রোদ্দুর
রেলওয়ে
প্লাটফর্মের উল্টো দিকের রোদে দাঁড়িয়ে বিজয়বাবু শুনলেন, ট্রেন আসছে। দৌড়ে গিয়ে
টিকিট কিনে, গাড়ি পাবো কি পাবে কি না, এর
উত্তর নিয়ে মতবিরোধ আছে। তবো দৌঁড় লাগালেন।
টিকিটের লাইন, লাইন এগোচ্ছে দ্রুত, তবুও খবর হওয়া গাড়ির সঙ্গে
পাল্লা দিতে পারে না। হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছেন কাউন্টারে, তখন
গাড়ির হুইসেল। প্লাটফর্মের মাথায় গাড়ি। হাতে টিকিট কিন্তু চড়বে কারা ? হাতে ছোট ছেলের হাত, যাকে নিয়ে দৌঁড়ে পার
হয়েছিলেন রেল লাইন। কিন্তু পরিবারের বাকি অর্ধেক অর্থাৎ মেয়ে ও স্ত্রী, তারা এখনও লাইনের ওপাড়ে। অসহায় ভাবে হাতে টিকিট নিয়ে দেখলেন দম্পতির
মধ্য দিয়ে সংযত হাঁপের শব্দে চলে গেল বারো বগির গাড়ি।
স্ত্রী কিছুটা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবতী। হাতকাটা ব্লাউজ টান টান। ঠোঁটে লিপস্টিক উজ্জ্বল ও বেসামাল ঘামে। মেয়েটি উদ্ভিন্ন কিন্তু স্নিগ্ধ। হটপ্যান্ট, টপ, হাইহিলে কিশোরী। কানে মোবাইলের হেডফোন।
ছেলেটি অসংযত, দুর্দান্ত
বালক। এই দুই নাবালকের প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব উপভোগ করেন বাবা, আর মায়ের সর্বক্ষণের জ্বালাও সেই উপভোগ।
ছেলেটি
শুধু বললো--বাবা একটা কোল্ডড্রিংকস খাবো।
যে সিমেন্টের বেদির উপরে ওরা বসেছেন, তার নিচে সদ্য ও পুরনো খাওয়া অনেক চায়ের প্লাস্টিক কাপ গড়াগড়ি দিচ্ছে। একপাশে পানের পিক, গুটকার পিকের ছররা । মুড়ি তেলে ভাজার ঠোঙা, বাদামের প্লাস্টিক প্যাকেট ।
এর মধ্যেই আর একজন লোক এসে একটু ঠেকিয়ে বসেই একটা বিড়ি ধরালো। ডান
দিকে একবার তাকিয়ে ধোঁয়াটা উপর দিকে ছাড়তে লাগলো। বিড়ি শেষ হলে গলা খাকারি দিয়ে, জোরে কেশে নিয়ে, একবার থুতুর
কামান ছুড়লো, যাতে প্লাটফর্মের নীচে পড়ে। না বসে ছোড়ায়
ততটা জোরে ছিলনা । প্লাটফর্মের উপরেই পড়ল। পরে কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ, পিঠ, ও গলার গাম মুছে থামল। অন্যরা তার সঙ্গে বেচা
কেনা লাভ লোকসান নিয়ে গল্প জুড়ে দিল।
লোকটির থুথু ফেলা, ঘর্মাক্ত গামছা ঘুরানো, বিড়ির
ধোঁয়ায় বিরক্ত হয়ে বিজয় বাবু বললেন,
আরে ভাই আমরাওতো রেলের যাত্রী। টিকিট কেটেছি। এমন করলে কি মানুষ বসতে পারে ? এটা ভদ্রলোকের আচরণ ? লোকটি একটু সরে গেল। সহযাত্রীকে সম্মান জানিয়ে বিড়ির ধোঁয়া উল্টো দিকে ছাড়তে লাগল। কিন্তু এরপরেই আশেপাশের সমস্ত লোকের মনের ভাব পাল্টে গেল। মুখে ভাঁজ এবং ফিসফিস ধরা পড়ল। যে মহিলা ওদের সঙ্গে ছিল, তারা বিজয়বাবুর মেয়েকে, স্ত্রীকে এমন তীব্র চোখে দেখছিল, যে মনে হচ্ছে অতীতকাল হলে ওরা ভষ্ম হয়ে যেতেন। তাদের পোষাক সাজ-গোছ একেবারেই মানতে পারছে না।
যে লোকগুলো আগে থেকেই বেঞ্চে বসেছিল তারা স্টেশনের পাশের গোরাবাজারের সব্জী বিক্রি করেন, চট পেতে বসে। খুব সকালে আসেন, দুটো- আড়াইটা পর্যন্ত থাকেন। তারপর মাঝের হাট বনগা গাড়ি ধরে বাড়ি ফেরেন। তারা পাইকারি বাজারের দাম, এবং ‘সবজি বেচে আর সুখ নাই’ রকমের কথা বলছিলেন। কিন্তু বিজয় বাবুর বিরক্তি প্রকাশের পরেই যেন বৈশাখের রোদ আরো তীব্র হয়ে উঠছে। পা গরম করে দিচ্ছে।
মেয়েটির হটপ্যান্ট এবং টপ দেখে অনেকেই প্রথমে অনেকেই ভ্রু
কোচকাচ্ছিলেন। পাশের অন্যান্য বেঞ্চে ভিড় করে বসা লোকেরাও তাদের মধ্যে আছে।
অল্পবয়েসী কয়েকটি ছেলেও কেন এগিয়ে এসেছে। তাঁদের চোখে মুগ্ধতা।
এতসময় যারা দেশের এই হাল নিয়ে, মেয়েদের নির্লজ্জতায় নাক কোঁচকানো গুমোট করে রেখেছিল তাদের মুখ যেন হঠাৎ করেই ফিসফিস পেয়ে গেল।
পোষাক যথেষ্ট ভদ্র মনে হচ্ছে না। মহিলার বগল দেখা যাচ্ছে। গলায় আবার
ট্যাটু করেছে। ট্যাটুতে তিনটি শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। হট প্যান্ট হাঁটুর উপরে, টপ, প্যান্টের সঙ্গে সম্পর্ক
ছাড়িয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে হাত নাড়ালেই। তার উপর সে বেশ লম্বা । বারে বারে তাদের
গায়ে যেন টর্চের তীব্র আলো ফেলছে সাধারণ মানুষগুলি। সে আলো যেন মাছ কোপানো ঝুপি ।
বিকাল
তিনটে-সাড়ে তিনটের হেলানো রোদ তখন তীব্র। এই রোদ চোখে পড়লে কপালে ব্যথা হয়।
অনেক
ঠেলা ঠেলিতেও উঠছেনা দেখে হালকা মারধর শুরু হল। তাঁদের ঠেলাঠেলিতে বিজয়বাবুর গায়েও একটু ঘষা লাগলে কিছু বললেন না, বরং সঙ্কুচিত হয়ে থাকার চেষ্টা করলেন।
আবার ডাকাডাকি শুরু হল। ট্রেন আসছে। ওঠাতেই হবে। একসময় মহিলাটি উঠে
গিয়ে পিছনের এক পান বিড়ির দোকানের সামনে রাখা বালতি থেকে একমগ জল নিয়ে এসে ঢেলে দিলো ঘুমন্ত ব্যক্তির মাথায়। ঘুমভাঙানোর এর
থেকে আর তীব্র উপায় কী হতে পারে! ঘুমানো লোকটাও উঠে পড়ল ধড়মড় করে, এবং সারা গায়ের ঝারতে লাগল। জল ছিটকে পড়ল চার দিকে।
--
কী সব ছোটোলোকের মত কাজ! এটা কী মগের মুল্লুক ? যা ইচ্ছা
তাই করছো।
-- আপনার গায়ে লেগেছে ? একফোটাও লেগেছে ?
আরে জায়গাটা তো নোংরা হচ্ছে। আমার গায়ে লাগতেও তো
পারতো।
– লাগেনি
তো। বেশি ভদ্রলোকি দেখাবেন না।
আর আমরা ছোটলোকই।
ওদের সঙ্গের মেয়েটিও তার সঙ্গে যোগ দিল।
– আমরা গতর খাটিয়ে খাই। গতর দেখিয়ে
বেড়াই না। – তার চোখের দৃষ্টি মা ও মেয়ের যেন পুড়িয়ে দেবে।
পাশাপাশি থাকা দোকানগুলির সঙ্গে ওদেরই সম্পর্ক ভালো। তাই তাঁরাও বেড়িয়ে এসে ওদের পক্ষ নিল। নানা মন্তব্য উড়ে এলো,
-- অত
তুলতুলে হলে ট্যাক্সিতে যেতে পারেন না !
আর একজন বলল, না না, হেলিকপ্টার।
--
এরা না থাকলে খাওয়া পরা জুটতো ? এরা চাষি।
দেশে মেরুডন্ড !
নিত্য যাত্রীরা বিজয় বাবুর এই ঔদ্ধত্যে ভারী বিরক্ত। তারা বলল-- ডেলি প্যাসেঞ্জারর না হলে এরা
এসব বুঝবে না। মনে মনে এখনও জমিদার।
(যদিও তার পূর্বতন তিন পুরুষের হাতে
মাত্র তিন কাঠার বাড়ি ছিল, তাও এখন দুই ভাগ। )
ওরা একই ট্রেনে উঠল। পশ্চিমা রোদ ট্রেনের গায়ে লেগে থেকেই এগিয়ে চলছে।
নীহার জয়ধর
0 মন্তব্যসমূহ