আনুবিসের দাঁত- একটি পাঠানুভব
সুবিৎ
আপাদমস্তক কবি । বাছবিচার নেই বড়ো একটা শব্দ ব্যবহারে , মেঠো বা আরবান ,এঁটো বা
মার্জিত , সব আত্মস্থ করে নেন তিনি । শুধু কি শব্দ ! দেশজ পুরাণ অথবা বিদেশী ,ইতিহাসের
হরেক উপাদান , বিজ্ঞান অথবা হালফিলের রাজনীতি , রাষ্ট্র এবং একলা মানুষের বিষাদ , টেথিস সাগর থেকে
মিলিন্দ সোমন মায় মেডুসা পর্যন্ত হুড়মুড়িয়ে তার লেখায় ঢুকে পড়ে ,ব্যক্তিগত ভাবে আমার গোটা বইটি পড়ে মনে হয়েছে আমি একটি মেলায় ঢুকে
পড়েছি, তার পাতায় পাতায় হরেক পশরা , বিচিত্র তার সম্ভার , যেমনটি মেলায় হয় , সব কিছুই ছুঁয়ে দেখতে দেখতে ,ক্রমাগত ইন্দ্রিয়ের
বিশদ বিপর্যয় হতে হতে একটা বিস্তারে চলে যাওয়া যায় ,কোনো
নির্দিষ্ট ,কেন্দ্র অভিমুখী ,একটানা
স্থায়ী সুর নয় , বইটি শেষ হলে মনে হয় একটি ভ্রমণ সম্পন্ন
হলো, দেশ কাল ইতিহাস পুরাণ বিজ্ঞান লোকাচার মথিত করে ,বিভিন্ন স্রোত
বহু দেশ ছুঁয়ে একটি মূল স্রোতে মিশে সমুদ্র হলে যেমন বোধ হয় ,তেমন অনুভূতি হয় গোটা বইটি পড়া শেষ হলে , অন্তর্মুখী
এবং বহির্মুখী , ভিড়ের মাঝে একা এবং কখনো নৈর্ব্যক্তিক হয়েও বহু স্পর্শ করে থাকে লেখাগুলি সেটি কবির
সমগ্রের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
মাধব কবিতাটিতে
যেমন
সমস্ত
লজ্জাবস্ত্র নিয়ে বসে আছেন তিনি গাছে।
জলে তোলপাড়
রাই সহচরী এখন ই চায় অঙ্গবস্ত্র,বেলা যায় ।
তাদের ঘরে ফিরে
সংসারে মন দিতে হবে।
এদিকে অজ্ঞাত
বাস শেষে পাণ্ডব এসেছেন সেই বৃক্ষের নীচে ।
সমস্ত অস্ত্র
রাখা আছে বৃক্ষ বাকলে।
তারা চায়
অস্ত্র । হস্তিনায় ফিরতে হবে দিন শেষে..
কী ফেরাবেন
মাধব !
বস্ত্র না
অস্ত্র ! মানুষের কোনটা আগে লাগে ঈশ্বর!
প্রায়ই এভাবে
বিভিন্ন কবিতায় মহাকাব্য বা পৌরাণিক ঘটনাপ্রবাহে জারিত করে পাঠককে মাইগ্রেট করান
তার ব্যক্তিগত দর্শনে,জীবনবোধের যে মূল বিড়ম্বনাগুলি অধিকাংশ সময় অমীমাংসিত সেগুলি রাখেন শেষে
,বিব্রত করেন পাঠককে ।
কখনো কবির
স্বপ্নের ভেতরে গভীর খাদ এসে অনিশ্চয়তার বোধ তৈরি করে , নিরাপত্তাহীনতার ছবি আঁকে , কখনো তিনি ই রাধানাথ শিকদার , টেথিসের সব জল শুষে
নিয়ে যে হিমালয়ের উত্থান ,তার অবনত ছায়া পরিমাপ করেন ,কথা এবং কাজের যতটুকু তফাত সেটুকু মাপার কথা বলা হয়ে থাকে কবিতার
গোড়াতেই ।
এক আমির মধ্যে
কি নেই অনেক আমি ? যে মানুষ তুমুল ভালবাসে আর ঘৃণা ঝরায় ,পা মাড়িয়ে
চলে যায় আর খিস্তি করে ,আপোষে যায় , অপমানে
ভেঙে যায় , নিস্পৃহ আপিসে যায় , এই
ভিন্ন ভিন্ন আমি যেমন একটি ই লোক ,আবার আমার মধ্যে বসত করে
কয়জনা সে কি আমি ই জানি !
আমি না জানলেও
কবি বিলক্ষণ জানেন ,তাই বলেন নীল ফুলদানি কবিতায়
একটি মানুষ
আসলে তো কয়েকটি লোক/
.......একই নীল
ফুলদানিতে তাদের আনন্দ দুঃখ পাশাপাশি ফুটে থাকে ....
মরে গেলে তার
বদনাম করতে নেই
মৃত মানুষ তারা
হয়ে যায় জান না বুঝি !
তারার কোন ও
দোষ গুণ অবস্থা পরিমাপ সংখ্যা
কিছুই থাকেনা
আর
কেবল আলো থাকে
।
মরা আলো ।
উপরে উল্লিখিত
"বদনাম" নামের কবিতাটিতে যে ভাষা ব্যবহার ,কবিতার যেমন চলন এবং মেজাজ তার সম্পূর্ণ
বিপরীতে থাকে ' দপ্তরে ' কবিতাটি ।
কমলাকান্ত উলু
বনে ঢুকিল এবং হারাইয়া গেল। সে শুনিয়াছে উলু বনে বাঘ থাকে,
সে বাঘ খুঁজিল
শৃগাল পাইল ।
তখন তাহার
শৃগালেই ব্যাঘ্র ভ্রম হইল
এবং তাহার রূপে
বিমোহিত হইয়া গেল
এক শৃগাল ডাকিল
হুক্কা হুয়া
দুই শৃগাল
ডাকিল হুক্কা হুয়া
সকল শৃগাল
ডাকিল হুক্কা হুয়া
কমলাকান্ত
জানিল বাঘ ডাকে হুক্কা হুয়া ।
ক্রোধ কবিতাটি
শুরু হয় এভাবে
রাজপথে ক্রোধ
দাঁড়িয়ে রয়েছে,
মাইল ফলকের মত
।
আমাদের সবার
খুব সামান্য অভিজ্ঞতা এটি ,প্রতিদিন ঘরে ,বাইরে , ব্যক্তি
অথবা রাষ্ট্র ক্রোধ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে আমাদের গ্রাস করবে বলেই । ঈর্ষার ক্রোধ ,প্রত্যাখ্যানের ক্রোধ, প্রত্যাশা না পূর্ণ হওয়ার ক্রোধ আমরা স্পর্শ করে ফেলি প্রায়শই ।পরিত্রাণ
কোথায় ! এই তুমুল ক্রোধ চরাচরে সামান্য কবি কি করবেন ...
'আজকাল
সারসের মত
আমি ক্রোধ
ডিঙিয়ে চলি '
কিন্তু
'জান কি
আমার বাড়ির
থেকে তোমার বাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে
ঠিক এক ক্রোধ
দূরে ।'
ঠিক ই পড়েছেন পাঠক,এক ক্রোশ নয় ,একেকটি ক্রোধ দূরত্বে আজ আমাদের বিপন্নযাপন ,এবং এই বিপন্নতা ছুঁয়ে ,উজ্জীবনের কথাও বলে কবিতাগুলি ,ক্রমশ সন্ধ্যে হয়ে আসে , আলো জ্বলে ওঠে জীবনের আনন্দমেলায় , কার্নিভালে, ফিরে আসার সময় দেখি কবিতাগুলি উজ্জ্বল পশরা হয়ে ফুটে উঠছে পাতায় পাতায়,জায়মান জার্নি গাঢ় হয়ে ওঠে ..........
আনুবিসের দাঁত
কবি সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক গীর্বাণ
বিনিময় মূল্য ১৮০/-
যোগাযোগ: ৯৯১৬০৯৪৭২০
0 মন্তব্যসমূহ