ডাল দিয়ে ভাত মাখতে যাবে
এমন সময় আরতি বলে উঠল, 'আমার জন্য
একটু পটল ভেজেছি। তোমায় কি দেব? তুমি
তো খেতে চাওনা তাই আগের থেকে দেইনি।'
থালার ভাত ডালের মধ্যে বিচলিত সুব্রতর আঙুলগুলো হঠাৎ থেমে গেল। তবে কয়েক লহমার জন্য।তারপর তারা দ্বিগুন বেগে কর্মপালনে ব্যস্ত হল। আরতির প্রস্তাবে এইটুকুই তার প্রতিক্রিয়া।
অন্যদিন হলে সুব্রতকে ও
পটল ভাজা খাওয়ার উপরোধ করতো না। দুপুরের
নিস্তব্ধ ঘরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা ওর বুকের উপর চেপে বসছিল। সেটা কাটাতেই বাক্য প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
আরতি আবার জিজ্ঞেস করে, 'খাবে কি? '
সুব্রত বিরক্ত হল। ভাবলো বারবার ভাজা খাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আরতি হয়তো ওর মান
ভাঙানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আরতি আজ যা করেছে তাতে এত সহজে ও
বৌকে ক্ষমা করবে না। চড়া সুরে জবাব দিল, 'না।'
আবার সব চুপচাপ।
আরতি শান্ত দৃষ্টিতে বসে বসে বরের খাওয়া দেখে যায়। বরের রাগ রাগ মুখটা দেখতে ওর বেশ লাগছিল। ওরও তো অনেক কিছুতে প্রচুর রাগ হয়। কিন্তু সেই রাগের তো কেউ তোয়াক্কাই করেনা ।
সুব্রতর ডাল দিয়ে ভাত
খাওয়া শেষ।
সে এবার থালার পাশের বাটি
দুটির দিকে তাকিয়েছে। একটাতে চিংড়ির
চচ্চড়ি আর আরেকটাতে ট্যাংরার ঝাল।
সুব্রতর বাড়ি যশোররোড লাগোয়া হাবড়া অঞ্চলে। বড় রাস্তার পাশে বাড়ির উঠোনের এককোণে ওর বহুদিনের চায়ের দোকান। আয় বেশ ভালোই। একরকম ভালোই দিন কাটছিল এদের। তবে সংসারে হঠাৎ দাপিয়ে এল এক ঘোরালো দুর্যোগ।
অবিবেচক সুব্রত ওর মেয়ের
বিয়ে ঠিক করে ফেলল এক খদ্দেরের ছেলের সঙ্গে। তবে তিনি চায়ের খদ্দের ছিলেন না। এক রবিবার দেশি
মুরগি কিনতে এসেছিলেন সুব্রতর কাছে।
চায়ের কারবারের পাশাপাশি
ওকে একদিন মাংসের কারবারেও মন দিতে হয়। ওদের বাড়িতে হাঁস মুরগি পোষা শুরু হয় এই পরিবারে আরতির গৃহবধূ
হয়ে আসার পর। ও ছোটবেলা থেকেই হাঁস মুরগি পুষে আসছে। শ্বশুর বাড়িতেও সেই অভ্যাস চালু করে। মেয়ে
একটু বড় হলে সেও মায়ের শখে ভাগ বসায়। রতনের এই সব বালাই নেই। সে কম্পিউটার বা অত্যাধুনিক গেজেট নিয়েই মেতে থাকতো।
সুব্রত হাঁস মুরগির কোনো
খোঁজ রাখতো না। কিন্তু একদিন
ওদের দিকে নজর দিতে বাধ্য হল। একজন চা খেতে খেতে হঠাৎ বলে
উঠেছিল, 'আমায় ওই তাগড়াই মোরগটা বিক্রি করবে? কত দাম লাগবে বলো । '
সুব্রত বলে, 'ওর মালিক আমি না দাদা। আমার বৌ পোষে। '
সেই খদ্দের তখন বলেছিল, 'তাহলে তোমার বৌয়ের কাছ থেকে দাম টা শুনে আসো।'
প্রথমদিন মেনে নিলেও আরতি বাধা দিতে বাধ্য হল যখন দেখলো বেশি লাভের লোভে বর মাংসের কারবারেও ঢুকে পড়ছে। সুব্রত চায়ের দোকানের এককোণে মাংস কাটার ব্যবস্থাও করে ফেলে। ব্যবসার লাভের মোহে সুব্রত একটা বড় লোকসান নিয়ে ভাবতে ভুলে গেলো। বৌয়ের প্রিয় প্রাণীগুলোকে শুধুমাত্র টাকার জন্য নিকেশ করা যে বৌয়ের মনেই আঘাত দেওয়া সেটা ও মোটা বুদ্ধিতে বুঝতে পারলো না।দৈনন্দিন খিটখিটানি থেকে একটা সময় দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো। ফলে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলবার আগেও বৌয়ের সঙ্গে আলোচনা করার মানসিকতা ওর রইল না। গোয়ারের মতো কথা দিয়ে ফেলে পাত্রপক্ষকে।
ছেলের বাবা মনিকার রূপে মুগ্ধ হয়ে জানিয়ে দেন ওদের কোনো দাবি দাওয়া নেই। এমনকি খাট আলমারি দেওয়ার ভদ্রতাটুকু না করলেও চলবে। ছেলের ঘরে নাকি বৌ ছাড়া আর কিছুর অভাব নেই।এই লোভনীয় প্রস্তাব হাতছাড়া করতে চায়না সুব্রত ।
মাকে জড়িয়ে মনিকা অনেক কাঁদে। কিন্তু আরতি কোনো ভরসা দিতে পারেনা। ও সেইসময় শ্বশুর শাশুড়ির কথা খুব ভেবেছিল। ওর মনে হয়েছিল ওঁরা বেঁচে থাকলে সুব্রতকে বাধা দিতে পারতেন।
মনিকা ছাত্রী হিসাবে ভালো
ছিল। কিন্তু পড়াশোনাতে ইতি টেনে ওকে বিয়ের
পিঁড়িতে বসতে হল। বিয়ের পর বোঝা গেলো পাত্র হিসাবে ছেলেটি
একেবারে অপদার্থ। এখনো বাপের পয়সায় ফুটানি মারে।এমনকি রাতে মদ গিলে এসে সগর্বে বৌও পিটায় ।
ছেলেটা একেবারে অকুতোভয়। যেকোনো ভোটে ও ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম শক্তিধর প্রচারযন্ত্র। উঠতি নেতারাও ওকে তেলিয়ে চলে। কারণ হাওয়া
বুঝে দল বদল করার ওর রেকর্ড আছে। নীতি বিচার করে ও নেতা
নির্বাচন করেনা, বরং উল্টোটাই ঘটে। নেতাদের
সুবিধার্থে পেশীশক্তি বিনিয়োগ করে ও পেয়ে যায় লাগামছাড়া রোয়াববাজি করার স্বাধীনতা। আরতি যখন মেয়ের কাছ থেকে সব জানতে পারল তখন আর নিজেকে শান্ত রাখতে
পারেনা। চেঁচিয়ে সুব্রতকে বলে ওঠে, 'প্রতিদিন
হাঁস মুরগির গলা কাটতে কাটতে দয়া মায়া আর কিছু নেই। নিজের
মেয়েটাকেও কসাইয়ের হাতে তুলে দিলে। একটু খোঁজখবর নেওয়ারও
প্রয়োজন বোধ করলে না। '
তারপর থেকেই মাংসের
কারবার বন্ধ করবার জন্য আরতি উঠে পড়ে লাগে ।
অনেকদিন সে ঝগড়া বাধিয়েছে। ঝাঁজ নিয়ে সুব্রতকে বলেছে, 'টাকার অভাব হলে আম বাগানের জমিটা বিক্রি করে দাও। কিন্তু
আর অবলা প্রাণীদের রক্ত ঝরাতে পারবেনা। '
চিরশান্ত আরতির মধ্যে
এতটা তেজের সঞ্চার কীভাবে হল সুব্রত বুঝেই পায় না। আরতির গভীরে লাগা একটা চোট থেকেই যে ওর আচরণে একটা বিকার
এসেছে সেটা বুঝতে পারেনা সুব্রত?
এর পরেও ও ব্যবসা চালিয়ে
যায়। হাট থেকে আরো হাঁস মুরগি কিনে এনে
ব্যবসার কলেবর বাড়িয়ে তোলে। ও আন্দাজ করতে পারেনা আরতি ওই
অবলা প্রাণীদের মধ্যে নিজের মেয়ের অসহায়তাকে খুঁজে পায়।
পরিস্থিতি আরো জটিল হল গতকাল সন্ধেবেলা।
দোকান ছেড়ে টিফিন করতে এসে সুব্রত আমতা আমতা করে বলে, 'ডাক্তার কল্যাণ সেনকে চেনো তো।এর মধ্যে একদিন সকালে এসে মতিকে দেখে নাকি খুব পছন্দ
হয়েছে। তখন কিছু বলেননি। এইমাত্র এসে বলে গেলেন। কালো রঙের চীনা হাঁস বলতেই
বুঝে গেছি। বলেছেন যত দাম চাই, তাইই
দেবেন।একশো টাকা অ্যাডভান্স করে দিয়েও গেলেন। কাল সকালে আসবেন নিতে। কী করি !একে সম্মানীয় মানুষ।'
মতি নামটি আরতিই আদর করে
রেখেছিল। ওর বড় পছন্দের হাঁস সেটি। তাই সুব্রতর এত সংকোচ।কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে
আরতি চুপ করে রইল। সুব্রত বৌয়ের মৌনভাবকে সম্মতির লক্ষণ
ভেবে নিয়ে নিশ্চিন্তে দোকানে ফিরে যায়।
আজ সকালে যথারীতি ডাক্তারবাবু হাঁস কিনতে হাজির হন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সারা বাড়িতে চীনা হাঁসটির কোনো হদিস পাওয়া যায়না। অ্যাডভান্স নিয়ে এইভাবে শাঁসালো খদ্দেরকে অসন্তুষ্ট করতে বড় খারাপ লাগে তার ও বুঝতে পারে আরতিই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে হাঁসটিকে। সেই থেকে সুব্রতর রাগ বৌয়ের উপর।
এর মধ্যে সুব্রতর চিংড়ির
চচ্চড়ি খাওয়া শেষ হয়েছে। ট্যাংরার
বাটিটার দিকে হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় আরতি আবার কথা বলল, 'সব
ভাত মাছ দিয়ে মাখিও না। মাংস আছে । '
সকালে আরতিই বাজারে যায়। সুব্রত সময় পায় না।
কথাটা শুনে রাগত স্বরে
সুব্রত বলল, 'দুই রকম মাছ
আবার মাংস !'
'মাংস আমি কিনিনি। '
'তুমি কেনোনি,
তাহলে মাংস এল কোথা থেকে? '
'রঞ্জনের বৌ
দিয়েছে । '
রঞ্জন সুব্রতর প্রতিবেশী। পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো হলেও রান্নার বাটি চালাচালি হবার মতো
সংস্কৃতি এদের মধ্যে ছিল না। তাই হতবাক সুব্রত জানতে চাইল,
'হঠাৎ মাংস এল কেন ওই বাড়ি থেকে? '
'আমার দিক থেকেও
হঠাৎ একটা কাজ হল বলেই । '
'তুমি আবার হঠাৎ
করে কী করলে? '
রঞ্জন হাঁসের মাংস
ভালোবাসে। অনেকদিন আগে আমার কাছ থেকে একটা
কিনতে চেয়েছিল। তখন দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম
পাশের বাড়ির সাথে ব্যবসা চলে না। দিতে হলে এমনি দেওয়া উচিত।এতদিন দিতে পারিনি। কাল সন্ধ্যায় মতিকে দিয়ে
আসি। '
সুব্রত খাওয়া ভুলে আরতির
দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের বৌকেই
যেন চিনতে পারছে না। বলল, 'এই বেলা
মায়া হল না? আমি বিক্রি করলেই যত দোষ !'
'আমি বিক্রি
করিনি। এমনিই দিয়েছি। বলেছিলাম একটু
রান্না মাংস দিতে। রতন আর তুমি ভালো খাও।আর মতিকে অন্যের হাতে মরতেও হয়নি। আমি নিজে বঁটি
দিয়ে ওর গলা কেটে দিয়ে এসেছি।মনিকাকেও যদি এইভাবে নিজের
হাতে...... যাক গে । '
সুব্রত পাথর হয়ে রইল।
আরতি বলল, 'এখন মাংস খাও । মাছটা বরং রাতে খেয়ো ।'
সুব্রত মাথা নিচু করে
মাছের বাটির দিকে হাত বাড়ালো।
'মাংসটা কি তালে
রাতের জন্য রেখে দেবো? '
ওই মাংসের বাটির মধ্যে যে
আরতির প্রতিবাদ আর প্রতিশোধ এক হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারল সুব্রত । সে জানে ওই মাংস সে খেতে পারলেও হজম করতে পারবেনা । তাই জবাব দিল, 'না । আমার জন্য
রাখার দরকার নেই।'
0 মন্তব্যসমূহ