু ফাঁকি দিয়েছে। অথচ যার ক্ষেতে সে কাজ করছে, সেই নিয়ামনাফা তার পিতৃবিয়োগের পর চার দিন তাকে যত্ন করে নিজের বাড়ি
রেখেছিল। তখন দমদাফার মাত্র সাত বছর বয়স। এরপর বড়ো হয়ে যখনই সে বিনিময় শ্রম দিতে
চাইত, তখনই নিয়ামনাফা কোনো না কোনো একটা অজুহাত করে তা নিতে
অনীহা দেখাতো। নিরুপায় হয়ে দমদাফা তখন মন্ত্রিসভায় নালিশ জানায়। অবশেষে তার ওই
তিন দিনের খাল কাটার বিধান হয়। দমদাফা আর তার রূপসী স্ত্রী লুয়ালাফা, দু-জনে মিলে রাতদিন ক্ষেতে কাজ করে। কিন্তু তিনদিন পর কাজ শেষ হতেই
দমদাফার কান্না শুরু হয়। এমন অবিচার, এত অসহ্য ফাঁকি সে কী
করে মেনে নেবে? যথেষ্ট শ্রম না দিলে যে মরেও সে শান্তি পাবে
না! তার সুন্দরী বউটাও সেই জন্য সারাদিন দুঃখ দুঃখ মুখ করে বসে থাকতো সেসময়।
এই ঘটনাটা না ঘটলে, হয়তো পুনরায় মন্ত্রী নির্বাচনের প্রয়োজনই হতো
না। কিন্তু দমদাফা তার স্বেচ্ছাশ্রমের প্রতি হওয়া এই চরম অবিচার কোনোমতেই মেনে
নিতে পারে না। অবশেষে পুনরায় নির্বাচন হবে জানতে পেরেই মন্ত্রিসভাতে খুশির হাওয়া
বইতে শুরু করে। সকলেই নিশ্চিন্ত হয়, এবার তাহলে মুক্তি!
দশ-দশটা বছর তুল্যমূল্য বিচার করতে করতে কাটিয়ে দেওয়া, কি
মুখের কথা? এদিকে নগরীর যাঁরা প্রকৃত প্রতিভাবান মানুষ,
যাঁরা বিদ্বান ও জ্ঞানী, শিল্পে ও নির্মাণে
যাঁরা সিদ্ধহস্ত; তাঁরা রীতিমতো ঘাবড়ে যান। নাওয়া-খাওয়া
বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের। ভয়ের চোটে রাতে তাঁদের ভালো করে ঘুমই আসে না। সারাক্ষণ এই
দুশ্চিন্তা - এই না ঘাড়ে ধরে মন্ত্রী করে দেয়। একবার ওই বিচ্ছিরি পরিষদ ভবনে
ঢুকলেই হল, সারাদিন বিচার আর বিচার। সকলেই শ্রম দিতে চায়।
কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ঠকাতে চায় না। এদের কোনো সমস্যার মীমাংসা করা কি সোজা কথা!
বিচারে একটু ভুল হল তো কাঁদতে বসে যাবে। সে বয়স যতই হোক না কেন, গায়ে মাথায় হাত বোলালেও কান্না থামবে না। শিশুদের মধ্যে সামান্য
মারামারি হলেই উফাউফার গৃহিণীরা আহত শিশুর বাড়িতে একটা গোটা দিন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে
আসে। পথচারীকে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধাক্কা দেওয়ায় আজীবন তার গৃহভৃত্য হয়ে থাকার আর্জি
জানান স্বয়ং মহান রাজা তয়ুতাফার নাতির নাতি রমরাফা। ভাবুন দেখি, সেদেশে মন্ত্রীদের কি কষ্ট!
(২)
রাজপ্রাসাদের উদ্যানে তখন তরুণ শিল্পোদ্যোগী
লাপাহাফা দৌড়ে দৌড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। আর তাঁর পিছু ধাওয়া করছিল রাজ্যের
অগুনতি সুন্দরী যুবতী। তিনিও মন্ত্রী হবেন না,
আর মেয়েগুলিও তাঁকে ছাড়বে না। এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হেসে
গড়াগড়ি যাচ্ছিলেন সুদূর রাশিয়া থেকে আসা বছর চল্লিশের স্বেচ্ছাসেবী, সুলেখক ও ভ্রমণপ্রেমী ইগর। ইগর পরেছিলেন নেভি ব্লু শার্টের উপর একটা কালো
মোটা জ্যাকেট। সঙ্গে ডেনিমের জিন্সের প্যান্ট। মানুষটা শৌখিন হলেও, ওই ভ্রমণের নেশাতেই তাঁর জমানো টাকা সমস্ত খরচ হয়ে যায়। কোমল সবুজ ঘাসে
ঢাকা বিশাল মাঠটার উপরে পায়ে গামবুট পরে, তিনি বসেছিলেন একটা
গদি-আঁটা চেয়ার দখল করে। হাজার হোক তিনিই মন্ত্রী নির্বাচনের অনুষ্ঠানে, সেদিনের মাননীয় অতিথি। অবশ্য তাঁর কিছু দায়িত্বও আছে। শুধু দেখলেই হবে
না, গোটা অনুষ্ঠান দেখার পর, তা নিয়ে
তাঁর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা লিখতে হবে তাঁকে। কোথাও কোনো ফাঁক রয়েছে কিনা,
শাসনপ্রণালীতে কোন্ কোন্ জায়গায় সংশোধন করা যেতে পারে - এসব বিষয়ে
ভাবনা চিন্তা করার জন্যে তিনি গোটা দিনটা পাবেন। সাত সকালেই তাঁকে রিপোর্ট জমা
দিতে হবে সুদর্শন আমুনাফার হাতে।
এই আমুনাফাই রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত
কাজান শহরে গিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছেন। অবশ্য কাজটা খুব সহজে হয়নি।
তিনি নিজেই বারবার কথা দিয়েও দেখা করে উঠতে পারেননি। আর প্রস্তাবটাও ছিল বড়ই
অদ্ভুত। ভোলগার এক উপনদী কাজাঙ্কায় একটা স্পিড-বোটে উঠতে বলা হয়েছিল তাঁকে, তাও শীতের গভীর রাতে। ইগর বিয়ে-থা করেন নি।
একেবারেই একা মানুষ। রাশিয়াতে থাকেনই বা কদিন! দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানোই তাঁর
নেশা। যখন যেখানে যান, যাহোক কাজ জুটিয়ে নেন। সুতরাং
দায়ভার বলে তাঁর কিছুই ছিল না। আমুনাফা জানিয়েছিলেন, একজন
জ্ঞানী পর্যটক খুঁজছেন তাঁরা; যিনি একটা গোটা দিন আজব নগর
উফাউফা দর্শন ও পর্যবেক্ষণে ব্যয় করবেন। আর তারপর সেই অভিজ্ঞতা থেকে একটি
সমালোচনামূলক প্রতিবেদন লিখে দেবেন নগরীর সামগ্রিক উন্নতিকল্পে। কোনো পিছুটান না
থাকায় অবশেষে কিন্তু কিন্তু করেও রাজি হয়েছেন ইগর, অন্তত
একটা নতুন দেশ দেখা তো হবে, তাও নিখরচায়। স্পিডবোটে উঠতেই
তাঁর চোখ দুটো পূর্ব শর্ত মতো বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর শুধু তিনি শব্দ শুনেছেন,
নদীর জলের অনন্ত কলকল শব্দ। শুনতে-শুনতে কখন যেন ঘুমিয়েও
পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙতে দেখলেন তিনি একটা বিরাট হল-ঘরে আরামকেদারায় মাথা হেলিয়ে
আধ-শোয়া হয়ে আছেন আর তাঁর সামনে রাশি রাশি খাবার। তাঁর পিঠের কাছে দ্বিতীয় প্রস্থ
পুলওভারটা খোলা, ঝুলছে কেদারা থেকে। গোটা ঘরটায় একটা ঠান্ডা
ঠান্ডা ভাব, হয়তো মোটা মোটা থামওয়ালা সেকেলে প্রাসাদ বলেই।
ক্ষুধার্ত ইগর হাত-মুখ না ধুয়েই গপাগপ খেয়ে ফেলেন চাড্ডি পনীর, পেস্ট্রী আর মুরগীর রোস্ট। সত্যি বলতে পানীয়রও অভাব ছিল না, কিন্তু তার স্বাদ বিচিত্র। খেয়েদেয়ে দেহে-মনে তিনি অপূর্ব স্ফূর্তি
অনুভব করেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে উদ্যানে বেরিয়ে এসে তো তিনি অবাক! প্রত্যেকে নীল
বর্ডার দেওয়া ধবধবে সাদা পোশাক পরে আছে, অনেকটা আলখাল্লা
ধরনের পোশাকটা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের একই পোশাক। প্রত্যেকের কোমরে কাপড়ের
তৈরি মোটা নীল কোমর-বন্ধনী, কোমর-বন্ধনীর উপরে আবার সাদা রঙের প্রজাপতি। পায়ে ছাগচর্মের
জুতো আর মাথায় হলুদ-লাল-বেগুনি ফুলের গোলাকার রিং। মেয়েগুলোকে দেখে ইগরের চোখ
জুড়িয়ে যায়। তিনি এত দেশে ঘুরেছেন,
কই এমন অপূর্ব রূপসী তো তাঁর চোখে পড়ে নি! তিনি কি তাহলে স্বর্গে
এসে পৌঁছালেন? এই কি বেহেশ্ত? কিন্তু
কে তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে? সবাই যে চপল ভঙ্গীতে
সংগীতের তালে তালে গদগদ হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে!
(৩)
"কি মশাই! কি মনে হচ্ছে? স্বর্গ
তো?" - আমুনাফা মুচকি হেসে, পাশে
এসে প্রশ্ন করেন ইগরের উদ্দেশ্যে।
"সে আর বলতে! স্বর্গ বোধহয় একেই বলে!" -
ইগরের অকপট স্বীকারোক্তি।
"দেখুন, ঘুরুন, মজা করুন। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। যেকোনো প্রশ্ন করতে
পারেন। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, স্বর্গ টিকিয়ে
রাখতে গেলে কিছু মূল্যও চোকাতে হয়।"
"মশাই, এইখানেই আমার
প্রশ্ন। এসব করলেন কী করে আপনারা! আপনি পূর্বেই নিষেধ করেছেন, এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। বুঝতে পারছি,
স্বর্গ টিকিয়ে রাখার এও এক আবশ্যিক কৌশল।"
"হ্যাঁ, বলতে পারেন আমরা
নিরুপায়। স্বর্গদ্বার যদি উন্মুক্ত হয় আর যেমন খুশি গমনাগমনের সুযোগ থাকে, সিঁড়ি যদি দৃশ্যমান হয়, তবে অনাচার আসতে দেরি হয় না।
গড়া খুব সহজ নয়, ভাঙা কিন্তু অতীব সহজ। তাই আমরা আমাদের
স্বর্গ লুকিয়ে রেখেছি চার পাহাড়ের কোলে। সিঁড়িটা নিয়েছি গুটিয়ে। একমাত্র তখনই কেউ
আসতে বা যেতে পারে, যখন আমরা চাই।"
"তাহলে আপনারা কোন্ প্রশাসকের অধীন? কোন্ দেশের সংবিধান মানেন? কোন্ সরকারকে কর প্রদান
করেন?"
"আমরা স্বাধীন, আমাদের
সংবিধান আমাদের নিজস্ব, আমরা কাউকে কর দিই না। আমরা কাউকে,
কোনো সরকারকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।"
"কিন্তু এ যে আজকের পৃথিবীতে সম্ভব নয়!"
"কেন সম্ভব নয়! প্রগতিকে প্রযুক্তির সাথে
গুলিয়ে না ফেললেই সব সম্ভব।"
"আপনারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না?"
"নাহ্। তার দরকারই বা কী?"
"কিন্তু তাহলে আপনারা গোটা দুনিয়ার খবর রাখবেন
কী করে?"
"তার তো কোনো প্রয়োজন দেখি না! স্বর্গের
দেবতারা কবে আর মর্ত্যবাসীদের
খোঁজ-খবর রেখেছে বলুন? তাছাড়া
আপনাদের দুনিয়ায় যুদ্ধ-বিগ্রহ আছে, সামাজিক ভেদ-বিভেদ আছে,
ধর্মের শাসন আছে, পুলিশের প্রশাসনের নজরদারি
আছে, হাজারো প্রতিযোগিতা আছে - আমাদের ওসব কিছু নেই। আমরা
বাঁচি ইচ্ছেমতো। অন্য সভ্য দেশের সাথে আমাদের কোনো লেনদেনের সম্পর্ক নেই।"
"কিন্তু তাই যদি বলেন, দরকার
কি আপনাদের কখনওই পড়বে না?"
"দেখুন আমরা যথেষ্ট স্বনির্ভর। আমরা চাইলেই
শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে পারি, কিন্তু দিই নি। কেন জানেন?
শিল্প চাহিদা বৃদ্ধি করে, চাহিদা জন্ম দেয়
ভোগলিপ্সার, ভোগ এনে দেয় প্রতিযোগিতা, কলহ
ও বিবাদ। গৃহযুদ্ধ বাঁধতে দেরি হয় না। স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। এসব বলছি বলে আমাদের
স্বভাবভীরু অথবা উদ্যোগহীন ভেবে বসবেন না! আমরা কৃষি, বয়ন,
পশুপালন, বাগিচা ফসল, খনিজ
দ্রব্যের সীমিত প্রক্রিয়াকরণ ও বন্টনের উপর নির্ভর করে এখনও অবধি অর্থনীতি সচল
রাখতে পেরেছি। আমাদের এখানে প্রত্যেকে স্বেচ্ছাধীন। বেশি উৎপাদন কেউ করবে না,
কোনো অপচয় হবে না। আমাদের এখানে কেউ ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চয় করে
না, তাই ব্যাঙ্ক যেমন নেই, তেমনি
অতিরিক্ত উচ্চাশা বা লালসা নেই। কেউই যেহেতু সঞ্চয় করছে না, সেহেতু
ধন এদেশে মুষ্টিমেয় লোকের করায়ত্ত হয়ে থাকে না কখনও। অভাব এখনও আমাদের স্পর্শ করে
নি কারণ পরিবেশ ও প্রতিবেশ - উভয়ের প্রতি আমরা যত্নবান। আমরা কৃতজ্ঞ যে জলবায়ু
আমাদের বসবাসের অনুকূল। আমরা প্রত্যেকের আনন্দ ও শ্রমকে মর্যাদা দিই। আমাদের যার
যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি কেউ দাবী করি না। এই যে দেখছেন
প্রাসাদ, এ এক্কেবারে উন্মুক্ত। সবাই এখানে এসে থাকতে পারে,
তাই যত্ন নেওয়ার দায়ও সবার। আমরা বিদ্যালয় খুলি নি, আমাদের কোনো প্রথাগত শিক্ষা-ব্যবস্থা নেই। যার যেমন চাহিদা, সে তেমনি শেখে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা জ্ঞান ও বিদ্যাদানের পরিবর্তে শিশুদের
পিতামাতার কাছ থেকে বিনিময় শ্রম নেন। এখানে সকলেই শিক্ষক, সকলেই
শ্রমিক। কারও কোনো নির্দিষ্ট পদ নেই, নেই কোনো ক্ষমতার বলয়।
তদুপরি নেই কোনো মাসিক বেতন। তাই প্রত্যেকে সচেতন তার নিজের নিজের যোগ্যতা ও
ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়ে। কেউ আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে অপরের মর্যাদাহানি করে না। কারণ
প্রত্যেকে জানে, তার সামাজিক মর্যাদা একমাত্র তার শ্রমদান ও
গ্রহণের উপর নির্ভরশীল।"
"বিস্ময়কর এই ব্যবস্থা! তবু বলি, যাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের সমাজে অবস্থান কোথায়?"
"আপনার প্রশ্নটি বুঝেছি। বৃদ্ধরা শিশুদের গল্প
বলেন, পরামর্শ দেন যুবকদের, তাঁদের
অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন অন্যদের সাথে। আদর্শ সমাজে এই বৃদ্ধদের প্রকৃত
অবস্থান।"
"আর যাঁরা নিতান্ত অপারগ বা, অথর্ব? যাঁরা অসুন্দর ও বিকৃত? তাঁদের সমাজে কী দশা হয়? স্পর্ধা মার্জনা করবেন,
কিন্তু এখানে দেখছি, সকলেই বড্ড সুন্দর - সে
নারীই হোক বা পুরুষ!"
"আমাদের ইচ্ছামৃত্যুর মুক্ত-নিয়ম আছে। অপারগ আর
অনিচ্ছুকদের জন্য এই ব্যবস্থা। নিরাময়হীন রোগভোগে যারা ক্লান্ত, তাদের জন্যও এই ব্যবস্থা। এক্ষেত্রেও কোনো জোর-জবরদস্তি নেই । কারো উপর
কোনো বল-প্রয়োগ করা হয় না। তাঁদের জন্য পুনর্জন্মের মধুময় পথ খোলা। ভলাতাফা পাহাড়ের
চূড়া থেকে তাঁরা আত্মবিসর্জন করতে পারেন স্বেচ্ছায় - এখানকার এই ব্যবস্থা।"
ঘাড় নাড়তে থাকেন ইগর। ব্যবস্থাটি যে তাঁর পছন্দ
হয় নি, তা বুঝেও কিচ্ছুটি বলেন না
আমুনাফা। একটি সাদা রুমাল বের করে বাম হাতে রাখেন, ডান হাতে
ফতুয়া-আকৃতির সাদা পোশাকের ডান দিকের পকেট থেকে বের করে আনেন একটি সুবৃহৎ আপেল।
রুমালে আপেলটি মুছে নিয়ে, কামড় বসান তাতে। তারপর শান্ত স্বরে
বলেন, "চলুন আপনাকে রোনারাফা নদীর ধারে নিয়ে যাই।
আমাদের দেশে 'ফা' ধ্বনির দুটি অর্থ -
সূর্য ও সৌভাগ্য। তাই প্রায় প্রতিটি শব্দেই 'ফা'-এর উপস্থিতি। রোনারাফা নদীর ধারে আমাদের মুক্ত সঙ্গমস্থল - নারী ও পুরুষ
এখানে স্বেচ্ছা-মিলনে অংশ নেন। চলুন, গেলেই দেখতে
পাবেন।"
"এ জিনিস যে আমি দেখি নি, তা নয়। বেশ কয়েক জায়গায় দেখেছি। এখানে যে এরকম একটা ব্যাপার থাকবে,
আগেই অনুমান করেছিলাম।"
"আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি।"
"আচ্ছা, আমার আগেও কি
এদেশে আমার মতো কোনো বিদেশি এসেছেন?"
"অবশ্যই। উজবেকিস্তান থেকে এসেছেন শ্রীমান
বেলবগ ও ভারত থেকে এসেছেন উপমন্যু নামক এক বিদ্বান ব্যক্তি। আমাদের এই পরম্পরা এই
নিয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ল। পরের বৎসর বিদুষী ইরা ক্যানিংহাম আসার কথা, গ্রেট ব্রিটেন থেকে; সেরকমই কথা চলছে।"
"যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা
এখান থেকে স্ব-স্ব দেশে ফিরে গিয়ে কিছু বলেন নি?" - চিন্তিত
মুখে প্রশ্ন করেন ইগর।
উত্তরে মুচকি হাসেন আমুনাফা। তারপর যেন খুব দেরি
হয়ে যাচ্ছে, এমন
ভঙ্গি করে বলেন, "চলুন আমরা নদী তীরে যাই। বেলা হয়ে গেল
যে।"
(8)
রোনারাফা নদীর তীরে তখন ভোরের অস্বচ্ছ কুয়াশার
আবরণ অনেকটা দূর হয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে অদূরে গাঢ় সবুজ পাহাড়ের সারি আর ঊর্ধ্বে
স্বচ্ছ নীলাকাশ। প্রকৃতিতে কোথাও যেন কোনো জড়তা নেই, নেই কোনো আবরণ। বালুকাবেলা মোহময় স্বর্ণাভ। নদী না
বলে এটিকে খাঁড়ি বলাই যুক্তিসংগত। কারণ কাছেই সমুদ্র, তা
নোনা বাতাসে বেশ বোঝা যায়।
বালুকাবেলায় নানা বয়সের সঙ্গমরত নারী ও পুরুষ
নিঃসংকোচে যৌন-মিলনে ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে দৃষ্টিপাতও করছে না। সকলেই নিজের নিজের
সঙ্গীকে নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি যুবক-যুবতীরাও রয়েছে এদের মধ্যে, কয়েকজনের নিতান্ত অল্প বয়স। ধর্মভীরু যে কোনো
ব্যক্তি এ-স্থানে এসে পড়লে সেই মুহূর্তে পালানোর উপক্রম করতেন লজ্জায় ও সংকোচে।
কিন্তু ইগর নানা দেশে ঘুরেছেন, তাঁর অভিজ্ঞতাও বিশাল।
ফ্রি-সেক্স বা, অবাধ যৌন-মিলন যেমন তিনি দেখেছেন, তেমনই ন্যুডিস্ট বীচ দেখার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে এহেন
যথেচ্ছাচার দেখে তিনিও বাক্যিহারা হয়ে যান। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে ইগর খুঁজে পান না
আমুনাফাকে।
ভদ্রলোক গেলেন কোথায়! তারপর এদিক ওদিক সন্ধান
করে, সহসাই দেখেন তাঁকে। একটা
প্রকাণ্ড নারিকেল গাছের নীচে একটা বেলনাকার বিশাল পাথরখণ্ডের উপর এক নগ্নিকাকে
বেষ্টন করে দুলছেন আমুনাফা। নগ্নিকা অল্পবয়স্কা, বয়স কুড়ির
কাছাকাছিই হবে। অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব! সংকোচ জয় করে ইগর সেদিকে অগ্রসর হন।
দু-জনের চুম্বনে বাধা দিয়ে ইগর বলে ওঠেন, "ও মশাই, আপনি যে
বেমালুম আমায় ফেলে রেখে পালালেন!"
"আলাপ করিয়ে দিই - এ হল লুয়ালাফা, আমাদের নগরীর
অত্যন্ত সহৃদয় এক যুবক দমদাফার স্ত্রী। মেয়ে হিসেবে এর কোনো জবাব নেই। ওকে আপনার
কথা বলেছি। আজ ও আপনাকেই সময় দেবে। আমি নেহাৎ কেজো কথার ফাঁকে চুম্বনের লোভ
সামলাতে পারলাম না।" - জড়তাহীন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে, বিদায়ী
চুম্বন সেরে, হাত নেড়ে, হাঁটতে হাঁটতে
দূরে মিলিয়ে গেলেন আমুনাফা। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তখুনি ইগর তাকালেন রূপসীর চোখে।
কিন্তু এ তো কাম নয়, এ যে বেদনা! কিন্তু কেন! ইগর স্তম্ভিত
হয়ে গেলেন।
মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে ইগর এতদূর
আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন যে বহুক্ষণ খেয়ালই করেন নি, মেয়েটি তাকে দেশজ ভাষায় কিছু বলছে! রোদ উঠেছে,
শীত ভাব প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু জোরে বাতাস বইলে মৃদু শিহরণ খেলে
যায় শরীরে। অবশ্য নদীতীরের অভাবনীয় দৃশ্যাবলি যতটা শিহরণ-সঞ্চারী, তার পর আর কিছুই মালুম হয় না!
"তুমি কি আমায় কিছু বলতে চাইছ? এঁকে বোঝাতে পারবে?" - বলে সোনা রঙের বালির উপর
দাগ কাটে ইগর।
লুয়ালাফা যেন সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে। চোখে
মুখে স্বস্তির লক্ষণ ফুটে ওঠে তার। সে একটা গাছের শুকনো সরু ডাল তুলে নেয়। তারপর
একটা পাহাড় আঁকে। পাহাড়ের মাথায় ঝাঁটার কাঠির মতো অস্পষ্ট কতকগুলি মানুষ আঁকে। আর
একদম নীচে, পাহাড়ের তলায় একটা ঝাঁটার কাঠির
মতো মানুষের চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকার ছবি আঁকে। ইগর মোটামুটি অনুমান করে নেয়, মেয়েটি ইচ্ছামৃত্যুর কথাই বলতে চাইছে।
"হ্যাঁ জানি তো! এখানে এসেই শুনেছি।" -
নিশ্চিন্তে কথাগুলি বলেই খেয়াল হয় ইগরের, মেয়েটির পক্ষে তার
ভাষা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু মেয়েটির চোখের ভাষা সে পড়তে পারে। সেখানে তখনও উদ্বেগ
আর অশনি সংকেত। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে লক্ষ্য করে মেয়েটির ডানচোখ বেয়ে গড়িয়ে নামে
জলের ক্ষীণ ধারা, অন্য চোখটিও সজল হয়ে আছে। হতবুদ্ধি ইগর কী
ভেবে জড়িয়ে ধরে তাকে। অমনি তার গোটা দেহে অপার্থিব পুলক সঞ্চারিত হয়। পরস্ত্রীকে
স্পর্শ করার রোমাঞ্চে নয়। এ এক ভিন্নমাত্রার পুলক!
এমন
নবনীতসম অলৌকিক ত্বক, এমন
বর্তুল স্তন, এমন মসৃণ উরুদেশ ইগর ইতিপূর্বে কখনও স্পর্শ করে
নি। তার প্রতিটি রোমকূপে মুহূর্তে কামমদির কোলাহল জেগে ওঠে। সে সম্পূর্ণ
আত্মবিস্মৃত হয়। সহসা জোরে বাতাস বইতে থাকে। উইন্ডমিলের পাখার শব্দ কানে আসে
ইগরের। লুয়ালাফা মৃদু আপত্তি করলেও, ইগর তাকে আর পাত্তা দেয়
না। সে উপেক্ষা করে অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অপরিচিতা দয়াময়ীর সাবধানবাণী এবং সাদরে
গ্রহণ করে উপস্থিত বর্তমানকে। অচিরেই লুয়ালাফার শীৎকারধ্বনি মিলিত হয় তার নিজস্ব
শীৎকারে - ইগরের জীবনে তৈরি হয় অনাস্বাদিত এক স্বপ্নবৎ মুহূর্ত।
(৫)
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ প্রাসাদের উদ্যানে
ফিরেছিল ইগর। লুয়ালাফা মেয়েটির প্রতি সে তখন তিতিবিরক্ত। কী যে থেকে থেকে বলে, কিছুই তার মাথায় ঢোকে না। খালি হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে আর এমন ভঙ্গি করে, যার অর্থ হয় - 'এখনই এ স্থান ত্যাগ করো!' কেন রে বাবা! ইগর তো আর এখানে থাকতে আসে নি। চলেই তো যাবে সে।
আবার তার চোখ বাঁধা হবে। তাকে তোলা হবে কোনো স্পিড বোটে, তারপর
তাকে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া হবে তার স্বদেশে। তাহলে এই মেয়েটির এমন অধীরতা ও উন্মত্ততার
কারণ কী! সঙ্গমকালে এহেন চঞ্চলতা কার ভালো লাগে! দিব্যি চলছিল সব। সহসা আবার
ছটফটিয়ে উঠল। আবার সে কী বলতে চায়? আবার কী সব ছবি আঁকে।
একটা বড়ো সূর্য আঁকল একবার। আরেকবার একজনকে অনেকে টেনে নিয়ে চলেছে, এমন কিছু একটা আঁকল বালির উপর। কিন্তু সেও বুঝতে পারছে, ইগরের মাথায় সেভাবে কিছুই ঢুকছে না। সেই জন্যই বোধহয় সে অতিরিক্ত চঞ্চল
হয়ে উঠছিল। তার অস্থিরতার কারণ সম্পর্কে ইগরের প্রাথমিক যেটুকু কৌতূহল ছিল,
সে তো সেই কখন উধাও হয়েছে। এরপর তার অস্থিরতা ও অজানা ভাষায় ক্রমাগত
বকবক ইগরের বিরক্তি উৎপাদন করছিল। সে ধৈর্য হারিয়ে দু'বার
বকেওছে তসকে। তারপর আবার তার অবর্ণনীয় শরীরে সুখ খুঁজেছে, হারিয়ে
ফেলেছে নিজেকে।
কিন্তু বাগানে ঢুকেই যখন মেয়েটা অদ্ভুত সংযত হয়ে
গেল, তখন ইগরের সন্দেহ হল মেয়েটা
হয়তো এখানে বাস করে করে ক্লান্ত। এখন সে পালাবার পথ খুঁজছে, কিন্তু
স্বামীর কাছে সেটা গোপন রাখতে চায়। তাই ইগরকে বারবার বোঝাতে চাইছে। কিন্তু ইগর তো
ভবঘুরে, তার পক্ষে কারো দায়িত্ব নেওয়া অসম্ভব। তাও আবার একটি
সুন্দরী যুবতীর! সুতরাং বাগানে প্রবেশ করেই ইগর মেয়েটিকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
মেয়েটিও বোধহয় তার আশা ত্যাগ করেছিল! সেও কিছু না বলে, অন্যত্র
চলে গেল। দূরে একটি সুঠাম পুরুষ তাকে আলিঙ্গন করে কাছে টেনে নিল। ইগরের কপালে তখন
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, বেলা বাড়ছে আর সেই সঙ্গে রোদের তাত
ও বাড়ছে।
তারপর থেকে ইগর অবিরাম ঘুরে বেড়িয়েছে। মানুষের
জীবনযাপন তাকে আকৃষ্ট করে, আরো
আকৃষ্ট করে নানা দেশের ভালো ভালো খাবার। এখানকার সুরা এককথায় অনবদ্য! একরকম হলদেটে
পিঠা খেয়ে ইগর তো একেবারে মুগ্ধ।
সে ঘুরে ঘুরে দেখেছে, কেবলমাত্র শিশু ও বালক-বালিকারাই একপ্রকার টেক্সট্
বুক্ পড়ে। তাদের বয়স বাড়লেই বইপত্রের পাট চুকিয়ে সবাই হাতের কাজে লেগে যায়।
ক্ষুদ্র কুটির শিল্প যে এদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প, দেখলেই
বোঝা যায়। কারুকার্যে অপূর্ব সব বেতের জিনিসপত্র, মাদুর,
মোড়া, কাঠের চেয়ার, টেবিল,
চিরুনি, আলনা - এসব বানানোর কাজ অনেক জায়গাতেই
অল্পবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বানাচ্ছেও নিষ্ঠার সঙ্গে।
আপেল, ন্যাসপাতি, কমলালেবু, আঙুর ক্ষেতে অনেকেই দ্বিপ্রহরেও ব্যস্ত, বিশেষত
মেয়েরা। সকলেই সেই সাদা পোশাক পরে আছে। দেখে মনে হয় না, কারো
ভিন্ন কিছুতে কোনোরকম আগ্রহ আছে বলে! কাউকে ধূমপান বা, মাদক
সেবন করতে সে দেখে নি। কারো কোনো প্রকার আসক্তি আছে বলেও তার অন্তত মনে হয় নি।
নদীতীরে যে দেহজ মিলন সে সকাল থেকে দেখে এসেছে, তাও যেন একটা
সামাজিক অনুষ্ঠান মাত্রই ছিল। কেউ যে এজন্য খুব লালায়িত, তা
এখন আর মনে হচ্ছে না। সবাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। সকলেই তাঁর প্রতি হাসিমুখে তাকাচ্ছে,
কেউ কেউ মৃদু ঝুঁকে অভিবাদনও জানাচ্ছে। ইগরের বেশ ভালো লাগছে। বিকেল
ক্রমশ সন্ধ্যার দিকে এগোচ্ছে। জ্যাকেটের চেইনটা গলা অব্দি তুলে দেন ইগর।
এরা বিবাহ করে বটে, কিন্তু সেই বিবাহ কোনো প্রথা নয়, সেই অর্থে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানও হয় না। স্বামীগৃহে কন্যা চলে যায় না,
আবার তার উলটোটাও হয় না। বিবাহ একটা নামমাত্র স্বীকৃতি এখানে,
বিবাহের পরও সকলেই ব্যক্তিগত পরিসর ও যৌন জীবনে স্বাধীন। এ যেন -
কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা..." - ভাবতেই অদ্ভুত মজায় মজে যান ইগর। এরা
সংবাদপত্র পড়ে না, টেলিভিশন বা রেডিও দেখে না বা, শোনে না। জানেও না বোধহয় সে সব সম্পর্কে। ভাবা যায়, একটা
দেশ অলিম্পিকের নাম শোনে নি? তাদের পিরামিড নিয়ে কোনো আগ্রহ
নেই! ডিজনি ল্যান্ড খায় না, মাথায় দেয় - তারা জানে না! ভিডিও
গেমস্ খেলে না কেউ! ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সে সময় ব্যয় করে না! কী করে তাহলে! যৌথ
খামারে কাজ করে, প্রাণ খুলে দৌড়ায়, দলবদ্ধভাবে
নাচে-গায়-বাজনা বাজায়, নদীর ধারে মেতে ওঠে যৌনক্রীড়ায়!
একসাথে ঘুমায় বিশাল হলঘরে! তাদেরও নিজস্ব বাসভবন আছে, ছোটো
ছোটো ত্রিকোণ কটেজ, সব একই রকম; কিন্তু
অনেকেই একসাথে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ে। এ যেন অন্তহীন এক খেলা, যা
কখনও ফুরোবে না।
রাত নামে। একটা বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়
প্রাসাদের উদ্যানে। সেখানে কয়েকজন যুবক ঘন নীল আলখাল্লা পরে নাচতে নাচতে ঘুরতে
থাকে হাতে হাত ধরে, আগুনের
বৃত্তটাকে প্রদক্ষিণ করে। কয়েকটি মেয়ে বাঁশি বাজাতে থাকে। একজন বৃদ্ধা একটা চেলো
নিয়ে বাজাতে বসেন। দুই বৃদ্ধের হাতে বেহালা। একটি শিশু এদেরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে একটা
কত্তালের মতো চৌকো জিনিস নিয়ে বাজাতে থাকে। গান গাইতে শুরু করেন আমুনাফা, অমনি অনেকে গলা মেলায় তাতে। সেই মুহূর্তে অদ্ভুত রোমাঞ্চ বোধ করেন ইগর।
তাঁর বারবার মনে হয়, তিনি একটা স্বপ্ন দেখছেন; যেখানে কোনো হিংসা নেই, শঠতা নেই, মুখোশ নেই, এমন একটা সুখস্বপ্ন।
গান ও নাচ শেষ হতেই সোৎসাহে তোড়জোড় শুরু হয়
নৈশভোজনের। প্রাসাদের একটা বিশাল কক্ষে সব আলো জ্বলে ওঠে। ইতিপূর্বেই ইগর জেনেছেন, এরা টারবাইন ও উইন্ডমিলের সাহায্যে প্রগতির পথে
অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। আরো অনেক ক্ষেত্রেই এরা অগ্রগামী হতে পারতো। কিন্তু
জীবনযাত্রার এই নিশ্চিন্তি ও সমাজ-জীবনের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই তারা সে পথে পা
বাড়ায় নি। এরা বানিয়েছে নিজস্ব সেন্সর বোর্ড, উৎপাদন ও
উন্নয়নের কোন্ দিকগুলি তাদের জীবনের প্রতিষ্ঠিত ছক ভেঙে দেবে না, সে বিষয়ে তারা সবসময় নির্বাচন প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এ বিষয়ে তারা অত্যন্ত
সতর্ক।
ইগরকে নিজে এসে ডেকে নেন আমুনাফা। বস্তুত তিনি
ছাড়া অন্য কেউ ডাকলে, ইঙ্গিতের
সাহায্য নিতে হবে ভাষাগত তফাৎ-এর কারণে। আর একজন অতিথিকে আসন গ্রহণের সময় ইশারার
সাহায্য নেওয়াটা কুরুচিকর। আমুনাফা মানুষটি এখানকার বাকিদের মতোই সদাহাস্যময়,
কিন্তু লক্ষণীয় হল তিনি চিন্তাশীল। অন্যরা যেখানে মেতে আছে, তিনি ভাবছেন। ইগরকে তিনি আসন গ্রহণ করতে বললেন। কয়েকটা লম্বা টানা শতরঞ্জি
পাতা হয়েছে, সবাই মাটিতে একসাথে বসে খাবে। কিন্তু ইগর ও
আমুনাফা বসলেন ঠিক মধ্যিখানে। বাকিরা তাঁদের প্রায় গোল করে ঘিরে বসল। তাঁদের জন্য
একরকম মোলায়েম আর মোটা, উলের আসন পাতা ছিল। একটা প্রশস্ত
থালায় শূকরের ও গরুর মাংস, একরকম বিশেষ মশলা দেওয়া দুধ,
কয়েকরকম কাবাব, চারটে বড় বড় রুটি আর জেলির মতো
একরকম মিষ্টি রাখা হল তাঁর সামনে। আমুনাফা কিন্তু বাকিদের মতোই সাধারণ কাগজের
থালায় খাবার নিয়ে বসেছেন। সকলেই গল্প করতে করতে খাচ্ছে। কিন্তু ভিন্নরকম ব্যবস্থায়
ইগরের লজ্জা করছিল। আমুনাফা তাঁর পিঠে বাম হাত রেখে বললেন, "লজ্জা পাবেন না। খেতে শুরু করুন। আপনি আজ আমাদের অতিথি। এটুকু খাতির আপনার
প্রাপ্য। সব খাবার ঘরে বানানো। নিন শুরু করুন।"
"আচ্ছা আমি কি সকালেই ফিরে যাবো?"
"নিঃসন্দেহে। তবে আপনার লেখাটা কিন্তু লিখে
রাখবেন। লিখে আমাকেই দেবেন কারণ আপনার লেখা ওরা পড়তে পারবে না। আর সত্যি বলতে কী,
আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত জরুরী।"
"আমি খেয়ে উঠে, একটু
বিশ্রাম নিয়েই লিখতে বসব।"
"আপনি বিশ্রামকক্ষে আলাদা বাতি পাবেন। সেখানে
গিয়েই নিশ্চিন্তে লিখতে পারেন। ওখানেই আপনার শোয়ার ব্যবস্থা করেছি। লুয়ালাফা
আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে। আরেকটা কথা, আগামীকাল ভোরে আপনাকে
একটু কষ্ট দেবো।"
"কী ব্যাপার বলুন তো?"
"আসলে আমাদের উপাস্য দেবতা সূর্যদেব। আমাদের
কিছু নিবেদন থাকে তাঁর কাছে বছরের একটি বিশেষ দিনে। সেই বিশেষ দিনটিই আগামীকাল। 'জমথপা'-র নবনির্বাচিত সমস্ত মন্ত্রীরাও হাজির হবেন।
আপনার জন্য আমরা বিশেষ একটি বিদায় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছি। ফেয়ার ওয়েল বলতে
পারেন। কিন্তু সেজন্য একটু কষ্ট করে আপনাকে পাহাড়ে উঠতে হবে।"
"কোন্ পাহাড়?"
"ওই যে... ভলাতাফা পাহাড়ের চূড়ার কথা বলেছিলাম
না আপনাকে... সেখানেই।"
"কিন্তু সেখানে কেন?"
"ওই যে বললাম, বিদায়ী
অনুষ্ঠান!"
"ওহ্!" - এইটুকু বলেই চুপ মেরে যান ইগর।
তাঁর মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করছে।
(৬)
রাতে ইগরের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিল লুয়ালাফা। মজার
ব্যাপার, লেখার কাজ শেষ করে লুয়ালাফার
উরুসন্ধিতে যখন মাথা গুঁজেছেন ইগর, তখন সহসা মেয়েটার স্বামী
এসে ওদের সাথে যৌনাচারে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকার করে। কিন্তু ইগর এতটা মাখামাখি
অপছন্দ করেন। তাছাড়া তিনি সম্মানীয় অতিথি। 'তোমার বউ তো
তোমারই থাকছে রে বাবা! আমি তো আর তাকে নিয়ে পালাচ্ছি না!' - আপন
মনেই বলে উঠেছিলেন তিনি। তারপর সোজাসুজি নেতিবাচক অঙ্গভঙ্গি করে ওঠেন। লোকটির নাম
দমদাফা। তার দাদা নাকি নতুন একজন মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, সে
লোক আবার মৃৎশিল্পী! তবুও দমদাফা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গেই স্থানত্যাগ করে। কিন্তু
লুয়ালাফা কিছুটা বিমর্ষ হয়। ইগর নিজেও পরে আক্ষেপের সঙ্গে চিন্তা করেন, একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সুযোগ সম্ভবতঃ তিনি মিথ্যে সংকোচ করে নষ্ট
করলেন।
লিখেছেন তিনি মাত্র দু-পাতা, ওই রাত্রেই। প্রায় সবই প্রশংসা, এতখানি আতিথ্যের পরে বক্রোক্তি শোভা পায় না বুঝেও অবশ্য তিনি একটা
ব্যাপারে বেশ আপত্তি তুলেছেন। লিখেছেন, শিশু ও
বালক-বালিকাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকাটা বিস্ময়কর রকমের ভুল। কারণ ওখানে
তারা শৃঙ্খলা, সৌজন্য ও শিষ্টাচার শিখবে। গাছের তলায় বসে
পড়াশোনা হয় না। এও লিখেছেন, পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকাটা
দুর্ভাগ্যজনক। মূল্যায়ন না হলে শিক্ষার অর্থ কী? কেন পড়বে না
কিশোর-কিশোরীরা! ইতিহাস-ভূগোল-সাহিত্য-শিল্পচর্চার পাঠ্যপুস্তক নেই কেন? সেই সঙ্গে এ প্রশ্নও তুলেছেন, এমন চমৎকার নগর
পরিকল্পনা অথচ কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই কেন? ইগর সেই লেখা
ভোরবেলায় জমা দেবেন বলে, মাথার বালিশের নীচে রেখে দিয়েছিলেন।
কিন্তু লুয়ালাফা সেই কাগজ নিয়ে তৎক্ষণাৎ আমুনাফার হাতে দিয়ে এল। তারপর আমুনাফা
যেটা করলেন, তাও বিস্ময়কর! তিনি কাগজের লেখাটুকু পড়েই সেটিকে
উদ্যানের নিভে আসা অগ্নিকুণ্ডে বিসর্জন দিলেন। ইগরের ইচ্ছা ছিল, আমুনাফাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে লুয়ালাফার যে কী হয়!
সে পোশাক ছেড়ে ফেলে, দুই হাতে ইগরের মুখখানা টেনে নিয়ে চেপে
ধরে নিজের দুই বর্তুল স্তনের মধ্যিখানে। স্তনবৃন্তের চারিপাশে গোল করে জিহ্বার
অগ্রভাগ ঘষে দিতে দিতে ইগর আবার আত্মবিস্মৃত হন।
ভোরবেলা তাঁকে ডেকে তুলে দেওয়া হয়। মধু ও
মিষ্টান্ন খেতে বলা হয়। স্নান করানো হয় দুধ দিয়ে! ইগরের নিজেকে শিশু বলে মনে
হচ্ছিল! যেভাবে কয়েকজন মেয়ে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে স্নান করিয়ে দিল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে
যায়। কিন্তু মায়ের মুখটা আর তাঁর মনে পড়ে না! সে কতদিন হল, বাবা-মা
চলে গেছেন!
ইগরকে যখন স্নান শেষে নীলরঙের একটি আলখাল্লার
মতো উজ্জ্বল পোশাক পরানো হল, নিজেকে তখন তাঁর একজন সম্রাট বলেই মনে হল। পাতা আর ফুলের গোল রিং-এর মতো
তাজ পরানো হল তাঁর মাথায়। অন্তর্বস্ত্র বলে কিছুই নেই। দুই হাতের অনামিকায় পরানো
হল খড়ের আংটি। তারপরে সদলবলে আমুনাফা তাঁকে নিয়ে চললেন পর্বত চূড়ায়।
ভোরের কুয়াশায় সামনে দু-হাতের পরে আর কিছুই
স্পষ্ট নয়। কিন্তু উফাউফার নগরবাসী সম্ভবতঃ অনেক ভালো করে পথ দেখতে পাচ্ছিল। ইগর
কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যান। কিন্তু পথের শেষে কী আছে, তা জানার কৌতূহলও তাঁর কম নয়। উপরন্তু একটা নতুন
চিন্তা তাঁর মাথায় ঢুকেছে, লুয়ালাফার গর্ভে যদি তাঁর সন্তান
আসে, তিনি তার খবর পাবেন কি? অবশ্য
পেলেই বা কি! তাঁর পক্ষে অবৈধ সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ প্রায় অসম্ভব! তাই ওই
চিন্তাকে তিনি ঝেড়ে ফেলেন।
তারপর তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন সম্ভাব্য
অনুষ্ঠানের প্রকৃতি নিয়ে। উপরে ওঠার পর থেকেই বাতাসের বেগ বাড়ছে আর কানে আসছে
উইন্ডমিলের যান্ত্রিক শব্দ। ইগর উৎকর্ণ হয়ে শোনেন, গানের সুরে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু হয়েছে! একসময়
সকলের চলা শেষ হয়। ইগর অনুমানে বোঝেন এই পর্বতের চূড়া। কিন্তু কোনদিকে খাদ,
সেটা দৃশ্যমান নয়!
ইগরকে আবারো অবাক করে দিয়ে, আমুনাফা তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর হাতে একটি
দণ্ড। তাতে উপরিভাগে বিরাট একটি গোলাকার সূর্যদেবতার মুখ। পাকানো দুই চোখ, চারিপাশ থেকে সোনালি কাঁটার মতো কিছু বেরিয়েছে, যেটা
বোধহয় সূর্যরশ্মির প্রতীক। আমুনাফা সেই স্তম্ভটি একবার ইগরের বুকে আর একবার কপালে
ছুঁইয়ে দেন। তারপর কোথা থেকে লুয়ালাফা এসে সামনে দাঁড়ায় কুয়াশা ভেদ করে। তার দু'চোখ সজল, যেন সে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। কোনোরকম
ওজর-আপত্তির সুযোগ না দিয়ে সে ইগরের আলখাল্লার মতো নীল বস্ত্রটি মাথার উপর দিয়ে
গলিয়ে খুলে নেয়। তারপর সে পিছু হঠে যায়, কৌশলে চোখের জল গোপন
করে। উলুধ্বনির মতো একটা রব ওঠে আর একদল মেয়ে এসে ইগরের গোটা দেহে একরকম কাদার মতো
কিছু মাখিয়ে দেয় আর সমস্বরে কাঁদতে থাকে। বিহ্বল ইগর বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
শীতে তাঁর শরীর তখন কাঁপছে। আমুনাফা এবার এগিয়ে আসেন তাঁর সামনে, কুয়াশা মৃদু কমেছে, উদীয়মান সূর্যের একটা লালচে আভা
কুয়াশার চাদরের উপর একটা আশ্চর্য প্রলেপ তৈরি করেছে। অসামান্য নিসর্গ, কিন্তু ইগর যেন জড়বৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর
গোটা শরীর কাঁপছে। তিনি যেন অনুমান করতে পেরেছেন, তাঁর সাথে
কী হতে চলেছে! এই কম্পন কি শীতের? নাকি কোনো ভয়ঙ্কর অমঙ্গলের
আশঙ্কা করছেন তিনি!
"ধন্যবাদ বন্ধু। এই বীর্যহীনের সুদূর
দ্বীপভূমিতে এসে আপনি গর্ভবতী করলেন আমাদের এক কল্যাণীকে। আপনার ঋণ আমরা কোনোদিনও
ভুলতে পারব না। ঈশ্বরের কাছে কামনা করি, সূর্যলোকে আপনার
যাত্রা দ্রুত ও নির্ঝঞ্ঝাট হোক। আমাদের আতিথেয়তার ত্রুটি মার্জনা করবেন
বন্ধু।" - এ'কথা বলেই ইগরকে ওষ্ঠাধরে চুম্বন করলেন
আমুনাফা। ইগরের অজান্তেই দু'চোখ জলে ভরে যায়। তিনি কিছু বলতে
চান, কিন্তু তাঁর গলা যেন কেউ দু'হাত
দিয়ে টিপে ধরেছে! তিনি ব্যাকুল হয়ে খোঁজেন লুয়ালাফাকে। কিন্তু কুয়াশার
আস্তরণে কোথাও তাকে খুঁজে পান না। মেয়েরা আবার এগিয়ে আসে ইগরের দিকে। সেই মুহূর্তে
সূর্যদেব উদিত হন আর তাঁর প্রথম আলোয় আলোকিত হয় ইগরের মুখমণ্ডল। একটা উল্লাসের
ধ্বনি কানে আসে তাঁর। মেয়েদের হাতগুলি স্পর্শ করে ইগরের নগ্ন দেহ। এই শেষবার। ইগর প্রাণপণে
সেই স্পর্শসুখ গ্রহণ করেন। তারপর সেই সমবেত হাতগুলি মৃদু ঠেলা দেয় ইগরের শরীরে।
একটা গাছের ভাঙা ডালের মতো ইগরের দেহটা ঘুরপাক খেতে খেতে পিছন দিকে কোন্ অতলে নেমে
যায়। শিশিরের শব্দের মতো সেই পতন। ইগর জানেন না, একটি মেয়ে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে। পাথরের বুকে
লুটিয়ে পড়েছে সে।
লুয়ালাফা তখন সেই পর্বত শিখরে ভূলুন্ঠিত হয়ে
কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে,
তার হবু-সন্তানের পিতার আত্মার উদ্দেশ্যে।
0 মন্তব্যসমূহ