সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মৌসুমী চৌধুরী:গল্প:হিয়ার মাঝে

 


হিয়ার মাঝে

              ভীড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেও একা হয়ে যেত নন্দিনী। আর তখনই আসত সে,  বিছিয়ে দিত ছায়া, আলতো করে ধরত হাত! যেন গাছ হয়ে উঠত সে। ফিসফিসিয়ে বলত,
--"নন্দু, শরীর ঠিক আছে তো আজ?"
এক লহমায় জ্বর কমে যেত নন্দিনীর, রোগ -জ্বালা যেত যোজন দূরে! সুরেলা রিংটোনে বেজে উঠত, "জিন্দেগি অঔর কুছ ভি নেহী/ তেরি মেরি কাহানী হ্যায়"... অস্তিত্ব নাড়িয়ে উঠত ফুরফুরে বাতাস!
-- " নাহ্! এ সব ঠিক নয়, সুগত। এ অবৈধ, এ পাপ! তুমি আমায় আর মেসেজ কর না, প্লিজ! আমি আর তুমি দু'জনেই তো বিবাহিত, সংসারী! ওরা জানলে কষ্ট পবে।"
-- "ভালোবাসা অবৈধ হয় না, নন্দু। অবৈধ তো হয় সম্পর্ক। তোমার আর আমার মধ্যে তো কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তো পরস্পরের  দু'হাজার মাইল দূরত্বে বসে আছি। এটুকু আশ্রয়ও দেবে না আমায়?"
--" আশ্রয়?  আমি!!! জীবনটা তো ভার্চুয়াল নয়, সুগত। আমি পরস্ত্রী... ছিঃ!"
-- "নন্দু, প্লিজ..."
   তারপর... তারপর...তারপর তো প্রতিদিনই  ভালোবাসার উদযাপন চলতে লাগল সুগত আর নন্দিনীর... "তোমায় সাজাব যতনে কুসুম রতনে"...
   নরম আশ্রয়-আঁচল ছড়িয়ে ভালোবাসাকে আগলে রাখতে লাগল নন্দিনী। 
-- "এত সিগারেট খেওনা, প্লিইজ।...ঠাণ্ডা পড়েছে, তোমার হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে, না? শোন, একটা কটনের কাপড়ে কিছুটা বালি নিয়ে তাওয়ায় গরম করে হাঁটুতে সেঁক দিও তো। অনেক আরাম পাবে, দেখ।"
-- " জো হুকুম, ম্যাডাম। কিন্তু আজ রাতেও তোমার জ্বর এসেছে, না নন্দু? নতুন ডিপিটা-তে দেখছিলাম চোখের তলায় বেশ  কালি পড়েছে তোমার!"
-- "ও কিছু নয়, ঠিক হয়ে যাবে। সামনে ছেলের বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা, একটু চাপ যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমিও রাত জাগছি তো। ওর বাবা তো কিছুই দেখে না ওর পড়াশোনার।"

     —" শোন, তোমার পাঠানো বইটা আজকের ডাকে পেলাম। কতবার যে বুকে চেপে ধরে তোমার অনুষঙ্গের সুগন্ধি বুকে ভরে নিলাম, কি বলব! থ্যাংস্ সুগত...।"

—"তোমার হাতে বোনা ঘন নীল রঙের
পুলওভারটা আজ অফিসের ঠিকানায় এসে পৌঁছেছে। দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার। অসাধারণ দেখতে, খুব গরমও। এ বছর হাজারিবাগে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে, জানো? আমি ওই পুলওভারটাই ব্যবহার করছি। আর মনেহচ্ছে তুমি যেন উষ্ণতায় জড়িয়ে আছ আমায় সবসময়...।"

— "ঠিক আছে  ঠিক আছে... অত বাড়িয়ে বলতে হবে না। আমার কথা তুমি ভারী শোন!
বললাম গতকালের লেট নাইট পার্টিটাতে যেও না। কিন্তু তুমি সেই গিয়েই ছাড়লে ...!"
— " সে তো প্রলয় কতদিন পর দেশে ফিরেছে। বার বার খুব করে রিকোয়েস্ট করল যেতে। তাই যেতে বাধ্য হলাম। রাগ কোরো না,
নন্দু। সরি...সরি... আর কক্ষনও এমন হবে না,
প্রিয় সখী আমার।"

   
  তারপর...তারপর...তারপরে ভালোবাসার শরীরে, বন্ধুতার গায়ে হঠাৎ কবে থেকে যেন উঠে এল বিষাক্ত ময়াল সাপ! কে জানে কেন,  জানে না নন্দিনী! হয়ত অকারণেই...
-- "আজকাল কি খুব ব্যস্ত থাকছ, সুগত? আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ই তো হয় না তোমার!"
-- "হ্যাঁ, একটু ব্যস্ত",  সংক্ষেপে উত্তর আসে।
      সারাটাদিন বিষন্ন বাতাস গুমড়ে মরে নন্দিনীর বুকে। দূরের পলাশ-শিমূল বনে আগুন জ্বেলে বসন্ত আসে! কোকিলের একটানা পাগলপারা ডাক পুড়িয়ে ছাই করে দেয় তাকে ! ঘুঘু-ডাকা উদাস দুপুরে দক্ষিণের বারান্দায় কবিতার খাতা উপচে পড়ে অথৈ নোনাজলে। নৈঃশব্দ চুরচুর করে দেয় বুক...
-- "কাল রাত দেড়টা পর্যন্ত জেগে অন-লাইন ছিলে! কি করছিলে, সুগত ? শরীর খারাপ করবে যে !"
-- "আহ্ নন্দিনী! দিনদিন তুমি বড্ড সন্দেহ- প্রবণ হয়ে উঠেছ!"
-- "ওহ্! আমি আজকাল বুঝি নন্দু থেকে নন্দিনী হয়ে উঠেছি তোমার কাছে ?"
-- "এত ন্যাগিং কর না তো। রাখ এখন, একটু ব্যস্ত আছি।"
      দিন যায়, রাত কাটে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নন্দিনী। স্বামীর প্রমোশান, ছেলে স্কুল ডিঙিয়ে ১০+২ তে সায়েন্স স্ট্রীমে ভর্তি হয়েছে। দেওরের বিয়ে, শাশুড়ির বাতের ব্যথা...দৌড়ে চলে নন্দিনী...হাসি মুখে সামলায় সবটা! শুধু স্নানঘরে শাওয়ারের নিচে ভেসে যায় বাঁধভাঙা নোনা ঢেউয়ে...কেউ যেন কানের কাছে ফিস- ফিসিয়ে বলে,
--"নন্দু, তোমাকে একবার বাতাসের পোষাকে দেখতে খুব মন চায়।"...ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে নন্দিনী।
        বাতাসে পা টিপে টিপে আসে হেমন্ত। ভোরের গায়ে হালকা কুয়াশার সর। রং বদলায় গাছের পাতারা। হলদে রঙ মেখে পাতাঝরার মনখারাপিয়া গান গায় দূরের পলাশ, শিমূলের বন।
        তীব্র হ্যালোজেন-আলোর বন্যায় চোখ ভেসে যায় সুগতর। সন্ধ্যাতারাটির স্নিগ্ধ আলো আর চোখে পড়ে না। ক্রেয়ন লিপস্টিকের তীব্র মোহিনী যাদুকরী আবেদনে লেখক সুগত সেন ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলে আটপৌরে আঁচলের উষ্ণ  আশ্রয়খানা। হঠাৎ একদিন নন্দিনীর এক বান্ধবী তাকে মেসেজের স্ক্রীনশটটি দেখায়। সুগত লিখেছে,
— "ওহ্ শীট! নন্দিনী? আর বোলো না গো, বড্ড গায়ে পড়া মেয়ে!  সেক্স-স্টার্ভড্-মিডলএজড্-উইম্যান... এখনও আনফ্রেন্ড করি নি, তবে করে দেব।"
            
স্তব্ধতা ছুঁয়ে দেয় নন্দিনীর বুকের হাড়-পাঁজর! বুকের ভিতর কি যেন একটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে। সেই টুকরো টাকরাগুলোকে প্রাণপনে জরো করতে করতে একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে নন্দিনীর ঠোঁটের কোণায়!  তারপর...তারপর...তারপরেও...পরম আশ্লেষে ভালোবাসা শব্দটিকে, তার সঙ্গে লেপ্টে থাকা বোধটুকুকে বুকের দূর্গে আগলে রাখে নন্দিনী।  আদরে আদরে 'ভালোবাসা'কে সাজায় ফুলের গয়নায়। কারণ তীব্র পাপবোধ পেরিয়ে নন্দিনী একদিন জেনেছিল ভালোবাসা অবৈধ হয় না। নন্দিনী জেনেছে ভালোবাসা তার অহংকার, তার পূজা। একদিন ভালোবাসা তার কাছে নৈর্বক্তিক হয়ে ওঠে। তার নিজস্ব, নিভৃত পুজোর ঘরে কিছু সুর বার বার বেজে ওঠে হাওয়ায় হাওয়ায়,
--" আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি। /তোমায় দেখতে আমি পাই নি।..."


 


    মৌসুমী চৌধুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. টুপ্ টুপ্ করে শিশির ঝরে পড়ে,
    গাছের পাতায় মৃদু বাতাসের দোল।
    মন কেমনের বাঁশি বাজে দূরে,
    "হিয়ার মাঝে"উন্মনা বিহবল।

    উত্তরমুছুন